শাহরীনা আখতার
নোনা বাতাস আর মাটির গভীরে জমে থাকা লবণ, এটাই বাংলাদেশের উপকূলের প্রতিদিনের বাস্তবতা। কিন্তু এই কঠিন বাস্তবতার মাঝেই গড়ে উঠেছে সংগ্রামের এক অনন্য সংস্কৃতি, যেখানে জলই শুধু সংকট নয়, সম্ভাবনাও। পানির ওপর ভাসমান বাগান, চিংড়িঘেরে মাছের সঙ্গে হাঁস-মুরগির সহাবস্থান, নারীর হাতে উৎপাদনের দায়িত্ব আর তরুণের হাতে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ, এটাই এখন উপকূলীয় কৃষির নতুন পরিচয়। জলবায়ু পরিবর্তন বদলে দিয়েছে মাটি, পেশা ও জীবনযাত্রা, কিন্তু বদলাতে পারেনি উপকূলবাসীর সাহস। তারা প্রতিদিন লড়ছে লবণাক্ততা, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের বিরুদ্ধে, আর গড়ে তুলছে অভিযোজনের এক নিরব বিপ্লব। বিজ্ঞান, উদ্ভাবন এবং মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে গড়ে উঠছে একটি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জলবায়ু-সহনশীল উপকূল, যা জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হতে পারে। উপকূলের সম্ভাবনা বনাম সংকট : বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা এবং প্রায় ১ লাখ বর্গকিলোমিটার বিশাল সমুদ্রসীমা দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপকূলীয় অঞ্চল শুধু প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও কৃষি সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু নয়, বরং দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের আয়ের মূল উৎস। এখানে মৎস্য, কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও পর্যটন খাত উন্নয়নের জন্য অপরিসীম সুযোগ রয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততার বিস্তার, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন ও খরাপ্রবণতা ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। জমির উর্বরতা কমে যাওয়ায় কৃষকরা লবণ সহনশীল নতুন ধান, সবজি ও ফলের জাত চাষে ঝুঁকি নিয়েছেন। সরকার, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে উপকূলীয়
কৃষিকে টেকসই ও অভিযোজন সক্ষম করতে কাজ করছে। বিশেষ করে ভাসমান বাগান, সমন্বিত কৃষি-পশুপালন ও প্রযুক্তিভিত্তিক মনিটরিংয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, যা উপকূলবাসীর জীবনমান ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। মৎস্য খাতে উত্থান ও ভবিষ্যৎ ভাবনা : ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ৪.৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে, যা দেশের মৎস্য খাতের শক্তিশালী অগ্রগতি নির্দেশ করে। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক খামার ব্যবস্থাপনা, চাষকৃত মাছের বৃদ্ধি এবং মাছচাষিদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ভূমিকা। যদিও মৎস্য খাতের অবদান সামগ্রিক জাতীয় জিডিপিতে সামান্য কমে ২.৪১ শতাংশ হয়েছে, কৃষি জিডিপিতে এটি এখনও ২১.৮৩ শতাংশ। প্রায় ১.৯ কোটি মানুষ এই খাতে জড়িত, যেখানে নারীরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন। বিশ্বব্যাংক ও টঝঅওউ-এর সহায়তায় মৎস্যজীবীদের ফিশিং ভেসেল লাইসেন্সের সংখ্যা পাঁচগুণ বেড়েছে এবং ইলিশ মাছ সংরক্ষণের জন্য সমুদ্রের ৩১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ‘সমুদ্র সংরক্ষিত অঞ্চল’ ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও, উপকূলীয় মাছ প্রজাতির প্রায় ২৮ শতাংশ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এই হুমকির মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক তথ্যনির্ভর মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। ভাসমান বাগান ও লবণ সহনশীল কৃষির অগ্রযাত্রা : বাউড়া বা ভাসমান বাগান উপকূলের মানুষের এক অনন্য উদ্ভাবন, যা জলাবদ্ধ ও লবণাক্ত জমিতে সবজি উৎপাদনের নতুন পথ দেখিয়েছে। কচুরিপানা দিয়ে তৈরি এ প্রযুক্তিকে ঋঅঙ একটি গ্লোবাল অ্যাগ্রিকালচারাল হেরিটেজ সিস্টেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। টঘউচ ও চৎধপঃরপধষ অপঃরড়হ-এর সহায়তায় বহু নারী ও ভূমিহীন কৃষক পরিবার এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বছরে প্রায় ৮-৯ মাস শাকসবজি উৎপাদন করে খাদ্য নিরাপত্তা ও আয় নিশ্চিত করছে। অন্যদিকে, ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈবহঃবৎ ভড়ৎ ইরড়ংধষরহব অমৎরপঁষঃঁৎব (ওঈইঅ) ও টঘউচ-এর নেতৃত্বে চালু হওয়া লবণ সহনশীল ধান, সবজি ও সমন্বিত চাষ পদ্ধতি উপকূলের আটটি জেলায় প্রায় ২৩০০ পরিবারের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। ধান, মাছ ও হাঁসের সমন্বিত চাষ কৃষকের পুষ্টি ও আয়, দুই ক্ষেত্রেই উন্নতি সাধন করছে। স্থানীয় কৃষক হানিফ বলেন, ‘আগে শুধু চিংড়ি ছিল, এখন ঘেরে মাছ, পাড়ে সবজি আর হাঁস, সব মিলিয়ে আয় বেড়েছে, খাবারও নিশ্চিত।’ এই উদ্ভাবনগুলো জলবায়ু সহনশীল কৃষির দিকেই দেশের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করছে। প্রাণিসম্পদে উদ্ভাবনী গবেষণা : বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইখজও) উদ্ভাবন করেছে লিঙ্গ নির্ধারণযোগ্য মুরগি, মোরিঙ্গাভিত্তিক গরুর খাদ্য এবং প্রাণিসম্পদের জন্য কার্যকর টিকা। অঈওঅজ ও কেজিএফ-এর সহায়তায় মাছ ও চিংড়ির বর্জ্য দিয়ে গবাদিপশুর খাদ্য তৈরির গবেষণা চলছে, যা ‘সার্কুলার ইকোনমি’ বাস্তবায়নে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। একইসঙ্গে টঘওউঙ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মনিটরিং, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং পরিবেশবান্ধব খামার ব্যবস্থাপনায়। এই সমন্বিত উদ্যোগগুলো উপকূলীয় কৃষিকে প্রযুক্তিনির্ভর, নিরাপদ ও টেকসই করে তুলছে। অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের আন্তঃসম্পর্ক : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি ও মৎস্য খাতে প্রায় ৮৫% মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন থেকে বছরে আয় হয় প্রায় ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। কিন্তু পরিবেশ দূষণ, লবণাক্ততার বিস্তার ও
জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় ধীরে ধীরে হুমকিতে ফেলছে মাছ, বনজ সম্পদ ও মানুষের জীবনযাত্রা। মৃত্তিকা গবেষণায় ১৬২টি উপকূলীয় স্থানে লবণমাত্রা ০.০৫ থেকে ৯.০৯ সঝ/পস-এর মধ্যে পাওয়া গেছে, যা অঞ্চলভিত্তিক চাষ পরিকল্পনা ও অভিযোজন কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এই বৈজ্ঞানিক তথ্য এখন টেকসই কৃষি ও জলবায়ু সহনশীল উৎপাদন পদ্ধতির জন্য দিকনির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গবেষণায় নতুন নির্দেশনা ও সুযোগ : উপকূলীয় এলাকায় লবণ-সহনশীল গবাদিপশু, বিশেষত হাঁস-মুরগি ও ছাগল নিয়ে গবেষণা এখনো সীমিত পর্যায়ে রয়েছে, যদিও এগুলো কৃষকের আয়ের মূল ভরসা হতে পারে। ঝিনুক ও কাঁকড়া জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী এবং সামুদ্রিক শৈবাল চাষে বায়োটেকনোলজির প্রয়োগ বাড়িয়ে উপকূলীয় অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করা সম্ভব। এদিকে, আইওটিভিত্তিক সিদ্ধান্ত সহায়ক প্রযুক্তি, সেন্সর, রোগ সতর্কবার্তা ব্যবস্থা এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন উপকূলীয় কৃষিকে আরও বুদ্ধিদীপ্ত ও জলবায়ু-সহনশীল অভিযোজনের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে পারে। নারী নেতৃত্বাধীন খামার মডেল, তরুণ উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ব্লু-কার্বন ক্রেডিট ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও, তা এখনো কাক্সিক্ষত মাত্রায় কাজে লাগানো হয়নি। ব্লু-কার্বন ক্রেডিটের মাধ্যমে পুনঃউৎপাদনশীল ম্যানগ্রোভ বন, ঘের ও সামুদ্রিক শৈবাল চাষ থেকে কার্বন বাণিজ্যের সুযোগ রয়েছে। এসব খাতে সমন্বিত গবেষণা, প্রযুক্তি সহায়তা ও নীতিগত সহায়তা জরুরি। আন্তর্জাতিক অর্থায়নের প্রস্তুত কাঠামো : এসডিজি ২ (ক্ষুধামুক্তি ও টেকসই কৃষি), এসডিজি ৫ (জেন্ডার সমতা), এসডিজি ১৩ (জলবায়ু কর্ম) ও এসডিজি ১৪ (জলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষা) লক্ষ্যের সঙ্গে জাতিসংঘের ওশেন সায়েন্স ডেকেড ও ব্লু-ইকোনোমি ফ্রেমওয়ার্ককে সমন্বয় করে বাংলাদেশের উপকূলীয় কৃষি উদ্যোগকে পরিকল্পিত ও লক্ষ্যভিত্তিকভাবে পরিচালনা করলে গ্লোবাল ক্লাইমেট ফান্ড (এঈঋ), আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ওঋঅউ), বিশ্বব্যাংক, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (এঊঋ) ও প্রাইভেট সেক্টর থেকে যথেষ্ট অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ডেটাভিত্তিক মানচিত্র, উচ্চস্তরের জলবায়ু পূর্বাভাস, বাজার বিশ্লেষণ ও র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়ালভিত্তিক (জঈঞ) পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণসহিষ্ণু ফসলের সফল চাষ-পদ্ধতির তথ্য সংগ্রহ এবং তার আঞ্চলিক প্রভাবের মূল্যায়ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর বিশ্বাস ও অর্থায়ন বাড়াবে।
এই ধরনের প্রমাণভিত্তিক ও সুসংগঠিত উদ্যোগ উপকূলীয় কৃষির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এবং বৈশ্বিক জলবায়ু ও সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে উপকূল : বাংলাদেশের উপকূলীয় কৃষি এখন এক সংকট ও সম্ভাবনার মোড় ঘুরিয়েছে।
টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অবিলম্বে সরকারের, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমন্বিত ও সক্রিয় ভূমিকা। নারী ও তরুণদের সম্পূর্ণ ক্ষমতায়ন এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে উপকূলীয় কৃষি ও মৎস্য খাতের জন্য সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় শুধু প্রযুক্তি নয়, সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। তাই সব স্তরের মানুষকে একত্রিত হয়ে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু অভিযোজনের সফল রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
[লেখক : টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ও রিসার্চ অ্যাডভাইজার, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]
শাহরীনা আখতার
শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
নোনা বাতাস আর মাটির গভীরে জমে থাকা লবণ, এটাই বাংলাদেশের উপকূলের প্রতিদিনের বাস্তবতা। কিন্তু এই কঠিন বাস্তবতার মাঝেই গড়ে উঠেছে সংগ্রামের এক অনন্য সংস্কৃতি, যেখানে জলই শুধু সংকট নয়, সম্ভাবনাও। পানির ওপর ভাসমান বাগান, চিংড়িঘেরে মাছের সঙ্গে হাঁস-মুরগির সহাবস্থান, নারীর হাতে উৎপাদনের দায়িত্ব আর তরুণের হাতে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ, এটাই এখন উপকূলীয় কৃষির নতুন পরিচয়। জলবায়ু পরিবর্তন বদলে দিয়েছে মাটি, পেশা ও জীবনযাত্রা, কিন্তু বদলাতে পারেনি উপকূলবাসীর সাহস। তারা প্রতিদিন লড়ছে লবণাক্ততা, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের বিরুদ্ধে, আর গড়ে তুলছে অভিযোজনের এক নিরব বিপ্লব। বিজ্ঞান, উদ্ভাবন এবং মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে গড়ে উঠছে একটি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জলবায়ু-সহনশীল উপকূল, যা জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হতে পারে। উপকূলের সম্ভাবনা বনাম সংকট : বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা এবং প্রায় ১ লাখ বর্গকিলোমিটার বিশাল সমুদ্রসীমা দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপকূলীয় অঞ্চল শুধু প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও কৃষি সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু নয়, বরং দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের আয়ের মূল উৎস। এখানে মৎস্য, কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও পর্যটন খাত উন্নয়নের জন্য অপরিসীম সুযোগ রয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততার বিস্তার, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন ও খরাপ্রবণতা ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। জমির উর্বরতা কমে যাওয়ায় কৃষকরা লবণ সহনশীল নতুন ধান, সবজি ও ফলের জাত চাষে ঝুঁকি নিয়েছেন। সরকার, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে উপকূলীয়
কৃষিকে টেকসই ও অভিযোজন সক্ষম করতে কাজ করছে। বিশেষ করে ভাসমান বাগান, সমন্বিত কৃষি-পশুপালন ও প্রযুক্তিভিত্তিক মনিটরিংয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, যা উপকূলবাসীর জীবনমান ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। মৎস্য খাতে উত্থান ও ভবিষ্যৎ ভাবনা : ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ৪.৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে, যা দেশের মৎস্য খাতের শক্তিশালী অগ্রগতি নির্দেশ করে। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক খামার ব্যবস্থাপনা, চাষকৃত মাছের বৃদ্ধি এবং মাছচাষিদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ভূমিকা। যদিও মৎস্য খাতের অবদান সামগ্রিক জাতীয় জিডিপিতে সামান্য কমে ২.৪১ শতাংশ হয়েছে, কৃষি জিডিপিতে এটি এখনও ২১.৮৩ শতাংশ। প্রায় ১.৯ কোটি মানুষ এই খাতে জড়িত, যেখানে নারীরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন। বিশ্বব্যাংক ও টঝঅওউ-এর সহায়তায় মৎস্যজীবীদের ফিশিং ভেসেল লাইসেন্সের সংখ্যা পাঁচগুণ বেড়েছে এবং ইলিশ মাছ সংরক্ষণের জন্য সমুদ্রের ৩১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ‘সমুদ্র সংরক্ষিত অঞ্চল’ ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও, উপকূলীয় মাছ প্রজাতির প্রায় ২৮ শতাংশ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এই হুমকির মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক তথ্যনির্ভর মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। ভাসমান বাগান ও লবণ সহনশীল কৃষির অগ্রযাত্রা : বাউড়া বা ভাসমান বাগান উপকূলের মানুষের এক অনন্য উদ্ভাবন, যা জলাবদ্ধ ও লবণাক্ত জমিতে সবজি উৎপাদনের নতুন পথ দেখিয়েছে। কচুরিপানা দিয়ে তৈরি এ প্রযুক্তিকে ঋঅঙ একটি গ্লোবাল অ্যাগ্রিকালচারাল হেরিটেজ সিস্টেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। টঘউচ ও চৎধপঃরপধষ অপঃরড়হ-এর সহায়তায় বহু নারী ও ভূমিহীন কৃষক পরিবার এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বছরে প্রায় ৮-৯ মাস শাকসবজি উৎপাদন করে খাদ্য নিরাপত্তা ও আয় নিশ্চিত করছে। অন্যদিকে, ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈবহঃবৎ ভড়ৎ ইরড়ংধষরহব অমৎরপঁষঃঁৎব (ওঈইঅ) ও টঘউচ-এর নেতৃত্বে চালু হওয়া লবণ সহনশীল ধান, সবজি ও সমন্বিত চাষ পদ্ধতি উপকূলের আটটি জেলায় প্রায় ২৩০০ পরিবারের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। ধান, মাছ ও হাঁসের সমন্বিত চাষ কৃষকের পুষ্টি ও আয়, দুই ক্ষেত্রেই উন্নতি সাধন করছে। স্থানীয় কৃষক হানিফ বলেন, ‘আগে শুধু চিংড়ি ছিল, এখন ঘেরে মাছ, পাড়ে সবজি আর হাঁস, সব মিলিয়ে আয় বেড়েছে, খাবারও নিশ্চিত।’ এই উদ্ভাবনগুলো জলবায়ু সহনশীল কৃষির দিকেই দেশের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করছে। প্রাণিসম্পদে উদ্ভাবনী গবেষণা : বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইখজও) উদ্ভাবন করেছে লিঙ্গ নির্ধারণযোগ্য মুরগি, মোরিঙ্গাভিত্তিক গরুর খাদ্য এবং প্রাণিসম্পদের জন্য কার্যকর টিকা। অঈওঅজ ও কেজিএফ-এর সহায়তায় মাছ ও চিংড়ির বর্জ্য দিয়ে গবাদিপশুর খাদ্য তৈরির গবেষণা চলছে, যা ‘সার্কুলার ইকোনমি’ বাস্তবায়নে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। একইসঙ্গে টঘওউঙ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মনিটরিং, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং পরিবেশবান্ধব খামার ব্যবস্থাপনায়। এই সমন্বিত উদ্যোগগুলো উপকূলীয় কৃষিকে প্রযুক্তিনির্ভর, নিরাপদ ও টেকসই করে তুলছে। অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের আন্তঃসম্পর্ক : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি ও মৎস্য খাতে প্রায় ৮৫% মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন থেকে বছরে আয় হয় প্রায় ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। কিন্তু পরিবেশ দূষণ, লবণাক্ততার বিস্তার ও
জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় ধীরে ধীরে হুমকিতে ফেলছে মাছ, বনজ সম্পদ ও মানুষের জীবনযাত্রা। মৃত্তিকা গবেষণায় ১৬২টি উপকূলীয় স্থানে লবণমাত্রা ০.০৫ থেকে ৯.০৯ সঝ/পস-এর মধ্যে পাওয়া গেছে, যা অঞ্চলভিত্তিক চাষ পরিকল্পনা ও অভিযোজন কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এই বৈজ্ঞানিক তথ্য এখন টেকসই কৃষি ও জলবায়ু সহনশীল উৎপাদন পদ্ধতির জন্য দিকনির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গবেষণায় নতুন নির্দেশনা ও সুযোগ : উপকূলীয় এলাকায় লবণ-সহনশীল গবাদিপশু, বিশেষত হাঁস-মুরগি ও ছাগল নিয়ে গবেষণা এখনো সীমিত পর্যায়ে রয়েছে, যদিও এগুলো কৃষকের আয়ের মূল ভরসা হতে পারে। ঝিনুক ও কাঁকড়া জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী এবং সামুদ্রিক শৈবাল চাষে বায়োটেকনোলজির প্রয়োগ বাড়িয়ে উপকূলীয় অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করা সম্ভব। এদিকে, আইওটিভিত্তিক সিদ্ধান্ত সহায়ক প্রযুক্তি, সেন্সর, রোগ সতর্কবার্তা ব্যবস্থা এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন উপকূলীয় কৃষিকে আরও বুদ্ধিদীপ্ত ও জলবায়ু-সহনশীল অভিযোজনের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে পারে। নারী নেতৃত্বাধীন খামার মডেল, তরুণ উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ব্লু-কার্বন ক্রেডিট ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও, তা এখনো কাক্সিক্ষত মাত্রায় কাজে লাগানো হয়নি। ব্লু-কার্বন ক্রেডিটের মাধ্যমে পুনঃউৎপাদনশীল ম্যানগ্রোভ বন, ঘের ও সামুদ্রিক শৈবাল চাষ থেকে কার্বন বাণিজ্যের সুযোগ রয়েছে। এসব খাতে সমন্বিত গবেষণা, প্রযুক্তি সহায়তা ও নীতিগত সহায়তা জরুরি। আন্তর্জাতিক অর্থায়নের প্রস্তুত কাঠামো : এসডিজি ২ (ক্ষুধামুক্তি ও টেকসই কৃষি), এসডিজি ৫ (জেন্ডার সমতা), এসডিজি ১৩ (জলবায়ু কর্ম) ও এসডিজি ১৪ (জলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষা) লক্ষ্যের সঙ্গে জাতিসংঘের ওশেন সায়েন্স ডেকেড ও ব্লু-ইকোনোমি ফ্রেমওয়ার্ককে সমন্বয় করে বাংলাদেশের উপকূলীয় কৃষি উদ্যোগকে পরিকল্পিত ও লক্ষ্যভিত্তিকভাবে পরিচালনা করলে গ্লোবাল ক্লাইমেট ফান্ড (এঈঋ), আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ওঋঅউ), বিশ্বব্যাংক, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (এঊঋ) ও প্রাইভেট সেক্টর থেকে যথেষ্ট অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ডেটাভিত্তিক মানচিত্র, উচ্চস্তরের জলবায়ু পূর্বাভাস, বাজার বিশ্লেষণ ও র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়ালভিত্তিক (জঈঞ) পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণসহিষ্ণু ফসলের সফল চাষ-পদ্ধতির তথ্য সংগ্রহ এবং তার আঞ্চলিক প্রভাবের মূল্যায়ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর বিশ্বাস ও অর্থায়ন বাড়াবে।
এই ধরনের প্রমাণভিত্তিক ও সুসংগঠিত উদ্যোগ উপকূলীয় কৃষির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এবং বৈশ্বিক জলবায়ু ও সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে উপকূল : বাংলাদেশের উপকূলীয় কৃষি এখন এক সংকট ও সম্ভাবনার মোড় ঘুরিয়েছে।
টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অবিলম্বে সরকারের, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমন্বিত ও সক্রিয় ভূমিকা। নারী ও তরুণদের সম্পূর্ণ ক্ষমতায়ন এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে উপকূলীয় কৃষি ও মৎস্য খাতের জন্য সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় শুধু প্রযুক্তি নয়, সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। তাই সব স্তরের মানুষকে একত্রিত হয়ে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু অভিযোজনের সফল রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
[লেখক : টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ও রিসার্চ অ্যাডভাইজার, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]