মোহাম্মদ আবু নোমান
গত ১৯ জুন সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ‘সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থ গত এক বছরে বেড়েছে ৩৩ গুণ।’
অন্যদিকে গত ১৫ মে কুমিল্লার শিল্পকলা একাডেমিতে বিএনপির সদস্য ফরম বিতরণ ও সদস্য নবায়ন অনুষ্ঠানে মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, ‘গত ৮ মাসে ৯০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।’ দুটোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা বুঝতে পারছি না। বিষয়টি পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিলাম।
সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের আগে নানারকম শঙ্কা বিরাজ করায় দেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি ছাড়াও সমাজের বড়মাপের কালোটাকার মালিকরা অর্থ পাচারের চিন্তা করে। ২০২৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছে তা ছিল- ‘আমি-তুমি আর ডামির’ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হারজিত নিয়ে এমন কোনো শঙ্কা ছিল না যে, নির্বাচনে হারলে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বছরে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ ফ্র্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৮ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে যা ছিল ২৬৫ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে কারা এই টাকা সুইস ব্যাংকে জমা রেখেছে সেই তথ্য ওই প্রতিবেদনে নেই। যদিও সুইস ব্যাংক কোনো আমানতকারীর তথ্য কখনো প্রকাশ করে না।
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্বর্তী সরকার যখন বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তখন সুইস ব্যাংকের এমন তথ্য খুবই উদ্বেগের। আমরা মনে করি সুশাসনের অভাব এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করায় টাকা পাচারের লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। সরকার বদলের পর পাচার রোধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও সুইস ব্যাংকে এক লাফে বাংলাদেশিদের এত অর্থ বৃদ্ধির ঘটনা পাচার বন্ধের নিশ্চয়তা দেয় কী?
সুইস ব্যাংকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১০৮টি দেশ ‘অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই)’ চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং পাকিস্তানও এই চুক্তির আওতায় রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আওয়ামী সরকার এত কিছু করলেও উক্ত চুক্তি কেন করলো না? আর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারো কেন চুক্তিতে যুক্ত হচ্ছে না?
বোদ্ধামহলের মনে থাকার কথা, ২০২২ সালের ১০ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে তখনকার ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড বলেছিলেন, ‘সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধ পথে আয় করা বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য তথ্য চায়নি।’
সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত স্বীকার করেছিলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের সুইস ব্যাংকে জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধ পথে আয় করা। তাহলে বলাই যায়, সুইস ব্যাংক তাদের পৃষ্ঠপোষক! তৃতীয় বিশ্বের বড়-বড় চোরেরা তাদের মক্কেল। নানা চাতুরির মাধ্যমে তারা তৃতীয় বিশ্বের রক্তঝড়ানো অর্থ লালন-পালন করছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বড় ধরনের জমাকারীর জমার উৎস এবং ডকুমেন্ট হিসেবে ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্নের কপি চেয়ে থাকে। আর তারা সভ্য জগতে বাস করে এটা করে না, তা মানা যায় কী?
বাংলাদেশ সরকার সুইস ব্যাংকের কাছে তথ্য চায়নি মানলাম; কিন্তু আপনারা জমা রাখার সময় কেন এসব টাকার উৎস সম্পর্কে তথ্য চান না? চুরি, ডাকাতি, লুটপাটের টাকা, না সাদা টাকা, এটুকু যাচাই করার নৈতিক সততা কেন আপনাদের নেই? সুইস ব্যাংকের এই উদার নীতির কারণেই দেশে দেশে লুটেরা পয়দা হচ্ছে নাতো?
ওই দিনের অনুষ্ঠানে সুইস রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড আরও বলেছিলেন, ‘সুইস ব্যাংক সে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ১০ শতাংশের এত অবদান রেখে থাকে।’ এটা অনেক বড় ও বিস্ময়ের ব্যাপার! এভাবে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও যদি ব্যাংক পয়দা করে টাকার উপার্জনের উৎস যাচাই-বাচাই না করে রাখা শুরু করে, তাহলে বিশ্বের অবস্থা কী হবে? মানুষের রক্ত চোষা সরকারি, বেসরকারি, দুর্নীতিবাজদের টাকা থেকে অর্থনীতিতে ১০ ভাগ অবদান কিভাবে চলতে পারে! সুইজারল্যান্ডের এত একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুখী ও শান্তিপ্রিয় দেশ কী করে দুর্নীতিবাজদের অর্থ রাখে!
সুইজারল্যান্ড বিশ্বের মধ্যে শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র হলেও এমন একটি ব্যাংকিং সিস্টেম তৈরি করেছে, যেখানে পৃথিবীর সব বড় বড় চোর, বদমাইশ, ক্রিমিনাল, দুর্নীতিবাজ, ড্রাগডিলার, আর্মস ডিলার, ট্যাক্স ফাঁকিবাজরা নিরাপদে তাদের টাকা লুকিয়ে রাখে। সেই টাকা দিয়ে সুইজারল্যান্ড বাণিজ্য করে থাকে। সুইজারল্যান্ড কি পারে না, এই চোর বদমাইশগুলোর খবর প্রকাশ করে দিতে? কিন্তু করে না বলেই আমাদের উইকিলিকস, পানামা পেপার ইত্যাদির কাছ থেকে গোপন খবর জানতে হয়। সুইজারল্যান্ড যদি এসব মহাচোরদের লুকায়িত সম্পদের হিসাব এবং নাম-ঠিকানা তাদের নিজ নিজ সরকারের চাহিদা এত দিয়ে দিত, তাহলে বিশ্বের দুর্নীতি অনেকাংশে নির্মূল হয়ে যেত। সুইস ব্যাংক শব্দটাই কিংবা উইকিলিকস, পানামা পেপার এগুলোর নাম আমরা জানতামও না।
ক্রমবর্ধমান অর্থপাচার বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ যে গগনচুম্বী, এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। একইভাবে কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের অর্থ পাচারের বেশির ভাগ সংঘটিত হয় আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ভয়েসিং), হুন্ডি এবং ভিওআইপির মাধ্যমেÑ যার ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক কর ফাঁকি সংঘটিত হচ্ছে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এছাড়া বড় বড় ঘুষ লেনদেন হয় দেশের বাইরে ডলারে, যা পাচারকৃত টাকার অংশ। গত কয়েক বছরে সরাসরি বিদেশে লাগেজ ভর্তি করে ডলার নিয়ে যাওয়ার তথ্যও বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা দেখেছি।
দেশের আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়নে শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা গত ৫ বছরে দেয়া দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। আলোচ্য সময়ে প্রতি বছর পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরের পাচারের অর্থ দিয়েই ৭৮টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব।
শুধু সুইস ব্যাংক নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের তথ্য দেখা যায়। বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির। এতে প্রমাণিত হয় দেশে দুর্নীতি ও চোরের সংখ্যা ৩৩ গুণ বেড়েছে বলেই অর্থপাচারও বেড়েছে। আমরা মনে করি পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী]
মোহাম্মদ আবু নোমান
শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
গত ১৯ জুন সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ‘সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থ গত এক বছরে বেড়েছে ৩৩ গুণ।’
অন্যদিকে গত ১৫ মে কুমিল্লার শিল্পকলা একাডেমিতে বিএনপির সদস্য ফরম বিতরণ ও সদস্য নবায়ন অনুষ্ঠানে মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, ‘গত ৮ মাসে ৯০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।’ দুটোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা বুঝতে পারছি না। বিষয়টি পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিলাম।
সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের আগে নানারকম শঙ্কা বিরাজ করায় দেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি ছাড়াও সমাজের বড়মাপের কালোটাকার মালিকরা অর্থ পাচারের চিন্তা করে। ২০২৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছে তা ছিল- ‘আমি-তুমি আর ডামির’ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হারজিত নিয়ে এমন কোনো শঙ্কা ছিল না যে, নির্বাচনে হারলে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বছরে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ ফ্র্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৮ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে যা ছিল ২৬৫ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে কারা এই টাকা সুইস ব্যাংকে জমা রেখেছে সেই তথ্য ওই প্রতিবেদনে নেই। যদিও সুইস ব্যাংক কোনো আমানতকারীর তথ্য কখনো প্রকাশ করে না।
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্বর্তী সরকার যখন বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তখন সুইস ব্যাংকের এমন তথ্য খুবই উদ্বেগের। আমরা মনে করি সুশাসনের অভাব এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করায় টাকা পাচারের লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। সরকার বদলের পর পাচার রোধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও সুইস ব্যাংকে এক লাফে বাংলাদেশিদের এত অর্থ বৃদ্ধির ঘটনা পাচার বন্ধের নিশ্চয়তা দেয় কী?
সুইস ব্যাংকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১০৮টি দেশ ‘অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই)’ চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং পাকিস্তানও এই চুক্তির আওতায় রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আওয়ামী সরকার এত কিছু করলেও উক্ত চুক্তি কেন করলো না? আর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারো কেন চুক্তিতে যুক্ত হচ্ছে না?
বোদ্ধামহলের মনে থাকার কথা, ২০২২ সালের ১০ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে তখনকার ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড বলেছিলেন, ‘সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধ পথে আয় করা বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য তথ্য চায়নি।’
সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত স্বীকার করেছিলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের সুইস ব্যাংকে জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধ পথে আয় করা। তাহলে বলাই যায়, সুইস ব্যাংক তাদের পৃষ্ঠপোষক! তৃতীয় বিশ্বের বড়-বড় চোরেরা তাদের মক্কেল। নানা চাতুরির মাধ্যমে তারা তৃতীয় বিশ্বের রক্তঝড়ানো অর্থ লালন-পালন করছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বড় ধরনের জমাকারীর জমার উৎস এবং ডকুমেন্ট হিসেবে ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্নের কপি চেয়ে থাকে। আর তারা সভ্য জগতে বাস করে এটা করে না, তা মানা যায় কী?
বাংলাদেশ সরকার সুইস ব্যাংকের কাছে তথ্য চায়নি মানলাম; কিন্তু আপনারা জমা রাখার সময় কেন এসব টাকার উৎস সম্পর্কে তথ্য চান না? চুরি, ডাকাতি, লুটপাটের টাকা, না সাদা টাকা, এটুকু যাচাই করার নৈতিক সততা কেন আপনাদের নেই? সুইস ব্যাংকের এই উদার নীতির কারণেই দেশে দেশে লুটেরা পয়দা হচ্ছে নাতো?
ওই দিনের অনুষ্ঠানে সুইস রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড আরও বলেছিলেন, ‘সুইস ব্যাংক সে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ১০ শতাংশের এত অবদান রেখে থাকে।’ এটা অনেক বড় ও বিস্ময়ের ব্যাপার! এভাবে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও যদি ব্যাংক পয়দা করে টাকার উপার্জনের উৎস যাচাই-বাচাই না করে রাখা শুরু করে, তাহলে বিশ্বের অবস্থা কী হবে? মানুষের রক্ত চোষা সরকারি, বেসরকারি, দুর্নীতিবাজদের টাকা থেকে অর্থনীতিতে ১০ ভাগ অবদান কিভাবে চলতে পারে! সুইজারল্যান্ডের এত একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুখী ও শান্তিপ্রিয় দেশ কী করে দুর্নীতিবাজদের অর্থ রাখে!
সুইজারল্যান্ড বিশ্বের মধ্যে শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র হলেও এমন একটি ব্যাংকিং সিস্টেম তৈরি করেছে, যেখানে পৃথিবীর সব বড় বড় চোর, বদমাইশ, ক্রিমিনাল, দুর্নীতিবাজ, ড্রাগডিলার, আর্মস ডিলার, ট্যাক্স ফাঁকিবাজরা নিরাপদে তাদের টাকা লুকিয়ে রাখে। সেই টাকা দিয়ে সুইজারল্যান্ড বাণিজ্য করে থাকে। সুইজারল্যান্ড কি পারে না, এই চোর বদমাইশগুলোর খবর প্রকাশ করে দিতে? কিন্তু করে না বলেই আমাদের উইকিলিকস, পানামা পেপার ইত্যাদির কাছ থেকে গোপন খবর জানতে হয়। সুইজারল্যান্ড যদি এসব মহাচোরদের লুকায়িত সম্পদের হিসাব এবং নাম-ঠিকানা তাদের নিজ নিজ সরকারের চাহিদা এত দিয়ে দিত, তাহলে বিশ্বের দুর্নীতি অনেকাংশে নির্মূল হয়ে যেত। সুইস ব্যাংক শব্দটাই কিংবা উইকিলিকস, পানামা পেপার এগুলোর নাম আমরা জানতামও না।
ক্রমবর্ধমান অর্থপাচার বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ যে গগনচুম্বী, এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। একইভাবে কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের অর্থ পাচারের বেশির ভাগ সংঘটিত হয় আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ভয়েসিং), হুন্ডি এবং ভিওআইপির মাধ্যমেÑ যার ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক কর ফাঁকি সংঘটিত হচ্ছে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এছাড়া বড় বড় ঘুষ লেনদেন হয় দেশের বাইরে ডলারে, যা পাচারকৃত টাকার অংশ। গত কয়েক বছরে সরাসরি বিদেশে লাগেজ ভর্তি করে ডলার নিয়ে যাওয়ার তথ্যও বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা দেখেছি।
দেশের আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়নে শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা গত ৫ বছরে দেয়া দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। আলোচ্য সময়ে প্রতি বছর পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরের পাচারের অর্থ দিয়েই ৭৮টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব।
শুধু সুইস ব্যাংক নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের তথ্য দেখা যায়। বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির। এতে প্রমাণিত হয় দেশে দুর্নীতি ও চোরের সংখ্যা ৩৩ গুণ বেড়েছে বলেই অর্থপাচারও বেড়েছে। আমরা মনে করি পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী]