alt

উপ-সম্পাদকীয়

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

রেজাউল করিম খোকন

: শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

প্রতিটি জাতি, জনপদ বা অঞ্চল তার নিজস্ব ঐতিহ্য, প্রতীক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান বহন করে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এসব সাংস্কৃতিক চিহ্ন, স্মারক ও স্বকীয়তা একদিকে যেমন ইতিহাসের ধারক, অন্যদিকে তা হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ পরিচয়ের অনন্য দিকনির্দেশক। চট্টগ্রাম জেলার ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে এমন একটি প্রতীকী অস্তিত্বের নাম সাম্পান।

সাম্পান শুধু একটি নৌযান নয়, এটি এক জীবন্ত সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের আদি জনপদের জীবন-জীবিকা, লোকজ শিল্প, ভাষা, সংগীত, সংস্কার ও সৌন্দর্যবোধের এক অভিন্ন প্রকাশ এই সাম্পান। এটি একদিকে কর্ণফুলী, হালদা, শঙ্খ, মাতামুহুরি কিংবা চানখালির জলস্রোতের সঙ্গী, আবার অন্যদিকে চট্টগ্রামের লোককাহিনী, গান, চিত্রকলায়ও এক অনুপম অনুষঙ্গ।

সাম্পান চালানোর সময় মাঝিরা দাঁড়িয়ে যেভাবে হালিশে চাপ দেয়, তার ফলে বেত ও কাঠের সংঘর্ষে যে ধ্বনি উৎপন্ন হয়Ñ‘ক্যা কোরত, ক্যা কোরত’, তা শুধুই শব্দ নয়, এক ঐতিহ্যবাহী শ্রুতি-চিহ্ন। এটি রাতের নদীজীবনে দিক নির্দেশ করে, মানুষের প্রতীক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি বহন করে।

এই শব্দ চট্টগ্রামের মানুষকে বলে দেয় সাম্পান আসছে, যাত্রা শুরু হবে, হয়তো বাড়ি ফেরা কিংবা বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত। একসময় এই ধ্বনি ছিল চট্টগ্রামের নদীপারের জীবনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী, যা আজ আধুনিক ইঞ্জিনচালিত নৌযানের বিকট আওয়াজে হারিয়ে যেতে বসেছে।

‘সাম্পান’ শব্দটি এসেছে চীনা শব্দ ‘সাং পাং’ থেকে, যার অর্থ ‘তিন মাথা’। এটি এক অভিনব নৌযান, যার গঠন-ভবনে রয়েছে সামনের একটি গলুই ও পেছনের দুটি, দেখতে অনেকটা মেষের শিংয়ের মতো। এই গঠনই একে পৃথক করেছে গ্রামবাংলার অন্যান্য নৌযান থেকে।

আঞ্চলিক ভাষায় চট্টগ্রামে এটি পরিচিত ‘সাম্মান’ নামে। বিভিন্ন ভাষায় এর ভিন্ন নাম রয়েছে : বর্মী ভাষায় ‘থাম্মান’, জাপানি ভাষায় ‘জুমপেন’, মালয় ভাষায় ‘সামপেন’। এই বহুভাষিক উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে সাম্পান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক প্রাচীন ও বিস্তৃত নৌযান ঐতিহ্যের অংশ।

সাম্পান সাধারণত বইলাম, গর্জন, চাপালিশ, গামারি, কড়ই বা সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। বড় সাম্পানগুলোর গায়ে থাকে মাস্তুল বা ‘মসকুর’, যাতে পাল খাটানো হয়। কখনো তিন কোণা একটি ‘জীপ সর’ পালও ব্যবহৃত হয়। একটি ছোট সাম্পানে বসতে পারে ১২-১৫ জন, বড় সাম্পানে ৪০-৪৫ জন পর্যন্ত।

সাম্পান তৈরির কাজ এতটাই নিপুণ ও শ্রুতিমধুর ছিল যে, চট্টগ্রামের ফিশারিঘাট, চাক্তাই, বরকল, কোলাগাঁও, শঙ্খ নদীর পাড়সহ অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছিল সাম্পান তৈরির কারখানা। কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, রামু, চিরিঙ্গা, গুনধুম, বালুখালি, হ্নীলা অঞ্চলেও ছিল সাম্পান তৈরির কোলাহল।

একসময় সাম্পান শুধু পণ্য পরিবহনের মাধ্যম ছিল না, বরং একটি সম্পূর্ণ নদীবিপণন ব্যবস্থা। নৌবাণিজ্যের চালচিত্রে সাম্পানের ছিল নিরঙ্কুশ আধিপত্য। কর্ণফুলী নদীসহ চট্টগ্রামের নদীপথে মাছ, চাল, চিনি, খোলা, খৈল, চামড়া, কাঠ প্রভৃতি পণ্য বহনে সাম্পান ব্যবহার হতো। এমনকি দেশি-বিদেশি জাহাজের পাশে চট্টগ্রামের সাম্পানগুলো ছিল অপরিহার্য অংশ।

বর্তমানে ইঞ্জিনচালিত ফিশিং বোটের কারণে সাম্পান বিলুপ্তির পথে। একটি সাম্পান যেখানে ৫০ হাজার টাকায় তৈরি হয়, সেখানে একেকটি ফিশিং বোট তৈরিতে খরচ পড়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। চট্টগ্রামের সাম্পান কারিগররা এখন এই ফিশিং বোট নির্মাণেই নিয়োজিত।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, ভাটিয়ালি ও পল্লীগীতিতে সাম্পান এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। মোহনলাল দাশের লেখা ও শেফালী ঘোষের গাওয়াÑ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দেওয়ানা’ গানটি চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে অমর। এই গানকে ঘিরে পরবর্তীতে নির্মিত হয় সাম্পানওয়ালা চলচ্চিত্র।

ভাটিয়ালির ঘরানায় শোনা যায় :

“বাঁশখালী মইশখালী পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুড়গুড়াই চলে/

তোরা কনকন যাবি আঁর সাম্পানে/

কর্ণফুলীর মাঝি আঁই নিয়ুম ভাটি উজানে”

আরও আছে :

“কি গান মাঝি শুনাইলো, কি বাঁশি মাঝি বাজাইলো/

কর্ণফুলী সাম্পাওয়ালা আমার মন কাড়ি নিলো”

Ñএসব গানে চট্টগ্রামের সাম্পান হয়ে ওঠে প্রেম, প্রতীক্ষা ও যাত্রার রূপক।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক একাডেমি, চাটগাঁ ভাষা পরিষদসহ বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতীকে সাম্পান চিত্রিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোটি তৈরি করেছেন শিল্পাচার্য কামরুল হাসান, যার অবয়ব সাম্পানের সামনের দিকের কাঠামোকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

একসময়ের প্রাণবন্ত সাম্পান আজ বিলুপ্তির মুখে। ইঞ্জিনচালিত নৌযান, নগরায়ন, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও নদী দূষণের ফলে ছোট সাম্পান হারিয়ে যাচ্ছে। ‘ক্যা কোরত’ শব্দের স্থানে জায়গা নিচ্ছে স্যালো ইঞ্জিনের ‘গুপ গুপ’ শব্দ। শুধু শব্দ নয়, হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস, শিল্প, কারিগর, ঐতিহ্য এবং চট্টগ্রামের এক অসামান্য সাংস্কৃতিক প্রতীক।

সাম্পান এখন শুধুই স্মৃতি নয়, চট্টগ্রামের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। তার রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায় আমাদের সবার। এই নৌযান আর শুধু চট্টগ্রামের নদীপথ নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মারও বয়ে চলেছেÑএক অভিন্ন স্রোতধারায়।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ!

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

রেজাউল করিম খোকন

শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

প্রতিটি জাতি, জনপদ বা অঞ্চল তার নিজস্ব ঐতিহ্য, প্রতীক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান বহন করে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এসব সাংস্কৃতিক চিহ্ন, স্মারক ও স্বকীয়তা একদিকে যেমন ইতিহাসের ধারক, অন্যদিকে তা হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ পরিচয়ের অনন্য দিকনির্দেশক। চট্টগ্রাম জেলার ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে এমন একটি প্রতীকী অস্তিত্বের নাম সাম্পান।

সাম্পান শুধু একটি নৌযান নয়, এটি এক জীবন্ত সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের আদি জনপদের জীবন-জীবিকা, লোকজ শিল্প, ভাষা, সংগীত, সংস্কার ও সৌন্দর্যবোধের এক অভিন্ন প্রকাশ এই সাম্পান। এটি একদিকে কর্ণফুলী, হালদা, শঙ্খ, মাতামুহুরি কিংবা চানখালির জলস্রোতের সঙ্গী, আবার অন্যদিকে চট্টগ্রামের লোককাহিনী, গান, চিত্রকলায়ও এক অনুপম অনুষঙ্গ।

সাম্পান চালানোর সময় মাঝিরা দাঁড়িয়ে যেভাবে হালিশে চাপ দেয়, তার ফলে বেত ও কাঠের সংঘর্ষে যে ধ্বনি উৎপন্ন হয়Ñ‘ক্যা কোরত, ক্যা কোরত’, তা শুধুই শব্দ নয়, এক ঐতিহ্যবাহী শ্রুতি-চিহ্ন। এটি রাতের নদীজীবনে দিক নির্দেশ করে, মানুষের প্রতীক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি বহন করে।

এই শব্দ চট্টগ্রামের মানুষকে বলে দেয় সাম্পান আসছে, যাত্রা শুরু হবে, হয়তো বাড়ি ফেরা কিংবা বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত। একসময় এই ধ্বনি ছিল চট্টগ্রামের নদীপারের জীবনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী, যা আজ আধুনিক ইঞ্জিনচালিত নৌযানের বিকট আওয়াজে হারিয়ে যেতে বসেছে।

‘সাম্পান’ শব্দটি এসেছে চীনা শব্দ ‘সাং পাং’ থেকে, যার অর্থ ‘তিন মাথা’। এটি এক অভিনব নৌযান, যার গঠন-ভবনে রয়েছে সামনের একটি গলুই ও পেছনের দুটি, দেখতে অনেকটা মেষের শিংয়ের মতো। এই গঠনই একে পৃথক করেছে গ্রামবাংলার অন্যান্য নৌযান থেকে।

আঞ্চলিক ভাষায় চট্টগ্রামে এটি পরিচিত ‘সাম্মান’ নামে। বিভিন্ন ভাষায় এর ভিন্ন নাম রয়েছে : বর্মী ভাষায় ‘থাম্মান’, জাপানি ভাষায় ‘জুমপেন’, মালয় ভাষায় ‘সামপেন’। এই বহুভাষিক উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে সাম্পান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক প্রাচীন ও বিস্তৃত নৌযান ঐতিহ্যের অংশ।

সাম্পান সাধারণত বইলাম, গর্জন, চাপালিশ, গামারি, কড়ই বা সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। বড় সাম্পানগুলোর গায়ে থাকে মাস্তুল বা ‘মসকুর’, যাতে পাল খাটানো হয়। কখনো তিন কোণা একটি ‘জীপ সর’ পালও ব্যবহৃত হয়। একটি ছোট সাম্পানে বসতে পারে ১২-১৫ জন, বড় সাম্পানে ৪০-৪৫ জন পর্যন্ত।

সাম্পান তৈরির কাজ এতটাই নিপুণ ও শ্রুতিমধুর ছিল যে, চট্টগ্রামের ফিশারিঘাট, চাক্তাই, বরকল, কোলাগাঁও, শঙ্খ নদীর পাড়সহ অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছিল সাম্পান তৈরির কারখানা। কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, রামু, চিরিঙ্গা, গুনধুম, বালুখালি, হ্নীলা অঞ্চলেও ছিল সাম্পান তৈরির কোলাহল।

একসময় সাম্পান শুধু পণ্য পরিবহনের মাধ্যম ছিল না, বরং একটি সম্পূর্ণ নদীবিপণন ব্যবস্থা। নৌবাণিজ্যের চালচিত্রে সাম্পানের ছিল নিরঙ্কুশ আধিপত্য। কর্ণফুলী নদীসহ চট্টগ্রামের নদীপথে মাছ, চাল, চিনি, খোলা, খৈল, চামড়া, কাঠ প্রভৃতি পণ্য বহনে সাম্পান ব্যবহার হতো। এমনকি দেশি-বিদেশি জাহাজের পাশে চট্টগ্রামের সাম্পানগুলো ছিল অপরিহার্য অংশ।

বর্তমানে ইঞ্জিনচালিত ফিশিং বোটের কারণে সাম্পান বিলুপ্তির পথে। একটি সাম্পান যেখানে ৫০ হাজার টাকায় তৈরি হয়, সেখানে একেকটি ফিশিং বোট তৈরিতে খরচ পড়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। চট্টগ্রামের সাম্পান কারিগররা এখন এই ফিশিং বোট নির্মাণেই নিয়োজিত।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, ভাটিয়ালি ও পল্লীগীতিতে সাম্পান এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। মোহনলাল দাশের লেখা ও শেফালী ঘোষের গাওয়াÑ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দেওয়ানা’ গানটি চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে অমর। এই গানকে ঘিরে পরবর্তীতে নির্মিত হয় সাম্পানওয়ালা চলচ্চিত্র।

ভাটিয়ালির ঘরানায় শোনা যায় :

“বাঁশখালী মইশখালী পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুড়গুড়াই চলে/

তোরা কনকন যাবি আঁর সাম্পানে/

কর্ণফুলীর মাঝি আঁই নিয়ুম ভাটি উজানে”

আরও আছে :

“কি গান মাঝি শুনাইলো, কি বাঁশি মাঝি বাজাইলো/

কর্ণফুলী সাম্পাওয়ালা আমার মন কাড়ি নিলো”

Ñএসব গানে চট্টগ্রামের সাম্পান হয়ে ওঠে প্রেম, প্রতীক্ষা ও যাত্রার রূপক।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক একাডেমি, চাটগাঁ ভাষা পরিষদসহ বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতীকে সাম্পান চিত্রিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোটি তৈরি করেছেন শিল্পাচার্য কামরুল হাসান, যার অবয়ব সাম্পানের সামনের দিকের কাঠামোকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

একসময়ের প্রাণবন্ত সাম্পান আজ বিলুপ্তির মুখে। ইঞ্জিনচালিত নৌযান, নগরায়ন, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও নদী দূষণের ফলে ছোট সাম্পান হারিয়ে যাচ্ছে। ‘ক্যা কোরত’ শব্দের স্থানে জায়গা নিচ্ছে স্যালো ইঞ্জিনের ‘গুপ গুপ’ শব্দ। শুধু শব্দ নয়, হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস, শিল্প, কারিগর, ঐতিহ্য এবং চট্টগ্রামের এক অসামান্য সাংস্কৃতিক প্রতীক।

সাম্পান এখন শুধুই স্মৃতি নয়, চট্টগ্রামের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। তার রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায় আমাদের সবার। এই নৌযান আর শুধু চট্টগ্রামের নদীপথ নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মারও বয়ে চলেছেÑএক অভিন্ন স্রোতধারায়।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top