alt

উপ-সম্পাদকীয়

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

শেখর ভট্টাচার্য

: সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
image

মানবতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকারকে ধারণ করা হয়েছে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়

মহাত্মা লালনের যে সঙ্গীতটির প্রথম চরণ ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ এর পরের চরণ হলো ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই/মূল হারাবি...। ’ বিশ্ব সঙ্গীতে এরকম বাণী খুব বেশি পাওয়া যায় না। লোক ভাষায় মানবতার দর্শনকে এভাবে তুলে ধরার নজির বিরল। গণতন্ত্র কিংবা মানবতাবাদের আলোচনা থেকে যখন মানুষকে এড়িয়ে যাওয়া হয়, সরিয়ে দেয়া হয় তখন মনে হয় এসব আলোচনার উদ্দেশ্য ভিন্ন হয়ে যায়। মানুষকে এড়িয়ে গিয়ে অন্য ভাব, বিষয়, চেতনা নিয়ে আমরা যখন মশগুল হয়ে পড়ি তখন গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে দূরে সরে যাই। আমরা ক্ষুদ্র হয়ে যাই। নিজেদেরকে খোলসের মধ্যে বন্দি করে ফেলি।

উনিশ শতকে আমাদের বাউল সাধকেরা যে বিষয়টি নিয়ে গভীর সাধনায় মগ্ন ছিলেন, এরকম চেতনায় ধারণ করা ইংরেজি কিংবা অন্য কোন ভাষার সাধারণত আমরা দেখতে পাই না। লালন দর্শনের অনুরণন আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্র, নজরুল দর্শনের অন্তমূলে। রবীন্দ্রনাথ মানুষ ও মানবতার জয়গান শুনতে পেয়েছিলেন লালন সঙ্গীতের বাণীর ভেতর। লালনের মানবতাবাদী উদারনৈতিক মানবহিতৈষী কল্যাণময় দিকটি রবীন্দ্রনাথকে যারপারনাই অনুপ্রেরণা ও ভাবিয়ে তুলেছিল। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন, আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’ আসলে এ কথাটাই সত্য, লালন গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন তার সেই পরম মনের মানুষের কোনো জাত কোনো বর্ণ কোনো লিঙ্গ কোনো ধর্ম বলে কিছু নেই। রবীন্দ্র নাথের কথা অনুযায়ী আমরা সবাই কী সেদিকে অর্থাৎ মানবতাবাদের দিকে মনোযোগ দিতে পেরেছি। বিষয়টি গভীর ভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমন্বয়, মানুষের সাথে মানুষের ‘গলাগলির’ জন্য নজরুল তার সৃষ্টিকালীন সক্রিয় সময়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির’ রজতজয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি রূপে নজরুল একটি অভিভাষণ দান করেন। তার এই অভিভাষণটি মানুষ নজরুল। কবি নজরুলকে অনুধাবন করার জন্য অবশ্য পাঠ্য একটি অভিভাষণ। দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যাবার পূর্বে এই ছিল তার সর্বশেষ বক্তৃতা।

নজরুলের মানবতাবাদ, তার অকৃত্রিম মনোভাব আমরা এ অভিভাষণের প্রতিটি বাক্যে পেয়ে যাই। মানবতা, সাম্য এবং উদারতার এই বাণী চন্ডী দাস থেকে, আবদুল হাকিম, লালন হয়ে কী ভাবে রবীন্দ্র, নজরুলের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিলো নজরুলের শেষ অভিভষাণটি এর একটি দৃশ্যমান উদাহরণ। অভিভাষণটি বহুল আলোচিত, তারপরও এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি নাÑ ‘...কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই নয়। আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভনীয় হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে চুরি । হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত। মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র্য-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান- বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সবার মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা। সাম্যবাদী, বিদ্রোহী, প্রেমের কবি নজরুলের সমস্ত সৃষ্টিকর্মে আমরা মানুষের প্রতি ভালবাসায় পরিপূর্ণ এই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে পাই।

নজরুলের সৃষ্টিকর্মের দর্শন এবং আমাদের লোক কবিদের সৃষ্টিদর্শন এক এবং অভিচ্ছেদ্য বলে মনে হয়। আমাদের মরমী কবিদের সারা জীবন কেটেছে মানুষের ভেতরের মানুষকে অনুসন্ধান করে। গণতন্ত্রে, রাষ্ট্রনীতিতে মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর আমাদের বাউল কবিদের মানুষের প্রতি ভালবাসা কী ভিন্নার্থক। আমি মনে করি গণতন্ত্রে কাঠামোগত ভাবে মানুষের প্রতি ভালোবাসা কিছুটা আরোপিত কিন্তু বাউল দর্শনে এই ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত। অন্তর থেকে উদগীরিত। মানুষের প্রতি এই ভালোবাসা যদি হৃদয় কোরক থেকে উৎসারিত হয় তাহলে গণতন্ত্রে মানুষ কেন্দ্রিক দর্শনকে আমাদের বাউল দর্শন আরও শক্তিশালী করে তোলার ক্ষমতা রাখে বলে মনে করি। এখানে আমরা যদি আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সূত্রকে দেখি যেখানে বলা হয়েছেÑ ‘গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’ ১৮৬৩ সালের গেটিসবার্গ ভাষণে এই সংজ্ঞাটির মাধ্যমে লিংকন গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা তুলে ধরেছিলেন। রাষ্ট্রচিন্তায় মানুষকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার কথা সমাজ দর্শনে মানুষকে প্রাধান্য দেয়ার কথা আমাদের এই বাংলার চন্ডীদাস, আবদুল হাকিম মধ্যযুগে অর্থাৎ লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের চারশত বছর আগে বলে গেছেন। চন্ডীদাসের সেই উদ্ধৃতিটি বিশ্ব সমাজে সে ভাবে প্রচারিত হয়নি। মনে রাখতে হবে আমাদের দার্শনিকেরা ইউরোপের রেনেসাঁসের পূর্বে এরকম মানব দর্শনের কথা বলে গেছেন।

ফিরে আসি আবার আবহমান বাংলার মানবতাবাদী দর্শনে বিশেষ করে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ মরমী কবি, বাউল সাধক লালন শাহের কথায়। বাংলার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো লোকসঙ্গীত। আর লোকসঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ শাখা বা ধারা হলো বাউল সঙ্গীত। বাউলরা তাদের সঙ্গীতের মধ্য দিয়েই ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাউল দর্শনের উৎস নিহিত হৃদয় ধর্মে। দেহের মধ্যেই আছেন অন্তরবাসী দেবতা। মানুষে মানুষে ভেদ সৃষ্টিকারী প্রবৃত্তিসমূহকে ধ্বংস করে সোনার মানুষকে গড়তে পারলেই মনের মানুষকে পাওয়া সহজ হয়। মনের মানুষের সন্ধানে ব্রতী দার্শনিক লালন আজীবন মানুষের মধ্যে ভেদ, বিভেদের উচ্ছেদ চেয়েছেন। এ কারণে তাকে বলা হয় বাউল শিরোমণি বা বাউল সম্রাট। লালনের সাধারণ পরিচয় তিনি একজন কবি, গীতিকার। প্রকৃতপক্ষে তিনি শুধুই কবি নন, বরং জালাল উদ্দিন রুমী, আল্লামা ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের ন্যায় দার্শনিক কবি। কবিতা বা গানে কবি বা গীতিকারের আবেগ প্রাধান্য লাভ করে। কিন্তু লালনের গান তীক্ষè যুক্তির আশ্রয়ে রচিত হওয়ায় তা কেবল আবেগ সর্বস্ব নয়, বরং এক যুক্তিবাদী দর্শন। লালনের দর্শনে সন্নিবেশিত বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে মানবতাবাদ অন্যতম। কিন্ত তার মানবতাবাদী চিন্তা তার সঙ্গীতের মধ্যে কিভাবে নিহিত ও প্রকাশিত, সেই বিষয়ে আমাদের অনেকেরই অজানা। যে মানবতাবাদী চিন্তার জন্য লালন অধিকতর মহিমান্বিত হওয়ার দাবি রাখেন, সেটি হলো সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা, আধুনিক গণতন্ত্রে যেখানে সবার অধিকার নিশ্চিত হয় সেরকম সমাজ ব্যবস্থাকে লালন করা।

লালন আজীবন স্বপ্ন দেখতেন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র জাতহীন এক মানবিক সমাজের, যে সমাজে মানুষই সব; মানুষের মানবিক মূল্যবোধই সমাজের সহায়ক। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। শ্রেষ্ঠ হওয়া খুব সহজ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে হলে শ্রেষ্ঠ গুণের অধিকারী হতে হয়। এই পৃথিবীতে মানুষের পরিচয় কিসে? মানুষের পরিচয় তার মানবিকমূল্যবোধ অর্থাৎ মনুষ্যত্বে। আর এই মনুষ্যত্বের মধ্য থেকেই মানবতাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। সত্যি যে, মানুষকে ঘিরেই মনুষ্যত্ব কিংবা মানবতাবাদ আলোকিত হয়। ফকির লালন গুরুবাদীধর্মে সাধন-ভজনে মানুষের সেই পরম মনুষ্যত্ববোধকেই জাগ্রত করতে চেয়েছেন।

মানবতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকারকে ধারণ করা হয়েছে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়। গণতন্ত্রের মৌল বাণীর ভেতরও মানুষের অধিকারকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক বিভেদ, প্রতিহিংসা, গণতন্ত্রহীনতায় মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে ক্রমাগত। চন্ডীদাস থেকে নজরুলের দর্শন আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার শিক্ষা দিয়ে গেছে। আমরা কি সমাজের সব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে অনৈক্যকে দূর করতে পেরেছি? বৃত্তের বাইরে মানুষকে রেখে সেই কাজ যে সম্ভব নয়Ñ এ কথাটি বলাই বাহুল্য।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ!

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

শেখর ভট্টাচার্য

image

মানবতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকারকে ধারণ করা হয়েছে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়

সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

মহাত্মা লালনের যে সঙ্গীতটির প্রথম চরণ ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ এর পরের চরণ হলো ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই/মূল হারাবি...। ’ বিশ্ব সঙ্গীতে এরকম বাণী খুব বেশি পাওয়া যায় না। লোক ভাষায় মানবতার দর্শনকে এভাবে তুলে ধরার নজির বিরল। গণতন্ত্র কিংবা মানবতাবাদের আলোচনা থেকে যখন মানুষকে এড়িয়ে যাওয়া হয়, সরিয়ে দেয়া হয় তখন মনে হয় এসব আলোচনার উদ্দেশ্য ভিন্ন হয়ে যায়। মানুষকে এড়িয়ে গিয়ে অন্য ভাব, বিষয়, চেতনা নিয়ে আমরা যখন মশগুল হয়ে পড়ি তখন গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে দূরে সরে যাই। আমরা ক্ষুদ্র হয়ে যাই। নিজেদেরকে খোলসের মধ্যে বন্দি করে ফেলি।

উনিশ শতকে আমাদের বাউল সাধকেরা যে বিষয়টি নিয়ে গভীর সাধনায় মগ্ন ছিলেন, এরকম চেতনায় ধারণ করা ইংরেজি কিংবা অন্য কোন ভাষার সাধারণত আমরা দেখতে পাই না। লালন দর্শনের অনুরণন আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্র, নজরুল দর্শনের অন্তমূলে। রবীন্দ্রনাথ মানুষ ও মানবতার জয়গান শুনতে পেয়েছিলেন লালন সঙ্গীতের বাণীর ভেতর। লালনের মানবতাবাদী উদারনৈতিক মানবহিতৈষী কল্যাণময় দিকটি রবীন্দ্রনাথকে যারপারনাই অনুপ্রেরণা ও ভাবিয়ে তুলেছিল। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন, আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’ আসলে এ কথাটাই সত্য, লালন গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন তার সেই পরম মনের মানুষের কোনো জাত কোনো বর্ণ কোনো লিঙ্গ কোনো ধর্ম বলে কিছু নেই। রবীন্দ্র নাথের কথা অনুযায়ী আমরা সবাই কী সেদিকে অর্থাৎ মানবতাবাদের দিকে মনোযোগ দিতে পেরেছি। বিষয়টি গভীর ভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমন্বয়, মানুষের সাথে মানুষের ‘গলাগলির’ জন্য নজরুল তার সৃষ্টিকালীন সক্রিয় সময়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির’ রজতজয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি রূপে নজরুল একটি অভিভাষণ দান করেন। তার এই অভিভাষণটি মানুষ নজরুল। কবি নজরুলকে অনুধাবন করার জন্য অবশ্য পাঠ্য একটি অভিভাষণ। দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যাবার পূর্বে এই ছিল তার সর্বশেষ বক্তৃতা।

নজরুলের মানবতাবাদ, তার অকৃত্রিম মনোভাব আমরা এ অভিভাষণের প্রতিটি বাক্যে পেয়ে যাই। মানবতা, সাম্য এবং উদারতার এই বাণী চন্ডী দাস থেকে, আবদুল হাকিম, লালন হয়ে কী ভাবে রবীন্দ্র, নজরুলের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিলো নজরুলের শেষ অভিভষাণটি এর একটি দৃশ্যমান উদাহরণ। অভিভাষণটি বহুল আলোচিত, তারপরও এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি নাÑ ‘...কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই নয়। আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভনীয় হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে চুরি । হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত। মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র্য-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান- বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সবার মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা। সাম্যবাদী, বিদ্রোহী, প্রেমের কবি নজরুলের সমস্ত সৃষ্টিকর্মে আমরা মানুষের প্রতি ভালবাসায় পরিপূর্ণ এই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে পাই।

নজরুলের সৃষ্টিকর্মের দর্শন এবং আমাদের লোক কবিদের সৃষ্টিদর্শন এক এবং অভিচ্ছেদ্য বলে মনে হয়। আমাদের মরমী কবিদের সারা জীবন কেটেছে মানুষের ভেতরের মানুষকে অনুসন্ধান করে। গণতন্ত্রে, রাষ্ট্রনীতিতে মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর আমাদের বাউল কবিদের মানুষের প্রতি ভালবাসা কী ভিন্নার্থক। আমি মনে করি গণতন্ত্রে কাঠামোগত ভাবে মানুষের প্রতি ভালোবাসা কিছুটা আরোপিত কিন্তু বাউল দর্শনে এই ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত। অন্তর থেকে উদগীরিত। মানুষের প্রতি এই ভালোবাসা যদি হৃদয় কোরক থেকে উৎসারিত হয় তাহলে গণতন্ত্রে মানুষ কেন্দ্রিক দর্শনকে আমাদের বাউল দর্শন আরও শক্তিশালী করে তোলার ক্ষমতা রাখে বলে মনে করি। এখানে আমরা যদি আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সূত্রকে দেখি যেখানে বলা হয়েছেÑ ‘গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’ ১৮৬৩ সালের গেটিসবার্গ ভাষণে এই সংজ্ঞাটির মাধ্যমে লিংকন গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা তুলে ধরেছিলেন। রাষ্ট্রচিন্তায় মানুষকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার কথা সমাজ দর্শনে মানুষকে প্রাধান্য দেয়ার কথা আমাদের এই বাংলার চন্ডীদাস, আবদুল হাকিম মধ্যযুগে অর্থাৎ লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের চারশত বছর আগে বলে গেছেন। চন্ডীদাসের সেই উদ্ধৃতিটি বিশ্ব সমাজে সে ভাবে প্রচারিত হয়নি। মনে রাখতে হবে আমাদের দার্শনিকেরা ইউরোপের রেনেসাঁসের পূর্বে এরকম মানব দর্শনের কথা বলে গেছেন।

ফিরে আসি আবার আবহমান বাংলার মানবতাবাদী দর্শনে বিশেষ করে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ মরমী কবি, বাউল সাধক লালন শাহের কথায়। বাংলার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো লোকসঙ্গীত। আর লোকসঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ শাখা বা ধারা হলো বাউল সঙ্গীত। বাউলরা তাদের সঙ্গীতের মধ্য দিয়েই ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাউল দর্শনের উৎস নিহিত হৃদয় ধর্মে। দেহের মধ্যেই আছেন অন্তরবাসী দেবতা। মানুষে মানুষে ভেদ সৃষ্টিকারী প্রবৃত্তিসমূহকে ধ্বংস করে সোনার মানুষকে গড়তে পারলেই মনের মানুষকে পাওয়া সহজ হয়। মনের মানুষের সন্ধানে ব্রতী দার্শনিক লালন আজীবন মানুষের মধ্যে ভেদ, বিভেদের উচ্ছেদ চেয়েছেন। এ কারণে তাকে বলা হয় বাউল শিরোমণি বা বাউল সম্রাট। লালনের সাধারণ পরিচয় তিনি একজন কবি, গীতিকার। প্রকৃতপক্ষে তিনি শুধুই কবি নন, বরং জালাল উদ্দিন রুমী, আল্লামা ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের ন্যায় দার্শনিক কবি। কবিতা বা গানে কবি বা গীতিকারের আবেগ প্রাধান্য লাভ করে। কিন্তু লালনের গান তীক্ষè যুক্তির আশ্রয়ে রচিত হওয়ায় তা কেবল আবেগ সর্বস্ব নয়, বরং এক যুক্তিবাদী দর্শন। লালনের দর্শনে সন্নিবেশিত বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে মানবতাবাদ অন্যতম। কিন্ত তার মানবতাবাদী চিন্তা তার সঙ্গীতের মধ্যে কিভাবে নিহিত ও প্রকাশিত, সেই বিষয়ে আমাদের অনেকেরই অজানা। যে মানবতাবাদী চিন্তার জন্য লালন অধিকতর মহিমান্বিত হওয়ার দাবি রাখেন, সেটি হলো সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা, আধুনিক গণতন্ত্রে যেখানে সবার অধিকার নিশ্চিত হয় সেরকম সমাজ ব্যবস্থাকে লালন করা।

লালন আজীবন স্বপ্ন দেখতেন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র জাতহীন এক মানবিক সমাজের, যে সমাজে মানুষই সব; মানুষের মানবিক মূল্যবোধই সমাজের সহায়ক। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। শ্রেষ্ঠ হওয়া খুব সহজ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে হলে শ্রেষ্ঠ গুণের অধিকারী হতে হয়। এই পৃথিবীতে মানুষের পরিচয় কিসে? মানুষের পরিচয় তার মানবিকমূল্যবোধ অর্থাৎ মনুষ্যত্বে। আর এই মনুষ্যত্বের মধ্য থেকেই মানবতাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। সত্যি যে, মানুষকে ঘিরেই মনুষ্যত্ব কিংবা মানবতাবাদ আলোকিত হয়। ফকির লালন গুরুবাদীধর্মে সাধন-ভজনে মানুষের সেই পরম মনুষ্যত্ববোধকেই জাগ্রত করতে চেয়েছেন।

মানবতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকারকে ধারণ করা হয়েছে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়। গণতন্ত্রের মৌল বাণীর ভেতরও মানুষের অধিকারকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক বিভেদ, প্রতিহিংসা, গণতন্ত্রহীনতায় মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে ক্রমাগত। চন্ডীদাস থেকে নজরুলের দর্শন আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার শিক্ষা দিয়ে গেছে। আমরা কি সমাজের সব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে অনৈক্যকে দূর করতে পেরেছি? বৃত্তের বাইরে মানুষকে রেখে সেই কাজ যে সম্ভব নয়Ñ এ কথাটি বলাই বাহুল্য।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top