alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

প্রাচীন ভারতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি অঞ্চল শাসিত হতো। তখন পৃথিবীতে মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের প্রবর্তন হয়নি। এই রাজ্যটি ছিল যৌধেয় জাতির শাসনতান্ত্রিক অঞ্চল। এটা ছিল মূলত সিন্ধু নদ এবং এর উপনদীগুলোর আশপাশের সমতল ভূমি। এই অঞ্চলটিতে ওই সময় যৌধেয় জাতিরা বসবাস করত। যৌধেয়রা উপমহাদেশের একটি প্রাচীন জাতি। অনেক ইতিহাসবিদ যৌধেয়দের আদিবাসী হিসেবে আখ্যা দেন, তবে এই আখ্যা দেয়াটা ভুল, এরা মূলত ওই অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসী। যৌধেয় জাতি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের প্রথম দিকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসবাস করত। তারা ছিল মূলত যোদ্ধা জাতি। যৌধেয়রা শাসনকার্য পরিচালনার জন্য গণতান্ত্রিকভাবে রাজা (যাকে তারা পুরস্কর্তা বলত যার অর্থ সভাপতি) নির্বাচিত করতেন। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র যৌধেয়দের রাজ্যে ছিল না। যৌধেয় রাজ্যে ওই সময় তাদের নিজেদের মুদ্রার প্রচলন ছিল। যৌধেয়দের হাতে কুষাণদের পরাজয় হয়।

কুষাণ কারা? কুষাণরা ছিল মধ্য এশিয়ার একটি যাযাবর গোষ্ঠী। কুষাণ রাজা কদ্ফিসেস প্রথমে হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে পহ্লবদের পরাজিত করে কিপিন ও কাবুল দখল করেন। এরপর তিনি ব্যাক্টেরিয়াতে স্বীয় অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যাক্টোরিয়া শব্দটি আসলে একটি প্রাচীন স্থান বা অঞ্চলের নাম, যা বর্তমান আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। এটি হিন্দুকুশ পর্বতমালা এবং আমু দরিয়া নদীর (প্রাচীন অক্সাস নদী) মধ্যে অবস্থিত ছিল। এক সময় কুষাণ রাজ্যের রাজা হন সম্রাট কণিষ্ক। ধারণা করা হয় কণিষ্ক ১৫১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে কুষাণ সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়। তার পরবর্তী রাজা বিশিষ্ক, হুবিষ্ক, দ্বিতীয় কণিষ্ক, প্রথম বাসুদেব, তৃতীয় কণিষ্ক, দ্বিতীয় বাসুদেব প্রমুখ রাজা হন। কুষাণরা ছিল ধর্মতান্ত্রিক রাজকার্য চালানোর মতানুসারী। তারা রাজাকে দেবতাতুল্য বলে ঘোষণা দেন। ওই সময় উত্তর ভারতের বহু অঞ্চলের বসবাসরত জাতি-গোষ্ঠি তা মেনে না নিয়ে বিদ্রোহ করে। উত্তরপ্রদেশে নাগ ও মাঘ বংশীয় রাজারা পাঞ্জাবে বৌধেয় প্রমুখরা বিদ্রোহ করে। ওই সময় যৌধেয়রাও করে কুষাণদের বিরুদ্ধে।

যৌধেয়রা ছিল এমন একটি জাতি যারা নিজেদের সামরিক শক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য ওই সময় এশিয়া অঞ্চলে পরিচিত ছিল। তারা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা এবং তাদের সামরিক শক্তির কারণে তারা বহিরাগত শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। তাই যৌধেয়দের এলাকায় বিদেশি শাসন কায়েম হয়নি যদিও পরবর্তী সময় তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যৌধেয়রা ভারতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। যৌধেরা কুষাণ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কুষাণরা যৌধেয়দের কাছে হার মানে। যৌধেদের মূল ভূখ- বর্তমান পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা অঞ্চলের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত ছিল। যৌধেয়দের রাজ্যটি ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য । এই জাতি-গোষ্ঠির নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুশীল করে আসছিল প্রাচীনকাল থেকে। তারা নিজেদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি বজায় রেখেছিল বহুকাল ধরে।

যৌধেরা যোদ্ধা ছিল তবে তারা অন্য কোন রাজ্য আক্রমন করে নিজেদের আয়ত্তে তারা নেয়নি। তবে বিহঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার সমস্ত সামরিক আয়োজন তারা সব সময় প্রস্তত রাখত। যৌধেয় রাজ্যটিতে যে গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্ত বংশীয় স¤্রাট সমুদ্র গুপ্তের আমলে। অহিত্র, মথুরা বিজয়ের পর সমুদ্র গুপ্তের দৃষ্টি পড়ে সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরা যৌধেয় ভূমির ওপর। তিনি সংবাদ মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন যৌধেয়দের কোন রাজা নেই। রাজাহীন রাজ্য জয় করা সহজ ব্যাপার। তবে যৌধেয় রাজকার্য পরিচালনা থেকে শুরু করে, যুদ্ধ, সন্ধিসহ সর্ব বিষয়ে অন্তিম নির্ণায়ক ছিল রাজ্যটির জনগণ।

যৌধেয়রা দেবপুত্র শাহি ও ক্ষত্রপদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কুণিন্দ (একটি রাজ্যের নাম) এবং অর্জুনায়নকে (একটি রাজ্যের নাম) মিলিত হয়ে এক বিরাট গণসংঘের রূপ দিয়েছিলেন। যৌধেয়, কুণিন্দ এবং অর্জুনায়নÑ তিনটি পৃথক রাজ্য ছিল, প্রতিটি স্ব স্ব রাজকার্য পরিচালনার জন্য স্ব স্ব গণসংঘ ছিল। তবে তারা বিদেশি আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে এই তিনটি গণসংঘ ঐক্যবদ্ধ। তাদের এই ঐক্য ছিল ব্রজের মতো অটুট।

ওই সময় সমুদ্র গুপ্ত ভেবে ছিলেন রাজাহীন একটি রাজ্য তার বিশাল বাহিনী আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবে না। তাই তিনি যৌধেয় রাজ্যে আক্রমন চালায়। যৌধেয়রা ছিল দেশপ্রেমিক, তাদের গন স্বাতন্ত্র্যতা তাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয়। যুদ্ধের সময় রাজ্যটির শুধু সৈন্যরা নয়, নারী-পুরুষ, শিশু সবাই অস্ত্র ধারণ করে। সমুদ্র গুপ্ত যখন যৌধেয় রাজ্যটি আক্রমণ করেছিলেন, তখন নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সমুদ্র গুপ্তের সৈন্যরা নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে শুরু করে। যৌধেয়রা প্রাণ দিতে প্রস্তুত তাই তারা প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তুলে ফেলে। পরম বিক্রমশালী বীর রাজা সমুদ্র গুপ্ত যৌধেয়দের প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য হয়ে যান। তিনি দূত মারফত যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দেন। তখন যৌধেয়রা জানায় এই যুদ্ধবিরতি সাময়িক কারণ স্থায়ী যুদ্ধবিরতি দিতে হলে তাদের জনগণের মতামত লাগবে। স¤্রাট সমুদ্র গুপ্ত তাতে রাজি হন।

যৌধেয় গণপুরস্কর্তা (সভাপতি) জনমত নেয়ার জন্য যৌথেয় রাজ্যের বিভিন্ন গণসংগঠনের কাছে খবর পাঠায়। রাজ্যটির বিভিন্ন এলাকার গণসংগঠনের পুরস্কর্তা (সভাপতি ) জনগনের মতামত নিয়ে যৌধেয় পুরস্কর্তার সঙ্গে বেঠকে মিলিত হন। অনুরূপ কুণিন্দ ও অর্জুনায়নের রাজ্যরে সভাপতিরা জনমত গ্রহণ করেন। পরে এই তিন গণপুরুস্কর্তা বৈঠকে মিলিত হয়ে একমতে পৌছান যে, তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত। তাই তিন পুরস্কর্তা একত্রিত হয়ে সন্ধি চুক্তির জন্য সমুদ্র গুপ্তের কাছে পত্র পাঠান। সম্্রাট সমুদ্র গুপ্ত তাদের সাথে আলোচনা বসতে অভিপ্রায় ব্যাক্ত করেন। তিন পুরস্কর্তা ও তাদের সেনাপতি সমুদ্র গুপ্তের সাথে মথুরায় যান আলোচনা করতে।

যৌধেয় গণতান্ত্রিক শাসন কার্যে শাসক নির্বাচনের পদ্ধতিটা ছিল, অনেকটা বর্তমান সাংসদীয় কায়দার মতোই। যৌধেয় রাজ্যের এলাকাভিত্তিক ছিল গণসংঘ। এই গণসংঘের প্রধান কে বলা হতো পুরস্কর্তা (গণসংঘ প্রধান বা সভাপতি)। তিনি জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হতেন। তারপর এলাকাভিত্তিক নির্বাচিত পুরস্কর্তারা কেন্দ্রীয় প্রধান পুরুস্কর্তা নির্বাচিত করতেন। পুরুস্কর্তাসহ একটি গণসংঘ কমিটি রাজ্য পরিচালনার ভার নিতেন। কমিটি রাজ্যের শাসন কার্য পরিচালনার জন্য নিয়োগ দিতেন বিভিন্ন কর্মচারী-কর্মকর্তা। প্রাচীন ভারতে সেই সময় যৌধেয় অঞ্চলে এভাবেই শাসন কার্য পরিচালিত হত। তবে যৌধেয় অঞ্চলের প্রতিটি নাগরিকই যোদ্ধা ছিল। শিশু জন্ম গ্রহণের পর তাকে তলোয়ার ধুয়ে পানি পান করানো হতো। তবে এরা যোদ্ধা হলেও জীবনকে ভালোবাসত বেশি তার কারণ ছিল শিশুরা জন্মের পর বড় হতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটির অনুশীলন করে।

যৌধেয়দের মাঝে ধনী দরিদ্র ছিল। তবে ব্যবধানটা তীব্রতর ছিল না। যৌধেয় রাজ্যের কোন নাগরিক ক্ষুধার কষ্ট পেত না। গণসংঘের পুরুস্কর্তা বিষয়টি দেখভাল করতেন। এলাকাভিত্তিক গণসংঘের সভায় এলাকার সমস্যাগুলো উপস্থাপিত হতো। এবং সেখানেই সমাধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ছিল। এই সময় পশু শিকার ছিল অন্যতম একটি পেশা। যৌধেয় শিকারি বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পশু শিকারে জন্য বনে জঙ্গলে ঢুকে পড়তেন। দেখা যেত একটি দল অনেক বেশ কিছু পশু শিকার করে ফেললেন। অন্য দল কোন পশু শিকার করতে পারলেন না। তখন তারা সকলকে ডেকে শিকারকৃত পশুগুলো সমভাবে ভাগ করে নিতেন। কৃষি জমির মালিকানাটাও ছিল সামাজিকভাবে। যে অঞ্চলে যে জনগোষ্ঠী বাস করত তারা মিলে ওই অঞ্চলের ভূমিতে কৃষি ফসল ফলাতেন। উৎপাদিত ফসলের ভাগ সমভাবে বণ্টন করার হতো। আজ থেকে ১৮শ বছর পূর্বে ভারতে এমনটি রাজ্যের নির্দশন পাওয়া যায়। ইতিহাস গবেষক ও দার্শনিক প-িত রাহুল সংস্কৃতায়ন লিখে গেছেন, যৌধেয় ছিল একটি শক্তিশালী গন রাজ্য এবং তার অবস্থান ছিল যমুনা-শতদ্রু ও চম্বল হিমালয় মধ্যবর্তী ভূখ-। অশোকা স্তম্ভের গায়ে নিজের অভিলেখ লেখার সময় সম্রাট সমুদ্র গুপ্ত যৌধেয়দের নাম স্মরণ করেছেন। তবে পঞ্চম শতাব্দিতে এসে এই জাতিটির নাম আর শোনা যায়নি। ঐতিহাসিকদের মতে স¤্রাট চন্দ্র গুপ্ত বিক্রমাদিত্য এই রাজ্যটি দখল করে নেন। তারা ক্রোধানলে পরে এই জাতিটি ধ্বংস হয়ে যায়। যৌধেয়রা নিজ ভূম থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর নানা দিকে ছড়িয়ে পরে। তবে এখন এই জাতিটির কোন অংশ বা জনগোষ্ঠির নির্দশন ভারত বর্ষ তথা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায়না। নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্বলিত একটি জাতি এভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এই জাতির কাছ থেকে গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ শেখার অনেক বিষয় আছে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

প্রাচীন ভারতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি অঞ্চল শাসিত হতো। তখন পৃথিবীতে মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের প্রবর্তন হয়নি। এই রাজ্যটি ছিল যৌধেয় জাতির শাসনতান্ত্রিক অঞ্চল। এটা ছিল মূলত সিন্ধু নদ এবং এর উপনদীগুলোর আশপাশের সমতল ভূমি। এই অঞ্চলটিতে ওই সময় যৌধেয় জাতিরা বসবাস করত। যৌধেয়রা উপমহাদেশের একটি প্রাচীন জাতি। অনেক ইতিহাসবিদ যৌধেয়দের আদিবাসী হিসেবে আখ্যা দেন, তবে এই আখ্যা দেয়াটা ভুল, এরা মূলত ওই অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসী। যৌধেয় জাতি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের প্রথম দিকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসবাস করত। তারা ছিল মূলত যোদ্ধা জাতি। যৌধেয়রা শাসনকার্য পরিচালনার জন্য গণতান্ত্রিকভাবে রাজা (যাকে তারা পুরস্কর্তা বলত যার অর্থ সভাপতি) নির্বাচিত করতেন। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র যৌধেয়দের রাজ্যে ছিল না। যৌধেয় রাজ্যে ওই সময় তাদের নিজেদের মুদ্রার প্রচলন ছিল। যৌধেয়দের হাতে কুষাণদের পরাজয় হয়।

কুষাণ কারা? কুষাণরা ছিল মধ্য এশিয়ার একটি যাযাবর গোষ্ঠী। কুষাণ রাজা কদ্ফিসেস প্রথমে হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে পহ্লবদের পরাজিত করে কিপিন ও কাবুল দখল করেন। এরপর তিনি ব্যাক্টেরিয়াতে স্বীয় অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যাক্টোরিয়া শব্দটি আসলে একটি প্রাচীন স্থান বা অঞ্চলের নাম, যা বর্তমান আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। এটি হিন্দুকুশ পর্বতমালা এবং আমু দরিয়া নদীর (প্রাচীন অক্সাস নদী) মধ্যে অবস্থিত ছিল। এক সময় কুষাণ রাজ্যের রাজা হন সম্রাট কণিষ্ক। ধারণা করা হয় কণিষ্ক ১৫১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে কুষাণ সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়। তার পরবর্তী রাজা বিশিষ্ক, হুবিষ্ক, দ্বিতীয় কণিষ্ক, প্রথম বাসুদেব, তৃতীয় কণিষ্ক, দ্বিতীয় বাসুদেব প্রমুখ রাজা হন। কুষাণরা ছিল ধর্মতান্ত্রিক রাজকার্য চালানোর মতানুসারী। তারা রাজাকে দেবতাতুল্য বলে ঘোষণা দেন। ওই সময় উত্তর ভারতের বহু অঞ্চলের বসবাসরত জাতি-গোষ্ঠি তা মেনে না নিয়ে বিদ্রোহ করে। উত্তরপ্রদেশে নাগ ও মাঘ বংশীয় রাজারা পাঞ্জাবে বৌধেয় প্রমুখরা বিদ্রোহ করে। ওই সময় যৌধেয়রাও করে কুষাণদের বিরুদ্ধে।

যৌধেয়রা ছিল এমন একটি জাতি যারা নিজেদের সামরিক শক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য ওই সময় এশিয়া অঞ্চলে পরিচিত ছিল। তারা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা এবং তাদের সামরিক শক্তির কারণে তারা বহিরাগত শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। তাই যৌধেয়দের এলাকায় বিদেশি শাসন কায়েম হয়নি যদিও পরবর্তী সময় তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যৌধেয়রা ভারতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। যৌধেরা কুষাণ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কুষাণরা যৌধেয়দের কাছে হার মানে। যৌধেদের মূল ভূখ- বর্তমান পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা অঞ্চলের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত ছিল। যৌধেয়দের রাজ্যটি ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য । এই জাতি-গোষ্ঠির নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুশীল করে আসছিল প্রাচীনকাল থেকে। তারা নিজেদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি বজায় রেখেছিল বহুকাল ধরে।

যৌধেরা যোদ্ধা ছিল তবে তারা অন্য কোন রাজ্য আক্রমন করে নিজেদের আয়ত্তে তারা নেয়নি। তবে বিহঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার সমস্ত সামরিক আয়োজন তারা সব সময় প্রস্তত রাখত। যৌধেয় রাজ্যটিতে যে গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্ত বংশীয় স¤্রাট সমুদ্র গুপ্তের আমলে। অহিত্র, মথুরা বিজয়ের পর সমুদ্র গুপ্তের দৃষ্টি পড়ে সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরা যৌধেয় ভূমির ওপর। তিনি সংবাদ মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন যৌধেয়দের কোন রাজা নেই। রাজাহীন রাজ্য জয় করা সহজ ব্যাপার। তবে যৌধেয় রাজকার্য পরিচালনা থেকে শুরু করে, যুদ্ধ, সন্ধিসহ সর্ব বিষয়ে অন্তিম নির্ণায়ক ছিল রাজ্যটির জনগণ।

যৌধেয়রা দেবপুত্র শাহি ও ক্ষত্রপদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কুণিন্দ (একটি রাজ্যের নাম) এবং অর্জুনায়নকে (একটি রাজ্যের নাম) মিলিত হয়ে এক বিরাট গণসংঘের রূপ দিয়েছিলেন। যৌধেয়, কুণিন্দ এবং অর্জুনায়নÑ তিনটি পৃথক রাজ্য ছিল, প্রতিটি স্ব স্ব রাজকার্য পরিচালনার জন্য স্ব স্ব গণসংঘ ছিল। তবে তারা বিদেশি আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে এই তিনটি গণসংঘ ঐক্যবদ্ধ। তাদের এই ঐক্য ছিল ব্রজের মতো অটুট।

ওই সময় সমুদ্র গুপ্ত ভেবে ছিলেন রাজাহীন একটি রাজ্য তার বিশাল বাহিনী আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবে না। তাই তিনি যৌধেয় রাজ্যে আক্রমন চালায়। যৌধেয়রা ছিল দেশপ্রেমিক, তাদের গন স্বাতন্ত্র্যতা তাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয়। যুদ্ধের সময় রাজ্যটির শুধু সৈন্যরা নয়, নারী-পুরুষ, শিশু সবাই অস্ত্র ধারণ করে। সমুদ্র গুপ্ত যখন যৌধেয় রাজ্যটি আক্রমণ করেছিলেন, তখন নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সমুদ্র গুপ্তের সৈন্যরা নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে শুরু করে। যৌধেয়রা প্রাণ দিতে প্রস্তুত তাই তারা প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তুলে ফেলে। পরম বিক্রমশালী বীর রাজা সমুদ্র গুপ্ত যৌধেয়দের প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য হয়ে যান। তিনি দূত মারফত যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দেন। তখন যৌধেয়রা জানায় এই যুদ্ধবিরতি সাময়িক কারণ স্থায়ী যুদ্ধবিরতি দিতে হলে তাদের জনগণের মতামত লাগবে। স¤্রাট সমুদ্র গুপ্ত তাতে রাজি হন।

যৌধেয় গণপুরস্কর্তা (সভাপতি) জনমত নেয়ার জন্য যৌথেয় রাজ্যের বিভিন্ন গণসংগঠনের কাছে খবর পাঠায়। রাজ্যটির বিভিন্ন এলাকার গণসংগঠনের পুরস্কর্তা (সভাপতি ) জনগনের মতামত নিয়ে যৌধেয় পুরস্কর্তার সঙ্গে বেঠকে মিলিত হন। অনুরূপ কুণিন্দ ও অর্জুনায়নের রাজ্যরে সভাপতিরা জনমত গ্রহণ করেন। পরে এই তিন গণপুরুস্কর্তা বৈঠকে মিলিত হয়ে একমতে পৌছান যে, তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত। তাই তিন পুরস্কর্তা একত্রিত হয়ে সন্ধি চুক্তির জন্য সমুদ্র গুপ্তের কাছে পত্র পাঠান। সম্্রাট সমুদ্র গুপ্ত তাদের সাথে আলোচনা বসতে অভিপ্রায় ব্যাক্ত করেন। তিন পুরস্কর্তা ও তাদের সেনাপতি সমুদ্র গুপ্তের সাথে মথুরায় যান আলোচনা করতে।

যৌধেয় গণতান্ত্রিক শাসন কার্যে শাসক নির্বাচনের পদ্ধতিটা ছিল, অনেকটা বর্তমান সাংসদীয় কায়দার মতোই। যৌধেয় রাজ্যের এলাকাভিত্তিক ছিল গণসংঘ। এই গণসংঘের প্রধান কে বলা হতো পুরস্কর্তা (গণসংঘ প্রধান বা সভাপতি)। তিনি জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হতেন। তারপর এলাকাভিত্তিক নির্বাচিত পুরস্কর্তারা কেন্দ্রীয় প্রধান পুরুস্কর্তা নির্বাচিত করতেন। পুরুস্কর্তাসহ একটি গণসংঘ কমিটি রাজ্য পরিচালনার ভার নিতেন। কমিটি রাজ্যের শাসন কার্য পরিচালনার জন্য নিয়োগ দিতেন বিভিন্ন কর্মচারী-কর্মকর্তা। প্রাচীন ভারতে সেই সময় যৌধেয় অঞ্চলে এভাবেই শাসন কার্য পরিচালিত হত। তবে যৌধেয় অঞ্চলের প্রতিটি নাগরিকই যোদ্ধা ছিল। শিশু জন্ম গ্রহণের পর তাকে তলোয়ার ধুয়ে পানি পান করানো হতো। তবে এরা যোদ্ধা হলেও জীবনকে ভালোবাসত বেশি তার কারণ ছিল শিশুরা জন্মের পর বড় হতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটির অনুশীলন করে।

যৌধেয়দের মাঝে ধনী দরিদ্র ছিল। তবে ব্যবধানটা তীব্রতর ছিল না। যৌধেয় রাজ্যের কোন নাগরিক ক্ষুধার কষ্ট পেত না। গণসংঘের পুরুস্কর্তা বিষয়টি দেখভাল করতেন। এলাকাভিত্তিক গণসংঘের সভায় এলাকার সমস্যাগুলো উপস্থাপিত হতো। এবং সেখানেই সমাধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ছিল। এই সময় পশু শিকার ছিল অন্যতম একটি পেশা। যৌধেয় শিকারি বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পশু শিকারে জন্য বনে জঙ্গলে ঢুকে পড়তেন। দেখা যেত একটি দল অনেক বেশ কিছু পশু শিকার করে ফেললেন। অন্য দল কোন পশু শিকার করতে পারলেন না। তখন তারা সকলকে ডেকে শিকারকৃত পশুগুলো সমভাবে ভাগ করে নিতেন। কৃষি জমির মালিকানাটাও ছিল সামাজিকভাবে। যে অঞ্চলে যে জনগোষ্ঠী বাস করত তারা মিলে ওই অঞ্চলের ভূমিতে কৃষি ফসল ফলাতেন। উৎপাদিত ফসলের ভাগ সমভাবে বণ্টন করার হতো। আজ থেকে ১৮শ বছর পূর্বে ভারতে এমনটি রাজ্যের নির্দশন পাওয়া যায়। ইতিহাস গবেষক ও দার্শনিক প-িত রাহুল সংস্কৃতায়ন লিখে গেছেন, যৌধেয় ছিল একটি শক্তিশালী গন রাজ্য এবং তার অবস্থান ছিল যমুনা-শতদ্রু ও চম্বল হিমালয় মধ্যবর্তী ভূখ-। অশোকা স্তম্ভের গায়ে নিজের অভিলেখ লেখার সময় সম্রাট সমুদ্র গুপ্ত যৌধেয়দের নাম স্মরণ করেছেন। তবে পঞ্চম শতাব্দিতে এসে এই জাতিটির নাম আর শোনা যায়নি। ঐতিহাসিকদের মতে স¤্রাট চন্দ্র গুপ্ত বিক্রমাদিত্য এই রাজ্যটি দখল করে নেন। তারা ক্রোধানলে পরে এই জাতিটি ধ্বংস হয়ে যায়। যৌধেয়রা নিজ ভূম থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর নানা দিকে ছড়িয়ে পরে। তবে এখন এই জাতিটির কোন অংশ বা জনগোষ্ঠির নির্দশন ভারত বর্ষ তথা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায়না। নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্বলিত একটি জাতি এভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এই জাতির কাছ থেকে গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ শেখার অনেক বিষয় আছে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top