alt

উপ-সম্পাদকীয়

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

আনোয়ারুল হক

: বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
image

এক বছর আগে এই জুলাই মাসে তারুণ্যের জাগরণে সারাদেশের সরকারি বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে, লাখে লাখে বনের পাখি নেমে এসেছিল রাজপথে

শৈশব-কৈশোরকালে আমরা সবাই পড়েছি, ‘খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে। ’ বনের পাখি বলে, ‘আকাশ ঘন নীল কোথাও বাধা নাহি তার। ’ খাঁচার পাখি বলে, ‘খাঁচাটি পরিপাটি কেমন ঢাকা চারিধার। ’ বনের পাখি বলে, ‘আপনা ছাড়ি দাও মেঘের মাঝে একেবারে। ’ খাঁচার পাখি বলে, ‘নিরালা কোণে বসে বাঁধিয়া রাখো আপনারে। ’ বনের পাখি বলে, ‘না, সেথা কোথায় উড়িবারে পাই!’

এক বছর আগে এই জুলাই মাসে তারুণ্যের জাগরণে সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে, লাখে লাখে বনের পাখি নেমে এসেছিল রাজপথে। লাখো ছাত্র তরুণ-তরুণী বনের পাখির মতোই ঘন নীল আকাশের পানে তাকিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলো বৈষম্যের রাজত্বের বিরুদ্ধে, জেদ দম্ভ আর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে এবং দীর্ঘকালজুড়ে চেপে বসা স্বৈরশাসনের অবসান করে এক বৈচিত্র্যপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে।

জুলাই জাগরণের অন্যতম মুখ উমামা ফাতেমাকে অতি সম্প্রতি নতুন করে কেনো ঘোষণা করতে হচ্ছে যে, তিনি বনের পাখি। জুলাই জাগরণের সময়তো তিনি বনের পাখিই ছিলেন। তাইতো তিনি সক্ষম হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি ছাত্রী হলসহ ঢাকা শহরের ছাত্রীদের রাজপথের লড়াইয়ে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে। অভ্যুত্থানের পরে অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষত প্রধান উপদেষ্টার আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে এবং সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতায় যে ‘পরিপাটি ও চারিধার ঢাকা সোনার খাঁচা’ তৈরি করা হয়েছে সেখানে ‘নিরালা কোনে বসে বাঁধিয়া রাখো আপনারে’Ñ এর মতো তরুণী তিনি নন।

জুলাই জাগরনের শুরুটা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পরেও চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রথা এবং তার রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে। সাধারণ ছাত্র এবং চাকুরী প্রার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে ইতিপূর্বেও আন্দোলন করেছিলেন। কোটা সংস্কার না করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাগান্বিত স্বরে এবং অভিমানের সুরে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘কোটা নিয়ে যখন এত কথা, তখন সব কোটাই বাতিল করে দিলাম’। এটাও কিন্তু একধরনের স্বৈরাচারী কন্ঠস্বর এবং আপাতত আন্দোলন বন্ধ হলেও কার্যত তিনি সমস্যা সমাধান না করে সমস্যা জিইয়ে রাখলেন। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হলো বা করানো হলো।

২০২৪ সালে নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে দেশের বুকে গড়ে ওঠা বিশাল আন্দোলনকে দমন করে তিনি যখন তার মত করে নির্বাচন সম্পন্ন করতে সমর্থ হলেন, তখন গোটা আওয়ামী মহল মনে করলেন তারা অপারেজয় এবং তখন মামলাটা দ্রুত নিষ্পত্তি করে রায় বের করার জন্য তারা তোড়জোড় শুরু করলেন। আদালত কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করলে, নতুন করে আবার শুরু হ’ল আন্দোলন। আন্দোলনের শুরুতে সেøাগান শুনলামÑ কোটা না মেধা, মেধা মেধা। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই, শেখ হাসিনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি। দুই ছাত্র সমন্বয়ক, বর্তমানে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের এবং দক্ষিণাঞ্চলের ‘সিপাহসালার’ দুজনেই ছাত্রলীগের সাথেই ছিলেন। সারজিস আলম ছাত্রলীগের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে হল সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। হাসনাত আব্দুল্লাহ কোনো কমিটিতে না থাকলেও ফেসবুকে শেখ মুজিবের গুনগান করতেন। মুজিব শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর গুনগান করে তার লেখা ২০২০ সালের পত্রিকা ঘাটলেও পাওয়া যাবে। তাই আন্দোলনের শুরুতে তারা হয়তোবা এ ধরনের সেøাগান দিয়েছিলেন।

কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ‘অভিমানী সিদ্ধান্ত’। তাই আদালতের রায়ের পর ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে সরকার একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ নিতে থাকে। ছাত্রলীগকেও লাঠিসোটা দিয়ে নামানো হয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্র লীগের হামলায় আহত ছাত্রীদের রক্তাক্ত ছবি সারাদেশের ছাত্রছাত্রীদের আরো বিক্ষুব্ধ করে তোলে। আর রংপুরে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদকে টার্গেট করে একটার পর একটা গুলি করে হত্যার দৃশ্য প্রচারিত হওয়ার পর ছাত্রদের প্রতিবাদী আন্দোলনে যে যৌবন জল-তরঙ্গ সৃষ্টি হয় আমি ড্যামি ভোটের সরকার কি আর বালির বাঁধ দিয়ে তা রোধ করতে পারে! বরং রোধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে যেয়ে গুলিবিদ্ধ ‘পানিওয়ালা’ মুগ্ধ, রিকশার পা-দানিতে গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজ, পিতার বুকে গুলিবিদ্ধ শিশুর ছবিÑ বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার এক মহাপ্লাবন সৃষ্টি করে।

তাই তাকে বিদায় নিতে হলো। তিনি শেষ পর্যন্ত গেলেন, কিন্তু যাওয়ার আগে গোটা দেশকে রক্তাক্ত করে গেলেন। আর ১৫ বছর ধরে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বুলি আওড়িয়ে অবশেষে চুন কালি মেখে দিয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতির প্রতি এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক নিজের পিতার স্মৃতিও তা থেকে বাদ যায়নি।

স্বৈরাচারী শাসনের অবসান এবং তারুণ্যের জাগরনকে মানুষ ‘এসো আরম্ভ, এসো অমলিন সূচনা’ বলে স্বাগত জানায়; কিন্তু পতিত শাসকগোষ্ঠীর কর্মফল আর অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক বিকল্পের ক্ষেত্রে কার্যত এক শুন্যতা বিরাজ করায় বাংলাদেশের ইতিহাসকে যারা আবার নতুন করে পাকিস্তানি বয়ানে লিখতে চায় সেই গোষ্ঠীগুলোর উত্থান ঘটলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমের খাঁচায় ছাত্রলীগের আশ্রয়ে ঘাপটি মেরে থাকা উগ্রবাদীরা বেরিয়ে এসে এবং ধর্মীয় সেøাগানের আড়ালে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো। এক খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে তারা ঘৃণা, সংহিসতা, সাম্প্রদায়িকতা ও নারী বিদ্বেষের খাঁচায় ঢুকে পড়লো। মিথ্যা বয়ান ছড়িয়ে তারা যখন তখন মব উল্লোম্ফন শুরু করলো। সমন্বয়কদের একাংশও যুক্ত হয়ে পড়ল এ মবোল্লাসে। এত রক্ত, এত অশ্রু আর অসামান্য গৌরব গাঁথার বিনিময়ে যে অভ্যুত্থান সম্পন্ন হলো তাকে আবার আটকে ফেলা হলো কিছু উচ্চাভিলাষীর খাঁচায়।

কিন্তু এটা মনে রাখা প্রয়োজন জুলাই অভ্যুত্থান ছিল মূলত মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর বেদনার বহিঃপ্রকাশ। আর সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাতারে একজোট হয়ে দাঁড়ানোর অন্যতম কারণ ছিল, তারা মনে করেছিলেন এই আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক দলের খবরদারি বা স্বার্থান্বেষী ইন্ধন নেই। সেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই একটি নতুন রাজনৈতিক দলের ডাকে একইভাবে সাড়া দেবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই। বরং নতুন দলের কর্তাদের হাঁকডাক, জেদ দম্ভ, ক্রোধ প্রতিহিংসা এবং একাংশের মাঝে অর্থ বিত্ত, বাড়ী গাড়ি, ক্ষমতার লোভ দেখে তারা আশাহত। তাদের স্বপ্নগুলো সব ঝাপসা হয়ে গেছে।

কোটাবিরোধী আন্দোলন করে এনসিপি চক্রের এখন সব জায়গায় কোটা চাই। মন্ত্রী সভা, জাতীয় সংসদ, সচিবালয়, ব্যবসা, বানিজ্য,টেন্ডার বাণিজ্য, মামলা বানিজ্য সব জায়গায় কোটা চাই। সব চেয়ে দুঃখজনক বিষয় রাজনৈতিক পরিচয়হীন বা আন্দোলনের নেতাদের সংযোগ নেই এমন সাধারণ পরিবারের শহীদ বা আহতদের পরিবারের কেউ খোঁজখবর রাখেন না; কিন্তু একশ্রেণীর শহীদ এবং আহতদের নিয়ে একধরণের সিন্ডিকেট ব্যবসা গড়ে উঠেছে। শহীদ ও আহতদের তালিকা নিয়ে প্রতারনা, ভুয়া জুলাই যোদ্ধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকারও শহীদ পরিবারগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের বদলে এমন এমন উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যাতে করে শহীদ পরিবার সমূহ সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। উমামার ভাষ্য অনুযায়ী অভ্যুত্থানের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহতÑ এসব এখন বুলি মাত্র।

নতুন দলের কর্তারা এক সময় বলেছিলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির সাংগঠনিক কার্যক্রম থাকবেনা। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হবে; কিন্তু সবার আগে নতুন দল কৌশলে দুইটি ছাত্র সংগঠন দাঁড় করিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। একটি গনতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ এবং অপরটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সরাসরি এনসিপির ছাত্র শাখা এবং জুলাই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন বা আন্দোলনের সমর্থক কিন্তু দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে চান না এমন ছাত্রদেরকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সংগঠিত রাখার প্রয়াস হিসেবে এ সংগঠনটিও রাখা হয়েছে। দুটিই নিয়ন্ত্রিত হয় এনসিপি দল বা হেয়ার রোড থেকে।

এনসিপির রূপায়ন টাওয়ার তথা হেয়ার রোডের খাঁচায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বন্দি করার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন বনের পাখি উমামা। তিনি শিকল পরতে রাজি নন। তিনি আন্দোলনের মধ্যে থেকেই তার এক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন এ আন্দোলনে শুধু এনসিপি বা তাদের ছাত্র সংগঠন (প্রাক্তন ছাত্র শক্তি) নয়, ছাত্রলীগ বাদে সকল ছাত্র সংগঠন এ আন্দোলনের অংশীদার। আর সবচেয়ে বড় অংশীদার বনের পাখিরা যারা দলমতের বাইরে উড়ে এসেছিলো হাজারে হাজারে লাখে লাখে। এ আন্দোলনের অংশীদার শ্রমজীবী মানুষ যারা সেই বনের পাখিদের পাশে দাঁড়িয়ে রাজপথের প্রতিটি মোড়ে গড়ে তুলেছিলেন ব্যারিকেড। অংশীদার ছিলেন সেই সাহসী শিক্ষকরা যারা রাজপথে ব্যারিকেড হিসেবে দাঁড়িয়ে তাদের ছাত্রদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। অবশ্যই অংশীদার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যারা বিগত এক যুগের বেশি সময় ধরে গণতন্ত্র এবং অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য লড়াই করে আসছিলেন। ছাত্র নেতৃত্বের অনুরোধেই তো বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে জুলাই আন্দোলনে রাজপথে নামেন নাই। এ আন্দোলনের স্টেকহোল্ডার দেশের আপামর জনতা। এটা এনসিপি কুক্ষিগত করতে চাইলে ইতিহাসের বিকৃতি হবে।

তাই তো উমামা বলতে বাধ্য হয়েছেনÑ একটা শক্তিশালী চক্র অভ্যুত্থানকে বাজার দরে কেনা-বেচা করার চেষ্টা করছে। তাকে যেমন স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হয়নি, তেমনি স্বাধীনভাবে চলতে পারছে না ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। কার্যত এনসিপি সমর্থক আর কিছু শিবির সমর্থক বা মতালম্বী ছাড়া আর কেউ নেইও এখনকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে। তাহলে এনসিপি বা এখনকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিভাবে জুলাই সনদ ঘোষণা করবে। জুলাই তো তাদের একার নয়। জুলাই সনদ করতে হলে তো সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে করতে হবে। এনসিপির প্রতিনিধিরা উপদেষ্টা পরিষদে আছেন বিধায় তারা জোর করে বনের পাখিদের খাঁচায় পুরবেন বাঁ পায়ে শিকল পরাবেন!

পরিস্থিতিা বোধহয় আর এখন এনসিপি ও তার মিত্রদের অনুকূলে ততটা নেই। এই আবেগের জুলাই মাসেও মাঠে নেমে এনসিপি সেটা বুঝতে পারছে। তারা বুঝতে পারছে মাস দেড়েক আগে সারজিস আলমের ‘জামানত নিয়ে উচ্চারিত ভবিষ্যদ্বাণীর’ বাস্তবতা রয়েছে। তাই তারা এখন প্রতিটি পথসভায় হুমকি দিচ্ছেনÑ সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ছাড়া এনসিপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না; কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থান-গাথার নায়ক তো বনের পাখিরা। তারা ‘শিকলে ধরা নাহি দিবে’!

[লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা]

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

আনোয়ারুল হক

image

এক বছর আগে এই জুলাই মাসে তারুণ্যের জাগরণে সারাদেশের সরকারি বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে, লাখে লাখে বনের পাখি নেমে এসেছিল রাজপথে

বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

শৈশব-কৈশোরকালে আমরা সবাই পড়েছি, ‘খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে। ’ বনের পাখি বলে, ‘আকাশ ঘন নীল কোথাও বাধা নাহি তার। ’ খাঁচার পাখি বলে, ‘খাঁচাটি পরিপাটি কেমন ঢাকা চারিধার। ’ বনের পাখি বলে, ‘আপনা ছাড়ি দাও মেঘের মাঝে একেবারে। ’ খাঁচার পাখি বলে, ‘নিরালা কোণে বসে বাঁধিয়া রাখো আপনারে। ’ বনের পাখি বলে, ‘না, সেথা কোথায় উড়িবারে পাই!’

এক বছর আগে এই জুলাই মাসে তারুণ্যের জাগরণে সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে, লাখে লাখে বনের পাখি নেমে এসেছিল রাজপথে। লাখো ছাত্র তরুণ-তরুণী বনের পাখির মতোই ঘন নীল আকাশের পানে তাকিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলো বৈষম্যের রাজত্বের বিরুদ্ধে, জেদ দম্ভ আর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে এবং দীর্ঘকালজুড়ে চেপে বসা স্বৈরশাসনের অবসান করে এক বৈচিত্র্যপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে।

জুলাই জাগরণের অন্যতম মুখ উমামা ফাতেমাকে অতি সম্প্রতি নতুন করে কেনো ঘোষণা করতে হচ্ছে যে, তিনি বনের পাখি। জুলাই জাগরণের সময়তো তিনি বনের পাখিই ছিলেন। তাইতো তিনি সক্ষম হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি ছাত্রী হলসহ ঢাকা শহরের ছাত্রীদের রাজপথের লড়াইয়ে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে। অভ্যুত্থানের পরে অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষত প্রধান উপদেষ্টার আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে এবং সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতায় যে ‘পরিপাটি ও চারিধার ঢাকা সোনার খাঁচা’ তৈরি করা হয়েছে সেখানে ‘নিরালা কোনে বসে বাঁধিয়া রাখো আপনারে’Ñ এর মতো তরুণী তিনি নন।

জুলাই জাগরনের শুরুটা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পরেও চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রথা এবং তার রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে। সাধারণ ছাত্র এবং চাকুরী প্রার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে ইতিপূর্বেও আন্দোলন করেছিলেন। কোটা সংস্কার না করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাগান্বিত স্বরে এবং অভিমানের সুরে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘কোটা নিয়ে যখন এত কথা, তখন সব কোটাই বাতিল করে দিলাম’। এটাও কিন্তু একধরনের স্বৈরাচারী কন্ঠস্বর এবং আপাতত আন্দোলন বন্ধ হলেও কার্যত তিনি সমস্যা সমাধান না করে সমস্যা জিইয়ে রাখলেন। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হলো বা করানো হলো।

২০২৪ সালে নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে দেশের বুকে গড়ে ওঠা বিশাল আন্দোলনকে দমন করে তিনি যখন তার মত করে নির্বাচন সম্পন্ন করতে সমর্থ হলেন, তখন গোটা আওয়ামী মহল মনে করলেন তারা অপারেজয় এবং তখন মামলাটা দ্রুত নিষ্পত্তি করে রায় বের করার জন্য তারা তোড়জোড় শুরু করলেন। আদালত কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করলে, নতুন করে আবার শুরু হ’ল আন্দোলন। আন্দোলনের শুরুতে সেøাগান শুনলামÑ কোটা না মেধা, মেধা মেধা। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই, শেখ হাসিনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি। দুই ছাত্র সমন্বয়ক, বর্তমানে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের এবং দক্ষিণাঞ্চলের ‘সিপাহসালার’ দুজনেই ছাত্রলীগের সাথেই ছিলেন। সারজিস আলম ছাত্রলীগের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে হল সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। হাসনাত আব্দুল্লাহ কোনো কমিটিতে না থাকলেও ফেসবুকে শেখ মুজিবের গুনগান করতেন। মুজিব শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর গুনগান করে তার লেখা ২০২০ সালের পত্রিকা ঘাটলেও পাওয়া যাবে। তাই আন্দোলনের শুরুতে তারা হয়তোবা এ ধরনের সেøাগান দিয়েছিলেন।

কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ‘অভিমানী সিদ্ধান্ত’। তাই আদালতের রায়ের পর ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে সরকার একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ নিতে থাকে। ছাত্রলীগকেও লাঠিসোটা দিয়ে নামানো হয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্র লীগের হামলায় আহত ছাত্রীদের রক্তাক্ত ছবি সারাদেশের ছাত্রছাত্রীদের আরো বিক্ষুব্ধ করে তোলে। আর রংপুরে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদকে টার্গেট করে একটার পর একটা গুলি করে হত্যার দৃশ্য প্রচারিত হওয়ার পর ছাত্রদের প্রতিবাদী আন্দোলনে যে যৌবন জল-তরঙ্গ সৃষ্টি হয় আমি ড্যামি ভোটের সরকার কি আর বালির বাঁধ দিয়ে তা রোধ করতে পারে! বরং রোধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে যেয়ে গুলিবিদ্ধ ‘পানিওয়ালা’ মুগ্ধ, রিকশার পা-দানিতে গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজ, পিতার বুকে গুলিবিদ্ধ শিশুর ছবিÑ বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার এক মহাপ্লাবন সৃষ্টি করে।

তাই তাকে বিদায় নিতে হলো। তিনি শেষ পর্যন্ত গেলেন, কিন্তু যাওয়ার আগে গোটা দেশকে রক্তাক্ত করে গেলেন। আর ১৫ বছর ধরে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বুলি আওড়িয়ে অবশেষে চুন কালি মেখে দিয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতির প্রতি এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক নিজের পিতার স্মৃতিও তা থেকে বাদ যায়নি।

স্বৈরাচারী শাসনের অবসান এবং তারুণ্যের জাগরনকে মানুষ ‘এসো আরম্ভ, এসো অমলিন সূচনা’ বলে স্বাগত জানায়; কিন্তু পতিত শাসকগোষ্ঠীর কর্মফল আর অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক বিকল্পের ক্ষেত্রে কার্যত এক শুন্যতা বিরাজ করায় বাংলাদেশের ইতিহাসকে যারা আবার নতুন করে পাকিস্তানি বয়ানে লিখতে চায় সেই গোষ্ঠীগুলোর উত্থান ঘটলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমের খাঁচায় ছাত্রলীগের আশ্রয়ে ঘাপটি মেরে থাকা উগ্রবাদীরা বেরিয়ে এসে এবং ধর্মীয় সেøাগানের আড়ালে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো। এক খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে তারা ঘৃণা, সংহিসতা, সাম্প্রদায়িকতা ও নারী বিদ্বেষের খাঁচায় ঢুকে পড়লো। মিথ্যা বয়ান ছড়িয়ে তারা যখন তখন মব উল্লোম্ফন শুরু করলো। সমন্বয়কদের একাংশও যুক্ত হয়ে পড়ল এ মবোল্লাসে। এত রক্ত, এত অশ্রু আর অসামান্য গৌরব গাঁথার বিনিময়ে যে অভ্যুত্থান সম্পন্ন হলো তাকে আবার আটকে ফেলা হলো কিছু উচ্চাভিলাষীর খাঁচায়।

কিন্তু এটা মনে রাখা প্রয়োজন জুলাই অভ্যুত্থান ছিল মূলত মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর বেদনার বহিঃপ্রকাশ। আর সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাতারে একজোট হয়ে দাঁড়ানোর অন্যতম কারণ ছিল, তারা মনে করেছিলেন এই আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক দলের খবরদারি বা স্বার্থান্বেষী ইন্ধন নেই। সেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই একটি নতুন রাজনৈতিক দলের ডাকে একইভাবে সাড়া দেবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই। বরং নতুন দলের কর্তাদের হাঁকডাক, জেদ দম্ভ, ক্রোধ প্রতিহিংসা এবং একাংশের মাঝে অর্থ বিত্ত, বাড়ী গাড়ি, ক্ষমতার লোভ দেখে তারা আশাহত। তাদের স্বপ্নগুলো সব ঝাপসা হয়ে গেছে।

কোটাবিরোধী আন্দোলন করে এনসিপি চক্রের এখন সব জায়গায় কোটা চাই। মন্ত্রী সভা, জাতীয় সংসদ, সচিবালয়, ব্যবসা, বানিজ্য,টেন্ডার বাণিজ্য, মামলা বানিজ্য সব জায়গায় কোটা চাই। সব চেয়ে দুঃখজনক বিষয় রাজনৈতিক পরিচয়হীন বা আন্দোলনের নেতাদের সংযোগ নেই এমন সাধারণ পরিবারের শহীদ বা আহতদের পরিবারের কেউ খোঁজখবর রাখেন না; কিন্তু একশ্রেণীর শহীদ এবং আহতদের নিয়ে একধরণের সিন্ডিকেট ব্যবসা গড়ে উঠেছে। শহীদ ও আহতদের তালিকা নিয়ে প্রতারনা, ভুয়া জুলাই যোদ্ধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকারও শহীদ পরিবারগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের বদলে এমন এমন উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যাতে করে শহীদ পরিবার সমূহ সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। উমামার ভাষ্য অনুযায়ী অভ্যুত্থানের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহতÑ এসব এখন বুলি মাত্র।

নতুন দলের কর্তারা এক সময় বলেছিলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির সাংগঠনিক কার্যক্রম থাকবেনা। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হবে; কিন্তু সবার আগে নতুন দল কৌশলে দুইটি ছাত্র সংগঠন দাঁড় করিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। একটি গনতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ এবং অপরটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সরাসরি এনসিপির ছাত্র শাখা এবং জুলাই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন বা আন্দোলনের সমর্থক কিন্তু দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে চান না এমন ছাত্রদেরকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সংগঠিত রাখার প্রয়াস হিসেবে এ সংগঠনটিও রাখা হয়েছে। দুটিই নিয়ন্ত্রিত হয় এনসিপি দল বা হেয়ার রোড থেকে।

এনসিপির রূপায়ন টাওয়ার তথা হেয়ার রোডের খাঁচায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বন্দি করার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন বনের পাখি উমামা। তিনি শিকল পরতে রাজি নন। তিনি আন্দোলনের মধ্যে থেকেই তার এক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন এ আন্দোলনে শুধু এনসিপি বা তাদের ছাত্র সংগঠন (প্রাক্তন ছাত্র শক্তি) নয়, ছাত্রলীগ বাদে সকল ছাত্র সংগঠন এ আন্দোলনের অংশীদার। আর সবচেয়ে বড় অংশীদার বনের পাখিরা যারা দলমতের বাইরে উড়ে এসেছিলো হাজারে হাজারে লাখে লাখে। এ আন্দোলনের অংশীদার শ্রমজীবী মানুষ যারা সেই বনের পাখিদের পাশে দাঁড়িয়ে রাজপথের প্রতিটি মোড়ে গড়ে তুলেছিলেন ব্যারিকেড। অংশীদার ছিলেন সেই সাহসী শিক্ষকরা যারা রাজপথে ব্যারিকেড হিসেবে দাঁড়িয়ে তাদের ছাত্রদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। অবশ্যই অংশীদার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যারা বিগত এক যুগের বেশি সময় ধরে গণতন্ত্র এবং অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য লড়াই করে আসছিলেন। ছাত্র নেতৃত্বের অনুরোধেই তো বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে জুলাই আন্দোলনে রাজপথে নামেন নাই। এ আন্দোলনের স্টেকহোল্ডার দেশের আপামর জনতা। এটা এনসিপি কুক্ষিগত করতে চাইলে ইতিহাসের বিকৃতি হবে।

তাই তো উমামা বলতে বাধ্য হয়েছেনÑ একটা শক্তিশালী চক্র অভ্যুত্থানকে বাজার দরে কেনা-বেচা করার চেষ্টা করছে। তাকে যেমন স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হয়নি, তেমনি স্বাধীনভাবে চলতে পারছে না ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। কার্যত এনসিপি সমর্থক আর কিছু শিবির সমর্থক বা মতালম্বী ছাড়া আর কেউ নেইও এখনকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে। তাহলে এনসিপি বা এখনকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিভাবে জুলাই সনদ ঘোষণা করবে। জুলাই তো তাদের একার নয়। জুলাই সনদ করতে হলে তো সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে করতে হবে। এনসিপির প্রতিনিধিরা উপদেষ্টা পরিষদে আছেন বিধায় তারা জোর করে বনের পাখিদের খাঁচায় পুরবেন বাঁ পায়ে শিকল পরাবেন!

পরিস্থিতিা বোধহয় আর এখন এনসিপি ও তার মিত্রদের অনুকূলে ততটা নেই। এই আবেগের জুলাই মাসেও মাঠে নেমে এনসিপি সেটা বুঝতে পারছে। তারা বুঝতে পারছে মাস দেড়েক আগে সারজিস আলমের ‘জামানত নিয়ে উচ্চারিত ভবিষ্যদ্বাণীর’ বাস্তবতা রয়েছে। তাই তারা এখন প্রতিটি পথসভায় হুমকি দিচ্ছেনÑ সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ছাড়া এনসিপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না; কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থান-গাথার নায়ক তো বনের পাখিরা। তারা ‘শিকলে ধরা নাহি দিবে’!

[লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা]

back to top