alt

উপ-সম্পাদকীয়

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

শাহরীনা আখতার

: বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশ; যে ভূখ- একসময় বর্ষা, ধান আর সোনালি ফসলের প্রতিচ্ছবি ছিল, আজ এক ভয়াবহ জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি। ঋতুচক্রের চরম পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, নদীর নাব্য হ্রাস, লবণাক্ততার বিস্তার ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোতে প্রতিনিয়ত দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন প্রতিকূলতা। উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ২.৮৫ মিলিয়ন হেক্টর আবাদি জমির অর্ধেকের বেশি এখন লবণাক্ততায় আক্রান্ত, যা ২০৫০ সালের মধ্যে আরও ২৬% বাড়তে পারে। ২০২৩ সালে দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকায় সেচের পানি না থাকায় বোরো মৌসুমে চাষই হয়নি, যা এক যুগ আগেও ছিল অকল্পনীয়। জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৮০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ ১ মিটার বাড়লে দেশের ১২-১৬% ভূমি হারিয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানির সংকটে ভুগছে, যা ২০৮০ সালে দাঁড়াতে পারে ১৪.৮ মিলিয়নে। ফসলের ক্ষয়, কৃষকের ক্ষতি : উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা ও উর্বরতা হ্রাসের কারণে ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, কিছু উপজেলায় এই হার ১৫.৬% পর্যন্ত। বারিশাল ও চট্টগ্রামে ক্ষতির হার যথাক্রমে ১০.৫% ও ৭.৫%। ২০১০ সাল থেকে ১০ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি উর্বরতা হারিয়েছে। মাত্র ২ সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধিই উপকূলের ১৬% জমিকে নোনা করে তুলতে পারে, যা ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত। ২০২৪ সালের অক্টোবরে আকস্মিক বন্যায় ভেসে যায় ১১ লাখ টন ধান, যা জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৩%। এই বিপর্যয়ের আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ বিলিয়ন টাকা, যা শুধু কৃষকের ঘরে নয়, দেশের খাদ্যনিরাপত্তায়ও বড় ধাক্কা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই আমন ধানের ফলন হেক্টরপ্রতি ২.৯ থেকে ৫৩ কেজি পর্যন্ত কমে যেতে পারে, যা ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা।

এ সংকট শুধু ফসলের ক্ষয়েই সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবিকায়ও। খুলনা অঞ্চলে ৩৭% পরিবারে লবণাক্ত পানির কারণে দেখা দিয়েছে হালকা প্রোটিন ইউরিয়া, আর দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্তের হার পৌঁছেছে ২২%, যা বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ। কৃষি এখন আর শুধু উৎপাদনের প্রশ্ন নয়, এটি হয়ে উঠেছে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখার লড়াই।

অভিযোজনের প্রযুক্তি বিপ্লব : বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) উদ্ভাবন করেছে ১১৫টির বেশি ধানের জাত, যার মধ্যে ২০টির বেশি লবণসহিষ্ণু এবং ১৫টির বেশি তাপসহিষ্ণু। জিন-সম্পাদিত হাইব্রিড জাত যেমন- BRRI dhan-১০২ ও ১০৫ ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের চরম আবহাওয়ায় টিকে থাকার সম্ভাবনা জাগায়। পাশাপাশি, ফার্টিলাইজার ডিপ প্লেসমেন্ট (FDP) প্রযুক্তি ২৫ লাখ কৃষকের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এতে ফলন বেড়েছে ৩৬%, নাইট্রোজেন ক্ষরণ কমেছে ৪০%, এবং বছরে সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ২৯ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, অভিযোজনকে মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দিতে কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা। BRAC পরিচালিত অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক ইতোমধ্যে ৩৭,০০০ উপকূলীয় পরিবারকে সহনশীল বীজ ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছে। ‘সাসটেইনেবল অ্যাগ্রিকালচার’ প্রকল্পের আওতায় ১৬,০০০ কৃষক ২০০টির বেশি অ্যাগ্রো-হাবে ২০৯ টন নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০২৩ সালে ১.২ মিলিয়ন কৃষককে অভিযোজন কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যা অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে একটি বড় অগ্রগতি।

নারী ও তরুণের অভিযোজন নেতৃত্ব : CARE-এর পাইলট প্রকল্পে বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের নারীদের জন্য চালু হয়েছে জলবায়ু ঝুঁকিভিত্তিক বীমা, যা তাদের আর্থিক নিরাপত্তা ও অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। বর্তমানে নারী কৃষকের অংশগ্রহণ ৪৩% ছাড়িয়েছে, এবং অনেকেই জলবায়ু- সহনশীল কৃষি উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একইসঙ্গে, তরুণ উদ্যোক্তারা গড়ে তুলছেন ক্লাইমেট-স্মার্ট অ্যাগ্রো-স্টার্টআপ, যেমন হাইড্রোপনিক্স, ভার্টিকাল ফার্মিং ও অ্যাগ্রো-ড্রোন প্রযুক্তি, যা কৃষিকে আরও টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর ও ভবিষ্যতমুখী করে তুলছে। নারী ও তরুণদের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ অভিযোজনকে সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিচ্ছে।

তথ্য ও পূর্বাভাসের শক্তি : ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে স্যাটেলাইটচালিত খরা পূর্বাভাস প্রযুক্তির মাধ্যমে, যা ইতোমধ্যে ৩৮ জেলায় চালু হয়েছে। পাশাপাশি, তৈরি হচ্ছে ‘বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল নলেজ গ্রাফ’, একটি FAIR কমপ্লায়েন্ট তথ্যভা-ার, যেখানে জলবায়ু নির্গমন, ফলন, মাটি ও বন ব্যবস্থাপনার তথ্য একত্রিত হচ্ছে। এই প্ল্যাটফর্ম কৃষি গবেষণা, নীতি প্রণয়ন ও মাঠপর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। একইসঙ্গে, প্রাথমিক পর্যায়ের মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকদের জন্য রোগ শনাক্তকরণ, ফলন পূর্বাভাস ও সার ব্যবস্থাপনায় উপদেষ্টা সেবা দেয়া হচ্ছে।

২০২৪ সালে কৃষি তথ্য সার্ভিসের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ৫.৬ মিলিয়ন কৃষক সক্রিয় ব্যবহারকারী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। কৃষি আবহাওয়া অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিদিন ১.২ মিলিয়ন কৃষক আবহাওয়া, সেচ, বীজ ও চাষাবাদ-সংক্রান্ত আপডেট পাচ্ছেন। এই প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা কৃষকদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন পরিকল্পনা ও বাজার সংযোগে সহায়তা করছে, যা অভিযোজন সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। অভিযোজনের অর্জন : ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৯ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন করেছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে যথেষ্ট। এই উৎপাদন সক্ষমতা প্রমাণ করে যে, জলবায়ু সংকটের মধ্যেও কৃষি খাত অভিযোজনের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ধান আমদানির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, ২০২১ সালে যেখানে আমদানি ছিল ২.৬৫ মিলিয়ন টন, ২০২৩ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ মিলিয়নে। এটি শুধু খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকেই নয়, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের ক্ষেত্রেও একটি বড় অর্জন।

অন্যদিকে, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার মতো উপকূলীয় অঞ্চলে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সবজি, ফলমূল ও তেলবীজ উৎপাদনে ১১–৫০% পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। এই বহুমুখীকরণ ধান-নির্ভরতা কমিয়ে কৃষিকে আরও পুষ্টিকর, লাভজনক ও জলবায়ু সহনশীল করে তুলেছে। বিশেষ করে, লবণাক্ত জমিতে লাউ, তিল, সূর্যমুখী ও কচুর মতো ফসলের চাষ কৃষকদের জন্য বিকল্প আয়ের পথ খুলে দিয়েছে। এই পরিবর্তন শুধু উৎপাদনের পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি কৃষকের জীবিকায় স্থিতিশীলতা, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং বাজার সংযোগেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বহুমুখীকরণ কৌশল কৃষিকে একক ফসলের ঝুঁকি থেকে মুক্ত করে তুলেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় একটি কার্যকর প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, অভিযোজন শুধু প্রতিক্রিয়া নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত বিনিয়োগ।

অভিযোজনই নেতৃত্ব : বাংলাদেশের কৃষি অভিযোজন এখন আর কেবল প্রতিক্রিয়া নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি কৌশলগত রূপান্তরের রূপরেখা। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে কৃষি খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন একটি সমন্বিত ‘জাতীয় কৃষি অভিযোজন কাঠামো’, যার নেতৃত্বে থাকবে একটি শক্তিশালী কাউন্সিল। এই কাঠামোর মাধ্যমে সরকার-বেসরকারি খাত, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগীরা একসঙ্গে কাজ করবে। তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত, প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্বকে একসূত্রে গাঁথতে হবে।

নারী ও তরুণদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক বীমা ও ঋণসুবিধা, এবং কৃষি সম্প্রসারণ, গবেষণা ও বাজার সংযোগের মধ্যে কার্যকর সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে হবে। বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক অভিযোজন কেবল পরিবেশ রক্ষা নয়, এটি একটি সামাজিক ন্যায্যতার প্রশ্নও। হাওর, বন ও উপকূলীয় অঞ্চলে পুনঃবনায়নের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার ও কমিউনিটি টেন্যুর নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা প্রকৃতির সহাবস্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। ধান-নির্ভরতা কমিয়ে ডাল, শাকসবজি ও প্রাণিসম্পদে গবেষণা ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যা খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিবৈচিত্র্য নিশ্চিত করবে। এই বহুমুখীকরণ কৌশল কৃষিকে আরও টেকসই, লাভজনক ও জলবায়ু-সহনশীল করে তুলবে। অভিযোজন নীতির কেন্দ্রে রাখতে হবে জেন্ডার ও তরুণদের তথ্যভিত্তিক অন্তর্ভুক্তি, যাতে তদারকি হয় আরও কার্যকর, ন্যায্য ও টেকসই। বাংলাদেশ এখন শুধু টিকে থাকার লড়াই করছে না, বরং উদ্ভাবনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কৃষকের হাতে প্রযুক্তি, মাঠে গবেষণার ফল, আর তথ্যের শক্তি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ হচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ হতে পারে বৈশ্বিক অভিযোজন নীতির পথপ্রদর্শক। প্রতিটি দুর্যোগ তখন একেকটি সম্ভাবনার বীজ হয়ে উঠবে, আর অভিযোজন হবে শুধু প্রতিরক্ষা নয়, ভবিষ্যতের জন্য একটি সাহসী বিনিয়োগ।

[লেখক : টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ও রিসার্চ অ্যাডভাইজার, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

শাহরীনা আখতার

বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশ; যে ভূখ- একসময় বর্ষা, ধান আর সোনালি ফসলের প্রতিচ্ছবি ছিল, আজ এক ভয়াবহ জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি। ঋতুচক্রের চরম পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, নদীর নাব্য হ্রাস, লবণাক্ততার বিস্তার ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোতে প্রতিনিয়ত দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন প্রতিকূলতা। উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ২.৮৫ মিলিয়ন হেক্টর আবাদি জমির অর্ধেকের বেশি এখন লবণাক্ততায় আক্রান্ত, যা ২০৫০ সালের মধ্যে আরও ২৬% বাড়তে পারে। ২০২৩ সালে দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকায় সেচের পানি না থাকায় বোরো মৌসুমে চাষই হয়নি, যা এক যুগ আগেও ছিল অকল্পনীয়। জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৮০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ ১ মিটার বাড়লে দেশের ১২-১৬% ভূমি হারিয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানির সংকটে ভুগছে, যা ২০৮০ সালে দাঁড়াতে পারে ১৪.৮ মিলিয়নে। ফসলের ক্ষয়, কৃষকের ক্ষতি : উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা ও উর্বরতা হ্রাসের কারণে ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, কিছু উপজেলায় এই হার ১৫.৬% পর্যন্ত। বারিশাল ও চট্টগ্রামে ক্ষতির হার যথাক্রমে ১০.৫% ও ৭.৫%। ২০১০ সাল থেকে ১০ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি উর্বরতা হারিয়েছে। মাত্র ২ সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধিই উপকূলের ১৬% জমিকে নোনা করে তুলতে পারে, যা ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত। ২০২৪ সালের অক্টোবরে আকস্মিক বন্যায় ভেসে যায় ১১ লাখ টন ধান, যা জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৩%। এই বিপর্যয়ের আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ বিলিয়ন টাকা, যা শুধু কৃষকের ঘরে নয়, দেশের খাদ্যনিরাপত্তায়ও বড় ধাক্কা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই আমন ধানের ফলন হেক্টরপ্রতি ২.৯ থেকে ৫৩ কেজি পর্যন্ত কমে যেতে পারে, যা ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা।

এ সংকট শুধু ফসলের ক্ষয়েই সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবিকায়ও। খুলনা অঞ্চলে ৩৭% পরিবারে লবণাক্ত পানির কারণে দেখা দিয়েছে হালকা প্রোটিন ইউরিয়া, আর দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্তের হার পৌঁছেছে ২২%, যা বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ। কৃষি এখন আর শুধু উৎপাদনের প্রশ্ন নয়, এটি হয়ে উঠেছে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখার লড়াই।

অভিযোজনের প্রযুক্তি বিপ্লব : বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) উদ্ভাবন করেছে ১১৫টির বেশি ধানের জাত, যার মধ্যে ২০টির বেশি লবণসহিষ্ণু এবং ১৫টির বেশি তাপসহিষ্ণু। জিন-সম্পাদিত হাইব্রিড জাত যেমন- BRRI dhan-১০২ ও ১০৫ ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের চরম আবহাওয়ায় টিকে থাকার সম্ভাবনা জাগায়। পাশাপাশি, ফার্টিলাইজার ডিপ প্লেসমেন্ট (FDP) প্রযুক্তি ২৫ লাখ কৃষকের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এতে ফলন বেড়েছে ৩৬%, নাইট্রোজেন ক্ষরণ কমেছে ৪০%, এবং বছরে সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ২৯ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, অভিযোজনকে মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দিতে কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা। BRAC পরিচালিত অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক ইতোমধ্যে ৩৭,০০০ উপকূলীয় পরিবারকে সহনশীল বীজ ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছে। ‘সাসটেইনেবল অ্যাগ্রিকালচার’ প্রকল্পের আওতায় ১৬,০০০ কৃষক ২০০টির বেশি অ্যাগ্রো-হাবে ২০৯ টন নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০২৩ সালে ১.২ মিলিয়ন কৃষককে অভিযোজন কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যা অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে একটি বড় অগ্রগতি।

নারী ও তরুণের অভিযোজন নেতৃত্ব : CARE-এর পাইলট প্রকল্পে বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের নারীদের জন্য চালু হয়েছে জলবায়ু ঝুঁকিভিত্তিক বীমা, যা তাদের আর্থিক নিরাপত্তা ও অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। বর্তমানে নারী কৃষকের অংশগ্রহণ ৪৩% ছাড়িয়েছে, এবং অনেকেই জলবায়ু- সহনশীল কৃষি উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একইসঙ্গে, তরুণ উদ্যোক্তারা গড়ে তুলছেন ক্লাইমেট-স্মার্ট অ্যাগ্রো-স্টার্টআপ, যেমন হাইড্রোপনিক্স, ভার্টিকাল ফার্মিং ও অ্যাগ্রো-ড্রোন প্রযুক্তি, যা কৃষিকে আরও টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর ও ভবিষ্যতমুখী করে তুলছে। নারী ও তরুণদের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ অভিযোজনকে সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিচ্ছে।

তথ্য ও পূর্বাভাসের শক্তি : ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে স্যাটেলাইটচালিত খরা পূর্বাভাস প্রযুক্তির মাধ্যমে, যা ইতোমধ্যে ৩৮ জেলায় চালু হয়েছে। পাশাপাশি, তৈরি হচ্ছে ‘বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল নলেজ গ্রাফ’, একটি FAIR কমপ্লায়েন্ট তথ্যভা-ার, যেখানে জলবায়ু নির্গমন, ফলন, মাটি ও বন ব্যবস্থাপনার তথ্য একত্রিত হচ্ছে। এই প্ল্যাটফর্ম কৃষি গবেষণা, নীতি প্রণয়ন ও মাঠপর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। একইসঙ্গে, প্রাথমিক পর্যায়ের মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকদের জন্য রোগ শনাক্তকরণ, ফলন পূর্বাভাস ও সার ব্যবস্থাপনায় উপদেষ্টা সেবা দেয়া হচ্ছে।

২০২৪ সালে কৃষি তথ্য সার্ভিসের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ৫.৬ মিলিয়ন কৃষক সক্রিয় ব্যবহারকারী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। কৃষি আবহাওয়া অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিদিন ১.২ মিলিয়ন কৃষক আবহাওয়া, সেচ, বীজ ও চাষাবাদ-সংক্রান্ত আপডেট পাচ্ছেন। এই প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা কৃষকদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন পরিকল্পনা ও বাজার সংযোগে সহায়তা করছে, যা অভিযোজন সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। অভিযোজনের অর্জন : ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৯ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন করেছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে যথেষ্ট। এই উৎপাদন সক্ষমতা প্রমাণ করে যে, জলবায়ু সংকটের মধ্যেও কৃষি খাত অভিযোজনের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ধান আমদানির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, ২০২১ সালে যেখানে আমদানি ছিল ২.৬৫ মিলিয়ন টন, ২০২৩ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ মিলিয়নে। এটি শুধু খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকেই নয়, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের ক্ষেত্রেও একটি বড় অর্জন।

অন্যদিকে, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার মতো উপকূলীয় অঞ্চলে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সবজি, ফলমূল ও তেলবীজ উৎপাদনে ১১–৫০% পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। এই বহুমুখীকরণ ধান-নির্ভরতা কমিয়ে কৃষিকে আরও পুষ্টিকর, লাভজনক ও জলবায়ু সহনশীল করে তুলেছে। বিশেষ করে, লবণাক্ত জমিতে লাউ, তিল, সূর্যমুখী ও কচুর মতো ফসলের চাষ কৃষকদের জন্য বিকল্প আয়ের পথ খুলে দিয়েছে। এই পরিবর্তন শুধু উৎপাদনের পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি কৃষকের জীবিকায় স্থিতিশীলতা, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং বাজার সংযোগেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বহুমুখীকরণ কৌশল কৃষিকে একক ফসলের ঝুঁকি থেকে মুক্ত করে তুলেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় একটি কার্যকর প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, অভিযোজন শুধু প্রতিক্রিয়া নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত বিনিয়োগ।

অভিযোজনই নেতৃত্ব : বাংলাদেশের কৃষি অভিযোজন এখন আর কেবল প্রতিক্রিয়া নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি কৌশলগত রূপান্তরের রূপরেখা। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে কৃষি খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন একটি সমন্বিত ‘জাতীয় কৃষি অভিযোজন কাঠামো’, যার নেতৃত্বে থাকবে একটি শক্তিশালী কাউন্সিল। এই কাঠামোর মাধ্যমে সরকার-বেসরকারি খাত, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগীরা একসঙ্গে কাজ করবে। তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত, প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্বকে একসূত্রে গাঁথতে হবে।

নারী ও তরুণদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক বীমা ও ঋণসুবিধা, এবং কৃষি সম্প্রসারণ, গবেষণা ও বাজার সংযোগের মধ্যে কার্যকর সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে হবে। বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক অভিযোজন কেবল পরিবেশ রক্ষা নয়, এটি একটি সামাজিক ন্যায্যতার প্রশ্নও। হাওর, বন ও উপকূলীয় অঞ্চলে পুনঃবনায়নের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার ও কমিউনিটি টেন্যুর নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা প্রকৃতির সহাবস্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। ধান-নির্ভরতা কমিয়ে ডাল, শাকসবজি ও প্রাণিসম্পদে গবেষণা ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যা খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিবৈচিত্র্য নিশ্চিত করবে। এই বহুমুখীকরণ কৌশল কৃষিকে আরও টেকসই, লাভজনক ও জলবায়ু-সহনশীল করে তুলবে। অভিযোজন নীতির কেন্দ্রে রাখতে হবে জেন্ডার ও তরুণদের তথ্যভিত্তিক অন্তর্ভুক্তি, যাতে তদারকি হয় আরও কার্যকর, ন্যায্য ও টেকসই। বাংলাদেশ এখন শুধু টিকে থাকার লড়াই করছে না, বরং উদ্ভাবনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কৃষকের হাতে প্রযুক্তি, মাঠে গবেষণার ফল, আর তথ্যের শক্তি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ হচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ হতে পারে বৈশ্বিক অভিযোজন নীতির পথপ্রদর্শক। প্রতিটি দুর্যোগ তখন একেকটি সম্ভাবনার বীজ হয়ে উঠবে, আর অভিযোজন হবে শুধু প্রতিরক্ষা নয়, ভবিষ্যতের জন্য একটি সাহসী বিনিয়োগ।

[লেখক : টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ও রিসার্চ অ্যাডভাইজার, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

back to top