alt

উপ-সম্পাদকীয়

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

নিরাপদ পরিবেশের আওতায় যে সমস্ত অনুষঙ্গের কথা আমরা মনে করতে পারি তা হচ্ছে সুন্দর স্বাস্থ্য রক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার পরিবেশ, চলাচলের পরিবেশ, কাজের পরিবেশ, ভ্রমণের পরিবেশ, বসবাসের পরিবেশ, বিনোদনের পরিবেশ, খেলাধুলার পরিবেশ, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ, শিল্প-কলকারখানার অবকাঠামোগত পরিবেশ, রাস্তাঘাটের অবকাঠামোগত পরিবেশ, খাল নদী-নালার পরিবেশ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিবেশ, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার পরিবেশ। বর্ণিত বিষয়গুলো প্রতিটিতেই নিরাপত্তাজনিত সমস্যা বিদ্যমান থেকে ঢাকার জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে।

ঢাকার পরিবেশের সুরক্ষায় বুড়িগঙ্গা নদীর ভূমিকা অপরিসীম। বুড়িগঙ্গা নদীকে একসময় ঢাকা শহরের প্রাণ বলে ধরা হতো, কিন্তু বর্তমানে এটি দূষণ এবং দখলের শিকার। নদীটিকে বাঁচাতে হলে এর দূষণ রোধ করা এবং অবৈধ দখলদারিত্ব বন্ধ করা প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা নদীকে তার আগের রূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বুড়িগঙ্গা নদী ঢাকার পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু একটি নদী নয়, এটি ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। একসময় বুড়িগঙ্গা ছিল স্বচ্ছ পানির ধারা, যেখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত এবং এটি ছিল পাখিদের অভয়ারণ্য; কিন্তু বর্তমানে এটি শিল্প-কারখানার বর্জ্য, পয়ঃনিষ্কাশন এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থের কারণে দূষিত হচ্ছে। বস্তুত বুড়িগঙ্গাভিত্তিক ঢাকা শহরের বিকাশ যখন থেকে শুরু, তখন থেকে দূষণের ইতিহাসও শুরু।

ঢাকার সঙ্গে যে নদীটির নাম জড়িয়ে আছে, তা বুড়িগঙ্গা। এই শহর ও নদীটির অধঃপতন যেন পাল্লা দিয়ে চলছে। বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অনুপযুক্ত কয়েকটি শহরের মধ্যে আছে ঢাকা, আর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকার নদী বুড়িগঙ্গা। টেক্সটাইলস কারখানা থেকে শুরু করে সব ধরনের কলকারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য, পচা ফলমূল থেকে শুরু করে শাকসবজি, হাসপাতালের বর্জ্য, সুয়ারেজের বর্জ্য, মরা প্রাণী, প্লাস্টিকের বর্জ্য ও পেট্রোলিয়ামÑ কোনো কিছুই বাদ নেই।

প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় ৪ হাজার ৫০০ টন বর্জ্য এসে পড়ে। নদীতে সুয়ারেজের যে বর্জ্য ফেলা হয়, তার ৮০ শতাংশই কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়া বুড়িগঙ্গায় মেশে।বুড়িগঙ্গা কেন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর একটি, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার। আমরা যদি বুড়িগঙ্গাকে ভাগাড় বানাই, তবে তা-ই তো হওয়ার কথা। পাঁচ বছর আগের তুলনায় বুড়িগঙ্গায় দূষণের মাত্রা যেহেতু বেড়েছে, ফলে বুঝতে হবে যে এই সময়ে দূষণ দূর করার যেসব উদ্যোগ ও কথাবার্তা আমরা শুনেছি, তা কাজে দেয়নি। বরং বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলার পরিমাণ দিনে দিনে বেড়েছে। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, নদী রক্ষা করা ও দূষণমুক্ত করা সেসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার দায়িত্ব, তাদের বিরুদ্ধেই নদীদূষণের অভিযোগ রয়েছে। ওয়াসা বা সিটি করপোরেশনের ময়লা যদি নদীতে গিয়ে পড়ে, তবে নদী রক্ষা পাবে কিভাবে? ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোর নদীতে যেসব কলকারখানার বর্জ্য মেলে, সেগুলোতে আইন অনুযায়ী পরিশোধনযন্ত্র বা ইটিপি থাকার কথা। কিছু কারাখানায় তা বসানো হলেও সব সময়ে তা চালু থাকে না। এসব দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের। সেই কাজটি যথাযথভাবে পলিত হলে বুড়িগঙ্গার দশা দিনে দিনে খারাপ হতো না।

রাজধানীর যেসব নদী ও খাল দূষিত হচ্ছে, সেগুলো হলো বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু নদ, রামপুরা খাল, কল্যাণপুর খাল, বেগুনবাড়ী খাল, ভাটারা খাল, হাজারীবাগ খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, বাড্ডা খাল, আদি বুড়িগঙ্গা ও রূপনগর খাল। নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে ঢাকা জেলার নদনদী, খালবিল দূষণকারীদের তালিকা চাওয়া হয় ২০২১ সালের নভেম্বর। এক মাস পর পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার খাল ও নদনদী দূষণকারীদের তালিকা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে প্রাথমিকভাবে দূষণের ২৮০টি উৎস চিহ্নিত করা হয়। সেখানে দেখা যায়, শিল্পবর্জ্যের পাশাপাশি রাজধানীর হাসপাতালের তরল বর্জ্যও পড়ছে খাল ও নদীতে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত ২৮০টি উৎস মধ্যে ২২০টিই ছিল হাসপাতাল। নদী দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, কারখানাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই টেক্সটাইল ডাইং এবং প্রিন্টিং, ওয়াশিং, মেটাল, আইসক্রিম কারখানা। এছাড়া রয়েছে ওষুধ উৎপাদন কারখানা, সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, বেসরকারি ডায়াগনিস্টিক সেন্টার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোয় ইটিপি নেই বললেই চলে। পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারি হাসপাতালে ইটিপি বা ছাড়পত্র নেওয়ার বিষয়ে সংস্থাটির পক্ষ থেকে কঠোর অনুশাসন পতিপালন করা হয়না। মূলত হাসপাতাল বিবেচনায় এ বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় রাজধানীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটি বড় নদী। অপরিকল্পিত নগরায়ণে হারিয়ে গেছে অনেক খাল ও উল্লেখযোগ্য নদনদী। এক্ষেত্রে হাসপাতাল হোক বা কারখানা নদীদূষণের ক্ষেত্রে যাদেরই নাম আসে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

পরিবেশের সব ধরনের দূষণ যেন জীবনযাপনের নিত্যদিনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। ঢাকাবাসীর জীবনে দূষণকে সাধারণ সংস্কৃতির অংশ বললেও অত্যুক্তি হবে না! নীতিনির্ধারক থেকে সাধারণ নগরবাসী দূষণ নিয়ে যেন কারোরই কোনো বিকার নেই। ঢাকাকে ব্যবহার করে সবাই যেন নিজেদের আখের গোছাতে চায়, কিন্তু শহরটার বাসযোগ্যতার কথা কেউ ভাবেনা! বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, নদী-খাল দূষণ, প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ, পানিদূষণ, বর্জ্যদূষণ, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যায় জর্জরিত রাজধানী ঢাকা শহর। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যার দখল-দূষণরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও দখল-দূষণ থেমে নেই। নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রকৃতি-প্রতিবেশ ব্যবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। শহরের অভ্যন্তরের খালগুলোও দখলÑ দখলের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না।

একসময় ঢাকা শহরের মধ্যে ৫৪টিরও বেশি খাল ছিল। অধিকাংশ খাল দখল ও বর্জ্য-আবর্জনায় ভরাট হয়ে হারিয়ে গেছে। এখন কোনো রকমে ২৩টির মতো খালের অস্তিত্ব আছে। এগুলোও ব্যাপক দখল ও দূষণে জর্জরিত। খালগুলোর সাথে আশপাশের নদ-নদীর সংযোগ কাটা পড়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে। ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে চলে যাচ্ছে। তাই আগামী দিনগুলোতে নদ-নদীর উপরিভাগের পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়। তাই ঢাকার আশপাশের নদ-নদীগুলো দূষণ ও দখলমুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

শিল্পকারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও মানববর্জ্যরে দূষণে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের অন্যান্য নদ-নদীর পানি কালো হয়ে গেছে। তাই নদী-খাল রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে। পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ‘নিষিদ্ধ’ করা হলেও এর জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি। অবশ্য পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ও কাগজের ব্যাগ সহজলভ্য না করার কারণে পলিথিন দূষণ থামছে না! সহজে ব্যবহারযোগ্য ও ক্রেতার জন্য বিনা ফিতে পাওয়া পলিথিন পরিবেশের অন্যতম প্রধান শত্রু। অপচনশীল এই পলিথিন ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার ক্ষতিসহ সার্বিক পরিবেশ ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনি এমনি এই পলিথিন দূষণ বন্ধ হবে বলে মনে হয় না। পলিথিন উৎপাদন ও বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক অভিযান চলমান রাখতে হবে। পাশাপাশি জনসাধারণ পর্যায়ে পলিথিনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ব্যাপক সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার বাজার ও সব ধরনের দোকানে বিক্রেতা পর্যায়ে অভিযান চালাতে হবে। এ ছাড়া সারা দেশব্যাপী বাজার ও দোকানগুলোতেও অভিযান চলমান রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, বিক্রেতারা যদি পলিথিনে পণ্য ও মালামাল না দেয় তাহলে ক্রেতাদেরও কাছে পলিথিন কখনো পৌঁছাবে না। পাশাপাশি পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ জনপ্রিয় করতে শুরুর দিকে এর ওপর ব্যাপক ভর্তুকি দিতে হবে। পাটের ব্যাগ সহজলভ্য ও চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেওয়া সম্ভব হলে রুগ্ন পাটশিল্প বাঁচবে, পরিবেশও রক্ষা পাবে।

বিশে^র অন্যতম বায়ুদূষণের শহর মেগাসিটি ঢাকা। বিশ^ব্যাংকের সম্প্রতি এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে ক্ষতি হয় প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। আধুনিক ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না তোলার ফলে ময়লা-আবর্জনা রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। ঢাকা শহরে সড়কের সাথেই গড়ে উঠেছে ময়লা-আবর্জনা রাখার স্থান বা ‘সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন’ (এসটিএস)। ফলে চলতে-ফিরতে বর্জ্য দূষণের শিকার হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। সব ধরনের বর্জ্য একসাথে সংগ্রহ না করে আলাদা আলাদা করে সংগ্রহ করা হলে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, আঠা, সার ও অন্যান্য বিকল্প অনেক কিছু তৈরি করা সম্ভব। এ শহরটাকে পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত করে গড়ে তোলার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সবার। ইপিএ-এর প্রতিবেদন অনুসারে, পরিবেশ দূষণ রোধে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯তম। প্রতিবছর ঘটা করে পরিবেশ দিবস পালন করা হয়, পরিবেশ নিয়ে কত-শত আলোচনা ও উদ্যোগের কথা শোনা যায়। প্রশ্ন হলো, আসলে কি পরিবেশ দূষণ কমছে, পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে? এভাবে দিনের পর দিন পরিবেশ দূষণ করতে করতে আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদেরই খুন করছি না তো? পরিবেশ ধ্বংস করতে করতে এমন একটা সময় আসবে যখন থাকবে শুধু অপরিকল্পিত উন্নয়ন, দূষণ আর রোগগ্রস্ত জীবন। তখন কোনো কিছুর বিনিময়ে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা ও সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব হবে না!

ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ রক্ষায় বুড়িগঙ্গা নদীর ভূমিকা অপরিসীম। অথচ এই বুড়িগঙ্গা নদীকেই এখন ঢাকার দুঃখ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এবং ঢাকার পরিবেশ দুষণে বিভিন্ন দূষণ অনুষঙ্গের মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর প্রভাবশীর্ষ তালিকাতে এবং ঢাকা মহানগরীর অবস্থা বিশ্বের পরিবেশ দূষণকারী প্রথম ১০টি নগরের তালিকায় হিসাবভুক্ত বলে বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে হলে প্রথমেই বুড়িগঙ্গা পাড়ের বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়া ঢাকা শহরের চারপাশে বিভিন্ন ছোট ছোট নদী ও খাল সংষ্কারপূর্বক বাধ সৃষ্টি করে বাঁধের দুই পাড়কে সবুজায়নের ভূমিকা নিতে হবে। ঢাকা শহরের ভিতরে প্রবেশকারী ছোট ছোট খাল যা এখন বিলুপ্তপ্রায় তার অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন বিভাগের সাথে সমন্বিত কাজের অংশ হিসেবে শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে সকল স্কুল কলেজে পরিবেশ শিক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে এবং তাদের বাস্তব ব্যবহারিক জ্ঞানের মহড়ার মাধ্যমে তাদের কাজের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ফ্যাকালটির আওতায় বিভিন্ন বিভাগে অধ্যায়নরত উচ্চ শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। অধিকন্তু বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শিল্প কলকারখানা সরিয়ে ফেলতে হবে। অথবা প্রতিটি কলকারখানায় ইটিপি স্থাপনকে আবশ্যিক করতে হবে। সর্বোপরি সার্বিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারকে সুষ্ঠু সঠিক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, মহানগর ঢাকাকে সাজাতে হলে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হবে। ঢাকার বিকাশ ও সভ্যতা বিনির্মাণে পরিবেশের ভূমিকাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ লক্ষ্যে বুড়িগঙ্গার শাসন ও সংস্কার কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। অধিকন্তু পরিবেশের এ বিপর্যয় রোধ করার লক্ষ্যে পরিবেশ বান্ধব বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে বাস্তবমুখী সফল কার্যক্রম গ্রহণ করে পরিবেশের প্রতি একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে এবং পরিবেশ সুরক্ষার কাজকে একটি আন্দোলনে রূপান্তর করতে হবে। ঢাকা মাহানগরবাসীরা এক মহা আতঙ্কের মধ্যে পরে এক দূর্যোগময় ও দুঃসহ জীবন যাপনের শিকার হয়েছে। এই অবস্থা নিরসনকল্পে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণে মনযোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে সব সরকারি-বেসরকারি, এনজিও প্রতিনিধিকে সমন্বিত কর্মসূচি প্রণয়নপূর্বক তার যথাযথ বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

নিরাপদ পরিবেশের আওতায় যে সমস্ত অনুষঙ্গের কথা আমরা মনে করতে পারি তা হচ্ছে সুন্দর স্বাস্থ্য রক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার পরিবেশ, চলাচলের পরিবেশ, কাজের পরিবেশ, ভ্রমণের পরিবেশ, বসবাসের পরিবেশ, বিনোদনের পরিবেশ, খেলাধুলার পরিবেশ, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ, শিল্প-কলকারখানার অবকাঠামোগত পরিবেশ, রাস্তাঘাটের অবকাঠামোগত পরিবেশ, খাল নদী-নালার পরিবেশ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিবেশ, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার পরিবেশ। বর্ণিত বিষয়গুলো প্রতিটিতেই নিরাপত্তাজনিত সমস্যা বিদ্যমান থেকে ঢাকার জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে।

ঢাকার পরিবেশের সুরক্ষায় বুড়িগঙ্গা নদীর ভূমিকা অপরিসীম। বুড়িগঙ্গা নদীকে একসময় ঢাকা শহরের প্রাণ বলে ধরা হতো, কিন্তু বর্তমানে এটি দূষণ এবং দখলের শিকার। নদীটিকে বাঁচাতে হলে এর দূষণ রোধ করা এবং অবৈধ দখলদারিত্ব বন্ধ করা প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা নদীকে তার আগের রূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বুড়িগঙ্গা নদী ঢাকার পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু একটি নদী নয়, এটি ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। একসময় বুড়িগঙ্গা ছিল স্বচ্ছ পানির ধারা, যেখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত এবং এটি ছিল পাখিদের অভয়ারণ্য; কিন্তু বর্তমানে এটি শিল্প-কারখানার বর্জ্য, পয়ঃনিষ্কাশন এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থের কারণে দূষিত হচ্ছে। বস্তুত বুড়িগঙ্গাভিত্তিক ঢাকা শহরের বিকাশ যখন থেকে শুরু, তখন থেকে দূষণের ইতিহাসও শুরু।

ঢাকার সঙ্গে যে নদীটির নাম জড়িয়ে আছে, তা বুড়িগঙ্গা। এই শহর ও নদীটির অধঃপতন যেন পাল্লা দিয়ে চলছে। বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অনুপযুক্ত কয়েকটি শহরের মধ্যে আছে ঢাকা, আর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকার নদী বুড়িগঙ্গা। টেক্সটাইলস কারখানা থেকে শুরু করে সব ধরনের কলকারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য, পচা ফলমূল থেকে শুরু করে শাকসবজি, হাসপাতালের বর্জ্য, সুয়ারেজের বর্জ্য, মরা প্রাণী, প্লাস্টিকের বর্জ্য ও পেট্রোলিয়ামÑ কোনো কিছুই বাদ নেই।

প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় ৪ হাজার ৫০০ টন বর্জ্য এসে পড়ে। নদীতে সুয়ারেজের যে বর্জ্য ফেলা হয়, তার ৮০ শতাংশই কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়া বুড়িগঙ্গায় মেশে।বুড়িগঙ্গা কেন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর একটি, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার। আমরা যদি বুড়িগঙ্গাকে ভাগাড় বানাই, তবে তা-ই তো হওয়ার কথা। পাঁচ বছর আগের তুলনায় বুড়িগঙ্গায় দূষণের মাত্রা যেহেতু বেড়েছে, ফলে বুঝতে হবে যে এই সময়ে দূষণ দূর করার যেসব উদ্যোগ ও কথাবার্তা আমরা শুনেছি, তা কাজে দেয়নি। বরং বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলার পরিমাণ দিনে দিনে বেড়েছে। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, নদী রক্ষা করা ও দূষণমুক্ত করা সেসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার দায়িত্ব, তাদের বিরুদ্ধেই নদীদূষণের অভিযোগ রয়েছে। ওয়াসা বা সিটি করপোরেশনের ময়লা যদি নদীতে গিয়ে পড়ে, তবে নদী রক্ষা পাবে কিভাবে? ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোর নদীতে যেসব কলকারখানার বর্জ্য মেলে, সেগুলোতে আইন অনুযায়ী পরিশোধনযন্ত্র বা ইটিপি থাকার কথা। কিছু কারাখানায় তা বসানো হলেও সব সময়ে তা চালু থাকে না। এসব দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের। সেই কাজটি যথাযথভাবে পলিত হলে বুড়িগঙ্গার দশা দিনে দিনে খারাপ হতো না।

রাজধানীর যেসব নদী ও খাল দূষিত হচ্ছে, সেগুলো হলো বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু নদ, রামপুরা খাল, কল্যাণপুর খাল, বেগুনবাড়ী খাল, ভাটারা খাল, হাজারীবাগ খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, বাড্ডা খাল, আদি বুড়িগঙ্গা ও রূপনগর খাল। নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে ঢাকা জেলার নদনদী, খালবিল দূষণকারীদের তালিকা চাওয়া হয় ২০২১ সালের নভেম্বর। এক মাস পর পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার খাল ও নদনদী দূষণকারীদের তালিকা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে প্রাথমিকভাবে দূষণের ২৮০টি উৎস চিহ্নিত করা হয়। সেখানে দেখা যায়, শিল্পবর্জ্যের পাশাপাশি রাজধানীর হাসপাতালের তরল বর্জ্যও পড়ছে খাল ও নদীতে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত ২৮০টি উৎস মধ্যে ২২০টিই ছিল হাসপাতাল। নদী দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, কারখানাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই টেক্সটাইল ডাইং এবং প্রিন্টিং, ওয়াশিং, মেটাল, আইসক্রিম কারখানা। এছাড়া রয়েছে ওষুধ উৎপাদন কারখানা, সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, বেসরকারি ডায়াগনিস্টিক সেন্টার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোয় ইটিপি নেই বললেই চলে। পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারি হাসপাতালে ইটিপি বা ছাড়পত্র নেওয়ার বিষয়ে সংস্থাটির পক্ষ থেকে কঠোর অনুশাসন পতিপালন করা হয়না। মূলত হাসপাতাল বিবেচনায় এ বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় রাজধানীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটি বড় নদী। অপরিকল্পিত নগরায়ণে হারিয়ে গেছে অনেক খাল ও উল্লেখযোগ্য নদনদী। এক্ষেত্রে হাসপাতাল হোক বা কারখানা নদীদূষণের ক্ষেত্রে যাদেরই নাম আসে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

পরিবেশের সব ধরনের দূষণ যেন জীবনযাপনের নিত্যদিনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। ঢাকাবাসীর জীবনে দূষণকে সাধারণ সংস্কৃতির অংশ বললেও অত্যুক্তি হবে না! নীতিনির্ধারক থেকে সাধারণ নগরবাসী দূষণ নিয়ে যেন কারোরই কোনো বিকার নেই। ঢাকাকে ব্যবহার করে সবাই যেন নিজেদের আখের গোছাতে চায়, কিন্তু শহরটার বাসযোগ্যতার কথা কেউ ভাবেনা! বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, নদী-খাল দূষণ, প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ, পানিদূষণ, বর্জ্যদূষণ, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যায় জর্জরিত রাজধানী ঢাকা শহর। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যার দখল-দূষণরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও দখল-দূষণ থেমে নেই। নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রকৃতি-প্রতিবেশ ব্যবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। শহরের অভ্যন্তরের খালগুলোও দখলÑ দখলের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না।

একসময় ঢাকা শহরের মধ্যে ৫৪টিরও বেশি খাল ছিল। অধিকাংশ খাল দখল ও বর্জ্য-আবর্জনায় ভরাট হয়ে হারিয়ে গেছে। এখন কোনো রকমে ২৩টির মতো খালের অস্তিত্ব আছে। এগুলোও ব্যাপক দখল ও দূষণে জর্জরিত। খালগুলোর সাথে আশপাশের নদ-নদীর সংযোগ কাটা পড়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে। ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে চলে যাচ্ছে। তাই আগামী দিনগুলোতে নদ-নদীর উপরিভাগের পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়। তাই ঢাকার আশপাশের নদ-নদীগুলো দূষণ ও দখলমুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

শিল্পকারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও মানববর্জ্যরে দূষণে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের অন্যান্য নদ-নদীর পানি কালো হয়ে গেছে। তাই নদী-খাল রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে। পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ‘নিষিদ্ধ’ করা হলেও এর জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি। অবশ্য পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ও কাগজের ব্যাগ সহজলভ্য না করার কারণে পলিথিন দূষণ থামছে না! সহজে ব্যবহারযোগ্য ও ক্রেতার জন্য বিনা ফিতে পাওয়া পলিথিন পরিবেশের অন্যতম প্রধান শত্রু। অপচনশীল এই পলিথিন ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার ক্ষতিসহ সার্বিক পরিবেশ ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনি এমনি এই পলিথিন দূষণ বন্ধ হবে বলে মনে হয় না। পলিথিন উৎপাদন ও বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক অভিযান চলমান রাখতে হবে। পাশাপাশি জনসাধারণ পর্যায়ে পলিথিনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ব্যাপক সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার বাজার ও সব ধরনের দোকানে বিক্রেতা পর্যায়ে অভিযান চালাতে হবে। এ ছাড়া সারা দেশব্যাপী বাজার ও দোকানগুলোতেও অভিযান চলমান রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, বিক্রেতারা যদি পলিথিনে পণ্য ও মালামাল না দেয় তাহলে ক্রেতাদেরও কাছে পলিথিন কখনো পৌঁছাবে না। পাশাপাশি পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ জনপ্রিয় করতে শুরুর দিকে এর ওপর ব্যাপক ভর্তুকি দিতে হবে। পাটের ব্যাগ সহজলভ্য ও চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেওয়া সম্ভব হলে রুগ্ন পাটশিল্প বাঁচবে, পরিবেশও রক্ষা পাবে।

বিশে^র অন্যতম বায়ুদূষণের শহর মেগাসিটি ঢাকা। বিশ^ব্যাংকের সম্প্রতি এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে ক্ষতি হয় প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। আধুনিক ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না তোলার ফলে ময়লা-আবর্জনা রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। ঢাকা শহরে সড়কের সাথেই গড়ে উঠেছে ময়লা-আবর্জনা রাখার স্থান বা ‘সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন’ (এসটিএস)। ফলে চলতে-ফিরতে বর্জ্য দূষণের শিকার হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। সব ধরনের বর্জ্য একসাথে সংগ্রহ না করে আলাদা আলাদা করে সংগ্রহ করা হলে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, আঠা, সার ও অন্যান্য বিকল্প অনেক কিছু তৈরি করা সম্ভব। এ শহরটাকে পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত করে গড়ে তোলার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সবার। ইপিএ-এর প্রতিবেদন অনুসারে, পরিবেশ দূষণ রোধে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯তম। প্রতিবছর ঘটা করে পরিবেশ দিবস পালন করা হয়, পরিবেশ নিয়ে কত-শত আলোচনা ও উদ্যোগের কথা শোনা যায়। প্রশ্ন হলো, আসলে কি পরিবেশ দূষণ কমছে, পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে? এভাবে দিনের পর দিন পরিবেশ দূষণ করতে করতে আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদেরই খুন করছি না তো? পরিবেশ ধ্বংস করতে করতে এমন একটা সময় আসবে যখন থাকবে শুধু অপরিকল্পিত উন্নয়ন, দূষণ আর রোগগ্রস্ত জীবন। তখন কোনো কিছুর বিনিময়ে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা ও সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব হবে না!

ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ রক্ষায় বুড়িগঙ্গা নদীর ভূমিকা অপরিসীম। অথচ এই বুড়িগঙ্গা নদীকেই এখন ঢাকার দুঃখ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এবং ঢাকার পরিবেশ দুষণে বিভিন্ন দূষণ অনুষঙ্গের মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর প্রভাবশীর্ষ তালিকাতে এবং ঢাকা মহানগরীর অবস্থা বিশ্বের পরিবেশ দূষণকারী প্রথম ১০টি নগরের তালিকায় হিসাবভুক্ত বলে বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে হলে প্রথমেই বুড়িগঙ্গা পাড়ের বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়া ঢাকা শহরের চারপাশে বিভিন্ন ছোট ছোট নদী ও খাল সংষ্কারপূর্বক বাধ সৃষ্টি করে বাঁধের দুই পাড়কে সবুজায়নের ভূমিকা নিতে হবে। ঢাকা শহরের ভিতরে প্রবেশকারী ছোট ছোট খাল যা এখন বিলুপ্তপ্রায় তার অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন বিভাগের সাথে সমন্বিত কাজের অংশ হিসেবে শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে সকল স্কুল কলেজে পরিবেশ শিক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে এবং তাদের বাস্তব ব্যবহারিক জ্ঞানের মহড়ার মাধ্যমে তাদের কাজের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ফ্যাকালটির আওতায় বিভিন্ন বিভাগে অধ্যায়নরত উচ্চ শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। অধিকন্তু বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শিল্প কলকারখানা সরিয়ে ফেলতে হবে। অথবা প্রতিটি কলকারখানায় ইটিপি স্থাপনকে আবশ্যিক করতে হবে। সর্বোপরি সার্বিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারকে সুষ্ঠু সঠিক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, মহানগর ঢাকাকে সাজাতে হলে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হবে। ঢাকার বিকাশ ও সভ্যতা বিনির্মাণে পরিবেশের ভূমিকাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ লক্ষ্যে বুড়িগঙ্গার শাসন ও সংস্কার কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। অধিকন্তু পরিবেশের এ বিপর্যয় রোধ করার লক্ষ্যে পরিবেশ বান্ধব বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে বাস্তবমুখী সফল কার্যক্রম গ্রহণ করে পরিবেশের প্রতি একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে এবং পরিবেশ সুরক্ষার কাজকে একটি আন্দোলনে রূপান্তর করতে হবে। ঢাকা মাহানগরবাসীরা এক মহা আতঙ্কের মধ্যে পরে এক দূর্যোগময় ও দুঃসহ জীবন যাপনের শিকার হয়েছে। এই অবস্থা নিরসনকল্পে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণে মনযোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে সব সরকারি-বেসরকারি, এনজিও প্রতিনিধিকে সমন্বিত কর্মসূচি প্রণয়নপূর্বক তার যথাযথ বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top