জিয়াউদ্দীন আহমেদ
গত বছর ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হওয়া পাথর লুট বিগত এক বছরে গণহারে বিরামহীনভাবে চলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় এই লুটের কাহিনী প্রচার হলেও সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গেনি। ঘুম ভেঙ্গেছে পাথর লুট শেষ হওয়ার পর। লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে যৌথ বাহিনী ১৩ আগস্ট থেকে অভিযানে নামে এবং পাথরবোঝাই ১৩০টি ট্রাক জব্দ করে। জেলা প্রশাসকের বক্তব্য অনুযায়ী জব্দ করা পাথরগুলো যে সকল এলাকা থেকে লুট হয়েছে সেই সকল এলাকায় প্রতিস্থাপন করা হবে, অবশ্য এব্যাপারে আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। পাথর হচ্ছে খনিজ সম্পদ, তাই এই পাথরের উপর কর্তৃত্ব খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের, পাথর উত্তোলনের অনুমতি প্রদান বা উত্তোলন বন্ধ করার ক্ষমতা খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের।তবে পাথর উত্তোলনে পরিবেশের ক্ষতি হলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় তাতে আপত্তি উত্থাপন করতে পারে।
সরকার থেকে লিজ নিয়ে বা সরকারের অনুমোদন নিয়ে যেখান থেকে বালি ও পাথর উত্তোলন করা হয় তাকে বলে ‘কোয়ারি’। বাংলাদেশের বিভিন্ন কোয়ারি থেকে উত্তোলিত পাথর দিয়ে আমাদের ব্যাপক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না।পাথরের চাহিদার প্রায় সবটাই পূরণ করা হয় বিদেশ থেকে পাথর আমদানি করে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ৯৫ লাখ মেট্রিক টন পাথর আমদানি করা হয়েছে। চাহিদার সামান্যই পূরণ করা হয় দিনাজপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প এবং সিলেটের বিভিন্ন কোয়ারি থেকে উত্তোলিত পাথর দিয়ে। সিলেটের ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর উত্তোলন করে পাকিস্তান আমলেই ছাতকের সিমেন্ট কারখানায় সরবরাহ করা হতো এবং উত্তোলিত পাথর সরবরাহের জন্য ১৯৬৯ সনে ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ মাইলের একটি রোপওয়ে নির্মাণ করা হয়, কিন্তু সংস্কারের অভাবে বহু বছর আগেই তা বন্ধ হয়ে গেছে। ২০২০ সনের আগ পর্যন্ত সিলেটের আটটি কোয়ারিই ইজারা দেওয়া হতো এবং তা থেকে ইজারা গ্রহীতারা পাথর উত্তোলন করতো। কিন্তু পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় ২০২০ সন থেকে সিলেটের আর কোন পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়া হয়নি।আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে বর্তমান পরিবেশ উপদেষ্টার ভূমিকা ছিল।সম্ভবত তার একই ভূমিকা এখনো আছে বলেই অন্তর্বর্তী সরকারও এপ্রিল মাসে সিলেটের ৮টি কোয়ারিসহ দেশের ১৭টি কোয়ারির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সিলেটের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি একটি সাদাপাথর এলাকার পাশে। পাহাড় ঘেঁষা নদী থেকে শ্রমিকরা এই কোয়ারি থেকে পাথর তোলে। পাথর আসে সীমান্তের ওপারে ভারত থেকে, ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর পানির সঙ্গে প্রতিবছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে প্রচুর পাথর।সিলেটের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই বিভিন্ন কোয়ারি পুনরায় লিজ দিয়ে তা থেকে পাথর উত্তোলনের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকার অনুমতি দেয়নি। অনুমতি না দেওয়ার প্রধান কারণ পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কা। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের দাবী জানাতেই পারে, কিন্তু পাথর উত্তোলনে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের এত আগ্রহ কেন? পাথর উত্তোলনের পক্ষে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করার মতো একতাবদ্ধ কেন? নিশ্চয়ই তাদেরও যুক্তি আছে, তাদের যুক্তি হচ্ছে পাথর উত্তোলনে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হয়- নির্মল এবং নিষ্কলুষ যুক্তি। কিন্তু জনগণ জানে, রাজনৈতিক নেতারাই ব্যবসায়ী। আর যে ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতা নন, তার কাছ থেকে অঢেল চাঁদা আদায় করা যায়।
রাজনৈতিক নেতাদের বুদ্ধি আছে, যেমন ছিল মাওলানা ভাসানীর। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে মাওলানা ভাসানীর ‘জ্বালাও জ্বালাও, আগুন জ্বালাও’, স্লোগানে দেশের বাড়ি, গাড়িসহ প্রচুর সম্পদ আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়।এই স্লোগানের জন্য তাকে দোষারোপ করা হলে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমি তো মনের ভেতর আগুন জ্বালাতে বলেছিলাম, বাড়িঘরে নয়’। সিলেটের পাথর লুট নিয়ে রাজনৈতিক নেতারাও একই কথা বলছেন, ‘আমরা তো পাথর উত্তোলন চালু করতে বলেছিলাম, লুট করতে তো বলিনি’। তাহলে সিলেটের সংরক্ষিত এলাকা, পর্যটনকেন্দ্র ও কোয়ারিগুলোর পাথর একসঙ্গে লুট করে নেওয়ার সময় রাজনৈতিক নেতারা কেন রুখে দাঁড়লেন না। এর উত্তর হচ্ছে, লুট ঠেকানোর দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের।
স্থানীয় প্রশাসন লুট ঠেকাতে পারেনি। না পারার প্রধান কারণ, ৫ই আগস্টের পর স্থানীয় প্রশাসন সাজানো হয়েছে বিএনপি আর জামায়াতের লোক দিয়ে। তাই প্রশাসনের আমলারা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মতের বাইরে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। দ্বিতীয়ত, দেশের সর্বত্র প্রশাসন মব ভায়োলেন্সের ভয়ে তটস্থ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কথা না শুনলেই আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগিয়ে অপদস্ত করা হবে, চাকুরিচ্যুতির তীব্র আন্দোলন হবে। চাকুরিচ্যুতি না হলেও ডিসি, এসপিকে সচিবালয়ে চলে যেতে হবে, কিন্তু এরা সচিবালয়ে যেতে চান না। তৃতীয়ত, স্থানীয় প্রশাসনও পাথর উত্তোলনের পক্ষে ছিল, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত এক সভায় পাথর উত্তোলনের পক্ষে মত দেন। চতুর্থত, দেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি পাথরলুটে ইন্ধন যুগিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিলেটের সব কয়টি কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের স্থানীয় নেতারা। অভিযোগ রয়েছে, তাদের মদদেই প্রকাশ্যে পাথর লুট শুরু হয়। গত ২৪ জুন পাথর উত্তোলনের পক্ষে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সম্মুখে পাথর ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে যে মানববন্ধন হয় তাতে যোগ দিয়েছিলেন সিলেটের বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ ছয় নেতা।এছাড়াও কোয়ারি চালুর পক্ষে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা।
শুধু কোয়ারি থেকে পাথর লুট হলে এত হৈচৈ হতো না। সমস্যা হয়েছে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি পাশে পাঁচ একর জায়গা ব্যাপী যে সাদাপাথর ছিল তাও লুট হয়ে গেছে।এই সাদা পাথরসমৃদ্ধ উক্ত এলাকায় একটি জাঁকজমকপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠেছিল, সাদা পাথর দেখার জন্য, বড় বড় সাদা পাথরের উপর বসে ছবি তোলা, ভিডিও করার শখ ছিল পর্যটকদের।ভোলাগঞ্জ যাওয়ার রাস্তার প্রভূত উন্নতি হওয়ায় ২০১২ সন থেকে পর্যটকের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল।সর্বোপরি পর্যটকদের জন্য সাদা পাথরের আশেপাশে গড়ে তোলা হয় অসংখ্য দোকান, দৈনিক চার-পাঁচ হাজার পর্যটকের কাছে নানাবিধ পণ্য ও খাবার বিক্রি হতো।সাদা পাথর লুট হওয়ার পর পর্যটকের অভাবে পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের আয় বন্ধ হয়ে যায়।সাদা পাথর লুট হওয়ায় শুধু পর্যটনকেন্দ্র ধ্বংস হয়নি, ধ্বংস হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশও। ধলাই নদের উৎসমুখ ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্টে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির তীব্র বেগকে সামাল দিয়েছে জমে থাকা পাথরগুলো। পাথর না থাকলে পানির তীব্র বেগের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, নিয়ন্ত্রণ না থাকলে নদীর পাড় ভাঙবে, বন্যা হবে।অন্যদিকে পাথর নদীর পানিকে রেখেছিল স্বচ্ছ, এই স্বচ্ছ পানি অনেকে পান করত; পাথর লুট হওয়ার পর পানি হয়ে যায় কর্দমাক্ত।
সারা দেশেই লুটতরাজ আর চাঁদাবাজি হচ্ছে, লুটতরাজ আর চাঁদাবাজি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ হলেও তা অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্তব্যের মধ্যে পড়ছে না।কারণ দেশে একটি নোশান তৈরি হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ব্যতীত বাকি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ১৭ বছরের বুভুক্ষু, অসহনীয় ক্ষিধা, ক্ষিধা নিবারণের জন্য লুটতরাজ-চাঁদাবাজিকে প্রশ্রয় দিতে হচ্ছে।কত সহজ সমাধান, আইন কত ভদ্র। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম সাদা পাথর তুলতে না দেওয়ার পেছনে ভারতের ষড়যন্ত্র রয়েছে মর্মেও উল্লেখ করেছেন। পাথর লুট হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসনের ঘুম ভেঙ্গেছে। ভাগ্য ভালো লুট হওয়ার সময় ঘুম ভাঙ্গেনি, ভাঙ্গলে বিপদ হতো, আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগিয়ে ভারতের ‘র’-এর এজেন্ট বানিয়ে দেওয়া হতো। আওয়ামী লীগের ট্যাগ আর ভারতের ষড়যন্ত্র - এই দুইটি কথা একটু গলা ছেড়ে জোরে বললে সাধু-সন্ন্যাসীদের মুখও আজকাল বন্ধ হয়ে যায়। চাঁদাবাজি, টে-ারবাজি, স্টেশন দখল, ঘাট দখল, বালু লুট, পাথর চুরি, পাথর মেরে মানুষ হত্যা সবই চলছে ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে। ভারত বিদ্বেষী মনোভাব এবং ট্যাগ লাগানোর কৌশল রাজনীতির ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও প্রতিপক্ষের গায়ে ‘রাজাকার’-এর ট্যাগ লাগানো হতো। ’পাকিস্তান’-এর প্রস্তাবক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেই ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান। শেরে বাংলা ফজলুল হকের বিরুদ্ধে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ ছিল।
পাথর লুটে ক্ষতবিক্ষত সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরের পর্যটন কেন্দ্রটি আবার পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে ওঠবে, এই প্রত্যাশা সমগ্র দেশবাসীর। ‘আগের চার বছর জাফলং-এ পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরেছিলাম, এখন আমি উপদেষ্টা হয়েও পারলাম না’ -এই কথাটি বলেছেন স্বয়ং বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।তিনি পাথর উত্তোলনের প্রশ্নে সিলেটে সর্বদলীয় ঐক্য দেখেছেন।কিন্তু এই ঐক্য তো তাদেরই সৃষ্টি, এই ঐক্য দেখে মাইলস্টোনের ধ্বংসযজ্ঞের দিনেও প্রধান উপদেষ্টার মুখে প্রশান্তির নির্মম হাসি দেশবাসী দেখেছে।প্রধান উপদেষ্টার ‘এক পরিবার’ গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন যে কত কঠিন তা শুধু পরিবেশ উপদেষ্টাকে বুঝলে হবে না, বুঝতে হবে সমগ্র উপদেষ্টা ম-লীকে।
রাজনৈতিক দলগুলোর উপর অতি নির্ভরশীলতায় অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হচ্ছে, নিজের স্বপ্ন অন্যের চোখ দিয়ে দেখার কৌশল বুমেরাং হচ্ছে, স্বপ্নের বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে যাচ্ছে।রাজনৈতিক দলগুলোকে তোয়াজ করে দেশ শাসন করলে অরাজকতা আর চাঁদাবাজি দূর হবে না, পাথর লুটসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ উপদেষ্টার মতো অন্তর্বর্তী সরকারের অসহায়ত্ব দিন দিন বাড়তে থাকবে।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫
গত বছর ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হওয়া পাথর লুট বিগত এক বছরে গণহারে বিরামহীনভাবে চলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় এই লুটের কাহিনী প্রচার হলেও সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গেনি। ঘুম ভেঙ্গেছে পাথর লুট শেষ হওয়ার পর। লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে যৌথ বাহিনী ১৩ আগস্ট থেকে অভিযানে নামে এবং পাথরবোঝাই ১৩০টি ট্রাক জব্দ করে। জেলা প্রশাসকের বক্তব্য অনুযায়ী জব্দ করা পাথরগুলো যে সকল এলাকা থেকে লুট হয়েছে সেই সকল এলাকায় প্রতিস্থাপন করা হবে, অবশ্য এব্যাপারে আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। পাথর হচ্ছে খনিজ সম্পদ, তাই এই পাথরের উপর কর্তৃত্ব খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের, পাথর উত্তোলনের অনুমতি প্রদান বা উত্তোলন বন্ধ করার ক্ষমতা খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের।তবে পাথর উত্তোলনে পরিবেশের ক্ষতি হলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় তাতে আপত্তি উত্থাপন করতে পারে।
সরকার থেকে লিজ নিয়ে বা সরকারের অনুমোদন নিয়ে যেখান থেকে বালি ও পাথর উত্তোলন করা হয় তাকে বলে ‘কোয়ারি’। বাংলাদেশের বিভিন্ন কোয়ারি থেকে উত্তোলিত পাথর দিয়ে আমাদের ব্যাপক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না।পাথরের চাহিদার প্রায় সবটাই পূরণ করা হয় বিদেশ থেকে পাথর আমদানি করে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ৯৫ লাখ মেট্রিক টন পাথর আমদানি করা হয়েছে। চাহিদার সামান্যই পূরণ করা হয় দিনাজপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প এবং সিলেটের বিভিন্ন কোয়ারি থেকে উত্তোলিত পাথর দিয়ে। সিলেটের ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর উত্তোলন করে পাকিস্তান আমলেই ছাতকের সিমেন্ট কারখানায় সরবরাহ করা হতো এবং উত্তোলিত পাথর সরবরাহের জন্য ১৯৬৯ সনে ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ মাইলের একটি রোপওয়ে নির্মাণ করা হয়, কিন্তু সংস্কারের অভাবে বহু বছর আগেই তা বন্ধ হয়ে গেছে। ২০২০ সনের আগ পর্যন্ত সিলেটের আটটি কোয়ারিই ইজারা দেওয়া হতো এবং তা থেকে ইজারা গ্রহীতারা পাথর উত্তোলন করতো। কিন্তু পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় ২০২০ সন থেকে সিলেটের আর কোন পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়া হয়নি।আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে বর্তমান পরিবেশ উপদেষ্টার ভূমিকা ছিল।সম্ভবত তার একই ভূমিকা এখনো আছে বলেই অন্তর্বর্তী সরকারও এপ্রিল মাসে সিলেটের ৮টি কোয়ারিসহ দেশের ১৭টি কোয়ারির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সিলেটের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি একটি সাদাপাথর এলাকার পাশে। পাহাড় ঘেঁষা নদী থেকে শ্রমিকরা এই কোয়ারি থেকে পাথর তোলে। পাথর আসে সীমান্তের ওপারে ভারত থেকে, ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর পানির সঙ্গে প্রতিবছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে প্রচুর পাথর।সিলেটের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই বিভিন্ন কোয়ারি পুনরায় লিজ দিয়ে তা থেকে পাথর উত্তোলনের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকার অনুমতি দেয়নি। অনুমতি না দেওয়ার প্রধান কারণ পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কা। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের দাবী জানাতেই পারে, কিন্তু পাথর উত্তোলনে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের এত আগ্রহ কেন? পাথর উত্তোলনের পক্ষে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করার মতো একতাবদ্ধ কেন? নিশ্চয়ই তাদেরও যুক্তি আছে, তাদের যুক্তি হচ্ছে পাথর উত্তোলনে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হয়- নির্মল এবং নিষ্কলুষ যুক্তি। কিন্তু জনগণ জানে, রাজনৈতিক নেতারাই ব্যবসায়ী। আর যে ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতা নন, তার কাছ থেকে অঢেল চাঁদা আদায় করা যায়।
রাজনৈতিক নেতাদের বুদ্ধি আছে, যেমন ছিল মাওলানা ভাসানীর। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে মাওলানা ভাসানীর ‘জ্বালাও জ্বালাও, আগুন জ্বালাও’, স্লোগানে দেশের বাড়ি, গাড়িসহ প্রচুর সম্পদ আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়।এই স্লোগানের জন্য তাকে দোষারোপ করা হলে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমি তো মনের ভেতর আগুন জ্বালাতে বলেছিলাম, বাড়িঘরে নয়’। সিলেটের পাথর লুট নিয়ে রাজনৈতিক নেতারাও একই কথা বলছেন, ‘আমরা তো পাথর উত্তোলন চালু করতে বলেছিলাম, লুট করতে তো বলিনি’। তাহলে সিলেটের সংরক্ষিত এলাকা, পর্যটনকেন্দ্র ও কোয়ারিগুলোর পাথর একসঙ্গে লুট করে নেওয়ার সময় রাজনৈতিক নেতারা কেন রুখে দাঁড়লেন না। এর উত্তর হচ্ছে, লুট ঠেকানোর দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের।
স্থানীয় প্রশাসন লুট ঠেকাতে পারেনি। না পারার প্রধান কারণ, ৫ই আগস্টের পর স্থানীয় প্রশাসন সাজানো হয়েছে বিএনপি আর জামায়াতের লোক দিয়ে। তাই প্রশাসনের আমলারা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মতের বাইরে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। দ্বিতীয়ত, দেশের সর্বত্র প্রশাসন মব ভায়োলেন্সের ভয়ে তটস্থ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কথা না শুনলেই আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগিয়ে অপদস্ত করা হবে, চাকুরিচ্যুতির তীব্র আন্দোলন হবে। চাকুরিচ্যুতি না হলেও ডিসি, এসপিকে সচিবালয়ে চলে যেতে হবে, কিন্তু এরা সচিবালয়ে যেতে চান না। তৃতীয়ত, স্থানীয় প্রশাসনও পাথর উত্তোলনের পক্ষে ছিল, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত এক সভায় পাথর উত্তোলনের পক্ষে মত দেন। চতুর্থত, দেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি পাথরলুটে ইন্ধন যুগিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিলেটের সব কয়টি কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের স্থানীয় নেতারা। অভিযোগ রয়েছে, তাদের মদদেই প্রকাশ্যে পাথর লুট শুরু হয়। গত ২৪ জুন পাথর উত্তোলনের পক্ষে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সম্মুখে পাথর ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে যে মানববন্ধন হয় তাতে যোগ দিয়েছিলেন সিলেটের বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ ছয় নেতা।এছাড়াও কোয়ারি চালুর পক্ষে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা।
শুধু কোয়ারি থেকে পাথর লুট হলে এত হৈচৈ হতো না। সমস্যা হয়েছে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি পাশে পাঁচ একর জায়গা ব্যাপী যে সাদাপাথর ছিল তাও লুট হয়ে গেছে।এই সাদা পাথরসমৃদ্ধ উক্ত এলাকায় একটি জাঁকজমকপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠেছিল, সাদা পাথর দেখার জন্য, বড় বড় সাদা পাথরের উপর বসে ছবি তোলা, ভিডিও করার শখ ছিল পর্যটকদের।ভোলাগঞ্জ যাওয়ার রাস্তার প্রভূত উন্নতি হওয়ায় ২০১২ সন থেকে পর্যটকের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল।সর্বোপরি পর্যটকদের জন্য সাদা পাথরের আশেপাশে গড়ে তোলা হয় অসংখ্য দোকান, দৈনিক চার-পাঁচ হাজার পর্যটকের কাছে নানাবিধ পণ্য ও খাবার বিক্রি হতো।সাদা পাথর লুট হওয়ার পর পর্যটকের অভাবে পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের আয় বন্ধ হয়ে যায়।সাদা পাথর লুট হওয়ায় শুধু পর্যটনকেন্দ্র ধ্বংস হয়নি, ধ্বংস হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশও। ধলাই নদের উৎসমুখ ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্টে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির তীব্র বেগকে সামাল দিয়েছে জমে থাকা পাথরগুলো। পাথর না থাকলে পানির তীব্র বেগের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, নিয়ন্ত্রণ না থাকলে নদীর পাড় ভাঙবে, বন্যা হবে।অন্যদিকে পাথর নদীর পানিকে রেখেছিল স্বচ্ছ, এই স্বচ্ছ পানি অনেকে পান করত; পাথর লুট হওয়ার পর পানি হয়ে যায় কর্দমাক্ত।
সারা দেশেই লুটতরাজ আর চাঁদাবাজি হচ্ছে, লুটতরাজ আর চাঁদাবাজি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ হলেও তা অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্তব্যের মধ্যে পড়ছে না।কারণ দেশে একটি নোশান তৈরি হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ব্যতীত বাকি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ১৭ বছরের বুভুক্ষু, অসহনীয় ক্ষিধা, ক্ষিধা নিবারণের জন্য লুটতরাজ-চাঁদাবাজিকে প্রশ্রয় দিতে হচ্ছে।কত সহজ সমাধান, আইন কত ভদ্র। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম সাদা পাথর তুলতে না দেওয়ার পেছনে ভারতের ষড়যন্ত্র রয়েছে মর্মেও উল্লেখ করেছেন। পাথর লুট হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসনের ঘুম ভেঙ্গেছে। ভাগ্য ভালো লুট হওয়ার সময় ঘুম ভাঙ্গেনি, ভাঙ্গলে বিপদ হতো, আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগিয়ে ভারতের ‘র’-এর এজেন্ট বানিয়ে দেওয়া হতো। আওয়ামী লীগের ট্যাগ আর ভারতের ষড়যন্ত্র - এই দুইটি কথা একটু গলা ছেড়ে জোরে বললে সাধু-সন্ন্যাসীদের মুখও আজকাল বন্ধ হয়ে যায়। চাঁদাবাজি, টে-ারবাজি, স্টেশন দখল, ঘাট দখল, বালু লুট, পাথর চুরি, পাথর মেরে মানুষ হত্যা সবই চলছে ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে। ভারত বিদ্বেষী মনোভাব এবং ট্যাগ লাগানোর কৌশল রাজনীতির ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও প্রতিপক্ষের গায়ে ‘রাজাকার’-এর ট্যাগ লাগানো হতো। ’পাকিস্তান’-এর প্রস্তাবক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেই ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান। শেরে বাংলা ফজলুল হকের বিরুদ্ধে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ ছিল।
পাথর লুটে ক্ষতবিক্ষত সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরের পর্যটন কেন্দ্রটি আবার পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে ওঠবে, এই প্রত্যাশা সমগ্র দেশবাসীর। ‘আগের চার বছর জাফলং-এ পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরেছিলাম, এখন আমি উপদেষ্টা হয়েও পারলাম না’ -এই কথাটি বলেছেন স্বয়ং বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।তিনি পাথর উত্তোলনের প্রশ্নে সিলেটে সর্বদলীয় ঐক্য দেখেছেন।কিন্তু এই ঐক্য তো তাদেরই সৃষ্টি, এই ঐক্য দেখে মাইলস্টোনের ধ্বংসযজ্ঞের দিনেও প্রধান উপদেষ্টার মুখে প্রশান্তির নির্মম হাসি দেশবাসী দেখেছে।প্রধান উপদেষ্টার ‘এক পরিবার’ গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন যে কত কঠিন তা শুধু পরিবেশ উপদেষ্টাকে বুঝলে হবে না, বুঝতে হবে সমগ্র উপদেষ্টা ম-লীকে।
রাজনৈতিক দলগুলোর উপর অতি নির্ভরশীলতায় অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হচ্ছে, নিজের স্বপ্ন অন্যের চোখ দিয়ে দেখার কৌশল বুমেরাং হচ্ছে, স্বপ্নের বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে যাচ্ছে।রাজনৈতিক দলগুলোকে তোয়াজ করে দেশ শাসন করলে অরাজকতা আর চাঁদাবাজি দূর হবে না, পাথর লুটসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ উপদেষ্টার মতো অন্তর্বর্তী সরকারের অসহায়ত্ব দিন দিন বাড়তে থাকবে।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল]