alt

opinion » post-editorial

চাপে সামষ্টিক অর্থনীতি

মিহির কুমার রায়

: শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫

গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় অর্থনীতির অনেক সূচকই ছিল নেতিবাচক। এখনও সে অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তুলনামূলক ভালো অবস্থায় আছে। এটা সম্ভব হয়েছে প্রবাসীরা বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণে। পাশাপাশি মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি নেতিবাচক পর্যায়ে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপও কমেছে। অবশ্য এ সময়ে সরকারকে রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।

সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচক যেমনÑ কর্মসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ ইত্যাদির কোনোটি স্বস্তিদায়ক অবস্থানে নেই। ফলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বহাল রাখা হয়েছে। দেশের অর্থনীতি এখনও নানা চাপের মধ্যে রয়েছে। চলমান বৈশ্বিক সংকট, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতা মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির গতি কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছায়নি।

আর্থিক শৃঙ্খলায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবে কাঠামোগত সংস্কারে এখনো অনেক পথ বাকি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, অর্থনীতির বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অন্যতম। ২০২৪ সালের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি; যা গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়Ñ সেটি সামষ্টিক অর্থনীতির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। যদিও পরে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত হস্তক্ষেপে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরতে শুরু করে। তবু আর্থিক নীতির কড়াকড়ি, রাজস্ব আদায়ে কাঠামোগত জটিলতা এবং ব্যাংক খাতে চলমান চাপ কাটেনি।

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছেÑ

১. প্রবৃদ্ধি হ্রাস

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৯৭ শতাংশ, যেখানে ২০২৪ অর্থবছরে ছিল ৪.২২ শতাংশ। কম প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বিনিয়োগের ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সরবরাহ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, চাহিদার হ্রাস ও কার্যকর আর্থিক প্রণোদনার অভাব।

২. ঋণ প্রবৃদ্ধি স্থবিরতা

গত এক বছরে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬.৪০ শতাংশ। ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়া মানে বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণ রুদ্ধ হয়ে পড়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি নিষ্পত্তি ২৫.৪২ শতাংশ কমেছে।

৩. বিনিয়োগ সংকট ও কর্মসংস্থান স্থবিরতা

রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিনিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘ করছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির সরবরাহে সমস্যা বিনিয়োগের পরিবেশ দুর্বল করছে। দুর্নীতি, কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং উচ্চ সুদের হার উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম দাবিÑ চাকরির সুযোগ বাড়ানো অধরাই রয়ে গেছে।

৪. শিল্প খাতে সংকট

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ গাজীপুরের মোট ১০৬টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। শিল্পপুলিশের তথ্যমতে, চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৭৩ হাজার শ্রমিক। কেউ কেউ কম বেতনে নতুন চাকরি পেলেও হাজার হাজার শ্রমিক এখনও বেকার, অনেকে পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন।

৫. মূল্যস্ফীতির ওঠানামা

গত চার মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও জুলাইয়ে আবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৫৫ শতাংশে (জুনে ছিল ৮.৪৮ শতাংশ)। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭.৫৬ শতাংশে এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৯.৩৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যে আমদানি শুল্ক কমানো, এলসি শিথিলকরণ ও খাদ্যসার আমদানিকারকদের জন্য ঋণ সুবিধা দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে।

৬. রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতা

সরকারের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্যহীনতা বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ে অগ্রগতি হয়নি; বরং জিডিপির অনুপাতে আয় কমেছে। রাজস্ব ব্যয় বিশেষত বেতনভাতা, ভর্তুকি ও ঋণের সুদ পরিশোধ এতটাই বেড়েছে যে, উন্নয়ন ব্যয় ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে। গত অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ছিল ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা।

৭. এনবিআর সংস্কার

২০২৪ সালের মে মাসে সরকার রাজস্ব বোর্ডকে দুটি বিভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়Ñ ‘রেভিনিউ পলিসি বিভাগ’ ও ‘রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ’। এটি আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির শর্ত হলেও অর্থনীতিবিদরা অনেক আগে থেকেই এ সংস্কারের দাবি জানাচ্ছিলেন। তবে বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।

৮. টাস্কফোর্সের সুপারিশ

পরিকল্পনা উপদেষ্টা অর্থনৈতিক কৌশল প্রণয়নের জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেন। এতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর সুপারিশ দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয়গুলো স্বল্পমেয়াদে তা বাস্তবায়নে আগ্রহী হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করতে আলাদা টাস্কফোর্সও গঠিত হয়েছে।

৯. প্রাত্যহিক জীবনে প্রভাব

সামষ্টিক অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি আসেনি। আইনশৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা ও দুর্নীতির মতো সূচকে সরকারের সক্ষমতার ঘাটতি প্রকট। ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবায়নের ফারাক স্পষ্ট।

১০. রাজনৈতিক সংস্কারের সীমাবদ্ধতা

সংস্কারের জন্য কিছু কমিশন গঠিত হলেও স্বৈরাচারবিরোধী কাঠামোগত সংস্কারের মৌলিক দিকগুলো উপেক্ষিত রয়ে গেছে। কেবল প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা ও মেয়াদকাল নিয়েই আলোচনা হয়েছে।

১১. অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক পদক্ষেপ

ব্যাংক খাতে সংস্কার, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং রিজার্ভ পতন ঠেকাতে সরকার সফল হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রাজস্ব আহরণে অগ্রগতি হয়নি। বরং ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে।

১২. কর্মসংস্থান ও বৈষম্য

কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈষম্য হ্রাসে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হয়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অন্যতম চেতনা ছিল বৈষম্যবিরোধী দাবির ভিত্তিতে। কৃষক ন্যায্য দাম না পেলে, শ্রমিকের বেতন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে না বাড়লে তা হবে পরিতাপের বিষয়। পাশাপাশি নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক বিপন্নতাও বেড়েছে।

উপসংহার

অন্তর্বর্তী সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন খুবই সীমিত। অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বিদ্যমান। সাধারণ মানুষের জীবনে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসেনি। এ প্রেক্ষাপটে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করাই একমাত্র পথ। অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করার দায়িত্বও শেষপর্যন্ত নিতে হবে রাজনীতিবিদদের।

[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন ট্র্যাজেডি

হোক সবুজ বিপ্লব

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : একজন বিধায়কের জামিন

নিউটনের আপেল : পতনের ভেতরে জাগরণের গল্প

বায়ুদূষণ গবেষণার প্রসার ও তরুণদের ভূমিকা : প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা আহমদ

ছবি

একাত্তরের গণহত্যা : সংখ্যার বিতর্ক নাকি দায় হালকা করার চেষ্টা?

রম্যগদ্য : ‘দালাল-ধন্বন্তরি-জীবন রক্ষাকারী...’

সাদা পাথর লুটে সর্বদলীয় ঐক্য

গণিতের বহুমুখী ব্যবহার : আধুনিক বিজ্ঞানের চালিকাশক্তি

প্রসঙ্গ : পেঁপের রিং স্পট ভাইরাস

ছবি

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : রাজনৈতিক বিভেদের অমোচনীয় ক্ষত

ছবি

আলফ্রেড সরেন হত্যা : বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

কারাম উৎসব : বাংলার প্রাচীন কৃষি ও সংস্কৃতির ধারক

ছবি

আলাস্কা বৈঠক : শান্তির দেখা কি মিলল?

বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কতদূর?

মবের উন্মাদনা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার

জীবন থেকে নেয়া শিক্ষাগুলোই এগিয়ে দেয় জীবনকে

রাজনৈতিক কর্মসূচি, যানজট ও আচরণগত অর্থনীতি

সম্পদের অভিশাপ : সিলেটের সাদাপাথরে সংঘাতের সমাজতত্ত্ব ও নীতি-সংকট

নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো

মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার জরুরি

ছবি

সাদাপাথরের নীলাভ দেশ : ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য ও সংকট

একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমাজতত্ত্ব

বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির নতুন ভূরাজনীতি

মব ও জাস্টিস

ইতিহাসকে নতুন করে লেখা এক জগাখিচুড়ি!

নারীর সমঅধিকার : সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি

জ্ঞানের মঞ্চ এখন সার্কাস, গবেষণা সেখানে নীরব দর্শক

ছবি

ভরা শ্রাবণে স্বদেশ-ভাবনা

নারীর প্রতি সহিংসতা : বাস্তবতা, আইন ও প্রতিরোধের জরুরি দিকনির্দেশনা

ছাত্র রাজনীতি : নেতৃত্বের হাতেখড়ি নাকি দাসত্বের লেজুড়বৃত্তি?

ছবি

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

ছবি

উন্নয়ন ও প্রকৃতি

ছবি

কৃষকের চেয়ে বড় উদ্যোক্তা আর কে আছে

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষাগত ও সামাজিক সমস্যা

ট্রেড ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

tab

opinion » post-editorial

চাপে সামষ্টিক অর্থনীতি

মিহির কুমার রায়

শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫

গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় অর্থনীতির অনেক সূচকই ছিল নেতিবাচক। এখনও সে অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তুলনামূলক ভালো অবস্থায় আছে। এটা সম্ভব হয়েছে প্রবাসীরা বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণে। পাশাপাশি মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি নেতিবাচক পর্যায়ে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপও কমেছে। অবশ্য এ সময়ে সরকারকে রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।

সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচক যেমনÑ কর্মসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ ইত্যাদির কোনোটি স্বস্তিদায়ক অবস্থানে নেই। ফলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বহাল রাখা হয়েছে। দেশের অর্থনীতি এখনও নানা চাপের মধ্যে রয়েছে। চলমান বৈশ্বিক সংকট, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতা মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির গতি কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছায়নি।

আর্থিক শৃঙ্খলায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবে কাঠামোগত সংস্কারে এখনো অনেক পথ বাকি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, অর্থনীতির বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অন্যতম। ২০২৪ সালের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি; যা গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়Ñ সেটি সামষ্টিক অর্থনীতির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। যদিও পরে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত হস্তক্ষেপে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরতে শুরু করে। তবু আর্থিক নীতির কড়াকড়ি, রাজস্ব আদায়ে কাঠামোগত জটিলতা এবং ব্যাংক খাতে চলমান চাপ কাটেনি।

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছেÑ

১. প্রবৃদ্ধি হ্রাস

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৯৭ শতাংশ, যেখানে ২০২৪ অর্থবছরে ছিল ৪.২২ শতাংশ। কম প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বিনিয়োগের ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সরবরাহ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, চাহিদার হ্রাস ও কার্যকর আর্থিক প্রণোদনার অভাব।

২. ঋণ প্রবৃদ্ধি স্থবিরতা

গত এক বছরে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬.৪০ শতাংশ। ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়া মানে বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণ রুদ্ধ হয়ে পড়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি নিষ্পত্তি ২৫.৪২ শতাংশ কমেছে।

৩. বিনিয়োগ সংকট ও কর্মসংস্থান স্থবিরতা

রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিনিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘ করছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির সরবরাহে সমস্যা বিনিয়োগের পরিবেশ দুর্বল করছে। দুর্নীতি, কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং উচ্চ সুদের হার উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম দাবিÑ চাকরির সুযোগ বাড়ানো অধরাই রয়ে গেছে।

৪. শিল্প খাতে সংকট

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ গাজীপুরের মোট ১০৬টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। শিল্পপুলিশের তথ্যমতে, চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৭৩ হাজার শ্রমিক। কেউ কেউ কম বেতনে নতুন চাকরি পেলেও হাজার হাজার শ্রমিক এখনও বেকার, অনেকে পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন।

৫. মূল্যস্ফীতির ওঠানামা

গত চার মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও জুলাইয়ে আবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৫৫ শতাংশে (জুনে ছিল ৮.৪৮ শতাংশ)। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭.৫৬ শতাংশে এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৯.৩৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যে আমদানি শুল্ক কমানো, এলসি শিথিলকরণ ও খাদ্যসার আমদানিকারকদের জন্য ঋণ সুবিধা দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে।

৬. রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতা

সরকারের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্যহীনতা বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ে অগ্রগতি হয়নি; বরং জিডিপির অনুপাতে আয় কমেছে। রাজস্ব ব্যয় বিশেষত বেতনভাতা, ভর্তুকি ও ঋণের সুদ পরিশোধ এতটাই বেড়েছে যে, উন্নয়ন ব্যয় ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে। গত অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ছিল ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা।

৭. এনবিআর সংস্কার

২০২৪ সালের মে মাসে সরকার রাজস্ব বোর্ডকে দুটি বিভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়Ñ ‘রেভিনিউ পলিসি বিভাগ’ ও ‘রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ’। এটি আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির শর্ত হলেও অর্থনীতিবিদরা অনেক আগে থেকেই এ সংস্কারের দাবি জানাচ্ছিলেন। তবে বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।

৮. টাস্কফোর্সের সুপারিশ

পরিকল্পনা উপদেষ্টা অর্থনৈতিক কৌশল প্রণয়নের জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেন। এতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর সুপারিশ দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয়গুলো স্বল্পমেয়াদে তা বাস্তবায়নে আগ্রহী হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করতে আলাদা টাস্কফোর্সও গঠিত হয়েছে।

৯. প্রাত্যহিক জীবনে প্রভাব

সামষ্টিক অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি আসেনি। আইনশৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা ও দুর্নীতির মতো সূচকে সরকারের সক্ষমতার ঘাটতি প্রকট। ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবায়নের ফারাক স্পষ্ট।

১০. রাজনৈতিক সংস্কারের সীমাবদ্ধতা

সংস্কারের জন্য কিছু কমিশন গঠিত হলেও স্বৈরাচারবিরোধী কাঠামোগত সংস্কারের মৌলিক দিকগুলো উপেক্ষিত রয়ে গেছে। কেবল প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা ও মেয়াদকাল নিয়েই আলোচনা হয়েছে।

১১. অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক পদক্ষেপ

ব্যাংক খাতে সংস্কার, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং রিজার্ভ পতন ঠেকাতে সরকার সফল হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রাজস্ব আহরণে অগ্রগতি হয়নি। বরং ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে।

১২. কর্মসংস্থান ও বৈষম্য

কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈষম্য হ্রাসে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হয়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অন্যতম চেতনা ছিল বৈষম্যবিরোধী দাবির ভিত্তিতে। কৃষক ন্যায্য দাম না পেলে, শ্রমিকের বেতন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে না বাড়লে তা হবে পরিতাপের বিষয়। পাশাপাশি নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক বিপন্নতাও বেড়েছে।

উপসংহার

অন্তর্বর্তী সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন খুবই সীমিত। অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বিদ্যমান। সাধারণ মানুষের জীবনে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসেনি। এ প্রেক্ষাপটে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করাই একমাত্র পথ। অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করার দায়িত্বও শেষপর্যন্ত নিতে হবে রাজনীতিবিদদের।

[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

back to top