কামরুজ্জমান মজুমদার
বর্তমান বিশ্বে বায়ুদূষণ এক অদৃশ্য কিন্তু ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা মানবজীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। নগরায়ন, শিল্পায়ন, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বায়ুতে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষতিকর উপাদান, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। বাংলাদেশে শিল্প, অবকাঠামো ও নগর সম্প্রসারণের কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেও পরিবেশের ওপর চাপ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা প্রায়শই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে। ধূলিকণা, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও ব্ল্যাক কার্বনের মতো দূষণকারী উপাদান প্রতিদিন মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে, যার ফলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, হৃদরোগ এবং ফুসফুস ক্যান্সারের মতো রোগ বাড়ছে। শীত মৌসুমে ইটভাটা, নির্মাণকাজের ধুলা ও যানবাহনের ধোঁয়া এ সমস্যা আরও প্রকট করে তোলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ অকাল মৃত্যুর শিকার হয়।
এই জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান, গবেষণা এবং প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ। বায়ুদূষণের প্রকৃতি, উৎস ও প্রভাব বোঝার জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন অপরিহার্য; কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বাংলাদেশে গবেষণার পরিসর এখনও সীমিত এবং এর পরিসর অপর্যাপ্ত। দেশের প্রায় ১৬৩টি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩০টির মতো পরিবেশবিজ্ঞান বা সংশ্লিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও আধুনিক ল্যাব, পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ফলে আমরা সমস্যার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাই না, আর গবেষণার অভাবের কারণে নীতি নির্ধারণও হয় অসম্পূর্ণ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার অন্যতম উপায় হলো তরুণ প্রজন্মকে পরিবেশ গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা এবং তাদের দক্ষ গবেষক হিসেবে গড়ে তোলা। কারণ তরুণরা মেধা, সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে সবচেয়ে সক্ষম এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদি অংশগ্রহণই বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে।
তরুণরা নতুন ভাবনা, উদ্যম ও সৃজনশীলতার জন্য পরিচিত। তারা প্রযুক্তির সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে, নতুন বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম আয়ত্ত করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা আহরণ করতে পারে। তরুণ গবেষকদের সমস্যা দেখার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, তারা প্রচলিত ধারা ভেঙে উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে পায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তারা ইটভাটার বিকল্প প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী, বৈদ্যুতিক যানবাহন, সৌরশক্তি, জৈব জ্বালানি ও কম খরচে বায়ু মান পরিমাপের যন্ত্র উদ্ভাবন করতে পারে। নগর পরিকল্পনায় সবুজায়নের নতুন কৌশল, ডেটা অ্যানালাইটিকসের মাধ্যমে দূষণ পূর্বাভাস বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার টেকসই সমাধানেও তারা এগিয়ে আসতে পারে।
অবশ্য তরুণ গবেষক গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন একটি অনুকূল পরিবেশ। প্রথমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে গবেষণামুখী করতে হবে। প্রাথমিক স্তর থেকেই পরিবেশ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিশুরা প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়। উচ্চশিক্ষায় বিশেষত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা চালু করে শিক্ষার্থীদের থিসিস বা ব্যবহারিক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, যাতে তারা বাস্তব সমস্যার সমাধান খুঁজতে পারে। সরকার ও বেসরকারি খাতকে মিলিতভাবে গবেষণা অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং তরুণদের জন্য বিশেষ ফেলোশিপ চালু করতে হবে। গবেষণা ল্যাব ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নত করতে হবে, যাতে তারা আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করতে পারে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ তরুণ গবেষকদের নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করবে এবং সেই অভিজ্ঞতা দেশীয় বাস্তবতায় প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।
তরুণ গবেষক তৈরির একটি কার্যকর উপায় হলো পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করা। গবেষণার জন্য আধুনিক সরঞ্জাম, ল্যাব, দূষণ পরিমাপ যন্ত্র, সফটওয়্যার, মাঠসমীক্ষা ও কম খরচে ব্যবহারযোগ্য সেন্সর প্রযুক্তি প্রয়োজন। তরুণরা হাতে-কলমে এসব ব্যবহার করলে আরও দক্ষ হবে। বাংলাদেশে গবেষণা বাজেট সীমিত এবং তরুণদের জন্য আলাদা তহবিল কম থাকে। তাই সরকারকে বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে, যেখানে তরুণরা প্রতিযোগিতামূলক অনুদান বা ফেলোশিপ পাবে। বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদেরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এছাড়া জাতীয় গবেষণা নেটওয়ার্ক তৈরি করা জরুরি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে। এতে তরুণরা একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারবে এবং সমন্বিত উদ্যোগে সমস্যার সমাধান করবে। তরুণদের গবেষণালব্ধ তথ্য ও সুপারিশ নীতিনির্ধারণে গুরুত্ব পেলে তারা অনুপ্রাণিত হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় যুক্ত থাকবে।
গবেষণার পাশাপাশি তরুণদের উদ্ভাবনী ধারণা উদ্যোক্তা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াও একটি কার্যকর উপায়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইনোভেশন ল্যাব, ইনকিউবেশন সেন্টার ও স্টার্টআপ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে, যেখানে তরুণ গবেষকরা নিজেদের উদ্ভাবনকে ব্যবসায়িক রূপ দিতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির প্রযুক্তি, কম খরচে বায়ু দূষণ পরিমাপক যন্ত্র, বা বৈদ্যুতিক যানবাহন চার্জিং সিস্টেমকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা সম্ভব। এভাবে গবেষণার ফলাফল সমাজ ও অর্থনীতির বাস্তব প্রয়োগে পৌঁছাবে, আর তরুণ গবেষকরা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হবে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে তরুণ গবেষকদের হাত ধরেই বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। তাদের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও গবেষণার ফলে শিল্পোন্নয়নের চাপ থাকা সত্ত্বেও বায়ুমানের উন্নতি হয়েছে। তাই তরুণদের আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় যুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ প্রকল্প, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ও ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এতে তারা বৈশ্বিক গবেষণার মানদ- বুঝবে এবং বিদেশি অভিজ্ঞতা দেশীয় সমস্যার সমাধানে প্রয়োগ করতে পারবে। বাংলাদেশ যদি তরুণ গবেষকদের যথাযথ সমর্থন ও স্বীকৃতি দেয়, তবে স্বল্প সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে। তবে তরুণ গবেষক তৈরির পথে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশে গবেষণার প্রতি আগ্রহ কম এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও চাকরির কারণে অনেক তরুণ মনোযোগ দিতে পারে না। এছাড়া মেধাপাচার রোধ করাও বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ অনেক মেধাবী তরুণ সুযোগ না পেয়ে বিদেশে চলে যায়। তাই গবেষণা পেশাকে আকর্ষণীয় ও সম্মানজনক করতে হবে। গবেষকদের জন্য ভালো কর্মপরিবেশ, সম্মানী, পদোন্নতি ও দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে, যাতে তারা দেশে থেকেই গবেষণায় নিয়োজিত থাকে।
বায়ু দূষণের প্রকৃতি, মাত্রা ও উৎস অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়। ঢাকার দূষণ প্রধানত যানবাহন ও ইটভাটা থেকে আসে, আর চট্টগ্রামে শিল্পকারখানার নির্গমন প্রধান কারণ। তাই কার্যকর সমাধানের জন্য সঠিক তথ্য সংগ্রহ, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন দরকার। গবেষণা ছাড়া অনুমাননির্ভর পদক্ষেপ সমস্যার মূল সমাধান করতে পারে না এবং নীতির কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। গবেষণা শুধু কারণ চিহ্নিত করাই নয়, সম্ভাব্য সমাধানের পথও নির্দেশ করে। যেমন- কোন ধরনের ইটভাটা বেশি দূষণ করছে, কোন জ্বালানি বিকল্প ব্যবহারযোগ্য, বা কিভাবে নগর পরিকল্পনায় দূষণ কমানো যায়Ñএসব প্রশ্নের উত্তর গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব।
বায়ুদূষণ কেবল একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং এটি একটি স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও উন্নয়ন সংকট। এর সমাধান খুঁজতে হলে কেবল নীতি বা আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক গবেষণার শক্ত ভিত। আর সেই ভিত তৈরি করবে তরুণ গবেষকরা। এ দেশে বায়ু দূষণ শিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা এখন আর আলোচনার বিষয় নয়, বরং সময়ের অপরিহার্য দাবি। তাই শিক্ষা ও গবেষণার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে, পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে, আধুনিক অবকাঠামো গড়তে হবে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে এবং কঠোর আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। তরুণদের জ্ঞান, মেধা ও সৃজনশীলতা যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ একদিকে যেমন স্বাস্থ্যকর ও দূষণমুক্ত পরিবেশ পাবে, অন্যদিকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
[লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ]
কামরুজ্জমান মজুমদার
শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫
বর্তমান বিশ্বে বায়ুদূষণ এক অদৃশ্য কিন্তু ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা মানবজীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। নগরায়ন, শিল্পায়ন, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বায়ুতে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষতিকর উপাদান, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। বাংলাদেশে শিল্প, অবকাঠামো ও নগর সম্প্রসারণের কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেও পরিবেশের ওপর চাপ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা প্রায়শই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে। ধূলিকণা, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও ব্ল্যাক কার্বনের মতো দূষণকারী উপাদান প্রতিদিন মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে, যার ফলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, হৃদরোগ এবং ফুসফুস ক্যান্সারের মতো রোগ বাড়ছে। শীত মৌসুমে ইটভাটা, নির্মাণকাজের ধুলা ও যানবাহনের ধোঁয়া এ সমস্যা আরও প্রকট করে তোলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ অকাল মৃত্যুর শিকার হয়।
এই জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান, গবেষণা এবং প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ। বায়ুদূষণের প্রকৃতি, উৎস ও প্রভাব বোঝার জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন অপরিহার্য; কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বাংলাদেশে গবেষণার পরিসর এখনও সীমিত এবং এর পরিসর অপর্যাপ্ত। দেশের প্রায় ১৬৩টি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩০টির মতো পরিবেশবিজ্ঞান বা সংশ্লিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও আধুনিক ল্যাব, পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ফলে আমরা সমস্যার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাই না, আর গবেষণার অভাবের কারণে নীতি নির্ধারণও হয় অসম্পূর্ণ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার অন্যতম উপায় হলো তরুণ প্রজন্মকে পরিবেশ গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা এবং তাদের দক্ষ গবেষক হিসেবে গড়ে তোলা। কারণ তরুণরা মেধা, সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে সবচেয়ে সক্ষম এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদি অংশগ্রহণই বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে।
তরুণরা নতুন ভাবনা, উদ্যম ও সৃজনশীলতার জন্য পরিচিত। তারা প্রযুক্তির সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে, নতুন বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম আয়ত্ত করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা আহরণ করতে পারে। তরুণ গবেষকদের সমস্যা দেখার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, তারা প্রচলিত ধারা ভেঙে উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে পায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তারা ইটভাটার বিকল্প প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী, বৈদ্যুতিক যানবাহন, সৌরশক্তি, জৈব জ্বালানি ও কম খরচে বায়ু মান পরিমাপের যন্ত্র উদ্ভাবন করতে পারে। নগর পরিকল্পনায় সবুজায়নের নতুন কৌশল, ডেটা অ্যানালাইটিকসের মাধ্যমে দূষণ পূর্বাভাস বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার টেকসই সমাধানেও তারা এগিয়ে আসতে পারে।
অবশ্য তরুণ গবেষক গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন একটি অনুকূল পরিবেশ। প্রথমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে গবেষণামুখী করতে হবে। প্রাথমিক স্তর থেকেই পরিবেশ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিশুরা প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়। উচ্চশিক্ষায় বিশেষত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা চালু করে শিক্ষার্থীদের থিসিস বা ব্যবহারিক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, যাতে তারা বাস্তব সমস্যার সমাধান খুঁজতে পারে। সরকার ও বেসরকারি খাতকে মিলিতভাবে গবেষণা অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং তরুণদের জন্য বিশেষ ফেলোশিপ চালু করতে হবে। গবেষণা ল্যাব ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নত করতে হবে, যাতে তারা আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করতে পারে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ তরুণ গবেষকদের নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করবে এবং সেই অভিজ্ঞতা দেশীয় বাস্তবতায় প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।
তরুণ গবেষক তৈরির একটি কার্যকর উপায় হলো পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করা। গবেষণার জন্য আধুনিক সরঞ্জাম, ল্যাব, দূষণ পরিমাপ যন্ত্র, সফটওয়্যার, মাঠসমীক্ষা ও কম খরচে ব্যবহারযোগ্য সেন্সর প্রযুক্তি প্রয়োজন। তরুণরা হাতে-কলমে এসব ব্যবহার করলে আরও দক্ষ হবে। বাংলাদেশে গবেষণা বাজেট সীমিত এবং তরুণদের জন্য আলাদা তহবিল কম থাকে। তাই সরকারকে বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে, যেখানে তরুণরা প্রতিযোগিতামূলক অনুদান বা ফেলোশিপ পাবে। বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদেরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এছাড়া জাতীয় গবেষণা নেটওয়ার্ক তৈরি করা জরুরি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে। এতে তরুণরা একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারবে এবং সমন্বিত উদ্যোগে সমস্যার সমাধান করবে। তরুণদের গবেষণালব্ধ তথ্য ও সুপারিশ নীতিনির্ধারণে গুরুত্ব পেলে তারা অনুপ্রাণিত হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় যুক্ত থাকবে।
গবেষণার পাশাপাশি তরুণদের উদ্ভাবনী ধারণা উদ্যোক্তা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াও একটি কার্যকর উপায়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইনোভেশন ল্যাব, ইনকিউবেশন সেন্টার ও স্টার্টআপ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে, যেখানে তরুণ গবেষকরা নিজেদের উদ্ভাবনকে ব্যবসায়িক রূপ দিতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির প্রযুক্তি, কম খরচে বায়ু দূষণ পরিমাপক যন্ত্র, বা বৈদ্যুতিক যানবাহন চার্জিং সিস্টেমকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা সম্ভব। এভাবে গবেষণার ফলাফল সমাজ ও অর্থনীতির বাস্তব প্রয়োগে পৌঁছাবে, আর তরুণ গবেষকরা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হবে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে তরুণ গবেষকদের হাত ধরেই বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। তাদের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও গবেষণার ফলে শিল্পোন্নয়নের চাপ থাকা সত্ত্বেও বায়ুমানের উন্নতি হয়েছে। তাই তরুণদের আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় যুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ প্রকল্প, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ও ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এতে তারা বৈশ্বিক গবেষণার মানদ- বুঝবে এবং বিদেশি অভিজ্ঞতা দেশীয় সমস্যার সমাধানে প্রয়োগ করতে পারবে। বাংলাদেশ যদি তরুণ গবেষকদের যথাযথ সমর্থন ও স্বীকৃতি দেয়, তবে স্বল্প সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে। তবে তরুণ গবেষক তৈরির পথে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশে গবেষণার প্রতি আগ্রহ কম এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও চাকরির কারণে অনেক তরুণ মনোযোগ দিতে পারে না। এছাড়া মেধাপাচার রোধ করাও বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ অনেক মেধাবী তরুণ সুযোগ না পেয়ে বিদেশে চলে যায়। তাই গবেষণা পেশাকে আকর্ষণীয় ও সম্মানজনক করতে হবে। গবেষকদের জন্য ভালো কর্মপরিবেশ, সম্মানী, পদোন্নতি ও দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে, যাতে তারা দেশে থেকেই গবেষণায় নিয়োজিত থাকে।
বায়ু দূষণের প্রকৃতি, মাত্রা ও উৎস অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়। ঢাকার দূষণ প্রধানত যানবাহন ও ইটভাটা থেকে আসে, আর চট্টগ্রামে শিল্পকারখানার নির্গমন প্রধান কারণ। তাই কার্যকর সমাধানের জন্য সঠিক তথ্য সংগ্রহ, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন দরকার। গবেষণা ছাড়া অনুমাননির্ভর পদক্ষেপ সমস্যার মূল সমাধান করতে পারে না এবং নীতির কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। গবেষণা শুধু কারণ চিহ্নিত করাই নয়, সম্ভাব্য সমাধানের পথও নির্দেশ করে। যেমন- কোন ধরনের ইটভাটা বেশি দূষণ করছে, কোন জ্বালানি বিকল্প ব্যবহারযোগ্য, বা কিভাবে নগর পরিকল্পনায় দূষণ কমানো যায়Ñএসব প্রশ্নের উত্তর গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব।
বায়ুদূষণ কেবল একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং এটি একটি স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও উন্নয়ন সংকট। এর সমাধান খুঁজতে হলে কেবল নীতি বা আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক গবেষণার শক্ত ভিত। আর সেই ভিত তৈরি করবে তরুণ গবেষকরা। এ দেশে বায়ু দূষণ শিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা এখন আর আলোচনার বিষয় নয়, বরং সময়ের অপরিহার্য দাবি। তাই শিক্ষা ও গবেষণার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে, পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে, আধুনিক অবকাঠামো গড়তে হবে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে এবং কঠোর আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। তরুণদের জ্ঞান, মেধা ও সৃজনশীলতা যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ একদিকে যেমন স্বাস্থ্যকর ও দূষণমুক্ত পরিবেশ পাবে, অন্যদিকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
[লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ]