এম এ হোসাইন
মায়ানমারে বিগত চার বছরের সংঘাতের ফলে ৮২ হাজারের বেশি প্রাণহানি, ৩২ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ এবং দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ এখন আয়তনের মাত্র এক-পঞ্চমাংশে সীমিত। বাকি অংশ ছিন্নভিন্ন ছোট ছোট টুকরো যা জাতিগত মিলিশিয়া, বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দখলে, যারা একে অপরকেও স্বীকার করে না। এমনকি কোথাও কোথাও জাতীয় মুদ্রাও অচল। মায়ানমার কেবল সংকটের মধ্যেই নয়, বরং দেশটি আসলে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে এক ধরনের ‘স্থায়ী বিশৃঙ্খলা’ কারণে যা আমরা আগে দেখেছি সোমালিয়া বা লিবিয়ায়।
কিন্তু পার্থক্য হলোÑ মায়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতির কেন্দ্রে। এই ভাঙনের ফলে এখন মাদক ব্যবসা, মানব পাচার ও অস্ত্র চোরাচালানের স্বর্গে পরিণত হয়েছে। তার চেয়েও ভয়াবহ, এটি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্য প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছেÑচীন, ভারত, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেকে নিজেদের স্বার্থে দড়ি টানাটানি করছে। ফলে এই গৃহযুদ্ধ কেবল মায়ানমারের নয়, একবিংশ শতাব্দীর প্রক্সি যুদ্ধের পরীক্ষাগার। আর ইতিহাস বলছে, এমন আগুন কখনো সীমান্তে আটকে থাকে না।
বর্তমানে ক্ষমতার কেন্দ্রে আছেন জেনারেল মিন অং হ্লাইং। কাগজে-কলমে তিনি সরকারের প্রধান, বাস্তবে তার দখল কেবল কয়েকটি শহর ও মহাসড়কে। দেশের বাকি অংশে শক্তি ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন বাহিনীর হাতে। উত্তরে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করছে। পশ্চিমে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পথে এগোচ্ছে। চিন রাজ্যে বহু মিলিশিয়া একে অপরের সঙ্গেও লড়াই করছে। পূর্বে কারেন ও কারেনি বাহিনী বহু দশকের পুরনো বিদ্রোহ চালাচ্ছে। শান অঞ্চলেও বিভক্তি, কেউ চায় ফেডারেল কাঠামো, কেউ পুরোপুরি বিচ্ছিন্নতা।
এর উপর আছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স, নির্বাসিত বেসামরিক সরকারের সশস্ত্র শাখা। তাদের লক্ষ্য সেনাশাসন উচ্ছেদ করে ফেডারেল গণতন্ত্র গড়া। কিন্তু এ পরিকল্পনা বহু জাতিগত মিলিশিয়ার কাছে অগ্রহণযোগ্য। ফলে মাঠে দাঁড়িয়েছে এক হোবসীয় বিশৃঙ্খলাÑকোনো একক জোট নেই, নেই কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাইরের খেলোয়াড় হলো চীন। কারণ ভৌগোলিক বাস্তবতা। মায়ানমারই একমাত্র প্রতিবেশী যা সরাসরি স্থলপথে ভারত মহাসাগরে পৌঁছার রাস্তা দেয়। মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প এই ১৭০০ কিলোমিটারের করিডর চীনের জন্য জীবনরেখা। ইউনান প্রদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত গড়ে উঠছে পাইপলাইন, সড়ক, রেলপথ। এর দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে দুইটি প্রকল্পÑ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দর ও ১.৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক অঞ্চল।
এ কারণেই চীন খেলছে দুই দিকেই। তারা সেনাশাসনকে অস্ত্র বিক্রি করছে, আবার চোখ বন্ধ করে রাখছে যখন চীনা অস্ত্র বিদ্রোহীদের হাতে পৌঁছাচ্ছে। অলিখিত নিয়ম হলো: যুদ্ধ চালিয়ে যাও, কিন্তু চীনা সম্পদে হাত দিও না। এই বাস্তবতাই চীনের প্রকৃত কূটনীতি।
এটি নতুন নয়। ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন দমন হলে পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা দেয়। তখনই চীন সামনে আসে, এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অস্ত্র বিক্রি করে ও সীমান্ত বাণিজ্য বাড়িয়ে তোলে। তবু মায়ানমারের সেনাবাহিনী চীনের উপর নির্ভরশীলতা নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল। তাই তারা রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তোলে। জান্তা সরকার রাশিয়ার কাছ থেকে মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও গানশিপ কিনে। আজও সেগুলো বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের চাপে রাশিয়ার মনোযোগ অন্যত্র, ফলে চীন আবারও হয়ে উঠেছে অবধারিত শক্তি।
ভারতের কৌশল তুলনায় অনেক দুর্বল। এর প্রধান উদ্বেগ সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চল। বহু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী মায়ানমারের জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়ে ভারতীয় ভূখ-ে হামলা চালায়। তাই দিল্লি সেনাশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করছে, গোপন অভিযানে অংশ নিচ্ছে, ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তার বাইরে ভারতের তেমন প্রভাব নেই। অর্থনৈতিক বিনিয়োগ কম, জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। ফলে ভারতের কৌশল চীনের মতো সুপরিকল্পিত নয়, বরং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলও অস্পষ্ট। প্রকাশ্যে তারা নির্বাসিত বেসামরিক সরকারকে কেবল অর্থনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে এবং সেনাশাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু আড়ালে হিসাব আলাদা। থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই শহরে প্রায় ২৪৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে যে বিশাল কনস্যুলেট ভবন তৈরি হচ্ছে, তা মূলত গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোর অংশ। গুজব আছে বাংলাদেশে কক্সবাজারে সরবরাহ ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনাও চলছে, যা আরাকান আর্মির মতো গোষ্ঠীকে সাহায্য করতে পারে।
এগুলো সত্য হোক বা না হোক, যুক্তরাষ্ট্রের একটি উদ্দেশ্য স্পষ্ট: চীনের করিডর দুর্বল করা এবং বঙ্গোপসাগরে তাদের প্রবেশাধিকার জটিল করা। তবে এই পথে গিয়ে বিদ্রোহীদের উস্কে দিলে মানবিক বিপর্যয় আরও বাড়তে পারে। আফগানিস্তান ও সিরিয়ার মতো জায়গায় দেখা গেছেÑপ্রক্সিকে অস্ত্র দেওয়ার ফলে শত্রু দুর্বল হয়, কিন্তু টেকসই রাষ্ট্র গড়তে পারে না।
মায়ানমারের দুর্দশা তাই পরিচিত দৃশ্য। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, সিরিয়াÑপ্রত্যেকটি দেশ স্থানীয় সংঘাত থেকে বৈশ্বিক প্রক্সি যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। ফলাফল ছিল একই: ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজ, চরমপন্থীদের উত্থান, লক্ষ লক্ষ শরণার্থী। মায়ানমারের ছবিও সেই পুনরাবৃত্তি। ২০২১ সালের অভ্যুত্থান এখন চীনের জ্বালানি নিরাপত্তা, ভারতের সীমান্ত, রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রি এবং আমেরিকার চীনবিরোধী কৌশলের খেলাঘরে রূপ নিয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থ খুঁজছে; কারও লক্ষ্যই স্থিতিশীলতা নয়। হারছে কেবল মায়ানমারের মানুষ।
তবে, এখন পর্যন্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দুটো। এক, চীন ধীরে ধীরে মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই তারা শান রাজ্যে আংশিক যুদ্ধবিরতি করাতে সক্ষম হয়েছে। সেনাশাসন ও মিলিশিয়াদের সঙ্গে তাদের প্রভাব আছে। তাই তারা শান্তি চাপিয়ে দিতে পারে। যদিও সেই শান্তি হবে চীনের করিডর সুরক্ষার শান্তি। গণতন্ত্র বা জাতিগত অধিকার সেখানে স্থান পাবে না। মায়ানমার বেঁচে থাকবে, কিন্তু তা হবে চীনের প্রভাব বলয়ের অধীনে। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো স্থায়ী ব্যর্থ রাষ্ট্র। সিরিয়ার মতো ছিন্নভিন্ন ভূখ-, স্থায়ী যুদ্ধ ও বহিরাগত শক্তির দৌরাত্ম্য। এতে কেবল মায়ানমার নয়, ভারতের উত্তর-পূর্ব, বাংলাদেশের উপকূল, থাইল্যান্ডের সীমান্তও অস্থির হবে।
পশ্চিমাদের জন্য এই সংকট এক পরিচিত নৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। কিছু না করা মানে হলো লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্বৈরতন্ত্র ও বিশৃঙ্খলার হাতে ছেড়ে দেওয়া। আবার হস্তক্ষেপ করা মানে ইরাক বা লিবিয়ার মতো অহঙ্কারী ভুলের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নেওয়া। তবু উদাসীনতাও নিরপেক্ষ নয়; সেটি এক ধরনের সহযোগিতা। যদি মায়ানমার চীনের করিডরের উপর একটি মাদক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তবে এর পরিণতি এশিয়ার সীমা ছাড়িয়ে আরও বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।
এখানে প্রয়োজন সংযম ও স্পষ্ট দৃষ্টি। মায়ানমার এমন যুদ্ধ নয় যেখানে বাইরের শক্তি জয়ী হতে পারবে। তবে তারা চাইলে ক্ষতি আর বৃদ্ধি পাবে না। এর মানে হলোÑচীনের উপর চাপ বাড়ানো যাতে তারা সত্যিকার শান্তির দায়িত্ব নেয়, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার না করা, এবং নীতির কেন্দ্রে রাখতে মায়ানমারের সাধারণ মানুষকেÑযারা আজও বাস্তুচ্যুত, নিঃস্ব, বিস্মৃত।
ভূরাজনীতিতে যা থামানো হয় না, তাই অধ্যয়ন করা হয়; আর যা অধ্যয়ন করা হয়, তা পরবর্তী যুদ্ধে পুনরাবৃত্তি ঘটে। মায়ানমার আজ একই সঙ্গে এক ট্র্যাজেডি ও এক সতর্কবার্তা। এটি মনে করিয়ে দেয় কিভাবে রাষ্ট্রব্যর্থতা মহাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার পরীক্ষাগারে পরিণত হয়, আর প্রক্সি যুদ্ধ কেবল আরও সহিংসতা জন্ম দেয়। দেশটি হয়তো চোখের সামনেই ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, কিন্তু এরকম পতন বিশ্ব এর আগেও দেখেছে। প্রশ্ন হলোÑকেউ কি এবার এর থেকে শিক্ষা নিতে প্রস্তুত?
[লেখক: প্রাবন্ধিক]
এম এ হোসাইন
শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫
মায়ানমারে বিগত চার বছরের সংঘাতের ফলে ৮২ হাজারের বেশি প্রাণহানি, ৩২ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ এবং দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ এখন আয়তনের মাত্র এক-পঞ্চমাংশে সীমিত। বাকি অংশ ছিন্নভিন্ন ছোট ছোট টুকরো যা জাতিগত মিলিশিয়া, বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দখলে, যারা একে অপরকেও স্বীকার করে না। এমনকি কোথাও কোথাও জাতীয় মুদ্রাও অচল। মায়ানমার কেবল সংকটের মধ্যেই নয়, বরং দেশটি আসলে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে এক ধরনের ‘স্থায়ী বিশৃঙ্খলা’ কারণে যা আমরা আগে দেখেছি সোমালিয়া বা লিবিয়ায়।
কিন্তু পার্থক্য হলোÑ মায়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতির কেন্দ্রে। এই ভাঙনের ফলে এখন মাদক ব্যবসা, মানব পাচার ও অস্ত্র চোরাচালানের স্বর্গে পরিণত হয়েছে। তার চেয়েও ভয়াবহ, এটি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্য প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছেÑচীন, ভারত, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেকে নিজেদের স্বার্থে দড়ি টানাটানি করছে। ফলে এই গৃহযুদ্ধ কেবল মায়ানমারের নয়, একবিংশ শতাব্দীর প্রক্সি যুদ্ধের পরীক্ষাগার। আর ইতিহাস বলছে, এমন আগুন কখনো সীমান্তে আটকে থাকে না।
বর্তমানে ক্ষমতার কেন্দ্রে আছেন জেনারেল মিন অং হ্লাইং। কাগজে-কলমে তিনি সরকারের প্রধান, বাস্তবে তার দখল কেবল কয়েকটি শহর ও মহাসড়কে। দেশের বাকি অংশে শক্তি ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন বাহিনীর হাতে। উত্তরে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করছে। পশ্চিমে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পথে এগোচ্ছে। চিন রাজ্যে বহু মিলিশিয়া একে অপরের সঙ্গেও লড়াই করছে। পূর্বে কারেন ও কারেনি বাহিনী বহু দশকের পুরনো বিদ্রোহ চালাচ্ছে। শান অঞ্চলেও বিভক্তি, কেউ চায় ফেডারেল কাঠামো, কেউ পুরোপুরি বিচ্ছিন্নতা।
এর উপর আছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স, নির্বাসিত বেসামরিক সরকারের সশস্ত্র শাখা। তাদের লক্ষ্য সেনাশাসন উচ্ছেদ করে ফেডারেল গণতন্ত্র গড়া। কিন্তু এ পরিকল্পনা বহু জাতিগত মিলিশিয়ার কাছে অগ্রহণযোগ্য। ফলে মাঠে দাঁড়িয়েছে এক হোবসীয় বিশৃঙ্খলাÑকোনো একক জোট নেই, নেই কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাইরের খেলোয়াড় হলো চীন। কারণ ভৌগোলিক বাস্তবতা। মায়ানমারই একমাত্র প্রতিবেশী যা সরাসরি স্থলপথে ভারত মহাসাগরে পৌঁছার রাস্তা দেয়। মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প এই ১৭০০ কিলোমিটারের করিডর চীনের জন্য জীবনরেখা। ইউনান প্রদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত গড়ে উঠছে পাইপলাইন, সড়ক, রেলপথ। এর দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে দুইটি প্রকল্পÑ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দর ও ১.৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক অঞ্চল।
এ কারণেই চীন খেলছে দুই দিকেই। তারা সেনাশাসনকে অস্ত্র বিক্রি করছে, আবার চোখ বন্ধ করে রাখছে যখন চীনা অস্ত্র বিদ্রোহীদের হাতে পৌঁছাচ্ছে। অলিখিত নিয়ম হলো: যুদ্ধ চালিয়ে যাও, কিন্তু চীনা সম্পদে হাত দিও না। এই বাস্তবতাই চীনের প্রকৃত কূটনীতি।
এটি নতুন নয়। ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন দমন হলে পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা দেয়। তখনই চীন সামনে আসে, এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অস্ত্র বিক্রি করে ও সীমান্ত বাণিজ্য বাড়িয়ে তোলে। তবু মায়ানমারের সেনাবাহিনী চীনের উপর নির্ভরশীলতা নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল। তাই তারা রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তোলে। জান্তা সরকার রাশিয়ার কাছ থেকে মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও গানশিপ কিনে। আজও সেগুলো বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের চাপে রাশিয়ার মনোযোগ অন্যত্র, ফলে চীন আবারও হয়ে উঠেছে অবধারিত শক্তি।
ভারতের কৌশল তুলনায় অনেক দুর্বল। এর প্রধান উদ্বেগ সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চল। বহু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী মায়ানমারের জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়ে ভারতীয় ভূখ-ে হামলা চালায়। তাই দিল্লি সেনাশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করছে, গোপন অভিযানে অংশ নিচ্ছে, ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তার বাইরে ভারতের তেমন প্রভাব নেই। অর্থনৈতিক বিনিয়োগ কম, জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। ফলে ভারতের কৌশল চীনের মতো সুপরিকল্পিত নয়, বরং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলও অস্পষ্ট। প্রকাশ্যে তারা নির্বাসিত বেসামরিক সরকারকে কেবল অর্থনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে এবং সেনাশাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু আড়ালে হিসাব আলাদা। থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই শহরে প্রায় ২৪৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে যে বিশাল কনস্যুলেট ভবন তৈরি হচ্ছে, তা মূলত গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোর অংশ। গুজব আছে বাংলাদেশে কক্সবাজারে সরবরাহ ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনাও চলছে, যা আরাকান আর্মির মতো গোষ্ঠীকে সাহায্য করতে পারে।
এগুলো সত্য হোক বা না হোক, যুক্তরাষ্ট্রের একটি উদ্দেশ্য স্পষ্ট: চীনের করিডর দুর্বল করা এবং বঙ্গোপসাগরে তাদের প্রবেশাধিকার জটিল করা। তবে এই পথে গিয়ে বিদ্রোহীদের উস্কে দিলে মানবিক বিপর্যয় আরও বাড়তে পারে। আফগানিস্তান ও সিরিয়ার মতো জায়গায় দেখা গেছেÑপ্রক্সিকে অস্ত্র দেওয়ার ফলে শত্রু দুর্বল হয়, কিন্তু টেকসই রাষ্ট্র গড়তে পারে না।
মায়ানমারের দুর্দশা তাই পরিচিত দৃশ্য। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, সিরিয়াÑপ্রত্যেকটি দেশ স্থানীয় সংঘাত থেকে বৈশ্বিক প্রক্সি যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। ফলাফল ছিল একই: ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজ, চরমপন্থীদের উত্থান, লক্ষ লক্ষ শরণার্থী। মায়ানমারের ছবিও সেই পুনরাবৃত্তি। ২০২১ সালের অভ্যুত্থান এখন চীনের জ্বালানি নিরাপত্তা, ভারতের সীমান্ত, রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রি এবং আমেরিকার চীনবিরোধী কৌশলের খেলাঘরে রূপ নিয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থ খুঁজছে; কারও লক্ষ্যই স্থিতিশীলতা নয়। হারছে কেবল মায়ানমারের মানুষ।
তবে, এখন পর্যন্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দুটো। এক, চীন ধীরে ধীরে মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই তারা শান রাজ্যে আংশিক যুদ্ধবিরতি করাতে সক্ষম হয়েছে। সেনাশাসন ও মিলিশিয়াদের সঙ্গে তাদের প্রভাব আছে। তাই তারা শান্তি চাপিয়ে দিতে পারে। যদিও সেই শান্তি হবে চীনের করিডর সুরক্ষার শান্তি। গণতন্ত্র বা জাতিগত অধিকার সেখানে স্থান পাবে না। মায়ানমার বেঁচে থাকবে, কিন্তু তা হবে চীনের প্রভাব বলয়ের অধীনে। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো স্থায়ী ব্যর্থ রাষ্ট্র। সিরিয়ার মতো ছিন্নভিন্ন ভূখ-, স্থায়ী যুদ্ধ ও বহিরাগত শক্তির দৌরাত্ম্য। এতে কেবল মায়ানমার নয়, ভারতের উত্তর-পূর্ব, বাংলাদেশের উপকূল, থাইল্যান্ডের সীমান্তও অস্থির হবে।
পশ্চিমাদের জন্য এই সংকট এক পরিচিত নৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। কিছু না করা মানে হলো লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্বৈরতন্ত্র ও বিশৃঙ্খলার হাতে ছেড়ে দেওয়া। আবার হস্তক্ষেপ করা মানে ইরাক বা লিবিয়ার মতো অহঙ্কারী ভুলের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নেওয়া। তবু উদাসীনতাও নিরপেক্ষ নয়; সেটি এক ধরনের সহযোগিতা। যদি মায়ানমার চীনের করিডরের উপর একটি মাদক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তবে এর পরিণতি এশিয়ার সীমা ছাড়িয়ে আরও বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।
এখানে প্রয়োজন সংযম ও স্পষ্ট দৃষ্টি। মায়ানমার এমন যুদ্ধ নয় যেখানে বাইরের শক্তি জয়ী হতে পারবে। তবে তারা চাইলে ক্ষতি আর বৃদ্ধি পাবে না। এর মানে হলোÑচীনের উপর চাপ বাড়ানো যাতে তারা সত্যিকার শান্তির দায়িত্ব নেয়, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার না করা, এবং নীতির কেন্দ্রে রাখতে মায়ানমারের সাধারণ মানুষকেÑযারা আজও বাস্তুচ্যুত, নিঃস্ব, বিস্মৃত।
ভূরাজনীতিতে যা থামানো হয় না, তাই অধ্যয়ন করা হয়; আর যা অধ্যয়ন করা হয়, তা পরবর্তী যুদ্ধে পুনরাবৃত্তি ঘটে। মায়ানমার আজ একই সঙ্গে এক ট্র্যাজেডি ও এক সতর্কবার্তা। এটি মনে করিয়ে দেয় কিভাবে রাষ্ট্রব্যর্থতা মহাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার পরীক্ষাগারে পরিণত হয়, আর প্রক্সি যুদ্ধ কেবল আরও সহিংসতা জন্ম দেয়। দেশটি হয়তো চোখের সামনেই ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, কিন্তু এরকম পতন বিশ্ব এর আগেও দেখেছে। প্রশ্ন হলোÑকেউ কি এবার এর থেকে শিক্ষা নিতে প্রস্তুত?
[লেখক: প্রাবন্ধিক]