alt

opinion » post-editorial

মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা: জাপান এক অনুসরণীয় আদর্শ

মাহরুফ চৌধুরী

: রোববার, ২৪ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় যে সংকটটি সবচেয়ে গভীর ও বিপজ্জনক রূপে আমাদের সামনে এসে

দাঁড়িয়েছে, তা হলো নৈতিক শিক্ষার অভাব। চারদিকে যত বিদ্যা, তত্ত্ব, তথ্য, ও কথাবার্তার সমারোহ

দেখা যায়, তার ভেতর অন্তঃসারশূন্যতাই প্রকট। চায়ের দোকানের টঙ-আলাপ থেকে শুরু করে টেলিভিশনের

টক-শো পর্যন্ত হাজারো কথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ নানা বিশ্লেষণ ও পরামর্শে মাতিয়ে রাখলেও, তাদের নৈতিক

দৃঢ়তা বা সমাজ-নির্মাণে কার্যকর ভূমিকা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এরা যেন পিছন থেকে পাহাড় ঠেলার চেষ্টায়

ব্যস্ত, কিন্তু সামনে আলোর পথ দেখানোর সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ও

আচার-আচরণে। চারিদিকে উচ্চ ডিগ্রির সনদের ছড়াছড়ি। এই বাস্তবতা আমাদের সামনে এক মৌলিক

প্রশ্ন তুলে ধরে: আমরা কি সত্যিই শিক্ষিত মানুষ হতে পেরেছি?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ‘শিক্ষা’ ধারণার পর্যালোচনা প্রয়োজন। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়,

একজন সৎ, দায়িত্বশীল ও মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এখন অনেক বেশি

জোরালো। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কাছে জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।

জাপানী শিক্ষা ব্যবস্থায় জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উন্নয়ন, শিষ্টাচার, দায়িত্ববোধ

ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশুরা প্রাথমিক স্তরেই শেখে সহানুভূতি,

পরিচ্ছন্নতা, দায়িত্ববোধ, দলগত কাজ এবং সামাজিক সম্প্রীতির মূল্য। তাদের এই মানবিক ভিত্তির

নির্মাণ প্রক্রিয়া আমাদের দেশের জন্য গভীরভাবে শিক্ষণীয়, বিশেষত যখন আমাদের সমাজে নৈতিক

অবক্ষয় একপ্রকার প্রাত্যহিক চিত্রে পরিণত হয়েছে।

প্রাথমিক স্তরেই শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতার হাতেখড়ি হওয়া উচিত প্রতিটি শিশুর। এক্ষেত্রে

পারিবারিক পরিবেশ ও বিদ্যালয়-পরিবার সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। আগেই

উল্লেখ করা হয়েছে, জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার এক অনন্য দিক হলো শিশুদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ও

দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা, যা শুরু হয় জীবনের একেবারে প্রারম্ভিক স্তর থেকেই। জাপানে শ্রদ্ধা কেবল

সামাজিক শিষ্টাচার নয়, বরং শিক্ষার একটি অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ, যা শিক্ষার্থীদের আচরণে

প্রাত্যহিকভাবে প্রতিফলিত হয়। শিক্ষক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহপাঠীদের প্রতি

সৌজন্য প্রকাশ এসব শুধু পাঠ্যসূচির অংশ নয়, বরং জীবনের অপরিহার্য অনুশীলন হিসেবে আত্মস্থ করা

হয়। বিশেষ করে, মেইজি যুগের পর থেকে জাপানে এই চর্চার ভিত গড়ে ওঠে কনফুসীয় নীতির ভিত্তিতে,

যেখানে সামাজিক সাম্য, আনুগত্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, শৃঙ্খলা ও কর্তব্যবোধকে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া

হয়।

জাপানি স্কুলে শিশুরা নিজেরাই শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার করে, টয়লেট ঝাড়– দেয়, এমনকি খাবার পরিবেশনেও

অংশ নেয়। এখানেই গড়ে ওঠে আত্মনির্ভরতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের শক্ত ভিত। ‘নিজের কাজ নিজে

করা’ সেখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নয়, বরং মর্যাদার বিষয়, একটি সংস্কৃতিগত অবস্থান। এই ধরনের

শিক্ষা প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের নাগরিক গুণ (ভার্চু) গঠনের তত্ত্বের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ,

যেখানে মানবিক উৎকর্ষ অর্জনের জন্য ব্যক্তির অভ্যাস, অনুশীলন ও নৈতিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর

দেওয়া হয়।

জাপানে খাবারের সময়টিও শিক্ষার অংশ। একত্রে বসে খাওয়া, নিজের খাবার নিজে নেওয়া ও অন্যকে খাবার

পরিবেশন করা, এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বন্ধন গড়ে তোলা এসবই শেখায় বিনয়, সমতা ও সামাজিক

সংহতি। এই প্রক্রিয়ায় শিশুরা শিখে যে, প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা মানবিক সমাজের ভিত্তি। একজন

পিছিয়ে পড়লে তাকে টেনে তোলা, অন্যের কষ্টে পাশে দাঁড়ানো, এবং সম্মিলিতভাবে সমাধানের পথে এগিয়ে

যাওয়াই সেখানে ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘মানবিকতা’র প্রকৃত অর্থ। এই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রমাণ করে যে, নৈতিকতা ও মানবিকতা কোনো পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ বিষয় নয়; বরং দৈনন্দিন জীবনে চর্চার মাধ্যমে এগুলো ব্যক্তি ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হতে পারে।

জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনুকরণীয় দিকগুলোর একটি হলো নৈতিক শিক্ষাকে

(মোরাল এডুকেশন) পাঠ্যক্রমের বাধ্যতামূলক অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। ‘ডোতোকু’ (নৈতিকতা বা

নীতিশাস্ত্র) নামে পরিচিত এই পাঠ্যক্রমে শিশুদের নৈতিকতা ও মানবিকতার বিষয়গুলো শেখানো হয় গল্প,

নাটক, জীবনের বাস্তব ঘটনা এবং দৃশ্য-চিত্রের মাধ্যমে। এর কারণ ডোতোকু একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ যা

জাপানি সংস্কৃতি এবং সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ধারণা প্রকাশ করে। প্রাথমিক স্তর থেকে

শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে এর সংযোজনের উদ্দেশ্য নিছক আচরণগত সংশোধন নয়; বরং শিক্ষার্থীর

মাঝে একটি সহানুভূতিশীল, দায়িত্ববান ও ন্যায়পরায়ণ মানবিক চরিত্র গঠন।

জাপানের এই শিক্ষানীতি ইমানুয়েল কান্টের নীতিবাদী দর্শনের সাথে মিল রয়েছে, যেখানে মানুষকে উদ্দেশ্য

হিসেবে দেখা হয়, উপায় হিসেবে নয়। শিশুকে শেখানো হয় সততা মানে শুধু মিথ্যা না বলা নয়, বরং

আত্মমর্যাদা রক্ষা করে সত্যে অবিচল থাকা। সহানুভূতির মানে কেবল দয়া নয়, বরং অপরের অবস্থান

বোঝার সক্ষমতা ও সক্রিয় সহায়তা। দায়িত্ববোধ মানে নির্ধারিত কাজ শেষ করা নয়, বরং সমাজ ও

পৃথিবীর প্রতি এক অন্তর্নিহিত দায়বদ্ধতা অনুভব করা। এই পাঠ্যসূচিতে শিশুদের বারবার মনে করিয়ে

দেওয়া হয় যে, জীবনের শ্রেষ্ঠ সাফল্য হলো একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠা। তারা শেখে, সামাজিক দায়-

দায়িত্ব ও মর্যাদা, চাকরি বা সম্পদের চেয়ে মূল্যবান হলো চরিত্র, আত্মসম্মানবোধ ও নৈতিক দৃঢ়তা। এই

দৃষ্টিভঙ্গি জাপানের সামাজিক কাঠামোতে গভীরভাবে প্রোথিত, এবং এর ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে একটি

দায়িত্বশীল, সহযোগিতামূলক ও মানবিক সমাজ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে যেখানে বর্তমানে নৈতিক মূল্যবোধের ঘাটতি রয়েছে কিংবা সেটা

শিক্ষায় ও আচরণে প্রায় অনুপস্থিত কিংবা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেখানে জাপানের এই

মডেল আমাদের জন্য একটি গাইডলাইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং

পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র সবার সম্মিলিত উদ্যোগে নৈতিকতা ও মানবিকতা যদি প্রাত্যহিক

শিক্ষায় একীভূত করে চর্চা করা হয়, তবে আমাদের সমাজেও জ্ঞানের পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের মাঝে

উত্তম চরিত্রের জাগরণ ঘটানো সম্ভব।

ব্যক্তিগত পরিসরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধই হলো নৈতিক শিক্ষার পরিণত রূপ। জাপানি নৈতিক শিক্ষার এটি

আরেকটি ব্যতিক্রমী ও বিস্ময়কর দিক। শিশুদের জীবনের শুরুতেই শিখানো হয় ব্যক্তিগত পরিসরের

(পারসোনাল বাউন্ডারিজ) প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে। এটি শুধুমাত্র ভদ্রতা বা সামাজিক শিষ্টাচারের

অংশ নয়, বরং নৈতিকতার একটি মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা বুঝে

নেয়, প্রত্যেক ব্যক্তির একটি নিজস্ব পরিসর বা পরিমন্ডল আছে, যেটিকে সম্মান জানানো মানে তার

মর্যাদাকে স্বীকার করা। তাদেরকে শেখানো হয় কাউকে তার পারিবারিক, আর্থিক, শারীরিক অবস্থা কিংবা

ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা অনুচিত। কারও ওজন, বয়স কিংবা শারীরিক বৈশিষ্ট্য

নিয়ে কৌতূহল প্রদর্শন করা সেখানে শুধু অশোভন নয়, এটি সামাজিক সচেতনতার ঘাটতির লক্ষণ হিসেবেও

বিবেচিত হয়। এই আচরণগত অনুশাসন মূলত ‘সহানুভূতিশীল সংবেদনশীলতা’ (এমপেথেটিক সেনসিভিলিটি)

গঠনের মাধ্যমে শিশুদের ভিন্নতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে সম্মান করতে শেখানো হয়।

এই শিক্ষা ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ক্ষমতার সম্পর্ক’ বিশ্লেষণের

আলোকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফুকো দেখিয়েছেন যে, ক্ষমতার সূক্ষ্ম রূপগুলো কেবল রাষ্ট্র বা

প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তি পর্যায়েও কাজ করে। জাপানি শিশুদের শেখানো হয়, ব্যক্তিগত গোপনীয়তায়

হস্তক্ষেপ না করাটাই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার এবং সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার উপায়। বাংলাদেশের

প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সামাজিক পরিসরে প্রায়ই দেখা যায়, পারিবারিক

বা ব্যক্তিগত বিষয়ে অযাচিত কৌতূহল ও মন্তব্য সামাজিক অসৌজন্যতাকে উৎসাহ দেয়, যা অনেক সময়

মানসিক অবক্ষয় ও বৈষম্যের জন্ম দেয়। জাপানের শিক্ষার সংস্কৃতি আমাদের শিখিয়ে দেয় যে,

সংবেদনশীলতা, সম্মান ও সহানুভূতির চর্চা কেবল আচরণের নয়, বরং নৈতিক উন্নয়নের পরিণত প্রকাশ।

অপরদিকে অন্যকে দৃঢ়তার সাথে ‘না’ বলার অধিকার এবং পছন্দ ও অপছন্দ নিয়ে ব্যক্তিগত অভিরুচির

সম্মানজনক চর্চাই জাপানী শিক্ষার্থীদের আত্মমর্যাদাবোধের বিশেষ পাঠ। জাপানি নৈতিক শিক্ষার একটি

মৌলিক দিক হলো শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় ‘না’ বলার অধিকার সবার আছে, এবং অন্যের সেই

‘না’ বলাকে শ্রদ্ধা করা অপরিহার্য। এটি কোনো বিদ্রোহী মানসিকতা নয়, বরং নিজস্ব ব্যক্তিত্বের

সীমারেখা বা পরিসর (পারসোনাল বাউন্ডারিজ) নির্ধারণ ও আত্মমর্যাদাবোধ প্রকাশের প্রাথমিক ধাপ।

জাপানি সমাজে একে অপমান নয়, বরং পারস্পরিক সম্মানের অংশ হিসেবে দেখা হয়।

এই শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা বুঝে যায় যে, মানবিক সম্পর্ক জোরজবরদস্তির নয়, পারস্পরিক সম্মতি ও

বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠা উচিত। ফলে জাপানে কারও ওপর নিজের মত, অনুভব বা সিদ্ধান্ত

চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি অনুপস্থিত। ‘আমি এটি করতে চাই না’ এই বাক্যটি সেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও

আত্মপরিচয়ের চিহ্ন, যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মর্যাদাকে নিশ্চিত করে। শিশুরা সহজেই শিখে নেয়

অন্যের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া, তার অভিপ্রায় শুনে নেওয়া এবং তার গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল

থাকা; আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, এগুলোই একটি সুস্থ ও ন্যায্য সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি। এই

ধারণাটি মার্কিন দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’র তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মিল

বলেছিলেন, ব্যক্তির স্বাধীনতা এমন এক পরিসর, যা অন্যের ক্ষতি না করে তার নিজস্ব চেতনা, মত ও

পছন্দকে অনুসরণ করার অধিকার দেয়। জাপানে নৈতিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিশুদের মনে সেই স্বতন্ত্র

চেতনার বিকাশ ঘটানো হয়, এবং সমাজ তাদের তা চর্চা করার পরিবেশ দেয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার জাপানি উদাহরণ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের

সমাজে প্রায়শই দেখা যায় সামাজিক রীতিনীতির নামে ব্যক্তি স্বাধীনতা দমন করা হয়, ভিন্নমতকে

অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। অথচ একটি সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন এমন একটি শিক্ষাদর্শন, যা

একদিকে শিশুকে শেখাবে নিজের মত প্রকাশের অধিকার, অন্যদিকে তাকে বুঝিয়ে দেবে অন্যের মতামত,

স্বাধীনতা ও সীমারেখার প্রতিও সমান শ্রদ্ধাশীল থাকা নৈতিক দায়িত্ব। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা

আমাদের সামনে এই বার্তাই স্পষ্টভাবে হাজির করে যে, মানবিকতা ও নৈতিকতা কেবল ভদ্রতা বা

আচরণের সৌজন্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি সম্মান, সামাজিক ন্যায়বোধ ও

পারস্পরিক দায়িত্ববোধের এক অবিচ্ছেদ্য সমন্বয়। তাই বাংলাদেশে যদি আমরা আগামী প্রজন্মকে

সত্যিকার অর্থে মানবিক, নৈতিক ও গণতান্ত্রিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তবে জাপানের এই

মডেল থেকে শিক্ষা নেওয়া আমাদের জন্য একান্ত জরুরি। জাতীয় শিক্ষা নীতিতে মানবিক ও নৈতিক

শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, পরিবার ও সমাজকে তার বাস্তব প্রয়োগে অংশীদার করা এবং ব্যক্তির

অধিকার ও সামাজিক দায়িত্বের ভারসাম্য রক্ষার উপর জোর দেওয়াই পারে আমাদের কাক্সিক্ষত

শিক্ষাসংস্কার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তনের সূচনা করতে।

[লেখক: ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

স্বপ্নের দক্ষিণ কোরিয়া; বাংলাদেশে আন্দোলন, ভিয়েতনামের সাফল্য

ডাকসু নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতি

ঢাকা শহরের উষ্ণতা: সবুজ হারানোর মূল্য

তিন বাহিনী প্রধানদের আশা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা

গনমাধ্যম জগতও নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে!

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন ট্র্যাজেডি

হোক সবুজ বিপ্লব

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : একজন বিধায়কের জামিন

নিউটনের আপেল : পতনের ভেতরে জাগরণের গল্প

বায়ুদূষণ গবেষণার প্রসার ও তরুণদের ভূমিকা : প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা আহমদ

চাপে সামষ্টিক অর্থনীতি

ছবি

একাত্তরের গণহত্যা : সংখ্যার বিতর্ক নাকি দায় হালকা করার চেষ্টা?

রম্যগদ্য : ‘দালাল-ধন্বন্তরি-জীবন রক্ষাকারী...’

সাদা পাথর লুটে সর্বদলীয় ঐক্য

গণিতের বহুমুখী ব্যবহার : আধুনিক বিজ্ঞানের চালিকাশক্তি

প্রসঙ্গ : পেঁপের রিং স্পট ভাইরাস

ছবি

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : রাজনৈতিক বিভেদের অমোচনীয় ক্ষত

ছবি

আলফ্রেড সরেন হত্যা : বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

কারাম উৎসব : বাংলার প্রাচীন কৃষি ও সংস্কৃতির ধারক

ছবি

আলাস্কা বৈঠক : শান্তির দেখা কি মিলল?

বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কতদূর?

মবের উন্মাদনা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার

জীবন থেকে নেয়া শিক্ষাগুলোই এগিয়ে দেয় জীবনকে

রাজনৈতিক কর্মসূচি, যানজট ও আচরণগত অর্থনীতি

সম্পদের অভিশাপ : সিলেটের সাদাপাথরে সংঘাতের সমাজতত্ত্ব ও নীতি-সংকট

নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো

মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার জরুরি

ছবি

সাদাপাথরের নীলাভ দেশ : ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য ও সংকট

একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমাজতত্ত্ব

বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির নতুন ভূরাজনীতি

মব ও জাস্টিস

ইতিহাসকে নতুন করে লেখা এক জগাখিচুড়ি!

নারীর সমঅধিকার : সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি

জ্ঞানের মঞ্চ এখন সার্কাস, গবেষণা সেখানে নীরব দর্শক

ছবি

ভরা শ্রাবণে স্বদেশ-ভাবনা

নারীর প্রতি সহিংসতা : বাস্তবতা, আইন ও প্রতিরোধের জরুরি দিকনির্দেশনা

tab

opinion » post-editorial

মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা: জাপান এক অনুসরণীয় আদর্শ

মাহরুফ চৌধুরী

রোববার, ২৪ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় যে সংকটটি সবচেয়ে গভীর ও বিপজ্জনক রূপে আমাদের সামনে এসে

দাঁড়িয়েছে, তা হলো নৈতিক শিক্ষার অভাব। চারদিকে যত বিদ্যা, তত্ত্ব, তথ্য, ও কথাবার্তার সমারোহ

দেখা যায়, তার ভেতর অন্তঃসারশূন্যতাই প্রকট। চায়ের দোকানের টঙ-আলাপ থেকে শুরু করে টেলিভিশনের

টক-শো পর্যন্ত হাজারো কথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ নানা বিশ্লেষণ ও পরামর্শে মাতিয়ে রাখলেও, তাদের নৈতিক

দৃঢ়তা বা সমাজ-নির্মাণে কার্যকর ভূমিকা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এরা যেন পিছন থেকে পাহাড় ঠেলার চেষ্টায়

ব্যস্ত, কিন্তু সামনে আলোর পথ দেখানোর সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ও

আচার-আচরণে। চারিদিকে উচ্চ ডিগ্রির সনদের ছড়াছড়ি। এই বাস্তবতা আমাদের সামনে এক মৌলিক

প্রশ্ন তুলে ধরে: আমরা কি সত্যিই শিক্ষিত মানুষ হতে পেরেছি?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ‘শিক্ষা’ ধারণার পর্যালোচনা প্রয়োজন। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়,

একজন সৎ, দায়িত্বশীল ও মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এখন অনেক বেশি

জোরালো। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কাছে জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।

জাপানী শিক্ষা ব্যবস্থায় জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উন্নয়ন, শিষ্টাচার, দায়িত্ববোধ

ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশুরা প্রাথমিক স্তরেই শেখে সহানুভূতি,

পরিচ্ছন্নতা, দায়িত্ববোধ, দলগত কাজ এবং সামাজিক সম্প্রীতির মূল্য। তাদের এই মানবিক ভিত্তির

নির্মাণ প্রক্রিয়া আমাদের দেশের জন্য গভীরভাবে শিক্ষণীয়, বিশেষত যখন আমাদের সমাজে নৈতিক

অবক্ষয় একপ্রকার প্রাত্যহিক চিত্রে পরিণত হয়েছে।

প্রাথমিক স্তরেই শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতার হাতেখড়ি হওয়া উচিত প্রতিটি শিশুর। এক্ষেত্রে

পারিবারিক পরিবেশ ও বিদ্যালয়-পরিবার সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। আগেই

উল্লেখ করা হয়েছে, জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার এক অনন্য দিক হলো শিশুদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ও

দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা, যা শুরু হয় জীবনের একেবারে প্রারম্ভিক স্তর থেকেই। জাপানে শ্রদ্ধা কেবল

সামাজিক শিষ্টাচার নয়, বরং শিক্ষার একটি অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ, যা শিক্ষার্থীদের আচরণে

প্রাত্যহিকভাবে প্রতিফলিত হয়। শিক্ষক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহপাঠীদের প্রতি

সৌজন্য প্রকাশ এসব শুধু পাঠ্যসূচির অংশ নয়, বরং জীবনের অপরিহার্য অনুশীলন হিসেবে আত্মস্থ করা

হয়। বিশেষ করে, মেইজি যুগের পর থেকে জাপানে এই চর্চার ভিত গড়ে ওঠে কনফুসীয় নীতির ভিত্তিতে,

যেখানে সামাজিক সাম্য, আনুগত্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, শৃঙ্খলা ও কর্তব্যবোধকে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া

হয়।

জাপানি স্কুলে শিশুরা নিজেরাই শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার করে, টয়লেট ঝাড়– দেয়, এমনকি খাবার পরিবেশনেও

অংশ নেয়। এখানেই গড়ে ওঠে আত্মনির্ভরতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের শক্ত ভিত। ‘নিজের কাজ নিজে

করা’ সেখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নয়, বরং মর্যাদার বিষয়, একটি সংস্কৃতিগত অবস্থান। এই ধরনের

শিক্ষা প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের নাগরিক গুণ (ভার্চু) গঠনের তত্ত্বের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ,

যেখানে মানবিক উৎকর্ষ অর্জনের জন্য ব্যক্তির অভ্যাস, অনুশীলন ও নৈতিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর

দেওয়া হয়।

জাপানে খাবারের সময়টিও শিক্ষার অংশ। একত্রে বসে খাওয়া, নিজের খাবার নিজে নেওয়া ও অন্যকে খাবার

পরিবেশন করা, এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বন্ধন গড়ে তোলা এসবই শেখায় বিনয়, সমতা ও সামাজিক

সংহতি। এই প্রক্রিয়ায় শিশুরা শিখে যে, প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা মানবিক সমাজের ভিত্তি। একজন

পিছিয়ে পড়লে তাকে টেনে তোলা, অন্যের কষ্টে পাশে দাঁড়ানো, এবং সম্মিলিতভাবে সমাধানের পথে এগিয়ে

যাওয়াই সেখানে ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘মানবিকতা’র প্রকৃত অর্থ। এই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রমাণ করে যে, নৈতিকতা ও মানবিকতা কোনো পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ বিষয় নয়; বরং দৈনন্দিন জীবনে চর্চার মাধ্যমে এগুলো ব্যক্তি ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হতে পারে।

জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনুকরণীয় দিকগুলোর একটি হলো নৈতিক শিক্ষাকে

(মোরাল এডুকেশন) পাঠ্যক্রমের বাধ্যতামূলক অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। ‘ডোতোকু’ (নৈতিকতা বা

নীতিশাস্ত্র) নামে পরিচিত এই পাঠ্যক্রমে শিশুদের নৈতিকতা ও মানবিকতার বিষয়গুলো শেখানো হয় গল্প,

নাটক, জীবনের বাস্তব ঘটনা এবং দৃশ্য-চিত্রের মাধ্যমে। এর কারণ ডোতোকু একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ যা

জাপানি সংস্কৃতি এবং সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ধারণা প্রকাশ করে। প্রাথমিক স্তর থেকে

শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে এর সংযোজনের উদ্দেশ্য নিছক আচরণগত সংশোধন নয়; বরং শিক্ষার্থীর

মাঝে একটি সহানুভূতিশীল, দায়িত্ববান ও ন্যায়পরায়ণ মানবিক চরিত্র গঠন।

জাপানের এই শিক্ষানীতি ইমানুয়েল কান্টের নীতিবাদী দর্শনের সাথে মিল রয়েছে, যেখানে মানুষকে উদ্দেশ্য

হিসেবে দেখা হয়, উপায় হিসেবে নয়। শিশুকে শেখানো হয় সততা মানে শুধু মিথ্যা না বলা নয়, বরং

আত্মমর্যাদা রক্ষা করে সত্যে অবিচল থাকা। সহানুভূতির মানে কেবল দয়া নয়, বরং অপরের অবস্থান

বোঝার সক্ষমতা ও সক্রিয় সহায়তা। দায়িত্ববোধ মানে নির্ধারিত কাজ শেষ করা নয়, বরং সমাজ ও

পৃথিবীর প্রতি এক অন্তর্নিহিত দায়বদ্ধতা অনুভব করা। এই পাঠ্যসূচিতে শিশুদের বারবার মনে করিয়ে

দেওয়া হয় যে, জীবনের শ্রেষ্ঠ সাফল্য হলো একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠা। তারা শেখে, সামাজিক দায়-

দায়িত্ব ও মর্যাদা, চাকরি বা সম্পদের চেয়ে মূল্যবান হলো চরিত্র, আত্মসম্মানবোধ ও নৈতিক দৃঢ়তা। এই

দৃষ্টিভঙ্গি জাপানের সামাজিক কাঠামোতে গভীরভাবে প্রোথিত, এবং এর ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে একটি

দায়িত্বশীল, সহযোগিতামূলক ও মানবিক সমাজ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে যেখানে বর্তমানে নৈতিক মূল্যবোধের ঘাটতি রয়েছে কিংবা সেটা

শিক্ষায় ও আচরণে প্রায় অনুপস্থিত কিংবা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেখানে জাপানের এই

মডেল আমাদের জন্য একটি গাইডলাইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং

পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র সবার সম্মিলিত উদ্যোগে নৈতিকতা ও মানবিকতা যদি প্রাত্যহিক

শিক্ষায় একীভূত করে চর্চা করা হয়, তবে আমাদের সমাজেও জ্ঞানের পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের মাঝে

উত্তম চরিত্রের জাগরণ ঘটানো সম্ভব।

ব্যক্তিগত পরিসরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধই হলো নৈতিক শিক্ষার পরিণত রূপ। জাপানি নৈতিক শিক্ষার এটি

আরেকটি ব্যতিক্রমী ও বিস্ময়কর দিক। শিশুদের জীবনের শুরুতেই শিখানো হয় ব্যক্তিগত পরিসরের

(পারসোনাল বাউন্ডারিজ) প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে। এটি শুধুমাত্র ভদ্রতা বা সামাজিক শিষ্টাচারের

অংশ নয়, বরং নৈতিকতার একটি মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা বুঝে

নেয়, প্রত্যেক ব্যক্তির একটি নিজস্ব পরিসর বা পরিমন্ডল আছে, যেটিকে সম্মান জানানো মানে তার

মর্যাদাকে স্বীকার করা। তাদেরকে শেখানো হয় কাউকে তার পারিবারিক, আর্থিক, শারীরিক অবস্থা কিংবা

ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা অনুচিত। কারও ওজন, বয়স কিংবা শারীরিক বৈশিষ্ট্য

নিয়ে কৌতূহল প্রদর্শন করা সেখানে শুধু অশোভন নয়, এটি সামাজিক সচেতনতার ঘাটতির লক্ষণ হিসেবেও

বিবেচিত হয়। এই আচরণগত অনুশাসন মূলত ‘সহানুভূতিশীল সংবেদনশীলতা’ (এমপেথেটিক সেনসিভিলিটি)

গঠনের মাধ্যমে শিশুদের ভিন্নতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে সম্মান করতে শেখানো হয়।

এই শিক্ষা ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ক্ষমতার সম্পর্ক’ বিশ্লেষণের

আলোকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফুকো দেখিয়েছেন যে, ক্ষমতার সূক্ষ্ম রূপগুলো কেবল রাষ্ট্র বা

প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তি পর্যায়েও কাজ করে। জাপানি শিশুদের শেখানো হয়, ব্যক্তিগত গোপনীয়তায়

হস্তক্ষেপ না করাটাই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার এবং সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার উপায়। বাংলাদেশের

প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সামাজিক পরিসরে প্রায়ই দেখা যায়, পারিবারিক

বা ব্যক্তিগত বিষয়ে অযাচিত কৌতূহল ও মন্তব্য সামাজিক অসৌজন্যতাকে উৎসাহ দেয়, যা অনেক সময়

মানসিক অবক্ষয় ও বৈষম্যের জন্ম দেয়। জাপানের শিক্ষার সংস্কৃতি আমাদের শিখিয়ে দেয় যে,

সংবেদনশীলতা, সম্মান ও সহানুভূতির চর্চা কেবল আচরণের নয়, বরং নৈতিক উন্নয়নের পরিণত প্রকাশ।

অপরদিকে অন্যকে দৃঢ়তার সাথে ‘না’ বলার অধিকার এবং পছন্দ ও অপছন্দ নিয়ে ব্যক্তিগত অভিরুচির

সম্মানজনক চর্চাই জাপানী শিক্ষার্থীদের আত্মমর্যাদাবোধের বিশেষ পাঠ। জাপানি নৈতিক শিক্ষার একটি

মৌলিক দিক হলো শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় ‘না’ বলার অধিকার সবার আছে, এবং অন্যের সেই

‘না’ বলাকে শ্রদ্ধা করা অপরিহার্য। এটি কোনো বিদ্রোহী মানসিকতা নয়, বরং নিজস্ব ব্যক্তিত্বের

সীমারেখা বা পরিসর (পারসোনাল বাউন্ডারিজ) নির্ধারণ ও আত্মমর্যাদাবোধ প্রকাশের প্রাথমিক ধাপ।

জাপানি সমাজে একে অপমান নয়, বরং পারস্পরিক সম্মানের অংশ হিসেবে দেখা হয়।

এই শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা বুঝে যায় যে, মানবিক সম্পর্ক জোরজবরদস্তির নয়, পারস্পরিক সম্মতি ও

বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠা উচিত। ফলে জাপানে কারও ওপর নিজের মত, অনুভব বা সিদ্ধান্ত

চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি অনুপস্থিত। ‘আমি এটি করতে চাই না’ এই বাক্যটি সেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও

আত্মপরিচয়ের চিহ্ন, যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মর্যাদাকে নিশ্চিত করে। শিশুরা সহজেই শিখে নেয়

অন্যের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া, তার অভিপ্রায় শুনে নেওয়া এবং তার গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল

থাকা; আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, এগুলোই একটি সুস্থ ও ন্যায্য সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি। এই

ধারণাটি মার্কিন দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’র তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মিল

বলেছিলেন, ব্যক্তির স্বাধীনতা এমন এক পরিসর, যা অন্যের ক্ষতি না করে তার নিজস্ব চেতনা, মত ও

পছন্দকে অনুসরণ করার অধিকার দেয়। জাপানে নৈতিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিশুদের মনে সেই স্বতন্ত্র

চেতনার বিকাশ ঘটানো হয়, এবং সমাজ তাদের তা চর্চা করার পরিবেশ দেয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার জাপানি উদাহরণ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের

সমাজে প্রায়শই দেখা যায় সামাজিক রীতিনীতির নামে ব্যক্তি স্বাধীনতা দমন করা হয়, ভিন্নমতকে

অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। অথচ একটি সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন এমন একটি শিক্ষাদর্শন, যা

একদিকে শিশুকে শেখাবে নিজের মত প্রকাশের অধিকার, অন্যদিকে তাকে বুঝিয়ে দেবে অন্যের মতামত,

স্বাধীনতা ও সীমারেখার প্রতিও সমান শ্রদ্ধাশীল থাকা নৈতিক দায়িত্ব। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা

আমাদের সামনে এই বার্তাই স্পষ্টভাবে হাজির করে যে, মানবিকতা ও নৈতিকতা কেবল ভদ্রতা বা

আচরণের সৌজন্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি সম্মান, সামাজিক ন্যায়বোধ ও

পারস্পরিক দায়িত্ববোধের এক অবিচ্ছেদ্য সমন্বয়। তাই বাংলাদেশে যদি আমরা আগামী প্রজন্মকে

সত্যিকার অর্থে মানবিক, নৈতিক ও গণতান্ত্রিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তবে জাপানের এই

মডেল থেকে শিক্ষা নেওয়া আমাদের জন্য একান্ত জরুরি। জাতীয় শিক্ষা নীতিতে মানবিক ও নৈতিক

শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, পরিবার ও সমাজকে তার বাস্তব প্রয়োগে অংশীদার করা এবং ব্যক্তির

অধিকার ও সামাজিক দায়িত্বের ভারসাম্য রক্ষার উপর জোর দেওয়াই পারে আমাদের কাক্সিক্ষত

শিক্ষাসংস্কার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তনের সূচনা করতে।

[লেখক: ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

back to top