আনোয়ারুল হক
প্রবাসে বসে দেশের অনলাইন পত্রিকায় খবর পড়তে হলো সাংবাদিক বিভূরঞ্জন সরকার আর নেই। বিভূরঞ্জন আমাদের মনোজগতে সাংবাদিক নয়, চলার পথের একজন সাথী, বিভূ দা। সদ্য স্বাধীন দেশে আমরা এসেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। আমি আসলাম ১৯৭২ সালে, আর বিভূ দা ১৯৭৩-এ। আমি দক্ষিণ বাংলার খুলনা থেকে আর বিভূ দা উত্তর বাংলার পঞ্চগড়ের বোদা থেকে। সেই থেকে ছাত্র আন্দোলনে একসাথে চলা। তবে গভীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে অনেক পরে।
ঘনিষ্ঠতা শুরুর উপলক্ষ চিত্র শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য। শিশির যখন ঠাকুরগাঁও থেকে চারুকলায় ভর্তি হতে এলো, উঠেছিলো বিভূদার কক্ষে। কোনো কাজে জগন্নাথ হলে গেলে বিভূদা শিশিরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। শিশিরও বিভূদার মতো স্কুল জীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সাথে ছিলো। একদিন বিভূদা আমাকে বললেন, শিশির আপনার একটা পোর্টেট আঁকতে চায়। আমি তো সানন্দে রাজি। নিজেকে বিশেষ ব্যক্তি মনে হতে লাগলো! এ উপলক্ষে বিভূদার রুমে ঘনঘন যাওয়া-আসা। শিশিরের আঁকা সেই পোর্টেট আজো সযতেœ রেখেছি। তখনকি জানতাম শিশির একদিন দেশসেরা চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট এবং একই সাথে শিক্ষাবিদ হবেন, আর বিভূ দা হবেন অবহেলিত সাংবাদিকদের একজন।
যাক সে সব কথা। বিভূ দা এবং আমরা আরো অনেকে, ছাত্র ইউনিয়নের যখন ভাটার টান সেই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসি। বিভূ দা সম্ভবত দুই দফা কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন। একবার প্রচার সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সহ সাধারণ সম্পাদক। ঐ সময়ে প্রয়াত খন্দকার ফারুক, নিতাই দাস, এম.এম. আকাশ, বিভূরঞ্জন সরকার, মহসিন আলী, রঞ্জন কর্মকার এবং আমি পরষ্পর খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি। ফারুক ভাইয়ের ‘ইকসু’ নিয়ে এবং রঞ্জন দার জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ নিয়ে পৃথক ব্যস্ততা থাকায় এবং আকাশের রাত্রিবাস পারিবারিক বাসায় হওয়ায় সব সময়ে তাদের তিনজনকে পাওয়া যেতো না। কিন্তু নিতাই দা, বিভূ দা, মহসিন ভাই আর আমার সকাল থেকে রাত অধিকাংশ সময়ই সংগঠনের কাজ, চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া আর আড্ডা একত্রে চলতো। বিভূ দা আমার অনেক আগেই ছাত্র আন্দোলন থেকে বিদায় নিয়ে একতা পত্রিকায় যোগ দিলেও আমার নিজ প্রয়োজনে যোগাযোগটা নিয়মিত ছিলো।
প্রধান প্রয়োজন ছিলো, ছাত্র ইউনিয়নের মুখপত্র ‘জয়ধ্বনি’-র জন্য লেখা প্রস্তুত করা। আমি বক্তৃতা বিবৃতি লিখতে পারতাম,অসুবিধা হতো না। কিন্তু ‘জয়ধ্বনি’র মূল লেখা বা সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় এসব লিখতে পারতাম না। আমার প্রধান অবলম্বন ছিলো বিভূ দা। এ কাজের জন্য একতা পত্রিকায় চলে যেতাম এবং বিভূদার সাহায্য নিয়ে লেখা প্রস্তুত করে ফেলতাম। বিভূদা না থাকলে বাধ্য হয়ে মৃনাল দা, হিলাল ভাই বা অজয় দার সাহায্য নিতাম কিন্তু ওনাদের সাহায্য নিতে একটু আড়ষ্টতা লাগতো। সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হলে তো লিখতেই হবে। তাই লেখালেখির ক্ষেত্রে সব সময় আমার ভরসার জায়গা ছিলো বিভূ দা।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির সামরিক শাসন বিরোধী রক্তক্ষয়ী ছাত্র বিক্ষোভের পর ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে যখন আত্মগোপনে যেতে হয় ভরসার স্থল ঐ বিভূ দা। পুরানো ঢাকার আগামছি লেনে বিভূ দা থাকতেন কামরুজ্জামান ননী ও শিখা দম্পত্তির সাথে পৃথক একটি বড় কক্ষে। বিভূ দার সাথে ঐ কক্ষেই আমার দীর্ঘ আত্মগোপন বাস। থাকা-খাওয়া ফ্রি! এভাবে তরুণ বয়সটায় বিভূদার সাথে নানাভাবে জড়িয়ে ছিলাম। অবশ্য কয়েক মাস পার হওয়ার পর এক জায়গায় থাকা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় তাহেরউল্লা আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে তেজকুনি পাড়ায় বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী সত্যব্রত দাস স্বপনের আবাস স্থলে নিয়ে যায়। ওখানেও থাকা-খাওয়া ছিলো ফ্রি।
বিভূ দার বিয়ে কোন সালে হয়েছিলো মনে নেই। তবে আমরা দলেবলে সেই পঞ্চগড়ের বোদায় বিয়েতে হাজির হয়েছিলাম। বিভূ দা বিয়ের পরে বাসা নেন নয়াপল্টনে। কিছুকাল পর আমিও নয়াপল্টনের জামাই হয়ে যাওয়ায় স্বপরিবারে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। ১৯৯১ সালের পর থেকে অনেকের মতো আমার রাজনৈতিক জীবনও ছন্নছাড়া হয়ে যায়। সম্ভবত বিভূ দারও তাই। পারষ্পরিক যোগাযোগ অনেক কমে যায়। দেখাসাক্ষাৎও হতো কদাচিৎ। তবে আমরা অনেকেই পেশাগত জীবনে একধরনের স্থিতি আনতে পারলেও বিভূ দা সেরকম স্থিতি আনতে পারেননি। বহুদিন পর গত বছর আগষ্ট ‘২৪ মাসে আমার একটা লেখা ছাপার বিষয়ে বিভূদার সাথে যোগাযোগ। আমি লেখাটি প্রথম আলো ও সমকালে ছাপাতে ব্যর্থ হলে কেউ একজন বিভূদার সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। বিভূ দা লেখাটি আজকের পত্রিকায় ছাপার ব্যবস্থা করলেন। বোধ করি কোনো দৈনিক পত্রিকায় সেটাই ছিলো আমার এই দীর্ঘ জীবনের প্রথম লেখা। বিভূ দা নিয়মিত লিখতে বললেন। লিখলামও বেশ কয়েকটি কলাম। এর মধ্যে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ‘বই মেলায় ডাস্টবিন’ নিয়ে একটি লেখা, ‘ধানমন্ডি ৩২’ নিয়ে লেখা এবং ‘৭ মার্চের তর্জনী’ নিয়ে লেখা পেয়ে তিনি বললেন তাদের পত্রিকায় এ ধরনের লেখা ছাপানো যাবে না। তাদের পত্রিকা চাপের মধ্যে আছে। তারপর থেকে আমিও আর ‘আজকের পত্রিকায়’ লেখা পাঠাই না। আবার যোগাযোগ কমে গেলো।
তবে এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি আমাকে একটি টেক্সট করেন। তখন তিনি অসুস্থ। তার শেষ চিঠিতে যে আর্থিক সংকটের কথা লিখেছেন অনেকটাই সে রকম। তার আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু তিনি সরাসরি চাইতে সংকোচ বোধ করছেন। আমি যেন তার হয়ে আমাদের বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে দেই। তিনি এটাও লেখেন বিষয়টা পাবলিক করা যাবে না। যা হোক আমি পৃথকভাবে এম.এম. আকাশ, মহসিন ভাই, আওয়াল, তাহেরউল্লাহ, আইউব প্রমুখকে জানাই। প্রায় সকলেই সাড়া দেয় এবং সরাসরি বিভূদার বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। তাহেরউল্লাহ উদ্যোগ নিয়ে আরো কয়েকজনকে দিয়ে পাঠায়। নিতাই দা আর রঞ্জন দা যেহেতু তার সাথে সবসময় সরাসরি যোগাযোগে ছিলেন তাই তাঁদেরকে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করিনি। বিভূ দা ধন্যবাদ জানিয়ে টেক্সট করেন।
এরপরে বিষয়টি নিয়ে আর চিন্তা আসে নাই। যেহেতু ছেলে-মেয়ে দুজনেই পড়াশোনা শেষ করে ফেলেছে; মেয়ের বিয়েও তো খেলাম অনেকদিন হয়ে গেলো এবং তিনি একটা চাকরির মধ্যে আছেন, তাই তার বড় ধরনের আর্থিক সংকটের কথা মাথায় আসে নাই। না আসাটাই স্বাভাবিক। বিভূ দা আর যাই হোক ভোগবাদীতায় তো ছিলেন না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের বড় একটি অংশ সুবিধাবাদ আর চাটুকারিতা করে যেভাবে ভোগ-বিলাসিতার জীবন বেছে নিয়েছিলেন তার বিপরীতে বিভূ দার আর্থিক দীন্যতা নিয়ে নিজের মাঝে এক ধরণের আক্ষেপ জমা হয়েছিল- যা কিন্তু তার জীবনের সাথে যায় না।
কিন্তু এই আর্থিক টানাপোড়েন আর অসুস্থতার মাঝে যখন একটি লেখা যা তার নিজেরও নয়, সেটা পত্রিকায় ছাপা নিয়ে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়েছে, অফিসে যেতে না করা হয়েছে তখন এই বয়সে এক গভীর অনিশ্চয়তা তাকে চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। হয়তো পত্রিকা কতৃপক্ষ রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপ থেকে রক্ষা পেতে বা হঠাৎ করে কোনো মব উল্লম্ফনের কোপানল থেকে রক্ষা পেতে এ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এ ঘটনায় প্রকাশ পেলো গণমাধ্যম জগতও এক ধরনের নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। বেতন কাঠামোর দুরবস্থা ছাড়াও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভয়ে তাদেরকে সেলফ-সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
এই বয়সে পরিবারকে হাহাকারের মধ্যে রেখে, আমাদেরকে বেদনায় নীল করে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন। নাকি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরো বড় ধরনের কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনার সংবাদ!
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]
আনোয়ারুল হক
রোববার, ২৪ আগস্ট ২০২৫
প্রবাসে বসে দেশের অনলাইন পত্রিকায় খবর পড়তে হলো সাংবাদিক বিভূরঞ্জন সরকার আর নেই। বিভূরঞ্জন আমাদের মনোজগতে সাংবাদিক নয়, চলার পথের একজন সাথী, বিভূ দা। সদ্য স্বাধীন দেশে আমরা এসেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। আমি আসলাম ১৯৭২ সালে, আর বিভূ দা ১৯৭৩-এ। আমি দক্ষিণ বাংলার খুলনা থেকে আর বিভূ দা উত্তর বাংলার পঞ্চগড়ের বোদা থেকে। সেই থেকে ছাত্র আন্দোলনে একসাথে চলা। তবে গভীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে অনেক পরে।
ঘনিষ্ঠতা শুরুর উপলক্ষ চিত্র শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য। শিশির যখন ঠাকুরগাঁও থেকে চারুকলায় ভর্তি হতে এলো, উঠেছিলো বিভূদার কক্ষে। কোনো কাজে জগন্নাথ হলে গেলে বিভূদা শিশিরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। শিশিরও বিভূদার মতো স্কুল জীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সাথে ছিলো। একদিন বিভূদা আমাকে বললেন, শিশির আপনার একটা পোর্টেট আঁকতে চায়। আমি তো সানন্দে রাজি। নিজেকে বিশেষ ব্যক্তি মনে হতে লাগলো! এ উপলক্ষে বিভূদার রুমে ঘনঘন যাওয়া-আসা। শিশিরের আঁকা সেই পোর্টেট আজো সযতেœ রেখেছি। তখনকি জানতাম শিশির একদিন দেশসেরা চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট এবং একই সাথে শিক্ষাবিদ হবেন, আর বিভূ দা হবেন অবহেলিত সাংবাদিকদের একজন।
যাক সে সব কথা। বিভূ দা এবং আমরা আরো অনেকে, ছাত্র ইউনিয়নের যখন ভাটার টান সেই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসি। বিভূ দা সম্ভবত দুই দফা কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন। একবার প্রচার সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সহ সাধারণ সম্পাদক। ঐ সময়ে প্রয়াত খন্দকার ফারুক, নিতাই দাস, এম.এম. আকাশ, বিভূরঞ্জন সরকার, মহসিন আলী, রঞ্জন কর্মকার এবং আমি পরষ্পর খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি। ফারুক ভাইয়ের ‘ইকসু’ নিয়ে এবং রঞ্জন দার জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ নিয়ে পৃথক ব্যস্ততা থাকায় এবং আকাশের রাত্রিবাস পারিবারিক বাসায় হওয়ায় সব সময়ে তাদের তিনজনকে পাওয়া যেতো না। কিন্তু নিতাই দা, বিভূ দা, মহসিন ভাই আর আমার সকাল থেকে রাত অধিকাংশ সময়ই সংগঠনের কাজ, চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া আর আড্ডা একত্রে চলতো। বিভূ দা আমার অনেক আগেই ছাত্র আন্দোলন থেকে বিদায় নিয়ে একতা পত্রিকায় যোগ দিলেও আমার নিজ প্রয়োজনে যোগাযোগটা নিয়মিত ছিলো।
প্রধান প্রয়োজন ছিলো, ছাত্র ইউনিয়নের মুখপত্র ‘জয়ধ্বনি’-র জন্য লেখা প্রস্তুত করা। আমি বক্তৃতা বিবৃতি লিখতে পারতাম,অসুবিধা হতো না। কিন্তু ‘জয়ধ্বনি’র মূল লেখা বা সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় এসব লিখতে পারতাম না। আমার প্রধান অবলম্বন ছিলো বিভূ দা। এ কাজের জন্য একতা পত্রিকায় চলে যেতাম এবং বিভূদার সাহায্য নিয়ে লেখা প্রস্তুত করে ফেলতাম। বিভূদা না থাকলে বাধ্য হয়ে মৃনাল দা, হিলাল ভাই বা অজয় দার সাহায্য নিতাম কিন্তু ওনাদের সাহায্য নিতে একটু আড়ষ্টতা লাগতো। সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হলে তো লিখতেই হবে। তাই লেখালেখির ক্ষেত্রে সব সময় আমার ভরসার জায়গা ছিলো বিভূ দা।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির সামরিক শাসন বিরোধী রক্তক্ষয়ী ছাত্র বিক্ষোভের পর ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে যখন আত্মগোপনে যেতে হয় ভরসার স্থল ঐ বিভূ দা। পুরানো ঢাকার আগামছি লেনে বিভূ দা থাকতেন কামরুজ্জামান ননী ও শিখা দম্পত্তির সাথে পৃথক একটি বড় কক্ষে। বিভূ দার সাথে ঐ কক্ষেই আমার দীর্ঘ আত্মগোপন বাস। থাকা-খাওয়া ফ্রি! এভাবে তরুণ বয়সটায় বিভূদার সাথে নানাভাবে জড়িয়ে ছিলাম। অবশ্য কয়েক মাস পার হওয়ার পর এক জায়গায় থাকা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় তাহেরউল্লা আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে তেজকুনি পাড়ায় বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী সত্যব্রত দাস স্বপনের আবাস স্থলে নিয়ে যায়। ওখানেও থাকা-খাওয়া ছিলো ফ্রি।
বিভূ দার বিয়ে কোন সালে হয়েছিলো মনে নেই। তবে আমরা দলেবলে সেই পঞ্চগড়ের বোদায় বিয়েতে হাজির হয়েছিলাম। বিভূ দা বিয়ের পরে বাসা নেন নয়াপল্টনে। কিছুকাল পর আমিও নয়াপল্টনের জামাই হয়ে যাওয়ায় স্বপরিবারে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। ১৯৯১ সালের পর থেকে অনেকের মতো আমার রাজনৈতিক জীবনও ছন্নছাড়া হয়ে যায়। সম্ভবত বিভূ দারও তাই। পারষ্পরিক যোগাযোগ অনেক কমে যায়। দেখাসাক্ষাৎও হতো কদাচিৎ। তবে আমরা অনেকেই পেশাগত জীবনে একধরনের স্থিতি আনতে পারলেও বিভূ দা সেরকম স্থিতি আনতে পারেননি। বহুদিন পর গত বছর আগষ্ট ‘২৪ মাসে আমার একটা লেখা ছাপার বিষয়ে বিভূদার সাথে যোগাযোগ। আমি লেখাটি প্রথম আলো ও সমকালে ছাপাতে ব্যর্থ হলে কেউ একজন বিভূদার সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। বিভূ দা লেখাটি আজকের পত্রিকায় ছাপার ব্যবস্থা করলেন। বোধ করি কোনো দৈনিক পত্রিকায় সেটাই ছিলো আমার এই দীর্ঘ জীবনের প্রথম লেখা। বিভূ দা নিয়মিত লিখতে বললেন। লিখলামও বেশ কয়েকটি কলাম। এর মধ্যে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ‘বই মেলায় ডাস্টবিন’ নিয়ে একটি লেখা, ‘ধানমন্ডি ৩২’ নিয়ে লেখা এবং ‘৭ মার্চের তর্জনী’ নিয়ে লেখা পেয়ে তিনি বললেন তাদের পত্রিকায় এ ধরনের লেখা ছাপানো যাবে না। তাদের পত্রিকা চাপের মধ্যে আছে। তারপর থেকে আমিও আর ‘আজকের পত্রিকায়’ লেখা পাঠাই না। আবার যোগাযোগ কমে গেলো।
তবে এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি আমাকে একটি টেক্সট করেন। তখন তিনি অসুস্থ। তার শেষ চিঠিতে যে আর্থিক সংকটের কথা লিখেছেন অনেকটাই সে রকম। তার আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু তিনি সরাসরি চাইতে সংকোচ বোধ করছেন। আমি যেন তার হয়ে আমাদের বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে দেই। তিনি এটাও লেখেন বিষয়টা পাবলিক করা যাবে না। যা হোক আমি পৃথকভাবে এম.এম. আকাশ, মহসিন ভাই, আওয়াল, তাহেরউল্লাহ, আইউব প্রমুখকে জানাই। প্রায় সকলেই সাড়া দেয় এবং সরাসরি বিভূদার বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। তাহেরউল্লাহ উদ্যোগ নিয়ে আরো কয়েকজনকে দিয়ে পাঠায়। নিতাই দা আর রঞ্জন দা যেহেতু তার সাথে সবসময় সরাসরি যোগাযোগে ছিলেন তাই তাঁদেরকে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করিনি। বিভূ দা ধন্যবাদ জানিয়ে টেক্সট করেন।
এরপরে বিষয়টি নিয়ে আর চিন্তা আসে নাই। যেহেতু ছেলে-মেয়ে দুজনেই পড়াশোনা শেষ করে ফেলেছে; মেয়ের বিয়েও তো খেলাম অনেকদিন হয়ে গেলো এবং তিনি একটা চাকরির মধ্যে আছেন, তাই তার বড় ধরনের আর্থিক সংকটের কথা মাথায় আসে নাই। না আসাটাই স্বাভাবিক। বিভূ দা আর যাই হোক ভোগবাদীতায় তো ছিলেন না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের বড় একটি অংশ সুবিধাবাদ আর চাটুকারিতা করে যেভাবে ভোগ-বিলাসিতার জীবন বেছে নিয়েছিলেন তার বিপরীতে বিভূ দার আর্থিক দীন্যতা নিয়ে নিজের মাঝে এক ধরণের আক্ষেপ জমা হয়েছিল- যা কিন্তু তার জীবনের সাথে যায় না।
কিন্তু এই আর্থিক টানাপোড়েন আর অসুস্থতার মাঝে যখন একটি লেখা যা তার নিজেরও নয়, সেটা পত্রিকায় ছাপা নিয়ে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়েছে, অফিসে যেতে না করা হয়েছে তখন এই বয়সে এক গভীর অনিশ্চয়তা তাকে চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। হয়তো পত্রিকা কতৃপক্ষ রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপ থেকে রক্ষা পেতে বা হঠাৎ করে কোনো মব উল্লম্ফনের কোপানল থেকে রক্ষা পেতে এ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এ ঘটনায় প্রকাশ পেলো গণমাধ্যম জগতও এক ধরনের নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। বেতন কাঠামোর দুরবস্থা ছাড়াও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভয়ে তাদেরকে সেলফ-সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
এই বয়সে পরিবারকে হাহাকারের মধ্যে রেখে, আমাদেরকে বেদনায় নীল করে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন। নাকি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরো বড় ধরনের কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনার সংবাদ!
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]