মিথুশিলাক মুরমু
দিন কয়েক আগে রাজধানী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির সংলগ্ন পলাশীর মোড়ে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শোভাযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিন বাহিনীর প্রধান উপস্থিত থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাহস, স্বপ্ন, অধিকার ও সম্প্রীতির বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বোধ করি, এটিই প্রথম কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অনুষ্ঠানে তিন বাহিনীর প্রধান একসাথে উপস্থিত হলেন। এতে নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ, তখন তিন বাহিনী প্রধানের সম্মিলিত আহ্বান কিছুটা হলেও আমাদের আশ্বস্ত করেছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, “এই দেশ সবার। সম্প্রীতির এই বাংলাদেশে শত শত বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পাহাড়ি, বাঙালি, উপজাতি সবাই মিলে অত্যন্ত শান্তিতে বসবাস করে আসছে। সবাই একসঙ্গে সুন্দরভাবে ও শান্তিতে বসবাস করব। এখানে জাতি-ধর্মে ভেদাভেদ থাকবে না।... আমরা সবাই মিলে সব সময় আপনাদের পাশে থাকব।”
বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেছেন, “এই বাংলাদেশ আমাদের সবার। স্বাধীনতাকে রক্ষা করা আমাদের সবার পবিত্র দায়িত্ব। সবাই মিলে কাজ করলে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারব।”
নৌবাহিনী প্রধান এম নাজমুল হাসান বলেন, “আসুন, পারস্পরিক সহনশীলতার মাধ্যমে দেশকে আরও শক্তিশালী করি। শ্রীকৃষ্ণ যেন সমাজে ন্যায় ও আলোর সত্য প্রজ্বলিত করেন।”
তিন বাহিনীর প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করেছেন। সাধারণত ধর্মীয় আয়োজনে সত্য ও সুন্দর, ন্যায় ও ন্যায্যতার বাণী উচ্চারিত হয়, যা নারী-পুরুষ, শিশু ও প্রবীণদের মনে দীর্ঘদিনের জন্য ছাপ ফেলে। ধর্মীয় নেতাদের বাণী যেমন প্রশান্তি আনে, তেমনি তিন বাহিনীর প্রধানও সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করেছেন যে, “এই দেশ সবার।” এতে সন্দেহের কিছু নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে অংশ নিয়েছিল, যার প্রতিফলন আমরা সংবিধানের প্রস্তাবনায় পাই। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেও এর প্রমাণ রয়েছে।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়Ñ সংখ্যালঘু ও আদিবাসীরা দেশকে মন থেকে ভালোবাসলেও দেশের মানুষ কি তাদের ভালোবাসে? প্রিয় মাতৃভূমি কি সত্যিই তাদেরকে ধারণ করছে? ‘সবার’ অর্থ এখানে দ্বিমুখীÑ সংখ্যাগুরুদের দায়িত্ব সংখ্যালঘুদের শান্তিতে বসবাস নিশ্চিত করা, আর প্রশাসন ও সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলে প্রশাসন এখনো আদিবাসী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। যদিও সেনাপ্রধান হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পাহাড়ি, বাঙালি, উপজাতি জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করেছেন, তবু ‘আদিবাসী’ শব্দটি উচ্চারিত হলে সাঁওতাল, উরাঁও, মু-া, মাহালী, গারো, খাসিয়া, হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরারা আরও উৎসাহিত হতো। এখনো রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীতে আদিবাসীদের চাপা কান্না শোনা যায়। পূর্বপুরুষদের পৈত্রিক ভিটা থেকে উচ্ছেদের নীলনকশা ও পেশিশক্তির ব্যবহার তাদের ভবিষ্যৎকে ভূমিহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বহু আদিবাসী দুঃখ-ক্ষোভে পরিবারসহ হারিয়ে গেছেন। দয়া করে আদিবাসীদের প্রতি যতœবান হোন, নইলে এই ভাষাশহীদদের দেশে একের পর এক মাতৃভাষারও অপমৃত্যু ঘটবে।
সেনাপ্রধান আশ্বাস দিয়েছেন, “আমরা সবাই মিলে সব সময় আপনাদের পাশে থাকব।” অথচ বাস্তবে সংখ্যালঘুরা নিজেদের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। বিশেষ করে সাঁওতালরা জানিয়েছে, তাদের থানায় যাওয়ার আগ্রহ শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থের প্রভাব ও পেশিশক্তির দাপটে তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। কেউ এটিকে কল্পকাহিনী ভাবলেও এটি নির্মম বাস্তবতা।
এই সংকটময় সময়ে তিন বাহিনীর প্রধানের প্রতিশ্রুতি যেন অন্ধকারে সূর্যের আলোর মতো। তাদের ঘোষণা আমাদের উজ্জীবিত করেছে। আদিবাসীদের প্রতি ন্যায় ও ন্যায্যতার প্রতিশ্রুতি তাদের টিকে থাকার স্বপ্ন ও সাহস জাগায়।
আদিবাসীরা শহরের আলো থেকে দূরে, নিভৃত পল্লীতে বাস করে। তাদের প্রতি অবিচার হলেও গণমাধ্যম নীরব থাকে। মনে হয়, সৃষ্টিকর্তাও যেন তাদের থেকে দূরে। আদিবাসীদের ক্ষত কি কোনোদিন শুকাবে? আমরা বিশ্বাস করি, তিন বাহিনী প্রধানের প্রতিজ্ঞা দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে কার্যকর হবে। তারা যদি বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ান, তবে আস্থা হারানো জনগোষ্ঠী আবারও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রগঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুসহ আদিবাসীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।
[লেখক: কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
রোববার, ২৪ আগস্ট ২০২৫
দিন কয়েক আগে রাজধানী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির সংলগ্ন পলাশীর মোড়ে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শোভাযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিন বাহিনীর প্রধান উপস্থিত থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাহস, স্বপ্ন, অধিকার ও সম্প্রীতির বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বোধ করি, এটিই প্রথম কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অনুষ্ঠানে তিন বাহিনীর প্রধান একসাথে উপস্থিত হলেন। এতে নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ, তখন তিন বাহিনী প্রধানের সম্মিলিত আহ্বান কিছুটা হলেও আমাদের আশ্বস্ত করেছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, “এই দেশ সবার। সম্প্রীতির এই বাংলাদেশে শত শত বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পাহাড়ি, বাঙালি, উপজাতি সবাই মিলে অত্যন্ত শান্তিতে বসবাস করে আসছে। সবাই একসঙ্গে সুন্দরভাবে ও শান্তিতে বসবাস করব। এখানে জাতি-ধর্মে ভেদাভেদ থাকবে না।... আমরা সবাই মিলে সব সময় আপনাদের পাশে থাকব।”
বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেছেন, “এই বাংলাদেশ আমাদের সবার। স্বাধীনতাকে রক্ষা করা আমাদের সবার পবিত্র দায়িত্ব। সবাই মিলে কাজ করলে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারব।”
নৌবাহিনী প্রধান এম নাজমুল হাসান বলেন, “আসুন, পারস্পরিক সহনশীলতার মাধ্যমে দেশকে আরও শক্তিশালী করি। শ্রীকৃষ্ণ যেন সমাজে ন্যায় ও আলোর সত্য প্রজ্বলিত করেন।”
তিন বাহিনীর প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করেছেন। সাধারণত ধর্মীয় আয়োজনে সত্য ও সুন্দর, ন্যায় ও ন্যায্যতার বাণী উচ্চারিত হয়, যা নারী-পুরুষ, শিশু ও প্রবীণদের মনে দীর্ঘদিনের জন্য ছাপ ফেলে। ধর্মীয় নেতাদের বাণী যেমন প্রশান্তি আনে, তেমনি তিন বাহিনীর প্রধানও সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করেছেন যে, “এই দেশ সবার।” এতে সন্দেহের কিছু নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে অংশ নিয়েছিল, যার প্রতিফলন আমরা সংবিধানের প্রস্তাবনায় পাই। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেও এর প্রমাণ রয়েছে।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়Ñ সংখ্যালঘু ও আদিবাসীরা দেশকে মন থেকে ভালোবাসলেও দেশের মানুষ কি তাদের ভালোবাসে? প্রিয় মাতৃভূমি কি সত্যিই তাদেরকে ধারণ করছে? ‘সবার’ অর্থ এখানে দ্বিমুখীÑ সংখ্যাগুরুদের দায়িত্ব সংখ্যালঘুদের শান্তিতে বসবাস নিশ্চিত করা, আর প্রশাসন ও সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলে প্রশাসন এখনো আদিবাসী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। যদিও সেনাপ্রধান হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পাহাড়ি, বাঙালি, উপজাতি জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করেছেন, তবু ‘আদিবাসী’ শব্দটি উচ্চারিত হলে সাঁওতাল, উরাঁও, মু-া, মাহালী, গারো, খাসিয়া, হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরারা আরও উৎসাহিত হতো। এখনো রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীতে আদিবাসীদের চাপা কান্না শোনা যায়। পূর্বপুরুষদের পৈত্রিক ভিটা থেকে উচ্ছেদের নীলনকশা ও পেশিশক্তির ব্যবহার তাদের ভবিষ্যৎকে ভূমিহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বহু আদিবাসী দুঃখ-ক্ষোভে পরিবারসহ হারিয়ে গেছেন। দয়া করে আদিবাসীদের প্রতি যতœবান হোন, নইলে এই ভাষাশহীদদের দেশে একের পর এক মাতৃভাষারও অপমৃত্যু ঘটবে।
সেনাপ্রধান আশ্বাস দিয়েছেন, “আমরা সবাই মিলে সব সময় আপনাদের পাশে থাকব।” অথচ বাস্তবে সংখ্যালঘুরা নিজেদের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। বিশেষ করে সাঁওতালরা জানিয়েছে, তাদের থানায় যাওয়ার আগ্রহ শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থের প্রভাব ও পেশিশক্তির দাপটে তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। কেউ এটিকে কল্পকাহিনী ভাবলেও এটি নির্মম বাস্তবতা।
এই সংকটময় সময়ে তিন বাহিনীর প্রধানের প্রতিশ্রুতি যেন অন্ধকারে সূর্যের আলোর মতো। তাদের ঘোষণা আমাদের উজ্জীবিত করেছে। আদিবাসীদের প্রতি ন্যায় ও ন্যায্যতার প্রতিশ্রুতি তাদের টিকে থাকার স্বপ্ন ও সাহস জাগায়।
আদিবাসীরা শহরের আলো থেকে দূরে, নিভৃত পল্লীতে বাস করে। তাদের প্রতি অবিচার হলেও গণমাধ্যম নীরব থাকে। মনে হয়, সৃষ্টিকর্তাও যেন তাদের থেকে দূরে। আদিবাসীদের ক্ষত কি কোনোদিন শুকাবে? আমরা বিশ্বাস করি, তিন বাহিনী প্রধানের প্রতিজ্ঞা দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে কার্যকর হবে। তারা যদি বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ান, তবে আস্থা হারানো জনগোষ্ঠী আবারও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রগঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুসহ আদিবাসীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।
[লেখক: কলামিস্ট]