alt

opinion » post-editorial

ঢাকা শহরের উষ্ণতা: সবুজ হারানোর মূল্য

জাহিদুল ইসলাম

: সোমবার, ২৫ আগস্ট ২০২৫

ঢাকার গ্রীষ্মকালীন দুপুর। আকাশ নীল, সূর্যের কিরণ যেন নগরের কংক্রিটের বহুতল ভবনগুলোকে আগুনে ভেজাচ্ছে। বাতাস শূন্যের মতো স্তব্ধ, মানুষ হাঁটছে ছায়াহীন রাস্তায়, শিশুরা খেলার মাঠের পরিবর্তে ঘরের ভিতর শীতল বাতাসের জন্য হাহাকার করছে। গাড়ি, মোটরসাইকেল, এবং নির্মাণের শব্দ উত্তাপকে যেন আরেকটু ঘন করছে। এই দৃশ্য শুধু অস্বস্তিকর নয়, বরং শহরের নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই চরম উত্তাপের পেছনে রয়েছে শহরের সবুজ হারানোর দুঃখজনক সত্যি, যা একটি প্রাকৃতিক শীতলীকরণ ব্যবস্থা কেড়ে নিয়েছে।

অথচ আমাদের ঢাকা এরকম ছিল না। সবুজ ঢাকার বর্ণনা পাওয়া যায় বেশ কয়েকজন বিখ্যাত লেখেকের লেখনি থেকেই। খন্দকার মাহমুদুল হাসানের লেখা ‘সেকালের ঢাকা’ বইয়ে তিনি ধানমন্ডির বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছেন ‘ধানমণ্ডির মাঠগুলো একসময় গ্রীষ্মকালীন ছায়া ছিল যেখানে পাখিরা গান গাইত।’ আমার ঢাকা গ্রন্থে শামসুর রাহমান লিখেছেন ‘নদী আর পুকুর ছিল ঢাকার প্রাণ, আজ আর তারা নেই, শুধু স্মৃতি রয়ে গেছে। রমনার পাখির কলতানে ভরে উঠত শহর, আজ শুধু স্মৃতিতেই তা বাঁচে।’ ঢাকার ইতিবৃত্ত ও ঐতিহ্য গ্রন্থে ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম লিখেছেন ‘গাছপালা ছিল শহরের রঙ, আজ কংক্রিট আর ইটের জঞ্জালে ঢাকা ঢাকার স্মৃতি ম্লান হয়ে গেছে।’

ঢাকা শহর আজ এক উত্তপ্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। শত বছরের পুরোনো এই শহরের পরিবেশ ও প্রকৃতি এক অভাবনীয় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে নগরায়নের যে গতির সূচনা হয়েছিল, তা বর্তমানে নিয়ন্ত্রণহীন অবকাঠামো নির্ভর শহরায়নের দিকে গতি পেয়েছে। চারদিক জুড়ে নির্মাণ, রাস্তা সম্প্রসারণ, কংক্রিটের বহুতল ভবন এবং নগর উন্নয়নের নামে গাছ কেটে ফেলা একটি দৈনন্দিন চিত্রে পরিণত হয়েছে। বিগত তিন দশকে ঢাকার গাছের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে, আর তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে শহরের তাপমাত্রা ও জনজীবনে।

বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন মাসগুলোতে ঢাকার বেশিরভাগ অংশে ৩৮ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এখন প্রায় নিয়মিত। গাছের ছায়া হারানো, বাতাস চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং তাপ শোষণকারী কংক্রিট, টিন ও পিচঢালা রাস্তাগুলো শহরের তাপমাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। একে বলা হয় ‘Urban Heat Island (UHI)’প্রভাব, যেখানে শহরের কেন্দ্রীয় অংশ আশপাশের গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি উত্তপ্ত থাকে। এই তাপদাহ শুধু অস্বস্তিকরই নয়, বরং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে—বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য।

এই প্রেক্ষাপটে, গাছ হারানোর ফলে ঢাকায় যে উষ্ণতা ও তাপদাহের প্রকোপ বেড়েছে, তার বাস্তবতা যাচাই ও ভবিষ্যতের জন্য করণীয় নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং-এর মাধ্যমে এই তাপদাহের মানচিত্র তৈরি করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা যেতে পারে। এই গবেষণা শুধু বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণেই থেমে থাকবে না; বরং পরিবেশবান্ধব নগর নকশা, সবুজায়ন এবং নীতিমালার সুপারিশ করাও এর অন্যতম লক্ষ্য। সবার প্রথমে জানা দরকার আরবান হিট আইল্যান্ড (ইউএইচআই)কী? Urban Heat Island (UHI) হলো এমন একটি প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট পরিবেশগত প্রভাব, যার ফলে শহরাঞ্চল আশপাশের গ্রামীণ বা কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার তুলনায় অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। মূলত নগরায়ন, ঘনবসতি, গাছপালা কমে যাওয়া এবং প্রচুর তাপ শোষণকারী অবকাঠামো ব্যবহারের কারণে এই বৈষম্য তৈরি হয়। UHI সৃষ্টির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সিমেন্ট, কংক্রিট, পিচ, টিন, এবং ধাতব ছাদ ইত্যাদি নির্মাণ উপাদান, যেগুলো তাপ শোষণ করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে তাপ ধরে রাখে। এছাড়া গাছপালা ও খোলা জমি কমে যাওয়া, বাষ্পীভবনের হার কমে যাওয়া, বাতাস চলাচলের প্রতিবন্ধকতা, এবং অতিরিক্ত যানবাহনের কারণে কার্বন ও গ্রীনহাউস গ্যাসের উপস্থিতি তাপমাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সবুজ এলাকার অনুপস্থিতি শহরজুড়ে একটি তাপ স্তর তৈরি করে, যা বিশেষত গ্রীষ্মকালে তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

গাছের ভূমিকা এই প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছ শুধু ছায়া দিয়ে তাপ কমায় না, বরং এর পাতার মাধ্যমে ট্রান্সপিরেশন এবং ইভাপোরেশন -এর মাধ্যমে চারপাশে ঠা-া পরিবেশ সৃষ্টি করে। একইসাথে গাছ বাতাসে থাকা ধূলিকণা ও বিষাক্ত উপাদান শোষণ করে পরিবেশের মান উন্নত করে। একটি পরিপক্ক গাছ দিনে প্রায় ৫০-১০০ লিটার পানি বাষ্পীভবনের মাধ্যমে নিঃসরণ করতে পারে, যা আশপাশের পরিবেশকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ঠা-া করতে সক্ষম।

ইউএইচআই-এর স্বাস্থ্যগত প্রভাবও ভয়াবহ। রাতের বেলা শহরের তাপমাত্রা কম না থাকায় শরীর বিশ্রাম পায় না, যার ফলে হিট স্ট্রোক, ইনসোলেশন, হাঁপানি, ডিহাইড্রেশন এবং কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং গরিব জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা -এর মতে, শহরের ইউএইচআই প্রভাব একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।

ঢাকা শহরে Urban Heat Island-এর মানচিত্রায়ন ও বিশ্লেষণে রিমোট সেন্সিং ও জিআইএস-এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। একাধিক গবেষণা খঝঞ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাপ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল চিহ্নিত করেছে। গবেষণাগুলোর ফলাফলে দেখা যায়, যেখানে গাছপালা, খোলা জায়গা ও পানির উৎস আছে সেখানে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম, আর যেখানে ঘনবসতিপূর্ণ কংক্রিটের গঠন রয়েছে, সেখানে তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঢাকার তাপদাহ পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নানা গবেষণা পরিচালিত হয়েছে, বিশেষ করে ভূ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, রিমোট সেন্সিং এবং জিআইএস-প্রযুক্তির মাধ্যমে। এসব গবেষণা মূলত Land Surface Temperature (LST), Normalized Difference Vegetation Index (NDVI), এবং Urban Heat Island (UHI) নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গাজীপুর জেলায় পরিচালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে NDVI মান উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে (NDVI দ্বারা সবুজ আচ্ছাদনের মাত্রা পরিমাপ করা হয়)। গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে নির্মিত অঞ্চলগুলোর উপর ভিত্তি করে খঝঞ ২-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধিপেয়েছে। বনভূমি থেকে কংক্রিটে রূপান্তরের এই ধারা শুধু গাজীপুর নয়, পুরো ঢাকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হলো Heat Vulnerability Index (HVI)। এটি একটি সমন্বিত সূচক যা তাপদাহে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। MDPI-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব, নি¤œ আয়ের বসতি এবং প্রাকৃতিক ছায়ার অভাবে এই এলাকাগুলো অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে ঢাকার এলএসটি পরিবর্তন এবং তাপপ্রভাবজনিত জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশিত গবেষণায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিশু ও বৃদ্ধদের হিটস্ট্রোক, হিট-একজস্টশন ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের হার বাড়ছে। এসব গবেষণা শহরের নি¤œ আয়ের এলাকা ও ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চলকে ঝুঁকির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে।

আলোচ্য গবেষণাগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্দেশ করে শীতকালেও ঢাকায় UHI প্রভাব তীব্র হতে পারে। MDPI-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, গ্রীষ্মকালের পাশাপাশি শীতকালেও যখন সাধারণত তাপমাত্রা কম থাকে, তখনও নির্মিত অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকে। এই অবস্থাকে “Winter UHI” বলা হয়।

সবশেষে, গবেষণাগুলো শহরের পরিকল্পনায় পরিবেশগত বিবেচনার অনুপস্থিতিকে দায়ী করেছে। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ঢাকায় উষ্ণতা কমাতে নির্মাণ উপকরণ, ছাদের ধরন, রাস্তার পরিকল্পনা ও পানি ব্যবস্থাপনার ধরন পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি সবুজ করিডোর, ছাদ বাগান, শহুরে বন (urban forest) এবং জলাশয় সংরক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

তাপদাহ বৃদ্ধির ফলে স্বাস্থ্যখাতে মারাত্মক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, গত দশকে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন ও তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তির হার ২৫% পর্যন্ত বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও, এই অবস্থা ঢাকা শহরের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিয়েছে। গরমের কারণে নির্মাণ কাজ, শ্রমিক কার্যক্রম ও যানবাহন চলাচলে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়, যার ফলে জিডিপি-তে ৮-১০% পর্যন্ত ক্ষতি হয় বলে গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে জলবায়ু-সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য খরচ আগামী দশকে দ্বিগুণ হতে পারে। কর্মঘণ্টার ক্ষয়, কর্মক্ষমতা হ্রাস, এবং শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা বাড়ছে-যা শহরকে আরও অস্থির করে তুলতে পারে।

নগর উষ্ণতা দ্বীপ (Urban Heat Island)প্রভাবের মোকাবিলায় গাছ একটি অপরিহার্য উপাদান। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ দিনে প্রায় ১০০ লিটার লিটার পানি বাষ্পীভবনের মাধ্যমে নির্গত করে, যা আশপাশের তাপমাত্রা ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে গাছের ছায়া এবং বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া আবাসিক এলাকায় সান্ত¡নার অন্যতম উৎস। শুধু তাই নয়, গাছ বায়ুতে ময়লা কণা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও ওজোন শোষণ করে শহরের বায়ু মান উন্নত করে। গাছপালা নগর স্বাস্থ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সবুজ খোলা স্থান নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য, হৃদরোগ প্রতিরোধ এবং হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে।

ঢাকার নগরায়ন পরিকল্পনায় দীর্ঘদিন ধরেই গাছ এবং সবুজ এলাকার গুরুত্ব উপেক্ষিত। ইট, কংক্রিট এবং অন্ধকার রঙের স্থাপত্য উপকরণ তাপ শোষণ করে শহরকে দিনের শেষে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে গরম রাখে। ‘ল্যান্ড ইউজ ল্যান্ড কাভার’ পরিবর্তন বিশ্লেষণ বলছে, গত দুই দশকে ঢাকায় বনভূমি বা সবুজ এলাকা ৩৫-৪০% কমেছে এবং তা নির্মিত স্থানে রূপান্তরিত হয়েছে যা সরাসরি ‘ল্যান্ড সারফেস টেম্পেরাচার’ বৃদ্ধির কারণ।

নগর নকশায় পরিকল্পিতভাবে সবুজ করিডোর, পার্ক, ছায়াময় রাস্তার ধারে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা এবং ভবন নির্মাণে ছাদবাগান ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করা গেলে পরিস্থিতি অনেকাংশে পরিবর্তন সম্ভব। তবে সমস্যা শুধুমাত্র প্রযুক্তি বা পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ নয়। জনসচেতনতার অভাব এবং দুর্বল পরিবেশ আইন বাস্তবায়ন এই সংকট আরও জটিল করেছে। ঢাকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে EIA (Environmental Impact Assessment) নিয়মিতভাবে উপেক্ষিত হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ও নগর পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে আরও সমন্বয় প্রয়োজন। ইতোমধ্যে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, হৃদরোগসহ বিভিন্ন হিট–রিলেটেড রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় উৎপাদনশীলতায়। কার্যকর নীতি ও পদক্ষেপ হিসেবে সুপারিশ করা যায়: ১. নগরে দ্রুত urban forestry ও ছায়াদানকারী বৃক্ষরোপণ। ২. Heat-action প্ল্যান প্রণয়ন, যেখানে সময়োপযোগী সতর্কতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকবে। ৩. Reflective ও heat-resistant নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার। ৪. নগর পরিকল্পনায় green corridors ও urban forest অন্তর্ভুক্ত করা। ৫. জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, যেন নগরবাসী নিজ উদ্যোগে ছাদবাগান, দেয়ালবাগান ও ছোট আকারে সবুজায়নে অংশ নেয়।

উপরোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে ঢাকার পরিবেশ শীতল এবং বসবাস যোগ্য শহর রুপে ঢাকাকে ফিরে পাওয়া সম্ভব।

[লেখক: শিক্ষক, বাংলাদেশ স্টাডিজ এন্ড জিওগ্রাফি, মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল কলেজ (এমডিআইসি), ঢাকা]

স্বপ্নের দক্ষিণ কোরিয়া; বাংলাদেশে আন্দোলন, ভিয়েতনামের সাফল্য

ডাকসু নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতি

তিন বাহিনী প্রধানদের আশা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা

গনমাধ্যম জগতও নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে!

মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা: জাপান এক অনুসরণীয় আদর্শ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন ট্র্যাজেডি

হোক সবুজ বিপ্লব

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : একজন বিধায়কের জামিন

নিউটনের আপেল : পতনের ভেতরে জাগরণের গল্প

বায়ুদূষণ গবেষণার প্রসার ও তরুণদের ভূমিকা : প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা আহমদ

চাপে সামষ্টিক অর্থনীতি

ছবি

একাত্তরের গণহত্যা : সংখ্যার বিতর্ক নাকি দায় হালকা করার চেষ্টা?

রম্যগদ্য : ‘দালাল-ধন্বন্তরি-জীবন রক্ষাকারী...’

সাদা পাথর লুটে সর্বদলীয় ঐক্য

গণিতের বহুমুখী ব্যবহার : আধুনিক বিজ্ঞানের চালিকাশক্তি

প্রসঙ্গ : পেঁপের রিং স্পট ভাইরাস

ছবি

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : রাজনৈতিক বিভেদের অমোচনীয় ক্ষত

ছবি

আলফ্রেড সরেন হত্যা : বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

কারাম উৎসব : বাংলার প্রাচীন কৃষি ও সংস্কৃতির ধারক

ছবি

আলাস্কা বৈঠক : শান্তির দেখা কি মিলল?

বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কতদূর?

মবের উন্মাদনা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার

জীবন থেকে নেয়া শিক্ষাগুলোই এগিয়ে দেয় জীবনকে

রাজনৈতিক কর্মসূচি, যানজট ও আচরণগত অর্থনীতি

সম্পদের অভিশাপ : সিলেটের সাদাপাথরে সংঘাতের সমাজতত্ত্ব ও নীতি-সংকট

নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো

মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার জরুরি

ছবি

সাদাপাথরের নীলাভ দেশ : ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য ও সংকট

একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমাজতত্ত্ব

বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির নতুন ভূরাজনীতি

মব ও জাস্টিস

ইতিহাসকে নতুন করে লেখা এক জগাখিচুড়ি!

নারীর সমঅধিকার : সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি

জ্ঞানের মঞ্চ এখন সার্কাস, গবেষণা সেখানে নীরব দর্শক

ছবি

ভরা শ্রাবণে স্বদেশ-ভাবনা

নারীর প্রতি সহিংসতা : বাস্তবতা, আইন ও প্রতিরোধের জরুরি দিকনির্দেশনা

tab

opinion » post-editorial

ঢাকা শহরের উষ্ণতা: সবুজ হারানোর মূল্য

জাহিদুল ইসলাম

সোমবার, ২৫ আগস্ট ২০২৫

ঢাকার গ্রীষ্মকালীন দুপুর। আকাশ নীল, সূর্যের কিরণ যেন নগরের কংক্রিটের বহুতল ভবনগুলোকে আগুনে ভেজাচ্ছে। বাতাস শূন্যের মতো স্তব্ধ, মানুষ হাঁটছে ছায়াহীন রাস্তায়, শিশুরা খেলার মাঠের পরিবর্তে ঘরের ভিতর শীতল বাতাসের জন্য হাহাকার করছে। গাড়ি, মোটরসাইকেল, এবং নির্মাণের শব্দ উত্তাপকে যেন আরেকটু ঘন করছে। এই দৃশ্য শুধু অস্বস্তিকর নয়, বরং শহরের নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই চরম উত্তাপের পেছনে রয়েছে শহরের সবুজ হারানোর দুঃখজনক সত্যি, যা একটি প্রাকৃতিক শীতলীকরণ ব্যবস্থা কেড়ে নিয়েছে।

অথচ আমাদের ঢাকা এরকম ছিল না। সবুজ ঢাকার বর্ণনা পাওয়া যায় বেশ কয়েকজন বিখ্যাত লেখেকের লেখনি থেকেই। খন্দকার মাহমুদুল হাসানের লেখা ‘সেকালের ঢাকা’ বইয়ে তিনি ধানমন্ডির বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছেন ‘ধানমণ্ডির মাঠগুলো একসময় গ্রীষ্মকালীন ছায়া ছিল যেখানে পাখিরা গান গাইত।’ আমার ঢাকা গ্রন্থে শামসুর রাহমান লিখেছেন ‘নদী আর পুকুর ছিল ঢাকার প্রাণ, আজ আর তারা নেই, শুধু স্মৃতি রয়ে গেছে। রমনার পাখির কলতানে ভরে উঠত শহর, আজ শুধু স্মৃতিতেই তা বাঁচে।’ ঢাকার ইতিবৃত্ত ও ঐতিহ্য গ্রন্থে ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম লিখেছেন ‘গাছপালা ছিল শহরের রঙ, আজ কংক্রিট আর ইটের জঞ্জালে ঢাকা ঢাকার স্মৃতি ম্লান হয়ে গেছে।’

ঢাকা শহর আজ এক উত্তপ্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। শত বছরের পুরোনো এই শহরের পরিবেশ ও প্রকৃতি এক অভাবনীয় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে নগরায়নের যে গতির সূচনা হয়েছিল, তা বর্তমানে নিয়ন্ত্রণহীন অবকাঠামো নির্ভর শহরায়নের দিকে গতি পেয়েছে। চারদিক জুড়ে নির্মাণ, রাস্তা সম্প্রসারণ, কংক্রিটের বহুতল ভবন এবং নগর উন্নয়নের নামে গাছ কেটে ফেলা একটি দৈনন্দিন চিত্রে পরিণত হয়েছে। বিগত তিন দশকে ঢাকার গাছের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে, আর তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে শহরের তাপমাত্রা ও জনজীবনে।

বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন মাসগুলোতে ঢাকার বেশিরভাগ অংশে ৩৮ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এখন প্রায় নিয়মিত। গাছের ছায়া হারানো, বাতাস চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং তাপ শোষণকারী কংক্রিট, টিন ও পিচঢালা রাস্তাগুলো শহরের তাপমাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। একে বলা হয় ‘Urban Heat Island (UHI)’প্রভাব, যেখানে শহরের কেন্দ্রীয় অংশ আশপাশের গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি উত্তপ্ত থাকে। এই তাপদাহ শুধু অস্বস্তিকরই নয়, বরং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে—বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য।

এই প্রেক্ষাপটে, গাছ হারানোর ফলে ঢাকায় যে উষ্ণতা ও তাপদাহের প্রকোপ বেড়েছে, তার বাস্তবতা যাচাই ও ভবিষ্যতের জন্য করণীয় নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং-এর মাধ্যমে এই তাপদাহের মানচিত্র তৈরি করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা যেতে পারে। এই গবেষণা শুধু বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণেই থেমে থাকবে না; বরং পরিবেশবান্ধব নগর নকশা, সবুজায়ন এবং নীতিমালার সুপারিশ করাও এর অন্যতম লক্ষ্য। সবার প্রথমে জানা দরকার আরবান হিট আইল্যান্ড (ইউএইচআই)কী? Urban Heat Island (UHI) হলো এমন একটি প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট পরিবেশগত প্রভাব, যার ফলে শহরাঞ্চল আশপাশের গ্রামীণ বা কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার তুলনায় অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। মূলত নগরায়ন, ঘনবসতি, গাছপালা কমে যাওয়া এবং প্রচুর তাপ শোষণকারী অবকাঠামো ব্যবহারের কারণে এই বৈষম্য তৈরি হয়। UHI সৃষ্টির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সিমেন্ট, কংক্রিট, পিচ, টিন, এবং ধাতব ছাদ ইত্যাদি নির্মাণ উপাদান, যেগুলো তাপ শোষণ করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে তাপ ধরে রাখে। এছাড়া গাছপালা ও খোলা জমি কমে যাওয়া, বাষ্পীভবনের হার কমে যাওয়া, বাতাস চলাচলের প্রতিবন্ধকতা, এবং অতিরিক্ত যানবাহনের কারণে কার্বন ও গ্রীনহাউস গ্যাসের উপস্থিতি তাপমাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সবুজ এলাকার অনুপস্থিতি শহরজুড়ে একটি তাপ স্তর তৈরি করে, যা বিশেষত গ্রীষ্মকালে তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

গাছের ভূমিকা এই প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছ শুধু ছায়া দিয়ে তাপ কমায় না, বরং এর পাতার মাধ্যমে ট্রান্সপিরেশন এবং ইভাপোরেশন -এর মাধ্যমে চারপাশে ঠা-া পরিবেশ সৃষ্টি করে। একইসাথে গাছ বাতাসে থাকা ধূলিকণা ও বিষাক্ত উপাদান শোষণ করে পরিবেশের মান উন্নত করে। একটি পরিপক্ক গাছ দিনে প্রায় ৫০-১০০ লিটার পানি বাষ্পীভবনের মাধ্যমে নিঃসরণ করতে পারে, যা আশপাশের পরিবেশকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ঠা-া করতে সক্ষম।

ইউএইচআই-এর স্বাস্থ্যগত প্রভাবও ভয়াবহ। রাতের বেলা শহরের তাপমাত্রা কম না থাকায় শরীর বিশ্রাম পায় না, যার ফলে হিট স্ট্রোক, ইনসোলেশন, হাঁপানি, ডিহাইড্রেশন এবং কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং গরিব জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা -এর মতে, শহরের ইউএইচআই প্রভাব একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।

ঢাকা শহরে Urban Heat Island-এর মানচিত্রায়ন ও বিশ্লেষণে রিমোট সেন্সিং ও জিআইএস-এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। একাধিক গবেষণা খঝঞ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাপ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল চিহ্নিত করেছে। গবেষণাগুলোর ফলাফলে দেখা যায়, যেখানে গাছপালা, খোলা জায়গা ও পানির উৎস আছে সেখানে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম, আর যেখানে ঘনবসতিপূর্ণ কংক্রিটের গঠন রয়েছে, সেখানে তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঢাকার তাপদাহ পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নানা গবেষণা পরিচালিত হয়েছে, বিশেষ করে ভূ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, রিমোট সেন্সিং এবং জিআইএস-প্রযুক্তির মাধ্যমে। এসব গবেষণা মূলত Land Surface Temperature (LST), Normalized Difference Vegetation Index (NDVI), এবং Urban Heat Island (UHI) নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গাজীপুর জেলায় পরিচালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে NDVI মান উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে (NDVI দ্বারা সবুজ আচ্ছাদনের মাত্রা পরিমাপ করা হয়)। গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে নির্মিত অঞ্চলগুলোর উপর ভিত্তি করে খঝঞ ২-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধিপেয়েছে। বনভূমি থেকে কংক্রিটে রূপান্তরের এই ধারা শুধু গাজীপুর নয়, পুরো ঢাকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হলো Heat Vulnerability Index (HVI)। এটি একটি সমন্বিত সূচক যা তাপদাহে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। MDPI-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব, নি¤œ আয়ের বসতি এবং প্রাকৃতিক ছায়ার অভাবে এই এলাকাগুলো অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে ঢাকার এলএসটি পরিবর্তন এবং তাপপ্রভাবজনিত জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশিত গবেষণায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিশু ও বৃদ্ধদের হিটস্ট্রোক, হিট-একজস্টশন ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের হার বাড়ছে। এসব গবেষণা শহরের নি¤œ আয়ের এলাকা ও ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চলকে ঝুঁকির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে।

আলোচ্য গবেষণাগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্দেশ করে শীতকালেও ঢাকায় UHI প্রভাব তীব্র হতে পারে। MDPI-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, গ্রীষ্মকালের পাশাপাশি শীতকালেও যখন সাধারণত তাপমাত্রা কম থাকে, তখনও নির্মিত অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকে। এই অবস্থাকে “Winter UHI” বলা হয়।

সবশেষে, গবেষণাগুলো শহরের পরিকল্পনায় পরিবেশগত বিবেচনার অনুপস্থিতিকে দায়ী করেছে। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ঢাকায় উষ্ণতা কমাতে নির্মাণ উপকরণ, ছাদের ধরন, রাস্তার পরিকল্পনা ও পানি ব্যবস্থাপনার ধরন পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি সবুজ করিডোর, ছাদ বাগান, শহুরে বন (urban forest) এবং জলাশয় সংরক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

তাপদাহ বৃদ্ধির ফলে স্বাস্থ্যখাতে মারাত্মক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, গত দশকে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন ও তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তির হার ২৫% পর্যন্ত বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও, এই অবস্থা ঢাকা শহরের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিয়েছে। গরমের কারণে নির্মাণ কাজ, শ্রমিক কার্যক্রম ও যানবাহন চলাচলে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়, যার ফলে জিডিপি-তে ৮-১০% পর্যন্ত ক্ষতি হয় বলে গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে জলবায়ু-সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য খরচ আগামী দশকে দ্বিগুণ হতে পারে। কর্মঘণ্টার ক্ষয়, কর্মক্ষমতা হ্রাস, এবং শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা বাড়ছে-যা শহরকে আরও অস্থির করে তুলতে পারে।

নগর উষ্ণতা দ্বীপ (Urban Heat Island)প্রভাবের মোকাবিলায় গাছ একটি অপরিহার্য উপাদান। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ দিনে প্রায় ১০০ লিটার লিটার পানি বাষ্পীভবনের মাধ্যমে নির্গত করে, যা আশপাশের তাপমাত্রা ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে গাছের ছায়া এবং বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া আবাসিক এলাকায় সান্ত¡নার অন্যতম উৎস। শুধু তাই নয়, গাছ বায়ুতে ময়লা কণা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও ওজোন শোষণ করে শহরের বায়ু মান উন্নত করে। গাছপালা নগর স্বাস্থ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সবুজ খোলা স্থান নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য, হৃদরোগ প্রতিরোধ এবং হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে।

ঢাকার নগরায়ন পরিকল্পনায় দীর্ঘদিন ধরেই গাছ এবং সবুজ এলাকার গুরুত্ব উপেক্ষিত। ইট, কংক্রিট এবং অন্ধকার রঙের স্থাপত্য উপকরণ তাপ শোষণ করে শহরকে দিনের শেষে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে গরম রাখে। ‘ল্যান্ড ইউজ ল্যান্ড কাভার’ পরিবর্তন বিশ্লেষণ বলছে, গত দুই দশকে ঢাকায় বনভূমি বা সবুজ এলাকা ৩৫-৪০% কমেছে এবং তা নির্মিত স্থানে রূপান্তরিত হয়েছে যা সরাসরি ‘ল্যান্ড সারফেস টেম্পেরাচার’ বৃদ্ধির কারণ।

নগর নকশায় পরিকল্পিতভাবে সবুজ করিডোর, পার্ক, ছায়াময় রাস্তার ধারে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা এবং ভবন নির্মাণে ছাদবাগান ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করা গেলে পরিস্থিতি অনেকাংশে পরিবর্তন সম্ভব। তবে সমস্যা শুধুমাত্র প্রযুক্তি বা পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ নয়। জনসচেতনতার অভাব এবং দুর্বল পরিবেশ আইন বাস্তবায়ন এই সংকট আরও জটিল করেছে। ঢাকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে EIA (Environmental Impact Assessment) নিয়মিতভাবে উপেক্ষিত হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ও নগর পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে আরও সমন্বয় প্রয়োজন। ইতোমধ্যে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, হৃদরোগসহ বিভিন্ন হিট–রিলেটেড রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় উৎপাদনশীলতায়। কার্যকর নীতি ও পদক্ষেপ হিসেবে সুপারিশ করা যায়: ১. নগরে দ্রুত urban forestry ও ছায়াদানকারী বৃক্ষরোপণ। ২. Heat-action প্ল্যান প্রণয়ন, যেখানে সময়োপযোগী সতর্কতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকবে। ৩. Reflective ও heat-resistant নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার। ৪. নগর পরিকল্পনায় green corridors ও urban forest অন্তর্ভুক্ত করা। ৫. জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, যেন নগরবাসী নিজ উদ্যোগে ছাদবাগান, দেয়ালবাগান ও ছোট আকারে সবুজায়নে অংশ নেয়।

উপরোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে ঢাকার পরিবেশ শীতল এবং বসবাস যোগ্য শহর রুপে ঢাকাকে ফিরে পাওয়া সম্ভব।

[লেখক: শিক্ষক, বাংলাদেশ স্টাডিজ এন্ড জিওগ্রাফি, মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল কলেজ (এমডিআইসি), ঢাকা]

back to top