alt

opinion » post-editorial

স্বপ্নের দক্ষিণ কোরিয়া; বাংলাদেশে আন্দোলন, ভিয়েতনামের সাফল্য

অসীম বিকাশ বড়ুয়া

: সোমবার, ২৫ আগস্ট ২০২৫

সাম্প্রতিক সময়ে ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত দেশের বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য শিক্ষণীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মতো একটি দেশ কেন একই ধরনের সুবিধা লুফে নিতে পারছে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কেবল সরকারের নীতির দিকে আঙুল তুললেই হবে না, বরং আমাদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে যা তাদের অর্থনৈতিক গতিপথকে ভিন্ন পথে চালিত করেছে। এই পার্থক্যগুলো শুধু অর্থনৈতিক নীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা তাদের সংস্কৃতি, শ্রমশক্তি এবং সামাজিক মূল্যবোধেও গভীরভাবে প্রোথিত। এই প্রবন্ধে আমরা সেই কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখব কেন ভিয়েতনাম সফল আর আমরা কোথায় পিছিয়ে আছি।

অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল চাবিকাঠি: ভিয়েতনামের মডেল

ভিয়েতনাম ২০০০ সালের পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য অত্যন্ত দূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো শ্রমিকদের সহজলভ্যতা এবং স্থিতিশীলতা। ভিয়েতনামে শ্রমিকরা অত্যন্ত কম খরচে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। তারা ৭-৮ জন শ্রমিক এক ঘরে বসবাস করতে আপত্তি জানায় না, যা তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কমিয়ে দেয়। এর ফলে উৎপাদন খরচও কমে আসে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের পণ্য প্রতিযোগিতামূলক হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মধ্যে এককভাবে বা কম লোক নিয়ে থাকার প্রবণতা বেশি, যা জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তোলে।

যোগাযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্থা: একটি বিশাল পার্থক্য

ভিয়েতনামের ভৌগোলিক অবস্থান এবং উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখে। ভিয়েতনাম থেকে দক্ষিণ কোরিয়াতে পণ্যবাহী জাহাজ মাত্র একদিনে পৌঁছাতে পারে, যা দ্রুত সরবরাহ শৃঙ্খল (ংঁঢ়ঢ়ষু পযধরহ) নিশ্চিত করে। এর ফলে কোরিয়ান ব্যবসায়ীরা কম সময়ে তাদের পণ্য বাজারে নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ। ১৫ দিনেরও বেশি সময় লেগে যায় পণ্য পৌঁছাতে, যা পণ্য পরিবহন খরচ এবং সময় উভয়ই বাড়িয়ে দেয়। এই দীর্ঘ সময় এবং অতিরিক্ত খরচ বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতাকে হ্রাস করে। উন্নত অবকাঠামো এবং ভৌগোলিক সুবিধা ভিয়েতনামের একটি বড় শক্তি, যা বাংলাদেশের নেই।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা: বাঙালি জাতির সমস্যা

ভিয়েতনামের সাফল্যের আরেকটি বড় কারণ হলো তাদের সামাজিক সংহতি। ভিয়েতনামী শ্রমিকরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একসঙ্গে কাজ করে এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে। সেখানে শ্রমিকদের মধ্যে ধর্ম, আঞ্চলিকতা বা ব্যক্তিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনো বিভেদ নেই। তারা কোরিয়ান খাবার গ্রহণ করতেও দ্বিধা করে না, যা তাদের নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, এই সামাজিক বিভেদ এক বিশাল সমস্যা। হিন্দু এবং মুসলিম শ্রমিকদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বিরোধ প্রায়ই দেখা যায়। এমনকি একই জেলার বা একই গ্রামের লোক ছাড়া অন্য কাউকে কাজে নিতে অনেকেই আগ্রহী হন না। এই ধরনের বিভাজনমূলক মানসিকতা কর্মক্ষেত্রের পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে এবং বিদেশি নিয়োগকর্তাদের কাছে বাঙালিদের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দেয়। কোরিয়ান মালিকরা সাধারণত এমন একটি শান্ত ও সহযোগী কর্মপরিবেশ চান, যা বাঙালিদের মধ্যে প্রায়ই অনুপস্থিত।

বোয়েসেল এবং ইপিএস: আমাদের প্রত্যাশা ও বাস্তবতায়

একজন ইপিএস কর্মী হিসেবে সবাই জানে যে, ইপিএস প্রক্রিয়ায় সফলতা কেবল মেধা বা ভাষা পারদর্শিতার ওপর নির্ভর করে না, বরং ভাগ্যের ওপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল। লটারি ও ভাষা পারদর্শী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও কোরিয়া যাওয়ার নিশ্চয়তা সরকার বা বোয়েসেল দেয় না। এটি একটি অনিশ্চিত এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যেখানে ধৈর্য ও প্রচেষ্টা উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারের ভূমিকা ও জনগণের দায়িত্ব:

বাংলাদেশে যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন আমরা প্রায়শই শুধু সরকারের দিকে আঙুল তুলি। কিন্তু আমাদের নিজেদের আচরণ, সামাজিক বিভেদ এবং কাজের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাবকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের দেশের জনগণ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, কাজের প্রতি আরও বেশি নিবেদিত হওয়া এবং বিভাজনমূলক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা। শুধু সরকারের সমালোচনা না করে, আমাদের উচিত নিজেদের উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া।

উপসংহার:

আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে কোরিয়ান সার্কুলার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।আর যদি কোরিয়ান সার্কুলার না হয় তাহলে বাংলাদেশের এই ইপিএস সিস্টেমটা বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা যারা ইপিএস লাইনে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি, আমাদের মাথায় একটা কথা চিন্তা রাখতে হবে যে আমি যেতে না পারলেও বা আমার ভাগ্য কোরিয়াতে না থাকলেও আমার দেশের অন্যান্য ভাইয়েরাতো প্রতি মাসে দক্ষিণ কোরিয়াতে যাচ্ছে। তাদের ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছে বলে তারা দক্ষিণ কোরিয়াতে যাচ্ছে । আর যদি ভিসা না হতো তাহলে কোরিয়াতে প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশী ইপিএস কর্মী কিভাবে গেল? আমাদের স্বার্থপরতা ও একটি ভুলের কারণে আমাদের দেশের মানুষের তথা অন্য ভাইদের ভবিষ্যতে কোরিয়া যাওয়ার স্বপ্ন রুদ্ধ হয়ে না যায় সেটাই আমাদেরকে সব সময় মনে রাখতে হবে। দেশ সমৃদ্ধ হলে জাতি সমৃদ্ধ হবে।আর যদি আমরা দেশের কথা না ভেবে শুধু নিজেদের কথা ভাবি তাহলে একদিন এমন সময় আসবে শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতে নয় সারা পৃথিবীতে আমাদের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

[ লেখক: দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী; ভাইস চেয়ারম্যান, কোরিয়া-বাংলা প্রেসক্লাব]

ডাকসু নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতি

ঢাকা শহরের উষ্ণতা: সবুজ হারানোর মূল্য

তিন বাহিনী প্রধানদের আশা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা

গনমাধ্যম জগতও নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে!

মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা: জাপান এক অনুসরণীয় আদর্শ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন ট্র্যাজেডি

হোক সবুজ বিপ্লব

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : একজন বিধায়কের জামিন

নিউটনের আপেল : পতনের ভেতরে জাগরণের গল্প

বায়ুদূষণ গবেষণার প্রসার ও তরুণদের ভূমিকা : প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা আহমদ

চাপে সামষ্টিক অর্থনীতি

ছবি

একাত্তরের গণহত্যা : সংখ্যার বিতর্ক নাকি দায় হালকা করার চেষ্টা?

রম্যগদ্য : ‘দালাল-ধন্বন্তরি-জীবন রক্ষাকারী...’

সাদা পাথর লুটে সর্বদলীয় ঐক্য

গণিতের বহুমুখী ব্যবহার : আধুনিক বিজ্ঞানের চালিকাশক্তি

প্রসঙ্গ : পেঁপের রিং স্পট ভাইরাস

ছবি

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : রাজনৈতিক বিভেদের অমোচনীয় ক্ষত

ছবি

আলফ্রেড সরেন হত্যা : বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

কারাম উৎসব : বাংলার প্রাচীন কৃষি ও সংস্কৃতির ধারক

ছবি

আলাস্কা বৈঠক : শান্তির দেখা কি মিলল?

বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কতদূর?

মবের উন্মাদনা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার

জীবন থেকে নেয়া শিক্ষাগুলোই এগিয়ে দেয় জীবনকে

রাজনৈতিক কর্মসূচি, যানজট ও আচরণগত অর্থনীতি

সম্পদের অভিশাপ : সিলেটের সাদাপাথরে সংঘাতের সমাজতত্ত্ব ও নীতি-সংকট

নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো

মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার জরুরি

ছবি

সাদাপাথরের নীলাভ দেশ : ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য ও সংকট

একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমাজতত্ত্ব

বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির নতুন ভূরাজনীতি

মব ও জাস্টিস

ইতিহাসকে নতুন করে লেখা এক জগাখিচুড়ি!

নারীর সমঅধিকার : সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি

জ্ঞানের মঞ্চ এখন সার্কাস, গবেষণা সেখানে নীরব দর্শক

ছবি

ভরা শ্রাবণে স্বদেশ-ভাবনা

নারীর প্রতি সহিংসতা : বাস্তবতা, আইন ও প্রতিরোধের জরুরি দিকনির্দেশনা

tab

opinion » post-editorial

স্বপ্নের দক্ষিণ কোরিয়া; বাংলাদেশে আন্দোলন, ভিয়েতনামের সাফল্য

অসীম বিকাশ বড়ুয়া

সোমবার, ২৫ আগস্ট ২০২৫

সাম্প্রতিক সময়ে ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত দেশের বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য শিক্ষণীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মতো একটি দেশ কেন একই ধরনের সুবিধা লুফে নিতে পারছে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কেবল সরকারের নীতির দিকে আঙুল তুললেই হবে না, বরং আমাদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে যা তাদের অর্থনৈতিক গতিপথকে ভিন্ন পথে চালিত করেছে। এই পার্থক্যগুলো শুধু অর্থনৈতিক নীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা তাদের সংস্কৃতি, শ্রমশক্তি এবং সামাজিক মূল্যবোধেও গভীরভাবে প্রোথিত। এই প্রবন্ধে আমরা সেই কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখব কেন ভিয়েতনাম সফল আর আমরা কোথায় পিছিয়ে আছি।

অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল চাবিকাঠি: ভিয়েতনামের মডেল

ভিয়েতনাম ২০০০ সালের পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য অত্যন্ত দূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো শ্রমিকদের সহজলভ্যতা এবং স্থিতিশীলতা। ভিয়েতনামে শ্রমিকরা অত্যন্ত কম খরচে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। তারা ৭-৮ জন শ্রমিক এক ঘরে বসবাস করতে আপত্তি জানায় না, যা তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কমিয়ে দেয়। এর ফলে উৎপাদন খরচও কমে আসে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের পণ্য প্রতিযোগিতামূলক হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মধ্যে এককভাবে বা কম লোক নিয়ে থাকার প্রবণতা বেশি, যা জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তোলে।

যোগাযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্থা: একটি বিশাল পার্থক্য

ভিয়েতনামের ভৌগোলিক অবস্থান এবং উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখে। ভিয়েতনাম থেকে দক্ষিণ কোরিয়াতে পণ্যবাহী জাহাজ মাত্র একদিনে পৌঁছাতে পারে, যা দ্রুত সরবরাহ শৃঙ্খল (ংঁঢ়ঢ়ষু পযধরহ) নিশ্চিত করে। এর ফলে কোরিয়ান ব্যবসায়ীরা কম সময়ে তাদের পণ্য বাজারে নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ। ১৫ দিনেরও বেশি সময় লেগে যায় পণ্য পৌঁছাতে, যা পণ্য পরিবহন খরচ এবং সময় উভয়ই বাড়িয়ে দেয়। এই দীর্ঘ সময় এবং অতিরিক্ত খরচ বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতাকে হ্রাস করে। উন্নত অবকাঠামো এবং ভৌগোলিক সুবিধা ভিয়েতনামের একটি বড় শক্তি, যা বাংলাদেশের নেই।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা: বাঙালি জাতির সমস্যা

ভিয়েতনামের সাফল্যের আরেকটি বড় কারণ হলো তাদের সামাজিক সংহতি। ভিয়েতনামী শ্রমিকরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একসঙ্গে কাজ করে এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে। সেখানে শ্রমিকদের মধ্যে ধর্ম, আঞ্চলিকতা বা ব্যক্তিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনো বিভেদ নেই। তারা কোরিয়ান খাবার গ্রহণ করতেও দ্বিধা করে না, যা তাদের নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, এই সামাজিক বিভেদ এক বিশাল সমস্যা। হিন্দু এবং মুসলিম শ্রমিকদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বিরোধ প্রায়ই দেখা যায়। এমনকি একই জেলার বা একই গ্রামের লোক ছাড়া অন্য কাউকে কাজে নিতে অনেকেই আগ্রহী হন না। এই ধরনের বিভাজনমূলক মানসিকতা কর্মক্ষেত্রের পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে এবং বিদেশি নিয়োগকর্তাদের কাছে বাঙালিদের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দেয়। কোরিয়ান মালিকরা সাধারণত এমন একটি শান্ত ও সহযোগী কর্মপরিবেশ চান, যা বাঙালিদের মধ্যে প্রায়ই অনুপস্থিত।

বোয়েসেল এবং ইপিএস: আমাদের প্রত্যাশা ও বাস্তবতায়

একজন ইপিএস কর্মী হিসেবে সবাই জানে যে, ইপিএস প্রক্রিয়ায় সফলতা কেবল মেধা বা ভাষা পারদর্শিতার ওপর নির্ভর করে না, বরং ভাগ্যের ওপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল। লটারি ও ভাষা পারদর্শী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও কোরিয়া যাওয়ার নিশ্চয়তা সরকার বা বোয়েসেল দেয় না। এটি একটি অনিশ্চিত এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যেখানে ধৈর্য ও প্রচেষ্টা উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারের ভূমিকা ও জনগণের দায়িত্ব:

বাংলাদেশে যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন আমরা প্রায়শই শুধু সরকারের দিকে আঙুল তুলি। কিন্তু আমাদের নিজেদের আচরণ, সামাজিক বিভেদ এবং কাজের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাবকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের দেশের জনগণ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, কাজের প্রতি আরও বেশি নিবেদিত হওয়া এবং বিভাজনমূলক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা। শুধু সরকারের সমালোচনা না করে, আমাদের উচিত নিজেদের উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া।

উপসংহার:

আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে কোরিয়ান সার্কুলার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।আর যদি কোরিয়ান সার্কুলার না হয় তাহলে বাংলাদেশের এই ইপিএস সিস্টেমটা বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা যারা ইপিএস লাইনে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি, আমাদের মাথায় একটা কথা চিন্তা রাখতে হবে যে আমি যেতে না পারলেও বা আমার ভাগ্য কোরিয়াতে না থাকলেও আমার দেশের অন্যান্য ভাইয়েরাতো প্রতি মাসে দক্ষিণ কোরিয়াতে যাচ্ছে। তাদের ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছে বলে তারা দক্ষিণ কোরিয়াতে যাচ্ছে । আর যদি ভিসা না হতো তাহলে কোরিয়াতে প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশী ইপিএস কর্মী কিভাবে গেল? আমাদের স্বার্থপরতা ও একটি ভুলের কারণে আমাদের দেশের মানুষের তথা অন্য ভাইদের ভবিষ্যতে কোরিয়া যাওয়ার স্বপ্ন রুদ্ধ হয়ে না যায় সেটাই আমাদেরকে সব সময় মনে রাখতে হবে। দেশ সমৃদ্ধ হলে জাতি সমৃদ্ধ হবে।আর যদি আমরা দেশের কথা না ভেবে শুধু নিজেদের কথা ভাবি তাহলে একদিন এমন সময় আসবে শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতে নয় সারা পৃথিবীতে আমাদের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

[ লেখক: দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী; ভাইস চেয়ারম্যান, কোরিয়া-বাংলা প্রেসক্লাব]

back to top