গৌতম রায়
যে ছাব্বিশ হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি গেল তৃণমূল কংগ্রেসের কেষ্টবিষ্টুদের ঘুষ খাওয়ার পরিণামে, তাদের মধ্যে যে সকলেই ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছিল- তা যে নয় আদালতের বিচারকদের তা অজানা নয়। কিন্তু ঘুষখোর সতীর্থদের বাঁচাতে কারা ঘুষ দিয়ে চাকরি বাগিয়েছিল- আদালত বার বার বলা স্বত্ত্বেও তাদের তালিকা সংশ্লিষ্টরা আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে আনেনি। ফলে নিরুপায় হয়ে আদালতকে মুড়ি-মিছরির একদর করতে হয়েছে। আদালত চলে আইন ও তথ্য-প্রমাণের উপর। আবেগকে সম্মান জানালেও আবেগকে আশ্রয় করে চলা আদালতের পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রথম যখন ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়ার কারণে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করেন, তার আগে কারা যোগ্য, পরীক্ষায় সঠিক ফল করে, বিনা ঘুষে চাকরি পেয়েছেন কারা- সেটা জানানোর জন্যে তিনি আইনগতভাবে অনেক সুযোগ রাজ্য সরকারকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যোগ্যদের বিষয়টা মেনে নিলে যে সরাসরি স্বীকার করা হয়ে যায় শাসক তৃণমূলের ঘনিষ্ঠেরা মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়ে অযোগ্যদের চাকরি পাইয়ে দিয়েছে। যোগ্যদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করে দেওয়া হলে যে, অযোগ্য যারা চাকরি পেয়েছিল, তারা কাকে ঘুষ দিয়ে চাকরি ‘কিনেছিল’, সেটা প্রকাশ্যে চলে আসবার সমুহ আশঙ্কা রয়েছে। সেই কারনেই নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যে সরকার যোগ্যদের তালিকা কখনো আদালতে পেশই করেনি। কার্যত যূপকাষ্ঠে চড়িয়েছে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের।
যারা ঘুষ দিয়ে চাকরি কিনেছে, সরকার তাদের বাঁচাতেই নিত্যনতুন যেসব কথা বলছে, সরকারি প্রকল্প তৈরির কথা বলছে, ভাতা দিতে চাইছে- এসবের ফলে পরিস্থিতি ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছিল। যারা ঘুষ নিয়ে চাকরি দিয়েছে, তাদের প্রতি রাজ্য সরকারের দায়বদ্ধতার বিষয়টিই ক্রমশ তার রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকান্ড আর সিদ্ধান্ত গুলোর মধ্যে দিয়ে বেশি জোরদারভাবে ফুটে উঠছিল। এই বিষয়টা নিশ্চয়ই আদালতের নজর এড়িয়ে যায়নি। সামাজিক সঙ্কট ঘিরে মমলাতে তো পারিপার্শ্বিকতাকে ভুলে কেবল আইনের কচকচির মধ্যে আদালত নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে পারে না। সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিও আদালতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।
আদালতের কাছে কেন যোগ্য-অযোগ্যের তালিকা পেশ করলো না সরকার? সারদা কেলেঙ্কারীর তথ্য প্রমাণ লোপাটে কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তথা দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্যপাল শ্যামল সেনের ভূমিকাটি খুব রহস্যাবৃত। সরকার বিচারপতি শ্যামল সেনকে সারদা কেলেঙ্কারী সংক্রান্ত একটা কমিটির প্রধান করেছিল। এই কমিটি কেলেঙ্কারীর মূল অনুসন্ধান তো দূরের কথা, কেলেঙ্কারীর নায়কদের বাঁচাতেই সবথেকে বেশি যতœশীল ছিল।
যোগ্য- অযোগ্যের তালিকা প্রকাশ করতে পারা যেত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে। কিন্তু সে পথে হাঁটার সাহস সরকারের হয়নি। কারণ, এই তালিকা বের হলেই অযোগ্যের হিসেবটা পরিস্কার হয়ে যাবে। কতজন লোক ক্ষমাতসীন দলের কেষ্ট - বিষ্টুদের মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে , ফাঁকা পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে চাকরি কিনেছিল- সেই হিসেবটা জলের মত পরিস্কার হয়ে যাবে।
প্রশ্ন হলো, যে মানুষেরা নিজেদের মেধার ভিত্তিতে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছিলেন, শাসক দলের সঙ্গে যোগসাজস করে ঘুষ দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের অপরাধের জন্যে কেন যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি যাবে?
চাকরিহারা দু একজন শিক্ষকের আত্মহত্যার খবর আসছে সংবাদ মাধ্যমে। আবার অকালে হার্ট অ্যাটাকের মত রোগে মারা গেছেন দু একজন চাকরিহারা শিক্ষক। কেউ অবশ্য বলতেই পারেন, হার্ট অ্যাটাকের কোনও বয়স নেই। এটাও বলতে পারেন, চাকরি যাওয়ার কারনে ওদের হার্ট অ্যাটাক হয়নি। আগের থেকেই হার্টের রোগ ছিল! সেই যে প্রাচীন প্রবাদ আছে না- দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। সেইরকমই আর কী।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক চাকরিহারা শিক্ষক আত্মহত্যা করেছেন। তিনি রীতিমত সুইসসাইড নোট লিখে রেখে গেছেন। সেখানে বলেছেন, যোগ্য শিক্ষক হয়েও তাকে চাকরি হারানোর অপবাদে ভয়ঙ্কর সামাজিক অসম্মানের মুখে পড়তে হয়েছে। তাই তার এই আত্মহত্যা।
কিন্তু সেই সুইসাইড নোটটিকে পুলিশ সম্পুর্ণ চেপে দিয়েছে। এমন কি তার পাড়ার লোকেদেরও এ বিষয় ঘিরে সমাজ মাধ্যমে বা মিডিয়ার কাছে মুখ না খোলার জন্যে পুলিশের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সমাজ মাধ্যমে যারা এই আত্মহত্যার ঘটনাটার কথা লিখেছিলেন, তাদের বেশিরভাগকেই দেখতে পাওয়া গেল , কয়েকঘন্টার মধ্যে হয় পোস্ট মুছে দিলেন। নতুবা বয়ান বদলে দিলেন পোস্টের। অর্থাৎ ওই মৃত্যুটিকে একটা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে চালাতে চাইলেন। বোঝাই গেল কোন চাপের মুখে তাদের এই ১৮০ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া।
এটাই এখন পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা। সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে একটা শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করতে এখন এই রাজ্যের মানুষ ভয় পাচ্ছে। অথচ যে প্রাথমিক শিক্ষকদের তালিকা এখন আদালতের বিচারাধীন বেআইনী নিয়োগ ঘিরে, সেই তালিকার এক শিক্ষিকা খুব সহজেই অন্য জেলা থেকে নিজের শ্বশুরবাড়ির পাড়ার একটা স্কুলে বদলি হয়ে গেলেন। বাম আমলে মাত্র চার ভোটে পৌর নির্বাচনে জেতা এক ব্যক্তি , বাম আমলের অন্তিম লগ্নে প্রাথমিকে চাকরি পেয়ে বসতবাটী থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে চাকরি পেয়েছিলেন। মমতার জামানায় বাইরে নিজের বামপন্থী ভেকটা বজায় রেখে নিজের শহরে খুব সহজেই বদলি হয়ে এলেন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গত ২৭ আগস্ট আদেশ দিয়েছে, সাত দিনের মধ্যে এই নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে অযোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট তো এই কিছুদিন আগে রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের ডি এ অন্তর্বতীকালীন ভাবে কিছুটা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাজ্য সরকার মানল সেই নির্দেশ? ঠিক অতীতের জমিদারদের মত, কোর্টের ডি এ ঘিরে নির্দেশ কে বুড়ো আঙোল দেখিয়ে কেবলমাত্র বাঙালি হিন্দদের দুর্গা পুজোতে একদম নিলাম হাঁকার স্টাইলে সরকারি অনুদান ঠিক করে দিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীই।
কে বলবে এই পোড়া পশ্চিমবঙ্গেই চাকরি হারিয়ে একটা বিরাট অংশের মানুষের কাছে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই? প্রায় দশ বছরের উপর এইসব মানুষেরা চাকরি করেছেন। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের একটা বড় অংশ ই বিয়ে করেছেন জৈবিক তাগিদে। সন্তানের বাবা বা মা হয়েছেন। সাংসারিক দায় দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন।
আজ হঠাৎ কিছু লোকের ঘুষের বিনিময়ে কিছু লোককে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার তাগিদে এরা মুড়ি-মিছরি এক হয়ে যাওয়ার ফলে চাকরিচ্যুত। কেবলমাত্র চাকরিচ্যুতই নয়। চাকরি হারানোর জেরে ভয়ঙ্কর রকম ভাবে সামাজিক অসম্মানের শিকার। কেউ জানে না এদের জন্যে আগামী জীবনে কি বিবিষিকা অপেক্ষা করে আছে।
অযোগ্যদের তালিকা প্রকাশ মানেই ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা যাদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি কিনেছিল, তারা কাদের টাকা দিয়ে এই চাকরি কিনেছিল, সেইসব লোকেদের নাম প্রকাশ হয়ে পড়বেই। আর যারা ঘুষের বিনিময়ে চাকরি বেচেছেন, সেই ঘুষের টাকার ভাগ তারা কোথায় পাঠিয়েছে- সেসব নাম প্রকাশ্যে চলে আসবেই। কান টানলে মাথা আসার মত সেই প্রবাদ বাক্যটা তখন আরো বেশি বাস্তবের আকার নেবে।
[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শনিবার, ৩০ আগস্ট ২০২৫
যে ছাব্বিশ হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি গেল তৃণমূল কংগ্রেসের কেষ্টবিষ্টুদের ঘুষ খাওয়ার পরিণামে, তাদের মধ্যে যে সকলেই ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছিল- তা যে নয় আদালতের বিচারকদের তা অজানা নয়। কিন্তু ঘুষখোর সতীর্থদের বাঁচাতে কারা ঘুষ দিয়ে চাকরি বাগিয়েছিল- আদালত বার বার বলা স্বত্ত্বেও তাদের তালিকা সংশ্লিষ্টরা আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে আনেনি। ফলে নিরুপায় হয়ে আদালতকে মুড়ি-মিছরির একদর করতে হয়েছে। আদালত চলে আইন ও তথ্য-প্রমাণের উপর। আবেগকে সম্মান জানালেও আবেগকে আশ্রয় করে চলা আদালতের পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রথম যখন ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়ার কারণে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করেন, তার আগে কারা যোগ্য, পরীক্ষায় সঠিক ফল করে, বিনা ঘুষে চাকরি পেয়েছেন কারা- সেটা জানানোর জন্যে তিনি আইনগতভাবে অনেক সুযোগ রাজ্য সরকারকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যোগ্যদের বিষয়টা মেনে নিলে যে সরাসরি স্বীকার করা হয়ে যায় শাসক তৃণমূলের ঘনিষ্ঠেরা মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়ে অযোগ্যদের চাকরি পাইয়ে দিয়েছে। যোগ্যদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করে দেওয়া হলে যে, অযোগ্য যারা চাকরি পেয়েছিল, তারা কাকে ঘুষ দিয়ে চাকরি ‘কিনেছিল’, সেটা প্রকাশ্যে চলে আসবার সমুহ আশঙ্কা রয়েছে। সেই কারনেই নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যে সরকার যোগ্যদের তালিকা কখনো আদালতে পেশই করেনি। কার্যত যূপকাষ্ঠে চড়িয়েছে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের।
যারা ঘুষ দিয়ে চাকরি কিনেছে, সরকার তাদের বাঁচাতেই নিত্যনতুন যেসব কথা বলছে, সরকারি প্রকল্প তৈরির কথা বলছে, ভাতা দিতে চাইছে- এসবের ফলে পরিস্থিতি ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছিল। যারা ঘুষ নিয়ে চাকরি দিয়েছে, তাদের প্রতি রাজ্য সরকারের দায়বদ্ধতার বিষয়টিই ক্রমশ তার রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকান্ড আর সিদ্ধান্ত গুলোর মধ্যে দিয়ে বেশি জোরদারভাবে ফুটে উঠছিল। এই বিষয়টা নিশ্চয়ই আদালতের নজর এড়িয়ে যায়নি। সামাজিক সঙ্কট ঘিরে মমলাতে তো পারিপার্শ্বিকতাকে ভুলে কেবল আইনের কচকচির মধ্যে আদালত নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে পারে না। সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিও আদালতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।
আদালতের কাছে কেন যোগ্য-অযোগ্যের তালিকা পেশ করলো না সরকার? সারদা কেলেঙ্কারীর তথ্য প্রমাণ লোপাটে কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তথা দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্যপাল শ্যামল সেনের ভূমিকাটি খুব রহস্যাবৃত। সরকার বিচারপতি শ্যামল সেনকে সারদা কেলেঙ্কারী সংক্রান্ত একটা কমিটির প্রধান করেছিল। এই কমিটি কেলেঙ্কারীর মূল অনুসন্ধান তো দূরের কথা, কেলেঙ্কারীর নায়কদের বাঁচাতেই সবথেকে বেশি যতœশীল ছিল।
যোগ্য- অযোগ্যের তালিকা প্রকাশ করতে পারা যেত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে। কিন্তু সে পথে হাঁটার সাহস সরকারের হয়নি। কারণ, এই তালিকা বের হলেই অযোগ্যের হিসেবটা পরিস্কার হয়ে যাবে। কতজন লোক ক্ষমাতসীন দলের কেষ্ট - বিষ্টুদের মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে , ফাঁকা পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে চাকরি কিনেছিল- সেই হিসেবটা জলের মত পরিস্কার হয়ে যাবে।
প্রশ্ন হলো, যে মানুষেরা নিজেদের মেধার ভিত্তিতে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছিলেন, শাসক দলের সঙ্গে যোগসাজস করে ঘুষ দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের অপরাধের জন্যে কেন যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি যাবে?
চাকরিহারা দু একজন শিক্ষকের আত্মহত্যার খবর আসছে সংবাদ মাধ্যমে। আবার অকালে হার্ট অ্যাটাকের মত রোগে মারা গেছেন দু একজন চাকরিহারা শিক্ষক। কেউ অবশ্য বলতেই পারেন, হার্ট অ্যাটাকের কোনও বয়স নেই। এটাও বলতে পারেন, চাকরি যাওয়ার কারনে ওদের হার্ট অ্যাটাক হয়নি। আগের থেকেই হার্টের রোগ ছিল! সেই যে প্রাচীন প্রবাদ আছে না- দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। সেইরকমই আর কী।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক চাকরিহারা শিক্ষক আত্মহত্যা করেছেন। তিনি রীতিমত সুইসসাইড নোট লিখে রেখে গেছেন। সেখানে বলেছেন, যোগ্য শিক্ষক হয়েও তাকে চাকরি হারানোর অপবাদে ভয়ঙ্কর সামাজিক অসম্মানের মুখে পড়তে হয়েছে। তাই তার এই আত্মহত্যা।
কিন্তু সেই সুইসাইড নোটটিকে পুলিশ সম্পুর্ণ চেপে দিয়েছে। এমন কি তার পাড়ার লোকেদেরও এ বিষয় ঘিরে সমাজ মাধ্যমে বা মিডিয়ার কাছে মুখ না খোলার জন্যে পুলিশের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সমাজ মাধ্যমে যারা এই আত্মহত্যার ঘটনাটার কথা লিখেছিলেন, তাদের বেশিরভাগকেই দেখতে পাওয়া গেল , কয়েকঘন্টার মধ্যে হয় পোস্ট মুছে দিলেন। নতুবা বয়ান বদলে দিলেন পোস্টের। অর্থাৎ ওই মৃত্যুটিকে একটা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে চালাতে চাইলেন। বোঝাই গেল কোন চাপের মুখে তাদের এই ১৮০ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া।
এটাই এখন পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা। সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে একটা শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করতে এখন এই রাজ্যের মানুষ ভয় পাচ্ছে। অথচ যে প্রাথমিক শিক্ষকদের তালিকা এখন আদালতের বিচারাধীন বেআইনী নিয়োগ ঘিরে, সেই তালিকার এক শিক্ষিকা খুব সহজেই অন্য জেলা থেকে নিজের শ্বশুরবাড়ির পাড়ার একটা স্কুলে বদলি হয়ে গেলেন। বাম আমলে মাত্র চার ভোটে পৌর নির্বাচনে জেতা এক ব্যক্তি , বাম আমলের অন্তিম লগ্নে প্রাথমিকে চাকরি পেয়ে বসতবাটী থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে চাকরি পেয়েছিলেন। মমতার জামানায় বাইরে নিজের বামপন্থী ভেকটা বজায় রেখে নিজের শহরে খুব সহজেই বদলি হয়ে এলেন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গত ২৭ আগস্ট আদেশ দিয়েছে, সাত দিনের মধ্যে এই নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে অযোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট তো এই কিছুদিন আগে রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের ডি এ অন্তর্বতীকালীন ভাবে কিছুটা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাজ্য সরকার মানল সেই নির্দেশ? ঠিক অতীতের জমিদারদের মত, কোর্টের ডি এ ঘিরে নির্দেশ কে বুড়ো আঙোল দেখিয়ে কেবলমাত্র বাঙালি হিন্দদের দুর্গা পুজোতে একদম নিলাম হাঁকার স্টাইলে সরকারি অনুদান ঠিক করে দিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীই।
কে বলবে এই পোড়া পশ্চিমবঙ্গেই চাকরি হারিয়ে একটা বিরাট অংশের মানুষের কাছে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই? প্রায় দশ বছরের উপর এইসব মানুষেরা চাকরি করেছেন। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের একটা বড় অংশ ই বিয়ে করেছেন জৈবিক তাগিদে। সন্তানের বাবা বা মা হয়েছেন। সাংসারিক দায় দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন।
আজ হঠাৎ কিছু লোকের ঘুষের বিনিময়ে কিছু লোককে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার তাগিদে এরা মুড়ি-মিছরি এক হয়ে যাওয়ার ফলে চাকরিচ্যুত। কেবলমাত্র চাকরিচ্যুতই নয়। চাকরি হারানোর জেরে ভয়ঙ্কর রকম ভাবে সামাজিক অসম্মানের শিকার। কেউ জানে না এদের জন্যে আগামী জীবনে কি বিবিষিকা অপেক্ষা করে আছে।
অযোগ্যদের তালিকা প্রকাশ মানেই ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা যাদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি কিনেছিল, তারা কাদের টাকা দিয়ে এই চাকরি কিনেছিল, সেইসব লোকেদের নাম প্রকাশ হয়ে পড়বেই। আর যারা ঘুষের বিনিময়ে চাকরি বেচেছেন, সেই ঘুষের টাকার ভাগ তারা কোথায় পাঠিয়েছে- সেসব নাম প্রকাশ্যে চলে আসবেই। কান টানলে মাথা আসার মত সেই প্রবাদ বাক্যটা তখন আরো বেশি বাস্তবের আকার নেবে।
[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]