মিহির কুমার রায়
পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। বর্তমানে দেশে পাটচাষীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান হচ্ছে পাট চাষে। পাট শিল্পে ও পাটপণ্য রফতানির কাজে জড়িত আছেন প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক। জিডিপিতে পাটের অবদান প্রায় শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। কৃষি জিডিপিতে পাটের অংশ প্রায় ১ শতাংশ। মোট রফতানি আয়ের প্রায় ২ শতাংশ আসে পাট ও পাটপণ্য রফতানি থেকে। তৈরি পোশাক শিল্পের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত।
পাট থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রফতানি থেকে। এক সময় পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে মোট বৈদেশিক আয়ে পাটের অংশ ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ দশমিক ৮৮ শতাংশে।
১৯৫৮ সালে এ দেশে সাদা পাটের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল শতকরা ৭৫ দশমিক ৪৮ ভাগ এবং তোষা ২৪ দশমিক ৫২ ভাগ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তোষা পাট জমির প্রায় ৮৯ ভাগ, সাদা পাট ৪ ভাগ এবং মেস্তা ও কেনাফ প্রায় ৭ ভাগ জমিতে চাষ হয়েছে। তোষা পাটের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ১৩ দশমিক ৬৪ বেল, সাদা পাটের উৎপাদন ৯ দশমিক ৭৩ বেল এবং মেস্তা ও কেনাফের গড় উৎপাদন ১০ দশমিক শূন্য ৬ বেল। সারা দেশে হেক্টরপ্রতি পাটের গড় উৎপাদন ১৩ দশমিক ২৪ বেল। নব্বইয়ের দশকে এ দেশে পাট চাষ হতো প্রায় ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। বর্তমানে তা নেমে এসেছে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ হেক্টরে।
মাঠ গবেষণায় দেখা যায়, একসময় রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতির মূল প্রাণ ছিল পাট। কিন্তু এখন সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। গত ২০ বছরে পাট চাষ কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ, ফলে হাজার হাজার কৃষক বেকার হয়েছেন। এর প্রধান কারণ বন্যা, ভালো বীজের অভাব এবং বাজারের অনিশ্চয়তা। তবে এবার নতুন পাট বাজারে ওঠায় এবং ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা কিছুটা খুশি।
রংপুর কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর (খরিফ-১ মৌসুমে) রংপুর বিভাগের আট জেলার (রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী) মোট ৫৪ হাজার ৬৬৯ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রত্যাশা ৭ লাখ ৯ হাজার ৭৯৯ বেল পাট উৎপাদন হবে। উল্লেখ্য, গত তিন বছরে এই অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ কমেছে। ২০২৩ সালে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলায় মোট ৫১ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছিল। এতে প্রায় ৭০ হাজার কৃষক যুক্ত ছিলেন। ২০২২ সালে এই জমির পরিমাণ ছিল ৫৬ হাজার ৪১২ হেক্টর এবং প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক এতে জড়িত ছিলেন। গত ১০ বছরে এই অঞ্চলে পাট চাষের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ এবং গত ২০ বছরে ৭০ শতাংশ কমেছে।
পাট চাষ কৃষি শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। কৃষকরা পাট কাটার পর আমন ধানের চারা রোপণ করেন। এরপর প্রায় এক থেকে দেড় মাস তাদের হাতে কাজ থাকে না। এই সময়ে পাট জাগ দেওয়া ও আঁশ ছাড়ানোর কাজ করে কৃষি শ্রমিকরা আয় করেন। কিন্তু পাট চাষ কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগও হ্রাস পেয়েছে। তবে আশার কথা, এ বছর নতুন পাট বাজারে উঠতে শুরু করেছে। প্রতি মণ পাট মানভেদে ৩,০০০ থেকে ৩,২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কৃষকরা এতে কিছুটা লাভবান হচ্ছেন। এছাড়া প্রতি মণ পাটকাঠি ৭০০ থেকে ১,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাটকাঠি এখন আর শুধু জ্বালানি নয়, এটি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। পাটকাঠি দিয়ে হার্ডবোর্ড ও বিশেষ প্রক্রিয়ায় কয়লা তৈরি করা হয়, যা গুঁড়ো করে কার্বন ও প্রিন্টারের কালি বানানো হয়। ফলে পাট এখন কৃষকদের জন্য লাভজনক ফসল হিসেবে ফিরে আসছে।
লালমনিরহাটের কৃষক মো. আশরাফ দুই একর জমিতে ৪৫ মণ পাট উৎপাদন করে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা আয় করেছেন। ৭০ মণ পাটকাঠি বিক্রি করে আরও ৪৯ হাজার টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি। চাষের সব খরচ বাদ দিয়ে তার প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে। কৃষক আব্দুস সাত্তার (৫০) বলেন, একসময় উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল পাট। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই ফসল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু আধুনিকতার প্রভাব, চাষের খরচ বৃদ্ধি এবং ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় পাট চাষ এখন বিলুপ্তির পথে। তবে সরকার পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় বাজারে কিছুটা গতি ফিরেছে। ভবিষ্যতে পাট চাষ বাড়াতে হলে কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে এবং পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
রংপুর পাট গবেষণা ও উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বন্যা, বীজের অভাব, পানির সংকট এবং বাজারের অনিশ্চয়তার কারণেই রংপুর বিভাগে পাট চাষের জমি ও উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে। তবে আশার খবর, চলতি খরিফ মৌসুমে উঁচু জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে একসময় কৃষকের মনে পাট জাগ দেওয়া নিয়ে ভয় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আষাঢ় মাসের শেষে বৃষ্টির কারণে খাল-বিলে পানি জমে যায়, ফলে পাট পচন নিয়ে বড় কোনো সমস্যা হয়নি।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানান, পাট এখন কৃষকদের জন্য লাভজনক ফসল। কৃষকরা এ অঞ্চলে দুটি প্রধান ফসলের মাঝামাঝি সময়ে পাট চাষ করতে পারেন। কারণ পাট কাটার পর আমন ধানের চারা রোপণ সম্ভব হয়। তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চলের কৃষকরা এখনও সনাতন পদ্ধতিতে পাট আঁটি করে জাগ দেন। এতে পাটের মান ও রং খারাপ হয়, শ্রমিক বেশি লাগে এবং উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। তাই তিনি কৃষকদের ‘ফিতা রেটিং’ পদ্ধতিতে পাট জাগ দিতে উৎসাহিত করেন। এই পদ্ধতিতে কম পানি লাগে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজে আঁশ ছাড়ানো যায় এবং উৎপাদন খরচও কমে।
বর্তমানে নীতিনির্ধারণী ও গবেষণা পর্যায়ে অনেক কিছু করার আছে। পাট গবেষণায় ইতিমধ্যে সাদা পাটের ১২টি উচ্চফলনশীল জাত, তোষা পাটের আটটি, কেনাফের চারটি এবং মেস্তার তিনটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর সম্প্রসারণ চলছে মাঠ পর্যায়ে। বর্তমানে পাটের গড় ফলন পৃথিবীর পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বাধিক। এর পেছনে কৃষি বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান অনস্বীকার্য। সম্প্রতি পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবন হয়েছে। এর মাধ্যমে রোগ ও পোকা প্রতিরোধী উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের এমন জাত উদ্ভাবন করতে হবে, যা খরা, লবণাক্ততা ও শীতসহিষ্ণু এবং সারা বছর উৎপাদন উপযোগী।
ইতিমধ্যে বছরে দু’বার, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে পাট বোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাতে উৎপাদন আরও বাড়বে। তবে গবেষণার মাঠে নতুন উদ্ভাবিত জাতের ফলন যত বেশি, কৃষকের মাঠে তা ততটা পাওয়া যায় না। গবেষণা ও মাঠ পর্যায়ে ফলনের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ফারাক আছে। এটি কমাতে হলে গবেষণা ও সম্প্রসারণে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় প্রয়োজন। একইসাথে পাট গবেষণা ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, বাজার স্থিতিশীল রাখতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে।
[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]
মিহির কুমার রায়
শনিবার, ৩০ আগস্ট ২০২৫
পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। বর্তমানে দেশে পাটচাষীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান হচ্ছে পাট চাষে। পাট শিল্পে ও পাটপণ্য রফতানির কাজে জড়িত আছেন প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক। জিডিপিতে পাটের অবদান প্রায় শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। কৃষি জিডিপিতে পাটের অংশ প্রায় ১ শতাংশ। মোট রফতানি আয়ের প্রায় ২ শতাংশ আসে পাট ও পাটপণ্য রফতানি থেকে। তৈরি পোশাক শিল্পের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত।
পাট থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রফতানি থেকে। এক সময় পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে মোট বৈদেশিক আয়ে পাটের অংশ ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ দশমিক ৮৮ শতাংশে।
১৯৫৮ সালে এ দেশে সাদা পাটের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল শতকরা ৭৫ দশমিক ৪৮ ভাগ এবং তোষা ২৪ দশমিক ৫২ ভাগ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তোষা পাট জমির প্রায় ৮৯ ভাগ, সাদা পাট ৪ ভাগ এবং মেস্তা ও কেনাফ প্রায় ৭ ভাগ জমিতে চাষ হয়েছে। তোষা পাটের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ১৩ দশমিক ৬৪ বেল, সাদা পাটের উৎপাদন ৯ দশমিক ৭৩ বেল এবং মেস্তা ও কেনাফের গড় উৎপাদন ১০ দশমিক শূন্য ৬ বেল। সারা দেশে হেক্টরপ্রতি পাটের গড় উৎপাদন ১৩ দশমিক ২৪ বেল। নব্বইয়ের দশকে এ দেশে পাট চাষ হতো প্রায় ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। বর্তমানে তা নেমে এসেছে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ হেক্টরে।
মাঠ গবেষণায় দেখা যায়, একসময় রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতির মূল প্রাণ ছিল পাট। কিন্তু এখন সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। গত ২০ বছরে পাট চাষ কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ, ফলে হাজার হাজার কৃষক বেকার হয়েছেন। এর প্রধান কারণ বন্যা, ভালো বীজের অভাব এবং বাজারের অনিশ্চয়তা। তবে এবার নতুন পাট বাজারে ওঠায় এবং ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা কিছুটা খুশি।
রংপুর কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর (খরিফ-১ মৌসুমে) রংপুর বিভাগের আট জেলার (রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী) মোট ৫৪ হাজার ৬৬৯ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রত্যাশা ৭ লাখ ৯ হাজার ৭৯৯ বেল পাট উৎপাদন হবে। উল্লেখ্য, গত তিন বছরে এই অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ কমেছে। ২০২৩ সালে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলায় মোট ৫১ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছিল। এতে প্রায় ৭০ হাজার কৃষক যুক্ত ছিলেন। ২০২২ সালে এই জমির পরিমাণ ছিল ৫৬ হাজার ৪১২ হেক্টর এবং প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক এতে জড়িত ছিলেন। গত ১০ বছরে এই অঞ্চলে পাট চাষের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ এবং গত ২০ বছরে ৭০ শতাংশ কমেছে।
পাট চাষ কৃষি শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। কৃষকরা পাট কাটার পর আমন ধানের চারা রোপণ করেন। এরপর প্রায় এক থেকে দেড় মাস তাদের হাতে কাজ থাকে না। এই সময়ে পাট জাগ দেওয়া ও আঁশ ছাড়ানোর কাজ করে কৃষি শ্রমিকরা আয় করেন। কিন্তু পাট চাষ কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগও হ্রাস পেয়েছে। তবে আশার কথা, এ বছর নতুন পাট বাজারে উঠতে শুরু করেছে। প্রতি মণ পাট মানভেদে ৩,০০০ থেকে ৩,২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কৃষকরা এতে কিছুটা লাভবান হচ্ছেন। এছাড়া প্রতি মণ পাটকাঠি ৭০০ থেকে ১,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাটকাঠি এখন আর শুধু জ্বালানি নয়, এটি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। পাটকাঠি দিয়ে হার্ডবোর্ড ও বিশেষ প্রক্রিয়ায় কয়লা তৈরি করা হয়, যা গুঁড়ো করে কার্বন ও প্রিন্টারের কালি বানানো হয়। ফলে পাট এখন কৃষকদের জন্য লাভজনক ফসল হিসেবে ফিরে আসছে।
লালমনিরহাটের কৃষক মো. আশরাফ দুই একর জমিতে ৪৫ মণ পাট উৎপাদন করে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা আয় করেছেন। ৭০ মণ পাটকাঠি বিক্রি করে আরও ৪৯ হাজার টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি। চাষের সব খরচ বাদ দিয়ে তার প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে। কৃষক আব্দুস সাত্তার (৫০) বলেন, একসময় উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল পাট। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই ফসল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু আধুনিকতার প্রভাব, চাষের খরচ বৃদ্ধি এবং ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় পাট চাষ এখন বিলুপ্তির পথে। তবে সরকার পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় বাজারে কিছুটা গতি ফিরেছে। ভবিষ্যতে পাট চাষ বাড়াতে হলে কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে এবং পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
রংপুর পাট গবেষণা ও উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বন্যা, বীজের অভাব, পানির সংকট এবং বাজারের অনিশ্চয়তার কারণেই রংপুর বিভাগে পাট চাষের জমি ও উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে। তবে আশার খবর, চলতি খরিফ মৌসুমে উঁচু জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে একসময় কৃষকের মনে পাট জাগ দেওয়া নিয়ে ভয় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আষাঢ় মাসের শেষে বৃষ্টির কারণে খাল-বিলে পানি জমে যায়, ফলে পাট পচন নিয়ে বড় কোনো সমস্যা হয়নি।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানান, পাট এখন কৃষকদের জন্য লাভজনক ফসল। কৃষকরা এ অঞ্চলে দুটি প্রধান ফসলের মাঝামাঝি সময়ে পাট চাষ করতে পারেন। কারণ পাট কাটার পর আমন ধানের চারা রোপণ সম্ভব হয়। তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চলের কৃষকরা এখনও সনাতন পদ্ধতিতে পাট আঁটি করে জাগ দেন। এতে পাটের মান ও রং খারাপ হয়, শ্রমিক বেশি লাগে এবং উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। তাই তিনি কৃষকদের ‘ফিতা রেটিং’ পদ্ধতিতে পাট জাগ দিতে উৎসাহিত করেন। এই পদ্ধতিতে কম পানি লাগে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজে আঁশ ছাড়ানো যায় এবং উৎপাদন খরচও কমে।
বর্তমানে নীতিনির্ধারণী ও গবেষণা পর্যায়ে অনেক কিছু করার আছে। পাট গবেষণায় ইতিমধ্যে সাদা পাটের ১২টি উচ্চফলনশীল জাত, তোষা পাটের আটটি, কেনাফের চারটি এবং মেস্তার তিনটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর সম্প্রসারণ চলছে মাঠ পর্যায়ে। বর্তমানে পাটের গড় ফলন পৃথিবীর পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বাধিক। এর পেছনে কৃষি বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান অনস্বীকার্য। সম্প্রতি পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবন হয়েছে। এর মাধ্যমে রোগ ও পোকা প্রতিরোধী উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের এমন জাত উদ্ভাবন করতে হবে, যা খরা, লবণাক্ততা ও শীতসহিষ্ণু এবং সারা বছর উৎপাদন উপযোগী।
ইতিমধ্যে বছরে দু’বার, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে পাট বোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাতে উৎপাদন আরও বাড়বে। তবে গবেষণার মাঠে নতুন উদ্ভাবিত জাতের ফলন যত বেশি, কৃষকের মাঠে তা ততটা পাওয়া যায় না। গবেষণা ও মাঠ পর্যায়ে ফলনের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ফারাক আছে। এটি কমাতে হলে গবেষণা ও সম্প্রসারণে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় প্রয়োজন। একইসাথে পাট গবেষণা ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, বাজার স্থিতিশীল রাখতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে।
[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]