alt

উপ-সম্পাদকীয়

“বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা”

শেখর ভট্টাচার্য

: সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২
image

কবি শামসুর রাহমানের ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। মুক্তিযুদ্ধের দামামা প্রায় বেজে উঠল বলে। কবি নিজ বাস ভূমে অবস্থান করে আশার প্রহর গুনছেন। স্বদেশ তখনো অবরুদ্ধ। অবরুদ্ধ স্বদেশে থেকে কবি নিজ বাস ভূম-সৃষ্টির জন্য আকুল হয়ে আছেন। তার আলোচিত নিজ “নিজ বাসভূমে’ নামক কাব্যগ্রন্থেরই একটি অনিন্দ্য সুন্দর কবিতা “বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা”। পরাধীনতার কবলে স্বদেশ, বর্ণমালাও স্বাধীন নয়। নানা উদ্ভট পরীক্ষা, নিরীক্ষা চলছে বর্ণমালাকে ঘিরে। কখনো উর্দু, কখনো বা রোমান হরফে বাংলা বর্ণমালা লেখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বাঙালির প্রাণভোমরা তার সংস্কৃতির ভেতরে। এ বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয়নি শাসকগোষ্ঠীর। তাই মরিয়া হয়ে আঘাত হানছে শাসকরা বাংলা ভাষা, সাহিত্যে ও সংস্কৃতির ওপর। বাংলা ভাষার যে বর্ণমালা নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকে বাঙালির হৃদয়ে, হয় অনাবিল আলোর উৎস হয়ে কিংবা দিকনির্দেশনা প্রদান করে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনায়নে, সেই বর্ণমালাকে যখন কবি দুঃখিনী বলে আখ্যায়িত করেন, তখন সম্ভবত সেই দুঃখের মাত্রাটি শুধু রাজনৈতিক বাদ-বিসম্বাদেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এই বর্ণমালার সমন্বয়ে যে শব্দ ও বাক্য আমরা উদয়াস্ত নির্মাণ করি, সেই নির্মিতিতেও থেকে যায় অনেকগুলো বিচ্যুতি।

কবি শামসুর রাহমান যখন বর্ণমালাকে নিয়ে ‘খ্যাংরার নোংরামি’ দেখেন, দেখেন ‘খিস্তি খেউড়ের পৌষ মাস’ তখন আমরা দ্রুত সেই ঐতিহাসিক উপলব্ধিতে পৌঁছে যাই, যেখানে পাকিস্তানি শাসকের হাতে আমাদের ভাষা হয়েছে সেভাবে লাঞ্ছিত, যেভাবে হয়েছেন আমাদের বহু নারী। আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তকে কেঁড়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। কেঁড়ে নেয়া না গেলে তাতে ধর্মের প্রলেপ লাগানো হচ্ছে। নজরুলের শ্যামা সংগীত, দেশাত্মবোধক গান, কবিতা আড়ালে রেখে ইসলাম ধর্মীয় হামদ, নাতকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। নজরুলের কবিতার ধর্মীয়করণ করে মহাশ্মশানকে গোরস্তানে রূপান্তরিত করা হচ্ছে।

বায়ান্ন সালে যারা ভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তারা তো বাঙালি সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার চূড়ান্ত ক্ষণে তাই জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উপড়ে ফেলার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী। শামসুর রাহমান তাই বলেন, ‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?/উনিশশো বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী। /সে ফুলের একটি পাঁপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে। /এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,/এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস /তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো/বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা”।

স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য একটি নতুন গতি লাভ করেছে এবং নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা এ ক্ষেত্রে এগিয়েছি অনেকখানি। পরিভাষাগত সীমাবদ্ধতা আমরা কাটাতে চেয়েছি, স্বাধীনতার সেই প্রথম প্রহর থেকেই। হয়তো বাংলা ভাষার ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি ছিল আমাদের সত্তর দশকের গোড়ার দিকে, তার সবটুকু পূরণ সম্ভব হয়নি। কিন্তু ভাষা ব্যবহারে আমাদের অর্জন ও নিতান্ত সামান্য নয়। এত অর্জনের পরও মনে হয়, ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে আমাদের জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, চর্চায় মাতৃভাষার সার্থক ব্যবহার করে জাতিকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র আমাদের প্রচুর দৈনতা রয়ে গেছে।

বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসারে মাতৃভাষার ভূমিকা শুধু ঐতিহ্য বা কৃষ্টিমন্ডিত নয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে এ ভাষার অবদান ব্যাপক। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে দীর্ঘ সংগ্রামের পথপরিক্রমায় ঋদ্ধ প্রাণশক্তিতে পরিপুষ্ট হয়ে মাতৃভাষা বাংলা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শক্ত ভিত হিসেবে উপহৃত। একুশের চেতনায় ভাস্মর মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতিগুলো তথা সংবিধানসম্মত জাতির প্রধান চার আদর্শ-জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে জাতি তাদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করেছে। মাতৃভাষা বাংলাকে প্রায়োগিক অর্থে যথাযথ মূল্যায়ন এবং সর্বত্র এর বিকাশকে অগ্রাধিকার না দিয়ে শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি অথবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে আমাদের তৎপরতা কোনোভাবেই জাতির সামষ্টিক আর্থসামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে সব স্তরে এবং সব জনপদে শিক্ষাকে যদি কার্যকরভাবে জনপ্রিয় করা না যায়, তাহলে শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং এর প্রাসঙ্গিক উন্নয়ন নিয়ামকগুলোর তুলনামূলক প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

মাতৃভাষায় চিন্তা, মতপ্রকাশ এবং সামগ্রিক অর্থে জ্ঞান অর্জনের যে ধারা; সেটি বিশ্বের শীর্ষ উন্নত দেশ যেমন চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মান ইত্যাদির উন্নয়নের সফল ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরিপূর্ণ রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা অভিষিক্ত হলেও এখনো আমরা দেখি যে, সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর ব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশনা চেয়ে ২০১৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে বাংলা ভাষায় একটি রিট আবেদন করা হয়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ বাস্তবায়নে নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, বাংলা ভাষা আইন সর্বত্র অনুসরণ করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এবং ওই আইনের ৪ ধারা অনুসারে প্রয়োজনীয় বিধি জারি করার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না-এ মর্মে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবসহ সাতজনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রুল চাওয়া হয়। ‘একুশ মানে মাথানত না করা’-মাতৃভাষা আন্দোলনের এ বোধ এখনও কতটুকু জোরালোভাবে সঞ্চারিত হচ্ছে, এ রিট আবেদন তারই সাক্ষ্য বহন করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, শিল্পসাহিত্য ইত্যাদির অপরিসীম উন্নয়ন মাতৃভাষা বাংলাকে ঘিরে এবং এর যথাযথ মর্যাদা এবং সর্বক্ষেত্রেই এর সামগ্রিক প্রচলন যতটুকু না প্রভাব বিস্তারের কথা ছিল, তা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি বলেই আমাদের এখনও আদালতের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। বাঙালি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা কী হতে পারে! সংস্কৃতির বিশ্বায়ন এমন এক ভঙ্গুর সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মোড়কে উদীয়মান হয়েছে, যা প্রতিনিয়ত আমাদের ঐতিহ্যকে নষ্টামির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা এখন সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগের ব্যাপারে লড়াই করবো কার সঙ্গে? যে জাতি মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, সে জাতি যে এখনও মাতৃভাষায় শিক্ষাসহ যাবতীয় ক্ষেত্রে মাতৃভাষা ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য সফলতা লাভ করতে পারেনি তার ব্যর্থতার দায়ভার নিতে হবে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ সব সচেতন নাগরিকদের। ঔপনিবেশিক মানসিকতা, অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণী বিভাজন আমাদের শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে ইংরেজির মুখোমুখি করে তুলছে। উপনিবেশিক শক্তি আমাদের ত্যাগ করলেও মনের ভেতরের উপনিবেশ আমাদের গ্রাস করছে ধীরে ধীরে।

স্বাধীন বাংলাদেশের নব্যধণিক ও উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজভূমে পরবাসি এখন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ তাই এখন বাঙালি জাতিসত্তার ঐতিহ্যমন্ডিত দেশে তারা দেখতে পাচ্ছেন না। সন্তানেরা যাতে ইংরেজি মাধ্যমে একটি স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করে, উন্নত দেশে তাল মিলিয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে এ কারণে সবাই ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া অন্য মাধ্যমে শিক্ষ লাভের কথা চিন্তাও করতে পারেন না। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের চিন্তাভাবনাও প্রায় একই রকম। শুধু ব্যাপকসংখ্যক নিম্নবিত্ত এবং অতিসাধারণ মানুষদের জন্য দুটি পথ খোলা আছে। একটি হলো মাদ্রাসা শিক্ষা যেখানে বাংলা হয় আরোপিত না হয় অবহেলায় গৃহীত আর সাধারণের জন্য খোলা আছে বাংলা মাধ্যম।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের চেতনা, শহীদদের আত্মত্যাগের কথা বিবেচনার মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতি মূল্যায়ন করলে আমরা কী বলতে পারব, চেতনাগত দিক দিয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পেরেছি? বাঙালি জাতিসত্তার কী সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটানো গেছে স্বাধীন বাংলাদেশে? সহস্র বছর পূর্ব থেকে বাঙালি জাতি সত্তার উন্মেষিত হচ্ছিল ভাষাকে কেন্দ্র করে। হাজার বছর আগেই চর্যাপদের কবি কি বলেননি ভূষক বাঙালি ভইলি! ভাষাভিত্তিক এই জাতিসত্তা ধর্ম বর্ণ, গোত্র, গোষ্ঠীকে অতিক্রম করেই রূপ নিয়েছিল। তাই দৃপ্তকণ্ঠে কবি আবদুল হাকিম বলেছেন, যেজন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেজন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। মধ্য যুগের এই দূর দৃষ্টিসম্পন্ন কবির মতো আমাদেরও আবার জেগে উঠতে হবে। আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমরা কী আবার জেগে উঠতে পারব?

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

স্নায়ুরোগ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব ও করণীয়

শাসনব্যবস্থা : জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

tab

উপ-সম্পাদকীয়

“বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা”

শেখর ভট্টাচার্য

image

সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২

কবি শামসুর রাহমানের ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। মুক্তিযুদ্ধের দামামা প্রায় বেজে উঠল বলে। কবি নিজ বাস ভূমে অবস্থান করে আশার প্রহর গুনছেন। স্বদেশ তখনো অবরুদ্ধ। অবরুদ্ধ স্বদেশে থেকে কবি নিজ বাস ভূম-সৃষ্টির জন্য আকুল হয়ে আছেন। তার আলোচিত নিজ “নিজ বাসভূমে’ নামক কাব্যগ্রন্থেরই একটি অনিন্দ্য সুন্দর কবিতা “বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা”। পরাধীনতার কবলে স্বদেশ, বর্ণমালাও স্বাধীন নয়। নানা উদ্ভট পরীক্ষা, নিরীক্ষা চলছে বর্ণমালাকে ঘিরে। কখনো উর্দু, কখনো বা রোমান হরফে বাংলা বর্ণমালা লেখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বাঙালির প্রাণভোমরা তার সংস্কৃতির ভেতরে। এ বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয়নি শাসকগোষ্ঠীর। তাই মরিয়া হয়ে আঘাত হানছে শাসকরা বাংলা ভাষা, সাহিত্যে ও সংস্কৃতির ওপর। বাংলা ভাষার যে বর্ণমালা নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকে বাঙালির হৃদয়ে, হয় অনাবিল আলোর উৎস হয়ে কিংবা দিকনির্দেশনা প্রদান করে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনায়নে, সেই বর্ণমালাকে যখন কবি দুঃখিনী বলে আখ্যায়িত করেন, তখন সম্ভবত সেই দুঃখের মাত্রাটি শুধু রাজনৈতিক বাদ-বিসম্বাদেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এই বর্ণমালার সমন্বয়ে যে শব্দ ও বাক্য আমরা উদয়াস্ত নির্মাণ করি, সেই নির্মিতিতেও থেকে যায় অনেকগুলো বিচ্যুতি।

কবি শামসুর রাহমান যখন বর্ণমালাকে নিয়ে ‘খ্যাংরার নোংরামি’ দেখেন, দেখেন ‘খিস্তি খেউড়ের পৌষ মাস’ তখন আমরা দ্রুত সেই ঐতিহাসিক উপলব্ধিতে পৌঁছে যাই, যেখানে পাকিস্তানি শাসকের হাতে আমাদের ভাষা হয়েছে সেভাবে লাঞ্ছিত, যেভাবে হয়েছেন আমাদের বহু নারী। আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তকে কেঁড়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। কেঁড়ে নেয়া না গেলে তাতে ধর্মের প্রলেপ লাগানো হচ্ছে। নজরুলের শ্যামা সংগীত, দেশাত্মবোধক গান, কবিতা আড়ালে রেখে ইসলাম ধর্মীয় হামদ, নাতকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। নজরুলের কবিতার ধর্মীয়করণ করে মহাশ্মশানকে গোরস্তানে রূপান্তরিত করা হচ্ছে।

বায়ান্ন সালে যারা ভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তারা তো বাঙালি সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার চূড়ান্ত ক্ষণে তাই জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উপড়ে ফেলার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী। শামসুর রাহমান তাই বলেন, ‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?/উনিশশো বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী। /সে ফুলের একটি পাঁপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে। /এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,/এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস /তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো/বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা”।

স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য একটি নতুন গতি লাভ করেছে এবং নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা এ ক্ষেত্রে এগিয়েছি অনেকখানি। পরিভাষাগত সীমাবদ্ধতা আমরা কাটাতে চেয়েছি, স্বাধীনতার সেই প্রথম প্রহর থেকেই। হয়তো বাংলা ভাষার ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি ছিল আমাদের সত্তর দশকের গোড়ার দিকে, তার সবটুকু পূরণ সম্ভব হয়নি। কিন্তু ভাষা ব্যবহারে আমাদের অর্জন ও নিতান্ত সামান্য নয়। এত অর্জনের পরও মনে হয়, ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে আমাদের জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, চর্চায় মাতৃভাষার সার্থক ব্যবহার করে জাতিকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র আমাদের প্রচুর দৈনতা রয়ে গেছে।

বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসারে মাতৃভাষার ভূমিকা শুধু ঐতিহ্য বা কৃষ্টিমন্ডিত নয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে এ ভাষার অবদান ব্যাপক। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে দীর্ঘ সংগ্রামের পথপরিক্রমায় ঋদ্ধ প্রাণশক্তিতে পরিপুষ্ট হয়ে মাতৃভাষা বাংলা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শক্ত ভিত হিসেবে উপহৃত। একুশের চেতনায় ভাস্মর মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতিগুলো তথা সংবিধানসম্মত জাতির প্রধান চার আদর্শ-জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে জাতি তাদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করেছে। মাতৃভাষা বাংলাকে প্রায়োগিক অর্থে যথাযথ মূল্যায়ন এবং সর্বত্র এর বিকাশকে অগ্রাধিকার না দিয়ে শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি অথবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে আমাদের তৎপরতা কোনোভাবেই জাতির সামষ্টিক আর্থসামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে সব স্তরে এবং সব জনপদে শিক্ষাকে যদি কার্যকরভাবে জনপ্রিয় করা না যায়, তাহলে শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং এর প্রাসঙ্গিক উন্নয়ন নিয়ামকগুলোর তুলনামূলক প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

মাতৃভাষায় চিন্তা, মতপ্রকাশ এবং সামগ্রিক অর্থে জ্ঞান অর্জনের যে ধারা; সেটি বিশ্বের শীর্ষ উন্নত দেশ যেমন চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মান ইত্যাদির উন্নয়নের সফল ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরিপূর্ণ রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা অভিষিক্ত হলেও এখনো আমরা দেখি যে, সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর ব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশনা চেয়ে ২০১৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে বাংলা ভাষায় একটি রিট আবেদন করা হয়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ বাস্তবায়নে নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, বাংলা ভাষা আইন সর্বত্র অনুসরণ করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এবং ওই আইনের ৪ ধারা অনুসারে প্রয়োজনীয় বিধি জারি করার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না-এ মর্মে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবসহ সাতজনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রুল চাওয়া হয়। ‘একুশ মানে মাথানত না করা’-মাতৃভাষা আন্দোলনের এ বোধ এখনও কতটুকু জোরালোভাবে সঞ্চারিত হচ্ছে, এ রিট আবেদন তারই সাক্ষ্য বহন করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, শিল্পসাহিত্য ইত্যাদির অপরিসীম উন্নয়ন মাতৃভাষা বাংলাকে ঘিরে এবং এর যথাযথ মর্যাদা এবং সর্বক্ষেত্রেই এর সামগ্রিক প্রচলন যতটুকু না প্রভাব বিস্তারের কথা ছিল, তা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি বলেই আমাদের এখনও আদালতের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। বাঙালি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা কী হতে পারে! সংস্কৃতির বিশ্বায়ন এমন এক ভঙ্গুর সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মোড়কে উদীয়মান হয়েছে, যা প্রতিনিয়ত আমাদের ঐতিহ্যকে নষ্টামির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা এখন সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগের ব্যাপারে লড়াই করবো কার সঙ্গে? যে জাতি মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, সে জাতি যে এখনও মাতৃভাষায় শিক্ষাসহ যাবতীয় ক্ষেত্রে মাতৃভাষা ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য সফলতা লাভ করতে পারেনি তার ব্যর্থতার দায়ভার নিতে হবে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ সব সচেতন নাগরিকদের। ঔপনিবেশিক মানসিকতা, অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণী বিভাজন আমাদের শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে ইংরেজির মুখোমুখি করে তুলছে। উপনিবেশিক শক্তি আমাদের ত্যাগ করলেও মনের ভেতরের উপনিবেশ আমাদের গ্রাস করছে ধীরে ধীরে।

স্বাধীন বাংলাদেশের নব্যধণিক ও উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজভূমে পরবাসি এখন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ তাই এখন বাঙালি জাতিসত্তার ঐতিহ্যমন্ডিত দেশে তারা দেখতে পাচ্ছেন না। সন্তানেরা যাতে ইংরেজি মাধ্যমে একটি স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করে, উন্নত দেশে তাল মিলিয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে এ কারণে সবাই ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া অন্য মাধ্যমে শিক্ষ লাভের কথা চিন্তাও করতে পারেন না। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের চিন্তাভাবনাও প্রায় একই রকম। শুধু ব্যাপকসংখ্যক নিম্নবিত্ত এবং অতিসাধারণ মানুষদের জন্য দুটি পথ খোলা আছে। একটি হলো মাদ্রাসা শিক্ষা যেখানে বাংলা হয় আরোপিত না হয় অবহেলায় গৃহীত আর সাধারণের জন্য খোলা আছে বাংলা মাধ্যম।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের চেতনা, শহীদদের আত্মত্যাগের কথা বিবেচনার মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতি মূল্যায়ন করলে আমরা কী বলতে পারব, চেতনাগত দিক দিয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পেরেছি? বাঙালি জাতিসত্তার কী সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটানো গেছে স্বাধীন বাংলাদেশে? সহস্র বছর পূর্ব থেকে বাঙালি জাতি সত্তার উন্মেষিত হচ্ছিল ভাষাকে কেন্দ্র করে। হাজার বছর আগেই চর্যাপদের কবি কি বলেননি ভূষক বাঙালি ভইলি! ভাষাভিত্তিক এই জাতিসত্তা ধর্ম বর্ণ, গোত্র, গোষ্ঠীকে অতিক্রম করেই রূপ নিয়েছিল। তাই দৃপ্তকণ্ঠে কবি আবদুল হাকিম বলেছেন, যেজন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেজন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। মধ্য যুগের এই দূর দৃষ্টিসম্পন্ন কবির মতো আমাদেরও আবার জেগে উঠতে হবে। আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমরা কী আবার জেগে উঠতে পারব?

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top