alt

উপ-সম্পাদকীয়

মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় জৈবসার

এম মনির উদ্দিন

: শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২
image

কৃষিজমির হারানো স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার জন্য জমিতে জৈবসার প্রয়োগের বিকল্প নেই

কৃষি উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের ৮৭২২৩টি গ্রামে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ ১১ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিশ্বে জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম এবং এশিয়ার মধ্যে পঞ্চম। তাই দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কৃষির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৬ শতাংশ এবং মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭ শতাংশ কৃষিনির্ভর। সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে সব কৃষিপণ্যের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও স্থায়িত্ব অর্জনের জন্য কৃষিবান্ধব সরকার প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে।

দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে দেশের কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসয়নিক সার ও পেস্টিসাইড। কৃষিতে বরাদ্দ দেয়া বাজেটের সিংহভাগ ভর্তুকিতে ব্যয় করা হয় এবং মোট ভর্তুকির ৭৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় শুধু রাসায়নিক সার ব্যবস্থাপনায়। এর ফলে দেশের কৃষক কম দামে রাসায়নিক সার কিনতে পারছে। এর প্রভাবে কয়েক বছরের মধ্যে সব ধরনের ফসলের উৎপাদন ৮০-২০০ শতাংশ বেড়েছে।

সকল ধরনের ফসলের স্বাভাবিক জীবনচক্র চালানোর জন্য ১৭টি পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন হয়। যেখানে বিগত কয়েক দশকে দেশের জমিতে মূলত নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম নামে ৩টি সার প্রয়োগ করা হয়েছে। দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা প্রায় ৫০ লাখ টন। এর মধ্যে ইউরিয়া সারের পরিমাণ ২৭ লাখ টন এবং অন্যান্য সার মিলে ২৩ লাখ টন। রাসায়নিক সারে ভর্তুকি প্রদানের ফলে দেশের ৯৮ শতাংশ জমিতে বর্তমানে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়।

ফসল উৎপাদনে অনেকাংশে রাসায়নিক সার ও পেস্টিসাইড ব্যবহারের কারণে একদিকে যেমন কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে সেইসঙ্গে কমে যাচ্ছে জমির উৎপাদনশীলতা; যার অন্যতম প্রধান কারণ মাটির জৈব পদার্থ কমে যাওয়া। এমন প্রেক্ষাপটে জলবায়ুর পরিবর্তন, ফলন হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার বলয় অনেকটাই আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়ছে।

আমাদের কৃষিজমির হারানো স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার জন্য এবং ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে জমিতে জৈবসার প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, ফসলের ফলন কমে যাওয়া, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ভারসাম্যহীন ব্যবহারের বর্তমান অবস্থায় মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করার জন্য জৈবসারের ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়েছে। আদর্শ উর্বর জমিতে মাটির শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা দরকার অথচ আমাদের দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমতে কমতে ২ শতাংশ এমনকি কোথাও কোথাও তা ১ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। জমিতে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য মাটিতে কমপক্ষে ৩ শতাংশ হারে জৈব পদার্থ থাকা দরকার।

টেকসই কৃষির জন্য পরিবেশগত উপাদানগুলোর সুরক্ষা এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য শুধুমাত্র রাসায়নিক সারের ব্যবহারই নয়, জৈব সারের ব্যবহারকেও ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ১৯৬০ এর দশকের পূর্বে কৃষিতে শস্যের বহুমুখিতা ছিল; যার ফলে জমিতে প্রাকৃতিকভাবে জৈব পদার্থ যুক্ত হতো। সেইসঙ্গে কৃষকেরা বিভিন্ন ফসলের চাষে গোবরসহ অন্যান্য আবর্জনাসার প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করতে পারতো এবং এতে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণে ভারসাম্যতা বজায় থাকতো।

বর্তমানে দেশে আবাদি জমি কমে যাওয়া সেইসঙ্গে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করতে জমির ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় জমিতে প্রতিটি ফসল চাষ করতে গিয়ে ইউরিয়া, ফসফেট ও পটাশ প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করতে হচ্ছে। প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের ৬০-৭০ ভাগ পরিবেশে মিশে গিয়ে পরিবেশকে দূষিত করছে। ফসলের ফলন বাড়ানোর জন্য ফসফেট ও পটাশ সারের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকন্তু রাসয়নিক সার একচেটিয়া ব্যবহারের কারণে মাটির উপকারী অনুজীব দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর কারণে গাছ মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে পারছে না- এমনকি সার বেশি পরিমাণে ব্যবহার করেও কাজ করছে না।

মাটিতে প্রয়াজনীয় পরিমাণে জৈব পদার্থ থাকলে মাটির জন্য উপকারী অনুজীবের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায় এবং তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় ১৭টি প্রধান ও গৌন পুষ্টি উপাদানের প্রাপ্যতা বেড়ে যায়। এ বিবেচনায় দেশের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাটি উর্বর ও উৎপাদনক্ষম রাখতে কম্পোস্টিং খুবই প্রয়োজন।

মাটির জৈব পদার্থ কমে যাওয়ায় মাটির স্বাস্থ্য আজ বিপন্ন। বিজ্ঞানীরা গত তিন দশকে মাটির স্বাস্থ্য এবং মানুষের স্বাস্থ্যের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক চিহিৃত করতে সক্ষম হয়েছেন। ফসলের গাছের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক উপাদান পাওয়া গেছে; যা মাটি থেকে সংগ্রহ করে। মানুষ গাছের মাধ্যমে তার দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ৪৮টি পুষ্টি উপাদান খাদ্য থেকে গ্রহণ করে। মানুষের অন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের অনুজীব আছে এবং এ অনুজীবগুলো নির্দিষ্ট ধরনের পুষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এ অনুজীবগুলো যদি সঠিক পুষ্টি না পায় তাহলে মানুষের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে প্রভাব ফেলে এবং নির্দিষ্ট রোগের কারণ হয়। এ কারণে জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করা একটি কার্যকরী পদক্ষেপ।

এক কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহারে ২০ কেজি শস্য উৎপাদন করার কথা; অথচ আমাদের জমিতে এটি মাত্র ৮-১০ কেজি শস্য উৎপাদন করতে পারছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে জমিতে জৈব পদাথের অভাব। মাটিতে জৈব পদার্থ যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-

জৈব পদার্থ মাটির গঠন উন্নত করে, যার ফলে মাটির পানি ও পুষ্টি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

জৈব পদার্থে কার্বন রয়েছে, যা নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়ামের সঙ্গে কার্বন যুক্ত করে অনুজীবের বংশবৃদ্ধি ঘটায় এবং প্রাকৃতিকভাবে জৈবিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের জন্য পুষ্টি সরবরাহ বৃদ্ধি করে।

জৈবসার রাসায়নিক সারের মতো সহজে শেষ হয় না; কারণ এটি মাটির কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত থাকে। ফলে জৈবসার রাসায়নিক সারের তুলনায় মাটির জীববৈচিত্র্য ৩০ শতাংশ বাড়ায়।

জৈবসার ফসলের জন্য ব্যাপকভাবে পুষ্টি সরবরাহ করে; যা কৃষিপণ্যের মান উন্নত করে এবং মাটির বাফারিং ক্ষমতা বাড়ায়।

জৈবসার মাটির গঠন উন্নত করায় আদ্রতা ধারণক্ষমতা বাড়ে এবং ফসলে কম সেচের প্রয়োজন হয়।

দেশে জৈবসার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পর্যাপ্ত আছে কিন্তু সঠিক ব্যবহার না থাকায় এ সমস্ত কাঁচামাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাটিতে ডাম্পিং করা হচ্ছে। দেশের শহরাঞ্চলের বর্জ্য ডাম্পিং করা হচ্ছে, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামারে উৎপাদিত ব্যাপক পরিমাণ বর্জ্য ব্যবহার না থাকায় ডাম্পিং করা হচ্ছে। অথচ এ সমস্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ থাকলে দেশে প্রতি বছর কয়েক লাখ টন জৈবসার উৎপাদন করা সম্ভব। তাছাড়া দেশের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর পাশাপাশি জৈবসার দেশের বাইরে রপ্তানি করারও সুযোগ রয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নেয়া কর্মসূচির ফলে দেশে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করে সীমিত পরিসরে বাজারজাত করছে। ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান জৈবসার উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করেছে এবং বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জৈবসার উৎপাদনের আগ্রহ নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। এখন প্রয়োজন কৃষিবান্ধব সরকারের তথা কৃষি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহযোগিতা। বিগত কয়েক বছরে যেমন সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ বিশেষ করে রাসায়নিক সারে ভর্তুকি ও প্রণোদনার কারণে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন ৮০-২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আগামী দিনেও যাতে কৃষির এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে সেজন্য রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈবসারেও ভর্তুকির ব্যবস্থা করা আবশ্যক।

সম্প্রতি মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন- এ বছর সারের ভর্তুকির জন্য সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের ৩ বছর মেয়াদে কৃষিতে যে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে তার অন্যতম কারণ রাসায়নিক সারে ভর্তুকি ও প্রণোদনা। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মূলে কাজ করছে কৃষির ব্যাপক সাফল্য; আর এ সাফল্যকে ধরে রাখতে অবশ্যই অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেয়া প্রয়োজন। এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, দেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কৃষির অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে হবে। দেশের ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছে কৃষি। তাই কৃষির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরই প্রভাব ফেলবে। তাই সুযোগ্য কৃষিমন্ত্রী আগামী দিনে কৃষি ও কৃষকের সার্বিক কল্যাণে শুধু রাসায়নিক সারই নয়, জৈবসারেও প্রয়োজনীয় ভর্তুকির ব্যবস্থা করে দেশের কৃষিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

[লেখক : এগ্রোনোমিস্ট, উন্নয়ন কর্মী]

ভূমি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী আমূল সংস্কার জরুরি

বরেন্দ্রর মাটিতে আমের বিপ্লব : সম্ভাবনা ও সতর্কবার্তা

অবশেষে ‘হাসিনা’ গ্রেফতার

স্ক্যাবিস সংক্রমণের কারণ ও প্রতিরোধে করণীয়

বাস্তবমুখী বাজেটের প্রত্যাশা : বৈষম্যহীন অর্থনীতির পথে কতটা অগ্রগতি?

কৌশল নয়, এবার প্রযুক্তিতে সৌদি-মার্কিন জোট

সিউল : স্বর্গ নেমেছে ধরায়

নাচোল বিদ্রোহ ও ইলা মিত্র সংগ্রহশালা : সাঁওতাল স্মৃতি কেন উপেক্ষিত?

ছবি

অন্ধকার সত্য, শেষ সত্য নয়!

বিয়েতে মিতব্যয়িতা

এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার কথা

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাহবা, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের ভয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় জৈবসার

এম মনির উদ্দিন

image

কৃষিজমির হারানো স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার জন্য জমিতে জৈবসার প্রয়োগের বিকল্প নেই

শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২

কৃষি উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের ৮৭২২৩টি গ্রামে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ ১১ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিশ্বে জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম এবং এশিয়ার মধ্যে পঞ্চম। তাই দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কৃষির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৬ শতাংশ এবং মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭ শতাংশ কৃষিনির্ভর। সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে সব কৃষিপণ্যের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও স্থায়িত্ব অর্জনের জন্য কৃষিবান্ধব সরকার প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে।

দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে দেশের কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসয়নিক সার ও পেস্টিসাইড। কৃষিতে বরাদ্দ দেয়া বাজেটের সিংহভাগ ভর্তুকিতে ব্যয় করা হয় এবং মোট ভর্তুকির ৭৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় শুধু রাসায়নিক সার ব্যবস্থাপনায়। এর ফলে দেশের কৃষক কম দামে রাসায়নিক সার কিনতে পারছে। এর প্রভাবে কয়েক বছরের মধ্যে সব ধরনের ফসলের উৎপাদন ৮০-২০০ শতাংশ বেড়েছে।

সকল ধরনের ফসলের স্বাভাবিক জীবনচক্র চালানোর জন্য ১৭টি পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন হয়। যেখানে বিগত কয়েক দশকে দেশের জমিতে মূলত নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম নামে ৩টি সার প্রয়োগ করা হয়েছে। দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা প্রায় ৫০ লাখ টন। এর মধ্যে ইউরিয়া সারের পরিমাণ ২৭ লাখ টন এবং অন্যান্য সার মিলে ২৩ লাখ টন। রাসায়নিক সারে ভর্তুকি প্রদানের ফলে দেশের ৯৮ শতাংশ জমিতে বর্তমানে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়।

ফসল উৎপাদনে অনেকাংশে রাসায়নিক সার ও পেস্টিসাইড ব্যবহারের কারণে একদিকে যেমন কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে সেইসঙ্গে কমে যাচ্ছে জমির উৎপাদনশীলতা; যার অন্যতম প্রধান কারণ মাটির জৈব পদার্থ কমে যাওয়া। এমন প্রেক্ষাপটে জলবায়ুর পরিবর্তন, ফলন হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার বলয় অনেকটাই আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়ছে।

আমাদের কৃষিজমির হারানো স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার জন্য এবং ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে জমিতে জৈবসার প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, ফসলের ফলন কমে যাওয়া, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ভারসাম্যহীন ব্যবহারের বর্তমান অবস্থায় মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করার জন্য জৈবসারের ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়েছে। আদর্শ উর্বর জমিতে মাটির শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা দরকার অথচ আমাদের দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমতে কমতে ২ শতাংশ এমনকি কোথাও কোথাও তা ১ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। জমিতে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য মাটিতে কমপক্ষে ৩ শতাংশ হারে জৈব পদার্থ থাকা দরকার।

টেকসই কৃষির জন্য পরিবেশগত উপাদানগুলোর সুরক্ষা এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য শুধুমাত্র রাসায়নিক সারের ব্যবহারই নয়, জৈব সারের ব্যবহারকেও ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ১৯৬০ এর দশকের পূর্বে কৃষিতে শস্যের বহুমুখিতা ছিল; যার ফলে জমিতে প্রাকৃতিকভাবে জৈব পদার্থ যুক্ত হতো। সেইসঙ্গে কৃষকেরা বিভিন্ন ফসলের চাষে গোবরসহ অন্যান্য আবর্জনাসার প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করতে পারতো এবং এতে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণে ভারসাম্যতা বজায় থাকতো।

বর্তমানে দেশে আবাদি জমি কমে যাওয়া সেইসঙ্গে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করতে জমির ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় জমিতে প্রতিটি ফসল চাষ করতে গিয়ে ইউরিয়া, ফসফেট ও পটাশ প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করতে হচ্ছে। প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের ৬০-৭০ ভাগ পরিবেশে মিশে গিয়ে পরিবেশকে দূষিত করছে। ফসলের ফলন বাড়ানোর জন্য ফসফেট ও পটাশ সারের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকন্তু রাসয়নিক সার একচেটিয়া ব্যবহারের কারণে মাটির উপকারী অনুজীব দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর কারণে গাছ মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে পারছে না- এমনকি সার বেশি পরিমাণে ব্যবহার করেও কাজ করছে না।

মাটিতে প্রয়াজনীয় পরিমাণে জৈব পদার্থ থাকলে মাটির জন্য উপকারী অনুজীবের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায় এবং তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় ১৭টি প্রধান ও গৌন পুষ্টি উপাদানের প্রাপ্যতা বেড়ে যায়। এ বিবেচনায় দেশের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাটি উর্বর ও উৎপাদনক্ষম রাখতে কম্পোস্টিং খুবই প্রয়োজন।

মাটির জৈব পদার্থ কমে যাওয়ায় মাটির স্বাস্থ্য আজ বিপন্ন। বিজ্ঞানীরা গত তিন দশকে মাটির স্বাস্থ্য এবং মানুষের স্বাস্থ্যের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক চিহিৃত করতে সক্ষম হয়েছেন। ফসলের গাছের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক উপাদান পাওয়া গেছে; যা মাটি থেকে সংগ্রহ করে। মানুষ গাছের মাধ্যমে তার দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ৪৮টি পুষ্টি উপাদান খাদ্য থেকে গ্রহণ করে। মানুষের অন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের অনুজীব আছে এবং এ অনুজীবগুলো নির্দিষ্ট ধরনের পুষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এ অনুজীবগুলো যদি সঠিক পুষ্টি না পায় তাহলে মানুষের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে প্রভাব ফেলে এবং নির্দিষ্ট রোগের কারণ হয়। এ কারণে জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করা একটি কার্যকরী পদক্ষেপ।

এক কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহারে ২০ কেজি শস্য উৎপাদন করার কথা; অথচ আমাদের জমিতে এটি মাত্র ৮-১০ কেজি শস্য উৎপাদন করতে পারছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে জমিতে জৈব পদাথের অভাব। মাটিতে জৈব পদার্থ যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-

জৈব পদার্থ মাটির গঠন উন্নত করে, যার ফলে মাটির পানি ও পুষ্টি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

জৈব পদার্থে কার্বন রয়েছে, যা নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়ামের সঙ্গে কার্বন যুক্ত করে অনুজীবের বংশবৃদ্ধি ঘটায় এবং প্রাকৃতিকভাবে জৈবিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের জন্য পুষ্টি সরবরাহ বৃদ্ধি করে।

জৈবসার রাসায়নিক সারের মতো সহজে শেষ হয় না; কারণ এটি মাটির কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত থাকে। ফলে জৈবসার রাসায়নিক সারের তুলনায় মাটির জীববৈচিত্র্য ৩০ শতাংশ বাড়ায়।

জৈবসার ফসলের জন্য ব্যাপকভাবে পুষ্টি সরবরাহ করে; যা কৃষিপণ্যের মান উন্নত করে এবং মাটির বাফারিং ক্ষমতা বাড়ায়।

জৈবসার মাটির গঠন উন্নত করায় আদ্রতা ধারণক্ষমতা বাড়ে এবং ফসলে কম সেচের প্রয়োজন হয়।

দেশে জৈবসার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পর্যাপ্ত আছে কিন্তু সঠিক ব্যবহার না থাকায় এ সমস্ত কাঁচামাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাটিতে ডাম্পিং করা হচ্ছে। দেশের শহরাঞ্চলের বর্জ্য ডাম্পিং করা হচ্ছে, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামারে উৎপাদিত ব্যাপক পরিমাণ বর্জ্য ব্যবহার না থাকায় ডাম্পিং করা হচ্ছে। অথচ এ সমস্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ থাকলে দেশে প্রতি বছর কয়েক লাখ টন জৈবসার উৎপাদন করা সম্ভব। তাছাড়া দেশের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর পাশাপাশি জৈবসার দেশের বাইরে রপ্তানি করারও সুযোগ রয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নেয়া কর্মসূচির ফলে দেশে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করে সীমিত পরিসরে বাজারজাত করছে। ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান জৈবসার উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করেছে এবং বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জৈবসার উৎপাদনের আগ্রহ নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। এখন প্রয়োজন কৃষিবান্ধব সরকারের তথা কৃষি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহযোগিতা। বিগত কয়েক বছরে যেমন সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ বিশেষ করে রাসায়নিক সারে ভর্তুকি ও প্রণোদনার কারণে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন ৮০-২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আগামী দিনেও যাতে কৃষির এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে সেজন্য রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈবসারেও ভর্তুকির ব্যবস্থা করা আবশ্যক।

সম্প্রতি মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন- এ বছর সারের ভর্তুকির জন্য সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের ৩ বছর মেয়াদে কৃষিতে যে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে তার অন্যতম কারণ রাসায়নিক সারে ভর্তুকি ও প্রণোদনা। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মূলে কাজ করছে কৃষির ব্যাপক সাফল্য; আর এ সাফল্যকে ধরে রাখতে অবশ্যই অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেয়া প্রয়োজন। এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, দেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কৃষির অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে হবে। দেশের ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছে কৃষি। তাই কৃষির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরই প্রভাব ফেলবে। তাই সুযোগ্য কৃষিমন্ত্রী আগামী দিনে কৃষি ও কৃষকের সার্বিক কল্যাণে শুধু রাসায়নিক সারই নয়, জৈবসারেও প্রয়োজনীয় ভর্তুকির ব্যবস্থা করে দেশের কৃষিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

[লেখক : এগ্রোনোমিস্ট, উন্নয়ন কর্মী]

back to top