আহমদ রফিক
ভাষাসংগ্রামী, কবি ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক। তরুণ বয়সে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। কবিতা, প্রবন্ধ ও রাজনৈতিক লেখালেখি মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা প্রচুর। তাঁর সাহিত্যকর্মের সিংহভাগ জায়গায় স্থান করে নিয়েছে ভাষা আন্দোলন। এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সংবাদ-এর পক্ষে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন ওবায়েদ আকাশ
সংবাদ: আপনারা একটি স্বপ্ন নিয়ে ভাষা আন্দোলন করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পর আপনাদের সেই স্বপ্ন কতোটা পূরণ হয়েছে?
আহমদ রফিক: আমাদের স্বপ্ন সম্পূর্ণ পূরণ হয়নি। আমরা যে চারটি মূল দাবি নিয়ে ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলাম, সেই দাবিগুলো হলো- ১. রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ২. রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, ৩. সর্বস্তরে বাংলা চালু করো এবং ৪. শহীদ স্মৃতি অমর হোক। আমাদের সেই দাবি আজো পূরণ হয়নি। আংশিকমাত্র পূরণ হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলা স্বীকৃতি পেয়েছে একটিমাত্র বাক্যে। এ বাক্যটি হলো- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।
সংবাদ: কেন বলছেন পূরণ হয়নি?
আ. র.: আমাদের রাষ্ট্রভাষা যেহেতু বাংলা, আমাদের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হওয়া উচিত। কিন্তু উচ্চশিক্ষা, উচ্চ আদালতসহ সর্বত্র বাংলার ব্যবহার এখনো নিশ্চিত হয়নি। ঔপনিবেশিক রাজভাষা ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং ইংরেজি ইনস্টিটিউশন, বেসরকারি পর্যায়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে সারা দেশ, বিশেষ করে সারা ঢাকাসহ প্রধান শহরগুলো ভরে গেছে। এটাকে আমি মনে করি সংবিধানের লংঘন। সংবিধান লংঘন করে এটা চলছে। এক্ষেত্রে এটা প্রমাণিত যে, আমাদের ভাষা আন্দোলনের একটা বড় দাবি পূরণ হলো না।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৬ খন্ডে ইতিহাস ও দলিলপত্র প্রকাশিত হলো, কিন্তু যে ভাষা আন্দোলনকে একাত্তরের সূতিকাগার বলা হয়, সেই আন্দোলনের জন্য এক খন্ড দলিলপত্র বা ইতিহাস রচিত হলো না। আজ সত্তর ৭০ বছর পরে হাইকোর্ট বলছে, ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা তৈরি করতে। এত দীর্ঘ সময় পরে কি কোনো নিদর্শন থাকে? এটা কি সম্ভব? এখন তালিকা তৈরি করতে গেলে তো একটি ভুল তালিকা তৈরি হবে। একটি নির্ভুল তালিকা তৈরি করার জন্য কাজটি অনেক আগেই শুরা করা দরকার ছিল। এখন এই ঢাকা শহরেই কয়জন ভাষা সংগ্রামী বেঁচে আছেন? এই বছরই তো গুরুত্বপূর্ণ তিনচার জন ভাষাসংগ্রামী মারা গেলেন। মুক্তিযোদ্ধার যেমন তালিকা করা হয়েছে, তেমনি ভাষা সংগ্রামীর তালিকা করাও সময়ের দাবি। একুশের ভাষা আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, একেবারে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত, এই প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা এতোদিন পরে কীভাবে তৈরি করা সম্ভব? গ্রামের মানুষ তো অনেকেই তার কোনো নিদর্শন রাখেনি। অনেকেই অনেক আগে মারা গেছেন। এখন কি আর কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারবেন কারা কারা ভাষা সংগ্রাম করেছিল? এ ধরনের ঘাটতিগুলো আমাদের দাবিগুলোকে খর্ব করেছে। এখন আর তা পূরণ হচ্ছে না। আমরা মহান একুশে বলি। এই একুশের ভাষা আন্দোলনের চেতনা রক্ষা একটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। ভাষার মাসে বাংলা একাডেমিতে বক্তৃতামালা, গানবাজনা, আর বইমেলা। এগুলোরও দরকার আছে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের নানান শাখা নিয়ে যদি গবেষণা না হয়, তাহলে বাংলা ভাষা ক্রমেই ইংরেজি ও বিদেশি ভাষার সামনে উপেক্ষিত ও অবহেলিত হবে। নির্ভুল বাংলা না বলা, ইংরেজি মিক্সড করে কথা বলা- এগুলো তার প্রমাণ।
উচ্চ আদালতের আর একটা কথা বলি, উচ্চ আদালতে যখন গ্রাম থেকে লোকজন আসে, তার উকিল ও বিচারক ইংরেজিতে কথা বলে। কিন্তু বিচারপ্রার্থী লোকজন তা বুঝতে পারে না। এতে কি তার নাগরিক অধিকার খর্ব হচ্ছে না? উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হলেই কেবল নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
সংবাদ: আমরা একুশকে বলি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার- একটু ব্যাখ্যা করবেন?
আ. র.: একুশের আন্দোলনের যে রাজনৈতিক চতেনা, জাতীয়তাবাদী চেতনা, সেটার ভিত্তিতেই, ষাটের দশকে আওয়ামী লীগের ছয় দফা, যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা, ছাত্রদের এগারো দফা, আর ভাসানীর চৌদ্দ দফা দাবি উত্থাপিত হলো। এগুলো একই প্রাদেশিক সায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন। এবং এটার সবশেষ পরিণতি হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। যেটা ছিল একটা অসাম্প্রদাযিক মুক্তিযুদ্ধ। এবং সেখানে শ্রেণি চেতনারও কোনো আলাদা প্রাধান্য ছিল না। সাধারাণ মানুষ থেকে শ্রমিক কৃষক পর্যন্ত যোগ দিয়েছিল। এটা ছিল সর্বজনীন একটি আন্দোলন। যার ভিত্তিতে একটা মানচিত্র, একটি পতাকা, একটি স্বাধীন দেশ পেলাম। এটাকে আমরা বলি ভাষিক জাতিরাষ্ট্র। সংবিধানের ভাষায় বলতে হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
সংবাদ: জাতীয় জীবনে ভাষার গুরুত্ব এবং তা সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে কী ধরনের সমস্যা দেখা দেয়?
আ. র.: একটা কথা বলা প্রয়োজন, যে কোনো জাতিরাষ্ট্রের মাতৃভাষা, তার রাষ্ট্রভাষা হলো জাতীয় ভাষা ও জীবিকার ভাষা। জীবকিার ভাষাটি গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, তরুণরা তাদের উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে তাদের ক্যারিয়ার গঠন করবে তো নিজস্ব ভাষায়ই। সেই ভাষা যদি নিজস্ব না হয়ে হয় অন্য কোনো ভাষা, তাহলে সেখানে স্ববিরোধিতা তৈরি হয়। আমরা সেই স্ববিরোধিতায় ভুগছি।
সংবাদ: মুক্তির উপায় কী?
আ. র.: স্বপ্ন পূরণের জন্য, এত মহিমান্বিত একটি ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছিল তরুণরা। তারুণ্যের আন্দোলনের সঙ্গে কোনো সার্থের প্রশ্ন থাকে না। তখন আদর্শের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দেয়া যায়। তরুণরাই আন্দোলনগুলোকে সফল করে তোলে। এই তরুণরা যদি অনুভব করে যে, ভাষা আন্দোলনের দাবিগুরো পূরণ হয়নি, আমাদেরকে তা পূরণ করতে হবে। তারা যদি তাদের ক্যারিয়ার রক্ষা করে যদি এই দাবি পূরণের জন্য সংগ্রাম শুরু করে, তাহলেই শুধুমাত্র একুশের দাবিগুলো পূরণ হবে।
সংবাদ: বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনি কি শঙ্কিত?
আ. র.: আজ আমি শঙ্কিত এজন্য যে, বাংলা উপেক্ষিত হচ্ছে। শুধু সাহিত্য ছাড়া আর কোথাও পূর্ণাঙ্গ বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে না। নানাভাবে বাংলা ভাষা পিছিয়ে পড়ছে। এটা ভাষা সংগ্রামী হিসেবে শুধু আমার নয়, ভাষা-সচেতন সবারই শঙ্কিত হবার কারণ।
সমাজ জীবন, ব্যক্তিজীবন থেকে মাতৃভাষার চর্চা পিছিয়ে পড়ছে, শুধুমাত্র সাহিত্যই বাংলা ভাষার কদর করছে। শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, সমষ্টিগত জীবন বাংলা ভাষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে।
আর একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, ইংরেজির সামনে আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগি। মাথা উঁচু করে বাংলা ভাষায় কথা বলার মতো সাহস আমাদের সকলের নেই। এভাবে আমরা নিজেরাই আমাদের মাতৃভাষাকে অবহেলা করি, উপেক্ষা করে দূরে ঠেলে দিই।
আহমদ রফিক
রোববার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১
ভাষাসংগ্রামী, কবি ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক। তরুণ বয়সে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। কবিতা, প্রবন্ধ ও রাজনৈতিক লেখালেখি মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা প্রচুর। তাঁর সাহিত্যকর্মের সিংহভাগ জায়গায় স্থান করে নিয়েছে ভাষা আন্দোলন। এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সংবাদ-এর পক্ষে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন ওবায়েদ আকাশ
সংবাদ: আপনারা একটি স্বপ্ন নিয়ে ভাষা আন্দোলন করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পর আপনাদের সেই স্বপ্ন কতোটা পূরণ হয়েছে?
আহমদ রফিক: আমাদের স্বপ্ন সম্পূর্ণ পূরণ হয়নি। আমরা যে চারটি মূল দাবি নিয়ে ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলাম, সেই দাবিগুলো হলো- ১. রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ২. রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, ৩. সর্বস্তরে বাংলা চালু করো এবং ৪. শহীদ স্মৃতি অমর হোক। আমাদের সেই দাবি আজো পূরণ হয়নি। আংশিকমাত্র পূরণ হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলা স্বীকৃতি পেয়েছে একটিমাত্র বাক্যে। এ বাক্যটি হলো- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।
সংবাদ: কেন বলছেন পূরণ হয়নি?
আ. র.: আমাদের রাষ্ট্রভাষা যেহেতু বাংলা, আমাদের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হওয়া উচিত। কিন্তু উচ্চশিক্ষা, উচ্চ আদালতসহ সর্বত্র বাংলার ব্যবহার এখনো নিশ্চিত হয়নি। ঔপনিবেশিক রাজভাষা ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং ইংরেজি ইনস্টিটিউশন, বেসরকারি পর্যায়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে সারা দেশ, বিশেষ করে সারা ঢাকাসহ প্রধান শহরগুলো ভরে গেছে। এটাকে আমি মনে করি সংবিধানের লংঘন। সংবিধান লংঘন করে এটা চলছে। এক্ষেত্রে এটা প্রমাণিত যে, আমাদের ভাষা আন্দোলনের একটা বড় দাবি পূরণ হলো না।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৬ খন্ডে ইতিহাস ও দলিলপত্র প্রকাশিত হলো, কিন্তু যে ভাষা আন্দোলনকে একাত্তরের সূতিকাগার বলা হয়, সেই আন্দোলনের জন্য এক খন্ড দলিলপত্র বা ইতিহাস রচিত হলো না। আজ সত্তর ৭০ বছর পরে হাইকোর্ট বলছে, ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা তৈরি করতে। এত দীর্ঘ সময় পরে কি কোনো নিদর্শন থাকে? এটা কি সম্ভব? এখন তালিকা তৈরি করতে গেলে তো একটি ভুল তালিকা তৈরি হবে। একটি নির্ভুল তালিকা তৈরি করার জন্য কাজটি অনেক আগেই শুরা করা দরকার ছিল। এখন এই ঢাকা শহরেই কয়জন ভাষা সংগ্রামী বেঁচে আছেন? এই বছরই তো গুরুত্বপূর্ণ তিনচার জন ভাষাসংগ্রামী মারা গেলেন। মুক্তিযোদ্ধার যেমন তালিকা করা হয়েছে, তেমনি ভাষা সংগ্রামীর তালিকা করাও সময়ের দাবি। একুশের ভাষা আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, একেবারে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত, এই প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা এতোদিন পরে কীভাবে তৈরি করা সম্ভব? গ্রামের মানুষ তো অনেকেই তার কোনো নিদর্শন রাখেনি। অনেকেই অনেক আগে মারা গেছেন। এখন কি আর কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারবেন কারা কারা ভাষা সংগ্রাম করেছিল? এ ধরনের ঘাটতিগুলো আমাদের দাবিগুলোকে খর্ব করেছে। এখন আর তা পূরণ হচ্ছে না। আমরা মহান একুশে বলি। এই একুশের ভাষা আন্দোলনের চেতনা রক্ষা একটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। ভাষার মাসে বাংলা একাডেমিতে বক্তৃতামালা, গানবাজনা, আর বইমেলা। এগুলোরও দরকার আছে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের নানান শাখা নিয়ে যদি গবেষণা না হয়, তাহলে বাংলা ভাষা ক্রমেই ইংরেজি ও বিদেশি ভাষার সামনে উপেক্ষিত ও অবহেলিত হবে। নির্ভুল বাংলা না বলা, ইংরেজি মিক্সড করে কথা বলা- এগুলো তার প্রমাণ।
উচ্চ আদালতের আর একটা কথা বলি, উচ্চ আদালতে যখন গ্রাম থেকে লোকজন আসে, তার উকিল ও বিচারক ইংরেজিতে কথা বলে। কিন্তু বিচারপ্রার্থী লোকজন তা বুঝতে পারে না। এতে কি তার নাগরিক অধিকার খর্ব হচ্ছে না? উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হলেই কেবল নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
সংবাদ: আমরা একুশকে বলি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার- একটু ব্যাখ্যা করবেন?
আ. র.: একুশের আন্দোলনের যে রাজনৈতিক চতেনা, জাতীয়তাবাদী চেতনা, সেটার ভিত্তিতেই, ষাটের দশকে আওয়ামী লীগের ছয় দফা, যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা, ছাত্রদের এগারো দফা, আর ভাসানীর চৌদ্দ দফা দাবি উত্থাপিত হলো। এগুলো একই প্রাদেশিক সায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন। এবং এটার সবশেষ পরিণতি হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। যেটা ছিল একটা অসাম্প্রদাযিক মুক্তিযুদ্ধ। এবং সেখানে শ্রেণি চেতনারও কোনো আলাদা প্রাধান্য ছিল না। সাধারাণ মানুষ থেকে শ্রমিক কৃষক পর্যন্ত যোগ দিয়েছিল। এটা ছিল সর্বজনীন একটি আন্দোলন। যার ভিত্তিতে একটা মানচিত্র, একটি পতাকা, একটি স্বাধীন দেশ পেলাম। এটাকে আমরা বলি ভাষিক জাতিরাষ্ট্র। সংবিধানের ভাষায় বলতে হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
সংবাদ: জাতীয় জীবনে ভাষার গুরুত্ব এবং তা সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে কী ধরনের সমস্যা দেখা দেয়?
আ. র.: একটা কথা বলা প্রয়োজন, যে কোনো জাতিরাষ্ট্রের মাতৃভাষা, তার রাষ্ট্রভাষা হলো জাতীয় ভাষা ও জীবিকার ভাষা। জীবকিার ভাষাটি গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, তরুণরা তাদের উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে তাদের ক্যারিয়ার গঠন করবে তো নিজস্ব ভাষায়ই। সেই ভাষা যদি নিজস্ব না হয়ে হয় অন্য কোনো ভাষা, তাহলে সেখানে স্ববিরোধিতা তৈরি হয়। আমরা সেই স্ববিরোধিতায় ভুগছি।
সংবাদ: মুক্তির উপায় কী?
আ. র.: স্বপ্ন পূরণের জন্য, এত মহিমান্বিত একটি ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছিল তরুণরা। তারুণ্যের আন্দোলনের সঙ্গে কোনো সার্থের প্রশ্ন থাকে না। তখন আদর্শের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দেয়া যায়। তরুণরাই আন্দোলনগুলোকে সফল করে তোলে। এই তরুণরা যদি অনুভব করে যে, ভাষা আন্দোলনের দাবিগুরো পূরণ হয়নি, আমাদেরকে তা পূরণ করতে হবে। তারা যদি তাদের ক্যারিয়ার রক্ষা করে যদি এই দাবি পূরণের জন্য সংগ্রাম শুরু করে, তাহলেই শুধুমাত্র একুশের দাবিগুলো পূরণ হবে।
সংবাদ: বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনি কি শঙ্কিত?
আ. র.: আজ আমি শঙ্কিত এজন্য যে, বাংলা উপেক্ষিত হচ্ছে। শুধু সাহিত্য ছাড়া আর কোথাও পূর্ণাঙ্গ বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে না। নানাভাবে বাংলা ভাষা পিছিয়ে পড়ছে। এটা ভাষা সংগ্রামী হিসেবে শুধু আমার নয়, ভাষা-সচেতন সবারই শঙ্কিত হবার কারণ।
সমাজ জীবন, ব্যক্তিজীবন থেকে মাতৃভাষার চর্চা পিছিয়ে পড়ছে, শুধুমাত্র সাহিত্যই বাংলা ভাষার কদর করছে। শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, সমষ্টিগত জীবন বাংলা ভাষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে।
আর একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, ইংরেজির সামনে আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগি। মাথা উঁচু করে বাংলা ভাষায় কথা বলার মতো সাহস আমাদের সকলের নেই। এভাবে আমরা নিজেরাই আমাদের মাতৃভাষাকে অবহেলা করি, উপেক্ষা করে দূরে ঠেলে দিই।