সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন বাংলা সাহিত্য পঠন-পাঠনের জন্য কোনো স্বতন্ত্র বিভাগ ছিল না। সংস্কৃত ও বাংলা নিয়ে ছিল একটি বিভাগ। এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলাকে স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা পেতে সময় লেগেছে। ব্যাপারটা যে খুব অস্বাভাবিক তা বলা যাবে না, ইংল্যান্ডেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পঠনীয় হতে ইংরেজি সাহিত্যকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে প্রাচীনের কদর আছে, নবীনের নেই, সমসাময়িকের তো থাকারই কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারটা তো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে। এবং এখানে সর্বস্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান চলবে, এটাই তো ছিল প্রত্যাশিত। কেবল প্রত্যাশিত বলি কেন, সেটাই তো হওয়ার কথা ছিল স্বাভাবিক। তাছাড়া বাঙালির সংখ্যা তো কম নয়। পৃথিবীব্যাপী হিসেব করলে দেখা যাবে বাঙালির সংখ্যা পঁচিশ কোটির কম হবে না। এত মানুষের মাতৃভাষা যেখানে বাংলা এবং যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেছে, সেখানে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা কেন মাধ্যম হবে না। চ্যালেঞ্জ? অবশ্যই মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ তো বটেই। কিন্তু দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাজার হাজার নৃশংস সদস্যকে বিতাড়ন করাটাও তো খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জই ছিল বৈকি। সেই প্রায় অসম্ভবকে তো আমরা সম্ভব করেছি। তাহলে? সর্বস্তরে বাংলা ভাষার এই চ্যালেঞ্জটা আমরা নিচ্ছি না কেন? নিচ্ছি না এই জন্য যে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমরা পরিচালিত ছিলাম যে সমষ্টিগত স্বপ্নের তাড়নায় সেই স্বপ্নটা আজ আর নেই। আজ আমরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত হয়ে পড়েছি এবং সন্দেহ কী যে ব্যক্তিগত সাফল্যের জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রচলিত যে ব্যবস্থা রয়েছে, অর্থাৎ মোটামুটি ইংরেজি মাধ্যমের ব্যবস্থা, সেটাকে গ্রহণ করাই ভালো। তদুপরি ব্যবস্থাটা তো বদলাচ্ছে না। আর বদলাচ্ছে না যেহেতু, তাই সেখানে মাথা না কুটে যা পাওয়া যাচ্ছে তার সদ্ব্যবহার করাটা যে ভালো, এ সত্যকে তো সত্য বলে মানতেই হবে।
বাংলাদেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু এদের মধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাটাই বেশি। এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলার জন্য স্বতন্ত্র কোনো বিভাগ নেই বললেই চলে। অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ১৯২১ সালে যেমনটা ছিল তার তুলনায়ও শোচনীয়। কিন্তু যদি স্বতন্ত্র বিভাগ থাকত তাহলেই বা অবস্থাটাকে আশাব্যঞ্জক বলা যেত কি? মোটেই না। হিসাবটা সোজা, কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যদি জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা সাহিত্যে পাঠদানের জন্য আলাদা একটা বিভাগ খুলে বসত তাহলে পরিণতিটা কেমন দাঁড়াত, সেটা অনুমান করা দুঃসাধ্য নয়। যদিও বাস্তবতাটা দুঃখজনক ঠেকে বৈকি। একেবারে নিশ্চিত কণ্ঠেই বলা যায় যে, বাংলা সাহিত্যে পড়ার জন্য একজনও পড়–য়া পাওয়া যেত না। যার দরুন বিভাগের পাততাড়ি অচিরেই গুটিয়ে ফেলতে হতো। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা এমনকি পদার্থবিজ্ঞান পড়তেও যায় না, তারা যায় বিবিএ ও কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে; লাখ লাখ টাকা পানিতে ফেলে তারা বাংলা সাহিত্যের মতো একটা অকার্যকর বিষয় পড়তে যাবে কোন দুর্বুদ্ধিতে, শুনি?
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা না হয় বাদই থাক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে শিক্ষা অতটা দুর্মূল্য নয়, সেখানেইবা বাংলা পড়ার জন্য কতজন আগ্রহ দেখায়। এখন নয়, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের ঘটনা মনে পড়ে। ভর্তি কমিটি একজন ছাত্রীকে বাংলায় ভালো নম্বর পেয়েছে দেখে বাংলা বিভাগে ভর্তির কথা বলেছিল, শুনে মেয়েটি কথা নেই বার্তা নেই, সবার সামনে সশব্দে কেঁদে ফেলেছিল। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল যে, প্রস্তাবটি তার কাছে নিতান্তই অপমানকর ঠেকেছে; কেননা বাংলা সাহিত্যে সে তো ঘরে বসেই পড়ে নিতে পারে, তার জন্য আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হবে কেন? এ ঘটনাকে ব্যতিক্রম বলা ঠিক হবে না; তথাকথিত ভালো ছেলেমেয়েরা পারতপক্ষে বাংলায় ভর্তি হতে চায় না।
অথচ এমনকি পাকিস্তান আমলেও এমনটা ছিল না। তখন অনেক মেধাবান ব্যক্তি বাংলা পড়েছেন এবং কালে যশস্বী হয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী প্রথমে ইংরেজি পড়াতেন, পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দরুন কারাবন্দি অবস্থায় বাংলায় এমএ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বাংলা বিভাগে চলে যান। কিন্তু তাই বলে আজও যে বাংলায় পাস করা ছাত্রছাত্রীরা সামাজিকভাবে উচ্চসম্মান পেতেন, এমন নয়। মুনীর চৌধুরীর নিজের মুখে শোনা একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। এক বিয়ে বাড়িতে ভদ্র মহিলারা নিজের স্বামীদের বিষয়ে আলাপ করছিলেন, মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের লিলি ভাবীর স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন শুনে মহিলারা কেউ প্রথমে একটু নড়ে-চড়ে বসেছিলেন, কিন্তু কোন বিষয় পড়ান সেই প্রশ্নের জবাবে ভাবী যখন জানালেন বাংলা তখন তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেরে বলেছেন, ‘বাংলা, তাই বলুন।’ নিতান্ত আত্মরক্ষার দায়ে তখন ভাবীকে বলতে হয়েছিল যে, একসময় তার স্বামী ইংরেজি বিভাগেই অধ্যাপনা করতেন। কিন্তু সেটা তো ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক দুঃসময়ের ঘটনা, এখন তো পরিস্থিতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটার কথা। কিন্তু ঘটেনি; বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটেছে।
না, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু করার কথা আমরা বলছি না, তবে সেখানে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে এক শ’ নম্বরের বাংলা পাঠদানের ব্যবস্থা থাকা জরুরি বলে মনে করি। তাতে করে শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। বাংলা ভাষার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন না হয়ে কিছুটা হলেও বাংলা চর্চা করলে শিক্ষার্থীরা যুক্ত থাকতে পারবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে এবং সেই সঙ্গে সমাজের সঙ্গেও। বিচ্ছিন্নতা আজকে সমাজে একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা সর্বত্র উৎসাহিত হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় খুব ভালো একটা কাজ করবে যদি দায়িত্ব নেয় বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে তরুণদের সাহায্য করতে। শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে একদিন কথা হচ্ছিল তাঁর আর্ট কলেজে ছাত্রভর্তি নিয়ে। যারা আগে থেকেই ছবি আঁকা কিছুটা শিখে এসেছে তাদের অগ্রাধিকার দেন কি-না এ প্রশ্নের জবাবে শিল্পী তাঁর অতি প্রসন্ন হাসিটি দিয়ে বলেছিলেন, যারা কিছু শিখে আসে তাদের নিয়েই বরং বিপদ হয়। দায়িত্ব পড়ে যেটুকু শিখে এসেছে আগে সেটা ভুলিয়ে তবে কাজ করার। ফাঁকা জমি বরং ভালো, আগাছার চেয়ে, তিনি জানিয়েছিলেন। বিদ্যালয়ের কাঁধে ওই দায়িত্বটা সবসময়ই থাকে, দায়িত্ব থাকে বাড়ি থেকে ছেলেমেয়েরা উল্টোপাল্টা যা শিখে আসে সেটা ভুলিয়ে তবে নতুন জ্ঞানের কর্ষণ শুরু করার। সমাজ ও গৃহ এখন মহোৎসাহে বিচ্ছিন্নতা শেখাচ্ছে এবং মানুষকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে রাখছে, বিদ্যালয়ের পক্ষে তাই সংলগ্ন হওয়ার শিক্ষাদান একটি প্রাথমিক কর্তব্য বটে।
আর সংলগ্ন হওয়ার শিক্ষাদানের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে মাতৃভাষার চর্চা। সর্বস্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান যে দরকার এটা তো সর্বজনস্বীকৃত। শিক্ষাকে সর্বজনীন করা, তাকে সমাজ ও পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত রাখার ব্যাপারটা তো রয়েছেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মাতৃভাষার মাধ্যমে যে শিক্ষা লাভ করা যায় সেটা হয় স্বাভাবিক, চলে যায় গভীরে, অংশ হয়ে যায় সত্তার। আর সর্বজনীন শিক্ষার কথা তো ভাবাই সম্ভব নয় মাতৃভাষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করে। ভাষা সেখানে মাধ্যম থাকে না, পরিণত হয়ে শিক্ষাতেই। শিক্ষা যে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে- এ বিষয়ে দ্বিমত নেই; কিন্তু মাতৃভাষা পারে অন্তত ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারটাতে একটা সমতল প্রতিষ্ঠা করতে।
এ রকম কথা বলা হয় যে, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করলে আমরা প্রাদেশিক হয়ে যাব এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। কথাটা সত্য নয়। বিশ্বে যেসব অগ্রসর জাতি রয়েছে তারা কেউই মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে অন্যের ভাষায় বিদ্যা চর্চা করে না, অথচ তাদের প্রাদেশিক বা জগৎ বিচ্ছিন্ন বলার কোনো উপায়ই নেই। বললেও তা নিতান্ত হাস্যকর শোনাবে। আসল সত্যটা হলো ওইসব জাতি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত, তাই তাদের অতটা সম্মান, উন্নতি ও সম্মান লাভ কিছুতেই সম্ভব হতো না, যদি তারা মাতৃভাষাকে ত্যাগ করে অন্যভাষার আশ্রয়প্রার্থী হতো। অন্যভাষার দ্বারস্থ হওয়া স্বাধীনতার চিহ্ন নয়, অধীনতার চিহ্ন বটে। আমরা যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছি না সেটা প্রমাণ করে যে, এখনো আমরা পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারিনি, পরাধীনই রয়ে গেছি এবং আমাদের ক্ষমতা নেই যে নিজের পায়ে দাঁড়াব। নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে অন্যকে আশ্রয় করে চলার চেষ্টা খঞ্জের সাজে, সুস্থ মানুষের জন্য ওটি নিতান্তই অশোভন। অশোভনইবা বলব কেন, ওটি তো সামর্থ্য না থাকারই প্রমাণ। মাতৃভাষাকে ত্যাগ করে অবশ্যই ভীষণভাবে গ্রাম্য হয়ে যাচ্ছি আমরা, আন্তর্জাতিক না হয়ে। আন্তর্জাতিকতার প্রথম কথাটাই হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানো; যে পরগাছা তার আবার আন্তর্জাতিকতা কী, সে তো ঝড়ের মুখে উপড়ে পড়বে এবং উড়ে যাবে খড়কুটোর মতো।
মাতৃভাষার যে প্রচলন চাই সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু কাজটা কীভাবে করা যাবে, বড় প্রশ্ন তো সেটাই। করতে হলে প্রথমে যা দরকার সেটা হলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, বলা যায় অঙ্গীকার। এটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পুরোপুরি ছিল; কিন্তু এখন নেই। ওই অঙ্গীকারটিকে ফেরত আনা চাই। কিন্তু আনা যাবে কী করে? এও তো সেই নটে গাছের কাহিনী। হ্যাঁ, আসল কারণ এই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত রয়েছে তারা ওই অঙ্গীকার ভুলে গেছে। ভোলার প্রধান কারণ তারা মনে করে, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি চালু রাখলে তাদের বিদেশমুখো ছেলেমেয়েদের খুব সুবিধা হবে, দ্বিতীয় কারণ, সেটাকে প্রধানও বলা চলে, তাদের ভেতর দেশপ্রেমের নিদারুণ অভাব দেখা দিয়েছে। মাতৃভাষার ব্যবহার না করতে পারাটা প্রমাণ করে যে, মুক্ত হব কী, আমরা এখন পর্যন্ত স্বাধীনই হইনি। বিশ্ব পুঁজিবাদ যে আমাদের ওপর প্রভুত্ব করছে তাতে যেমন প্রমাণ হয় যে আমরা স্বাধীন নই, মাতৃভাষার অপ্রচলনও কিন্তু সেই একই সংবাদ ঘোষণা করছে, ভিন্নভাবে যদিও। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা- সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা চাই এবং সেই স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে বিকল্প দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা, যে শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের কাছে নিয়ে আসবে। রাষ্ট্র তখন জনগণের হবে এবং জনগণের মাতৃভাষাতে শিক্ষাসহ সব কাজ সম্পন্ন হবে।
এ কাজটা কারা করবেন? করতে হবে দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীদের। তারা শুরু করবেন, শেষ করবেন জনগণ। বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বৈপ্লবিক ঐক্য গড়ে উঠবে, যে ঐক্য নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিকশিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের হাতে ফেরত দেবে। কিন্তু এটা তো সময়সাপেক্ষ কাজ। ইতিমধ্যে কী করা যাবে এবং করতে হবে?
করতে হবে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ। এখানেও বুদ্ধিজীবীদেও দায়িত্বটাই হবে প্রধান। অন্যসব কাজের মধ্যে একটি হবে বই লেখা। জ্ঞানের বই এবং বিজ্ঞানের বই চাই, যেমন চাই সাহিত্যের বই। সাহিত্যের বইয়েও দরকার হবে দার্শনিকতা ও ইতিহাস চেতনার। যাতে পৃথিবীটাকে জানতে ও বুঝতে সুবিধা হয়। বই নানা রকমের হয়। কোন বইয়ের কী বিষয় তাও জানা দরকার। অনুবাদ চাই, অন্য ভাষার বই যেমন বাংলায় অনুবাদ হবে, তেমনি বাংলা বইও অনূদিত হবে বিভিন্ন ভাষায়। এই আদান-প্রদানে আমাদের মাতৃভাষা ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।
দরকার হবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। কেবল হালকা বইয়ের নয়, গভীর বইয়েরও। সে জন্য একটি গ্রন্থাগার আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এর জন্য কেন্দ্রীয় উদ্যোগ না হলেও চলবে। স্থানীয় উদ্যোগই যথেষ্ট। পাড়ায়-মহল্লায় যে শিক্ষিত ব্যক্তিরা আছেন তারাই পারেন স্থানীয়ভাবে গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জেলা পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের অধীনে যেসব ভবন আছে সেখানে গ্রন্থাগারের জন্য জায়গা চাওয়া যেতে পারে। উদ্বুদ্ধ হলেও ব্যক্তিও ছেড়ে দিতে পারেন বাড়ির বাড়তি কোনো ঘর। গ্রন্থাগারকে ভ্রাম্যমাণ হিসেবে বিবেচনা করার উপায় নেই, তাকে অবশ্যই হতে হবে স্থানীয় ও যতটা সম্ভব স্থায়ী। প্রত্যেকটি শিক্ষায়তনে যে গ্রন্থাগার থাকবে সেটা তো বলাই বাহুল্য। গ্রন্থাগার বিশেষভাবে আকর্ষণ করবে কিশোর-কিশোরীদের, বই যাদের সবচেয়ে উপকারী বন্ধুতে পরিণত হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বই সংগ্রহ করা কঠিন, সংগৃহীত বই সংরক্ষণ করাটাও সহজ নয়- এ ব্যাপারে গ্রন্থাগারের যে ভূমিকা তার কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু কেবল বই কেন, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বহুবিধ আয়োজন প্রয়োজন। গান, নাটক, আবৃত্তি, প্রদর্শনী, খেলাধুলা, পত্রিকা প্রকাশ, দেয়াল পত্রিকা তৈরি করা- সব কিছুই চলবে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই উদ্দেশ্যহীন হবে না। পেছনে থাকবে একটি আদর্শ, সেটা হলো দেশপ্রেম ও গণতান্ত্রিকতা তৈরি করা। যাতে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটতে পারে।
রাজনীতিকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে আসছি। রাজনীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনীতি তো গভীর হবে না, যদি না তার অভ্যন্তরে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে। সমাজে আমরা পরিবর্তন চাই, তার জন্যও দরকার সাংস্কৃতিক কাজ। যারা নতুন সমাজ ও পরিবর্তিত রাষ্ট্র গড়তে চান, প্রতিষ্ঠা করতে চান যথার্থ গণতন্ত্র সংস্কৃতিকে তারা কোনোমতেই উপেক্ষা করবেন না। চাই কি প্রতি বছর একটি সাংস্কৃতিক, লংমার্চেও আয়োজন করা যেতে পারে। যাতে অংশগ্রহণ করে সংস্কৃতিকর্মীরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হবেন, আদান-প্রদান করবেন অভিজ্ঞতার, উদ্বুদ্ধ করবেন এবং উদ্বুদ্ধ হবেন এবং সমৃদ্ধ হবেন বিভিন্নভাবে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবজাগরণের জন্য এ ধরনের একটি কর্মসূচির উপযোগিতা রয়েছে। আমরা রেনেসাঁর কথা শুনেছি, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে তেমন একটি ঘটনা ঘটেছিল বলে দাবি করা হয়। তা কিছু একটা অবশ্যই ঘটেছিল; কিন্তু সেটা যথার্থ রেনেসাঁ নয়। পরাধীন দেশে এবং জনগণকে বাইরে রেখে রেনেসাঁ এটা সম্ভব নয় এবং সেটা ঘটেওনি।
কিন্তু ঘটা দরকার। একটি সাংস্কৃতিক মহাজাগরণের জন্য প্রতীক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ। মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাদানের যে প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করলাম সেটি আসবে ওই মহাজাগরণের পথ ধরে এবং তাকে সম্ভব করে তোলার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে।
সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ আমাদের প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি হওয়া দরকার। এটি একটি মস্ত চ্যালেঞ্জ অবশ্যই, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ জয়ের চেয়ে কম নয়, সহজও নয়; কিন্তু এ যুদ্ধেও আমাদের অবশ্যই জয়ী হতে হবে, যদি আমরা মুক্তি চাই। আসলে এ ক্ষেত্রে পরাজয়ের কোনো স্থান বা সুযোগ নেই, যেমন ছিল না একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। প্রকৃতপক্ষে এটা তো আমাদের অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধেরই পরবর্তী পদক্ষেপ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
রোববার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন বাংলা সাহিত্য পঠন-পাঠনের জন্য কোনো স্বতন্ত্র বিভাগ ছিল না। সংস্কৃত ও বাংলা নিয়ে ছিল একটি বিভাগ। এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলাকে স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা পেতে সময় লেগেছে। ব্যাপারটা যে খুব অস্বাভাবিক তা বলা যাবে না, ইংল্যান্ডেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পঠনীয় হতে ইংরেজি সাহিত্যকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে প্রাচীনের কদর আছে, নবীনের নেই, সমসাময়িকের তো থাকারই কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারটা তো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে। এবং এখানে সর্বস্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান চলবে, এটাই তো ছিল প্রত্যাশিত। কেবল প্রত্যাশিত বলি কেন, সেটাই তো হওয়ার কথা ছিল স্বাভাবিক। তাছাড়া বাঙালির সংখ্যা তো কম নয়। পৃথিবীব্যাপী হিসেব করলে দেখা যাবে বাঙালির সংখ্যা পঁচিশ কোটির কম হবে না। এত মানুষের মাতৃভাষা যেখানে বাংলা এবং যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেছে, সেখানে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা কেন মাধ্যম হবে না। চ্যালেঞ্জ? অবশ্যই মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ তো বটেই। কিন্তু দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাজার হাজার নৃশংস সদস্যকে বিতাড়ন করাটাও তো খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জই ছিল বৈকি। সেই প্রায় অসম্ভবকে তো আমরা সম্ভব করেছি। তাহলে? সর্বস্তরে বাংলা ভাষার এই চ্যালেঞ্জটা আমরা নিচ্ছি না কেন? নিচ্ছি না এই জন্য যে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমরা পরিচালিত ছিলাম যে সমষ্টিগত স্বপ্নের তাড়নায় সেই স্বপ্নটা আজ আর নেই। আজ আমরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত হয়ে পড়েছি এবং সন্দেহ কী যে ব্যক্তিগত সাফল্যের জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রচলিত যে ব্যবস্থা রয়েছে, অর্থাৎ মোটামুটি ইংরেজি মাধ্যমের ব্যবস্থা, সেটাকে গ্রহণ করাই ভালো। তদুপরি ব্যবস্থাটা তো বদলাচ্ছে না। আর বদলাচ্ছে না যেহেতু, তাই সেখানে মাথা না কুটে যা পাওয়া যাচ্ছে তার সদ্ব্যবহার করাটা যে ভালো, এ সত্যকে তো সত্য বলে মানতেই হবে।
বাংলাদেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু এদের মধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাটাই বেশি। এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলার জন্য স্বতন্ত্র কোনো বিভাগ নেই বললেই চলে। অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ১৯২১ সালে যেমনটা ছিল তার তুলনায়ও শোচনীয়। কিন্তু যদি স্বতন্ত্র বিভাগ থাকত তাহলেই বা অবস্থাটাকে আশাব্যঞ্জক বলা যেত কি? মোটেই না। হিসাবটা সোজা, কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যদি জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা সাহিত্যে পাঠদানের জন্য আলাদা একটা বিভাগ খুলে বসত তাহলে পরিণতিটা কেমন দাঁড়াত, সেটা অনুমান করা দুঃসাধ্য নয়। যদিও বাস্তবতাটা দুঃখজনক ঠেকে বৈকি। একেবারে নিশ্চিত কণ্ঠেই বলা যায় যে, বাংলা সাহিত্যে পড়ার জন্য একজনও পড়–য়া পাওয়া যেত না। যার দরুন বিভাগের পাততাড়ি অচিরেই গুটিয়ে ফেলতে হতো। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা এমনকি পদার্থবিজ্ঞান পড়তেও যায় না, তারা যায় বিবিএ ও কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে; লাখ লাখ টাকা পানিতে ফেলে তারা বাংলা সাহিত্যের মতো একটা অকার্যকর বিষয় পড়তে যাবে কোন দুর্বুদ্ধিতে, শুনি?
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা না হয় বাদই থাক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে শিক্ষা অতটা দুর্মূল্য নয়, সেখানেইবা বাংলা পড়ার জন্য কতজন আগ্রহ দেখায়। এখন নয়, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের ঘটনা মনে পড়ে। ভর্তি কমিটি একজন ছাত্রীকে বাংলায় ভালো নম্বর পেয়েছে দেখে বাংলা বিভাগে ভর্তির কথা বলেছিল, শুনে মেয়েটি কথা নেই বার্তা নেই, সবার সামনে সশব্দে কেঁদে ফেলেছিল। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল যে, প্রস্তাবটি তার কাছে নিতান্তই অপমানকর ঠেকেছে; কেননা বাংলা সাহিত্যে সে তো ঘরে বসেই পড়ে নিতে পারে, তার জন্য আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হবে কেন? এ ঘটনাকে ব্যতিক্রম বলা ঠিক হবে না; তথাকথিত ভালো ছেলেমেয়েরা পারতপক্ষে বাংলায় ভর্তি হতে চায় না।
অথচ এমনকি পাকিস্তান আমলেও এমনটা ছিল না। তখন অনেক মেধাবান ব্যক্তি বাংলা পড়েছেন এবং কালে যশস্বী হয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী প্রথমে ইংরেজি পড়াতেন, পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দরুন কারাবন্দি অবস্থায় বাংলায় এমএ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বাংলা বিভাগে চলে যান। কিন্তু তাই বলে আজও যে বাংলায় পাস করা ছাত্রছাত্রীরা সামাজিকভাবে উচ্চসম্মান পেতেন, এমন নয়। মুনীর চৌধুরীর নিজের মুখে শোনা একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। এক বিয়ে বাড়িতে ভদ্র মহিলারা নিজের স্বামীদের বিষয়ে আলাপ করছিলেন, মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের লিলি ভাবীর স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন শুনে মহিলারা কেউ প্রথমে একটু নড়ে-চড়ে বসেছিলেন, কিন্তু কোন বিষয় পড়ান সেই প্রশ্নের জবাবে ভাবী যখন জানালেন বাংলা তখন তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেরে বলেছেন, ‘বাংলা, তাই বলুন।’ নিতান্ত আত্মরক্ষার দায়ে তখন ভাবীকে বলতে হয়েছিল যে, একসময় তার স্বামী ইংরেজি বিভাগেই অধ্যাপনা করতেন। কিন্তু সেটা তো ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক দুঃসময়ের ঘটনা, এখন তো পরিস্থিতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটার কথা। কিন্তু ঘটেনি; বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটেছে।
না, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু করার কথা আমরা বলছি না, তবে সেখানে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে এক শ’ নম্বরের বাংলা পাঠদানের ব্যবস্থা থাকা জরুরি বলে মনে করি। তাতে করে শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। বাংলা ভাষার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন না হয়ে কিছুটা হলেও বাংলা চর্চা করলে শিক্ষার্থীরা যুক্ত থাকতে পারবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে এবং সেই সঙ্গে সমাজের সঙ্গেও। বিচ্ছিন্নতা আজকে সমাজে একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা সর্বত্র উৎসাহিত হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় খুব ভালো একটা কাজ করবে যদি দায়িত্ব নেয় বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে তরুণদের সাহায্য করতে। শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে একদিন কথা হচ্ছিল তাঁর আর্ট কলেজে ছাত্রভর্তি নিয়ে। যারা আগে থেকেই ছবি আঁকা কিছুটা শিখে এসেছে তাদের অগ্রাধিকার দেন কি-না এ প্রশ্নের জবাবে শিল্পী তাঁর অতি প্রসন্ন হাসিটি দিয়ে বলেছিলেন, যারা কিছু শিখে আসে তাদের নিয়েই বরং বিপদ হয়। দায়িত্ব পড়ে যেটুকু শিখে এসেছে আগে সেটা ভুলিয়ে তবে কাজ করার। ফাঁকা জমি বরং ভালো, আগাছার চেয়ে, তিনি জানিয়েছিলেন। বিদ্যালয়ের কাঁধে ওই দায়িত্বটা সবসময়ই থাকে, দায়িত্ব থাকে বাড়ি থেকে ছেলেমেয়েরা উল্টোপাল্টা যা শিখে আসে সেটা ভুলিয়ে তবে নতুন জ্ঞানের কর্ষণ শুরু করার। সমাজ ও গৃহ এখন মহোৎসাহে বিচ্ছিন্নতা শেখাচ্ছে এবং মানুষকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে রাখছে, বিদ্যালয়ের পক্ষে তাই সংলগ্ন হওয়ার শিক্ষাদান একটি প্রাথমিক কর্তব্য বটে।
আর সংলগ্ন হওয়ার শিক্ষাদানের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে মাতৃভাষার চর্চা। সর্বস্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান যে দরকার এটা তো সর্বজনস্বীকৃত। শিক্ষাকে সর্বজনীন করা, তাকে সমাজ ও পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত রাখার ব্যাপারটা তো রয়েছেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মাতৃভাষার মাধ্যমে যে শিক্ষা লাভ করা যায় সেটা হয় স্বাভাবিক, চলে যায় গভীরে, অংশ হয়ে যায় সত্তার। আর সর্বজনীন শিক্ষার কথা তো ভাবাই সম্ভব নয় মাতৃভাষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করে। ভাষা সেখানে মাধ্যম থাকে না, পরিণত হয়ে শিক্ষাতেই। শিক্ষা যে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে- এ বিষয়ে দ্বিমত নেই; কিন্তু মাতৃভাষা পারে অন্তত ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারটাতে একটা সমতল প্রতিষ্ঠা করতে।
এ রকম কথা বলা হয় যে, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করলে আমরা প্রাদেশিক হয়ে যাব এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। কথাটা সত্য নয়। বিশ্বে যেসব অগ্রসর জাতি রয়েছে তারা কেউই মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে অন্যের ভাষায় বিদ্যা চর্চা করে না, অথচ তাদের প্রাদেশিক বা জগৎ বিচ্ছিন্ন বলার কোনো উপায়ই নেই। বললেও তা নিতান্ত হাস্যকর শোনাবে। আসল সত্যটা হলো ওইসব জাতি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত, তাই তাদের অতটা সম্মান, উন্নতি ও সম্মান লাভ কিছুতেই সম্ভব হতো না, যদি তারা মাতৃভাষাকে ত্যাগ করে অন্যভাষার আশ্রয়প্রার্থী হতো। অন্যভাষার দ্বারস্থ হওয়া স্বাধীনতার চিহ্ন নয়, অধীনতার চিহ্ন বটে। আমরা যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছি না সেটা প্রমাণ করে যে, এখনো আমরা পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারিনি, পরাধীনই রয়ে গেছি এবং আমাদের ক্ষমতা নেই যে নিজের পায়ে দাঁড়াব। নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে অন্যকে আশ্রয় করে চলার চেষ্টা খঞ্জের সাজে, সুস্থ মানুষের জন্য ওটি নিতান্তই অশোভন। অশোভনইবা বলব কেন, ওটি তো সামর্থ্য না থাকারই প্রমাণ। মাতৃভাষাকে ত্যাগ করে অবশ্যই ভীষণভাবে গ্রাম্য হয়ে যাচ্ছি আমরা, আন্তর্জাতিক না হয়ে। আন্তর্জাতিকতার প্রথম কথাটাই হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানো; যে পরগাছা তার আবার আন্তর্জাতিকতা কী, সে তো ঝড়ের মুখে উপড়ে পড়বে এবং উড়ে যাবে খড়কুটোর মতো।
মাতৃভাষার যে প্রচলন চাই সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু কাজটা কীভাবে করা যাবে, বড় প্রশ্ন তো সেটাই। করতে হলে প্রথমে যা দরকার সেটা হলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, বলা যায় অঙ্গীকার। এটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পুরোপুরি ছিল; কিন্তু এখন নেই। ওই অঙ্গীকারটিকে ফেরত আনা চাই। কিন্তু আনা যাবে কী করে? এও তো সেই নটে গাছের কাহিনী। হ্যাঁ, আসল কারণ এই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত রয়েছে তারা ওই অঙ্গীকার ভুলে গেছে। ভোলার প্রধান কারণ তারা মনে করে, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি চালু রাখলে তাদের বিদেশমুখো ছেলেমেয়েদের খুব সুবিধা হবে, দ্বিতীয় কারণ, সেটাকে প্রধানও বলা চলে, তাদের ভেতর দেশপ্রেমের নিদারুণ অভাব দেখা দিয়েছে। মাতৃভাষার ব্যবহার না করতে পারাটা প্রমাণ করে যে, মুক্ত হব কী, আমরা এখন পর্যন্ত স্বাধীনই হইনি। বিশ্ব পুঁজিবাদ যে আমাদের ওপর প্রভুত্ব করছে তাতে যেমন প্রমাণ হয় যে আমরা স্বাধীন নই, মাতৃভাষার অপ্রচলনও কিন্তু সেই একই সংবাদ ঘোষণা করছে, ভিন্নভাবে যদিও। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা- সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা চাই এবং সেই স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে বিকল্প দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা, যে শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের কাছে নিয়ে আসবে। রাষ্ট্র তখন জনগণের হবে এবং জনগণের মাতৃভাষাতে শিক্ষাসহ সব কাজ সম্পন্ন হবে।
এ কাজটা কারা করবেন? করতে হবে দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীদের। তারা শুরু করবেন, শেষ করবেন জনগণ। বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বৈপ্লবিক ঐক্য গড়ে উঠবে, যে ঐক্য নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিকশিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের হাতে ফেরত দেবে। কিন্তু এটা তো সময়সাপেক্ষ কাজ। ইতিমধ্যে কী করা যাবে এবং করতে হবে?
করতে হবে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ। এখানেও বুদ্ধিজীবীদেও দায়িত্বটাই হবে প্রধান। অন্যসব কাজের মধ্যে একটি হবে বই লেখা। জ্ঞানের বই এবং বিজ্ঞানের বই চাই, যেমন চাই সাহিত্যের বই। সাহিত্যের বইয়েও দরকার হবে দার্শনিকতা ও ইতিহাস চেতনার। যাতে পৃথিবীটাকে জানতে ও বুঝতে সুবিধা হয়। বই নানা রকমের হয়। কোন বইয়ের কী বিষয় তাও জানা দরকার। অনুবাদ চাই, অন্য ভাষার বই যেমন বাংলায় অনুবাদ হবে, তেমনি বাংলা বইও অনূদিত হবে বিভিন্ন ভাষায়। এই আদান-প্রদানে আমাদের মাতৃভাষা ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।
দরকার হবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। কেবল হালকা বইয়ের নয়, গভীর বইয়েরও। সে জন্য একটি গ্রন্থাগার আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এর জন্য কেন্দ্রীয় উদ্যোগ না হলেও চলবে। স্থানীয় উদ্যোগই যথেষ্ট। পাড়ায়-মহল্লায় যে শিক্ষিত ব্যক্তিরা আছেন তারাই পারেন স্থানীয়ভাবে গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জেলা পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের অধীনে যেসব ভবন আছে সেখানে গ্রন্থাগারের জন্য জায়গা চাওয়া যেতে পারে। উদ্বুদ্ধ হলেও ব্যক্তিও ছেড়ে দিতে পারেন বাড়ির বাড়তি কোনো ঘর। গ্রন্থাগারকে ভ্রাম্যমাণ হিসেবে বিবেচনা করার উপায় নেই, তাকে অবশ্যই হতে হবে স্থানীয় ও যতটা সম্ভব স্থায়ী। প্রত্যেকটি শিক্ষায়তনে যে গ্রন্থাগার থাকবে সেটা তো বলাই বাহুল্য। গ্রন্থাগার বিশেষভাবে আকর্ষণ করবে কিশোর-কিশোরীদের, বই যাদের সবচেয়ে উপকারী বন্ধুতে পরিণত হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বই সংগ্রহ করা কঠিন, সংগৃহীত বই সংরক্ষণ করাটাও সহজ নয়- এ ব্যাপারে গ্রন্থাগারের যে ভূমিকা তার কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু কেবল বই কেন, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বহুবিধ আয়োজন প্রয়োজন। গান, নাটক, আবৃত্তি, প্রদর্শনী, খেলাধুলা, পত্রিকা প্রকাশ, দেয়াল পত্রিকা তৈরি করা- সব কিছুই চলবে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই উদ্দেশ্যহীন হবে না। পেছনে থাকবে একটি আদর্শ, সেটা হলো দেশপ্রেম ও গণতান্ত্রিকতা তৈরি করা। যাতে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটতে পারে।
রাজনীতিকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে আসছি। রাজনীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনীতি তো গভীর হবে না, যদি না তার অভ্যন্তরে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে। সমাজে আমরা পরিবর্তন চাই, তার জন্যও দরকার সাংস্কৃতিক কাজ। যারা নতুন সমাজ ও পরিবর্তিত রাষ্ট্র গড়তে চান, প্রতিষ্ঠা করতে চান যথার্থ গণতন্ত্র সংস্কৃতিকে তারা কোনোমতেই উপেক্ষা করবেন না। চাই কি প্রতি বছর একটি সাংস্কৃতিক, লংমার্চেও আয়োজন করা যেতে পারে। যাতে অংশগ্রহণ করে সংস্কৃতিকর্মীরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হবেন, আদান-প্রদান করবেন অভিজ্ঞতার, উদ্বুদ্ধ করবেন এবং উদ্বুদ্ধ হবেন এবং সমৃদ্ধ হবেন বিভিন্নভাবে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবজাগরণের জন্য এ ধরনের একটি কর্মসূচির উপযোগিতা রয়েছে। আমরা রেনেসাঁর কথা শুনেছি, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে তেমন একটি ঘটনা ঘটেছিল বলে দাবি করা হয়। তা কিছু একটা অবশ্যই ঘটেছিল; কিন্তু সেটা যথার্থ রেনেসাঁ নয়। পরাধীন দেশে এবং জনগণকে বাইরে রেখে রেনেসাঁ এটা সম্ভব নয় এবং সেটা ঘটেওনি।
কিন্তু ঘটা দরকার। একটি সাংস্কৃতিক মহাজাগরণের জন্য প্রতীক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ। মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাদানের যে প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করলাম সেটি আসবে ওই মহাজাগরণের পথ ধরে এবং তাকে সম্ভব করে তোলার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে।
সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ আমাদের প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি হওয়া দরকার। এটি একটি মস্ত চ্যালেঞ্জ অবশ্যই, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ জয়ের চেয়ে কম নয়, সহজও নয়; কিন্তু এ যুদ্ধেও আমাদের অবশ্যই জয়ী হতে হবে, যদি আমরা মুক্তি চাই। আসলে এ ক্ষেত্রে পরাজয়ের কোনো স্থান বা সুযোগ নেই, যেমন ছিল না একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। প্রকৃতপক্ষে এটা তো আমাদের অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধেরই পরবর্তী পদক্ষেপ।