alt

সাময়িকী

মৃৎচক্রের দিনগুলো

: শুক্রবার, ০২ এপ্রিল ২০২১

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

খুব গম্ভীর মুখে হাঁড়িগুলো নৌকোতে লোড করছে হরিশ কুমার। বেপরোয়া বাতাস বড্ড জ্বালা দিচ্ছে। খানিক বাদে বাদেই গাঙে ঢেউ উঠিয়ে নৌকোটাকে উতলা করে তুলছে। নায়ের গলুইয়ের উপর বসে আখ চিবোচ্ছে হরিশের পুত্র নরেন কুমার। চোখ পড়তেই খেকিয়ে উঠলো হরিশ। আখ ভালো কইরা চাবাইন্না দেহাইয়া দিমু। হাট শুরু হতে বেশি দেরি নেই আর উনি আউখ চাবাইতাছে। হাত লাগা হারামি। অর্ধ খাওয়া আখটাকে ধুতির কোচে গুঁজে নিয়ে নৌকোতে হাঁড়ি কলসি লোডে বাবার সাথে হাত লাগায় নরেন। রামকৃষ্ণপুর থেকে কালকিনী হাট মাইল পাঁচেক দূরে। নানা গ্রাম থেকে প্রতি বুধবার বেপারিরা তাদের বাণিজ্যিক পসরা সাজিয়ে বসেন। হরিশ বাবুর বসার জন্য একটা নির্ধারিত জায়গা রয়েছে। হাটের শেষ মাথায় একটা বটগাছ আছে। বটগাছের নিচে মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিল, বাসনকোসন, গনেশ ঠাকুর, লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ছোট পুতুল, মাটির ফল, ব্যাংক নানা রকমের খেলনার পসরা সাজিয়ে বসে। হামিদা আর তার বোন শাহিদা প্রতি বুধবার বাবার সাথে হাটে আসে কাচা মরিচ, টমেটো, বেগুনসহ ক্ষেতের নানা তরিতরকারি বিক্রি করতে। বেঁচাকেনা শেষ হলে ঠোঙায় ভরে আমৃত্তি, বাতাসা এসব কিনেন। সাদা সাদা বাতাসার টুকরিতে চোখ পড়লেই ওদের মনে হতো যেন অনেকগুলো বুনো সাদাফুল টুকরিতে ভরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হামিদার মা সুখীবিবি মুড়ি ভাজার হাঁড়িতে নারিকেলের শলা দিয়ে বালুগুলো নাড়েনচাড়েন আর নানা লোকছড়া কাটেন- ইটকিরি বিটকিরি রবির দানা, রবির বউ কারি, চিকন চাউল ঝাড়ি, ঝাড়তে ঝাড়তে ফুরায় না, চিকন চাইলে মানায়না, হাপলা হাপলা হাপের বাপ, মুড়ি ফোট খাপের খাপ। এরপরই খুব চমৎকারভাবে পপকর্ণের মতো হাঁড়ির ভেতর মুড়ির দানাগুলো খিলখিল করে হেসে উঠতো যেন। মোটা চালের লাল মুড়ির সাথে কুটকুট করে সর্ষেক্ষেতের ভিতরে দু’বোন মিলে মুড়ি চিবোয়, দৌড়ায়, আর কাকতাড়–য়ার মাথার হাঁড়ি ফাটিয়ে পালিয়ে চলে আসে বাড়িতে।

গেল বছর কুমোর বাড়িতে পুজোর আগে মা দুর্গার হাত নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছিল হামিদার ছোটবোন শাহিদা। এরপর কুমোরপাড়ার বুড়ো সাধুর দাবাড় খেয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। তাই হাটে এলে খেলনা কেনার অনেক শখ থাকলেও গত বছরের পাপকর্মের কথা মাথায় রেখে আর ও দোকানের পাশ মাড়ায় না। কিন্তু শাহিদার অনেক ইচ্ছা হয় মাটির পুতুল কিনতে। জামাই বউয়ের একটা পুতুল দেখা যাচ্ছে। জামাই বউ খেলার জন্য অনেক দিন থেকে বাবাকে একটা জামাই বউ পুতুল কেনার কথা বলে আসছে শাহিদা। কিন্তু বাবা পুতুলটুতুল খুব একটা পছন্দ করেন না। পুতুলের কথা বললে বাবা বলেন- আম্মা তুমি এই যে পুতুল কিনতে চাও, এইসব মাটির পুতুল দিয়া খেলা হারাম, নবীজির নিষেধ। তাই অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাটির পুতুল আর কেনা হয়ে ওঠে না। হরিশ বাবুর ছেলে নরেনকে চিনেন শাহিদা। ওর পাঠশালার বন্ধু। নরেন শাহিদাকে বলেছে পুতুল বানানো শিখাবে। তাই মাঝে মাঝেই লুকিয়ে লুকিয়ে নরেনদের বাড়ি যেত শাহিদা পুতুল বানানো শিখতে। কিন্তু নরেনের বাবা হরিশ কুমার গোড়া লোক মুসলমানদের আনাগোনা পছন্দ করেন না। কোনকিছুতে মুসলমানদের হাত পড়লে রাম রাম করে পানি ছিটিয়ে সেটি পবিত্র করতে থাকেন। এ কাণ্ড দেখে শাহিদা আর হামিদা মিটিমিটি করে হাসেন।

গাঁয়ের পাঠশালা বন্ধ তাই এখন ফুলটাইম বাবাকে সময় দিচ্ছেন নরেন। শুনেছে ঢাকা শহরে নাকি গণ্ডগোল বেঁধেছে। হাটের মানুষদের ভিতরেও কেমন যেন একটা গম্ভীর ভাব। এই প্রাণচঞ্চল কালকিনীর হাটে সবসময় মানুষের মুখে একটা হাসি লেগে থাকতো। বেপারিরা বেচাকেনা শেষ করে চায়ের দোকানে আড্ডা দিত। দোতরায় গানে টান দিত অবিনাশ বাউল। কিন্তু গেল একমাস থেকেই যেন মানুষের মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি। মানুষ চায়ের দোকানে বসে এখন আর গান শোনে না। রেডিওতে কান পেতে বাংলাদেশ বেতারের খবর শোনেন। ভুট্টো, ইয়াহিয়া, টিক্কা খান এই নামগুলো মানুষের মুখে শোনা যায়। জটলা দেখলেই জটলা ভেঙে দিচ্ছে গ্রাম্য মাতবর আছমত আলী। কোন কাম নাই তোমাগো ভাগো, যাও বাড়ি যাও। তারপর জটলা ভেঙে যে যার বাড়িতে চলে যায়। আছমত আলী মুখে পান গুঁজে দিয়ে বলে এই হাটে কোন দলবাজি চলবো না। বাঁচতে চাইলে আমি যেইভাবে কমু সেইভাবে ব্যবসাপাতি করবা। হাটের চান্দা ভাবতাছি আগামি হপ্তা থিকা বাড়াইয়া দিমু। এই অঞ্চলে মেহমানরা আসবো। বিদেশী মেহমান আল্লাহর নেক বান্দারা, পাকিস্তানের ফেরেস্তারা আসবো আমাগো গঞ্জে। তাগো খেদমত করা আমাগো ঈমানী দায়িত্ব। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বড় জোব্বা, আলখেল্লা পরা ছাগলা দাড়িওয়া কিছু লোক। এই দেখ আরবি ভাষায় আমার কাছে চিঠি আইছে। আছমত আলীর ছেলে হাসেম আলী বাবার কানে কানে বলে- আব্বা এইডা আরবি ভাষা না উর্দু। ছেলেকে ধমক দিয়ে বলে দূরে যা হারামখোর। আমারে অক্ষর চিনাস। হাসেম আলী বাবার এইসব কর্মকাণ্ড পছন্দ করে না। গাঁয়ের মানুষকে বোকা বানাচ্ছে আছমত। উর্দুকে আরবি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। জনাবিশেক ছাগলা দাড়িওয়ালা আধা বয়স্ক লোক আর কয়েকজন চাঁদাবাজ যুবকদের নিয়ে আছমত আলী গড়ে তোলেন শান্তি কমিটি। কিন্তু চিন্তার বিষয় আছমত আলীর ছেলে হাসেমের কাণ্ডকারখানা ভালো ঠেকছে না আছমতের। ওর চালচলন সন্দেহজনক।

কানে রেডিও লাগিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনছেন মোছলেম বেপারি। তার পাশে এসে বসে হামিদা আর শাহিদা। বাবো রেডিওতে কী হোনেন। মোছলেমের চোখেমুখে আতঙ্ক। মেয়েদের কাছে টেনে নিয়ে বলেন, মা দেশের পরিস্থিতি ভালো না। ঢাহা শহরে গণ্ডগোল লাগছে।

আছমত আলী বলেন- হুজুর উধার মে, মেরে সাথ আও। বড় জিপ আর ভ্যানে ভরে গেছে গাও। ওরে কেডা কোম্মে আছো মেলেটারি আইছে এই বলে আর্তচিৎকার করে উঠলেন হরিশ বাবুর বৌ রাধা। সবাই যে যার মতো ছুটতে লাগলেন

মানুষ মারতাছে পাখির মতো গুলি কইরা। ওরা বিভিন্ন গেরামেও হানা দিতাছে। মানুষ মারতাছে, ঘর, গোলা, পুড়াইতাছে। আমরা কই যামু বাবো- ওরা কী আমাগো গেরামেও আইবো? মোছলেম মেয়েদের সাহস দিয়ে বলে, আইতে পারে আবার নাও আইতে পারে। কারণ আমাগো গেরামের ভিতর দিয়ো আইতে হইলে জঙ্গল পাড়ি হইতে হইবো। তারপর গাঙ, খাল, পাটক্ষেত এতো কিছু পার হইয়া ওরা এদিকে আইতে পারবো না। তোমরা অন্য গেরামে যাইয়ো না কিন্তু। বাড়ি ছাইড়া কোনো জায়গায় যাইবা না। হাট বাজার বন্ধ। আমি নাও লইয়া গাঙে যাইমু কাইল। একটা মালের চালান আইবো ডাক পড়ছে।

গভীর রাতে মোসলেম মেয়েদের ঘুমে রেখে নাও নিয়ে বের হয়ে যায়। চারদিকে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। নাও গাঙ দিয়ে যেতে যেতে একটা খালের ভিতরে ঢোকে। খালের পাশ দিয়ে বিস্তৃত আখ ক্ষেত আর পাট ক্ষেতের সমাহার। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বৃষ্টি নামতে পারে। মোছলেম খুব ধীরে ধীরে নাও বেয়ে যাচ্ছে। একটা খেতের ভিতর থেকে শিষ বেজে ওঠে। মোসলেম শিষ শুনে নৌকোটা পাটক্ষেতের ভিতরে প্রবেশ করায়। আছমত আলীর ছেলে হাসেম। তার মাথায় গামছা বাঁধা। হাতে একটা বস্তা সে বস্তাটা মোছলেমের হাতে দিয়ে বলে মোসলেম ভাই এই বস্তাটা লুকাইয়া রাখবা। আমরা দুই একদিনের মধ্যেই গেরামে আইতাছি। মোসলেম বস্তাটা নাওয়ের পাঠাতনের ভিতরে লুকিয়ে রাখে। কালকিনী বাজারে শান্তি কমিটির অফিস খুলেছে আছমত আলী। তাই বাজারের সামনে দিয়ে নাও নিয়ে সাবধানে যেতে হবে।

মোছলেম নাও নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। বাজারের কাছে আসতেই আছমত আলীর চেলাদের হাকডাক। ওই কেডা যায় এত রাইতে নাও লইয়া। নাও ভিড়াও চেক করমু। মোছলেম কোনো কথা বলে না নায়ে জোরে জোরে বৈঠা মারতে থাকতে। থামো কইতাছি, গুলি ছুড়মু কিন্তু। মোসলেম পাটাতন উঠিয়ে বস্তাটা নিয়ে গাঙের মধ্যে লাফ দেয়। শান্তি কমিটির পবিত্র সেনারা গুলি ছুড়তে থাকে। মোছলেম পাতিহাঁসের মতো ডুব দিয়ে অনেক দূরে গিয়ে ওঠে। নৌকাটা ঝাঁঝড়া করে ফেলা হয়েছে গুলি করে। আছমত আলী পরদিন সকালে তার চেলাচামুন্ডাদের নিয়ে জরুরি মিটিংয়ে বসে। নায়ের ভিতর থেকে বস্তা নিয়ে নদীতে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাওয়া বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেন না তিনি। হেড কোয়ার্টারে এই খবর পৌঁছালে তাকে আস্ত রাখবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুই চার গ্রামে সার্চ করবেন বাড়ি বাড়ি। কোন বাড়িতে বস্তাটা লুকানো আছে। আর কার নৌকা খোয়া গেছে সেটা চেক করলেই বেরিয়ে পড়বে আসল শত্রু কে? বাড়ি বাড়ি চিরুনি অভিযান চালানো হচ্ছে। নোমোকান্দির কুমাড় বাড়ি থেকে শুরু করে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত সব গ্রাম চষে ফেলা হয়েছে। কিন্তু বস্তা খুঁজে পাওয়া গেলো না। মোছলেমের বাড়িতে মোছলেম শুয়ে আছে। তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন তার মেয়েরা। তার খুব জ্বর এসেছে। আছমত আলীর চেলা মোছলেমের দিকে তাকিয়ে বলে কিরে মোছলেম তোর জ্বর আইলো কেমনে। ভাই কাইল বৃষ্টিতে ভিজা মাছ ধরছি এর পর থিকাই জ্বর। আচ্ছা তোর নাও কই। মোছলেম জ্বরে কাতর কণ্ঠে বলে- আছে হয়তো কোনো জাগায়। ডুবাইয়া রাখছি। যেই দিনকাল পড়ছে। চুরির ভয়ে ডুবাইয়া রাখছি। সহসা আছমত আলীর ডাক উঠোন থেকে। ওই শাহাদাত চল ক্যাম্পে যাইতে হইবো, হেড কোয়ার্টার থিকা ডাক পড়ছে আল্লাহই জানে কপালে কী আছে। সবাই চলে যায় কালকিনী বাজারের দিকে। সারা বাজারে বড়ো বড়ো আর্মি ভ্যানে ভরে গিয়েছে। গোলাগুলি শুরু হয়ে গিয়েছে। বাজারের দোকানপাট সব পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আছমত আলী দৌড়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে গিয়ে শান্তি কমিটির অফিসে পৌঁছে মেজর একরামউল্লাহকে দেখে স্যালুট ঠুকে দেন। আর পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান করতে থাকেন। সাথে তার লুঙ্গি পরিহিত শান্তি বাহিনীরও আগমন। ইধারমে হিন্দুকা গাও কাহা হে। আছমত আলী বলেন- হুজুর উধার মে, মেরে সাথ আও। বড় জিপ আর ভ্যানে ভরে গেছে গাও। ওরে কেডা কোম্মে আছো মেলেটারি আইছে এই বলে আর্তচিৎকার করে উঠলেন হরিশ বাবুর বৌ রাধা। সবাই যে যার মতো ছুটতে লাগলেন। কেউ পানিতে ঝাপ দিলেন, কেউ ধানের গোলায় লুকিয়ে থাকলেন। গুলির বৃষ্টি ঝরছে যেন সারা গায়ে। হিন্দু কুমারী কন্যা আশারাণীকে কাঁধে তুলে ভ্যানে তুলে নিয়ে যান পাক সেনারা, শুধু আশা নয় গাঁয়ের আট নয় বছরের মেয়ে থেকে শুরু করে মাঝ বয়সী নারী পর্যন্ত কেউই বাদ যায়নি। হরিশ বাবুর মাটির হাঁড়ি, কলসি বানানোর চাকাটি ঘুরছিল। হাঁড়ি বানাচ্ছিলেন হরিশ বাবু। মিলিটারির কথা শুনেই কিশোর বয়সী পুত্র নরেনকে নিয়ে গাঙে ঝাপ দেন হরিশ। তার সাথে অনেক নারী, পুরুষ, যুবক গাঙে লাফিয়ে সাঁতরে সাঁতরে ডুবে ডুবে পৌঁছে যান সাদীপুর গ্রামে। অনেকের হাত পা পুড়ে গেছে। কেউ আবার পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছেন। পুরো গ্রামটাই যেন একটা অলিখিত হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। এই গ্রামটি দুর্গম থাকায় মিলিটারিদের প্রবেশ করতে একটু বেগ পেতে হবে। মিলিটারিদের আগমনের কথা শুনে খালের উপর কাঠের পুলটি ভেঙে ফেলেছেন গ্রামবাসী। গ্রামে আসতে হলে পাটক্ষেত, আখক্ষেত ও ছোটবড় খাল পেরিয়ে গায়ে ঢুকতে হয়ে। কৃষ্ণনগর গ্রামের সাথে সংযুক্ত একমাত্র পুলটি ভেঙে ফেলায় মিলিটারিদের জন্য আরো কঠিন হয়ে গেল গায়ে প্রবেশ। যার গোলায় যা ছিল তা দিয়ে খিচুরি পাকানো হয়েছে। হরিশ বাবুর স্ত্রী ও কন্যাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ক্যাম্পে। স্ত্রী বউয়ের কথা চিন্তা করে কান্না জুড়ে দিয়েছেন। তার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দিচ্ছেন মোছলেম। জাত-পাত সব ভুলে একসাথে সবাই মিলিত হয়েছেন। আস্তে আস্তে রাত নেমে আসে রাত আরো গভীরতর হয়। উঠোনে জনাবিশেক মুক্তিযোদ্ধা তাদের নেতৃত্বে আছেন আছমতের ছেলে হাসেম। মোছলেম ধানের গোলা থেকে বস্তাটা বের করে দেন হাসেমকে। বস্তাভর্তি আগ্নেয়াস্ত্র। পানিতে ভিজে ছিল। তাই খুব ভালো করে মুছে ধানের গোলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। রাত ৩টা ৩০- এই গভীর রাতেই ক্যাম্পে হামলা করার উপযুক্ত সময়। নারীদের প্রতি চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। তার উপর ভিন্নধর্মের নারী। ধর্ষণের পর সিগেরেটের ছ্যাকা দেয়া হচ্ছে তাদের যোনিতে। তাদের আর্ত চিৎকারে ক্যাম্পের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছে।

পাটক্ষেতের ভিতর থেকে আস্তে আস্তে কয়েকটা কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে গাঙের পাশ দিয়ে। সবাই যে যার মতো পজিশন নিয়েই হামলা শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় ধ্বংস করা হয় ক্যাম্প। মিলিটারিদের ভ্যানগুলো গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেয়া হয়। আছমত আলী পালাবার জন্য পথ খুঁজতে চায়। কিন্তু তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তার পুত্র হাসেম। হাসেমের সামনে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে একজন রাজাকার। তার বাবা নয়। আছমত ছেলেকে দেখে গর্জে ওঠে হারামির বাচ্চা এইসব তোর কাজ। হাসেমের স্টেনগ্যান থেকে বৃষ্টির মতো গুলি বেরিয়ে ঝাঁঝড়া করে দেয় তার বুক। মুক্তিযুদ্ধের এই সফলতায় হানাদারমুক্ত হয় কালকিনী। নদীতে ভেসে যাচ্ছে নারী, শিশুদের মৃতদেহ। হামিদা আর শাহিদা বাবার কাঁধে মাথা রেখে একটি স্বাধীন দেশের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। হরিশ বাবুর চোখে ভাসে তার বউ আর স্ত্রীর মুখ। যেদিন তিনি প্রথম মা হয়েছিলেন। আবারও তিনি চাকা ঘোরাবেন। পোড়া চাকাটাকে আবারও ঘোরাতে হবে।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

মৃৎচক্রের দিনগুলো

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

শুক্রবার, ০২ এপ্রিল ২০২১

খুব গম্ভীর মুখে হাঁড়িগুলো নৌকোতে লোড করছে হরিশ কুমার। বেপরোয়া বাতাস বড্ড জ্বালা দিচ্ছে। খানিক বাদে বাদেই গাঙে ঢেউ উঠিয়ে নৌকোটাকে উতলা করে তুলছে। নায়ের গলুইয়ের উপর বসে আখ চিবোচ্ছে হরিশের পুত্র নরেন কুমার। চোখ পড়তেই খেকিয়ে উঠলো হরিশ। আখ ভালো কইরা চাবাইন্না দেহাইয়া দিমু। হাট শুরু হতে বেশি দেরি নেই আর উনি আউখ চাবাইতাছে। হাত লাগা হারামি। অর্ধ খাওয়া আখটাকে ধুতির কোচে গুঁজে নিয়ে নৌকোতে হাঁড়ি কলসি লোডে বাবার সাথে হাত লাগায় নরেন। রামকৃষ্ণপুর থেকে কালকিনী হাট মাইল পাঁচেক দূরে। নানা গ্রাম থেকে প্রতি বুধবার বেপারিরা তাদের বাণিজ্যিক পসরা সাজিয়ে বসেন। হরিশ বাবুর বসার জন্য একটা নির্ধারিত জায়গা রয়েছে। হাটের শেষ মাথায় একটা বটগাছ আছে। বটগাছের নিচে মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিল, বাসনকোসন, গনেশ ঠাকুর, লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ছোট পুতুল, মাটির ফল, ব্যাংক নানা রকমের খেলনার পসরা সাজিয়ে বসে। হামিদা আর তার বোন শাহিদা প্রতি বুধবার বাবার সাথে হাটে আসে কাচা মরিচ, টমেটো, বেগুনসহ ক্ষেতের নানা তরিতরকারি বিক্রি করতে। বেঁচাকেনা শেষ হলে ঠোঙায় ভরে আমৃত্তি, বাতাসা এসব কিনেন। সাদা সাদা বাতাসার টুকরিতে চোখ পড়লেই ওদের মনে হতো যেন অনেকগুলো বুনো সাদাফুল টুকরিতে ভরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হামিদার মা সুখীবিবি মুড়ি ভাজার হাঁড়িতে নারিকেলের শলা দিয়ে বালুগুলো নাড়েনচাড়েন আর নানা লোকছড়া কাটেন- ইটকিরি বিটকিরি রবির দানা, রবির বউ কারি, চিকন চাউল ঝাড়ি, ঝাড়তে ঝাড়তে ফুরায় না, চিকন চাইলে মানায়না, হাপলা হাপলা হাপের বাপ, মুড়ি ফোট খাপের খাপ। এরপরই খুব চমৎকারভাবে পপকর্ণের মতো হাঁড়ির ভেতর মুড়ির দানাগুলো খিলখিল করে হেসে উঠতো যেন। মোটা চালের লাল মুড়ির সাথে কুটকুট করে সর্ষেক্ষেতের ভিতরে দু’বোন মিলে মুড়ি চিবোয়, দৌড়ায়, আর কাকতাড়–য়ার মাথার হাঁড়ি ফাটিয়ে পালিয়ে চলে আসে বাড়িতে।

গেল বছর কুমোর বাড়িতে পুজোর আগে মা দুর্গার হাত নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছিল হামিদার ছোটবোন শাহিদা। এরপর কুমোরপাড়ার বুড়ো সাধুর দাবাড় খেয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। তাই হাটে এলে খেলনা কেনার অনেক শখ থাকলেও গত বছরের পাপকর্মের কথা মাথায় রেখে আর ও দোকানের পাশ মাড়ায় না। কিন্তু শাহিদার অনেক ইচ্ছা হয় মাটির পুতুল কিনতে। জামাই বউয়ের একটা পুতুল দেখা যাচ্ছে। জামাই বউ খেলার জন্য অনেক দিন থেকে বাবাকে একটা জামাই বউ পুতুল কেনার কথা বলে আসছে শাহিদা। কিন্তু বাবা পুতুলটুতুল খুব একটা পছন্দ করেন না। পুতুলের কথা বললে বাবা বলেন- আম্মা তুমি এই যে পুতুল কিনতে চাও, এইসব মাটির পুতুল দিয়া খেলা হারাম, নবীজির নিষেধ। তাই অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাটির পুতুল আর কেনা হয়ে ওঠে না। হরিশ বাবুর ছেলে নরেনকে চিনেন শাহিদা। ওর পাঠশালার বন্ধু। নরেন শাহিদাকে বলেছে পুতুল বানানো শিখাবে। তাই মাঝে মাঝেই লুকিয়ে লুকিয়ে নরেনদের বাড়ি যেত শাহিদা পুতুল বানানো শিখতে। কিন্তু নরেনের বাবা হরিশ কুমার গোড়া লোক মুসলমানদের আনাগোনা পছন্দ করেন না। কোনকিছুতে মুসলমানদের হাত পড়লে রাম রাম করে পানি ছিটিয়ে সেটি পবিত্র করতে থাকেন। এ কাণ্ড দেখে শাহিদা আর হামিদা মিটিমিটি করে হাসেন।

গাঁয়ের পাঠশালা বন্ধ তাই এখন ফুলটাইম বাবাকে সময় দিচ্ছেন নরেন। শুনেছে ঢাকা শহরে নাকি গণ্ডগোল বেঁধেছে। হাটের মানুষদের ভিতরেও কেমন যেন একটা গম্ভীর ভাব। এই প্রাণচঞ্চল কালকিনীর হাটে সবসময় মানুষের মুখে একটা হাসি লেগে থাকতো। বেপারিরা বেচাকেনা শেষ করে চায়ের দোকানে আড্ডা দিত। দোতরায় গানে টান দিত অবিনাশ বাউল। কিন্তু গেল একমাস থেকেই যেন মানুষের মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি। মানুষ চায়ের দোকানে বসে এখন আর গান শোনে না। রেডিওতে কান পেতে বাংলাদেশ বেতারের খবর শোনেন। ভুট্টো, ইয়াহিয়া, টিক্কা খান এই নামগুলো মানুষের মুখে শোনা যায়। জটলা দেখলেই জটলা ভেঙে দিচ্ছে গ্রাম্য মাতবর আছমত আলী। কোন কাম নাই তোমাগো ভাগো, যাও বাড়ি যাও। তারপর জটলা ভেঙে যে যার বাড়িতে চলে যায়। আছমত আলী মুখে পান গুঁজে দিয়ে বলে এই হাটে কোন দলবাজি চলবো না। বাঁচতে চাইলে আমি যেইভাবে কমু সেইভাবে ব্যবসাপাতি করবা। হাটের চান্দা ভাবতাছি আগামি হপ্তা থিকা বাড়াইয়া দিমু। এই অঞ্চলে মেহমানরা আসবো। বিদেশী মেহমান আল্লাহর নেক বান্দারা, পাকিস্তানের ফেরেস্তারা আসবো আমাগো গঞ্জে। তাগো খেদমত করা আমাগো ঈমানী দায়িত্ব। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বড় জোব্বা, আলখেল্লা পরা ছাগলা দাড়িওয়া কিছু লোক। এই দেখ আরবি ভাষায় আমার কাছে চিঠি আইছে। আছমত আলীর ছেলে হাসেম আলী বাবার কানে কানে বলে- আব্বা এইডা আরবি ভাষা না উর্দু। ছেলেকে ধমক দিয়ে বলে দূরে যা হারামখোর। আমারে অক্ষর চিনাস। হাসেম আলী বাবার এইসব কর্মকাণ্ড পছন্দ করে না। গাঁয়ের মানুষকে বোকা বানাচ্ছে আছমত। উর্দুকে আরবি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। জনাবিশেক ছাগলা দাড়িওয়ালা আধা বয়স্ক লোক আর কয়েকজন চাঁদাবাজ যুবকদের নিয়ে আছমত আলী গড়ে তোলেন শান্তি কমিটি। কিন্তু চিন্তার বিষয় আছমত আলীর ছেলে হাসেমের কাণ্ডকারখানা ভালো ঠেকছে না আছমতের। ওর চালচলন সন্দেহজনক।

কানে রেডিও লাগিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনছেন মোছলেম বেপারি। তার পাশে এসে বসে হামিদা আর শাহিদা। বাবো রেডিওতে কী হোনেন। মোছলেমের চোখেমুখে আতঙ্ক। মেয়েদের কাছে টেনে নিয়ে বলেন, মা দেশের পরিস্থিতি ভালো না। ঢাহা শহরে গণ্ডগোল লাগছে।

আছমত আলী বলেন- হুজুর উধার মে, মেরে সাথ আও। বড় জিপ আর ভ্যানে ভরে গেছে গাও। ওরে কেডা কোম্মে আছো মেলেটারি আইছে এই বলে আর্তচিৎকার করে উঠলেন হরিশ বাবুর বৌ রাধা। সবাই যে যার মতো ছুটতে লাগলেন

মানুষ মারতাছে পাখির মতো গুলি কইরা। ওরা বিভিন্ন গেরামেও হানা দিতাছে। মানুষ মারতাছে, ঘর, গোলা, পুড়াইতাছে। আমরা কই যামু বাবো- ওরা কী আমাগো গেরামেও আইবো? মোছলেম মেয়েদের সাহস দিয়ে বলে, আইতে পারে আবার নাও আইতে পারে। কারণ আমাগো গেরামের ভিতর দিয়ো আইতে হইলে জঙ্গল পাড়ি হইতে হইবো। তারপর গাঙ, খাল, পাটক্ষেত এতো কিছু পার হইয়া ওরা এদিকে আইতে পারবো না। তোমরা অন্য গেরামে যাইয়ো না কিন্তু। বাড়ি ছাইড়া কোনো জায়গায় যাইবা না। হাট বাজার বন্ধ। আমি নাও লইয়া গাঙে যাইমু কাইল। একটা মালের চালান আইবো ডাক পড়ছে।

গভীর রাতে মোসলেম মেয়েদের ঘুমে রেখে নাও নিয়ে বের হয়ে যায়। চারদিকে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। নাও গাঙ দিয়ে যেতে যেতে একটা খালের ভিতরে ঢোকে। খালের পাশ দিয়ে বিস্তৃত আখ ক্ষেত আর পাট ক্ষেতের সমাহার। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বৃষ্টি নামতে পারে। মোছলেম খুব ধীরে ধীরে নাও বেয়ে যাচ্ছে। একটা খেতের ভিতর থেকে শিষ বেজে ওঠে। মোসলেম শিষ শুনে নৌকোটা পাটক্ষেতের ভিতরে প্রবেশ করায়। আছমত আলীর ছেলে হাসেম। তার মাথায় গামছা বাঁধা। হাতে একটা বস্তা সে বস্তাটা মোছলেমের হাতে দিয়ে বলে মোসলেম ভাই এই বস্তাটা লুকাইয়া রাখবা। আমরা দুই একদিনের মধ্যেই গেরামে আইতাছি। মোসলেম বস্তাটা নাওয়ের পাঠাতনের ভিতরে লুকিয়ে রাখে। কালকিনী বাজারে শান্তি কমিটির অফিস খুলেছে আছমত আলী। তাই বাজারের সামনে দিয়ে নাও নিয়ে সাবধানে যেতে হবে।

মোছলেম নাও নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। বাজারের কাছে আসতেই আছমত আলীর চেলাদের হাকডাক। ওই কেডা যায় এত রাইতে নাও লইয়া। নাও ভিড়াও চেক করমু। মোছলেম কোনো কথা বলে না নায়ে জোরে জোরে বৈঠা মারতে থাকতে। থামো কইতাছি, গুলি ছুড়মু কিন্তু। মোসলেম পাটাতন উঠিয়ে বস্তাটা নিয়ে গাঙের মধ্যে লাফ দেয়। শান্তি কমিটির পবিত্র সেনারা গুলি ছুড়তে থাকে। মোছলেম পাতিহাঁসের মতো ডুব দিয়ে অনেক দূরে গিয়ে ওঠে। নৌকাটা ঝাঁঝড়া করে ফেলা হয়েছে গুলি করে। আছমত আলী পরদিন সকালে তার চেলাচামুন্ডাদের নিয়ে জরুরি মিটিংয়ে বসে। নায়ের ভিতর থেকে বস্তা নিয়ে নদীতে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাওয়া বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেন না তিনি। হেড কোয়ার্টারে এই খবর পৌঁছালে তাকে আস্ত রাখবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুই চার গ্রামে সার্চ করবেন বাড়ি বাড়ি। কোন বাড়িতে বস্তাটা লুকানো আছে। আর কার নৌকা খোয়া গেছে সেটা চেক করলেই বেরিয়ে পড়বে আসল শত্রু কে? বাড়ি বাড়ি চিরুনি অভিযান চালানো হচ্ছে। নোমোকান্দির কুমাড় বাড়ি থেকে শুরু করে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত সব গ্রাম চষে ফেলা হয়েছে। কিন্তু বস্তা খুঁজে পাওয়া গেলো না। মোছলেমের বাড়িতে মোছলেম শুয়ে আছে। তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন তার মেয়েরা। তার খুব জ্বর এসেছে। আছমত আলীর চেলা মোছলেমের দিকে তাকিয়ে বলে কিরে মোছলেম তোর জ্বর আইলো কেমনে। ভাই কাইল বৃষ্টিতে ভিজা মাছ ধরছি এর পর থিকাই জ্বর। আচ্ছা তোর নাও কই। মোছলেম জ্বরে কাতর কণ্ঠে বলে- আছে হয়তো কোনো জাগায়। ডুবাইয়া রাখছি। যেই দিনকাল পড়ছে। চুরির ভয়ে ডুবাইয়া রাখছি। সহসা আছমত আলীর ডাক উঠোন থেকে। ওই শাহাদাত চল ক্যাম্পে যাইতে হইবো, হেড কোয়ার্টার থিকা ডাক পড়ছে আল্লাহই জানে কপালে কী আছে। সবাই চলে যায় কালকিনী বাজারের দিকে। সারা বাজারে বড়ো বড়ো আর্মি ভ্যানে ভরে গিয়েছে। গোলাগুলি শুরু হয়ে গিয়েছে। বাজারের দোকানপাট সব পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আছমত আলী দৌড়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে গিয়ে শান্তি কমিটির অফিসে পৌঁছে মেজর একরামউল্লাহকে দেখে স্যালুট ঠুকে দেন। আর পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান করতে থাকেন। সাথে তার লুঙ্গি পরিহিত শান্তি বাহিনীরও আগমন। ইধারমে হিন্দুকা গাও কাহা হে। আছমত আলী বলেন- হুজুর উধার মে, মেরে সাথ আও। বড় জিপ আর ভ্যানে ভরে গেছে গাও। ওরে কেডা কোম্মে আছো মেলেটারি আইছে এই বলে আর্তচিৎকার করে উঠলেন হরিশ বাবুর বৌ রাধা। সবাই যে যার মতো ছুটতে লাগলেন। কেউ পানিতে ঝাপ দিলেন, কেউ ধানের গোলায় লুকিয়ে থাকলেন। গুলির বৃষ্টি ঝরছে যেন সারা গায়ে। হিন্দু কুমারী কন্যা আশারাণীকে কাঁধে তুলে ভ্যানে তুলে নিয়ে যান পাক সেনারা, শুধু আশা নয় গাঁয়ের আট নয় বছরের মেয়ে থেকে শুরু করে মাঝ বয়সী নারী পর্যন্ত কেউই বাদ যায়নি। হরিশ বাবুর মাটির হাঁড়ি, কলসি বানানোর চাকাটি ঘুরছিল। হাঁড়ি বানাচ্ছিলেন হরিশ বাবু। মিলিটারির কথা শুনেই কিশোর বয়সী পুত্র নরেনকে নিয়ে গাঙে ঝাপ দেন হরিশ। তার সাথে অনেক নারী, পুরুষ, যুবক গাঙে লাফিয়ে সাঁতরে সাঁতরে ডুবে ডুবে পৌঁছে যান সাদীপুর গ্রামে। অনেকের হাত পা পুড়ে গেছে। কেউ আবার পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছেন। পুরো গ্রামটাই যেন একটা অলিখিত হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। এই গ্রামটি দুর্গম থাকায় মিলিটারিদের প্রবেশ করতে একটু বেগ পেতে হবে। মিলিটারিদের আগমনের কথা শুনে খালের উপর কাঠের পুলটি ভেঙে ফেলেছেন গ্রামবাসী। গ্রামে আসতে হলে পাটক্ষেত, আখক্ষেত ও ছোটবড় খাল পেরিয়ে গায়ে ঢুকতে হয়ে। কৃষ্ণনগর গ্রামের সাথে সংযুক্ত একমাত্র পুলটি ভেঙে ফেলায় মিলিটারিদের জন্য আরো কঠিন হয়ে গেল গায়ে প্রবেশ। যার গোলায় যা ছিল তা দিয়ে খিচুরি পাকানো হয়েছে। হরিশ বাবুর স্ত্রী ও কন্যাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ক্যাম্পে। স্ত্রী বউয়ের কথা চিন্তা করে কান্না জুড়ে দিয়েছেন। তার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দিচ্ছেন মোছলেম। জাত-পাত সব ভুলে একসাথে সবাই মিলিত হয়েছেন। আস্তে আস্তে রাত নেমে আসে রাত আরো গভীরতর হয়। উঠোনে জনাবিশেক মুক্তিযোদ্ধা তাদের নেতৃত্বে আছেন আছমতের ছেলে হাসেম। মোছলেম ধানের গোলা থেকে বস্তাটা বের করে দেন হাসেমকে। বস্তাভর্তি আগ্নেয়াস্ত্র। পানিতে ভিজে ছিল। তাই খুব ভালো করে মুছে ধানের গোলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। রাত ৩টা ৩০- এই গভীর রাতেই ক্যাম্পে হামলা করার উপযুক্ত সময়। নারীদের প্রতি চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। তার উপর ভিন্নধর্মের নারী। ধর্ষণের পর সিগেরেটের ছ্যাকা দেয়া হচ্ছে তাদের যোনিতে। তাদের আর্ত চিৎকারে ক্যাম্পের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছে।

পাটক্ষেতের ভিতর থেকে আস্তে আস্তে কয়েকটা কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে গাঙের পাশ দিয়ে। সবাই যে যার মতো পজিশন নিয়েই হামলা শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় ধ্বংস করা হয় ক্যাম্প। মিলিটারিদের ভ্যানগুলো গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেয়া হয়। আছমত আলী পালাবার জন্য পথ খুঁজতে চায়। কিন্তু তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তার পুত্র হাসেম। হাসেমের সামনে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে একজন রাজাকার। তার বাবা নয়। আছমত ছেলেকে দেখে গর্জে ওঠে হারামির বাচ্চা এইসব তোর কাজ। হাসেমের স্টেনগ্যান থেকে বৃষ্টির মতো গুলি বেরিয়ে ঝাঁঝড়া করে দেয় তার বুক। মুক্তিযুদ্ধের এই সফলতায় হানাদারমুক্ত হয় কালকিনী। নদীতে ভেসে যাচ্ছে নারী, শিশুদের মৃতদেহ। হামিদা আর শাহিদা বাবার কাঁধে মাথা রেখে একটি স্বাধীন দেশের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। হরিশ বাবুর চোখে ভাসে তার বউ আর স্ত্রীর মুখ। যেদিন তিনি প্রথম মা হয়েছিলেন। আবারও তিনি চাকা ঘোরাবেন। পোড়া চাকাটাকে আবারও ঘোরাতে হবে।

back to top