রুহুল আমিন বাচ্চু
-ঐ কেডারে?
ভোরের আযান শেষ হলো মাত্র। কদমার শরীরে ওমভর্তি। একটু নড়াচড়া করলে ওমের বাঁধনটা ঢিলে হয়ে যায়। ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আর কুয়াসা ফাঁদ পাতে কম্বলের ভেতর। কদমা ডানে কাত হয়ে শুয়ে আছে। একটা প্রাণী তার পেছনে কম্বলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। কুকুর না মানুষ বুঝতে পারে না।
ডান কনুই মেরে দ্বিতীয় প্রাণীটির অস্তিত্ব অনুভব করে। কুকুর নয় মানুষের দেহ মনে হয়। এবার খেঁকিয়ে ওঠে, আরে কেডায়রে আমার কম্বলে হান্দাইছস্?
কনুইয়ের দুই গুতো খেয়ে ওপাশ থেকে কেউ একজন কঁকিয়ে ওঠে।
-গেলি, না আরো গুঁতা খাইবি?
কিছুটা কাতুরের গলায় জবাব আসে, কদমা আমি, আমি কালা।
-দুত্তরি কালা হালা, আমার কম্বলে তুই হান্দাইছস ক্যা? রাইতে তোরেওতো সবেরা টিভি ক্যামেরার বাত্তিমাইরা নয়া কম্বল দিছে। যা ভাগ হালা।
-কদমা কথা হুনবিতো শেষ রাইতে ঠান্ডার জইম্যা যাইতাছি। আচমকা ঘুম ভাইঙ্গা গেলেগা দেহি আমার গতরের লাল কম্বলটা নাই। মনে হয় কেউ-
-হালার পো হালা। কম্বল লইয়া গেছে, না কোন পিরিতের মাসীরে দিছস্?
-বিশ্বাস কর। হবায় আযান দিছে। আল্লারকীরা ফেরেশতারা দুইন্যাইত নাইম্যা আইতাছে। অহন বেহেশ্তী সময়। মিছা কথা কই নাই।
-আইছে ঘুমা।
কদমা তার কম্বলের বাড়তি অংশের একাংশ ছাড় দেয় কালার জন্য। কমলাপুর রেলস্টেশনের পার্শ্বে শেষ মাথায় সারি সারি মানব সন্তানের রাত্রি যাপন। কপাল তাদের ভাল। গত রাতে কারা যেন তার ছালা ভরা গায়ে কম্বল ফেলে গেছে সাথে ছিল টেলিভিশন ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। কদমার ভাগেও একখান পড়ছে। বড় ওম কম্বলের লোমের মধ্যে। শান্তিতে রাত পার করলো। কুয়াশা ঘিরে আছে খোলা স্টেশন। খুব উঁচু সাপের ফনা মার্কা স্টেশনের ছাদ। ঠাণ্ডা কুয়াশা শা-শা করে তেরছা বাঁকে ঢুকে যায় নাকের মধ্যে। আল্লার কাছে দোয়া করে কম্বল দাতার জন্য। কোন সময় কালা তার কম্বলে ঢুকেছে টের পায়নি। আস্তে আস্তে যখন কম্বলের ভাগ টানতে থাকে, তখনি টের পায়। ভোর হতে কু-উ-উ ঘটাং ঘটাং করে রেলগাড়ি ঢুকে পড়ে স্টেশনে। পাবলিকের হৈ হুল্লোড় আর পুলিশের প্যাদানি খেয়ে তখন ছুটতে হয়। আবার গিয়ে ঘুম দিবে ফুটপাতে।
ডিসেম্বরের শেষ, পৌষের মাঝামাঝি। কদম বছর তিনেক আগে মার সাথে ঢাকা এসেছিল। তখন তার বয়স চার পাঁচ বছর হবে। কমলাপুরে বস্তীতে মা ঘর নেয়। ছেলে আর মায়ের সংসার। দক্ষিণ কমলাপুর এক মেসে মা কাজ করতো। বাপ তো মাকে তালাক দিয়েই সরে গেল।
মাঝেমধ্যে দেখতো কমলাপুর ব্রিজের নিচে লেংড়া ফকিরটার সাথে মা কি যেন কথা বলতো অনেক সময় ধরে। দূরে সরিয়ে রাখতো কদমকে। কথা শেষ হলে বলতো কদমা আয় বাজান।
একদিন রাতে মা উঠলো লেংড়া ফকিরটার ঘরে। কদম মার পিছে পিছে যায়। পরে মানুষের কাছে শোনে মা লেংড়াকে বিয়ে করেছে। পরের রাতে লেংড়া তার লাঠি দিয়ে কদমাকে দিল মার। বললো, ফাহিরনীর পুত আর আবিনা আমার ঘরে। যা ভাগ। আমার তো এক ঠ্যাং গেছে তোর দুই ঠ্যাং কাইট্যা নিমু। মা ঘরে ছিল না। তবে বুঝতে পারে সে এখন মার কাছের মানুষ। মার সোয়ামি। আর কদমা মরা বেডার পুত।
রাগে দুঃখে পালিয়ে বেড়ালো পীরজঙ্গী মাজার আর মতিঝিল। একদিন দেখা কালার সাথে। দোস্তালি হলো। সে এখন আপন জন।
কোন সময়ে সকাল পার হয়ে নাস্তার সময় গেল টের পায়নি। টের যখন পেলো কম্বলটা গা থেকে সরে একটা রিক্সার ভাঙ্গা স্পোকের সাথে চক্কর দিয়ে যাচ্ছে রাস্তা কুড়িয়ে। দুজনে লাফ দিয়ে উঠলো। কম্বলটাকে রক্ষা করলো।
রাততো গেল আরামে। এখন কি খাবে? দুজনের কাছে কাছে আছে আট টাকা। দুই পরোটার দাম।
কম্বলটা ভাজ করে মাথায় রাখলো। দুই পারোটা খাওয়া শেষে বিনি পয়সার পানি দিয়ে পেট ভর্তি করলো।
কাজ কামতো কিছু একটা করতে অয়। ভাঙ্গারির দোকানে মাল বাছাইয়ে কাম। তারপর বান্ডিল বানানো।
কম্বল কোথায় রাখে চিন্তায় পড়ে। কম্বল নিয়ে দোকানে গেলে মহাজনের চোখ এড়াতে পারবে না। যেভাবেই হোক কম্বলটা হাত করবে।
কম্বলের কাহিনীর আগে ছিল ছেড়া বস্তা। কমলাপুর ওভার ব্রীজের কাটাতারের বেড়ায় ভেতরে ইট দিয় চেপে রাখতো।
হালার ছেড়া বস্তা! এইডাও চুরি যায়। দুইদিন গায়ে দিলোতো তিন দিনে হাওয়া। আবার আরেকজনেরটা চুরি করে। ছালা বদলের জীবন।
কম্বল মাথায় দিনের আধা শেষ। দুই দোস্ত এক সাথে চলে। কম্বল কই রাখে জায়গা পায় না। একবার ভাবে বাবুলের চা দোকানে রাখে। আবার ভাবে বাবুলকেও বিশ্বাস নাই। আবার কেউ না নিয়া যায়!
প্রায় সময় হজম করে বাবুলের নেংটা গালি। কোন মাগীর পুতে আমার চায়ের কাপ নিয়া গেলরে, আবার নাই চায়ের চামচ।
কালার উপর গোস্বা হয়। হালারপো তুইতো কামে লাইগ্যা যাইতে পারস্। আমারে না হয় একদিন খাওয়াইলি। দেহস্ আমি বিপদে। রাইতেতো আবি কুত্তার লাহান কম্বলের ভাগ নিতে।
কালার বিশ্বস্ত জবাব।
দোস্ত হারাজীবন এক লগে কাম করছি। তোরে ছাড়া যে কামে মন বহেনা।
পিরিতে কথা ফালা। খাওনের ব্যবস্থা কর, জোহরের আযান শেষে ঘণ্টা পার অইছে।
চিন্তা করিস না। আজকা ফাও মারুম। তুই খাড়া।
কথা মাটিতে পড়ার আগেই জনস্রোতে মিশে যায় কালা। কম্বলটা বগলে চেপে অপেক্ষা করে কদম। মানুষ জন যাচ্ছে- আসছে স্রোতের মতো। কাদার মধ্যে গেঁথে থাকা শুকনো লাকড়ির অস্তিত্বে কদম।
কারো গায়ে কোট প্যান্ট। গলায় টাইয়ের বাহার। কেউ চাদর গায়ে। কেউ হাফ ফুল সোয়েটার, গলায় মাফলার। চলছে বাহারি জনস্রোত রাজপথে।
পিন পিন শীত নেমে আসছে। এদিকটায় ছায়া জমে যাচ্ছে। রাস্তায় ওপারে রোদে দাঁড়ায় কদমা। কম্বলের ওম এখন তার বোগলে। হঠাৎ মনে হয় কম্বলটা একটু রোদে দিলে ভাল হতো না। আরামের ভেতর আরাম। রাস্তায় একটা গাড়ির হার্ড ব্রেক, বিরক্তিভরে ফিরে তাকায়। নেংটা পাগলটা নিত্য দিনের মতো ট্রাফিক সার্জেন্ট সেজেছে। রিক্সাসারি দুভাগ করে করে রাস্তায় মাঝে দাঁড়িয়ে। কেউ কিছু বলছেনা। এদিকে ট্রাফিক পুলিশ ও নেই।
-লাগবো নিহি বাঘরখানি?
আহ্ ডায়লগটা তার জিহ্বার আগা ভিজিয়ে দেয়। চায়ে চুবিয়ে বাখরখানি। বাখরখানিও চা খায়, কদমা বাখরখানি খায়। তিন খান বাখাখানিতে দুইকাপ চায়ের দরকার।
-হালারা ফুটপাতের চায়ের দামও বাড়ায় দিছে। কদমার খেদ টং দোকানের টুং টাং শব্দ শুনে।
হঠাৎ র্ধ র্ধ শোরগোল। রাস্তার মাঝে ধরা পড়ে কালা। হাতে তার কখানা পারোটা। কদমা চোখ ঘুরিয়ে নেয়। সে জানে এখন দৌড় দিলে তার কম্বলও যাবে মার ও খাবে। তার চেয়ে আড়ালে একটু নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়।
কদমা কম্বলটা রাখার নতুন স্থান খোঁজে। একবার ভাবে পাশের ডিপোর ওয়ালের পাশে লুকিয়ে রাখে।
নাহ্ কারো নজরে পড়ে যাবে।
হালার চোরে দেশটা ভইরা গেছে গা। কম্বল দাতাদের উদ্দেশ্যে এক তোড় গালি বর্ষণ করে। হালারা কম্বল দিতে আইছে? টেলিভিশন, ক্যামেরা লগে। ইলেকশন করবো নাকি হেরা? আবার ভাবে অহনতো ইলেকশনের মওশুমনা। তা অইলে উদ্দেশ?
ও বুঝছি, গরিরেরে দান। ছওয়াব কামাইবো আমারে বিপদে ফালায়া।
একটু পরে কালা নাকমুখ ফাটিয়ে ফিরে আসে।
-দুইচারইডা লুডির লাইগ্যা এমন মাইর। দশটেকার মাল। অহন ডাক্তার-অসুধ -বড়ি শ’ টেকার।
-দুর অষুদ বড়ি লাগবো না। ল’ চল অন্য পথে। দেখি দোস্ত বাতেনেরে মতিঝিলে পাইলে দশবিশ টেকা পাওন যাইবো।
কদম বলে, কালা তুই খাড়া। আইতাছি।
কালা পাশের লাইট পোস্টটায় হেলান দিয়ে রোদ পোহায়। বাম হাতে অনুমান করে আঘাতের অস্তিত্ব। নাকের ভেতর থেকে একদলা রক্ত আঙ্গুলে তুলে চোখের সামনে ধরে। নিজেকেই শালা বলে গালি দিকে তাকায় রেস্তোরার দিকে। কদমা ফিরে আসে একটু পর। বগলের নিচে কম্বলটা নেই। ডান হাতে মেলে ধরে পঞ্চাশ টাকার দুটো লাল নোট। মুখের হাসিটি অনেকক্ষণ ধরে রাখে কালার উদ্দেশে।
রুহুল আমিন বাচ্চু
বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১
-ঐ কেডারে?
ভোরের আযান শেষ হলো মাত্র। কদমার শরীরে ওমভর্তি। একটু নড়াচড়া করলে ওমের বাঁধনটা ঢিলে হয়ে যায়। ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আর কুয়াসা ফাঁদ পাতে কম্বলের ভেতর। কদমা ডানে কাত হয়ে শুয়ে আছে। একটা প্রাণী তার পেছনে কম্বলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। কুকুর না মানুষ বুঝতে পারে না।
ডান কনুই মেরে দ্বিতীয় প্রাণীটির অস্তিত্ব অনুভব করে। কুকুর নয় মানুষের দেহ মনে হয়। এবার খেঁকিয়ে ওঠে, আরে কেডায়রে আমার কম্বলে হান্দাইছস্?
কনুইয়ের দুই গুতো খেয়ে ওপাশ থেকে কেউ একজন কঁকিয়ে ওঠে।
-গেলি, না আরো গুঁতা খাইবি?
কিছুটা কাতুরের গলায় জবাব আসে, কদমা আমি, আমি কালা।
-দুত্তরি কালা হালা, আমার কম্বলে তুই হান্দাইছস ক্যা? রাইতে তোরেওতো সবেরা টিভি ক্যামেরার বাত্তিমাইরা নয়া কম্বল দিছে। যা ভাগ হালা।
-কদমা কথা হুনবিতো শেষ রাইতে ঠান্ডার জইম্যা যাইতাছি। আচমকা ঘুম ভাইঙ্গা গেলেগা দেহি আমার গতরের লাল কম্বলটা নাই। মনে হয় কেউ-
-হালার পো হালা। কম্বল লইয়া গেছে, না কোন পিরিতের মাসীরে দিছস্?
-বিশ্বাস কর। হবায় আযান দিছে। আল্লারকীরা ফেরেশতারা দুইন্যাইত নাইম্যা আইতাছে। অহন বেহেশ্তী সময়। মিছা কথা কই নাই।
-আইছে ঘুমা।
কদমা তার কম্বলের বাড়তি অংশের একাংশ ছাড় দেয় কালার জন্য। কমলাপুর রেলস্টেশনের পার্শ্বে শেষ মাথায় সারি সারি মানব সন্তানের রাত্রি যাপন। কপাল তাদের ভাল। গত রাতে কারা যেন তার ছালা ভরা গায়ে কম্বল ফেলে গেছে সাথে ছিল টেলিভিশন ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। কদমার ভাগেও একখান পড়ছে। বড় ওম কম্বলের লোমের মধ্যে। শান্তিতে রাত পার করলো। কুয়াশা ঘিরে আছে খোলা স্টেশন। খুব উঁচু সাপের ফনা মার্কা স্টেশনের ছাদ। ঠাণ্ডা কুয়াশা শা-শা করে তেরছা বাঁকে ঢুকে যায় নাকের মধ্যে। আল্লার কাছে দোয়া করে কম্বল দাতার জন্য। কোন সময় কালা তার কম্বলে ঢুকেছে টের পায়নি। আস্তে আস্তে যখন কম্বলের ভাগ টানতে থাকে, তখনি টের পায়। ভোর হতে কু-উ-উ ঘটাং ঘটাং করে রেলগাড়ি ঢুকে পড়ে স্টেশনে। পাবলিকের হৈ হুল্লোড় আর পুলিশের প্যাদানি খেয়ে তখন ছুটতে হয়। আবার গিয়ে ঘুম দিবে ফুটপাতে।
ডিসেম্বরের শেষ, পৌষের মাঝামাঝি। কদম বছর তিনেক আগে মার সাথে ঢাকা এসেছিল। তখন তার বয়স চার পাঁচ বছর হবে। কমলাপুরে বস্তীতে মা ঘর নেয়। ছেলে আর মায়ের সংসার। দক্ষিণ কমলাপুর এক মেসে মা কাজ করতো। বাপ তো মাকে তালাক দিয়েই সরে গেল।
মাঝেমধ্যে দেখতো কমলাপুর ব্রিজের নিচে লেংড়া ফকিরটার সাথে মা কি যেন কথা বলতো অনেক সময় ধরে। দূরে সরিয়ে রাখতো কদমকে। কথা শেষ হলে বলতো কদমা আয় বাজান।
একদিন রাতে মা উঠলো লেংড়া ফকিরটার ঘরে। কদম মার পিছে পিছে যায়। পরে মানুষের কাছে শোনে মা লেংড়াকে বিয়ে করেছে। পরের রাতে লেংড়া তার লাঠি দিয়ে কদমাকে দিল মার। বললো, ফাহিরনীর পুত আর আবিনা আমার ঘরে। যা ভাগ। আমার তো এক ঠ্যাং গেছে তোর দুই ঠ্যাং কাইট্যা নিমু। মা ঘরে ছিল না। তবে বুঝতে পারে সে এখন মার কাছের মানুষ। মার সোয়ামি। আর কদমা মরা বেডার পুত।
রাগে দুঃখে পালিয়ে বেড়ালো পীরজঙ্গী মাজার আর মতিঝিল। একদিন দেখা কালার সাথে। দোস্তালি হলো। সে এখন আপন জন।
কোন সময়ে সকাল পার হয়ে নাস্তার সময় গেল টের পায়নি। টের যখন পেলো কম্বলটা গা থেকে সরে একটা রিক্সার ভাঙ্গা স্পোকের সাথে চক্কর দিয়ে যাচ্ছে রাস্তা কুড়িয়ে। দুজনে লাফ দিয়ে উঠলো। কম্বলটাকে রক্ষা করলো।
রাততো গেল আরামে। এখন কি খাবে? দুজনের কাছে কাছে আছে আট টাকা। দুই পরোটার দাম।
কম্বলটা ভাজ করে মাথায় রাখলো। দুই পারোটা খাওয়া শেষে বিনি পয়সার পানি দিয়ে পেট ভর্তি করলো।
কাজ কামতো কিছু একটা করতে অয়। ভাঙ্গারির দোকানে মাল বাছাইয়ে কাম। তারপর বান্ডিল বানানো।
কম্বল কোথায় রাখে চিন্তায় পড়ে। কম্বল নিয়ে দোকানে গেলে মহাজনের চোখ এড়াতে পারবে না। যেভাবেই হোক কম্বলটা হাত করবে।
কম্বলের কাহিনীর আগে ছিল ছেড়া বস্তা। কমলাপুর ওভার ব্রীজের কাটাতারের বেড়ায় ভেতরে ইট দিয় চেপে রাখতো।
হালার ছেড়া বস্তা! এইডাও চুরি যায়। দুইদিন গায়ে দিলোতো তিন দিনে হাওয়া। আবার আরেকজনেরটা চুরি করে। ছালা বদলের জীবন।
কম্বল মাথায় দিনের আধা শেষ। দুই দোস্ত এক সাথে চলে। কম্বল কই রাখে জায়গা পায় না। একবার ভাবে বাবুলের চা দোকানে রাখে। আবার ভাবে বাবুলকেও বিশ্বাস নাই। আবার কেউ না নিয়া যায়!
প্রায় সময় হজম করে বাবুলের নেংটা গালি। কোন মাগীর পুতে আমার চায়ের কাপ নিয়া গেলরে, আবার নাই চায়ের চামচ।
কালার উপর গোস্বা হয়। হালারপো তুইতো কামে লাইগ্যা যাইতে পারস্। আমারে না হয় একদিন খাওয়াইলি। দেহস্ আমি বিপদে। রাইতেতো আবি কুত্তার লাহান কম্বলের ভাগ নিতে।
কালার বিশ্বস্ত জবাব।
দোস্ত হারাজীবন এক লগে কাম করছি। তোরে ছাড়া যে কামে মন বহেনা।
পিরিতে কথা ফালা। খাওনের ব্যবস্থা কর, জোহরের আযান শেষে ঘণ্টা পার অইছে।
চিন্তা করিস না। আজকা ফাও মারুম। তুই খাড়া।
কথা মাটিতে পড়ার আগেই জনস্রোতে মিশে যায় কালা। কম্বলটা বগলে চেপে অপেক্ষা করে কদম। মানুষ জন যাচ্ছে- আসছে স্রোতের মতো। কাদার মধ্যে গেঁথে থাকা শুকনো লাকড়ির অস্তিত্বে কদম।
কারো গায়ে কোট প্যান্ট। গলায় টাইয়ের বাহার। কেউ চাদর গায়ে। কেউ হাফ ফুল সোয়েটার, গলায় মাফলার। চলছে বাহারি জনস্রোত রাজপথে।
পিন পিন শীত নেমে আসছে। এদিকটায় ছায়া জমে যাচ্ছে। রাস্তায় ওপারে রোদে দাঁড়ায় কদমা। কম্বলের ওম এখন তার বোগলে। হঠাৎ মনে হয় কম্বলটা একটু রোদে দিলে ভাল হতো না। আরামের ভেতর আরাম। রাস্তায় একটা গাড়ির হার্ড ব্রেক, বিরক্তিভরে ফিরে তাকায়। নেংটা পাগলটা নিত্য দিনের মতো ট্রাফিক সার্জেন্ট সেজেছে। রিক্সাসারি দুভাগ করে করে রাস্তায় মাঝে দাঁড়িয়ে। কেউ কিছু বলছেনা। এদিকে ট্রাফিক পুলিশ ও নেই।
-লাগবো নিহি বাঘরখানি?
আহ্ ডায়লগটা তার জিহ্বার আগা ভিজিয়ে দেয়। চায়ে চুবিয়ে বাখরখানি। বাখরখানিও চা খায়, কদমা বাখরখানি খায়। তিন খান বাখাখানিতে দুইকাপ চায়ের দরকার।
-হালারা ফুটপাতের চায়ের দামও বাড়ায় দিছে। কদমার খেদ টং দোকানের টুং টাং শব্দ শুনে।
হঠাৎ র্ধ র্ধ শোরগোল। রাস্তার মাঝে ধরা পড়ে কালা। হাতে তার কখানা পারোটা। কদমা চোখ ঘুরিয়ে নেয়। সে জানে এখন দৌড় দিলে তার কম্বলও যাবে মার ও খাবে। তার চেয়ে আড়ালে একটু নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়।
কদমা কম্বলটা রাখার নতুন স্থান খোঁজে। একবার ভাবে পাশের ডিপোর ওয়ালের পাশে লুকিয়ে রাখে।
নাহ্ কারো নজরে পড়ে যাবে।
হালার চোরে দেশটা ভইরা গেছে গা। কম্বল দাতাদের উদ্দেশ্যে এক তোড় গালি বর্ষণ করে। হালারা কম্বল দিতে আইছে? টেলিভিশন, ক্যামেরা লগে। ইলেকশন করবো নাকি হেরা? আবার ভাবে অহনতো ইলেকশনের মওশুমনা। তা অইলে উদ্দেশ?
ও বুঝছি, গরিরেরে দান। ছওয়াব কামাইবো আমারে বিপদে ফালায়া।
একটু পরে কালা নাকমুখ ফাটিয়ে ফিরে আসে।
-দুইচারইডা লুডির লাইগ্যা এমন মাইর। দশটেকার মাল। অহন ডাক্তার-অসুধ -বড়ি শ’ টেকার।
-দুর অষুদ বড়ি লাগবো না। ল’ চল অন্য পথে। দেখি দোস্ত বাতেনেরে মতিঝিলে পাইলে দশবিশ টেকা পাওন যাইবো।
কদম বলে, কালা তুই খাড়া। আইতাছি।
কালা পাশের লাইট পোস্টটায় হেলান দিয়ে রোদ পোহায়। বাম হাতে অনুমান করে আঘাতের অস্তিত্ব। নাকের ভেতর থেকে একদলা রক্ত আঙ্গুলে তুলে চোখের সামনে ধরে। নিজেকেই শালা বলে গালি দিকে তাকায় রেস্তোরার দিকে। কদমা ফিরে আসে একটু পর। বগলের নিচে কম্বলটা নেই। ডান হাতে মেলে ধরে পঞ্চাশ টাকার দুটো লাল নোট। মুখের হাসিটি অনেকক্ষণ ধরে রাখে কালার উদ্দেশে।