সিরাজউদ্দিন আহমেদ
আকাশের বিয়ের খবর শুনে বন্ধুরা বিস্মিত হলো। বন্ধুদের জমজমাট আড্ডা এই একটি সংবাদে থমকে গেল। বরং বলা ভালো চমকে গেল। সংবাদটি সুসংবাদ না দুঃসংবাদ, বন্ধুরা বুঝে উঠতে পারছে না।
আকাশ মানে আমাদের লজ্জাবতী বিয়ে করেছে? বলিস কী, আশ্চর্য!
তুই জানলি কী করে?
আসার পথে ওর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। সেই বলল।
আমাদের জানালো না?
জানালে যদি গোমর ফাঁস হয়ে যায়। সেই ভয়ে হয়তো এই গোপনীয়তা।
আহারে, কোন মেয়ের সর্বনাশ হলো কে জানে!
আমরা ভেবেছি লজ্জাবতী কোনোদিন বিয়ে করবে না। কোন মেয়ে ওকে পছন্দ করবে? ইউনিভার্সিটি জীবনে কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। কোন মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারতো না। ওকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো। সেই লজ্জাবতী কিনা আমাদের সবার আগে বিয়ে করে ফেললো।
তোরা যা-ই বলিস, লজ্জাবতীর লজ্জাটুক বাদ দিলে সব ব্যাপারে ও আমাদের সেরা। মেধায় বিত্তে সৌন্দর্যে।ভালো চাকরি করছে। নায়কের মতো দেখতে।
বল নায়িকাদের মতো সুন্দরী। লাজুকলতা লজ্জাবতী। যে পুরুষ মানুষের পুরুষত্ব নেই, মেয়েদের মতো চালচলন সে আবার পুরুষ নাকি?
ওতো হিজড়া। ওর জীবন ষোল আনা মিছে।
কয়েক মাস যেতে দে। গোমড় যখন ফাঁস হবে- দেখবি আকাশের জীবনও ফাঁক হয়ে যাবে। পাখি
খাঁচা ছেড়ে পালাবে। নারীর মন ভেজাতে পুরুষের আসল জিনিস দরকার। ওটা না থাকলে ভালো চাকরি আর হিরোর মতো চেহারা দিয়ে ধরে রাখা যায় না বন্ধু।
আমারও তাই মনে হয়। বিয়ের আগে মেয়েটির হয়তো লজ্জাবতীর সঙ্গে আলাপ করার কোনো সুযোগ হয়নি। ভালো চাকরি গাড়ি বাড়ি দেখে পাত্র হাতছাড়া করেনি মেয়ের বাবা মা। যখন জানাজানি হবে নিশ্চিত ডিভোর্স।
আকাশ অনেকক্ষণ ধরে লাবণ্যকে দেখছে। দেখে দেখে আশ মেটে না। চোখের পলক পড়ে না। লাবণ্য কি স্বর্গের অপ্সরী? ভুল করে পৃথিবীতে নেমে এসেছে? ভুল ভাঙলে তাকে ছেড়ে পৃথিবী ছেড়ে আবার সে স্বর্গালোকে ফিরে যাবে? আকাশের অন্তর কেঁপে ওঠে। আকাশ নিজের ভেতর নিমগ্ন থেকে মগ্ন স্বরে ডাকল, কলাবতী... কলাবতী...
লাবণ্য ঘাড় ফেরাল, কাকে ডাকছো?
তোমাকে।
আমি লাবণ্য। কলাবতী নই।
তুমি আমার কলাবতী।
না। আমি লাবণ্য। আমার নাম আমার পরিচয়। অন্য কোনো নামে আমাকে ডেকো না। আমার নামে
ডাকো। সাড়া পাবে।
লাবণ্য।
এইতো আমি। তোমার সীমানায়। বলো, কী চাও?
আমি যা চাই তুমি তাই দেবে?
যদি আমার সাধ্যে কুলোয়।
আমার ভেতর দ্বিধা। সবাই আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করে। তুমি আমায় ভালবাসো?
ভালবাসা মুখ ফুটে বলতে হয় না। অনুভবের গভীরে সে ধরা দেয়। আমার স্বপ্নে জাগরণে কর্মে,
আমার প্রতি রোমকূপে কূপে তোমার ভালবাসার অনুরণন ক্ষণে ক্ষণে বেজে ওঠে। যা আমার সুন্দর জীবনের প্রেরণা। আমার অনুভব। তুমি?
আমার হৃদয় বীণায় তোমার ভালবাসার মধুর আলাপ শুনতে পাই। আমি আনন্দে স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। তখন আমার ভেতর জেগে ওঠে শঙ্কা।
কেন?
আমার চোখের দিকে তাকাও।
তোমার চোখে জল কেন?
তুমি এতো সুন্দর কেন?
ওমা, এটা কোন ধরনের প্রশ্ন!
তুমি এতো সুন্দর যে আমি স্পর্শ করতে পারি না।
সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি। যদি ভেঙে যাও। তোমাকে ছোঁয়া মাত্র হারিয়ে যাও। তুমি হারিয়ে গেলে আমি কী নিয়ে বাঁচবো, বলো? তোমাকে হারাতে চাই না। সোনার খাঁচায় তোমাকে আটকে রাখবো। তুমি পালাতে পারবে না। আমি দিবানিশি প্রাণ ভরে তোমাকে দেখবো। তোমার কোনো অভাব থাকবে না। আমার মেধা যশ সম্পদ সব তোমার। শুধু আমার স্পর্শ তুমি পাবে না। একমাস আমাদের বিয়ে হয়েছে। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে এখনো তোমাকে স্পর্শ করিনি। আমার চোখের জল তোমাকে স্পর্শ না করতে পারার বেদনা।
লাবণ্যের চোখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। তাঁর শরীর থেকে খস পড়ল একে একে সকল বস্ত্র। নতমুখী আকাশের মুখোমুখি প্রার্থনার ভঙ্গিতে লাবণ্য বসল। প্রায়ান্ধকার সুবাসিত ঘরে দূর অতীত থেকে ভেসে এলো নারীর কণ্ঠস্বর। যেন লাবণ্য নয়, কথা বলছে স্বর্গের কোন অপ্সরী-
আমার জীবন-যৌবন সৌন্দর্য, তেইশ বছর ধরে জমানো আমার স্বপ্ন আনন্দ, প্রেম ভালবাসা, লজ্জা ঘৃণা, আমার যা কিছু অর্জন সব আজ তোমার। গ্রহণ করো, প্রিয়তম। গ্রহণ করে আমায় ভারমুক্ত করো।
আকাশ তাকাতে পারে না। তাকালে ভস্ম হয়ে যাবে। এ কোন প্রলয় জাগছে অন্তরে! ঘামছে। শরীর কাঁপছে। ভূমিকম্প হচ্ছে। আকাশ ভয়ে মাটি আঁকড়ে ধরলো।
প্রিয়তম, আমার চোখে তাকাও। আমার নৈবেদ্য গ্রহণ করো। আমাকে ছোঁয়া মাত্র তোমার সব ভয় কেটে যাবে। জেগে উঠবে তোমার দীপ্ত পৌরুষ।
অনন্ত পিপাসা। আমি তোমায় দেবো পিপাসার জল। তুমি আমায় দেবে স্বপ্নের বীজ। আমার ভেতর নির্মাণ হবে ভবিষ্যত। আমরা হবো আমাদের।
আকাশের ভেতর ঝড় উঠেছে। প্রলয়ের ডংকা বাজছে। কী তীক্ষ্ণ তীব্র নিষ্ঠুর সৌন্দর্য! তাকানো যায় না। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে সর্বগ্রাসী তৃষ্ণার আগুন। প্রভু রক্ষা করো, শুদ্ধ করো, মুক্তি দাও।
লাবণ্য আরও নিবিড় হলো, বেশতো, আমি তোমায় স্পর্শ করি। তোমার যাতনা কমবে। স্বপ্ন জাগবে। তীব্র আনন্দে প্লাবিত হবে দেহমন। প্রশান্তির বৃষ্টি নামবে চেতনা জুড়ে। এসো প্রিয়তম।
চাতক পাখির মতো লাবণ্যের তৃষ্ণার্ত ঠোঁট সবেগে উঠে এলো আকাশমুখী। দুবাহু বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলো আকাশের কণ্ঠ। চুম্বকের মতো টেনে নিল আকাশের ভীতু কামুক ওষ্ঠ। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে এলো প্রলয়ঙ্করী এক অগ্নিপুরুষ। নব আনন্দে নব জন্ম হলো তাঁর।
কাজের ছেলেটি এসে বলল, মামা, আপনার বন্ধুরা এসেছে।
আকাশ ভীতসন্ত্রস্ত চোখে লাবণ্যের দিকে তাকাল। লাবণ্যের হাসিমাখা মুখে অভয়ের বাণী।
বলল, তুমি বন্ধুদের মুখোমুখি হবে।
আকাশ শংকিত হয়ে বলল, তুমি ওদের জানো না। দুষ্ট প্রকৃতির ওরা। খুব খারাপ খারাপ কথা বলে। এতদিন সহ্য করেছি। তোমার সামনে অপমান সইতে পারবো না।
কে তোমাকে সইতে বলেছে? কেন সইবে? ওরা যেভাবে যে ভাষায় কথা বলবে, তুমি ঠিক সেই ভাষায় সেই ভাবে উত্তর দেবে। তুমি ভয় পাবে না।
তোমার সঙ্গে আমি আছি। মনে রাখবে তুমি ওদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। দেখবে, আজ তোমার বন্ধুরা তোমাকে ভয় পাবে।
লাবণ্যকে দেখে আকাশের চার সহপাঠী চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেলো। তাঁরা কি জেগে আছে, নাকি স্বপ্ন দেখছে? এ যে ঐশ্বরিয়া! বিধাতা এ তোমার কেমন খেলা, কার হাতে কাকে সঁপেছো!
কিরে, চুপিচুপি বিয়ে করলি। আমাদের জানালি না?
আকাশ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, হঠাৎ হয়ে গেল তো। ফ্যামিলি মেম্বার ছাড়া কাউকে বলতে পারি নাই।
বুঝিরে বুঝি, সবই বুঝি। ফাঁস হওয়ার ভয়ে আমাদের দাওয়াত করস নাই। একদিন তো ফাঁস হবেই। সত্য কখনো গোপন থাকে না, বুঝলি।
ওরা ভেবেছিল এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার একটি দৃশ্য দেখতে পাবে। আকাশ ভয়ে আতংকে ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। কথা জড়িয়ে যাবে, তোঁৎলাতে থাকবে। ওদের দিকে বার বার সকাতর নয়নে করুণা ভিক্ষা করবে। প্রকাশ্য জনারণ্যে বিবস্ত্র হয়ে পড়ছে মনে করে প্যান্ট চেপে আকাশ ঘর ছেড়ে পালাবে। আর লাবণ্য পরম আগ্রহে জানতে চাইবে লজ্জাবতীর ইতিহাস, সেটা আবার কী? তখনই সব ফাঁস হয়ে যাবে।
বাস্তবে আগের মতো কিছুই ঘটলো না। আকাশ ভয় পেল না। লজ্জা পেল না। রাগও করলো না।
করুণার সঙ্গে বন্ধুদের দিকে তাকাল। মৃদু হেসে নরম গলায় বলল, লাবণ্য জানে তো।
লাবণ্য বলল, আকাশ আমাকে সব বলেছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আপনারা ওকে আদর করে লজ্জাবতী নামে ডাকতেন।
চার বন্ধু হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অস্বস্তি বোধ করছে। আকাশ কিংবা লাবণ্য কারো দিকে তাকাতে পারছে না। যে পুরুষ মাটির সঙ্গে কথা বলে পথ চলে, কোনো নারী তাকে জয় করতে পারেনি। সেই অসাধ্য সাধন করেছি আমি। আকাশকে আমি জয় করেছি।
চার বন্ধু চমকে তাকায়, বিয়ের আগে আকাশের সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল?
প্রেম ছিল তিন বছর ধরে।
ওদের মুখে কোনো কথা জোগায় না। সব কথা হারিয়ে গেছে। উসখুস করে। দরজার দিকে বার বার ফিরে তাকায়। একজন মিনমিনে গলায় বলল, আকাশের সৌভাগ্যে আমরা গর্বিত, ভাবি।
এখন আপনি আমাদের শেষ ভরসা।
সে কেমন?
আপনার বান্ধবীদের সঙ্গে আমাদের আলাপ পরিচয় করিয়ে দিন। আমরা তো এতিম হয়ে গেছি।
কেন, প্রেমিকা গার্লফ্রেন্ড নেই?
ছিল। এখন নেই। আমরা সবাই ব্যর্থ। দুবার থেকে চারবার। আপনাদের মতো বিজয়ী হতে পারিনি।
আবার যে বিজয়ী হবেন তার কোনো নিশ্চয়তা আছে?
আপনি আমাদের বিজয়ীর সূত্র ধরিয়ে দেবেন।
বেশ। অধিকাংশ তরুণীর স্বামী হিসেবে প্রথম পছন্দ লাজুক পুরুষ। এর গূঢ় রহস্য আমি জানি,
তরুণীরাও জানে। তরুণীদের হৃদয় জয় করতে আপনাদের প্রথম লেসন, দেহ-মনে লজ্জাবতী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। বন্ধুরা হাসাহাসি করবে, কিন্তু আপনার কাজ হবে দৃপ্ত প্রতিজ্ঞায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া।
চার বন্ধু পরস্পরের দিকে তাকাল। তারা কেউ লাবণ্যের দিকে তাকাতে পারলো না। গোপন চোখে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ যেমন আগে ওদের দিকে তাকাতো। মাটির দিকে নতমুখী দৃষ্টি রেখে একে একে ওরা বেরিয়ে গেল।
পেছন থেকে লাবণ্য মধুর কণ্ঠে ডাকল, লজ্জাবতী।
ওরা ডাক শুনলো। ফিরে তাকাতে পারলো না।
লজ্জা করতে লাগলো।
সিরাজউদ্দিন আহমেদ
বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১
আকাশের বিয়ের খবর শুনে বন্ধুরা বিস্মিত হলো। বন্ধুদের জমজমাট আড্ডা এই একটি সংবাদে থমকে গেল। বরং বলা ভালো চমকে গেল। সংবাদটি সুসংবাদ না দুঃসংবাদ, বন্ধুরা বুঝে উঠতে পারছে না।
আকাশ মানে আমাদের লজ্জাবতী বিয়ে করেছে? বলিস কী, আশ্চর্য!
তুই জানলি কী করে?
আসার পথে ওর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। সেই বলল।
আমাদের জানালো না?
জানালে যদি গোমর ফাঁস হয়ে যায়। সেই ভয়ে হয়তো এই গোপনীয়তা।
আহারে, কোন মেয়ের সর্বনাশ হলো কে জানে!
আমরা ভেবেছি লজ্জাবতী কোনোদিন বিয়ে করবে না। কোন মেয়ে ওকে পছন্দ করবে? ইউনিভার্সিটি জীবনে কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। কোন মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারতো না। ওকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো। সেই লজ্জাবতী কিনা আমাদের সবার আগে বিয়ে করে ফেললো।
তোরা যা-ই বলিস, লজ্জাবতীর লজ্জাটুক বাদ দিলে সব ব্যাপারে ও আমাদের সেরা। মেধায় বিত্তে সৌন্দর্যে।ভালো চাকরি করছে। নায়কের মতো দেখতে।
বল নায়িকাদের মতো সুন্দরী। লাজুকলতা লজ্জাবতী। যে পুরুষ মানুষের পুরুষত্ব নেই, মেয়েদের মতো চালচলন সে আবার পুরুষ নাকি?
ওতো হিজড়া। ওর জীবন ষোল আনা মিছে।
কয়েক মাস যেতে দে। গোমড় যখন ফাঁস হবে- দেখবি আকাশের জীবনও ফাঁক হয়ে যাবে। পাখি
খাঁচা ছেড়ে পালাবে। নারীর মন ভেজাতে পুরুষের আসল জিনিস দরকার। ওটা না থাকলে ভালো চাকরি আর হিরোর মতো চেহারা দিয়ে ধরে রাখা যায় না বন্ধু।
আমারও তাই মনে হয়। বিয়ের আগে মেয়েটির হয়তো লজ্জাবতীর সঙ্গে আলাপ করার কোনো সুযোগ হয়নি। ভালো চাকরি গাড়ি বাড়ি দেখে পাত্র হাতছাড়া করেনি মেয়ের বাবা মা। যখন জানাজানি হবে নিশ্চিত ডিভোর্স।
আকাশ অনেকক্ষণ ধরে লাবণ্যকে দেখছে। দেখে দেখে আশ মেটে না। চোখের পলক পড়ে না। লাবণ্য কি স্বর্গের অপ্সরী? ভুল করে পৃথিবীতে নেমে এসেছে? ভুল ভাঙলে তাকে ছেড়ে পৃথিবী ছেড়ে আবার সে স্বর্গালোকে ফিরে যাবে? আকাশের অন্তর কেঁপে ওঠে। আকাশ নিজের ভেতর নিমগ্ন থেকে মগ্ন স্বরে ডাকল, কলাবতী... কলাবতী...
লাবণ্য ঘাড় ফেরাল, কাকে ডাকছো?
তোমাকে।
আমি লাবণ্য। কলাবতী নই।
তুমি আমার কলাবতী।
না। আমি লাবণ্য। আমার নাম আমার পরিচয়। অন্য কোনো নামে আমাকে ডেকো না। আমার নামে
ডাকো। সাড়া পাবে।
লাবণ্য।
এইতো আমি। তোমার সীমানায়। বলো, কী চাও?
আমি যা চাই তুমি তাই দেবে?
যদি আমার সাধ্যে কুলোয়।
আমার ভেতর দ্বিধা। সবাই আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করে। তুমি আমায় ভালবাসো?
ভালবাসা মুখ ফুটে বলতে হয় না। অনুভবের গভীরে সে ধরা দেয়। আমার স্বপ্নে জাগরণে কর্মে,
আমার প্রতি রোমকূপে কূপে তোমার ভালবাসার অনুরণন ক্ষণে ক্ষণে বেজে ওঠে। যা আমার সুন্দর জীবনের প্রেরণা। আমার অনুভব। তুমি?
আমার হৃদয় বীণায় তোমার ভালবাসার মধুর আলাপ শুনতে পাই। আমি আনন্দে স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। তখন আমার ভেতর জেগে ওঠে শঙ্কা।
কেন?
আমার চোখের দিকে তাকাও।
তোমার চোখে জল কেন?
তুমি এতো সুন্দর কেন?
ওমা, এটা কোন ধরনের প্রশ্ন!
তুমি এতো সুন্দর যে আমি স্পর্শ করতে পারি না।
সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি। যদি ভেঙে যাও। তোমাকে ছোঁয়া মাত্র হারিয়ে যাও। তুমি হারিয়ে গেলে আমি কী নিয়ে বাঁচবো, বলো? তোমাকে হারাতে চাই না। সোনার খাঁচায় তোমাকে আটকে রাখবো। তুমি পালাতে পারবে না। আমি দিবানিশি প্রাণ ভরে তোমাকে দেখবো। তোমার কোনো অভাব থাকবে না। আমার মেধা যশ সম্পদ সব তোমার। শুধু আমার স্পর্শ তুমি পাবে না। একমাস আমাদের বিয়ে হয়েছে। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে এখনো তোমাকে স্পর্শ করিনি। আমার চোখের জল তোমাকে স্পর্শ না করতে পারার বেদনা।
লাবণ্যের চোখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। তাঁর শরীর থেকে খস পড়ল একে একে সকল বস্ত্র। নতমুখী আকাশের মুখোমুখি প্রার্থনার ভঙ্গিতে লাবণ্য বসল। প্রায়ান্ধকার সুবাসিত ঘরে দূর অতীত থেকে ভেসে এলো নারীর কণ্ঠস্বর। যেন লাবণ্য নয়, কথা বলছে স্বর্গের কোন অপ্সরী-
আমার জীবন-যৌবন সৌন্দর্য, তেইশ বছর ধরে জমানো আমার স্বপ্ন আনন্দ, প্রেম ভালবাসা, লজ্জা ঘৃণা, আমার যা কিছু অর্জন সব আজ তোমার। গ্রহণ করো, প্রিয়তম। গ্রহণ করে আমায় ভারমুক্ত করো।
আকাশ তাকাতে পারে না। তাকালে ভস্ম হয়ে যাবে। এ কোন প্রলয় জাগছে অন্তরে! ঘামছে। শরীর কাঁপছে। ভূমিকম্প হচ্ছে। আকাশ ভয়ে মাটি আঁকড়ে ধরলো।
প্রিয়তম, আমার চোখে তাকাও। আমার নৈবেদ্য গ্রহণ করো। আমাকে ছোঁয়া মাত্র তোমার সব ভয় কেটে যাবে। জেগে উঠবে তোমার দীপ্ত পৌরুষ।
অনন্ত পিপাসা। আমি তোমায় দেবো পিপাসার জল। তুমি আমায় দেবে স্বপ্নের বীজ। আমার ভেতর নির্মাণ হবে ভবিষ্যত। আমরা হবো আমাদের।
আকাশের ভেতর ঝড় উঠেছে। প্রলয়ের ডংকা বাজছে। কী তীক্ষ্ণ তীব্র নিষ্ঠুর সৌন্দর্য! তাকানো যায় না। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে সর্বগ্রাসী তৃষ্ণার আগুন। প্রভু রক্ষা করো, শুদ্ধ করো, মুক্তি দাও।
লাবণ্য আরও নিবিড় হলো, বেশতো, আমি তোমায় স্পর্শ করি। তোমার যাতনা কমবে। স্বপ্ন জাগবে। তীব্র আনন্দে প্লাবিত হবে দেহমন। প্রশান্তির বৃষ্টি নামবে চেতনা জুড়ে। এসো প্রিয়তম।
চাতক পাখির মতো লাবণ্যের তৃষ্ণার্ত ঠোঁট সবেগে উঠে এলো আকাশমুখী। দুবাহু বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলো আকাশের কণ্ঠ। চুম্বকের মতো টেনে নিল আকাশের ভীতু কামুক ওষ্ঠ। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে এলো প্রলয়ঙ্করী এক অগ্নিপুরুষ। নব আনন্দে নব জন্ম হলো তাঁর।
কাজের ছেলেটি এসে বলল, মামা, আপনার বন্ধুরা এসেছে।
আকাশ ভীতসন্ত্রস্ত চোখে লাবণ্যের দিকে তাকাল। লাবণ্যের হাসিমাখা মুখে অভয়ের বাণী।
বলল, তুমি বন্ধুদের মুখোমুখি হবে।
আকাশ শংকিত হয়ে বলল, তুমি ওদের জানো না। দুষ্ট প্রকৃতির ওরা। খুব খারাপ খারাপ কথা বলে। এতদিন সহ্য করেছি। তোমার সামনে অপমান সইতে পারবো না।
কে তোমাকে সইতে বলেছে? কেন সইবে? ওরা যেভাবে যে ভাষায় কথা বলবে, তুমি ঠিক সেই ভাষায় সেই ভাবে উত্তর দেবে। তুমি ভয় পাবে না।
তোমার সঙ্গে আমি আছি। মনে রাখবে তুমি ওদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। দেখবে, আজ তোমার বন্ধুরা তোমাকে ভয় পাবে।
লাবণ্যকে দেখে আকাশের চার সহপাঠী চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেলো। তাঁরা কি জেগে আছে, নাকি স্বপ্ন দেখছে? এ যে ঐশ্বরিয়া! বিধাতা এ তোমার কেমন খেলা, কার হাতে কাকে সঁপেছো!
কিরে, চুপিচুপি বিয়ে করলি। আমাদের জানালি না?
আকাশ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, হঠাৎ হয়ে গেল তো। ফ্যামিলি মেম্বার ছাড়া কাউকে বলতে পারি নাই।
বুঝিরে বুঝি, সবই বুঝি। ফাঁস হওয়ার ভয়ে আমাদের দাওয়াত করস নাই। একদিন তো ফাঁস হবেই। সত্য কখনো গোপন থাকে না, বুঝলি।
ওরা ভেবেছিল এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার একটি দৃশ্য দেখতে পাবে। আকাশ ভয়ে আতংকে ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। কথা জড়িয়ে যাবে, তোঁৎলাতে থাকবে। ওদের দিকে বার বার সকাতর নয়নে করুণা ভিক্ষা করবে। প্রকাশ্য জনারণ্যে বিবস্ত্র হয়ে পড়ছে মনে করে প্যান্ট চেপে আকাশ ঘর ছেড়ে পালাবে। আর লাবণ্য পরম আগ্রহে জানতে চাইবে লজ্জাবতীর ইতিহাস, সেটা আবার কী? তখনই সব ফাঁস হয়ে যাবে।
বাস্তবে আগের মতো কিছুই ঘটলো না। আকাশ ভয় পেল না। লজ্জা পেল না। রাগও করলো না।
করুণার সঙ্গে বন্ধুদের দিকে তাকাল। মৃদু হেসে নরম গলায় বলল, লাবণ্য জানে তো।
লাবণ্য বলল, আকাশ আমাকে সব বলেছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আপনারা ওকে আদর করে লজ্জাবতী নামে ডাকতেন।
চার বন্ধু হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অস্বস্তি বোধ করছে। আকাশ কিংবা লাবণ্য কারো দিকে তাকাতে পারছে না। যে পুরুষ মাটির সঙ্গে কথা বলে পথ চলে, কোনো নারী তাকে জয় করতে পারেনি। সেই অসাধ্য সাধন করেছি আমি। আকাশকে আমি জয় করেছি।
চার বন্ধু চমকে তাকায়, বিয়ের আগে আকাশের সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল?
প্রেম ছিল তিন বছর ধরে।
ওদের মুখে কোনো কথা জোগায় না। সব কথা হারিয়ে গেছে। উসখুস করে। দরজার দিকে বার বার ফিরে তাকায়। একজন মিনমিনে গলায় বলল, আকাশের সৌভাগ্যে আমরা গর্বিত, ভাবি।
এখন আপনি আমাদের শেষ ভরসা।
সে কেমন?
আপনার বান্ধবীদের সঙ্গে আমাদের আলাপ পরিচয় করিয়ে দিন। আমরা তো এতিম হয়ে গেছি।
কেন, প্রেমিকা গার্লফ্রেন্ড নেই?
ছিল। এখন নেই। আমরা সবাই ব্যর্থ। দুবার থেকে চারবার। আপনাদের মতো বিজয়ী হতে পারিনি।
আবার যে বিজয়ী হবেন তার কোনো নিশ্চয়তা আছে?
আপনি আমাদের বিজয়ীর সূত্র ধরিয়ে দেবেন।
বেশ। অধিকাংশ তরুণীর স্বামী হিসেবে প্রথম পছন্দ লাজুক পুরুষ। এর গূঢ় রহস্য আমি জানি,
তরুণীরাও জানে। তরুণীদের হৃদয় জয় করতে আপনাদের প্রথম লেসন, দেহ-মনে লজ্জাবতী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। বন্ধুরা হাসাহাসি করবে, কিন্তু আপনার কাজ হবে দৃপ্ত প্রতিজ্ঞায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া।
চার বন্ধু পরস্পরের দিকে তাকাল। তারা কেউ লাবণ্যের দিকে তাকাতে পারলো না। গোপন চোখে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ যেমন আগে ওদের দিকে তাকাতো। মাটির দিকে নতমুখী দৃষ্টি রেখে একে একে ওরা বেরিয়ে গেল।
পেছন থেকে লাবণ্য মধুর কণ্ঠে ডাকল, লজ্জাবতী।
ওরা ডাক শুনলো। ফিরে তাকাতে পারলো না।
লজ্জা করতে লাগলো।