alt

সাময়িকী

সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে

বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের অনুপুঙ্খ উপস্থাপনা

মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক

: বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১

দীর্ঘ সময়, অন্তত কয়েকশ ধরে যে বন্দিত্বের অচলায়ন তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙে মুক্তির পথ তৈরি করতে বলতে গেলে পুরো জীবনটাই সংগ্রাম করেছেন বঙ্গবন্ধু। দুই দশকের বেশি সময় পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে।

তাঁর সংগ্রামের পথ ধরেই বাঙালির একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর সেই সংগ্রামের বৈশ্বিক বা মহাকালিক গুরুত্বের জায়গাটি হচ্ছে- তিনি একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে অবিশ্বাস্য মুক্তি এনে দিয়েছিলেন। হাজার বছরে প্রথম বাঙালি পেয়েছিল স্বশাসন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ।

এরপর তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করার প্রক্রিয়ায়, স্বপ্ন দেখেছিলেন দুঃখ-দারিদ্র্যপীড়িত বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বিশ্বের বুকে।

কিন্তু তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। একটি পদানত জাতির রক্তার্জিত স্বাধীনতা আরো দু’দশকের জন্য স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। যে অশুভের বিরুদ্ধে তিনি জীবনব্যাপী লড়াই করে গিয়েছিলেন, তারাই বাঙালির রাষ্ট্রের ওপর দখল কায়েম করে জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানের ইতিহাসকে অন্ধকারের আস্তর দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছে।

যদিও তারা পুরোপুরি সফল হয়নি, কিন্তু বাঙালি জাতি পিছিয়েছে। তার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ তার অভীষ্ট থেকে দূরে পড়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সার্বজনীন প্রতীক, জাতির জনকের হত্যার বিচার হয়েছে। সত্য পরিস্ফুট হতে শুরু করেছে।

আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র বিশ্বেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশ্ব সংস্থা, উচ্চ বিদ্যায়তনসমূহে তাঁকে ঘিরে নানা উদযাপন ও গবেষণা শুরু হয়েছে।

বলতে গেলে, সে হিসেবে এখনো পিছিয়ে আছে বাংলাদেশই। বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে জানার বিষয়টি রাজনৈতিক সংকীর্ণতার বাধা পেরোতে পারছে না।

যেসব গণতান্ত্রিক, মুক্তিযুদ্ধপন্থী রাজনৈতিক দল, সংগঠন তাঁকে স্মরণে রেখেছেন, তাদের বক্তব্য, বিবৃতি, আলোচনায় তাঁকে পূর্ণাঙ্গভাবে পাওয়া যায় না। কেননা তারা তাঁকে উপস্থাপন করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে, তাদের নিজস্ব নিয়মে। সেগুলোও ইতিবাচক, সন্দেহ নেই। এভাবেই এগোয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবন ও সংগ্রামের ওপর আলো ফেলার পরিসর ও অবকাশ তাদের নেই।

ধরুন, রাজনৈতিক সভায় বঙ্গবন্ধুর যে স্মরণ, তাতে তিনি শুধু জাতির পিতা, বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন, বড়জোর তিনি যে ছয় দফা দিয়েছিলেন, সে কথাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়। তাছাড়া রাজনৈতিক বক্তৃতা আমাদের এখানে রীতিনির্ভর। তার বাইরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে জানার আকাক্সক্ষাটি প্রকাশ পায় না। তাছাড়া একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বিপ্লব আর গতানুগতিক রাজনৈতিক কর্মসূচির ব্যপকতা তো এক নয় সবসময়।

তাই বঙ্গবন্ধুর জীবনকে জানার জন্য আমাদের যেতে হলো বঙ্গবন্ধুর কাছেই। তিনি যে রোজনামচা লিখে গিয়েছিলেন, তা হাতে পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হলো স্বাধীনতার পরও চার-পাঁচ দশক।

আজ এত বছর পর আমি দেখি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যারা কথা বলেন, তাঁর স্মৃতিচারণ করেন, তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরতে চান, দুয়েকজন ব্যতিক্রম বাদে তাদের অধিকাংশেরই বঙ্গবন্ধুর গোটা জীবনের ওপর যে সাধারণ জানাশোনা প্রত্যাশিত, তার পরিচয় পাওয়া যায় না। বিশেষ করে আজকের দিনে তাঁর রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব যাদের ওপর বর্তায় তাদের কাছে।

কিন্তু তাদের এ নিয়ে দোষ দেওয়া যায় না। তার কারণটাও ঐতিহাসিক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, তাঁর আদর্শের রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলো উপড়ে ফেলার পর যে বাতাবরণগুলো দিয়ে তার কীর্তিগুলোকে ঢেকে ফেলার অপচেষ্টা হয়েছিল, তার মধ্যে আমরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মিথ্যাচার যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি অতি-উৎপাদন বহু অসার আলোচনার, সেগুলোর কোনো কিছুই সফল হয়নি।

বঙ্গবন্ধু এমন এক আবেগ যাকে রুদ্ধ করা যায়নি। তবে তাকে জানার, বেশি করে জানার, গভীর করে জানার প্রয়োজন আজ আরো বেশি।

কেননা বঙ্গবন্ধুকে শুধু একটি-দুটি রাজনৈতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। তিনি রাজনৈতিকভাবে কীভাবে বিকশিত হয়েছেন, কীভাবে তাঁকে কেন্দ্র করে বাংলার রাজনীতি বিবর্তিত হয়েছে, তা জানা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অস্তিত্ব জানার মতোই অনস্বীকার্য।

কীভাবে একটি স্থানিক সমস্যার সমাধানে দায়িত্ব নেওয়া থেকে শুরু করে গোটা বিশ্বপ্রেক্ষিতে তিনি নিপীড়িত মানবমুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন, তার অপরিমেয় অভিজ্ঞানমূল্য আজ বিতর্কাতীত।

সেই প্রেক্ষিতে “সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে”, আমাদের জন্য আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে।

শিরোনামটি তাৎপর্যবহ তার সাংকেতিক যাথার্থ্যরে দিক থেকে।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে আগুন তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার চেতনায় জ্বালিয়েছিলেন তার প্রজ্জলনের ঘটনা তাঁর কিশোর জীবনেই ঘটেছিল।

এই আগুন দিয়ে তিনি দূর করেছিলেন বহু শতক ধরে চেপে থাকা পরাধীনতার অন্ধকার। তা দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন পরশাসন ও ঔপনিবেশের বুনিয়াদ।

সেই আগুনে জ্বলেছিল আলো। তাতে বাঙালি ঘৃণার ঊর্ধ্বে, এক ধরনের সাম্যবোধে, মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল জনগোষ্ঠী।

তাঁর জীবনের পুরো ঘটনাটি কাব্যরূপায়ন হয়েছে এক বইয়ের শিরোনামের কলেবরে।

কখন, কোথায়, কেন, সেই সভ্যতার, চেতনার, গণতন্ত্রের, সাম্যের, মুক্তির আকাক্সক্ষার আগুনের প্রজ্জলন, বিস্তারণ ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তার সব দিন তারিখ আমরা জানিনি, জানলেও আমাদের সুবিদিত বিস্মৃতিপরায়ণতা রয়েছে।

কিন্তু সেই সব প্রদীপ যেন ছবিরূপে, স্মৃতিরূপে, একটি প্রামাণ্যের পরিসরে বিধৃত, সংকলিত হয়েছে আইআরসির প্রতিষ্ঠান শিলালিপির এই প্রকাশনা উদ্যোগে। আজ বাংলাদেশের মানুষের বিচরণ বিশ্বময়। ধরুন, আপনার কাছে বঙ্গবন্ধুর গল্পটি কেউ জানতে চাইলো বাঙালির প্রতিনিধিরূপে আপনি রয়েছেন কোথাও। কিন্তু তাঁর ভাষণ আপনি জানেন, কিন্তু ভাষণের পথে তিনি যে বাঙালির জন্য কতবার কারাবরণ করলেন, কিংবা তার কোন কোন ভূমিকায় একেকটা বাঁকবদল সূচিত হলো, আমাদের জনপরিসরে যেগুলো জানা আছে তার বাইরেও, আপনি যদি তা না জানেন, তার গল্পটি, তার অবয়বটি পূর্ণ হলো না কিন্তু।

বঙ্গবন্ধুর ওপর সুগ্রন্থিত এই পুস্তক-অর্ঘ্যখানি বাস্তবিক একটি জাদুঘরের সমতুল্য। যেখানে বঙ্গবন্ধুর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনক্ষণ শুধু নয়, দেশ ও বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ, ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, গণমাধ্যমে তাঁর উপস্থিতি শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর আবেগ, আত্মত্যাগ ও অভিব্যক্তিসমূহও পাওয়া যায়- যা তাঁর রাজনীতি বা জীবন শুধু নয়, তাঁর দর্শন, তাঁর স্বপ্ন ও সংকল্পকেও ফুটিয়ে তোলে।

তাঁর জীবনের বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত, ঘটনার এই সংকলন ইতিহাস উপস্থাপনার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বঙ্গবন্ধুকে আরো গভীরভাবে জানার আগ্রহ তো মেটাবেই, সেই সঙ্গে তার ওপর বিদ্যাচর্চা, গবেষণার উৎস হিসেবে কাজ করবে এটি।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে

বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের অনুপুঙ্খ উপস্থাপনা

মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক

বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১

দীর্ঘ সময়, অন্তত কয়েকশ ধরে যে বন্দিত্বের অচলায়ন তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙে মুক্তির পথ তৈরি করতে বলতে গেলে পুরো জীবনটাই সংগ্রাম করেছেন বঙ্গবন্ধু। দুই দশকের বেশি সময় পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে।

তাঁর সংগ্রামের পথ ধরেই বাঙালির একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর সেই সংগ্রামের বৈশ্বিক বা মহাকালিক গুরুত্বের জায়গাটি হচ্ছে- তিনি একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে অবিশ্বাস্য মুক্তি এনে দিয়েছিলেন। হাজার বছরে প্রথম বাঙালি পেয়েছিল স্বশাসন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ।

এরপর তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করার প্রক্রিয়ায়, স্বপ্ন দেখেছিলেন দুঃখ-দারিদ্র্যপীড়িত বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বিশ্বের বুকে।

কিন্তু তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। একটি পদানত জাতির রক্তার্জিত স্বাধীনতা আরো দু’দশকের জন্য স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। যে অশুভের বিরুদ্ধে তিনি জীবনব্যাপী লড়াই করে গিয়েছিলেন, তারাই বাঙালির রাষ্ট্রের ওপর দখল কায়েম করে জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানের ইতিহাসকে অন্ধকারের আস্তর দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছে।

যদিও তারা পুরোপুরি সফল হয়নি, কিন্তু বাঙালি জাতি পিছিয়েছে। তার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ তার অভীষ্ট থেকে দূরে পড়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সার্বজনীন প্রতীক, জাতির জনকের হত্যার বিচার হয়েছে। সত্য পরিস্ফুট হতে শুরু করেছে।

আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র বিশ্বেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশ্ব সংস্থা, উচ্চ বিদ্যায়তনসমূহে তাঁকে ঘিরে নানা উদযাপন ও গবেষণা শুরু হয়েছে।

বলতে গেলে, সে হিসেবে এখনো পিছিয়ে আছে বাংলাদেশই। বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে জানার বিষয়টি রাজনৈতিক সংকীর্ণতার বাধা পেরোতে পারছে না।

যেসব গণতান্ত্রিক, মুক্তিযুদ্ধপন্থী রাজনৈতিক দল, সংগঠন তাঁকে স্মরণে রেখেছেন, তাদের বক্তব্য, বিবৃতি, আলোচনায় তাঁকে পূর্ণাঙ্গভাবে পাওয়া যায় না। কেননা তারা তাঁকে উপস্থাপন করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে, তাদের নিজস্ব নিয়মে। সেগুলোও ইতিবাচক, সন্দেহ নেই। এভাবেই এগোয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবন ও সংগ্রামের ওপর আলো ফেলার পরিসর ও অবকাশ তাদের নেই।

ধরুন, রাজনৈতিক সভায় বঙ্গবন্ধুর যে স্মরণ, তাতে তিনি শুধু জাতির পিতা, বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন, বড়জোর তিনি যে ছয় দফা দিয়েছিলেন, সে কথাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়। তাছাড়া রাজনৈতিক বক্তৃতা আমাদের এখানে রীতিনির্ভর। তার বাইরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে জানার আকাক্সক্ষাটি প্রকাশ পায় না। তাছাড়া একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বিপ্লব আর গতানুগতিক রাজনৈতিক কর্মসূচির ব্যপকতা তো এক নয় সবসময়।

তাই বঙ্গবন্ধুর জীবনকে জানার জন্য আমাদের যেতে হলো বঙ্গবন্ধুর কাছেই। তিনি যে রোজনামচা লিখে গিয়েছিলেন, তা হাতে পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হলো স্বাধীনতার পরও চার-পাঁচ দশক।

আজ এত বছর পর আমি দেখি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যারা কথা বলেন, তাঁর স্মৃতিচারণ করেন, তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরতে চান, দুয়েকজন ব্যতিক্রম বাদে তাদের অধিকাংশেরই বঙ্গবন্ধুর গোটা জীবনের ওপর যে সাধারণ জানাশোনা প্রত্যাশিত, তার পরিচয় পাওয়া যায় না। বিশেষ করে আজকের দিনে তাঁর রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব যাদের ওপর বর্তায় তাদের কাছে।

কিন্তু তাদের এ নিয়ে দোষ দেওয়া যায় না। তার কারণটাও ঐতিহাসিক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, তাঁর আদর্শের রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলো উপড়ে ফেলার পর যে বাতাবরণগুলো দিয়ে তার কীর্তিগুলোকে ঢেকে ফেলার অপচেষ্টা হয়েছিল, তার মধ্যে আমরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মিথ্যাচার যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি অতি-উৎপাদন বহু অসার আলোচনার, সেগুলোর কোনো কিছুই সফল হয়নি।

বঙ্গবন্ধু এমন এক আবেগ যাকে রুদ্ধ করা যায়নি। তবে তাকে জানার, বেশি করে জানার, গভীর করে জানার প্রয়োজন আজ আরো বেশি।

কেননা বঙ্গবন্ধুকে শুধু একটি-দুটি রাজনৈতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। তিনি রাজনৈতিকভাবে কীভাবে বিকশিত হয়েছেন, কীভাবে তাঁকে কেন্দ্র করে বাংলার রাজনীতি বিবর্তিত হয়েছে, তা জানা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অস্তিত্ব জানার মতোই অনস্বীকার্য।

কীভাবে একটি স্থানিক সমস্যার সমাধানে দায়িত্ব নেওয়া থেকে শুরু করে গোটা বিশ্বপ্রেক্ষিতে তিনি নিপীড়িত মানবমুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন, তার অপরিমেয় অভিজ্ঞানমূল্য আজ বিতর্কাতীত।

সেই প্রেক্ষিতে “সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে”, আমাদের জন্য আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে।

শিরোনামটি তাৎপর্যবহ তার সাংকেতিক যাথার্থ্যরে দিক থেকে।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে আগুন তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার চেতনায় জ্বালিয়েছিলেন তার প্রজ্জলনের ঘটনা তাঁর কিশোর জীবনেই ঘটেছিল।

এই আগুন দিয়ে তিনি দূর করেছিলেন বহু শতক ধরে চেপে থাকা পরাধীনতার অন্ধকার। তা দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন পরশাসন ও ঔপনিবেশের বুনিয়াদ।

সেই আগুনে জ্বলেছিল আলো। তাতে বাঙালি ঘৃণার ঊর্ধ্বে, এক ধরনের সাম্যবোধে, মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল জনগোষ্ঠী।

তাঁর জীবনের পুরো ঘটনাটি কাব্যরূপায়ন হয়েছে এক বইয়ের শিরোনামের কলেবরে।

কখন, কোথায়, কেন, সেই সভ্যতার, চেতনার, গণতন্ত্রের, সাম্যের, মুক্তির আকাক্সক্ষার আগুনের প্রজ্জলন, বিস্তারণ ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তার সব দিন তারিখ আমরা জানিনি, জানলেও আমাদের সুবিদিত বিস্মৃতিপরায়ণতা রয়েছে।

কিন্তু সেই সব প্রদীপ যেন ছবিরূপে, স্মৃতিরূপে, একটি প্রামাণ্যের পরিসরে বিধৃত, সংকলিত হয়েছে আইআরসির প্রতিষ্ঠান শিলালিপির এই প্রকাশনা উদ্যোগে। আজ বাংলাদেশের মানুষের বিচরণ বিশ্বময়। ধরুন, আপনার কাছে বঙ্গবন্ধুর গল্পটি কেউ জানতে চাইলো বাঙালির প্রতিনিধিরূপে আপনি রয়েছেন কোথাও। কিন্তু তাঁর ভাষণ আপনি জানেন, কিন্তু ভাষণের পথে তিনি যে বাঙালির জন্য কতবার কারাবরণ করলেন, কিংবা তার কোন কোন ভূমিকায় একেকটা বাঁকবদল সূচিত হলো, আমাদের জনপরিসরে যেগুলো জানা আছে তার বাইরেও, আপনি যদি তা না জানেন, তার গল্পটি, তার অবয়বটি পূর্ণ হলো না কিন্তু।

বঙ্গবন্ধুর ওপর সুগ্রন্থিত এই পুস্তক-অর্ঘ্যখানি বাস্তবিক একটি জাদুঘরের সমতুল্য। যেখানে বঙ্গবন্ধুর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনক্ষণ শুধু নয়, দেশ ও বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ, ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, গণমাধ্যমে তাঁর উপস্থিতি শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর আবেগ, আত্মত্যাগ ও অভিব্যক্তিসমূহও পাওয়া যায়- যা তাঁর রাজনীতি বা জীবন শুধু নয়, তাঁর দর্শন, তাঁর স্বপ্ন ও সংকল্পকেও ফুটিয়ে তোলে।

তাঁর জীবনের বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত, ঘটনার এই সংকলন ইতিহাস উপস্থাপনার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বঙ্গবন্ধুকে আরো গভীরভাবে জানার আগ্রহ তো মেটাবেই, সেই সঙ্গে তার ওপর বিদ্যাচর্চা, গবেষণার উৎস হিসেবে কাজ করবে এটি।

back to top