alt

সাময়িকী

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

বিন্দু ও বৃত্তে

খোরশেদ বাহার

: বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে লেখক (ডানে)

সমকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী (১৯৪৮-২০২১) একটি নিবেদিত প্রাণের নাম। আজ তিনি গত। তার মননে মেধায় মস্তিষ্কে স্থান করে নিয়েছিল বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলার প্রকৃতি, বাংলার নদী, জল, মাঠ, তেপান্তর বিস্তৃত বাংলার আকাশ, চন্দ্র ও সূর্য। রূপ-লাবণ্যে ভরা লাস্যময়ী বাংলার ললনা ও মাতৃরূপেন নারীরা তো ছিলই, সেই সাথে স্বপ্ন আর অংক ও জ্যামিতির যে জীবন, বিন্দু আর বৃত্তের, রাষ্ট্র আর রাজনীতির এক অভাবনীয় কারিগরি দ্রষ্টা ও স্রষ্টা তিনি। কাব্যের প্রতিভায় কলমের শীর্ষাগ্রে সহজেই তা উপস্থাপিত করে সবাইকে যিনি চমকে দিয়েছেন তার নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী।

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন আমাদের এই কবি। স্বপ্নকে উপজীব্য করে লিখেছেন বেশ কিছু গদ্য ও কবিতা। পরতে পরতে স্বপ্নের সুঘ্রাণ লেগে আছে প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে।

মিছিলে রং মিশিয়ে মোরগের ঝুটি দেখে

কুটুমের খবর করে পড়শির চালে

বিপ্লব হাত নাড়ে, যাই।

স্বপ্ন একা দেখতে হয়: স্বপ্ন একার নয়!

[স্বপ্ন ]

বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা সাধু-সন্ন্যাসীদের জন্য এ এক অমোঘ বিশ্লেষণ। নিজের জন্য নয় জীবন মানুষের জন্য- এ তথ্য বুঝে উঠবার জন্য স্বপ্নভুক সিরাজীই লিখতে পাড়েন এমন কথা- ‘পড়শীর চালে বিপ্লব হাত নাড়ে’।

মানুষের জীবনে আরও গহীনে প্রবেশ করে মনুষ্যত্বকে ঝাঁকি দিতে ভুলে যাননি কবি। মানুষের বৈসাদৃশ্যপূর্ণ জীবনের সব জটিল কুটিল দিককে সিরাজী তুলে এনেছেন কলমের ডগায় তার ভালোবাসার পঙ্ক্তিতে:

বারান্দার ঘর লাগে, দোকানের মালামাল

ইস্ত্রি হচ্ছে শার্ট ও ব্লাউজ

ভেতরের মানুষ কোথায়?

জগতের তথা এই ভূখণ্ডের বেজায় বেমানান পেশা আর নেশা অবলম্বনকারী সবার জন্যই এই বৈসাদৃশ্যময় অপরিমিত জীবনের খাপছাড়া যাপনের বিপরীতে এমন ইঙ্গিত সিরাজীকে জীবনের দর্শনগত ভাবনায় আরও বেশি বলিষ্ঠ আর সাবলীল করে তুলেছে।

পথে পথে পা রেখেছেন এই কবি। ঘাটের মাঝি, ভ্যানচালক, রিকশাওয়ালা, লঞ্চঘাটের কুলি, ঝুপড়ি ঘরের মাথায় বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাওয়া জীবনের আলেখ্য সিরাজীর অন্তর্দৃষ্টি কেড়েছে বারংবার। ভোলেননি তাদের কথাও যারা এমন করেই প্রতিদিনের অন্ন যোগাড় করে খায়, গতরে শক্তি বাড়ায় আর দিনের শেষে মেতে ওঠে খিস্তিখেউরে, রাতের নেশায়। দিনের আলোর বিপরীতে যাদের নিত্য আরাধনা অন্ধকারের জন্য, তাদের জন্যই সিরাজীর লেখা:

কাঁথার ভিতর চাঁদ তার ভিতর চর্বিওয়ালা বৃষ্টি

দশ টাকার নোটের উপর লাফায়

রেললাইন পল্টন গেলে

রাত ফর্সা গলায় গলায়।

কতটুকুইবা সময় এই রাত্রি! তা নিয়ে জীবনের আহাজারি জীবন তো নয় যেন নিজেকে ছাপিয়ে সবার জন্য, সবাইকে বাঁচিয়ে রাখার এই মহান দায়িত্বে যাদের সময় কাটে কাঁথার নিচে, সিরাজী তাদের মায়াময় চাঁদের সাথে তুলনা করেছেন। সত্যিই তা অতুলনীয়।

জীবনের এমন সব জটিল কুটিল দিকের অভিজ্ঞতাপ্রসূত জীবনদর্শনের এক মহান শ্লোক তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন প্রতিটি কবিতার ভাঁজে ভাঁজে। তিনি চাননি এমন। আমরা কেউই এমন প্রত্যশা নিয়ে সমাজে বাস করি না, করতে চাই না। কিন্তু দারুণ এই জীবনের ঘেরাটোপ, যৌবনের রসবোধ, কর্মক্লান্ত দিনের শেষে অবসন্ন সন্ধ্যা আর সিরাজীর কবিতার পঙ্ক্তি যখন মিলেমিশে একাকার- তখন দেখতে পাই তার স্বপ্নের স্বরূপ, ঘৃণা আর বেদনামাখা সে লেখায় উঠে আসে কবির অমোঘ সত্য কাহন:

স্বপ্ন হলো খুকির হাতের শ্লেট-পেন্সিল

ইচ্ছে হলেই শব্দ-অংকে করে দেবে খোলা বাড়ি

মুছে ফেলতেও লাগবে না দেরী

থুতু ও চোখের জলে।

এই তো হলো স্বপ্নের স্বরূপ-সন্ধানী কবির উপলব্ধি। তার ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে নতুন এক মাত্রা, শব্দ-অংকের মাখামাখি দ্যোতনা। এখানে বলে রাখা ভালো যে কবি হাবীবুল্লাহ্ সিরাজী পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন যন্ত্র প্রকৌশলী। জটিল অংকের হিসাব তার ভালো করেই জানা অনেক আগে থেকেই। প্রকৌশলগত লব্ধ জ্ঞানের সাথে কবিতার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন তিনি অনেক ক্ষেত্রে, বেশ সিদ্ধ হস্তে। শব্দ আর অংকের ঢাক গুড়গুড়ানি তার কবিতায় নিত্য সহচরের মতো স্থান করে নিয়েছে বেশ চমৎকারভাবে। যেমন-

বৃত্ত ও চতুর্ভুজের একই রকম রং তামাশায়

রানি গা আলগা করে দিলে

টেক্কা মারে ত্রিভুজ!

বৃত্ত, চতুর্ভুজ আর ত্রিভুজের এই যে রং-তামাশা আর টেক্কা মেরে হারজিতের অনুষঙ্গ তা কিন্তু কবিতায় বেশ মানানসই রূপেই স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু পেশাগত বাস্তবতায় বিন্দুর যে যাত্রা ও অগ্রসরমানতা তাই কিন্তু সবাইকে পথ দেখায়। বিন্দু থেকেই বৃত্ত, চতুর্ভুজ আর ত্রিভুজের জন্ম। অথচ এই অগ্রসরমানতার পথে কত না রসবোধ, কত না রং, কত না তামাশা! জীবন যেমন মিশে থাকে সময়ের সাথে, চেতনের সাথে চৈতন্যের সাথে জীবনের ধারা যদি বিন্দু হয়- সেও মিশে থাকে চলমান এক সঞ্চার পথে, কখনো ব্যাস আর ব্যাসার্ধের গোলকধাঁধায় হয়ে যায় বৃত্ত, কখনো রঙ্গলীলার নষ্ট পথে থেমে গিয়ে বারবার রং পাল্টায়, শেষে মিলে যায় জীবনের কোন এক বাঁকে। রঙিন জীবনের সাজঘরে ততক্ষণে চতুর্ভুজের পরিভ্রমণ সমাপ্ত বিন্দুর জীবনে।

মাঝপথে হারিয়ে গেলে রূপ-রস, এমনকি যৌবনের যেই আবেগ রসে দ্রুত বিন্দু ঘরে ফেরে সংক্ষিপ্ত পথে- ত্রিভুজের আদলে, এ তার সহজ পরিভ্রমণের টেক্কা মেরে চলা। এইসব শাব্দিক জ্যামিতিক ব্যাখ্যাকে কী অবলীলায় কবিতায় ঠাঁই করে দিয়েছেন কঠিন জ্যামিতিকে কবিতার চরম অনুষঙ্গ করে। এ কেবল তারই মেধার অনন্য এক রূপদক্ষ কারিগরের পক্ষেই সম্ভব।

কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী কল্পনার জালকে বিস্তৃত করতে চেয়েছেন জটিল গণিতের ঘেরাটোপ অবধি। শিকার করে আনতে চেয়েছেন কল্পনাপ্রসূত দু’চারটি বাস্তবতা যা জীবনকে আরও সিদ্ধ করে ঋদ্ধ করে

শুধু জ্যামিতি নয়, সংখ্যাতত্ত্ব আর সরল অংক নিয়েও সিরাজী মাতামাতি করেছেন কবিতার পঙ্ক্তিমালায়। তা সাধারণের জন্য দুর্বোধ্য কিংবা দুরূহ হলেও রসবোধের জায়গায় তা অনন্য।

জীবনদর্শনের এক পিঠে যদি কবিতা থাকে- তবে অন্য পিঠে নিঃসন্দেহে অংক তা সরলই হোক আর জটিল কোনো গাণিতিক সমস্যাই হোক। কল্পনা আর বাস্তবতার এ এক চরম সহাবস্থান। তাই কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী কল্পনার জালকে বিস্তৃত করতে চেয়েছেন জটিল গণিতের ঘেরাটোপ অবধি। শিকার করে আনতে চেয়েছেন কল্পনাপ্রসূত দু’চারটি বাস্তবতা যা জীবনকে আরও সিদ্ধ করে ঋদ্ধ করে। তিনি কবিতায় লিখছেন:

সরল অংকের সমাধান শূন্য হলে

উত্তরে একটি এক জুড়ে দশ করে নেয়া

অন্যদিকে যদি এক হয় তবে

দক্ষিণে একটি শূন্য দিয়ে দশই বানানো

মোদ্দাকথা এক এবং শূন্য ফলাফলে নিয়ন্ত্রণে রাখা

কী নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন কবি এই এক আর শূন্যর মারপ্যাঁচে? শূন্য একটি মহমূল্যবান সংখ্যা রীতিমত গোলকধাঁধার মতো। স্থানভেদে তার মূল্যমান অমূল্য- অর্থহীন কিংবা অসীম যত্রতত্র বিচরণ করতে পারে। কে চায় নিষ্ফল জীবনে অসীম নীরবতা! সুতরাং স্থানভেদ অতিশয় জরুরি। এই স্থানের নিয়ন্ত্রণ অবস্থানের সূদৃঢ়তাই এখানে মুখ্য। ডানে বামে শূন্য চাই অথবা অন্য কোথাও, জীবনদর্শনের এই চাওয়াপাওয়া দশদিক নিয়ন্ত্রণ করার মতো। যদি শূন্যকে ভালবেসে কাছে রাখি অনাদিকাল, করতে পারি আপন ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ তবে তো আমি শুধু সফলই নই, রাজাধিরাজও বটে। তা নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কার? শূন্যের। তাই তো মহামূল্যবান এ শূন্য সংখ্যাতীতভাবেই জীবনের সমস্ত দর্শনকে ছাপিয়ে চিন্তার ওপারে অমূল্য হয়ে থাকে ধরাধামে অসীমতা সৃষ্টির এক অমোঘ নিয়ামক হয়ে। কোনো কিছুকে শূন্য দ্বারা বিভাজন করলেই তা রূপ নেবে অসীমে। অসীমত্ব, শূন্যতা আর পূর্ণতা তাই অংকের গোলকধাঁধায় নিহিত। কবি সিরাজী তারই সন্ধানে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন শূন্যতাকে, পেতে চেয়েছেন পরিপূর্ণ এক জীবন আর দৃষ্টি মেলে ধরেছেন অসীমের দিকে।

পেশাগত দক্ষতা আর কাব্যিক প্রতিভায় প্রতিভাত হয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অসীমের সন্ধানী এক দর্শনপ্রেমী কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। জীবনের এই অমোঘ সত্যকে বুকে ধারণ করে পথ চলতে চলতে হোঁচট খেয়েছেন তিনি পদে পদে। কষ্ট আর যন্ত্রণায় নীল হয়ে নিজেই নিজেকে তুলে ধরেছেন এভাবে:

আমি এক সিরাজীকে চিনতাম, সেতো বছরদু’য়েক আগে

উটের চালক হয়ে চলে গেছে মধ্য সাহারায়

এ বাড়িতে ও নামের কেউ নেই, ছিলোও না কোনওদিন

কী আশ্চর্য, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কথা বলছেন, জানেন না বুঝি

ও তো চব্বিশ না পেরুতেই “মারা গেছে চাটগাঁর নিলীমা হোটেলে”।

নিজের সঙ্গে সময়ের- তার চারপাশের বৈরিতাকে কেউ না মেনে যদি আত্মগোপনে বসত করে তার আর কি বলবার থাকে? পেশাগত জীবনের প্রারম্ভেই নিজেকে মৃত ঘোষণার মধ্যে কী যে গূঢ় অর্থ নিহিত বা তা কতটুকু তাৎপর্যময় তা কবিই জানেন। আমরা শুধু তার আক্ষেপের জায়গাটা বেশ বুঝতে পারি। সে এক চরম মানসিক দৈন্যদশায় মানবিক বিপর্যয়ের স্বরূপ। মুক্ত স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জীবনে এ এক গভীর ছেদ। তারও পরে স্বভাবের জীবন কবির আদলে বেড়ে ওঠে এক তীব্র প্রতিক্রিয়ায়। পঙ্ক্তিটি এরূপ:

রাজপথে একাত্তর ঠনঠন বাজে

এক মুঠো ভাত কিংবা একটি বুলেট

যাই হোক তরতাজা চাই

অথবা

সত্তুর উতলা করে একাত্তর, তার পরেও ভাই

আসল দুধের মজা পঁচাত্তর চেটেপুটে খাই।

রাষ্ট্রসচেতন রাজনীতিসচেতন কবির ভাবালুতা উপলব্ধি আর আবেগ একটি সময়কে ঘিরে। ফ্রেমে আবদ্ধ সে সময়কে যারা ব্যবচ্ছদ করতে চান তাদের জন্য এই দুটো পঙ্ক্তি কবির রেখে যাওয়া সম্পদের মধ্যে আমার দৃষ্টিতে শুধু অমূল্যই নয়, বরং নির্মোহ ইতিহাসের স্বরূপ উন্মোচনের একটি মহামূল্যবান ইঙ্গিত।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী শুধু কবি ছিলেন না, তাঁর গদ্যের গাঁথুনি বেশ চমৎকার। যদিও তিনি বিনীতভাবে উল্লেখ করেছেন ‘গদ্য রচনায় যে শ্রম ও মেধার প্রয়োজন, যে বিচার ও দর্শনের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক- কোনো মতেই তা আমি ধারণ করি না।’ কিন্তু আমার বিশ্লেষণ একটু ভিন্নতর। কবি গদ্য লিখেছেন বেশ মজা করে স্বাধীনভাবে স্বকীয় ধারণায় সুখপাঠ্য করে। আবার যদি স্বপ্ন নিয়ে সিরাজী ভাইয়ের ভাবনা গদ্যরূপে তুলে ধরি তা এমন- “কল্পনা আসে স্বপ্নে, ভাবনা স্বপ্নে হেসে খেলে যায়, স্বপ্নেই মিশে যায় সামর্থ্যরে পূর্ণাঙ্গ অবয়ব।”

স্বপ্ন, ভাবনা আর সামর্থ নিয়ে তাঁর এই ভাবনা পাঠককে নড়েচড়ে বসার আহ্বান জানায়। পূর্ণাঙ্গ অবয়বকে স্বপ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তাকে ভাবনা ও চেতনার কাতারে সারিবদ্ধ করার এ কবির এ আহ্বান সতত সত্য। জ্যামিতিজ্ঞ সিরাজী আবারও জীবনের অভিজ্ঞতার খোঁজে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতকে এক সুতায় গাঁথার এক অভিন্ন জরুরি সন্ধান দিয়েছেন তাঁর লেখায়। যেমন: ‘বর্তমানের সঙ্গে অতীতকে সম্পৃক্ত করে ভবিষ্যতের জন্য বলা কবির কাজ।’ তবে কি কবি সিরাজী ‘Future Teller’ হতে চেয়েছেন। হ্যাঁ। যদিও নবী ও কবির একই সংজ্ঞা, তবে আর দোষ কি এমন ভাবনায়। কিন্তু বিষয়টি জ্ঞানের ও পাঠের।

পেশাগত জীবনের সফলতা সিরাজী ভাইকে অনন্য করেছে এ কারণেই যে তিনি বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যৎকে এক সুতায় গাঁথতে চেয়েছেন বর্তমানের ডিঙ্গিতে বসে। এ আর কিছু নয় জ্যামিতিক ইন্টার পোলেশন আর এক্সট্রা পোলেশনের খেলা। আবারও মনে হয় কি সহজভাবে তার শিক্ষাগত জীবনের অংকের ধু›ধুমারকে কাজে লাগিয়ে কবিত্বে তিনি সফল হয়েছেন। এ ভাবেই তিনি বেশ জোরেশোরে হাঁক ছেড়ে বলেছেন যে স্রষ্টা ও সৃষ্টি, কবিতা ও কবি একে অন্যে লীন। আমাদের সময়গুলো আমরা সৃষ্টির ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেছি, অতিক্রম করবো মহা সৃষ্টি পর্যন্ত।

এমনটিই চেয়েছিলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। কিন্তু ধরা পড়েছেন নিজের কবিতার কাছে, নিজের সাধ-আহ্লাদ স্বপ্ন আর কথার কাছে। বলেছিলেন:

কাউকে দিইনি কথা একমাত্র মৃত্যু ছাড়া

হাত ধরে আছে মৃত্যু মায়ার শরীর

ঝরাপাতা ঘাস যেদিন ডাকবে কাছে

মাটি খুলে দেবে বুক, যে আসার আসুক

কথা ছিলো, কথা রাখা হলো-

কথার বরখেলাপ করেননি তিনি। অনেক কথা লিখবার ছিল, অনেক উপাদানও ছিল। কবির ব্যক্তিগত সাহচর্যে কাটানো দিনগুলির কথা মানসপটে ভাসছে, সুদূর প্রবাসে এক সাথে এক ঘরে রাত্রি যাপনের স্মৃতিও তাড়িত করছে কম না। বাংলার মফস্বলে চাঁদের আলো আর মাছের ঝোলের ভাগাভাগি কিংবা বরফ গলা পানীয় প্রেমে বুঁদ হয়ে থাকা ঠিকানাহীন সময়। আরও আরও কত কিছু। কিন্তু না বিশ্লেষণাত্মক জীবনের বয়ানে তা না হয় নীরবেই থাক আমার একান্ত মনে স্মৃতিগাথা হয়ে। তাই আর সে কথাগুলো বলা হলো না। ঝরা পাতার আহ্বানে, মাটির খোলা বুকে পৃথিবীর সমস্ত ভালবাসা, সৌন্দর্যের সমস্ত পিপাসা আর স্বপ্নের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে স্বপ্নভুক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর মহাপ্রয়াণ...। তাঁর অনাগত অনন্ত কাল স্রষ্টার করুণায় অনাবিল আনন্দে স্বর্গধামে কাটুক এই হোক কবির প্রতি আমাদের বিনীত শ্রদ্ধার্ঘ্য আর সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিনীত অনুরোধ।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

বিন্দু ও বৃত্তে

খোরশেদ বাহার

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে লেখক (ডানে)

বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১

সমকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী (১৯৪৮-২০২১) একটি নিবেদিত প্রাণের নাম। আজ তিনি গত। তার মননে মেধায় মস্তিষ্কে স্থান করে নিয়েছিল বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলার প্রকৃতি, বাংলার নদী, জল, মাঠ, তেপান্তর বিস্তৃত বাংলার আকাশ, চন্দ্র ও সূর্য। রূপ-লাবণ্যে ভরা লাস্যময়ী বাংলার ললনা ও মাতৃরূপেন নারীরা তো ছিলই, সেই সাথে স্বপ্ন আর অংক ও জ্যামিতির যে জীবন, বিন্দু আর বৃত্তের, রাষ্ট্র আর রাজনীতির এক অভাবনীয় কারিগরি দ্রষ্টা ও স্রষ্টা তিনি। কাব্যের প্রতিভায় কলমের শীর্ষাগ্রে সহজেই তা উপস্থাপিত করে সবাইকে যিনি চমকে দিয়েছেন তার নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী।

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন আমাদের এই কবি। স্বপ্নকে উপজীব্য করে লিখেছেন বেশ কিছু গদ্য ও কবিতা। পরতে পরতে স্বপ্নের সুঘ্রাণ লেগে আছে প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে।

মিছিলে রং মিশিয়ে মোরগের ঝুটি দেখে

কুটুমের খবর করে পড়শির চালে

বিপ্লব হাত নাড়ে, যাই।

স্বপ্ন একা দেখতে হয়: স্বপ্ন একার নয়!

[স্বপ্ন ]

বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা সাধু-সন্ন্যাসীদের জন্য এ এক অমোঘ বিশ্লেষণ। নিজের জন্য নয় জীবন মানুষের জন্য- এ তথ্য বুঝে উঠবার জন্য স্বপ্নভুক সিরাজীই লিখতে পাড়েন এমন কথা- ‘পড়শীর চালে বিপ্লব হাত নাড়ে’।

মানুষের জীবনে আরও গহীনে প্রবেশ করে মনুষ্যত্বকে ঝাঁকি দিতে ভুলে যাননি কবি। মানুষের বৈসাদৃশ্যপূর্ণ জীবনের সব জটিল কুটিল দিককে সিরাজী তুলে এনেছেন কলমের ডগায় তার ভালোবাসার পঙ্ক্তিতে:

বারান্দার ঘর লাগে, দোকানের মালামাল

ইস্ত্রি হচ্ছে শার্ট ও ব্লাউজ

ভেতরের মানুষ কোথায়?

জগতের তথা এই ভূখণ্ডের বেজায় বেমানান পেশা আর নেশা অবলম্বনকারী সবার জন্যই এই বৈসাদৃশ্যময় অপরিমিত জীবনের খাপছাড়া যাপনের বিপরীতে এমন ইঙ্গিত সিরাজীকে জীবনের দর্শনগত ভাবনায় আরও বেশি বলিষ্ঠ আর সাবলীল করে তুলেছে।

পথে পথে পা রেখেছেন এই কবি। ঘাটের মাঝি, ভ্যানচালক, রিকশাওয়ালা, লঞ্চঘাটের কুলি, ঝুপড়ি ঘরের মাথায় বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাওয়া জীবনের আলেখ্য সিরাজীর অন্তর্দৃষ্টি কেড়েছে বারংবার। ভোলেননি তাদের কথাও যারা এমন করেই প্রতিদিনের অন্ন যোগাড় করে খায়, গতরে শক্তি বাড়ায় আর দিনের শেষে মেতে ওঠে খিস্তিখেউরে, রাতের নেশায়। দিনের আলোর বিপরীতে যাদের নিত্য আরাধনা অন্ধকারের জন্য, তাদের জন্যই সিরাজীর লেখা:

কাঁথার ভিতর চাঁদ তার ভিতর চর্বিওয়ালা বৃষ্টি

দশ টাকার নোটের উপর লাফায়

রেললাইন পল্টন গেলে

রাত ফর্সা গলায় গলায়।

কতটুকুইবা সময় এই রাত্রি! তা নিয়ে জীবনের আহাজারি জীবন তো নয় যেন নিজেকে ছাপিয়ে সবার জন্য, সবাইকে বাঁচিয়ে রাখার এই মহান দায়িত্বে যাদের সময় কাটে কাঁথার নিচে, সিরাজী তাদের মায়াময় চাঁদের সাথে তুলনা করেছেন। সত্যিই তা অতুলনীয়।

জীবনের এমন সব জটিল কুটিল দিকের অভিজ্ঞতাপ্রসূত জীবনদর্শনের এক মহান শ্লোক তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন প্রতিটি কবিতার ভাঁজে ভাঁজে। তিনি চাননি এমন। আমরা কেউই এমন প্রত্যশা নিয়ে সমাজে বাস করি না, করতে চাই না। কিন্তু দারুণ এই জীবনের ঘেরাটোপ, যৌবনের রসবোধ, কর্মক্লান্ত দিনের শেষে অবসন্ন সন্ধ্যা আর সিরাজীর কবিতার পঙ্ক্তি যখন মিলেমিশে একাকার- তখন দেখতে পাই তার স্বপ্নের স্বরূপ, ঘৃণা আর বেদনামাখা সে লেখায় উঠে আসে কবির অমোঘ সত্য কাহন:

স্বপ্ন হলো খুকির হাতের শ্লেট-পেন্সিল

ইচ্ছে হলেই শব্দ-অংকে করে দেবে খোলা বাড়ি

মুছে ফেলতেও লাগবে না দেরী

থুতু ও চোখের জলে।

এই তো হলো স্বপ্নের স্বরূপ-সন্ধানী কবির উপলব্ধি। তার ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে নতুন এক মাত্রা, শব্দ-অংকের মাখামাখি দ্যোতনা। এখানে বলে রাখা ভালো যে কবি হাবীবুল্লাহ্ সিরাজী পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন যন্ত্র প্রকৌশলী। জটিল অংকের হিসাব তার ভালো করেই জানা অনেক আগে থেকেই। প্রকৌশলগত লব্ধ জ্ঞানের সাথে কবিতার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন তিনি অনেক ক্ষেত্রে, বেশ সিদ্ধ হস্তে। শব্দ আর অংকের ঢাক গুড়গুড়ানি তার কবিতায় নিত্য সহচরের মতো স্থান করে নিয়েছে বেশ চমৎকারভাবে। যেমন-

বৃত্ত ও চতুর্ভুজের একই রকম রং তামাশায়

রানি গা আলগা করে দিলে

টেক্কা মারে ত্রিভুজ!

বৃত্ত, চতুর্ভুজ আর ত্রিভুজের এই যে রং-তামাশা আর টেক্কা মেরে হারজিতের অনুষঙ্গ তা কিন্তু কবিতায় বেশ মানানসই রূপেই স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু পেশাগত বাস্তবতায় বিন্দুর যে যাত্রা ও অগ্রসরমানতা তাই কিন্তু সবাইকে পথ দেখায়। বিন্দু থেকেই বৃত্ত, চতুর্ভুজ আর ত্রিভুজের জন্ম। অথচ এই অগ্রসরমানতার পথে কত না রসবোধ, কত না রং, কত না তামাশা! জীবন যেমন মিশে থাকে সময়ের সাথে, চেতনের সাথে চৈতন্যের সাথে জীবনের ধারা যদি বিন্দু হয়- সেও মিশে থাকে চলমান এক সঞ্চার পথে, কখনো ব্যাস আর ব্যাসার্ধের গোলকধাঁধায় হয়ে যায় বৃত্ত, কখনো রঙ্গলীলার নষ্ট পথে থেমে গিয়ে বারবার রং পাল্টায়, শেষে মিলে যায় জীবনের কোন এক বাঁকে। রঙিন জীবনের সাজঘরে ততক্ষণে চতুর্ভুজের পরিভ্রমণ সমাপ্ত বিন্দুর জীবনে।

মাঝপথে হারিয়ে গেলে রূপ-রস, এমনকি যৌবনের যেই আবেগ রসে দ্রুত বিন্দু ঘরে ফেরে সংক্ষিপ্ত পথে- ত্রিভুজের আদলে, এ তার সহজ পরিভ্রমণের টেক্কা মেরে চলা। এইসব শাব্দিক জ্যামিতিক ব্যাখ্যাকে কী অবলীলায় কবিতায় ঠাঁই করে দিয়েছেন কঠিন জ্যামিতিকে কবিতার চরম অনুষঙ্গ করে। এ কেবল তারই মেধার অনন্য এক রূপদক্ষ কারিগরের পক্ষেই সম্ভব।

কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী কল্পনার জালকে বিস্তৃত করতে চেয়েছেন জটিল গণিতের ঘেরাটোপ অবধি। শিকার করে আনতে চেয়েছেন কল্পনাপ্রসূত দু’চারটি বাস্তবতা যা জীবনকে আরও সিদ্ধ করে ঋদ্ধ করে

শুধু জ্যামিতি নয়, সংখ্যাতত্ত্ব আর সরল অংক নিয়েও সিরাজী মাতামাতি করেছেন কবিতার পঙ্ক্তিমালায়। তা সাধারণের জন্য দুর্বোধ্য কিংবা দুরূহ হলেও রসবোধের জায়গায় তা অনন্য।

জীবনদর্শনের এক পিঠে যদি কবিতা থাকে- তবে অন্য পিঠে নিঃসন্দেহে অংক তা সরলই হোক আর জটিল কোনো গাণিতিক সমস্যাই হোক। কল্পনা আর বাস্তবতার এ এক চরম সহাবস্থান। তাই কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী কল্পনার জালকে বিস্তৃত করতে চেয়েছেন জটিল গণিতের ঘেরাটোপ অবধি। শিকার করে আনতে চেয়েছেন কল্পনাপ্রসূত দু’চারটি বাস্তবতা যা জীবনকে আরও সিদ্ধ করে ঋদ্ধ করে। তিনি কবিতায় লিখছেন:

সরল অংকের সমাধান শূন্য হলে

উত্তরে একটি এক জুড়ে দশ করে নেয়া

অন্যদিকে যদি এক হয় তবে

দক্ষিণে একটি শূন্য দিয়ে দশই বানানো

মোদ্দাকথা এক এবং শূন্য ফলাফলে নিয়ন্ত্রণে রাখা

কী নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন কবি এই এক আর শূন্যর মারপ্যাঁচে? শূন্য একটি মহমূল্যবান সংখ্যা রীতিমত গোলকধাঁধার মতো। স্থানভেদে তার মূল্যমান অমূল্য- অর্থহীন কিংবা অসীম যত্রতত্র বিচরণ করতে পারে। কে চায় নিষ্ফল জীবনে অসীম নীরবতা! সুতরাং স্থানভেদ অতিশয় জরুরি। এই স্থানের নিয়ন্ত্রণ অবস্থানের সূদৃঢ়তাই এখানে মুখ্য। ডানে বামে শূন্য চাই অথবা অন্য কোথাও, জীবনদর্শনের এই চাওয়াপাওয়া দশদিক নিয়ন্ত্রণ করার মতো। যদি শূন্যকে ভালবেসে কাছে রাখি অনাদিকাল, করতে পারি আপন ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ তবে তো আমি শুধু সফলই নই, রাজাধিরাজও বটে। তা নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কার? শূন্যের। তাই তো মহামূল্যবান এ শূন্য সংখ্যাতীতভাবেই জীবনের সমস্ত দর্শনকে ছাপিয়ে চিন্তার ওপারে অমূল্য হয়ে থাকে ধরাধামে অসীমতা সৃষ্টির এক অমোঘ নিয়ামক হয়ে। কোনো কিছুকে শূন্য দ্বারা বিভাজন করলেই তা রূপ নেবে অসীমে। অসীমত্ব, শূন্যতা আর পূর্ণতা তাই অংকের গোলকধাঁধায় নিহিত। কবি সিরাজী তারই সন্ধানে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন শূন্যতাকে, পেতে চেয়েছেন পরিপূর্ণ এক জীবন আর দৃষ্টি মেলে ধরেছেন অসীমের দিকে।

পেশাগত দক্ষতা আর কাব্যিক প্রতিভায় প্রতিভাত হয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অসীমের সন্ধানী এক দর্শনপ্রেমী কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। জীবনের এই অমোঘ সত্যকে বুকে ধারণ করে পথ চলতে চলতে হোঁচট খেয়েছেন তিনি পদে পদে। কষ্ট আর যন্ত্রণায় নীল হয়ে নিজেই নিজেকে তুলে ধরেছেন এভাবে:

আমি এক সিরাজীকে চিনতাম, সেতো বছরদু’য়েক আগে

উটের চালক হয়ে চলে গেছে মধ্য সাহারায়

এ বাড়িতে ও নামের কেউ নেই, ছিলোও না কোনওদিন

কী আশ্চর্য, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কথা বলছেন, জানেন না বুঝি

ও তো চব্বিশ না পেরুতেই “মারা গেছে চাটগাঁর নিলীমা হোটেলে”।

নিজের সঙ্গে সময়ের- তার চারপাশের বৈরিতাকে কেউ না মেনে যদি আত্মগোপনে বসত করে তার আর কি বলবার থাকে? পেশাগত জীবনের প্রারম্ভেই নিজেকে মৃত ঘোষণার মধ্যে কী যে গূঢ় অর্থ নিহিত বা তা কতটুকু তাৎপর্যময় তা কবিই জানেন। আমরা শুধু তার আক্ষেপের জায়গাটা বেশ বুঝতে পারি। সে এক চরম মানসিক দৈন্যদশায় মানবিক বিপর্যয়ের স্বরূপ। মুক্ত স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জীবনে এ এক গভীর ছেদ। তারও পরে স্বভাবের জীবন কবির আদলে বেড়ে ওঠে এক তীব্র প্রতিক্রিয়ায়। পঙ্ক্তিটি এরূপ:

রাজপথে একাত্তর ঠনঠন বাজে

এক মুঠো ভাত কিংবা একটি বুলেট

যাই হোক তরতাজা চাই

অথবা

সত্তুর উতলা করে একাত্তর, তার পরেও ভাই

আসল দুধের মজা পঁচাত্তর চেটেপুটে খাই।

রাষ্ট্রসচেতন রাজনীতিসচেতন কবির ভাবালুতা উপলব্ধি আর আবেগ একটি সময়কে ঘিরে। ফ্রেমে আবদ্ধ সে সময়কে যারা ব্যবচ্ছদ করতে চান তাদের জন্য এই দুটো পঙ্ক্তি কবির রেখে যাওয়া সম্পদের মধ্যে আমার দৃষ্টিতে শুধু অমূল্যই নয়, বরং নির্মোহ ইতিহাসের স্বরূপ উন্মোচনের একটি মহামূল্যবান ইঙ্গিত।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী শুধু কবি ছিলেন না, তাঁর গদ্যের গাঁথুনি বেশ চমৎকার। যদিও তিনি বিনীতভাবে উল্লেখ করেছেন ‘গদ্য রচনায় যে শ্রম ও মেধার প্রয়োজন, যে বিচার ও দর্শনের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক- কোনো মতেই তা আমি ধারণ করি না।’ কিন্তু আমার বিশ্লেষণ একটু ভিন্নতর। কবি গদ্য লিখেছেন বেশ মজা করে স্বাধীনভাবে স্বকীয় ধারণায় সুখপাঠ্য করে। আবার যদি স্বপ্ন নিয়ে সিরাজী ভাইয়ের ভাবনা গদ্যরূপে তুলে ধরি তা এমন- “কল্পনা আসে স্বপ্নে, ভাবনা স্বপ্নে হেসে খেলে যায়, স্বপ্নেই মিশে যায় সামর্থ্যরে পূর্ণাঙ্গ অবয়ব।”

স্বপ্ন, ভাবনা আর সামর্থ নিয়ে তাঁর এই ভাবনা পাঠককে নড়েচড়ে বসার আহ্বান জানায়। পূর্ণাঙ্গ অবয়বকে স্বপ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তাকে ভাবনা ও চেতনার কাতারে সারিবদ্ধ করার এ কবির এ আহ্বান সতত সত্য। জ্যামিতিজ্ঞ সিরাজী আবারও জীবনের অভিজ্ঞতার খোঁজে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতকে এক সুতায় গাঁথার এক অভিন্ন জরুরি সন্ধান দিয়েছেন তাঁর লেখায়। যেমন: ‘বর্তমানের সঙ্গে অতীতকে সম্পৃক্ত করে ভবিষ্যতের জন্য বলা কবির কাজ।’ তবে কি কবি সিরাজী ‘Future Teller’ হতে চেয়েছেন। হ্যাঁ। যদিও নবী ও কবির একই সংজ্ঞা, তবে আর দোষ কি এমন ভাবনায়। কিন্তু বিষয়টি জ্ঞানের ও পাঠের।

পেশাগত জীবনের সফলতা সিরাজী ভাইকে অনন্য করেছে এ কারণেই যে তিনি বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যৎকে এক সুতায় গাঁথতে চেয়েছেন বর্তমানের ডিঙ্গিতে বসে। এ আর কিছু নয় জ্যামিতিক ইন্টার পোলেশন আর এক্সট্রা পোলেশনের খেলা। আবারও মনে হয় কি সহজভাবে তার শিক্ষাগত জীবনের অংকের ধু›ধুমারকে কাজে লাগিয়ে কবিত্বে তিনি সফল হয়েছেন। এ ভাবেই তিনি বেশ জোরেশোরে হাঁক ছেড়ে বলেছেন যে স্রষ্টা ও সৃষ্টি, কবিতা ও কবি একে অন্যে লীন। আমাদের সময়গুলো আমরা সৃষ্টির ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেছি, অতিক্রম করবো মহা সৃষ্টি পর্যন্ত।

এমনটিই চেয়েছিলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। কিন্তু ধরা পড়েছেন নিজের কবিতার কাছে, নিজের সাধ-আহ্লাদ স্বপ্ন আর কথার কাছে। বলেছিলেন:

কাউকে দিইনি কথা একমাত্র মৃত্যু ছাড়া

হাত ধরে আছে মৃত্যু মায়ার শরীর

ঝরাপাতা ঘাস যেদিন ডাকবে কাছে

মাটি খুলে দেবে বুক, যে আসার আসুক

কথা ছিলো, কথা রাখা হলো-

কথার বরখেলাপ করেননি তিনি। অনেক কথা লিখবার ছিল, অনেক উপাদানও ছিল। কবির ব্যক্তিগত সাহচর্যে কাটানো দিনগুলির কথা মানসপটে ভাসছে, সুদূর প্রবাসে এক সাথে এক ঘরে রাত্রি যাপনের স্মৃতিও তাড়িত করছে কম না। বাংলার মফস্বলে চাঁদের আলো আর মাছের ঝোলের ভাগাভাগি কিংবা বরফ গলা পানীয় প্রেমে বুঁদ হয়ে থাকা ঠিকানাহীন সময়। আরও আরও কত কিছু। কিন্তু না বিশ্লেষণাত্মক জীবনের বয়ানে তা না হয় নীরবেই থাক আমার একান্ত মনে স্মৃতিগাথা হয়ে। তাই আর সে কথাগুলো বলা হলো না। ঝরা পাতার আহ্বানে, মাটির খোলা বুকে পৃথিবীর সমস্ত ভালবাসা, সৌন্দর্যের সমস্ত পিপাসা আর স্বপ্নের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে স্বপ্নভুক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর মহাপ্রয়াণ...। তাঁর অনাগত অনন্ত কাল স্রষ্টার করুণায় অনাবিল আনন্দে স্বর্গধামে কাটুক এই হোক কবির প্রতি আমাদের বিনীত শ্রদ্ধার্ঘ্য আর সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিনীত অনুরোধ।

back to top