পিওনা আফরোজ
এ এক অন্যরকম সন্ধ্যা। সারাদিন অফিস শেষে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। শহর চষে বেড়ানো বাসগুলো ব্যস্ততা নিয়ে ছুটে চলেছে। কখনো থামছে। ফের ছুটছে। মিলি একটি গাড়িতে উঠে বসল। বাসের সিটে শরীরটা এলিয়ে দিল। গাড়ি ছুটে চলছে, শহরের সকল ব্যস্ততা নিয়ে। বাসের কন্ড্রাক্টরের চিৎকার, গাড়ির হর্নের শব্দ, ট্রাফিক জ্যাম। তার মধ্যেও হালকা ঝিমুনি ভাব চলে আসে। চোখের পাতাগুলো বন্ধ করা বইয়ের পাতার মতো লেগে থাকে। কন্ড্্রাক্টরের চিৎকারে চোখ খুলে যায়। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় মিলি। জসীম উদ্দীন মোড়। বাস থেকে নামার সময় হলো। নীলা জসীম উদ্দীন ব্রিজ পেরিয়ে রিকশা নিলো। বাসার কাছে এসে ভাড়া দিতে গিয়েই দেখলো, ব্যাগে মোবাইল নেই।
কখন হারালো? কীভাবে হারালো? কিছুইতো টের পায়নি।
দিন দিন এই চুরি শিল্পটা বেশ নান্দনিক হচ্ছে। প্রশংসা না করে উপায় নেই। কিন্তু এই অসময়ে ফোনটা চুরি হলো। জরুরি ফোন আসার কথা। নিশ্চয়ই ফোনে না পেয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা করবে মানুষটা! এখন প্রায় রাত আটটা। মার্কেটগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া নতুন ফোন কেনার মতো সঙ্গে এতগুলো টাকাও এই মুহূর্তে নেই।
বাসায় ফিরে ব্যাগটা বিছানায় রেখেই গ্রামীণ ফোনের কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিলো মিলি।
ওপাশ থেকে পৌরুষদীপ্ত সুন্দর একটি কণ্ঠ ভেসে এলো।
হ্যালো, জ্বী বলুন। আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি ম্যাম?
আজ সন্ধ্যায় আমার ফোনটি হারিয়ে গেছে। ফোন নাম্বার ০১৭১৫৫......৭।
নাম্বারটি কি বন্ধ পাচ্ছেন?
জ্বি।
আপনার নামটি প্লিজ?
তাবাসসুম মিলি।
ঠিক আছে ম্যাম আমি দেখছি। বলেই ফোন রেখে দিলো মোহনীয় কণ্ঠের মানুষটি।
রাতে মিলির ঘুম নেই। এপাশ ওপাশ করছে। রাত বাড়তে থাকে একাকী। কিন্তু ছেলেটির কণ্ঠস্বর বারবার তার মনের কার্নিশে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। বারবার সেই কণ্ঠস্বরটি শুনতে ইচ্ছে করছে। কী অদ্ভুত এক মাদকতা যেন ছড়িয়ে রয়েছে তার কণ্ঠে। তারই রেশ ফিরে ফিরে ধরা দেয় অবচেতন মনে।
পরদিন ছিলো ছুটির দিন। শুক্রবার। সকাল দশটা বাজতেই মিলি বাড়ি থেকে বেরিযে গেলো। মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ করে বড় এ্যামাউন্ট খরচ করে কিছু কেনার মতো টাকা মিলির হাতে নেই। কিন্তু মোবাইল ফোনের মতো প্রয়োজনীয় ডিভাইস ছাড়া একদিনও চলা সম্ভব নয়। কোনো উপায় না পেয়ে শেষপর্যন্ত মিলি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে একটি ফোন কিনেই ফেললো।
বাসায় ফিরে সেদিন রাতে মিলি আবারো গ্রামীণ ফোনের কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিল। সেই ঘোর লাগা, সেই চেনা কণ্ঠস¦র।
হ্যালো, মোহিত বলছি।
কী সৌভাগ্য আমার। আপনাকে পেয়ে গেলাম। আপনার সময় হবে কিছুক্ষণ?
জ্বী, বলুন।
আমাকে চিনতে পেরেছেন?
জ্বী, তাবাসসুম মিলি।
বাহ্। আমার নাম মনে আছে আপনার?
কিছু বিষয় আপনি চান বা নাই চান, মন তার কাছে রেখেই দেয়।
আপনি তো খুব সুন্দর করে কথা বলেন।
থ্যাংক ইউ।
আমি আপনাকে বিরক্ত করছি না তো!
না।
এরপর থেকে প্রতি রাতেই মিলি আর মোহিতের কথা হতে থাকে। সেলফোনের রিং বেজে উঠলেই বুক ধড়ফড় করে। স্ক্রিনে তার নামটা ভেসে উঠলেই গলা শুকিয়ে যায়। ফোন রিসিভ করতে কেটে যায় বেশ কিছু মুহূর্ত। বাজতে বাজতে রিং যখন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম, তখন রাজ্যের সংকোচ নিয়ে বলে, ‘হ্যালো...।’
ওপাশ থেকে তখন শিশুর পবিত্র হাসির শব্দের মতো তোমার উচ্ছ্বাস ভেসে আসে।
মোহিত বলছি।
দুটি মাত্র শব্দ। অথচ ওর কণ্ঠে একটা মাধুর্য ঢেউ খেলে যায়। শব্দগুলো যেন ঢেউ এর মতো আছড়ে পড়ে মিলির বুকে। মিলি মুগ্ধ হয়ে ওর প্রতিটা কথা শোনে। রাতভর কথা হয় মোহিতের সাথে। প্রিয় গান, কিছু প্রিয় সিনেমা, ওর অফিসের গল্প, শৈশবের গল্প, জীবনের পাওয়া ন-পাওয়ার গল্প।
পরদিন আবারো একই সময়ে মোহিতের ফোন আসে। বালিশের পাশে ফোনটা রিসিভ করতেই মিলি বলল, ঘুমাননি এখনো?
না, তুমি ঘুমাওনি?
আপনি আমায় তুমি করে বলছেন কেন?
শুরুটা না হয় হয়েই যাক।
কিন্তু আমাদের তো একটা তুমি উৎসব হওয়ার কথা ছিলো। ভুলে গেলেন?
না, ভুলিনি।
তাহলে?
সবকিছু সময় বেঁধে দিয়ে হয় না। আমিও পারবো না।
কিন্তু কথা ছিলো, যেদিন আমরা প্রথম দেখা করবো, সেদিন আমরা একজন অন্যজনকে তুমি করে বলবো। আমরা তুমি শব্দটা সেলিব্রেট করবো। আর সেদিন আমাকে নির্মেলেন্দু গুণের ওই কবিতাটি শোনাবেন! মনে আছে?
হুম। মনে আছে। কিন্তু পারবো না। আমি অতো অপেক্ষা করতে পারবো না।
তাহলে ‘তুমি উৎসবটা’ আজই সেলিব্রেট হোক। কিন্তু আমারও একটি কথা রাখতে হবে।
কী কথা?
আমাকে কবিতাটা শোনাতে হবে।
ঠিক আছে, হয়ে যাক। চন্দ্রালোকে গভীর রাত ভেসে যেতে থাকে। মোহিত কবিতাটা পড়ছে, ওর সবটুকু আবেগ দিয়ে। মিলি যেন অনুভব করছে, মোহিতের বুকে মাথা রেখেই কবিতাটি শুনছে। যেমন করে চাঁদের বুকে জোছনা থাকে, আকাশের বুকে নক্ষত্র।
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দ্ইুকে আমি এক করি না
এককে করি দুই
হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি।
কবিতার প্রতিটি লাইন স্পর্শ করে মিলির হৃদয়কে। প্রিয় মানুষটি পাশে না থেকেও যেন খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে গেলো। মোহিত ও ধীরে ধীরে মিলির মাঝে হারাতে থাকে। রাত প্রায় ভোর হয়ে এলো। ভোরের পাখিরা কিচিরমিচির করছে।
এমনি করেই রাতগুলো কাটতে থাকে। মোহিতের সাথে কখনও কথা না হলে মিলি খুব অভিমান করে। ভাবেÑ মোহিত বুঝি তাকে অবহেলা করছে! কিন্তু মিলি তো জানতো না তার ফোনের অপেক্ষায় কী দুঃসহ দিন কাটে মোহিতেরও। প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় সময় কাটে সূর্য ওঠা সকাল থেকে সূর্য ডোবা সন্ধ্যা অবধি।
এর দুই দিন পরেই মিলির সাথে প্রথম দেখা মোহিতের। ধানমন্ডির এক কফি শপে। মিলিকে দেখে মোহিত রীতিমতো বিস্মিতি, বিমুগ্ধ। মিলির কথায় তার মনে হয়েছিলোÑ মিলি হয়তো কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন। কিন্তু না, মিলির সাজপোশাকে স্পষ্ট আভিজাত্যের ছাপ। নীল সালোয়ার কামিজ, দু’ভুরুর মাঝখানে ছোট নীল টিপ, কানে নীল পাথরের দুল, হাতে নীল পাথরের আংটি। সব মিলিয়ে রীতিমতো অবাক করার মতো। বয়সটা কত হতে পারে বোঝা যাচ্ছে না। কখনো মনে হচ্ছে ২৫ কখনো বা ৩০।
মিলির দিকে তাকিয়ে মোহিত বলল, আমি কি দেরি করে ফেললাম?
মোহিত জানে সে ঠিক সময়েই এসেছে, তবুও সৌজন্যবোধ বলে কিছু তো আছে।
না, না। আমি পাঁচ মিনিট আগেই ঢুকলাম। স্যান্ডউইচ আর কফির অর্ডার দিয়েছি। কী চলবেতো?
বেশ চলবে। এরপর সবকিছু খুব দ্রুতই ঘটতে থাকে।
তাদের এখন প্রায়ই দেখা হয়। কোনোদিন রেস্টুরেন্ট বা কফিশপে, কোনোদিন পার্কে। একদিন সন্ধ্যায় কোনো রেস্টুরেন্ট বা কফিশপে না গিয়ে মোহিতের বাসায় চলে এলো মিলি। ধানমন্ডির মোটামুটি বড় পরিসরের এক ফ্ল্যাটে থাকে মোহিত। তারা একসাথে সন্ধ্যার কফি খায়। বারান্দায় বসে রাতের সৌন্দর্য দেখে। ঘরের ভেতর কবীর সুমনের গান বাজে। ‘তোমায় গান শুনাবো/ তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ/ ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া / তোমায় গান শোনাব / চমক দিয়ে তাই তো ডাক/ বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক/ওগো দুখজাগানিয়া/ তোমায় গান শোনাব...।’ কিছু কিছু গান নিভৃতে প্রাণে লাগে। এই গানটি তেমনই একটি গান।
সেদিনের পর থেকে ওরা প্রায়ই বাসায় দেখা করতো আর মাঝে মাঝে চলে যেতো কোনো না কোনো রিসোর্টে। হারিয়ে যেতো প্রকৃতির নিবিড় ছায়ায়। এভাবেই কেটে যায় তিনটি মাস।
তখন এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ। ওদের সিলেটের দুসাই রিসোর্টে যাওয়ার কথা। বাসের টিকেট, হোটেল বুকিং সবকিছুই কনফার্ম। কিন্তু হঠাৎ করেই মিলি মোহিতের ফোন ধরছে না। বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে। কোনো রেসপন্স নেই। ম্যাসেজ দিচ্ছে। কোনো রিপ্লাই আসছে না । অথচ যাওয়ার মাত্র একদিন বাকি। কী হয়েছে মিলির? কোনো দুর্ঘটনা নয়তো! মিলি ভালো আছে তো? এক অজানা আশঙ্কায় মোহিতের মন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। পাগলের মতো অপেক্ষা করতে থাকে মিলির ফোনের জন্য। দিন কেটে যায় ভীষণ অস্থিরতায়। সারারাত মোহিত একটি বারের জন্যও দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি। কখনো বিছানায় শুয়ে বসে, কখনো বা ঘরে পায়চারী করে নির্ঘুম রাত পার করেছে।
পরদিন সকালে ফোনের শব্দ পেয়ে মোহিত বিছানা থেকে উঠে বসে। ফোনের স্ক্রিনে মিলির নাম। মোহিত তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিভ করে।
তুমি আমার উপর রেগে আছ?
না, রাগ হবে কেন? তবে খুব টেনশন হচ্ছিল। কী হয়েছিলো বলো তো! কাল সারাদিন কোন যোগাযোগই করোনি!
কিছুই হয় নি। যোগাযোগ করতে ইচ্ছে করেনি।
কী বলছো এসব? আচ্ছা বাদ দাও। সিলেটে যাওয়ার সব প্রিপারেশন কমপ্লিট। হাতে মাত্র ঘণ্টাখানেক সময় আছে। তাড়াতাড়ি চলে এসো।
সম্ভব না মোহিত। তোমার সাথে দেখা করা বা কথা বলা কোনোটাই আর আমার পক্ষে সম্ভব না।
তুমি মজা করছো মিলি? হাতে একেবারেই সময় নেই। তাড়াতাড়ি এসো।
স্যরি মোহিত। প্লিজ টেক ইট সিরিয়াসলি। আমি যাচ্ছি না।
কিন্তু কেন? কী হয়েছে তোমার? শরীর ভালো তো?
আমি একদম ঠিক আছি। তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো।
বেশ, বলো!
তোমাকে বলা হয় নি। আমার হাজব্যান্ড অফিসের কাজে বেশ কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলো, সেদিন মোবাইল হারানোর মধ্য দিয়ে তোমার সাথে পরিচয়। তারপর থেকে যা যা ঘটেছে তার জন্য আমি দুঃখিত। আজকের পর থেকে আর কখনো আমাদের কথা হবে না। দেখাও হবে না। তুমিও আর আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে না। ভালো থেকো। বাই। বলেই ফোনটি রেখে দেয় মিল্।ি মোহিতের উত্তরের কোনো অপেক্ষা না করেই।
অবাক, স্তব্ধ মোহিত কী করবে ভেবে পায় না। তার কি রাগ হওয়া উচিত?
না, তার রাগ হলো না। রাগ করেইবা কী লাভ? ভালোবাসা তো জোর করে পাওয়ার কিছু নয়। তাছাড়া এ কয়দিন মিলির ভালোবাসার মানুষটি কাছে ছিলো না। একটা জায়গা খালি পড়ে ছিলো। সে ফাঁকা জায়গাটা মোহিত পূরণ করেছে। এখন তার স্বামী ফিরে এসেছে। সে জায়গায় তার স্বামীকেই সে উপযুক্ত মনে করেছে। এখন আর তার মনে মোহিতের কোনো জায়গা নেই।
না জেনে না বুঝে একটা ভুল পথ ধরে চলছিল মোহিত। সামনে দেয়াল। এগোনের আর কোনো পথ নেই। সে পথের শেষ এখানেই।
একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যায় বেশ কিছুদিন। হঠাৎ এক বর্ষার বিকেলে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। বিষণœ মনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলো মোহিত। এমন দিনে মিলির কথা খুব মনে পড়ছে। কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কী জানি কী ভেবে মোহিত হাতে রাখা মোবাইল থেকে মিলিকে ফোন দেয়।
না, ফোন বন্ধ। হয়তো মিলি তার ফোন নাম্বার বদলে ফেলেছে। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জারে ব্লক করে দিয়েছে অনেক আগেই।
তাইতো স্বাভাবিক। তাছাড়া মোহিতই বা মিলির জীবনে থাকতে চাইবে কেন? যার যার জীবনের সিদ্ধান্ত শুধুই তার নিজের।
মোহিত বারান্দায় টবে লাগানো ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে কত রঙের, কত গন্ধের ফুল ফুটে আছে। আর ভাবে, প্রতিদিন কত ভোমরা আসে আবার চলেও যায়। যেমন করে মিলিও চলে গেলো। মনে পড়ে যায়, সেই গানটির কথা ‘অলি বারবার ফিরে আসে/ বারবার ফিরে যায়।’ গুনগুন করে গানটা গাইতে গাইতে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে মোহিত। বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে...।
পিওনা আফরোজ
বৃহস্পতিবার, ০৮ জুলাই ২০২১
এ এক অন্যরকম সন্ধ্যা। সারাদিন অফিস শেষে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। শহর চষে বেড়ানো বাসগুলো ব্যস্ততা নিয়ে ছুটে চলেছে। কখনো থামছে। ফের ছুটছে। মিলি একটি গাড়িতে উঠে বসল। বাসের সিটে শরীরটা এলিয়ে দিল। গাড়ি ছুটে চলছে, শহরের সকল ব্যস্ততা নিয়ে। বাসের কন্ড্রাক্টরের চিৎকার, গাড়ির হর্নের শব্দ, ট্রাফিক জ্যাম। তার মধ্যেও হালকা ঝিমুনি ভাব চলে আসে। চোখের পাতাগুলো বন্ধ করা বইয়ের পাতার মতো লেগে থাকে। কন্ড্্রাক্টরের চিৎকারে চোখ খুলে যায়। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় মিলি। জসীম উদ্দীন মোড়। বাস থেকে নামার সময় হলো। নীলা জসীম উদ্দীন ব্রিজ পেরিয়ে রিকশা নিলো। বাসার কাছে এসে ভাড়া দিতে গিয়েই দেখলো, ব্যাগে মোবাইল নেই।
কখন হারালো? কীভাবে হারালো? কিছুইতো টের পায়নি।
দিন দিন এই চুরি শিল্পটা বেশ নান্দনিক হচ্ছে। প্রশংসা না করে উপায় নেই। কিন্তু এই অসময়ে ফোনটা চুরি হলো। জরুরি ফোন আসার কথা। নিশ্চয়ই ফোনে না পেয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা করবে মানুষটা! এখন প্রায় রাত আটটা। মার্কেটগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া নতুন ফোন কেনার মতো সঙ্গে এতগুলো টাকাও এই মুহূর্তে নেই।
বাসায় ফিরে ব্যাগটা বিছানায় রেখেই গ্রামীণ ফোনের কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিলো মিলি।
ওপাশ থেকে পৌরুষদীপ্ত সুন্দর একটি কণ্ঠ ভেসে এলো।
হ্যালো, জ্বী বলুন। আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি ম্যাম?
আজ সন্ধ্যায় আমার ফোনটি হারিয়ে গেছে। ফোন নাম্বার ০১৭১৫৫......৭।
নাম্বারটি কি বন্ধ পাচ্ছেন?
জ্বি।
আপনার নামটি প্লিজ?
তাবাসসুম মিলি।
ঠিক আছে ম্যাম আমি দেখছি। বলেই ফোন রেখে দিলো মোহনীয় কণ্ঠের মানুষটি।
রাতে মিলির ঘুম নেই। এপাশ ওপাশ করছে। রাত বাড়তে থাকে একাকী। কিন্তু ছেলেটির কণ্ঠস্বর বারবার তার মনের কার্নিশে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। বারবার সেই কণ্ঠস্বরটি শুনতে ইচ্ছে করছে। কী অদ্ভুত এক মাদকতা যেন ছড়িয়ে রয়েছে তার কণ্ঠে। তারই রেশ ফিরে ফিরে ধরা দেয় অবচেতন মনে।
পরদিন ছিলো ছুটির দিন। শুক্রবার। সকাল দশটা বাজতেই মিলি বাড়ি থেকে বেরিযে গেলো। মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ করে বড় এ্যামাউন্ট খরচ করে কিছু কেনার মতো টাকা মিলির হাতে নেই। কিন্তু মোবাইল ফোনের মতো প্রয়োজনীয় ডিভাইস ছাড়া একদিনও চলা সম্ভব নয়। কোনো উপায় না পেয়ে শেষপর্যন্ত মিলি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে একটি ফোন কিনেই ফেললো।
বাসায় ফিরে সেদিন রাতে মিলি আবারো গ্রামীণ ফোনের কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিল। সেই ঘোর লাগা, সেই চেনা কণ্ঠস¦র।
হ্যালো, মোহিত বলছি।
কী সৌভাগ্য আমার। আপনাকে পেয়ে গেলাম। আপনার সময় হবে কিছুক্ষণ?
জ্বী, বলুন।
আমাকে চিনতে পেরেছেন?
জ্বী, তাবাসসুম মিলি।
বাহ্। আমার নাম মনে আছে আপনার?
কিছু বিষয় আপনি চান বা নাই চান, মন তার কাছে রেখেই দেয়।
আপনি তো খুব সুন্দর করে কথা বলেন।
থ্যাংক ইউ।
আমি আপনাকে বিরক্ত করছি না তো!
না।
এরপর থেকে প্রতি রাতেই মিলি আর মোহিতের কথা হতে থাকে। সেলফোনের রিং বেজে উঠলেই বুক ধড়ফড় করে। স্ক্রিনে তার নামটা ভেসে উঠলেই গলা শুকিয়ে যায়। ফোন রিসিভ করতে কেটে যায় বেশ কিছু মুহূর্ত। বাজতে বাজতে রিং যখন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম, তখন রাজ্যের সংকোচ নিয়ে বলে, ‘হ্যালো...।’
ওপাশ থেকে তখন শিশুর পবিত্র হাসির শব্দের মতো তোমার উচ্ছ্বাস ভেসে আসে।
মোহিত বলছি।
দুটি মাত্র শব্দ। অথচ ওর কণ্ঠে একটা মাধুর্য ঢেউ খেলে যায়। শব্দগুলো যেন ঢেউ এর মতো আছড়ে পড়ে মিলির বুকে। মিলি মুগ্ধ হয়ে ওর প্রতিটা কথা শোনে। রাতভর কথা হয় মোহিতের সাথে। প্রিয় গান, কিছু প্রিয় সিনেমা, ওর অফিসের গল্প, শৈশবের গল্প, জীবনের পাওয়া ন-পাওয়ার গল্প।
পরদিন আবারো একই সময়ে মোহিতের ফোন আসে। বালিশের পাশে ফোনটা রিসিভ করতেই মিলি বলল, ঘুমাননি এখনো?
না, তুমি ঘুমাওনি?
আপনি আমায় তুমি করে বলছেন কেন?
শুরুটা না হয় হয়েই যাক।
কিন্তু আমাদের তো একটা তুমি উৎসব হওয়ার কথা ছিলো। ভুলে গেলেন?
না, ভুলিনি।
তাহলে?
সবকিছু সময় বেঁধে দিয়ে হয় না। আমিও পারবো না।
কিন্তু কথা ছিলো, যেদিন আমরা প্রথম দেখা করবো, সেদিন আমরা একজন অন্যজনকে তুমি করে বলবো। আমরা তুমি শব্দটা সেলিব্রেট করবো। আর সেদিন আমাকে নির্মেলেন্দু গুণের ওই কবিতাটি শোনাবেন! মনে আছে?
হুম। মনে আছে। কিন্তু পারবো না। আমি অতো অপেক্ষা করতে পারবো না।
তাহলে ‘তুমি উৎসবটা’ আজই সেলিব্রেট হোক। কিন্তু আমারও একটি কথা রাখতে হবে।
কী কথা?
আমাকে কবিতাটা শোনাতে হবে।
ঠিক আছে, হয়ে যাক। চন্দ্রালোকে গভীর রাত ভেসে যেতে থাকে। মোহিত কবিতাটা পড়ছে, ওর সবটুকু আবেগ দিয়ে। মিলি যেন অনুভব করছে, মোহিতের বুকে মাথা রেখেই কবিতাটি শুনছে। যেমন করে চাঁদের বুকে জোছনা থাকে, আকাশের বুকে নক্ষত্র।
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দ্ইুকে আমি এক করি না
এককে করি দুই
হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি।
কবিতার প্রতিটি লাইন স্পর্শ করে মিলির হৃদয়কে। প্রিয় মানুষটি পাশে না থেকেও যেন খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে গেলো। মোহিত ও ধীরে ধীরে মিলির মাঝে হারাতে থাকে। রাত প্রায় ভোর হয়ে এলো। ভোরের পাখিরা কিচিরমিচির করছে।
এমনি করেই রাতগুলো কাটতে থাকে। মোহিতের সাথে কখনও কথা না হলে মিলি খুব অভিমান করে। ভাবেÑ মোহিত বুঝি তাকে অবহেলা করছে! কিন্তু মিলি তো জানতো না তার ফোনের অপেক্ষায় কী দুঃসহ দিন কাটে মোহিতেরও। প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় সময় কাটে সূর্য ওঠা সকাল থেকে সূর্য ডোবা সন্ধ্যা অবধি।
এর দুই দিন পরেই মিলির সাথে প্রথম দেখা মোহিতের। ধানমন্ডির এক কফি শপে। মিলিকে দেখে মোহিত রীতিমতো বিস্মিতি, বিমুগ্ধ। মিলির কথায় তার মনে হয়েছিলোÑ মিলি হয়তো কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন। কিন্তু না, মিলির সাজপোশাকে স্পষ্ট আভিজাত্যের ছাপ। নীল সালোয়ার কামিজ, দু’ভুরুর মাঝখানে ছোট নীল টিপ, কানে নীল পাথরের দুল, হাতে নীল পাথরের আংটি। সব মিলিয়ে রীতিমতো অবাক করার মতো। বয়সটা কত হতে পারে বোঝা যাচ্ছে না। কখনো মনে হচ্ছে ২৫ কখনো বা ৩০।
মিলির দিকে তাকিয়ে মোহিত বলল, আমি কি দেরি করে ফেললাম?
মোহিত জানে সে ঠিক সময়েই এসেছে, তবুও সৌজন্যবোধ বলে কিছু তো আছে।
না, না। আমি পাঁচ মিনিট আগেই ঢুকলাম। স্যান্ডউইচ আর কফির অর্ডার দিয়েছি। কী চলবেতো?
বেশ চলবে। এরপর সবকিছু খুব দ্রুতই ঘটতে থাকে।
তাদের এখন প্রায়ই দেখা হয়। কোনোদিন রেস্টুরেন্ট বা কফিশপে, কোনোদিন পার্কে। একদিন সন্ধ্যায় কোনো রেস্টুরেন্ট বা কফিশপে না গিয়ে মোহিতের বাসায় চলে এলো মিলি। ধানমন্ডির মোটামুটি বড় পরিসরের এক ফ্ল্যাটে থাকে মোহিত। তারা একসাথে সন্ধ্যার কফি খায়। বারান্দায় বসে রাতের সৌন্দর্য দেখে। ঘরের ভেতর কবীর সুমনের গান বাজে। ‘তোমায় গান শুনাবো/ তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ/ ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া / তোমায় গান শোনাব / চমক দিয়ে তাই তো ডাক/ বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক/ওগো দুখজাগানিয়া/ তোমায় গান শোনাব...।’ কিছু কিছু গান নিভৃতে প্রাণে লাগে। এই গানটি তেমনই একটি গান।
সেদিনের পর থেকে ওরা প্রায়ই বাসায় দেখা করতো আর মাঝে মাঝে চলে যেতো কোনো না কোনো রিসোর্টে। হারিয়ে যেতো প্রকৃতির নিবিড় ছায়ায়। এভাবেই কেটে যায় তিনটি মাস।
তখন এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ। ওদের সিলেটের দুসাই রিসোর্টে যাওয়ার কথা। বাসের টিকেট, হোটেল বুকিং সবকিছুই কনফার্ম। কিন্তু হঠাৎ করেই মিলি মোহিতের ফোন ধরছে না। বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে। কোনো রেসপন্স নেই। ম্যাসেজ দিচ্ছে। কোনো রিপ্লাই আসছে না । অথচ যাওয়ার মাত্র একদিন বাকি। কী হয়েছে মিলির? কোনো দুর্ঘটনা নয়তো! মিলি ভালো আছে তো? এক অজানা আশঙ্কায় মোহিতের মন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। পাগলের মতো অপেক্ষা করতে থাকে মিলির ফোনের জন্য। দিন কেটে যায় ভীষণ অস্থিরতায়। সারারাত মোহিত একটি বারের জন্যও দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি। কখনো বিছানায় শুয়ে বসে, কখনো বা ঘরে পায়চারী করে নির্ঘুম রাত পার করেছে।
পরদিন সকালে ফোনের শব্দ পেয়ে মোহিত বিছানা থেকে উঠে বসে। ফোনের স্ক্রিনে মিলির নাম। মোহিত তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিভ করে।
তুমি আমার উপর রেগে আছ?
না, রাগ হবে কেন? তবে খুব টেনশন হচ্ছিল। কী হয়েছিলো বলো তো! কাল সারাদিন কোন যোগাযোগই করোনি!
কিছুই হয় নি। যোগাযোগ করতে ইচ্ছে করেনি।
কী বলছো এসব? আচ্ছা বাদ দাও। সিলেটে যাওয়ার সব প্রিপারেশন কমপ্লিট। হাতে মাত্র ঘণ্টাখানেক সময় আছে। তাড়াতাড়ি চলে এসো।
সম্ভব না মোহিত। তোমার সাথে দেখা করা বা কথা বলা কোনোটাই আর আমার পক্ষে সম্ভব না।
তুমি মজা করছো মিলি? হাতে একেবারেই সময় নেই। তাড়াতাড়ি এসো।
স্যরি মোহিত। প্লিজ টেক ইট সিরিয়াসলি। আমি যাচ্ছি না।
কিন্তু কেন? কী হয়েছে তোমার? শরীর ভালো তো?
আমি একদম ঠিক আছি। তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো।
বেশ, বলো!
তোমাকে বলা হয় নি। আমার হাজব্যান্ড অফিসের কাজে বেশ কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলো, সেদিন মোবাইল হারানোর মধ্য দিয়ে তোমার সাথে পরিচয়। তারপর থেকে যা যা ঘটেছে তার জন্য আমি দুঃখিত। আজকের পর থেকে আর কখনো আমাদের কথা হবে না। দেখাও হবে না। তুমিও আর আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে না। ভালো থেকো। বাই। বলেই ফোনটি রেখে দেয় মিল্।ি মোহিতের উত্তরের কোনো অপেক্ষা না করেই।
অবাক, স্তব্ধ মোহিত কী করবে ভেবে পায় না। তার কি রাগ হওয়া উচিত?
না, তার রাগ হলো না। রাগ করেইবা কী লাভ? ভালোবাসা তো জোর করে পাওয়ার কিছু নয়। তাছাড়া এ কয়দিন মিলির ভালোবাসার মানুষটি কাছে ছিলো না। একটা জায়গা খালি পড়ে ছিলো। সে ফাঁকা জায়গাটা মোহিত পূরণ করেছে। এখন তার স্বামী ফিরে এসেছে। সে জায়গায় তার স্বামীকেই সে উপযুক্ত মনে করেছে। এখন আর তার মনে মোহিতের কোনো জায়গা নেই।
না জেনে না বুঝে একটা ভুল পথ ধরে চলছিল মোহিত। সামনে দেয়াল। এগোনের আর কোনো পথ নেই। সে পথের শেষ এখানেই।
একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যায় বেশ কিছুদিন। হঠাৎ এক বর্ষার বিকেলে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। বিষণœ মনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলো মোহিত। এমন দিনে মিলির কথা খুব মনে পড়ছে। কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কী জানি কী ভেবে মোহিত হাতে রাখা মোবাইল থেকে মিলিকে ফোন দেয়।
না, ফোন বন্ধ। হয়তো মিলি তার ফোন নাম্বার বদলে ফেলেছে। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জারে ব্লক করে দিয়েছে অনেক আগেই।
তাইতো স্বাভাবিক। তাছাড়া মোহিতই বা মিলির জীবনে থাকতে চাইবে কেন? যার যার জীবনের সিদ্ধান্ত শুধুই তার নিজের।
মোহিত বারান্দায় টবে লাগানো ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে কত রঙের, কত গন্ধের ফুল ফুটে আছে। আর ভাবে, প্রতিদিন কত ভোমরা আসে আবার চলেও যায়। যেমন করে মিলিও চলে গেলো। মনে পড়ে যায়, সেই গানটির কথা ‘অলি বারবার ফিরে আসে/ বারবার ফিরে যায়।’ গুনগুন করে গানটা গাইতে গাইতে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে মোহিত। বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে...।