ধারাবাহিক রচনা : তিন
আহমেদ ফরিদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৩. ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ
আমরা টের পাই দেশে বিরাট একটা কিছু হতে চলেছে। সে একটা কিছু কি যুদ্ধ? হলেও হতে পারে। আমাদের স্কুল থেকে খুব বেশি দূরে নয় গোকর্ণ সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়। শুনেছি অনেক বড়ো বড়ো ছাত্র সেখানে পড়াশোনা করে। এমনকি আমরাও কোনো একদিন সেখানে পড়তে যেতে পারি যদি ঠিক মতো প্রাইমারিটা পাস দেয়া যায়। আমাদের পাড়ার কাদির চাচা সেই স্কুলের ছাত্র। কাদির চাচা প্যান্ট শার্ট পরে ছাতা মাথায় যখন গোকর্ণ স্কুলে পড়তে যায় তখন আমার খুব হিংসা লাগে। আহা! আমি যদি প্যান্ট শার্ট পরে কাদির চাচার মতো স্কুলে যেতে পারতাম। কাদির চাচার মতো আরো বেশ কয়েকজন আমাদের পাড়া থেকে গোকর্ন স্কুলে পড়তে যায়। এদের মধ্যে হামিদ ভাই অন্যতম। আমাদের পাড়ার বেশ কয়েকজন গোকর্ণ স্কুল পাস দিয়ে এখন কলেজে পড়াশোনা করছে। এদের মধ্যে মিনু ভাই, রিওয়াক ভাই আছেন।
এক খা খা রোদ মাখা দুপুরে আমাদের ক্লাস চলছে। এতো রোদ যে ক্লাসের দরোজা দিয়ে বাহিরের মাঠের দিকে তাকালে সামনে কোনো মাঠ দেখা যায় না, মাঠের পরিবর্তে দেখা যায় এক সমুদ্র যে সমুদ্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ খেলা করছে। আমাদের প্রাণ আইঢাই করছে কখন স্কুল ছুটি হবে আর আমরা সেই রোদের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমাদের চোখ অনু মিয়া স্যারের উপর আর মন রোদ্দুরের সেই সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। হঠাৎ দূর থেকে কিসের শব্দ যেনো ভেসে আসছে। অনু মিয়া স্যার বাজখাই গলায় ‘খামোশ’ বলে তাঁর হাতে থাকা মোটা জালিবেত দিয়ে টেবিলের উপরে একটা বারি মেরে নিজে কান উৎকর্ণ রেখে কী যেন শোনার চেষ্টা করছেন। স্যারের সাথে আমরাও কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করি। স্যারের কানে তেমন কোনো কিছু ধরা পড়েনি বলেই মনে হয়। আমরা কিছু শব্দ শুনতে পাই।
‘ছার, মনে হয় মারামারি লাগছে। মারামারির আওয়াজ’। আমাদের ক্লাসের আইয়ুব খান বলল। আইয়ুব খান আর সুরুজ খান দুই চাচাতো ভাই আমাদের সহপাঠী। আইয়ুব খানের চেহারা সুরত আসল আইযুব খানের মতই, লম্বা চওড়া আর ফর্সা। তার কান দুটো বেশ বড়োসড়ো। সুতারাং আমাদের চেয়ে তার বেশ ভালো শোনার কথা। অনু মিয়া স্যার আইয়ুব খানের কথায় বেশ আস্থা রেখেছেন বলেই মনে হলো। তিনি দরোজায় গিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলেন যদি কিছু দেখা যায়।
‘মিছিল, মিছিল আসছে’ বলে তিনি ছট করে ক্লাসের ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে দিলেন। দ্রুত মাথা না ঢুকালে যেনো তাঁর মাথাটি কেউ কেটে ফেলবে আর কি!
খবরদার কেউ বের হবি না। বের হলে বেতিয়ে একদম হাগিয়ে ছাড়ব। স্যার হুংকার ছাড়েন।
হাগিয়ে ছাড়ুক আর মুতিয়ে ছাড়ুক মিছিল দেখার জন্য আমাদের প্রাণ আকুলি বিকুলি করতে থাকে।
আমরা পুলকিত হই। মিছিল জিনিসটা বেশ মজাদার। বোমা মুখে নিয়ে একজন স্লোগান দেয় বাকিরা তার সাথে সুর আর ছন্দ মিলিয়ে পাল্টা একটা কিছু বলে। এতে বেশ একটা জোশের সৃষ্টি হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিছিলটা দৃশ্যমান হয়। হ্যাঁ, আমাদের স্কুলের দিকেই আসছে বেশ লম্বা একটা মিছিল। মিছিলকারীদের প্রত্যেকের হাতেই জিগার গাছের ডাল। এরা কাকে মারতে আসছে? আমাদেরকে নয়তো! নাকি আমাদের স্যারদেরকে। আমাদেরকে মারতে আসার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। স্যারদের হাতে আমাদেরকে প্রায়ই মার খেতে হয়। ওরাও নিশ্চয়ই স্যারদের হাতে মার খেয়েছে। এ জন্যই..
দেখি মিছিলের সামনে এ গায়েরই ছেলে হামিদ ভাই।
স্যার, স্কুল বন্ধ করেন। হেড মাস্টার স্যারকে উদ্দেশ্য করে হামিদ ভাই বললেন। বাকিরা যেনো ফুটন্ত হাঁড়ির ভাতের মতো টগবগ করে ফুটছে। আমাদের হেড মাস্টার চিন্তাহরণ বাবু। ফর্সা গোলগাল চেহারা স্যারের। কোনোদিন তাঁকে জোরে কথা বলতে কোনো শোনা যায়নি। মারা তো দূরের কথা ছাত্রদেরকে তিনি ধমকটা পর্যন্ত দেন না। তাঁর চেহারাটা সবসময় হাসি-খুশি। জগতের সকল চিন্তা হরণ করে কি তিনি হাসি-খুশি থাকেন সবসময়?
কেন বাবা. স্কুল বন্ধ করবো কেন? সরকার তো স্কুল বন্ধ করতে বলে নাই। স্কুল বন্ধের কোনো চিঠি তো আমরা পাই নাই। হেড মাস্টার চিন্তাহরণ স্যার মিন মিন করে বললেন।
স্যার, সরকার এখন চালায় শেখ মুজিব। ইয়াহিয়া নয়। আপনি কি শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ শোনেননি? তিনি বলেন নি আজ থেকে...
আপনি স্কুল বন্ধ না করলে আমরাই স্কুলে তালা লাগিয়ে দেব। এই তোমরা সবাই বের হয়ে আস। হামিদ ভাই বললেন।
অনু মিয়া স্যার হতভম্ব। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরই ছাত্ররা এমন বেয়াদবি করতে পারে! রাগে তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। ততক্ষণে উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা বের হয়ে মিছিলের সাথে মিশে গিয়েছে। আমরা কোনো আক্কেলে দাঁড়িয়ে থাকি। আমরাও অনু মিয়া স্যারের বেতের বাড়ি উপেক্ষা করে সুরুৎ করে খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে আসি। সেই যে আমাদের বের হওয়া দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আর আমরা স্কুল মুখো হইনি।
মিছিলকারীরা সেখানে সম্ভবত একটা ভাষণও দেয়। সেই ভাষণের মর্মবাণী কী ছিলো আজ আর মনে নেই। তবে এটা মনে আছে তারা বলছিল ঢাকা, গাজীপুর, রংপুর ইত্যাদি জায়গায় পাকিস্তানী সৈন্যরাদের সাথে বাঙালির যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা অনেক বাঙালিকে হত্যা করেছে। সুতারাং আমাদেরও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া দরকার।
দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। চারিদিকে নানা গুজব ভেসে বেড়াতে থাকে। আমরা শুনি যে একটা যুদ্ধ লেগে গিয়েছে। যেকোনো সময় যুদ্ধটা আমাদের এখানেও চলে আসতে পারে। আমি মনে মনে ভাবী যুদ্ধটা চলে আসলে মন্দ হবে না। লুকিয়ে লুকিয়ে হাতি-ঘোড়া আর ঢাল তলোয়ার হাতে বড় বড় বীরদের একটা যুদ্ধ দেখতে পাবো যা এতোদিন বাবার পড়া পুঁথিতে হতে শুনেছি।
৪.
আমরা থানা আক্রমণ করি
সেদিন বিকেলে মক্তবের মাঠে খেলছিলাম। মক্তবটা আমাদের গ্রামের উত্তর প্রাস্তে, কিছুদিন আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ছনের ঘরে আমরা দুলে দুলে আরবি পড়ি। ক্লাস শেষ হলে আমাদেরকে মাঠে গোলবের করে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। সেখানে আমরা চার কলমা আর নামাজ পড়ার দোয়া দরুদ শিখি। আমাদের আরো দুইটা মাঠ আছে, সেগুলো গ্রাম থেকে বেশ দূরে। আমরা সুযোগ পেলেই এ মাঠঠিতে খেলি। গোল্লাছুট, মলদাইর, দারাগুটি, ফুটবল ইত্যাদি। সেদিনের বিকেলেও আমরা খেলছি। যুদ্ধটা তখন সবে মাত্র শুরু হয়েছে। বাঙালি তরুণ সমাজ তখন টগবগ করে ফুঁসছে। প্রায়ই মিটিং মিছিল হচ্ছে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। গ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে একটা মিছিল বের হলো। অনেক লোক সে মিছিলে। মিছিলের অগ্রভাগে আছেন গ্রামের স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছাত্র নেতারা। বেশ লম্বা সে মিছিল। মিছিলের লোকজনের হাতে লাঠিসোটা। অধিকাংশের হাতে জিগার ডালের লাঠি। তখন জিগার গাছ রাস্তার ধারে প্রচুর পরিমাণে জন্মাতো প্রায় বিনা যতনে। নরম বলে এর ঢাল ভাঙ্গা ছিল অনেক সহজ। জিগার ঢালের লাঠি দিয়ে মারামারি করা তখনকার দিনে একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল। মিছিলটা এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। খেলা ফেলে আমরা অবাক হয়ে দেখছি। মিছিলের লেজটা যখন আমাদেরকে অতিক্রম করতে যাচ্ছে তখন আমাদের কেউ একজন বলল ‘ল যাই’ মানে চল মিছিলে যোগ দেই। কোনো কিছু না ভেবেই আমরা মিছিলের লেজে ঢুকে পড়ি। মিছিলটি বেশ দ্রুত গতিতে উত্তর দিকে চলছে। মিছিলকারীদের মুখে বিভিন্ন স্লোগান আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে আমরা স্লোগান দিয়ে সামনে এগুচ্ছি। আমাদের গ্রাম পার হলেই ফুলপুর গ্রাম শুরু। ফুলপুর থেকে আরো একদল লোক আমাদের মিছিলে যোগ দিল। এতে মিছিল আরো লম্বা হলো। আমরা মোটামুটিভাবে মিছিলের মাঝামাঝিতে পড়ে গেলাম। আমাদের গন্তব্য থানা সদরের দিকে বুঝতে পারলাম। থানা সদরটির নাম নাসিরনগর। আমাদের গ্রাম নূরপুর থেকে থানা সদরের দূরত্ব মাইল দুয়েকের মত। রাস্তাটির প্রায় অংশই ভাঙা। আমাদেরকে কখনো রাস্তার উপর দিয়ে কখনো বা রাস্তার নিচের গোপাট ধরে সামনে এগুতে হচ্ছে। আমাদের উৎসাহ উদ্দীপনার কোনো শেষ নেই, মনে অনেক ফুর্তি জাগছে। কী জন্য আমাদের ফুর্তি লাগছে তা মনে নেই। সবার সাথে তাল মিলিয়ে কিছু একটা করতে যাচ্ছি এটাই আমাদের আনন্দ। হঠাৎ করে মাথার উপর প্লেনের আওয়াজ শুনলাম। সবাই কান উৎকীর্ণ করে রাখছে। হ্যাঁ, প্লেনের আওয়াজই তো বটে। সবাই সতর্ক। বোমা টোমা ফেলবে না তো! কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা প্লেন উত্তর পূব দিক থেকে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। আমরা ভয়ে হতভম্ব। অনেককেই দেখলাম এদিক ওদিক ছুটে যেতে। অনেকেই খালের তলায় আশ্রয় নিল। সামান্য সময় মাত্র। এরই মধ্য মিছিল লণ্ডভণ্ড। অনেকেই উল্টো পথে অর্থাৎ গ্রামের দিকে বাড়ির পথে রওয়ানা দিল। আগে জান বাঁচানো ফরজ। আমরা কী করব ভেবে পাচ্ছি না। প্লেনটা তো উড়ে গেল কোনো বোমা টোমা না মেরেই। এখন না হয় বোমা না ফেলেই চলে গেলো কিছুক্ষণ পরে যে আবার সংগী সাথী নিয়ে আসবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমরা মাঝে মধ্যেই দেখি আকাশে একাধিক বিমান প্রচ- গর্জন করে ডিগবাজি খাচ্ছে। অবশ্য ঐ সকল বিমান এটার মতো ধীরে ধীরে চলে না। চোখের পলকেই এরা গর্জন তোলে হারিয়ে যায়।
‘নাহ্ আসছি যখন তখন আর ফিরে যাবো না’,’ আমাদের একজন বলল। ততক্ষণে মিছিল আবার সচল হতে শুরু করছে। মিছিল থেকে জানানো হলো এটা ছিল আসলে একটা যাত্রীবাহি বিমান। কাজেই ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমারও মনে হলো তাই। মিছিলের সাথে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। মিছিলটা তখন উইড়াল পার হয়ে বড় ভাঙার কাছাকাছি। বড় ভাঙা জায়গাটা আমার খুব পছন্দের জায়গা। এখানে রাস্তার উপর বেশ বড়ো একটা বটগাছ আছে। বটগাছটা তার বিশাল বাহু মেলে রাস্তা এবং খালের উপর ছড়িয়ে রয়েছে। গরম কালে রাখালেরা তাদের গরু ছেড়ে দিয়ে গাছটার নিচে বসে বাঁশি বাজায় কেউ বা নানা ধরনের গ্রামীণ খেলায় মেতে ওঠে। দূরের পথিকরাও পথের ক্লান্তি দূর করতে গাছটির নিচে বসে দু’দ- জিরিয়ে নেয়। আমি নিজেও অনেকবার গাছটির নিচে বসে জিরিয়েছি। বিশেষ করে বর্ষায় নিরাইয়ে মাছ ধরার সময় গাছটার নিচে নৌকায় বসে থাকতে অপার্থিব একটা আরাম পাওয়া যেতো। আর জায়গাটা আরো একটি কারণে বিখ্যাত ছিল। বটগাছটা পার হলেই ছিল একটা পুল। পুলের দুপাশে খালে ছিল দুটি খাদ। এতো গভীর ছিল খাদ দুটি যে বর্ষার সময় ওখানে রীতিমতো পানি পাক খেতো। আমরা মনে করতাম পানির নিচে দৈত্য-দানো একটা কিছু আছে। অনেক নৌকাও নাকি ওখানে ডুবে গিয়েছে। আশ্বিন কার্তিকে খাদ দুটিতে প্রচুর মাছ পড়ত। পুলের নিচে পাটি দিয়ে বাঁধ দেয়া হতো। মাঠের মাছ জমা হতো এসে খাদে। ডানদিকের খাদটাতে এতো মাছ পড়ত যে পানি পর্যন্ত দেখা যেতো না। সেই মাছ দেখার জন্যও মাঝে মাঝে আমরা বড়ভাঙায় যেতাম। গাছটা যখন পার হচ্ছি তখন বুকের ভিতর কেমন যেনো একটা মোচড় দিয়ে উঠে। প্রিয় বটগাছ, তোমার সাথে আবার দেখা হবে তো? আমরা তোমাকে দেখার জন্য, তোমার ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাবার জন্য বেঁচে থাকব তো আমরা? সেই মিছিলে অংশগ্রহণকারী অনেকেই বেঁচে নেই কিন্তু বটগাছটা এখনো আছে। তবে তার ডালপালা আর পাতার বাহার কমে গিয়েছে। তার শরীর অনেকটাই রাস্তার উপর চলে এসেছে। তাকে কি কেটে ফেলা হবে? মনে হয়।
আমাদের মিছিল নাসিরনগরের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। দত্তবাড়ির সামনে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। দত্তবাড়িটা রাস্তার একদম উপরে। এ বাড়িটি আমাকে বিস্মিত কারত। কারণ এতো বড় বাড়ি আমি তখনো কোথাও দেখিনি। রাস্তার সাথেই একটা বড় উঁচু ঘর। ঘরটির কোনো বেড়া নেই। ঘরটি পার হলেই বিশাল একটা দালান। দালানটির অবস্থান পূর্ব আর উত্তর ভিটায়। দালানের ছাতের নিচটায় সব পাখ পাখালির মূর্তি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম সেসকল মূর্তির দিকে। মাঝে মাঝে দেখতাম ঘরটাতে গরুর মলন দিয়ে ধান মাড়াই করা হচ্ছে। ঘরের ভিতরে গরুর মলন! ঘরটা অনেক বড় ছিল বলেই গরু দিয়ে ঘরের ভিতরে ধান মাড়াই করা সম্ভব ছিল। ঘরটার উত্তর পাশে আরো একটা দালান। দালানটির ভিত মাটি থেকে বেশ উঁচুতে ছিল। সেই দালানে দেখা যেতো বড় বড় নানা মূর্তি। আসলে দত্ত বাড়ির বহিরাঙ্গনে ছিল একটা নাটমন্দির। সেখানে পূজা অর্চনা আর নাটক হতো। আমি এসকল জিনিস খুব বিস্মিত হয়ে উপভোগ করতাম। আমার বিস্মিত হ্ওয়ার ক্ষমতা খুব বেশি বলে মনে হয়। আমি এখনো সামান্য কিছুতেই অকপটভাবে বিস্মিত হতে পারি। সেটা কোনো দোষ নাকি গুণ আমি জানি না। দত্ত বাড়ির বিশালত্ব আমাকে সত্যিকার অর্থেই বিস্মিত করত।
মিছিলটি দত্তবাড়ি পার হয়ে টিইও সাহেবের অফিসের সামনে দিয়ে আরো সামনে এগিয়ে আসলে সিইও অর্থাৎ সার্কেল অফিসার সাহেবের বাসা পড়ে। সিইও সাহবের বাড়িটিও আমার আকর্ষণের অন্যতম একটা জায়গা ছিল। বাড়ির একটা গেইট ছিল। সেখানে আবার একজন লোক পাহাড়া দিত। পাহারাদারটাকে আমরা খুব ভয় করতাম। লোক দেখলেই পাহারাদার হই হই করে তেড়ে আসত বিশেষ করে আমাদের মতো ছোট বাচ্চাদের দিকে। সেই বাড়ির গেটে আবার দুটি গাছ ছিল। সাদা ছালের গাছ দুটি সোজা আকাশে উড়াল দিয়েছে। গাছ দুটির পাতা ছিল সুস্বাদু। কুড়িয়ে কুড়িয়ে গাছ দুটির পাতা আমরা মুখে নিয়ে চিবাতাম। এতে মিষ্টি মসলা জাতীয় এক ধরনের স্বাদ ছিল। সিইও সাহেবের বাড়ি বামে রেখে মিছিলটি সামনে মোড় নিল। একটু এগুলেই থানা। থানা আমাদের কাছে একটা ভয়াবহ ব্যাপার। দারোগা দেখলে আমাদের কাপড়চোপড় নষ্ট হয়ে যেতো। দারোগা পুলিশের তেমন দেখা পাওয়া যেতো না। চুরি চামারি হলে গ্রামের চৌকিদার-দফাদারই ছিল যথেষ্ট। সেই ভয়াবহ থানার দিকে মিছিলটি যাওয়াতে আমাদের হৃৎপিণ্ডের ধুঁকধুকানি বেড়ে যায়। আমরা আশঙ্কা করতে থাকি থানা থেকে দারোগা-পুলিশ বের হয়ে আমাদের সবাইকে জেলের ভিতর ঢুকিয়ে দেবে নতুবা গুলি করে মেরে ফেলবে। কিছুই ঘটল না। কোনো দারোগা পুলিশের টিকিটও দেখা গেল না। কোনো বাঁধা না পেয়ে মিছিলটি তখন পাগলা হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ দিকে তারকাঁটার বেড়া ততক্ষণে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। পাকিস্তানের উড্ডীয়মান পতাকার বাঁশটি কেউ একজন নামিয়ে আনল, তারপর পতাকাতে আগুন ধরিয়ে দিল। দক্ষিণ আর পশ্চিম দিক থেকে পিলপিল করে লোকজন থানার ভিতরে ঢুকে পড়েছে। আমাদের প্রথম আক্রমণের শিকার হলো থানার দরজা জানালাগুলো। দমাদম লাথি আর ধাক্কায় ভেঙে পড়ল সকল দরজা জানালা। প্রতি রুমে রুমে লোক ঢুকে পড়েছে। কোনো পুলিশ সদস্যকে পাওয়া গেলো না তবে তাদের ফেলে যাওয়া কিছু জিনিসপত্র পাওয়া গেল। ফেলে যাওয়া জিনিস পত্রের মধ্যে ছিল তাদের ইউনিফর্ম, হ্যারিকেন, আরো কিছু টুকটাক জিনিসপত্র। কয়েকটা বন্দুকও পাওয়া গেলে। খুব অল্পক্ষণের মধ্যেই লোকজন থানার সকল জিনিস লুট করল। আমাদের ছোটদের ভাগ্যে কিছুই জুটল না। ধাক্কাধাক্কি হুড়াহুড়িতে আমরা বড়দের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারলাম না। বিরস বদনে আমরা বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। আমাদের চেয়ে একটু বড় জাহির চাচা একটা হ্যারিকেন আর পুলিশের একটি সুয়েটার পেলো। আমরা সুয়েটারটা হাত দিয়ে ধরে দেখতে পাচ্ছি সেটাই অনেক বড় সান্ত্বনা। খাকির বাচ্চা খাকি। ইচ্ছে হয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই তাদের সবকিছু। জাহির চাচা আগলে রাখে সোয়েটারটা। সে ওটা গায়ে দেবে। সে দুয়েকদিন সেটা সে গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অনেক লোক লুকিয়ে লুকিয়ে থানা থেকে আনা লুন্ঠিত মালামাল ব্যবহার করছে। বন্দুকগুলো বিভিন্ন জায়গায় মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়।
কিছু কিছু বন্দুক মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করেছিলেন আর কিছু কিছু এখনো মাটির নিচে কবরে শায়িত আছে। হয়তো মাটির সাথে মিশে গিয়েও থাকতে পারে। আমরা কোনো বাধা পেলাম না কেনো? থানাওয়ালারা কি পালিয়ে গিয়েছিল প্রাণের ভয়ে? নাকি তাঁরা চেয়েছিলো সাধারণ মানুষজন থানা দখল করে নিক? তারাও কি সাধারণ পোশাকে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল নিজ থানা আক্রমণে? হতেও তো পারে। নিজের মাতৃভুমিকে রক্ষা করতে কে না চায়?
এই ঘটনার পর মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে আমাদের গ্রাম দুটির নাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। নাম ছড়িয়ে পড়ার একটা বিপদও দেখা দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে নামটা পাকিস্তানী আর্মির কানে তুলে দেয়ার লোকের অভাব ছিল না। নূরপুর-ফুলপুর মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে পাকিস্তানি আর্মির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।
থানা সদরের পাশেই ছিল এক মুসলিম লীগ নেতার বাড়ি। তিনি ব্যাপারটা সহজে মেনে নেবেন কেন? পারলে সেদিনই পাকিস্তানী বাহিনী দিয়ে আমাদের গ্রাম দুটিকে শায়েস্তা করায় আর কি! থানা আক্রমণ, সরকারি অস্ত্র লুট একটা ভয়াবহ ব্যাপার। সরকার বিষয়টা এমনিতেই ছেড়ে দেবে তা তো হবার নয়। আমাদের গ্রামবাসী প্রমাদ গনতে থাকে পাকিস্তানী বাহিনী এই এলো বলে। কিন্তু আমাদের গ্রাম দুটিতে আসা এতো সহজ ব্যাপার নয়। গ্রীষ্মে গাড়ি দিয়ে আসা অনেক কঠিন একটা কাজ। একে তো রাস্তানেই তার উপর দ্’ুদু’টো ফেরি পার হতে হয়। সেই ফেরিগুলো আবার দু’টি নৌকা জোড়া দিয়ে তৈরি করা। এতে ভারি কোনো যানবাহন পার করানো সম্ভব নয়। বর্ষায় লঞ্চযোগে আসা যায়। লঞ্চঘাট আবার দেড় দু মাইল দূরে। এতো সব ঝক্কি সামলিয়ে বোধ হয় পাকিস্তানী সেনারা আসতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তবে আমরা সবসময় একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকি। থানা সদরের পাশের গ্রামের মুসলিম লীগারটিকে আমাদের সবচেয়ে বেশি ভয়। তিনি হয়তো পাকিস্তানি বাহিনীকে ইতিমধ্যেই আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন। একে তো গ্রাম দুটি মুক্তিবাহিনীর গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে তার উপর থানা লুঠ তার, উপর তিনি আবার আমাদের গ্রামের প্রার্থীর কাছে সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে হেরেছেন।
আমাদের আতঙ্ক কাটে না। পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের গ্রামে আসবেই আসবে। আসবে তো বুঝলাম। কিন্তু আসলে কী করতে হবে সে সম্পর্কে গ্রামের কারো কোনো ধারণা নেই। আমাদের গ্রামের একটা খ্যাতি রয়েছে লাঠিয়ালের গ্রাম হিসেবে। গ্রামটি অনেক বড় আর লোকজনের মধ্যে মারামারির বিষয়ে বেশ ভালো একটা ঐক্য রয়েছে। আশেপাশের গ্রামের লোকজন আমাদেরকে সমঝে চলে। মারামারি লাগলে বল্লম, বর্শা, কোচ, ছেতি, রামদা, গুলতি ইত্যাদি নিয়ে লোকজন নেমে পড়ে। দু’একজনকে তো দেখেছি মধ্যযুগের পালোয়ানদের মতো লোহার তৈরি ঢাল হাতে নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে।
বড় বড় লাঠিয়ালরা তাদের রামদা,বল্লম শান দিতে লাগল। পাঞ্জাবি হোক আর যেই হোক ছাড় দেয়া যাবে না। মরতে হলে লড়াই করেই মরবে। আমাদের সবার ভিতরেই ‘মরতে হলে লড়াই করেই মরব’ ধরণের একটা জোশ কাজ করে।
সেই জোশ নিয়ে আর লাঠিয়ালের বড়াই নিয়ে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি কখন আসবে পাক সেনাদল। ক্রমশ...
ধারাবাহিক রচনা : তিন
আহমেদ ফরিদ
রোববার, ২২ আগস্ট ২০২১
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৩. ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ
আমরা টের পাই দেশে বিরাট একটা কিছু হতে চলেছে। সে একটা কিছু কি যুদ্ধ? হলেও হতে পারে। আমাদের স্কুল থেকে খুব বেশি দূরে নয় গোকর্ণ সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়। শুনেছি অনেক বড়ো বড়ো ছাত্র সেখানে পড়াশোনা করে। এমনকি আমরাও কোনো একদিন সেখানে পড়তে যেতে পারি যদি ঠিক মতো প্রাইমারিটা পাস দেয়া যায়। আমাদের পাড়ার কাদির চাচা সেই স্কুলের ছাত্র। কাদির চাচা প্যান্ট শার্ট পরে ছাতা মাথায় যখন গোকর্ণ স্কুলে পড়তে যায় তখন আমার খুব হিংসা লাগে। আহা! আমি যদি প্যান্ট শার্ট পরে কাদির চাচার মতো স্কুলে যেতে পারতাম। কাদির চাচার মতো আরো বেশ কয়েকজন আমাদের পাড়া থেকে গোকর্ন স্কুলে পড়তে যায়। এদের মধ্যে হামিদ ভাই অন্যতম। আমাদের পাড়ার বেশ কয়েকজন গোকর্ণ স্কুল পাস দিয়ে এখন কলেজে পড়াশোনা করছে। এদের মধ্যে মিনু ভাই, রিওয়াক ভাই আছেন।
এক খা খা রোদ মাখা দুপুরে আমাদের ক্লাস চলছে। এতো রোদ যে ক্লাসের দরোজা দিয়ে বাহিরের মাঠের দিকে তাকালে সামনে কোনো মাঠ দেখা যায় না, মাঠের পরিবর্তে দেখা যায় এক সমুদ্র যে সমুদ্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ খেলা করছে। আমাদের প্রাণ আইঢাই করছে কখন স্কুল ছুটি হবে আর আমরা সেই রোদের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমাদের চোখ অনু মিয়া স্যারের উপর আর মন রোদ্দুরের সেই সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। হঠাৎ দূর থেকে কিসের শব্দ যেনো ভেসে আসছে। অনু মিয়া স্যার বাজখাই গলায় ‘খামোশ’ বলে তাঁর হাতে থাকা মোটা জালিবেত দিয়ে টেবিলের উপরে একটা বারি মেরে নিজে কান উৎকর্ণ রেখে কী যেন শোনার চেষ্টা করছেন। স্যারের সাথে আমরাও কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করি। স্যারের কানে তেমন কোনো কিছু ধরা পড়েনি বলেই মনে হয়। আমরা কিছু শব্দ শুনতে পাই।
‘ছার, মনে হয় মারামারি লাগছে। মারামারির আওয়াজ’। আমাদের ক্লাসের আইয়ুব খান বলল। আইয়ুব খান আর সুরুজ খান দুই চাচাতো ভাই আমাদের সহপাঠী। আইয়ুব খানের চেহারা সুরত আসল আইযুব খানের মতই, লম্বা চওড়া আর ফর্সা। তার কান দুটো বেশ বড়োসড়ো। সুতারাং আমাদের চেয়ে তার বেশ ভালো শোনার কথা। অনু মিয়া স্যার আইয়ুব খানের কথায় বেশ আস্থা রেখেছেন বলেই মনে হলো। তিনি দরোজায় গিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলেন যদি কিছু দেখা যায়।
‘মিছিল, মিছিল আসছে’ বলে তিনি ছট করে ক্লাসের ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে দিলেন। দ্রুত মাথা না ঢুকালে যেনো তাঁর মাথাটি কেউ কেটে ফেলবে আর কি!
খবরদার কেউ বের হবি না। বের হলে বেতিয়ে একদম হাগিয়ে ছাড়ব। স্যার হুংকার ছাড়েন।
হাগিয়ে ছাড়ুক আর মুতিয়ে ছাড়ুক মিছিল দেখার জন্য আমাদের প্রাণ আকুলি বিকুলি করতে থাকে।
আমরা পুলকিত হই। মিছিল জিনিসটা বেশ মজাদার। বোমা মুখে নিয়ে একজন স্লোগান দেয় বাকিরা তার সাথে সুর আর ছন্দ মিলিয়ে পাল্টা একটা কিছু বলে। এতে বেশ একটা জোশের সৃষ্টি হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিছিলটা দৃশ্যমান হয়। হ্যাঁ, আমাদের স্কুলের দিকেই আসছে বেশ লম্বা একটা মিছিল। মিছিলকারীদের প্রত্যেকের হাতেই জিগার গাছের ডাল। এরা কাকে মারতে আসছে? আমাদেরকে নয়তো! নাকি আমাদের স্যারদেরকে। আমাদেরকে মারতে আসার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। স্যারদের হাতে আমাদেরকে প্রায়ই মার খেতে হয়। ওরাও নিশ্চয়ই স্যারদের হাতে মার খেয়েছে। এ জন্যই..
দেখি মিছিলের সামনে এ গায়েরই ছেলে হামিদ ভাই।
স্যার, স্কুল বন্ধ করেন। হেড মাস্টার স্যারকে উদ্দেশ্য করে হামিদ ভাই বললেন। বাকিরা যেনো ফুটন্ত হাঁড়ির ভাতের মতো টগবগ করে ফুটছে। আমাদের হেড মাস্টার চিন্তাহরণ বাবু। ফর্সা গোলগাল চেহারা স্যারের। কোনোদিন তাঁকে জোরে কথা বলতে কোনো শোনা যায়নি। মারা তো দূরের কথা ছাত্রদেরকে তিনি ধমকটা পর্যন্ত দেন না। তাঁর চেহারাটা সবসময় হাসি-খুশি। জগতের সকল চিন্তা হরণ করে কি তিনি হাসি-খুশি থাকেন সবসময়?
কেন বাবা. স্কুল বন্ধ করবো কেন? সরকার তো স্কুল বন্ধ করতে বলে নাই। স্কুল বন্ধের কোনো চিঠি তো আমরা পাই নাই। হেড মাস্টার চিন্তাহরণ স্যার মিন মিন করে বললেন।
স্যার, সরকার এখন চালায় শেখ মুজিব। ইয়াহিয়া নয়। আপনি কি শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ শোনেননি? তিনি বলেন নি আজ থেকে...
আপনি স্কুল বন্ধ না করলে আমরাই স্কুলে তালা লাগিয়ে দেব। এই তোমরা সবাই বের হয়ে আস। হামিদ ভাই বললেন।
অনু মিয়া স্যার হতভম্ব। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরই ছাত্ররা এমন বেয়াদবি করতে পারে! রাগে তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। ততক্ষণে উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা বের হয়ে মিছিলের সাথে মিশে গিয়েছে। আমরা কোনো আক্কেলে দাঁড়িয়ে থাকি। আমরাও অনু মিয়া স্যারের বেতের বাড়ি উপেক্ষা করে সুরুৎ করে খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে আসি। সেই যে আমাদের বের হওয়া দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আর আমরা স্কুল মুখো হইনি।
মিছিলকারীরা সেখানে সম্ভবত একটা ভাষণও দেয়। সেই ভাষণের মর্মবাণী কী ছিলো আজ আর মনে নেই। তবে এটা মনে আছে তারা বলছিল ঢাকা, গাজীপুর, রংপুর ইত্যাদি জায়গায় পাকিস্তানী সৈন্যরাদের সাথে বাঙালির যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা অনেক বাঙালিকে হত্যা করেছে। সুতারাং আমাদেরও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া দরকার।
দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। চারিদিকে নানা গুজব ভেসে বেড়াতে থাকে। আমরা শুনি যে একটা যুদ্ধ লেগে গিয়েছে। যেকোনো সময় যুদ্ধটা আমাদের এখানেও চলে আসতে পারে। আমি মনে মনে ভাবী যুদ্ধটা চলে আসলে মন্দ হবে না। লুকিয়ে লুকিয়ে হাতি-ঘোড়া আর ঢাল তলোয়ার হাতে বড় বড় বীরদের একটা যুদ্ধ দেখতে পাবো যা এতোদিন বাবার পড়া পুঁথিতে হতে শুনেছি।
৪.
আমরা থানা আক্রমণ করি
সেদিন বিকেলে মক্তবের মাঠে খেলছিলাম। মক্তবটা আমাদের গ্রামের উত্তর প্রাস্তে, কিছুদিন আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ছনের ঘরে আমরা দুলে দুলে আরবি পড়ি। ক্লাস শেষ হলে আমাদেরকে মাঠে গোলবের করে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। সেখানে আমরা চার কলমা আর নামাজ পড়ার দোয়া দরুদ শিখি। আমাদের আরো দুইটা মাঠ আছে, সেগুলো গ্রাম থেকে বেশ দূরে। আমরা সুযোগ পেলেই এ মাঠঠিতে খেলি। গোল্লাছুট, মলদাইর, দারাগুটি, ফুটবল ইত্যাদি। সেদিনের বিকেলেও আমরা খেলছি। যুদ্ধটা তখন সবে মাত্র শুরু হয়েছে। বাঙালি তরুণ সমাজ তখন টগবগ করে ফুঁসছে। প্রায়ই মিটিং মিছিল হচ্ছে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। গ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে একটা মিছিল বের হলো। অনেক লোক সে মিছিলে। মিছিলের অগ্রভাগে আছেন গ্রামের স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছাত্র নেতারা। বেশ লম্বা সে মিছিল। মিছিলের লোকজনের হাতে লাঠিসোটা। অধিকাংশের হাতে জিগার ডালের লাঠি। তখন জিগার গাছ রাস্তার ধারে প্রচুর পরিমাণে জন্মাতো প্রায় বিনা যতনে। নরম বলে এর ঢাল ভাঙ্গা ছিল অনেক সহজ। জিগার ঢালের লাঠি দিয়ে মারামারি করা তখনকার দিনে একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল। মিছিলটা এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। খেলা ফেলে আমরা অবাক হয়ে দেখছি। মিছিলের লেজটা যখন আমাদেরকে অতিক্রম করতে যাচ্ছে তখন আমাদের কেউ একজন বলল ‘ল যাই’ মানে চল মিছিলে যোগ দেই। কোনো কিছু না ভেবেই আমরা মিছিলের লেজে ঢুকে পড়ি। মিছিলটি বেশ দ্রুত গতিতে উত্তর দিকে চলছে। মিছিলকারীদের মুখে বিভিন্ন স্লোগান আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে আমরা স্লোগান দিয়ে সামনে এগুচ্ছি। আমাদের গ্রাম পার হলেই ফুলপুর গ্রাম শুরু। ফুলপুর থেকে আরো একদল লোক আমাদের মিছিলে যোগ দিল। এতে মিছিল আরো লম্বা হলো। আমরা মোটামুটিভাবে মিছিলের মাঝামাঝিতে পড়ে গেলাম। আমাদের গন্তব্য থানা সদরের দিকে বুঝতে পারলাম। থানা সদরটির নাম নাসিরনগর। আমাদের গ্রাম নূরপুর থেকে থানা সদরের দূরত্ব মাইল দুয়েকের মত। রাস্তাটির প্রায় অংশই ভাঙা। আমাদেরকে কখনো রাস্তার উপর দিয়ে কখনো বা রাস্তার নিচের গোপাট ধরে সামনে এগুতে হচ্ছে। আমাদের উৎসাহ উদ্দীপনার কোনো শেষ নেই, মনে অনেক ফুর্তি জাগছে। কী জন্য আমাদের ফুর্তি লাগছে তা মনে নেই। সবার সাথে তাল মিলিয়ে কিছু একটা করতে যাচ্ছি এটাই আমাদের আনন্দ। হঠাৎ করে মাথার উপর প্লেনের আওয়াজ শুনলাম। সবাই কান উৎকীর্ণ করে রাখছে। হ্যাঁ, প্লেনের আওয়াজই তো বটে। সবাই সতর্ক। বোমা টোমা ফেলবে না তো! কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা প্লেন উত্তর পূব দিক থেকে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। আমরা ভয়ে হতভম্ব। অনেককেই দেখলাম এদিক ওদিক ছুটে যেতে। অনেকেই খালের তলায় আশ্রয় নিল। সামান্য সময় মাত্র। এরই মধ্য মিছিল লণ্ডভণ্ড। অনেকেই উল্টো পথে অর্থাৎ গ্রামের দিকে বাড়ির পথে রওয়ানা দিল। আগে জান বাঁচানো ফরজ। আমরা কী করব ভেবে পাচ্ছি না। প্লেনটা তো উড়ে গেল কোনো বোমা টোমা না মেরেই। এখন না হয় বোমা না ফেলেই চলে গেলো কিছুক্ষণ পরে যে আবার সংগী সাথী নিয়ে আসবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমরা মাঝে মধ্যেই দেখি আকাশে একাধিক বিমান প্রচ- গর্জন করে ডিগবাজি খাচ্ছে। অবশ্য ঐ সকল বিমান এটার মতো ধীরে ধীরে চলে না। চোখের পলকেই এরা গর্জন তোলে হারিয়ে যায়।
‘নাহ্ আসছি যখন তখন আর ফিরে যাবো না’,’ আমাদের একজন বলল। ততক্ষণে মিছিল আবার সচল হতে শুরু করছে। মিছিল থেকে জানানো হলো এটা ছিল আসলে একটা যাত্রীবাহি বিমান। কাজেই ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমারও মনে হলো তাই। মিছিলের সাথে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। মিছিলটা তখন উইড়াল পার হয়ে বড় ভাঙার কাছাকাছি। বড় ভাঙা জায়গাটা আমার খুব পছন্দের জায়গা। এখানে রাস্তার উপর বেশ বড়ো একটা বটগাছ আছে। বটগাছটা তার বিশাল বাহু মেলে রাস্তা এবং খালের উপর ছড়িয়ে রয়েছে। গরম কালে রাখালেরা তাদের গরু ছেড়ে দিয়ে গাছটার নিচে বসে বাঁশি বাজায় কেউ বা নানা ধরনের গ্রামীণ খেলায় মেতে ওঠে। দূরের পথিকরাও পথের ক্লান্তি দূর করতে গাছটির নিচে বসে দু’দ- জিরিয়ে নেয়। আমি নিজেও অনেকবার গাছটির নিচে বসে জিরিয়েছি। বিশেষ করে বর্ষায় নিরাইয়ে মাছ ধরার সময় গাছটার নিচে নৌকায় বসে থাকতে অপার্থিব একটা আরাম পাওয়া যেতো। আর জায়গাটা আরো একটি কারণে বিখ্যাত ছিল। বটগাছটা পার হলেই ছিল একটা পুল। পুলের দুপাশে খালে ছিল দুটি খাদ। এতো গভীর ছিল খাদ দুটি যে বর্ষার সময় ওখানে রীতিমতো পানি পাক খেতো। আমরা মনে করতাম পানির নিচে দৈত্য-দানো একটা কিছু আছে। অনেক নৌকাও নাকি ওখানে ডুবে গিয়েছে। আশ্বিন কার্তিকে খাদ দুটিতে প্রচুর মাছ পড়ত। পুলের নিচে পাটি দিয়ে বাঁধ দেয়া হতো। মাঠের মাছ জমা হতো এসে খাদে। ডানদিকের খাদটাতে এতো মাছ পড়ত যে পানি পর্যন্ত দেখা যেতো না। সেই মাছ দেখার জন্যও মাঝে মাঝে আমরা বড়ভাঙায় যেতাম। গাছটা যখন পার হচ্ছি তখন বুকের ভিতর কেমন যেনো একটা মোচড় দিয়ে উঠে। প্রিয় বটগাছ, তোমার সাথে আবার দেখা হবে তো? আমরা তোমাকে দেখার জন্য, তোমার ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাবার জন্য বেঁচে থাকব তো আমরা? সেই মিছিলে অংশগ্রহণকারী অনেকেই বেঁচে নেই কিন্তু বটগাছটা এখনো আছে। তবে তার ডালপালা আর পাতার বাহার কমে গিয়েছে। তার শরীর অনেকটাই রাস্তার উপর চলে এসেছে। তাকে কি কেটে ফেলা হবে? মনে হয়।
আমাদের মিছিল নাসিরনগরের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। দত্তবাড়ির সামনে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। দত্তবাড়িটা রাস্তার একদম উপরে। এ বাড়িটি আমাকে বিস্মিত কারত। কারণ এতো বড় বাড়ি আমি তখনো কোথাও দেখিনি। রাস্তার সাথেই একটা বড় উঁচু ঘর। ঘরটির কোনো বেড়া নেই। ঘরটি পার হলেই বিশাল একটা দালান। দালানটির অবস্থান পূর্ব আর উত্তর ভিটায়। দালানের ছাতের নিচটায় সব পাখ পাখালির মূর্তি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম সেসকল মূর্তির দিকে। মাঝে মাঝে দেখতাম ঘরটাতে গরুর মলন দিয়ে ধান মাড়াই করা হচ্ছে। ঘরের ভিতরে গরুর মলন! ঘরটা অনেক বড় ছিল বলেই গরু দিয়ে ঘরের ভিতরে ধান মাড়াই করা সম্ভব ছিল। ঘরটার উত্তর পাশে আরো একটা দালান। দালানটির ভিত মাটি থেকে বেশ উঁচুতে ছিল। সেই দালানে দেখা যেতো বড় বড় নানা মূর্তি। আসলে দত্ত বাড়ির বহিরাঙ্গনে ছিল একটা নাটমন্দির। সেখানে পূজা অর্চনা আর নাটক হতো। আমি এসকল জিনিস খুব বিস্মিত হয়ে উপভোগ করতাম। আমার বিস্মিত হ্ওয়ার ক্ষমতা খুব বেশি বলে মনে হয়। আমি এখনো সামান্য কিছুতেই অকপটভাবে বিস্মিত হতে পারি। সেটা কোনো দোষ নাকি গুণ আমি জানি না। দত্ত বাড়ির বিশালত্ব আমাকে সত্যিকার অর্থেই বিস্মিত করত।
মিছিলটি দত্তবাড়ি পার হয়ে টিইও সাহেবের অফিসের সামনে দিয়ে আরো সামনে এগিয়ে আসলে সিইও অর্থাৎ সার্কেল অফিসার সাহেবের বাসা পড়ে। সিইও সাহবের বাড়িটিও আমার আকর্ষণের অন্যতম একটা জায়গা ছিল। বাড়ির একটা গেইট ছিল। সেখানে আবার একজন লোক পাহাড়া দিত। পাহারাদারটাকে আমরা খুব ভয় করতাম। লোক দেখলেই পাহারাদার হই হই করে তেড়ে আসত বিশেষ করে আমাদের মতো ছোট বাচ্চাদের দিকে। সেই বাড়ির গেটে আবার দুটি গাছ ছিল। সাদা ছালের গাছ দুটি সোজা আকাশে উড়াল দিয়েছে। গাছ দুটির পাতা ছিল সুস্বাদু। কুড়িয়ে কুড়িয়ে গাছ দুটির পাতা আমরা মুখে নিয়ে চিবাতাম। এতে মিষ্টি মসলা জাতীয় এক ধরনের স্বাদ ছিল। সিইও সাহেবের বাড়ি বামে রেখে মিছিলটি সামনে মোড় নিল। একটু এগুলেই থানা। থানা আমাদের কাছে একটা ভয়াবহ ব্যাপার। দারোগা দেখলে আমাদের কাপড়চোপড় নষ্ট হয়ে যেতো। দারোগা পুলিশের তেমন দেখা পাওয়া যেতো না। চুরি চামারি হলে গ্রামের চৌকিদার-দফাদারই ছিল যথেষ্ট। সেই ভয়াবহ থানার দিকে মিছিলটি যাওয়াতে আমাদের হৃৎপিণ্ডের ধুঁকধুকানি বেড়ে যায়। আমরা আশঙ্কা করতে থাকি থানা থেকে দারোগা-পুলিশ বের হয়ে আমাদের সবাইকে জেলের ভিতর ঢুকিয়ে দেবে নতুবা গুলি করে মেরে ফেলবে। কিছুই ঘটল না। কোনো দারোগা পুলিশের টিকিটও দেখা গেল না। কোনো বাঁধা না পেয়ে মিছিলটি তখন পাগলা হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ দিকে তারকাঁটার বেড়া ততক্ষণে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। পাকিস্তানের উড্ডীয়মান পতাকার বাঁশটি কেউ একজন নামিয়ে আনল, তারপর পতাকাতে আগুন ধরিয়ে দিল। দক্ষিণ আর পশ্চিম দিক থেকে পিলপিল করে লোকজন থানার ভিতরে ঢুকে পড়েছে। আমাদের প্রথম আক্রমণের শিকার হলো থানার দরজা জানালাগুলো। দমাদম লাথি আর ধাক্কায় ভেঙে পড়ল সকল দরজা জানালা। প্রতি রুমে রুমে লোক ঢুকে পড়েছে। কোনো পুলিশ সদস্যকে পাওয়া গেলো না তবে তাদের ফেলে যাওয়া কিছু জিনিসপত্র পাওয়া গেল। ফেলে যাওয়া জিনিস পত্রের মধ্যে ছিল তাদের ইউনিফর্ম, হ্যারিকেন, আরো কিছু টুকটাক জিনিসপত্র। কয়েকটা বন্দুকও পাওয়া গেলে। খুব অল্পক্ষণের মধ্যেই লোকজন থানার সকল জিনিস লুট করল। আমাদের ছোটদের ভাগ্যে কিছুই জুটল না। ধাক্কাধাক্কি হুড়াহুড়িতে আমরা বড়দের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারলাম না। বিরস বদনে আমরা বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। আমাদের চেয়ে একটু বড় জাহির চাচা একটা হ্যারিকেন আর পুলিশের একটি সুয়েটার পেলো। আমরা সুয়েটারটা হাত দিয়ে ধরে দেখতে পাচ্ছি সেটাই অনেক বড় সান্ত্বনা। খাকির বাচ্চা খাকি। ইচ্ছে হয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই তাদের সবকিছু। জাহির চাচা আগলে রাখে সোয়েটারটা। সে ওটা গায়ে দেবে। সে দুয়েকদিন সেটা সে গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অনেক লোক লুকিয়ে লুকিয়ে থানা থেকে আনা লুন্ঠিত মালামাল ব্যবহার করছে। বন্দুকগুলো বিভিন্ন জায়গায় মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়।
কিছু কিছু বন্দুক মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করেছিলেন আর কিছু কিছু এখনো মাটির নিচে কবরে শায়িত আছে। হয়তো মাটির সাথে মিশে গিয়েও থাকতে পারে। আমরা কোনো বাধা পেলাম না কেনো? থানাওয়ালারা কি পালিয়ে গিয়েছিল প্রাণের ভয়ে? নাকি তাঁরা চেয়েছিলো সাধারণ মানুষজন থানা দখল করে নিক? তারাও কি সাধারণ পোশাকে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল নিজ থানা আক্রমণে? হতেও তো পারে। নিজের মাতৃভুমিকে রক্ষা করতে কে না চায়?
এই ঘটনার পর মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে আমাদের গ্রাম দুটির নাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। নাম ছড়িয়ে পড়ার একটা বিপদও দেখা দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে নামটা পাকিস্তানী আর্মির কানে তুলে দেয়ার লোকের অভাব ছিল না। নূরপুর-ফুলপুর মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে পাকিস্তানি আর্মির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।
থানা সদরের পাশেই ছিল এক মুসলিম লীগ নেতার বাড়ি। তিনি ব্যাপারটা সহজে মেনে নেবেন কেন? পারলে সেদিনই পাকিস্তানী বাহিনী দিয়ে আমাদের গ্রাম দুটিকে শায়েস্তা করায় আর কি! থানা আক্রমণ, সরকারি অস্ত্র লুট একটা ভয়াবহ ব্যাপার। সরকার বিষয়টা এমনিতেই ছেড়ে দেবে তা তো হবার নয়। আমাদের গ্রামবাসী প্রমাদ গনতে থাকে পাকিস্তানী বাহিনী এই এলো বলে। কিন্তু আমাদের গ্রাম দুটিতে আসা এতো সহজ ব্যাপার নয়। গ্রীষ্মে গাড়ি দিয়ে আসা অনেক কঠিন একটা কাজ। একে তো রাস্তানেই তার উপর দ্’ুদু’টো ফেরি পার হতে হয়। সেই ফেরিগুলো আবার দু’টি নৌকা জোড়া দিয়ে তৈরি করা। এতে ভারি কোনো যানবাহন পার করানো সম্ভব নয়। বর্ষায় লঞ্চযোগে আসা যায়। লঞ্চঘাট আবার দেড় দু মাইল দূরে। এতো সব ঝক্কি সামলিয়ে বোধ হয় পাকিস্তানী সেনারা আসতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তবে আমরা সবসময় একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকি। থানা সদরের পাশের গ্রামের মুসলিম লীগারটিকে আমাদের সবচেয়ে বেশি ভয়। তিনি হয়তো পাকিস্তানি বাহিনীকে ইতিমধ্যেই আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন। একে তো গ্রাম দুটি মুক্তিবাহিনীর গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে তার উপর থানা লুঠ তার, উপর তিনি আবার আমাদের গ্রামের প্রার্থীর কাছে সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে হেরেছেন।
আমাদের আতঙ্ক কাটে না। পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের গ্রামে আসবেই আসবে। আসবে তো বুঝলাম। কিন্তু আসলে কী করতে হবে সে সম্পর্কে গ্রামের কারো কোনো ধারণা নেই। আমাদের গ্রামের একটা খ্যাতি রয়েছে লাঠিয়ালের গ্রাম হিসেবে। গ্রামটি অনেক বড় আর লোকজনের মধ্যে মারামারির বিষয়ে বেশ ভালো একটা ঐক্য রয়েছে। আশেপাশের গ্রামের লোকজন আমাদেরকে সমঝে চলে। মারামারি লাগলে বল্লম, বর্শা, কোচ, ছেতি, রামদা, গুলতি ইত্যাদি নিয়ে লোকজন নেমে পড়ে। দু’একজনকে তো দেখেছি মধ্যযুগের পালোয়ানদের মতো লোহার তৈরি ঢাল হাতে নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে।
বড় বড় লাঠিয়ালরা তাদের রামদা,বল্লম শান দিতে লাগল। পাঞ্জাবি হোক আর যেই হোক ছাড় দেয়া যাবে না। মরতে হলে লড়াই করেই মরবে। আমাদের সবার ভিতরেই ‘মরতে হলে লড়াই করেই মরব’ ধরণের একটা জোশ কাজ করে।
সেই জোশ নিয়ে আর লাঠিয়ালের বড়াই নিয়ে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি কখন আসবে পাক সেনাদল। ক্রমশ...