alt

সাময়িকী

কাজী নজরুল ইসলাম

তাঁর তৃতীয় জীবন

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

: সোমবার, ৩০ আগস্ট ২০২১

এক

কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘজীবীই ছিলেন, বলা যায়। সাতাত্তর বছর তিন মাসের জীবন তাঁর। এবং এই সময়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম ছিল তাঁর সাহিত্যচর্চার কাল, ১৯১৯-১৯৪২। অর্থাৎ তাঁর শেষ রচনার সময়কাল আজ থেকে ষাট বছর আগের। বড় আশ্চর্যের কথা আজ থেকে মাত্র ত্রিশ/একত্রিশ বছর পূর্বের ঘটনাবলিও যে বাঙালির স্মৃতিতে ম্লান হয়ে যাচ্ছে, সেই বাঙালি অর্ধশতাধিক বছর পূর্বের স্তব্ধলেখনী এক কবিকে সমকালে এমন করে তাঁর জীবনে ধারণ করে আছে। যদিও সামান্য বিশ্লেষণেই দেখা যায় বাঙালাচিত্তে নজরুলবীক্ষার সূত্রটি চিরকাল অবিচ্ছিন্ন ছিল না। তাঁর অসুস্থতা পরবর্তী দুই দশকে আরও ন’দশটি গ্রন্থে প্রকাশিত হলেও বিয়াল্লিশ থেকে বাহাত্তর এই ত্রিশ বছরের নজরুলস্মৃতি বড় বর্ণহীন। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, মানসিক মৃত্যুর ত্রিশ বছর পরে শারীরিক মৃত্যুর মুহূর্তেই যেন কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি হৃদয়ের কাছাকাছি চলে এলেন।

অথবা তাই কি?

এই রকম ঘটনা, অর্থাৎ দূরে সরে যাওয়া আত্মার আত্মীয়কে হৃদয়ের আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, এই বাঙালির জীবনেই অন্তত বাংলাদেশে, আরো একবার ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথও তাঁর মৃত্যুর পরেই যেন বাংলাদেশে পুনর্জীবন লাভ করেছেন। পাঠকচিত্তে পুনরাবির্ভাবের এমন সৌভাগ্য পৃথিবীর খুব বেশি কবির ভাগ্যে ঘটেছে বলে জানা নেই।

http://sangbad.net.bd/images/2021/August/30Aug21/news/Nazrul-Islam-04.jpg

রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্কসূত্রে আরও দু-একটি সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অব্যবহিত পরবর্তী সময়কালেই নজরুলের মানসিক মৃত্যু ঘটে, এবং বাংলাদেশে বাঙালির জীবনে ফিরেও আসেন যেন তাঁরা একই সময়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাক, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের জন্ম যেমন ইংরেজি পঞ্জিকার যে-মাসে মৃত্যুও তেমনি ইংরেজি পঞ্জিকার একই মাসে। এবং বাঙালির জীবনে তাঁদের পুনরুত্থানও প্রায় একই কারণে- যদিও সেই কারণ অনুসন্ধানকালে দুই বিপরীতমুখী স্রোত লক্ষ্য করা বিচিত্র নয়।

সত্তরের দশকের পূর্বে বাংলাদেশে নজরুলচর্চা ছিল না, এমন নয়। নজরুল চর্চায় কোন বাধা ছিল না, তবে অন্তত সরকারিভাবে তার কোন আধিক্যও ছিল না। তৎকালীন বাঙালির জীবনে নজরুল এমন স্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন না যেখানে বর্তমানে তিনি আছেন বলে মনে করা হয়

যেমন ধরা যাক, একসময় ছিল যখন সরকারি তীব্র বিরোধিতা তৎকালীন পূর্ববাংলায় রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্বের ওপরে সংশয়ের ছায়া ফেলেছিল। বিক্ষিপ্তভাবে রবীন্দ্রচর্চা চললেও সাময়িকভাবে তাঁকে গ্রহণের পথে প্রতিবন্ধকতা ছিল পর্বতপ্রমাণ। তাঁর বই খুঁজে পাওয়া যেতো না দোকানে; টেলিভিশন রেডিওতে তাঁর স্থান ছিল না, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন ব্রাত্য, “এককথায় এক প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করিয়ে রবীন্দ্রনাথকে উচ্ছেদ করার মারাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী।”

কিন্তু দৈহিক মৃত্যুর দুই যুগ পর পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে। ষাটের দশকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের যে জোয়ার নেমেছিল তাঁর একটি উপলক্ষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হৃদয়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের নাম। বিধিনিষেধের মুখে বাংলাদেশের মানুষ রবীন্দ্রচর্চাকে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল।

নজরুলের ক্ষেত্রে কিন্তু ঠিক এমন ঘটেনি। সত্তরের দশকের পূর্বে বাংলাদেশে নজরুলচর্চা ছিল না, এমন নয়। নজরুল চর্চায় কোন বাধা ছিল না, তবে, অন্তত সরকারিভাবে, তার কোন আধিক্যও ছিল না। তৎকালীন বাঙালির জীবনে নজরুল এমন স্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন না যেখানে বর্তমানে তিনি আছেন বলে মনে করা হয়। এই প্রসঙ্গে দু’একজন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য স্মরণ করা যাক।

“নজরুল রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি কংগ্রেস করতেন এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জাতীয়তা ছিল সকল সম্প্রদায়ের মিলিত জাতীয়তা- সেখানে দ্বিজাতিতত্ত্ব বা বহুজাতিতত্ত্বের কোন স্থান ছিল না। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়কে দুটি আলাদা নেশন রূপে চিহ্নিত করে তাদের জাতীয়তার মূলে ঘা দেয়ার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে এদেশে চলে আসছে এবং এখনও যার বিরাম হয়নি, নজরুলের সাম্প্রদায়িক আদর্শ ছিল তাঁর মূর্তিমান প্রতিবাদস্বরূপ।”

এ কারণেই দ্বিজাতিতত্ত্বেও উদ্গাতাদের চোখে নজরুল প্রিয় ছিলেন না- “তখনকার মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষিত অভিজাত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কেউ মুসলিম লীগে কেউবা অন্য কোন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবৃক্ষ যত শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এরা তত ক্রমে কংগ্রেস পরিত্যাগ করেন। সে কারণে নজরুল যে শুধু ধর্মান্ধ মৌলবাদী আলেম সমাজের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন তা নয়, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে তিনি তৎকালীন মুসলিম রাজনৈতিক এলিট নেতৃত্বের শত্রুপক্ষীয় অবস্থানে ছিলেন। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ পর্যন্ত মুসলিম লীগ কংগ্রেস-বিরোধিতার নামে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং বৃটিশ সরকারের সহযোগী শক্তি হিসেবেক কাজ করে। স্পষ্টতই মুসলিম লীগের রাজনীতি ও পাকিস্তান আন্দোলন কোনটার সঙ্গে নজরুলের কোন যোগ ছিল না।” এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘আত্মকথা’র এক মন্তব্য থেকে “কাজী নজরুল ইসলাম আগাগোড়া মি. জিন্নাহর দ্বিজাতিত্ত্ব ও পাকিস্তানবিরোধী ছিলেন। স্বলিখিত সম্পাদকীয়ের নিচে তার স্বাক্ষর থাকতো। একাধিক স্বাক্ষরিত রচনায় তিনি কঠোর ভাষায় পাকিস্তান পরিকল্পনা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের সমালোচনা করেন।” আবু জাফর শামসুদ্দীন তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধেও কিছু গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন এই বলে যে, “পাকিস্তানপন্থী ও পাকিস্তানবিরোধী নির্বিশেষে প্রায় সকল মুসলিম রাজনীতিক অসুস্থ নজরুলকে পরিত্যাগ করেন।”

পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও এই ভূখ-ে নজরুল সম্পর্কিত চিন্তার কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের খবর পাওয়া যায় না। পূর্ববাংলার জনমানসে নজরুল কিছু পরিমাণে অধিষ্ঠিত থাকলেও তা এমন তীব্র ছিল না যাতে সরকারি নীতি পরিবর্তিত হতে পারতো। বিশেষত ১৯৪২ থেকে ১৯৭২ এই ত্রিশ বছর অসুস্থ নজরুল যে দুর্দশার মধ্যে কাটিয়েছেন তা সকলেরই জানা; কিন্তু পাকিস্তান সরকার যে নজরুলের ঐ দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে তা নিরসনকল্পে নানা প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এমন কথা কেউ জানেন না। কিছু সময়ের জন্যে অনিয়মিত মাসোহারার কথাই জানা যায়। ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গেও যে নজরুল ঐ ত্রিশ বছরে বাঙালির নয়নমণি হয়ে বিরাজ করেছেন এমন বলারও কোন শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। অসুস্থতাপরবর্তীকালে তাঁর চিকিৎসা ও ঐ উদ্দেশ্যে তাঁর বিদেশ গমন সম্ভব হয় মূলত কলকাতার কিছু সাহিত্যিকের প্রচেষ্টায় গঠিত ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র উদ্যোগেই। বস্তুত যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের পরে কবির মাসিক সাহিত্যিক বৃত্তি একশ’ টাকা বাড়িয়ে দেয়া ছাড়া নজরুলের প্রতি ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বদান্যতার তেমন কোন নিদর্শন দেখা যায় না। পশ্চিম বাংলার জনচিত্তে নজরুলের জন্যে আবেগসিক্ত স্থান একটি হয়তো আছে, কিন্তু তাঁর পরিচয় সর্বদা স্পষ্ট নয়। নজরুলের মৃত্যুর দু’দশক আগের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে কোন উল্লেখযোগ্য নজরুলচর্চার নিদর্শন নেই। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী সরকার নজরুল-স্বীকৃতির বিষয়ে অন্যদের অপেক্ষা অগ্রবর্তী ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং নজরুলের মৃত্যুর আগেই তাঁর গ্রাম চুরুলিয়ায় সাংবাৎসরিক নজরুল উৎসবের আয়োজন করেন।

http://sangbad.net.bd/images/2021/August/30Aug21/news/Nazrul-Islam-05.jpg

নজরুল বিষয়ে পূর্ববঙ্গে সাহিত্য-সমালোচনা ও স্বীকৃতির মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক বিবেচনা কাজ করেছে তার কোন অবকাশ ছিল না পশ্চিমবঙ্গে। তবুও পশ্চিমবঙ্গীয় মনোভাবের মধ্যে একধরনের উপেক্ষা ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে নজরুল দীর্ঘদিন যাবৎ জীবন্মৃত ছিলেন। তাঁর সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তাও এই উপেক্ষার জন্য সম্ভবত কিয়দংশে দায়ী।

দুই

এই রকম অবস্থার মধ্যে ১৯৭২-এ সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে নজরুল ঢাকায় আসেন এবং বস্তুত তখনই বাংলাদেশে তাঁর পুনরুজ্জীবনের সূত্রপাত ঘটে।

শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলের জন্যে যে অভ্যর্থনা, বাসস্থান, সেবা ইত্যাদির ব্যবস্থা করেন অমন কিছু জীবন্মৃত, বোধহীন ঐ কবির ভাগ্যে কখনো মেলেনি। পশ্চিম বাংলার নজরুলপ্রেমিক মজহারুল ইসলামের এই বিবৃতি স্পষ্ট করে তোলে ঐ সময়ে নজরুলের জীবন : “দেখি বাড়িটি সুন্দর। একটি ছোট দোতলা বাড়ি। বাড়িটির সামনে ছোট্ট লন। লন পেরিয়ে দোতলার সিঁড়ি। সামনের ঘরটিতে নজরুলের পরিচর্যার জন্যে একাধিক সেবিকা নিযুক্ত। তারা পর্যায়ক্রমে দিবারাত্রি নজরুলের পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত আছে। কবি ও কবিপরিবারের জন্যে রান্না করার লোক সরকারি খরচে রাখা হয়েছে। এমনকি নজরুলকে নিয়ে প্রত্যহ বেড়াবার জন্য একটি বিদেশি গাড়ি সরকারি খরচে কবিকে দেয়া হয়েছে। এককথায় বাংলাদেশ সরকার কবির স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সব ব্যবস্থাই করেছেন।” ক্রিস্টোফার রোডের দুই কামরার ফ্ল্যাটে নজরুলকে দেখতে অভ্যস্ত মজহারুল ইসলামের পক্ষে এইসব ঘটনায় অভিভূত হওয়া স্বাভাবিক। এবং এ কারণেই তিনি যখন বলেন, “সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার নজরুলের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করেছেন, তা স্বাধীনতাপ্রাপ্তির তিরিশ বছর পরেও পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত সরকার কবির জন্য বিশেষ কিছুই করেননি”, আমরা বুঝি।

১৯৭৩-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি দেয়, বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশের পদক প্রদান করে ১৯৭৫-এর ফেব্রুয়ারি মাসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবৎকালে।

বাংলাদেশে নজরুলচর্চার স্রোত তখনও প্রবল বেগে প্রবাহিত না হলেও নজরুললের ‘পুনরুজ্জীবন’ পর্ব আরম্ভের পথে। ঐ পর্বের সম্পূর্ণতা আসে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করার মধ্য দিয়ে, এবং ১৯৮২ সালে তাঁকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’র সম্মানে সম্মানিত করে।

কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতিসেবী বুদ্ধিজীবীদের এক বিশাল সমাজ নজরুলের এই ‘পুনরুজ্জীবন’কে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের ‘পুনরুজ্জীবনে’র সমার্থক মনে করেন না। তাদের কথায় “কবির জীবদ্দশায় তাঁর প্রতি যে চরম উপক্ষো দেখানো হয়েছিল এসব সম্মান প্রদর্শন তার কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত বলে ধরা যেতো; কিন্তু এটা একটা রাজনীতি ছাড়া কিছু নয়। কবিকে ‘জাতীয় কবি’র আসন দিয়ে তাঁকে কেবল মুসলিম ঐতিহ্যের কবিরূপে প্রতিষ্ঠার জঘন্য পুরানো প্রয়াস, পাকিস্তানী রাজনীতিরই অনুসরণ মনে করা যেতে পারে। এবং উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৬ সালের ৩০শে আগস্ট নজরুল প্রয়াণের অব্যবহিত পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রদত্ত শোকবার্তার সঙ্গে ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে নজরুল জন্মদিবসে প্রদত্ত তার বিবৃতির তুলনা করেন:

(১) “কবি নজরুল ছিলেন মানবতা ও সাম্যের কবি। নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে তাহার লেখনী ছিল সোচ্চার। তাহার ক্ষুরধার লেখা কিছুকাল নীরব থাকিলেও তাহার উপস্থিতি, তাহার বিশ্বজনীন বাণী আমাদিগকে প্রেরণা দিয়াছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নজরুলের কবিতা, সঙ্গীত, জনগণ ও স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে।” (৩০ শে আগস্ট, ১৯৭৬)।

(২) “নজরুল ছিলেন নিপীড়িত মানবতার কবি, জনগণের সংগ্রামী চেতনার বিমূর্ত প্রতীক। নির্যাতিত মানুষের দুঃখবেদনাই ছিল তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য, অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ ছিল চির সোচ্চার।” (২৬শে মে, ১৯৭৮)।

(৩) “জীবনসাধক এই শিল্পী ছিলেন রেনেসাঁর, বিশেষ করিয়া মুসলিম রেনেসাঁর স্বাপ্নিক কবি এবং আমাদের জাতীয়তাবাদের পথিকৃৎ।” (২৬শে মে ১৯৭৯)।

ঐ একই দিনে তাঁর প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান নজরুল জয়ন্তী ও নজরুল একাডেমি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় বলেন, “তাহার লেখনীতে ছিল অগ্রসর ও অত্যাচারিত মুসলমানদের জাগরণের বাণী। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষা হইতেছে বংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।”

বাংলাদেশে নজরুলের ‘পুনরুজ্জীবন’ এমনি করে সম্পূর্ণতা লাভ করে।

তিন

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরুদ্দিনের এক বাক্যালাপের বিবরণ পাওয়া যায়। নজরুলের তখন বড় অর্থকষ্ট। সুফিয়া কামালের সেই বিখ্যাত চিঠিটি পেয়ে কোন একটি ব্যবস্থা করার জন্য নজরুলকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মোঃ নাসিরুদ্দিন। বাক্যালপটি এইরকম:

- আপনার জন্য একটা পরিকল্পনা করেছি। জানি না আপনার মনঃপূত হবে কিনা।

- কি?

- ‘সওগাত’-এ আপনি যে কটি কবিতা লিখেছেন তা নিয়ে আমাদের সমাজে অনুকূল আলোচনা চলছে।

- অনুকূল আলোচনা?

- হ্যাঁ আপনার প্রতি মুসলমান সমাজের বিরূপ মনোভাব অনেকটা দূর হয়েছে।

- বলেন কি!

- হ্যাঁ, পাঠকদের কাছ থেকে প্রশংসাসূচক চিঠি পাচ্ছি।

- বেশ তো।

- এবার একটা কথা মন দিয়ে শুনুন।

- বলুন।

- এখন মুসলমানরা তাদের সাহিত্যে ভাবধারা ফুটিয়ে তুলতে চায়।

- নিজস্ব ভাবধারা, সে আবার কি।

- অধৈর্য না হয়ে শুনুন সবটা। হিন্দু দেবদেবীদের উপমা দিয়ে আপনি যেসব কবিতা লিখেছেন, গান রচনা করেছেন, তাতে কাব্যরস যথেষ্ট থাকলেও বিরূপ মনোভাবের দরুন মুসলমান সমাজের পাঠকদের কাছে তা সমাদৃত হয়নি।

ততক্ষণে নজরুলের মুখচোখে ফুটে উঠেছে বিরক্তির ছাপ। খুব গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, “আবার হিন্দু-মুসলমানের কথা তুললেন কেন। কোন জাতি বা ধর্ম নিয়ে কবিতা লিখলে সেটা আর যাই হোক কাব্য হয় না।”

এই রকম আরো কিছু কথাবার্তার পরে ‘সওগাতে’র প্রচারের স্বার্থে নজরুল নাসিরুদ্দিনের কথামত লিখতে রাজি হন, “আপনার কথা মত না হয় লিখলাম। দেশের মঙ্গলের জন্য, সাহিত্যসংস্কৃতির মাধ্যমে মুসলমানদের জাগাবার প্রয়োজন, সে কথা আমি স্বীকার করি। কিন্তু ধর্মের নামে, সমাজ ও দেশের নামে যারা ভণ্ডামি করে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমার কলম কিন্তু থামবে না।”

চার

এক নজরুল বিশেষজ্ঞের মন্তব্য: “নজরুল ইসলামের ইসলামী গান ও গজল শুনে তাকে একজন সাচ্চা পীর পয়গম্বর ভাবা যেমন সম্ভব, তার শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, হিন্দুদের দেবদেবী ও হিন্দুধর্মের বিষয় নিয়ে লেখা কবিতা পাঠেও যে কেউ তাকে একজন সাত্ত্বিক ঠাকুর পুরোহিত ভাবতে পারেন। তার সাম্যবাদের গান কবিতা পড়ে যেমন তাকে খাঁটি সমাজতন্ত্রী ও/বা কম্যুনিস্ট ভাবা সম্ভব আবার তার রচনার কিছু চরণ বা বাক্য লক্ষ্য করে তাকে একজন নাস্তিক ভাবাও অসম্ভব নয়। নজরুল তাহলে কি ছিলেন? একজন ধর্মান্ধ মৌলানা? নাকি পুরোহিত? একজন কম্যুনিস্ট কিংবা নাস্তিক? উত্তরে বোধহয় বলা যায়, নজরুল এর কোনটাই ছিলেন না। আবার এর সবটা মিলেই নজরুল-মানস গঠিত।”

কিন্তু যারা একথা মানে না তাদের নিয়ে কী করা?

আর এক নজরুলবেত্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “যা লক্ষ্য করার তা এই যে, আমাদের সমাজই তাকে বিদ্রোহী কবি হিসাবে শনাক্ত করেছে, ‘মুসলিম রেনেসাঁসে’র সার্থক বাঙালি প্রতিভু বলে ভাবতে ভালবেসেছে। এর চেয়েও প্রধান বিবেচ্য: এই দুই আংশিক সত্যকে সম্পূর্ণ সত্য হিসেবে গ্রহণ করে এই উভয়ের চেয়েও যা বড় সত্য- অর্থাৎ তার ধর্মনিরপেক্ষ প্রেমসাধনা (কি সাহিত্য কি ব্যক্তিগত জীবনে) এবং তাঁর সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা দুটোই আমাদের সমাজে গৌণ হয়ে গেছে। গৌণ যে হয়ে গেল তার দায় নজরুলের না আমাদের?”

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

কাজী নজরুল ইসলাম

তাঁর তৃতীয় জীবন

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

সোমবার, ৩০ আগস্ট ২০২১

এক

কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘজীবীই ছিলেন, বলা যায়। সাতাত্তর বছর তিন মাসের জীবন তাঁর। এবং এই সময়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম ছিল তাঁর সাহিত্যচর্চার কাল, ১৯১৯-১৯৪২। অর্থাৎ তাঁর শেষ রচনার সময়কাল আজ থেকে ষাট বছর আগের। বড় আশ্চর্যের কথা আজ থেকে মাত্র ত্রিশ/একত্রিশ বছর পূর্বের ঘটনাবলিও যে বাঙালির স্মৃতিতে ম্লান হয়ে যাচ্ছে, সেই বাঙালি অর্ধশতাধিক বছর পূর্বের স্তব্ধলেখনী এক কবিকে সমকালে এমন করে তাঁর জীবনে ধারণ করে আছে। যদিও সামান্য বিশ্লেষণেই দেখা যায় বাঙালাচিত্তে নজরুলবীক্ষার সূত্রটি চিরকাল অবিচ্ছিন্ন ছিল না। তাঁর অসুস্থতা পরবর্তী দুই দশকে আরও ন’দশটি গ্রন্থে প্রকাশিত হলেও বিয়াল্লিশ থেকে বাহাত্তর এই ত্রিশ বছরের নজরুলস্মৃতি বড় বর্ণহীন। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, মানসিক মৃত্যুর ত্রিশ বছর পরে শারীরিক মৃত্যুর মুহূর্তেই যেন কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি হৃদয়ের কাছাকাছি চলে এলেন।

অথবা তাই কি?

এই রকম ঘটনা, অর্থাৎ দূরে সরে যাওয়া আত্মার আত্মীয়কে হৃদয়ের আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, এই বাঙালির জীবনেই অন্তত বাংলাদেশে, আরো একবার ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথও তাঁর মৃত্যুর পরেই যেন বাংলাদেশে পুনর্জীবন লাভ করেছেন। পাঠকচিত্তে পুনরাবির্ভাবের এমন সৌভাগ্য পৃথিবীর খুব বেশি কবির ভাগ্যে ঘটেছে বলে জানা নেই।

http://sangbad.net.bd/images/2021/August/30Aug21/news/Nazrul-Islam-04.jpg

রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্কসূত্রে আরও দু-একটি সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অব্যবহিত পরবর্তী সময়কালেই নজরুলের মানসিক মৃত্যু ঘটে, এবং বাংলাদেশে বাঙালির জীবনে ফিরেও আসেন যেন তাঁরা একই সময়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাক, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের জন্ম যেমন ইংরেজি পঞ্জিকার যে-মাসে মৃত্যুও তেমনি ইংরেজি পঞ্জিকার একই মাসে। এবং বাঙালির জীবনে তাঁদের পুনরুত্থানও প্রায় একই কারণে- যদিও সেই কারণ অনুসন্ধানকালে দুই বিপরীতমুখী স্রোত লক্ষ্য করা বিচিত্র নয়।

সত্তরের দশকের পূর্বে বাংলাদেশে নজরুলচর্চা ছিল না, এমন নয়। নজরুল চর্চায় কোন বাধা ছিল না, তবে অন্তত সরকারিভাবে তার কোন আধিক্যও ছিল না। তৎকালীন বাঙালির জীবনে নজরুল এমন স্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন না যেখানে বর্তমানে তিনি আছেন বলে মনে করা হয়

যেমন ধরা যাক, একসময় ছিল যখন সরকারি তীব্র বিরোধিতা তৎকালীন পূর্ববাংলায় রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্বের ওপরে সংশয়ের ছায়া ফেলেছিল। বিক্ষিপ্তভাবে রবীন্দ্রচর্চা চললেও সাময়িকভাবে তাঁকে গ্রহণের পথে প্রতিবন্ধকতা ছিল পর্বতপ্রমাণ। তাঁর বই খুঁজে পাওয়া যেতো না দোকানে; টেলিভিশন রেডিওতে তাঁর স্থান ছিল না, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন ব্রাত্য, “এককথায় এক প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করিয়ে রবীন্দ্রনাথকে উচ্ছেদ করার মারাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী।”

কিন্তু দৈহিক মৃত্যুর দুই যুগ পর পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে। ষাটের দশকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের যে জোয়ার নেমেছিল তাঁর একটি উপলক্ষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হৃদয়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের নাম। বিধিনিষেধের মুখে বাংলাদেশের মানুষ রবীন্দ্রচর্চাকে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল।

নজরুলের ক্ষেত্রে কিন্তু ঠিক এমন ঘটেনি। সত্তরের দশকের পূর্বে বাংলাদেশে নজরুলচর্চা ছিল না, এমন নয়। নজরুল চর্চায় কোন বাধা ছিল না, তবে, অন্তত সরকারিভাবে, তার কোন আধিক্যও ছিল না। তৎকালীন বাঙালির জীবনে নজরুল এমন স্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন না যেখানে বর্তমানে তিনি আছেন বলে মনে করা হয়। এই প্রসঙ্গে দু’একজন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য স্মরণ করা যাক।

“নজরুল রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি কংগ্রেস করতেন এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জাতীয়তা ছিল সকল সম্প্রদায়ের মিলিত জাতীয়তা- সেখানে দ্বিজাতিতত্ত্ব বা বহুজাতিতত্ত্বের কোন স্থান ছিল না। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়কে দুটি আলাদা নেশন রূপে চিহ্নিত করে তাদের জাতীয়তার মূলে ঘা দেয়ার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে এদেশে চলে আসছে এবং এখনও যার বিরাম হয়নি, নজরুলের সাম্প্রদায়িক আদর্শ ছিল তাঁর মূর্তিমান প্রতিবাদস্বরূপ।”

এ কারণেই দ্বিজাতিতত্ত্বেও উদ্গাতাদের চোখে নজরুল প্রিয় ছিলেন না- “তখনকার মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষিত অভিজাত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কেউ মুসলিম লীগে কেউবা অন্য কোন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবৃক্ষ যত শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এরা তত ক্রমে কংগ্রেস পরিত্যাগ করেন। সে কারণে নজরুল যে শুধু ধর্মান্ধ মৌলবাদী আলেম সমাজের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন তা নয়, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে তিনি তৎকালীন মুসলিম রাজনৈতিক এলিট নেতৃত্বের শত্রুপক্ষীয় অবস্থানে ছিলেন। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ পর্যন্ত মুসলিম লীগ কংগ্রেস-বিরোধিতার নামে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং বৃটিশ সরকারের সহযোগী শক্তি হিসেবেক কাজ করে। স্পষ্টতই মুসলিম লীগের রাজনীতি ও পাকিস্তান আন্দোলন কোনটার সঙ্গে নজরুলের কোন যোগ ছিল না।” এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘আত্মকথা’র এক মন্তব্য থেকে “কাজী নজরুল ইসলাম আগাগোড়া মি. জিন্নাহর দ্বিজাতিত্ত্ব ও পাকিস্তানবিরোধী ছিলেন। স্বলিখিত সম্পাদকীয়ের নিচে তার স্বাক্ষর থাকতো। একাধিক স্বাক্ষরিত রচনায় তিনি কঠোর ভাষায় পাকিস্তান পরিকল্পনা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের সমালোচনা করেন।” আবু জাফর শামসুদ্দীন তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধেও কিছু গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন এই বলে যে, “পাকিস্তানপন্থী ও পাকিস্তানবিরোধী নির্বিশেষে প্রায় সকল মুসলিম রাজনীতিক অসুস্থ নজরুলকে পরিত্যাগ করেন।”

পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও এই ভূখ-ে নজরুল সম্পর্কিত চিন্তার কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের খবর পাওয়া যায় না। পূর্ববাংলার জনমানসে নজরুল কিছু পরিমাণে অধিষ্ঠিত থাকলেও তা এমন তীব্র ছিল না যাতে সরকারি নীতি পরিবর্তিত হতে পারতো। বিশেষত ১৯৪২ থেকে ১৯৭২ এই ত্রিশ বছর অসুস্থ নজরুল যে দুর্দশার মধ্যে কাটিয়েছেন তা সকলেরই জানা; কিন্তু পাকিস্তান সরকার যে নজরুলের ঐ দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে তা নিরসনকল্পে নানা প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এমন কথা কেউ জানেন না। কিছু সময়ের জন্যে অনিয়মিত মাসোহারার কথাই জানা যায়। ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গেও যে নজরুল ঐ ত্রিশ বছরে বাঙালির নয়নমণি হয়ে বিরাজ করেছেন এমন বলারও কোন শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। অসুস্থতাপরবর্তীকালে তাঁর চিকিৎসা ও ঐ উদ্দেশ্যে তাঁর বিদেশ গমন সম্ভব হয় মূলত কলকাতার কিছু সাহিত্যিকের প্রচেষ্টায় গঠিত ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র উদ্যোগেই। বস্তুত যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের পরে কবির মাসিক সাহিত্যিক বৃত্তি একশ’ টাকা বাড়িয়ে দেয়া ছাড়া নজরুলের প্রতি ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বদান্যতার তেমন কোন নিদর্শন দেখা যায় না। পশ্চিম বাংলার জনচিত্তে নজরুলের জন্যে আবেগসিক্ত স্থান একটি হয়তো আছে, কিন্তু তাঁর পরিচয় সর্বদা স্পষ্ট নয়। নজরুলের মৃত্যুর দু’দশক আগের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে কোন উল্লেখযোগ্য নজরুলচর্চার নিদর্শন নেই। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী সরকার নজরুল-স্বীকৃতির বিষয়ে অন্যদের অপেক্ষা অগ্রবর্তী ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং নজরুলের মৃত্যুর আগেই তাঁর গ্রাম চুরুলিয়ায় সাংবাৎসরিক নজরুল উৎসবের আয়োজন করেন।

http://sangbad.net.bd/images/2021/August/30Aug21/news/Nazrul-Islam-05.jpg

নজরুল বিষয়ে পূর্ববঙ্গে সাহিত্য-সমালোচনা ও স্বীকৃতির মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক বিবেচনা কাজ করেছে তার কোন অবকাশ ছিল না পশ্চিমবঙ্গে। তবুও পশ্চিমবঙ্গীয় মনোভাবের মধ্যে একধরনের উপেক্ষা ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে নজরুল দীর্ঘদিন যাবৎ জীবন্মৃত ছিলেন। তাঁর সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তাও এই উপেক্ষার জন্য সম্ভবত কিয়দংশে দায়ী।

দুই

এই রকম অবস্থার মধ্যে ১৯৭২-এ সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে নজরুল ঢাকায় আসেন এবং বস্তুত তখনই বাংলাদেশে তাঁর পুনরুজ্জীবনের সূত্রপাত ঘটে।

শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলের জন্যে যে অভ্যর্থনা, বাসস্থান, সেবা ইত্যাদির ব্যবস্থা করেন অমন কিছু জীবন্মৃত, বোধহীন ঐ কবির ভাগ্যে কখনো মেলেনি। পশ্চিম বাংলার নজরুলপ্রেমিক মজহারুল ইসলামের এই বিবৃতি স্পষ্ট করে তোলে ঐ সময়ে নজরুলের জীবন : “দেখি বাড়িটি সুন্দর। একটি ছোট দোতলা বাড়ি। বাড়িটির সামনে ছোট্ট লন। লন পেরিয়ে দোতলার সিঁড়ি। সামনের ঘরটিতে নজরুলের পরিচর্যার জন্যে একাধিক সেবিকা নিযুক্ত। তারা পর্যায়ক্রমে দিবারাত্রি নজরুলের পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত আছে। কবি ও কবিপরিবারের জন্যে রান্না করার লোক সরকারি খরচে রাখা হয়েছে। এমনকি নজরুলকে নিয়ে প্রত্যহ বেড়াবার জন্য একটি বিদেশি গাড়ি সরকারি খরচে কবিকে দেয়া হয়েছে। এককথায় বাংলাদেশ সরকার কবির স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সব ব্যবস্থাই করেছেন।” ক্রিস্টোফার রোডের দুই কামরার ফ্ল্যাটে নজরুলকে দেখতে অভ্যস্ত মজহারুল ইসলামের পক্ষে এইসব ঘটনায় অভিভূত হওয়া স্বাভাবিক। এবং এ কারণেই তিনি যখন বলেন, “সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার নজরুলের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করেছেন, তা স্বাধীনতাপ্রাপ্তির তিরিশ বছর পরেও পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত সরকার কবির জন্য বিশেষ কিছুই করেননি”, আমরা বুঝি।

১৯৭৩-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি দেয়, বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশের পদক প্রদান করে ১৯৭৫-এর ফেব্রুয়ারি মাসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবৎকালে।

বাংলাদেশে নজরুলচর্চার স্রোত তখনও প্রবল বেগে প্রবাহিত না হলেও নজরুললের ‘পুনরুজ্জীবন’ পর্ব আরম্ভের পথে। ঐ পর্বের সম্পূর্ণতা আসে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করার মধ্য দিয়ে, এবং ১৯৮২ সালে তাঁকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’র সম্মানে সম্মানিত করে।

কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতিসেবী বুদ্ধিজীবীদের এক বিশাল সমাজ নজরুলের এই ‘পুনরুজ্জীবন’কে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের ‘পুনরুজ্জীবনে’র সমার্থক মনে করেন না। তাদের কথায় “কবির জীবদ্দশায় তাঁর প্রতি যে চরম উপক্ষো দেখানো হয়েছিল এসব সম্মান প্রদর্শন তার কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত বলে ধরা যেতো; কিন্তু এটা একটা রাজনীতি ছাড়া কিছু নয়। কবিকে ‘জাতীয় কবি’র আসন দিয়ে তাঁকে কেবল মুসলিম ঐতিহ্যের কবিরূপে প্রতিষ্ঠার জঘন্য পুরানো প্রয়াস, পাকিস্তানী রাজনীতিরই অনুসরণ মনে করা যেতে পারে। এবং উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৬ সালের ৩০শে আগস্ট নজরুল প্রয়াণের অব্যবহিত পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রদত্ত শোকবার্তার সঙ্গে ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে নজরুল জন্মদিবসে প্রদত্ত তার বিবৃতির তুলনা করেন:

(১) “কবি নজরুল ছিলেন মানবতা ও সাম্যের কবি। নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে তাহার লেখনী ছিল সোচ্চার। তাহার ক্ষুরধার লেখা কিছুকাল নীরব থাকিলেও তাহার উপস্থিতি, তাহার বিশ্বজনীন বাণী আমাদিগকে প্রেরণা দিয়াছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নজরুলের কবিতা, সঙ্গীত, জনগণ ও স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে।” (৩০ শে আগস্ট, ১৯৭৬)।

(২) “নজরুল ছিলেন নিপীড়িত মানবতার কবি, জনগণের সংগ্রামী চেতনার বিমূর্ত প্রতীক। নির্যাতিত মানুষের দুঃখবেদনাই ছিল তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য, অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ ছিল চির সোচ্চার।” (২৬শে মে, ১৯৭৮)।

(৩) “জীবনসাধক এই শিল্পী ছিলেন রেনেসাঁর, বিশেষ করিয়া মুসলিম রেনেসাঁর স্বাপ্নিক কবি এবং আমাদের জাতীয়তাবাদের পথিকৃৎ।” (২৬শে মে ১৯৭৯)।

ঐ একই দিনে তাঁর প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান নজরুল জয়ন্তী ও নজরুল একাডেমি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় বলেন, “তাহার লেখনীতে ছিল অগ্রসর ও অত্যাচারিত মুসলমানদের জাগরণের বাণী। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষা হইতেছে বংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।”

বাংলাদেশে নজরুলের ‘পুনরুজ্জীবন’ এমনি করে সম্পূর্ণতা লাভ করে।

তিন

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরুদ্দিনের এক বাক্যালাপের বিবরণ পাওয়া যায়। নজরুলের তখন বড় অর্থকষ্ট। সুফিয়া কামালের সেই বিখ্যাত চিঠিটি পেয়ে কোন একটি ব্যবস্থা করার জন্য নজরুলকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মোঃ নাসিরুদ্দিন। বাক্যালপটি এইরকম:

- আপনার জন্য একটা পরিকল্পনা করেছি। জানি না আপনার মনঃপূত হবে কিনা।

- কি?

- ‘সওগাত’-এ আপনি যে কটি কবিতা লিখেছেন তা নিয়ে আমাদের সমাজে অনুকূল আলোচনা চলছে।

- অনুকূল আলোচনা?

- হ্যাঁ আপনার প্রতি মুসলমান সমাজের বিরূপ মনোভাব অনেকটা দূর হয়েছে।

- বলেন কি!

- হ্যাঁ, পাঠকদের কাছ থেকে প্রশংসাসূচক চিঠি পাচ্ছি।

- বেশ তো।

- এবার একটা কথা মন দিয়ে শুনুন।

- বলুন।

- এখন মুসলমানরা তাদের সাহিত্যে ভাবধারা ফুটিয়ে তুলতে চায়।

- নিজস্ব ভাবধারা, সে আবার কি।

- অধৈর্য না হয়ে শুনুন সবটা। হিন্দু দেবদেবীদের উপমা দিয়ে আপনি যেসব কবিতা লিখেছেন, গান রচনা করেছেন, তাতে কাব্যরস যথেষ্ট থাকলেও বিরূপ মনোভাবের দরুন মুসলমান সমাজের পাঠকদের কাছে তা সমাদৃত হয়নি।

ততক্ষণে নজরুলের মুখচোখে ফুটে উঠেছে বিরক্তির ছাপ। খুব গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, “আবার হিন্দু-মুসলমানের কথা তুললেন কেন। কোন জাতি বা ধর্ম নিয়ে কবিতা লিখলে সেটা আর যাই হোক কাব্য হয় না।”

এই রকম আরো কিছু কথাবার্তার পরে ‘সওগাতে’র প্রচারের স্বার্থে নজরুল নাসিরুদ্দিনের কথামত লিখতে রাজি হন, “আপনার কথা মত না হয় লিখলাম। দেশের মঙ্গলের জন্য, সাহিত্যসংস্কৃতির মাধ্যমে মুসলমানদের জাগাবার প্রয়োজন, সে কথা আমি স্বীকার করি। কিন্তু ধর্মের নামে, সমাজ ও দেশের নামে যারা ভণ্ডামি করে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমার কলম কিন্তু থামবে না।”

চার

এক নজরুল বিশেষজ্ঞের মন্তব্য: “নজরুল ইসলামের ইসলামী গান ও গজল শুনে তাকে একজন সাচ্চা পীর পয়গম্বর ভাবা যেমন সম্ভব, তার শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, হিন্দুদের দেবদেবী ও হিন্দুধর্মের বিষয় নিয়ে লেখা কবিতা পাঠেও যে কেউ তাকে একজন সাত্ত্বিক ঠাকুর পুরোহিত ভাবতে পারেন। তার সাম্যবাদের গান কবিতা পড়ে যেমন তাকে খাঁটি সমাজতন্ত্রী ও/বা কম্যুনিস্ট ভাবা সম্ভব আবার তার রচনার কিছু চরণ বা বাক্য লক্ষ্য করে তাকে একজন নাস্তিক ভাবাও অসম্ভব নয়। নজরুল তাহলে কি ছিলেন? একজন ধর্মান্ধ মৌলানা? নাকি পুরোহিত? একজন কম্যুনিস্ট কিংবা নাস্তিক? উত্তরে বোধহয় বলা যায়, নজরুল এর কোনটাই ছিলেন না। আবার এর সবটা মিলেই নজরুল-মানস গঠিত।”

কিন্তু যারা একথা মানে না তাদের নিয়ে কী করা?

আর এক নজরুলবেত্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “যা লক্ষ্য করার তা এই যে, আমাদের সমাজই তাকে বিদ্রোহী কবি হিসাবে শনাক্ত করেছে, ‘মুসলিম রেনেসাঁসে’র সার্থক বাঙালি প্রতিভু বলে ভাবতে ভালবেসেছে। এর চেয়েও প্রধান বিবেচ্য: এই দুই আংশিক সত্যকে সম্পূর্ণ সত্য হিসেবে গ্রহণ করে এই উভয়ের চেয়েও যা বড় সত্য- অর্থাৎ তার ধর্মনিরপেক্ষ প্রেমসাধনা (কি সাহিত্য কি ব্যক্তিগত জীবনে) এবং তাঁর সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা দুটোই আমাদের সমাজে গৌণ হয়ে গেছে। গৌণ যে হয়ে গেল তার দায় নজরুলের না আমাদের?”

back to top