alt

সাময়িকী

লকডাউন

স্বাতী চৌধুরী

: সোমবার, ৩০ আগস্ট ২০২১

এ্যাই তুমি আমার কাছে লগডাউনের নামে এ্যাতো প্যানপ্যানানি কইরো নাতো। পারলে চুপ কইরা থাহ। তা না পারলে গান গাও, বাচ্চারার লগে বকবক করো আমি কিচ্ছু কমু না। খালি আমারে লগডাউনের অজুহাত দিয়া মেজাজ গরম দেখাইও না।

ক্যান দেখামু না ক্যান? একটা পুরুষমানুষ হইয়া সারাদিন ঘরে বইয়া থাহনের কষ্ট তুমি কি বোঝবা? আর বুঝবাই ক্যামনে কও? মাইয়া মানুষ তুমি! দেও,এক কাপ চা দেও খাই।

সুযোগ পেয়ে তাহেজা আরেকটা মুখ ঝামটা দেয়। মেজাজ আমারে দেখাইবা ক্যান? লগডাউন কি আমি দিছি না করোনা রোগটাই আমি আনছি কও? তারপর বলে, হ! ঠিকই কইছো, মাইয়া মানুষ অইয়া পুরুষ মানুষের ঘরে থাহার কষ্ট আমি বুঝুমই বা ক্যামনে? বোঝার দায়ও নাই আমার। শুধু মাইয়া মানুষ অইছিলাম বুইলা ঘরের ভিত্রে সারাজীবন লগডাউন অইয়া থাহনের কষ্ট তুমরা পুরুষ মাইনষেরা যেমন কোনোকালে বোঝো নাই, বোঝার চেষ্টাও করো নাই, বোঝার দায়ও স্বীকার করো নাই।

কী কইলা?

যা কইবার কইছি আর হেইডা তুমি শুনছো। না বোঝার ভান করলে আমি কি করুম?

ঠিক আছে কইও না। অক্কন এক কাপ চা দ্যাও না? সেই কোন সুম ধইরা কইতাছি।রাশেদ এবার অনুনয় করে।

তাহেজা পিয়াজ রসুনের খোসা ছাড়াচ্ছিল। সেটা হলে রান্না হবে। রান্না কখন শেষ হবে ছেলেমেয়েরা দু’দুবার খোঁজ নিয়েছে। স্কুল নেই, পড়াশোনা নেই বাইরে গিয়ে খেলাধুলা নেই তাই শুধু লুডু ক্যারাম খেলে তাদের সময় কাটছে না। এখন সকলের পেটে ঘন ঘন খিদে লাগে। ছেলেটা বলেছে- পেটের ভিত্রে ছুঁচোগুলোও বোধ হয় লকডাউনে পড়ছে আম্মা! তাইতো ওরা আমাদের পেটের ভিত্রেই খালি দৌড়ায়। তাহেজা বুঝতে পারে শুধু ছেলেমেয়ের পেটের ভেতর নয় তাদের বাপ আর দাদীর পেটেও ছুঁচোরা লকডাউনে পড়ে কীর্ত্তন শুরু করছে। সেজন্যেই এদেরকে দিনভর খাবার সাপ্লাই দিয়েও কুলোতে পারছে না সে। আগেতো রাশেদও ঘরে থাকতো না। সক্কাল হলে এককাপ চা খেয়ে তার মোটর পার্টসের দোকানে ভোঁ দৌড়। দুপুরে আড়াইটা তিনটায় বাড়িতে এসে খেয়েই আবার দৌড়। ফিরতে ফিরতে সেই রাত দশটা সাড়ে দশটা। বাচ্চাগুলো চলে যেতো স্কুলে। ছুটির দিন হলে পাশের দোকান থেকে পুরি, সিঙ্গাড়া, কেক-পেস্ট্রি, পিঠা, মিস্টি যাহোক কিছু একটা কিনে দিলেই চলতো। কিন্তু এখন গোষ্ঠীর তিনবেলার খাবারের পরও দুপুরে বিকালে আরো দুইবেলা নাস্তা যোগানো লাগে। আবার সেও যেমনতেমন দিলে চলে না। সকাল বেলা ভুনা খিচুড়ি নয়তো পরোটা ভাজি, বেলা সাড়ে এগারোটায় ঝালমুড়ি, বিকেলে নুডুলস নয় সেমাই না হয় চিড়া ভাজা। নুডুলস করোতো সেটা সিদ্ধ করো, পানি ঝরাও, ডিম ভাজো, পিয়াজ ভাজো, সাথে শশা, গাজর, টমেটো, কাঁচামরিচ, ধনেপাতাকুচিও লাগে। শালার নুডুলস কোম্পানির ব্যাটারা তো দুই মিনিটে ঝটপট নুডুলস রান্নার বিজ্ঞাপন দিয়ে খালাস। যত হ্যাপা সামলাইতে হয় এই গিন্নি নামের কাজের বেডিদের। বিড়বিড় করে সে।

কি হইল চা দিবা না?

যা কইবার কইছি আর হেইডা তুমি শুনছো। না বোঝার ভান করলে আমি কি করুম? ঠিক আছে কইও না। অক্কন এক কাপ চা দ্যাও না? সেই কোন সুম ধইরা কইতাছি। রাশেদ এবার অনুনয় করে

দেখতাছোনা কাম করতাছি। সেও তোমরার খাওয়ার লাইগাই। পোলাপান দুইবার তাগিদ দিচে। হেরপর তুমিও দিবা। যত খাওয়া তত কাম। যতবার খাওয়া ততবার বাসন ধোয়া। তুমিত কইবা খাওন আমি কিইন্যা আনি না! আরে পকেটে পয়সা থাকলে কিইন্যা আনন সোজা। যাকিছু হোক কিন্যা দিলেই শেষ। কিন্তু গিন্নি নামের কাজের বেডিরার তখনতো শুরু। তুমি চা খাইবাত? দেখো চুলাত লং আদার পানি ফুটতাছে। কাপে চিনি চাপাতা দেও আর গরম পানি ঢালো। ব্যস চা হইয়া গেল।

তাও তুমি দিবা না?

আরে বাবা বাইরে যাইতে চাও তো শরীল নাড়াইবার লাগি নাকি? আপাতত চায়ের কাপে চামচ নাড়াও তাওতো একটু নড়াচড়া হইব কও!

রাশেদ তাহেজার দিকে চোখ পাকায়। বলে হাতি যখন কাদায় পড়ে চামচিকাও লাথি মারে।আমারও সেই দশা হইছে কিনা। ঠিক আছে, মুখের সুখ মিটাইয়া লও। এক করোনায়তো আর জিন্দেগী যাইতো না।

তাহেজা কড়াইয়ে পিঁয়াজ ভাজতে ভাজতে বলে, তুমি তাইলে নিজেরে হাতি মনে করো আর আমারে চামচিকা? কইয়া ফালাও, কইয়া ফালাও। সারাজীবন তোমরা পুরুষের জাত নিজেদের হাতি ঘোড়া মনে কইরা আর মেয়েরারে চামচিকা জ্ঞান কইরা সুখ পাইছো। অক্কন নিজে চামচিকা হইয়াও তেজ কমে নাই তাও তুচ্চতাচ্ছিল্যই করো। কিন্তু ভাইবা দেখো, আমি চামচিকা যদি হইতো তোমার মা চামচিকা, তোমার মেয়েও চামচিকা, হ্যাঁ। বলি ডাইনে বায়ে উপরে নিচে চামচিকার মাঝে থাইক্কা তুমি হতিঘোড়া হও ক্যামনে সেইটা কও দেখি?

রাশেদ চুপ করে থাকে। সে ভাবছে। তাহেজা সাংঘাতিক চালাক মেয়ে। ওকে ধরার সুযোগ দেয়না। যখন বললো, আমি চামচিকা হলে তোমার মাও চামচিকা তখন মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। ভেবেছিল এইবার খপ করে ধরে ফেলবে। শেষ পর্যন্ত কিনা মাকে তুলে গালাগালি! কিন্তু মেজাজ পুরোটা গরম হওয়ার আগেই বলে কিনা তোমার মেয়েও চামচিকা! কেমন ব্যালেন্স করে নিল দেখো! কিছু বললে বলবে মেয়েটা তোমার একার নয় আমারও। আর আমি চামচিকা হলেতো মেয়ে চামচিকা হবেই! রাশেদ জব্দ হয়েছে দেখে তাহেজা মনে মনে হাসে। কিন্তু তার ভেতরের কৌতুক ভেতরে চেপে রেখে কষানো মসলায় ঝোল দিয়ে ভাজা মাছগুলো ছাড়তে ছাড়তে সে কৃত্রিম গম্ভীর সুরে একটু ঝাঁজ এনে বলে, বেলুনের মতো চুপসায় গেলা ক্যান? আর কিছু কও !

খুব রঙ লেগেছে না? বেকায়দায় পেয়েছো! মজা করো, হ্যাঁ মজা করো। কিন্তু একদিন এমন দিন আমারও আসবে হ্যাঁ। রাগ উঠলে রাশেদ মাঝে মাঝে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। তাহেজা সেটা জানে। ভাবলো এবার একটু লাগাম টানা দরকার। এই করোনার দুর্দিনে লোকটাকে বেশি রাগিয়ে লাভ নেই। তাই সে তার সুর একটু নরম করে বলে, শোন অত কথা কইও না। দেখো কি কথা থাইকা কি কথা আইসা পড়ল। তোমার ভুলভাল কথা শুনলে আমারওতো মেজাজ খারাপ হয় কও? আরে লগডাউন কি তোমার একলার লাগি হইছে নাকি? সারা দুনিয়া লগডাউনের ফানদে পড়ছে। সকলেই ত্রাহি ত্রাহি করতাছে ঠিক, কিন্তু করারওতো কিছুই নাই নাকি?

সেই কথাইতো কইছিলাম। দোকানপাট ব্যবসাপাতি বন্ধ থাকলে চলুম ক্যামনে সেই চিন্তায় আমিও ত্রাহি ত্রাহিতে আছি বলেই না তোমার লগে সুখ দুখের কথা কইতে গেলাম! কিন্তু তুমিত তাতে পানি ঢাইল্যা দিয়া কইছো আমি প্যানাপ্যানাইতাছি-

শোন, ব্যবসাপতি দোকানদারি কিছুদিন না করলে আমরা মরুম না। আল্লায় তোমারে যথেষ্ট দিছে গো। কই কি বাইচা থাকলে হেরপরনা টেকা পয়সা ব্যবসা বাণিজ্য!যদি এই পয়সা পয়সা কইরা রোগ আইনা মইরা যাই তো তোমার পয়সা কোন কামে লাগব শুনি?

তা না হয় ঠিক আছে দোকানদারি নাইবা করলাম? কিন্তু ঘরে আর কত থাহন যায় কও? এট্টু বাইরে গেলে কি আর হইবো? কি না সবাই কয় খবরদার! বাইরে পুলিশ ব্যাটারা আছে- তারা কয় খবরদার আর ঘরে তুমি হইছো গিয়া পুলিশের মা-

তাইলে কও প্যানপানানি করার কথা যে কইছি তা আমি ভুল কি কইলাম? তোমরা পুরুষেরা সারাজীবন, জীবনের পর জীবন আমরা মেয়েরারে কখনো শাসন ত্রাসন কইরা, কথনো বিধি নিষেধ নানা রকম ফতোয়া দিয়া লগডাউনে রাখছো না? সেই আমরার কাছে তিনদিনের বৈরাগী হইয়া ভাত রে অন্ন কওনের মত লগডাউনের যন্ত্রণা বুঝাইতে আইলে প্যানাপ্যানানি ছাড়া আর কোনো শব্দ আমি খুঁইজা পাই নাই। বুঝলা?

রাশেদ হা করে তাহেজার দিকে চেয়ে থাকে। সে তাহেজার কথার কোন মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না। বলে তোমরা সারাজীবন লগডাউনে থাকছো? তোমরা মেয়েরা? হাহাহা। সে হাসে। হাসি যেন থামেই না। তারপর অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে, লগডাউন হইল বাইরের মাইনষেরে ঘরের ভিত্রে আটকাইয়া রাখা। তা তোমাদের ঘরে থাকাটা লগডাউন ক্যামনে হয়? তোমরাতো ঘরেই থাহ চিরকাল। যারা সারাক্ষণ ঘরেই থাহে তারার লাইগা আবার লগডাউন কি? আর লগডাউনের কি জ্বালা সেইটাও তারা বুঝে!

তাহেজা এবার হাসি ধরে রাখতে পারে না। হাসতে হাসতে বলে, সাধে কি আর তোমারে মাথামোটা কই? আরে মাথামোটা বলদা ব্যাটা, এই যে সারাক্ষণ আমরা ঘরে থাহি? ক্যান থাহি? শখ কইরা থাহি? বলি আমার কি ইচ্ছা করে না তোমার মতো ঘরের বাইরে যাইতে, আকাশ দেখতে, বাতাস গায়ে মাখতে, ফুল পাখির শব্দ গন্ধ উপভোগ করতে! আমার কি ইচ্ছা করে না চায়ের দোকানে বইসা রাজা উজির মারতে? আরে সেইখানে বইসা রাজনীতির খিস্তি খেউড় উগড়াইতে না পারলেও আমরা মাইনষের সুখ দুঃখের কথা লইয়া আলাপ বিলাপ করতে পারতামতো! আর একদিনও কি আমরার ইচ্ছা করে না মিটিঙ মিছিলে যাইতে, দুই হাত উড়াইয়া শোলোগান দিতে? ইচ্ছা কি করে না যখন যেখানে খুশি চইলা যাইতে! যাইতে পারি না ক্যান? বাপের বাড়িতে মা বাপ মরলেও তোমরার যদি ইচ্ছা না হয়, মরমর বা মরা মাবাপরেও আমরা দেখতে যাইতে পারি না ক্যান?

তাহেজার একটানা এতোগুলো প্রশ্ন শুনে রাশেদের কানে ঠাসকি লাগে। ভাবে মাইয়া মানুষও অত প্রশ্ন করতে পারে? একটু সামলে নিয়ে সে বলে, বাপরে বাপরে বাপ! এ্যাই কী সাংঘাতিক মাইয়া গো তুমি! যে একখান লেকচার দিলায় গো!বলি তোমারে রাজনীতির মাঠে নামাইয়া দেই? সত্যি কইতাছি, তাবড় তাবড় নেতারা ফেইল মারবো-

ফাইজলামি রাখো। প্রশ্ন যা করছি উত্তর দেও!

কি উত্তর দিমু? যা প্রশ্ন করছো সব তো মাথার উপর দিয়া গেছে। তুমিই কও ক্যান যাইতে পারো না ?

এবার কৃত্রিম রাগে গড়গড় করে তাহেজা। আর মুখ চেপে হেসে বলে তুমার মতো পুরুষরা যে শয়তানের শয়তান! যখন চিপায় পড়ো, বিলাই সাইজা যাও। কিছু না বোঝার ভান ধরো।

রাশেদের মা তাহেজার শাশুড়ি ফিরোজা বেগম এতাক্ষণ ধরে ছেলে আর বউয়ের খিটিমিটি শুনছেন। তাহেজার শেষের কথাগুলো তিনি শুনেছেন মন দিয়ে। শুনতে শুনতে ভেবেছেন তাইতো এইগুলান তো আমারও কথা। লগডাউন লইয়া এই পোলাপানগোই খালি ফাল পাড়তাছে। ঠিকইতো আমগো নারীরা তো সারাটা জীবন লগডাউনেই কাটাইয়া দিলাম। আমার মায়, তার মায়, তার আগের মায় এইভাবে যত পিছনদিকে যাওয়া যাইবো আরো কড়া লগডাউন দেকতে পাওয়া যাইব। কই কোন নারীতো আওয়াজ করে নাই। আওয়াজ করবো কি করতেও দেয় নাই। মাগো মা এমনকি আমগোর মুখেও লগডাউন দিয়া রাখছিল তারা। আর অক্কনইকি আর সব নারীর মুখের লগডাউন খুলছে ? কিন্তু ফিরোজা বেগম আজ আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। ভাবলেন নারীর জীবনের এই লকডাউন তাদের নিজেদেরকেই তুলতে হবে। তিনি ড্রইংরুমের সোফা ছেড়ে ডাইনিঙ টেবিলে ছেলের পাশে এসে বসেন। তারপর বলেন, শোন রাশেদ, বউ তোরে ঠিকই মাথামোটা কইছে আর নাইলে তুই বেজায় সেয়ানা।

ক্যান আম্মা? তুমিও বুঝি আইজ বউ-এর তালে তাল দিতাছো?

ক্যান দিতাছি? শোন তবে। তুই বউয়ের কথার একটা উত্তরও দিলি নাতো? তাইলে আমি উত্তর দেই কেমন? এই যে এতক্ষণ ধইরা বউ যা যা কইল, মানে নানান ইচ্ছার কথা; জানিস আমারও না এইসব ইচ্ছা করতোরে- কিন্তু আমরারে কি শিখাইছিলো? মা-বাপ, দাদী, নানী এমন কি পাড়া পরতিবেশী? বুলে মাইয়া মানুষ বউ হইয়া শশুর বাড়ি ঢুকবো আর লাশ হইয়া বাইর অইব। এইসব কথা কইয়া মাইয়ারার মনখানইতো বাইন্ধা দিল সমাজ। আমরা ইচ্ছাগুলোরে মুখে আনবার কথাই ভাবতেও পারি নাইরে। আর এইডাতো গেল শশুর বাড়ির কথা। বাপের বাড়্টািই কি আর লগডাউনের আওতার বাইরে আছিল কও বউ? জন্মের পর খেলাধুলার বয়স থাইকা বাড়ির সামনে যে বটতলার মাঠে আমরা কত গোল্লাছুট এক্কাদোক্কা লুকালুকি খেলতাম হঠাৎ এক সকালে মায়ে কয় আইজগা বিকালে আর কদম তলার মাঠে খেলতে যাবি না।

ক্যান মা?

ক্যান মা কি? বড় হইছস যে! মাইয়ারা বড় হইলে আর বাড়ির বাইরে যায় না। তোমার সীমানা এখন এই উঠানের চৌহদ্দি বুঝলা? মায়তো আমারে আটকাইয়া দিল। বাড়ির উঠানের চৌহদ্দি পার হইনা। বিকালে পুবের মাঠেত্থন পোলাপানের খেলাধুলার সময় হৈহুল্লোড় কানে ভাইসা আসে। মনের ভিত্রে হু হু করে চৈত মাসের তুফানের মতন। কেলাস ফাইভের পরীক্ষা দিছিলাম আর স্কুলে যাইতে দিল না বাবা। শুনি এই অবস্থা আমার একলার না। ফুলি, জোহরা, হাজেরা এমন কি হিন্দু পাড়ার রানী, রেখা, সীতা, গীতা সক্কলের। কারোর সাথে আর দেখা হয় না। কী কষ্ট কী কষ্ট। সেই কষ্ট কেউ বুঝে না। পাশের বাড়িত আছিল একটা সৌখিন লোক। সে কলের গান বাজাইত। একটা গান শুনলে মনটা কেমুন জানি করতো- ফান্দে পড়িয়া বগায় কান্দেরে- মনে হইত আমি সেই ধরলা নদীর বগি যে ফান্দে পইড়া ছাটাছাটি করি। সেই হাসফাঁস ফান্দের ভিত্রেই একদিন আমার বিয়া হইয়া গেল। শশুর বাড়ি আইলাম তো য্যান এক কারাগারের বন্দি মানুষ। বড়ফুফা একবার বিনাদোষে কেইস খাইয়া তিনমাস জেল খাইটা আইছে। সে বন্দিখানার গল্প করতো। চাইরদিকে চাইরখান উচা উচা বেড়া আর মাথার উপুর একখান ছাদ। চোক্কের সামনে আর কিস্তা নাই। বিয়ার পর আমার খালি ফুফার মুখে শোনা সেই নাদেখা জেলখানার কথা মনে পড়ে। বাপের বাড়িতে চৌহদ্দি আছিল উঠান। এইহানে উঠানে কী হয় দেহি না। সীমানা আরো ছুডু অই গেলগা। রান্নাঘর আর শোয়ার ঘর। শোয়ার ঘর আর রান্নাঘর আর পায়খানা। ঘরের বউ কয়দিন আর বসাইয়া খাওয়াইব? অক্কন সরকার যেবায় পাবলিকরে বিনাপয়সায় খাওয়্ইায়া আর কুলাইতে পারতাছেনা বুইলা এট্টু এট্টু কইরা লগডাউন ছাড়তাছে তেমনি সংসারের কাজ কইরা শাশুড়িও যখন আর কুলাইতে পারে না তখন এট্টু এট্টু ক্ইরা ছাড়ে। পরথমে কলতলা,তারপর উঠান গোয়ালঘর আর কিছুদিন পর পুকুরঘাট। কিন্তু ঐ অতটুকুই। পুকুর পাড়ের পথে দিয়া কত মানুষ আসে যায়। ঘোমটার ফাঁকে চাইয়া দেহি বাপের বাড়িত্তন কেউ আইলনি!কেউ আসে না। কত্তদিন বাপ মা ভাই বুইনের কথা মনে পড়ে, দেখবার লাইগা পরাণডা আকুলি বিকুলি করে। আর কেউরে কইমুকি রাশেদের বাপেরে ভয়ে ভয়ে কই। অমা! খেঁকাইয়া উঠে। কয় কি দুইদিন পর পর বাপের বাড়ি যাওন লাগে? অথচ এমনও হইছে যেদিন কথাটা কইছি সেইদিন হয়তো দুইবছ্ছর আমি বাপের বাড়ি যাই নাই।

তাহেজা রাশেদকে উদ্দেশ্য করে বলে শুনছো তো? আমি কইলে তোমার ভাল লাগতো না কিন্তু অক্কন আম্মার মুখের কথা শুইন্যাও কি তোমার আর কওয়ার কিছু আছে?শোনও এইসব মেয়েদের কথা। শাশুড়ি বউয়ের মধ্যে শত্রুতা থাকলেও এই জায়গায় শাশুড়ি বউয়ের কথা কিন্তু এক।

আগো বৌমা, তাওতো তুমরা অক্কন কত জাগাত যাও। শপিং করো, ব্যাংকে যাও, বাচ্চারে নিয়া স্কুলে যাও, কত মাইনষের লগে তুমরার চিনাজানা-

হ আম্মা কথা ঠিক কারন দিন কিছুটা হইলেও বদলাইছে। কিন্তু কতটুক বদলাইছে? বদলাইছে ততটুকই যতটুক সংসারের দরকার। আমার আপনের দরকারে নয়। ঠিক য্যান ঘুড্ডির মতো। নাটাই যার হাতে সে ততটুকই সুতা ছাড়ে যতটুক সে উড়াইতে চায় বা অন্যের ঘুড্ডিরে ভোকাট্টা করতে যতটুক সুতা আলগা করা লাগে-

এক্কেরে হাছা কথা কইছো। সারাটা জেবন আমরা সত্যি একটা ঘুড্ডি হইয়াই কাটাইয়া দিলাম রে মা। যার নাটাই আমরার হাতে আছিল না। সারাটা জেবন নাটাইওয়ালা তার ইচ্ছামতন আমরারে উড়াইছে।

মা আর বউয়ের কথা শুনতে শুনতে নিজের বানানো চা টা বড়ো আয়েশ করে খাচ্ছিল রাশেদ। চা খেতে খেতে সে হাসছিল। তার মা বলে, হাসতাছিস ক্যান?

হাসতাছি কারন আ্ইজ কি সুন্দর বউ শাশুড়ি একবিন্দুতে মিইল্যা গেলায় হেইটা দেইখ্যা-

অ! এর লাইগা? তা আমরার জেবনের পত্তন যে বাপ সেই এক বিন্দু থাইকাই! না মিইলা যাইব কই? কিন্তু বাপ তরে একটা কথা কই-লগডাউন লইয়া আর প্যানপ্যানি করিস না। ঘরে থাক। মা বউ পোলাপানের লগে সময় কাটানোর চাইয়া কি বাইরের বন্ধুরার লগে সময় কাটাইতে এত মজা রে? সারাজেবনতো তাই করছস। এইবার লগডাউনের উসিলায় না হয় কতগুলান দিন আমরার লগে কাটাইয়া দে। আমরার যে ভালা লাগে তুই ঘরে থাকলে সেইটা বুঝতে পারোসনা? মনে রাখিস সারাজেবনের লগডাউন কিন্তু আমরা পোলাপানের মুখের পাইল চাইয়া হাসিমুখেই মাইনা আইছি। আর তুই জেবন বাঁচাইবার লাইগা এই লগডাউন মানবি না? কয়দিন আর থাকবো ক? নায় ছয়মাস নায় একবছর? তোর মা বউয়ের সারাজেবনের লগডাউনের চাইয়া কি এই সময়টা খুব তুচ্চ নয়?

মায়ের কথা শেষ। রাশেদ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। মনে হয় সে বেশ জব্দ হয়েছে।

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বড়শি

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

ছবি

রক্তে লেখা প্রেম: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিপ্লব

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শঙ্খজীবন: যাপিত জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতিকথা

ছবি

ওসামা অ্যালোমার এক ঝুড়ি খুদে গল্প

ছবি

প্রযুক্তির আলোয় বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

সূর্যের দেশ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

লড়াই

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রচলিত সাহিত্যধারার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন মধুসূদন

ছবি

মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন

ছবি

উত্তর-মানবতাবাদ ও শিল্প-সাহিত্যে তার প্রভাব

ছবি

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

দুই ঋতপার কিসসা এবং এক ন্যাকা চৈতন্য

ছবি

অন্যজীবন অন্যআগুন ছোঁয়া

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কবিজীবন, দর্শন ও কাব্যসন্ধান

ছবি

অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

tab

সাময়িকী

লকডাউন

স্বাতী চৌধুরী

সোমবার, ৩০ আগস্ট ২০২১

এ্যাই তুমি আমার কাছে লগডাউনের নামে এ্যাতো প্যানপ্যানানি কইরো নাতো। পারলে চুপ কইরা থাহ। তা না পারলে গান গাও, বাচ্চারার লগে বকবক করো আমি কিচ্ছু কমু না। খালি আমারে লগডাউনের অজুহাত দিয়া মেজাজ গরম দেখাইও না।

ক্যান দেখামু না ক্যান? একটা পুরুষমানুষ হইয়া সারাদিন ঘরে বইয়া থাহনের কষ্ট তুমি কি বোঝবা? আর বুঝবাই ক্যামনে কও? মাইয়া মানুষ তুমি! দেও,এক কাপ চা দেও খাই।

সুযোগ পেয়ে তাহেজা আরেকটা মুখ ঝামটা দেয়। মেজাজ আমারে দেখাইবা ক্যান? লগডাউন কি আমি দিছি না করোনা রোগটাই আমি আনছি কও? তারপর বলে, হ! ঠিকই কইছো, মাইয়া মানুষ অইয়া পুরুষ মানুষের ঘরে থাহার কষ্ট আমি বুঝুমই বা ক্যামনে? বোঝার দায়ও নাই আমার। শুধু মাইয়া মানুষ অইছিলাম বুইলা ঘরের ভিত্রে সারাজীবন লগডাউন অইয়া থাহনের কষ্ট তুমরা পুরুষ মাইনষেরা যেমন কোনোকালে বোঝো নাই, বোঝার চেষ্টাও করো নাই, বোঝার দায়ও স্বীকার করো নাই।

কী কইলা?

যা কইবার কইছি আর হেইডা তুমি শুনছো। না বোঝার ভান করলে আমি কি করুম?

ঠিক আছে কইও না। অক্কন এক কাপ চা দ্যাও না? সেই কোন সুম ধইরা কইতাছি।রাশেদ এবার অনুনয় করে।

তাহেজা পিয়াজ রসুনের খোসা ছাড়াচ্ছিল। সেটা হলে রান্না হবে। রান্না কখন শেষ হবে ছেলেমেয়েরা দু’দুবার খোঁজ নিয়েছে। স্কুল নেই, পড়াশোনা নেই বাইরে গিয়ে খেলাধুলা নেই তাই শুধু লুডু ক্যারাম খেলে তাদের সময় কাটছে না। এখন সকলের পেটে ঘন ঘন খিদে লাগে। ছেলেটা বলেছে- পেটের ভিত্রে ছুঁচোগুলোও বোধ হয় লকডাউনে পড়ছে আম্মা! তাইতো ওরা আমাদের পেটের ভিত্রেই খালি দৌড়ায়। তাহেজা বুঝতে পারে শুধু ছেলেমেয়ের পেটের ভেতর নয় তাদের বাপ আর দাদীর পেটেও ছুঁচোরা লকডাউনে পড়ে কীর্ত্তন শুরু করছে। সেজন্যেই এদেরকে দিনভর খাবার সাপ্লাই দিয়েও কুলোতে পারছে না সে। আগেতো রাশেদও ঘরে থাকতো না। সক্কাল হলে এককাপ চা খেয়ে তার মোটর পার্টসের দোকানে ভোঁ দৌড়। দুপুরে আড়াইটা তিনটায় বাড়িতে এসে খেয়েই আবার দৌড়। ফিরতে ফিরতে সেই রাত দশটা সাড়ে দশটা। বাচ্চাগুলো চলে যেতো স্কুলে। ছুটির দিন হলে পাশের দোকান থেকে পুরি, সিঙ্গাড়া, কেক-পেস্ট্রি, পিঠা, মিস্টি যাহোক কিছু একটা কিনে দিলেই চলতো। কিন্তু এখন গোষ্ঠীর তিনবেলার খাবারের পরও দুপুরে বিকালে আরো দুইবেলা নাস্তা যোগানো লাগে। আবার সেও যেমনতেমন দিলে চলে না। সকাল বেলা ভুনা খিচুড়ি নয়তো পরোটা ভাজি, বেলা সাড়ে এগারোটায় ঝালমুড়ি, বিকেলে নুডুলস নয় সেমাই না হয় চিড়া ভাজা। নুডুলস করোতো সেটা সিদ্ধ করো, পানি ঝরাও, ডিম ভাজো, পিয়াজ ভাজো, সাথে শশা, গাজর, টমেটো, কাঁচামরিচ, ধনেপাতাকুচিও লাগে। শালার নুডুলস কোম্পানির ব্যাটারা তো দুই মিনিটে ঝটপট নুডুলস রান্নার বিজ্ঞাপন দিয়ে খালাস। যত হ্যাপা সামলাইতে হয় এই গিন্নি নামের কাজের বেডিদের। বিড়বিড় করে সে।

কি হইল চা দিবা না?

যা কইবার কইছি আর হেইডা তুমি শুনছো। না বোঝার ভান করলে আমি কি করুম? ঠিক আছে কইও না। অক্কন এক কাপ চা দ্যাও না? সেই কোন সুম ধইরা কইতাছি। রাশেদ এবার অনুনয় করে

দেখতাছোনা কাম করতাছি। সেও তোমরার খাওয়ার লাইগাই। পোলাপান দুইবার তাগিদ দিচে। হেরপর তুমিও দিবা। যত খাওয়া তত কাম। যতবার খাওয়া ততবার বাসন ধোয়া। তুমিত কইবা খাওন আমি কিইন্যা আনি না! আরে পকেটে পয়সা থাকলে কিইন্যা আনন সোজা। যাকিছু হোক কিন্যা দিলেই শেষ। কিন্তু গিন্নি নামের কাজের বেডিরার তখনতো শুরু। তুমি চা খাইবাত? দেখো চুলাত লং আদার পানি ফুটতাছে। কাপে চিনি চাপাতা দেও আর গরম পানি ঢালো। ব্যস চা হইয়া গেল।

তাও তুমি দিবা না?

আরে বাবা বাইরে যাইতে চাও তো শরীল নাড়াইবার লাগি নাকি? আপাতত চায়ের কাপে চামচ নাড়াও তাওতো একটু নড়াচড়া হইব কও!

রাশেদ তাহেজার দিকে চোখ পাকায়। বলে হাতি যখন কাদায় পড়ে চামচিকাও লাথি মারে।আমারও সেই দশা হইছে কিনা। ঠিক আছে, মুখের সুখ মিটাইয়া লও। এক করোনায়তো আর জিন্দেগী যাইতো না।

তাহেজা কড়াইয়ে পিঁয়াজ ভাজতে ভাজতে বলে, তুমি তাইলে নিজেরে হাতি মনে করো আর আমারে চামচিকা? কইয়া ফালাও, কইয়া ফালাও। সারাজীবন তোমরা পুরুষের জাত নিজেদের হাতি ঘোড়া মনে কইরা আর মেয়েরারে চামচিকা জ্ঞান কইরা সুখ পাইছো। অক্কন নিজে চামচিকা হইয়াও তেজ কমে নাই তাও তুচ্চতাচ্ছিল্যই করো। কিন্তু ভাইবা দেখো, আমি চামচিকা যদি হইতো তোমার মা চামচিকা, তোমার মেয়েও চামচিকা, হ্যাঁ। বলি ডাইনে বায়ে উপরে নিচে চামচিকার মাঝে থাইক্কা তুমি হতিঘোড়া হও ক্যামনে সেইটা কও দেখি?

রাশেদ চুপ করে থাকে। সে ভাবছে। তাহেজা সাংঘাতিক চালাক মেয়ে। ওকে ধরার সুযোগ দেয়না। যখন বললো, আমি চামচিকা হলে তোমার মাও চামচিকা তখন মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। ভেবেছিল এইবার খপ করে ধরে ফেলবে। শেষ পর্যন্ত কিনা মাকে তুলে গালাগালি! কিন্তু মেজাজ পুরোটা গরম হওয়ার আগেই বলে কিনা তোমার মেয়েও চামচিকা! কেমন ব্যালেন্স করে নিল দেখো! কিছু বললে বলবে মেয়েটা তোমার একার নয় আমারও। আর আমি চামচিকা হলেতো মেয়ে চামচিকা হবেই! রাশেদ জব্দ হয়েছে দেখে তাহেজা মনে মনে হাসে। কিন্তু তার ভেতরের কৌতুক ভেতরে চেপে রেখে কষানো মসলায় ঝোল দিয়ে ভাজা মাছগুলো ছাড়তে ছাড়তে সে কৃত্রিম গম্ভীর সুরে একটু ঝাঁজ এনে বলে, বেলুনের মতো চুপসায় গেলা ক্যান? আর কিছু কও !

খুব রঙ লেগেছে না? বেকায়দায় পেয়েছো! মজা করো, হ্যাঁ মজা করো। কিন্তু একদিন এমন দিন আমারও আসবে হ্যাঁ। রাগ উঠলে রাশেদ মাঝে মাঝে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। তাহেজা সেটা জানে। ভাবলো এবার একটু লাগাম টানা দরকার। এই করোনার দুর্দিনে লোকটাকে বেশি রাগিয়ে লাভ নেই। তাই সে তার সুর একটু নরম করে বলে, শোন অত কথা কইও না। দেখো কি কথা থাইকা কি কথা আইসা পড়ল। তোমার ভুলভাল কথা শুনলে আমারওতো মেজাজ খারাপ হয় কও? আরে লগডাউন কি তোমার একলার লাগি হইছে নাকি? সারা দুনিয়া লগডাউনের ফানদে পড়ছে। সকলেই ত্রাহি ত্রাহি করতাছে ঠিক, কিন্তু করারওতো কিছুই নাই নাকি?

সেই কথাইতো কইছিলাম। দোকানপাট ব্যবসাপাতি বন্ধ থাকলে চলুম ক্যামনে সেই চিন্তায় আমিও ত্রাহি ত্রাহিতে আছি বলেই না তোমার লগে সুখ দুখের কথা কইতে গেলাম! কিন্তু তুমিত তাতে পানি ঢাইল্যা দিয়া কইছো আমি প্যানাপ্যানাইতাছি-

শোন, ব্যবসাপতি দোকানদারি কিছুদিন না করলে আমরা মরুম না। আল্লায় তোমারে যথেষ্ট দিছে গো। কই কি বাইচা থাকলে হেরপরনা টেকা পয়সা ব্যবসা বাণিজ্য!যদি এই পয়সা পয়সা কইরা রোগ আইনা মইরা যাই তো তোমার পয়সা কোন কামে লাগব শুনি?

তা না হয় ঠিক আছে দোকানদারি নাইবা করলাম? কিন্তু ঘরে আর কত থাহন যায় কও? এট্টু বাইরে গেলে কি আর হইবো? কি না সবাই কয় খবরদার! বাইরে পুলিশ ব্যাটারা আছে- তারা কয় খবরদার আর ঘরে তুমি হইছো গিয়া পুলিশের মা-

তাইলে কও প্যানপানানি করার কথা যে কইছি তা আমি ভুল কি কইলাম? তোমরা পুরুষেরা সারাজীবন, জীবনের পর জীবন আমরা মেয়েরারে কখনো শাসন ত্রাসন কইরা, কথনো বিধি নিষেধ নানা রকম ফতোয়া দিয়া লগডাউনে রাখছো না? সেই আমরার কাছে তিনদিনের বৈরাগী হইয়া ভাত রে অন্ন কওনের মত লগডাউনের যন্ত্রণা বুঝাইতে আইলে প্যানাপ্যানানি ছাড়া আর কোনো শব্দ আমি খুঁইজা পাই নাই। বুঝলা?

রাশেদ হা করে তাহেজার দিকে চেয়ে থাকে। সে তাহেজার কথার কোন মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না। বলে তোমরা সারাজীবন লগডাউনে থাকছো? তোমরা মেয়েরা? হাহাহা। সে হাসে। হাসি যেন থামেই না। তারপর অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে, লগডাউন হইল বাইরের মাইনষেরে ঘরের ভিত্রে আটকাইয়া রাখা। তা তোমাদের ঘরে থাকাটা লগডাউন ক্যামনে হয়? তোমরাতো ঘরেই থাহ চিরকাল। যারা সারাক্ষণ ঘরেই থাহে তারার লাইগা আবার লগডাউন কি? আর লগডাউনের কি জ্বালা সেইটাও তারা বুঝে!

তাহেজা এবার হাসি ধরে রাখতে পারে না। হাসতে হাসতে বলে, সাধে কি আর তোমারে মাথামোটা কই? আরে মাথামোটা বলদা ব্যাটা, এই যে সারাক্ষণ আমরা ঘরে থাহি? ক্যান থাহি? শখ কইরা থাহি? বলি আমার কি ইচ্ছা করে না তোমার মতো ঘরের বাইরে যাইতে, আকাশ দেখতে, বাতাস গায়ে মাখতে, ফুল পাখির শব্দ গন্ধ উপভোগ করতে! আমার কি ইচ্ছা করে না চায়ের দোকানে বইসা রাজা উজির মারতে? আরে সেইখানে বইসা রাজনীতির খিস্তি খেউড় উগড়াইতে না পারলেও আমরা মাইনষের সুখ দুঃখের কথা লইয়া আলাপ বিলাপ করতে পারতামতো! আর একদিনও কি আমরার ইচ্ছা করে না মিটিঙ মিছিলে যাইতে, দুই হাত উড়াইয়া শোলোগান দিতে? ইচ্ছা কি করে না যখন যেখানে খুশি চইলা যাইতে! যাইতে পারি না ক্যান? বাপের বাড়িতে মা বাপ মরলেও তোমরার যদি ইচ্ছা না হয়, মরমর বা মরা মাবাপরেও আমরা দেখতে যাইতে পারি না ক্যান?

তাহেজার একটানা এতোগুলো প্রশ্ন শুনে রাশেদের কানে ঠাসকি লাগে। ভাবে মাইয়া মানুষও অত প্রশ্ন করতে পারে? একটু সামলে নিয়ে সে বলে, বাপরে বাপরে বাপ! এ্যাই কী সাংঘাতিক মাইয়া গো তুমি! যে একখান লেকচার দিলায় গো!বলি তোমারে রাজনীতির মাঠে নামাইয়া দেই? সত্যি কইতাছি, তাবড় তাবড় নেতারা ফেইল মারবো-

ফাইজলামি রাখো। প্রশ্ন যা করছি উত্তর দেও!

কি উত্তর দিমু? যা প্রশ্ন করছো সব তো মাথার উপর দিয়া গেছে। তুমিই কও ক্যান যাইতে পারো না ?

এবার কৃত্রিম রাগে গড়গড় করে তাহেজা। আর মুখ চেপে হেসে বলে তুমার মতো পুরুষরা যে শয়তানের শয়তান! যখন চিপায় পড়ো, বিলাই সাইজা যাও। কিছু না বোঝার ভান ধরো।

রাশেদের মা তাহেজার শাশুড়ি ফিরোজা বেগম এতাক্ষণ ধরে ছেলে আর বউয়ের খিটিমিটি শুনছেন। তাহেজার শেষের কথাগুলো তিনি শুনেছেন মন দিয়ে। শুনতে শুনতে ভেবেছেন তাইতো এইগুলান তো আমারও কথা। লগডাউন লইয়া এই পোলাপানগোই খালি ফাল পাড়তাছে। ঠিকইতো আমগো নারীরা তো সারাটা জীবন লগডাউনেই কাটাইয়া দিলাম। আমার মায়, তার মায়, তার আগের মায় এইভাবে যত পিছনদিকে যাওয়া যাইবো আরো কড়া লগডাউন দেকতে পাওয়া যাইব। কই কোন নারীতো আওয়াজ করে নাই। আওয়াজ করবো কি করতেও দেয় নাই। মাগো মা এমনকি আমগোর মুখেও লগডাউন দিয়া রাখছিল তারা। আর অক্কনইকি আর সব নারীর মুখের লগডাউন খুলছে ? কিন্তু ফিরোজা বেগম আজ আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। ভাবলেন নারীর জীবনের এই লকডাউন তাদের নিজেদেরকেই তুলতে হবে। তিনি ড্রইংরুমের সোফা ছেড়ে ডাইনিঙ টেবিলে ছেলের পাশে এসে বসেন। তারপর বলেন, শোন রাশেদ, বউ তোরে ঠিকই মাথামোটা কইছে আর নাইলে তুই বেজায় সেয়ানা।

ক্যান আম্মা? তুমিও বুঝি আইজ বউ-এর তালে তাল দিতাছো?

ক্যান দিতাছি? শোন তবে। তুই বউয়ের কথার একটা উত্তরও দিলি নাতো? তাইলে আমি উত্তর দেই কেমন? এই যে এতক্ষণ ধইরা বউ যা যা কইল, মানে নানান ইচ্ছার কথা; জানিস আমারও না এইসব ইচ্ছা করতোরে- কিন্তু আমরারে কি শিখাইছিলো? মা-বাপ, দাদী, নানী এমন কি পাড়া পরতিবেশী? বুলে মাইয়া মানুষ বউ হইয়া শশুর বাড়ি ঢুকবো আর লাশ হইয়া বাইর অইব। এইসব কথা কইয়া মাইয়ারার মনখানইতো বাইন্ধা দিল সমাজ। আমরা ইচ্ছাগুলোরে মুখে আনবার কথাই ভাবতেও পারি নাইরে। আর এইডাতো গেল শশুর বাড়ির কথা। বাপের বাড়্টািই কি আর লগডাউনের আওতার বাইরে আছিল কও বউ? জন্মের পর খেলাধুলার বয়স থাইকা বাড়ির সামনে যে বটতলার মাঠে আমরা কত গোল্লাছুট এক্কাদোক্কা লুকালুকি খেলতাম হঠাৎ এক সকালে মায়ে কয় আইজগা বিকালে আর কদম তলার মাঠে খেলতে যাবি না।

ক্যান মা?

ক্যান মা কি? বড় হইছস যে! মাইয়ারা বড় হইলে আর বাড়ির বাইরে যায় না। তোমার সীমানা এখন এই উঠানের চৌহদ্দি বুঝলা? মায়তো আমারে আটকাইয়া দিল। বাড়ির উঠানের চৌহদ্দি পার হইনা। বিকালে পুবের মাঠেত্থন পোলাপানের খেলাধুলার সময় হৈহুল্লোড় কানে ভাইসা আসে। মনের ভিত্রে হু হু করে চৈত মাসের তুফানের মতন। কেলাস ফাইভের পরীক্ষা দিছিলাম আর স্কুলে যাইতে দিল না বাবা। শুনি এই অবস্থা আমার একলার না। ফুলি, জোহরা, হাজেরা এমন কি হিন্দু পাড়ার রানী, রেখা, সীতা, গীতা সক্কলের। কারোর সাথে আর দেখা হয় না। কী কষ্ট কী কষ্ট। সেই কষ্ট কেউ বুঝে না। পাশের বাড়িত আছিল একটা সৌখিন লোক। সে কলের গান বাজাইত। একটা গান শুনলে মনটা কেমুন জানি করতো- ফান্দে পড়িয়া বগায় কান্দেরে- মনে হইত আমি সেই ধরলা নদীর বগি যে ফান্দে পইড়া ছাটাছাটি করি। সেই হাসফাঁস ফান্দের ভিত্রেই একদিন আমার বিয়া হইয়া গেল। শশুর বাড়ি আইলাম তো য্যান এক কারাগারের বন্দি মানুষ। বড়ফুফা একবার বিনাদোষে কেইস খাইয়া তিনমাস জেল খাইটা আইছে। সে বন্দিখানার গল্প করতো। চাইরদিকে চাইরখান উচা উচা বেড়া আর মাথার উপুর একখান ছাদ। চোক্কের সামনে আর কিস্তা নাই। বিয়ার পর আমার খালি ফুফার মুখে শোনা সেই নাদেখা জেলখানার কথা মনে পড়ে। বাপের বাড়িতে চৌহদ্দি আছিল উঠান। এইহানে উঠানে কী হয় দেহি না। সীমানা আরো ছুডু অই গেলগা। রান্নাঘর আর শোয়ার ঘর। শোয়ার ঘর আর রান্নাঘর আর পায়খানা। ঘরের বউ কয়দিন আর বসাইয়া খাওয়াইব? অক্কন সরকার যেবায় পাবলিকরে বিনাপয়সায় খাওয়্ইায়া আর কুলাইতে পারতাছেনা বুইলা এট্টু এট্টু কইরা লগডাউন ছাড়তাছে তেমনি সংসারের কাজ কইরা শাশুড়িও যখন আর কুলাইতে পারে না তখন এট্টু এট্টু ক্ইরা ছাড়ে। পরথমে কলতলা,তারপর উঠান গোয়ালঘর আর কিছুদিন পর পুকুরঘাট। কিন্তু ঐ অতটুকুই। পুকুর পাড়ের পথে দিয়া কত মানুষ আসে যায়। ঘোমটার ফাঁকে চাইয়া দেহি বাপের বাড়িত্তন কেউ আইলনি!কেউ আসে না। কত্তদিন বাপ মা ভাই বুইনের কথা মনে পড়ে, দেখবার লাইগা পরাণডা আকুলি বিকুলি করে। আর কেউরে কইমুকি রাশেদের বাপেরে ভয়ে ভয়ে কই। অমা! খেঁকাইয়া উঠে। কয় কি দুইদিন পর পর বাপের বাড়ি যাওন লাগে? অথচ এমনও হইছে যেদিন কথাটা কইছি সেইদিন হয়তো দুইবছ্ছর আমি বাপের বাড়ি যাই নাই।

তাহেজা রাশেদকে উদ্দেশ্য করে বলে শুনছো তো? আমি কইলে তোমার ভাল লাগতো না কিন্তু অক্কন আম্মার মুখের কথা শুইন্যাও কি তোমার আর কওয়ার কিছু আছে?শোনও এইসব মেয়েদের কথা। শাশুড়ি বউয়ের মধ্যে শত্রুতা থাকলেও এই জায়গায় শাশুড়ি বউয়ের কথা কিন্তু এক।

আগো বৌমা, তাওতো তুমরা অক্কন কত জাগাত যাও। শপিং করো, ব্যাংকে যাও, বাচ্চারে নিয়া স্কুলে যাও, কত মাইনষের লগে তুমরার চিনাজানা-

হ আম্মা কথা ঠিক কারন দিন কিছুটা হইলেও বদলাইছে। কিন্তু কতটুক বদলাইছে? বদলাইছে ততটুকই যতটুক সংসারের দরকার। আমার আপনের দরকারে নয়। ঠিক য্যান ঘুড্ডির মতো। নাটাই যার হাতে সে ততটুকই সুতা ছাড়ে যতটুক সে উড়াইতে চায় বা অন্যের ঘুড্ডিরে ভোকাট্টা করতে যতটুক সুতা আলগা করা লাগে-

এক্কেরে হাছা কথা কইছো। সারাটা জেবন আমরা সত্যি একটা ঘুড্ডি হইয়াই কাটাইয়া দিলাম রে মা। যার নাটাই আমরার হাতে আছিল না। সারাটা জেবন নাটাইওয়ালা তার ইচ্ছামতন আমরারে উড়াইছে।

মা আর বউয়ের কথা শুনতে শুনতে নিজের বানানো চা টা বড়ো আয়েশ করে খাচ্ছিল রাশেদ। চা খেতে খেতে সে হাসছিল। তার মা বলে, হাসতাছিস ক্যান?

হাসতাছি কারন আ্ইজ কি সুন্দর বউ শাশুড়ি একবিন্দুতে মিইল্যা গেলায় হেইটা দেইখ্যা-

অ! এর লাইগা? তা আমরার জেবনের পত্তন যে বাপ সেই এক বিন্দু থাইকাই! না মিইলা যাইব কই? কিন্তু বাপ তরে একটা কথা কই-লগডাউন লইয়া আর প্যানপ্যানি করিস না। ঘরে থাক। মা বউ পোলাপানের লগে সময় কাটানোর চাইয়া কি বাইরের বন্ধুরার লগে সময় কাটাইতে এত মজা রে? সারাজেবনতো তাই করছস। এইবার লগডাউনের উসিলায় না হয় কতগুলান দিন আমরার লগে কাটাইয়া দে। আমরার যে ভালা লাগে তুই ঘরে থাকলে সেইটা বুঝতে পারোসনা? মনে রাখিস সারাজেবনের লগডাউন কিন্তু আমরা পোলাপানের মুখের পাইল চাইয়া হাসিমুখেই মাইনা আইছি। আর তুই জেবন বাঁচাইবার লাইগা এই লগডাউন মানবি না? কয়দিন আর থাকবো ক? নায় ছয়মাস নায় একবছর? তোর মা বউয়ের সারাজেবনের লগডাউনের চাইয়া কি এই সময়টা খুব তুচ্চ নয়?

মায়ের কথা শেষ। রাশেদ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। মনে হয় সে বেশ জব্দ হয়েছে।

back to top