বাবু মল্লিক
বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়ার পর কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন কলকাতা কলেজ স্ট্রীটে ওঠেন তখন কাজী আব্দুল ওদুদ (২৬.৪১৮৯৪- ১৯.৫.১৯৭০)ও ছিলেন সেখানে। ‘কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আফজালুল হক সাহেবের পরিচয় ছিল না।... নজরুল যখন এসেছিলেন তখন তো ওদুদ সাহেব তাঁর সঙ্গে ৩২, কলেজ স্ট্রীটেই থাকতেন।...’১ কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে ওদুদ ছিলেন পাঁচ বছরের বড় আর এয়াকুব আলী চৌধুরী দশ বছরের বড়। চৌধুরী সাহেব কবিকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, “আপনাকে বাংলার মুসলমান বারীন ঘোষ হতে হবে।- ‘এয়াকুব আলী চৌধুরীর এই আশীর্বাদ নজরুলের জীবনকে ফলে-ফুলে সুশোভিত করে সাফল্যের স্বর্ণদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিল’।”২
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রথম সংখ্যায় (বৈশাখ ১৩২৫) তৎকালীন প্রখ্যাত লেখকদের মধ্যে রাজবাড়ীর কাজী অব্দুল ওদুদের গল্প ‘ভুল’ ছাপা হয়। ওদুদের সাহিত্য জীবন শুরু হয়েছিল আরো আগে, তাঁর কলকাতায় উপস্থিতি ঘটেছিল নজরুলের সাথে পরিচয়েরও বেশ আগে- ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১০ টাকা জেলাবৃত্তি নিয়ে। প্রেসিডেন্সি কলেজে আই.এ ক্লাসের ছাত্রাবস্থায় বকুলবাগানে কিংবা বেকার হোস্টেলে ‘গীতাঞ্জলী’র গানচর্চা করে তখন ‘সবুজপত্রে’র গ্রাহক ওদুদের সাহিত্য-রুচি সৃষ্টি হয়েছিল। কবি মোজাম্মেল পুত্র আফজাল-উল হক ও কমরেড মোজাফ্ফর আহম্মেদের বেকার হোস্টেল থেকে প্রকাশিত হাতে-লেখা পত্রিকায় ‘শ্রী-দীক্ষিত’ ছদ্মনামে প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমেই তাঁর সাহিত্য-কর্ম চলে আসছিল। ওদুদের ‘মীর পরিবার’ বেরিয়ে গেছে ১৯১৮ খ্রীস্টাব্দে। ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’র ত্রৈমাসিক পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে এরপরে। ওই পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা। কাজী নজরুল ইসলামের সাথে এখানেই কাজী আব্দুল ওদুদের পরিচয় ঘটে, ১৯২০ সালের ১২ই জুলাই তারিখে কাজী নজরুল ইসলাম ও মোজাফ্ফর আহম্মদের সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ যখন বের হয় কাজী আব্দুল ওদুদ তখন এমএ পাস করে কলকাতায়ই ছিলেন। তাঁর ঢাকা ইন্টামিডিয়েট কলেজে চাকরি হয়েছিল আরও কিছুদিন পরে।’৩
পল্লীকবির বাড়ির সন্নিকটে অম্বিকাপুর রেলস্টেশনে নামেন। রেললাইন তখনও ফরিদপুর স্টেশনে পৌঁছুতে পারেনি। নজরুলের সেবারের ফরিদপুর ভ্রমণেও রাজবাড়ীর আরেক জন ইতিহাসখ্যাত ছাত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সঙ্গলাভ করেছিলেন। ফরিদপুরে টেপাকোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তিনটি ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন’- এখানে এসে কবি একটি তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই সম্মেলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ছিলেন, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র কেতাব উদ্দিন আহম্মদ (১৪.৪.১৯০৮-১১.৪.১৯৮৫)। উত্তরকালে ইনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে এম.এ পাস করে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ’র আশীর্বাদপুষ্ট করটিয়া কলেজে দীর্ঘকালের অধ্যক্ষ ছিলেন, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন ফরিদপুর ইয়াছিন কলেজের। ১৯২৫ সালের ওই ‘ফরিদপুর সম্মেলনে’ই কবির সাথে প্রথম পরিচয় ঘটেছিল কেতাবউদ্দিন আহমদের। কবি নজরুল স্বরচিত গান গেয়ে ৩ দিনের সম্মেলন মাতিয়েছিলেন আর বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব উত্থাপন করে ইতিহাসে স্মরণীয় হন কেতাবউদ্দিন। ফরিদপুর কনফারেন্সের স্মৃতিচরণ করে কবি নজরুল প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন তিনি-
“আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। সব কনফারেন্সগুলিতে আমি অংশগ্রহণ করি। অল বেঙ্গল ছাত্র কনফারেন্সে বালিয়াকান্দি স্কুল থেকে ডেলিগেট হিসাবে আমি অংশ নেই।... অল বেঙ্গল ছাত্র কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। ঐ ছাত্র কনফারেন্সে আমি বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম) করার জন্য উত্থাপন করি। প্রস্তাবটি কনফারেন্সে পাশ হয়ে যায়।... কংগ্রেস কনফারেন্সের সভাপতি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও প্রধান অতিথি মহাত্মা গান্ধী। এই কনফারেন্সে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমি প্রথম দেখি। তাঁর নিজের তৈরি, নিজের কণ্ঠে গাওয়া কয়েকটি গান শুনে আমি বাস্তবিকই মুগ্ধ হই। এগুলির মধ্যে একটা ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।৪
রাজবাড়ীর হাবাসপুর ইউনিয়নের বাগমারা গ্রামের কৃতিসন্তান কাজী আব্দুল ওদুদও চাকরি নিয়ে তখন ঢাকা কলেজে যোগদান করেন, পরে চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে তিনি কলিকাতাবাসি হন। এ সময় কাজী নজরুল ও তাঁর পরিবারের সাথে অতি ঘনিষ্ট হয়ে পড়েন।
উত্তরকালে ওদুদ ‘নজরুল প্রতিভা’ (১৯৪৯ খ্রীঃ) রচনা করেন। ১৯৫২ সালে নজরুল পরিবারে আর্থিক অনটন লেগেই আছে, তিনি আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে আসছিলেন কিন্তু তাতেও কবির কোন উন্নতি হয়নি।
এয়াকুব আলী চৌধুরীর অপ্রকাশিত রচনাবলী : আব্দুল কাদির, বাঙলা একাডেমি, কার্তিক-১৩৭০। পৃঃ ‘গ’
পূর্বোক্ত।
মুহম্মদ মতিউর রহমান : বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতি’র-শতবর্ষ : ফিরে দেখি সেই ইতিহাস, দৈনিক আমার দেশ-৯ ডিসেম্বর’২০১১
মুজফ্ফর আহম্মদ : কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পৃঃ ১৭
বাবু মল্লিক
সোমবার, ৩০ আগস্ট ২০২১
বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়ার পর কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন কলকাতা কলেজ স্ট্রীটে ওঠেন তখন কাজী আব্দুল ওদুদ (২৬.৪১৮৯৪- ১৯.৫.১৯৭০)ও ছিলেন সেখানে। ‘কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আফজালুল হক সাহেবের পরিচয় ছিল না।... নজরুল যখন এসেছিলেন তখন তো ওদুদ সাহেব তাঁর সঙ্গে ৩২, কলেজ স্ট্রীটেই থাকতেন।...’১ কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে ওদুদ ছিলেন পাঁচ বছরের বড় আর এয়াকুব আলী চৌধুরী দশ বছরের বড়। চৌধুরী সাহেব কবিকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, “আপনাকে বাংলার মুসলমান বারীন ঘোষ হতে হবে।- ‘এয়াকুব আলী চৌধুরীর এই আশীর্বাদ নজরুলের জীবনকে ফলে-ফুলে সুশোভিত করে সাফল্যের স্বর্ণদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিল’।”২
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রথম সংখ্যায় (বৈশাখ ১৩২৫) তৎকালীন প্রখ্যাত লেখকদের মধ্যে রাজবাড়ীর কাজী অব্দুল ওদুদের গল্প ‘ভুল’ ছাপা হয়। ওদুদের সাহিত্য জীবন শুরু হয়েছিল আরো আগে, তাঁর কলকাতায় উপস্থিতি ঘটেছিল নজরুলের সাথে পরিচয়েরও বেশ আগে- ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১০ টাকা জেলাবৃত্তি নিয়ে। প্রেসিডেন্সি কলেজে আই.এ ক্লাসের ছাত্রাবস্থায় বকুলবাগানে কিংবা বেকার হোস্টেলে ‘গীতাঞ্জলী’র গানচর্চা করে তখন ‘সবুজপত্রে’র গ্রাহক ওদুদের সাহিত্য-রুচি সৃষ্টি হয়েছিল। কবি মোজাম্মেল পুত্র আফজাল-উল হক ও কমরেড মোজাফ্ফর আহম্মেদের বেকার হোস্টেল থেকে প্রকাশিত হাতে-লেখা পত্রিকায় ‘শ্রী-দীক্ষিত’ ছদ্মনামে প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমেই তাঁর সাহিত্য-কর্ম চলে আসছিল। ওদুদের ‘মীর পরিবার’ বেরিয়ে গেছে ১৯১৮ খ্রীস্টাব্দে। ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’র ত্রৈমাসিক পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে এরপরে। ওই পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা। কাজী নজরুল ইসলামের সাথে এখানেই কাজী আব্দুল ওদুদের পরিচয় ঘটে, ১৯২০ সালের ১২ই জুলাই তারিখে কাজী নজরুল ইসলাম ও মোজাফ্ফর আহম্মদের সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ যখন বের হয় কাজী আব্দুল ওদুদ তখন এমএ পাস করে কলকাতায়ই ছিলেন। তাঁর ঢাকা ইন্টামিডিয়েট কলেজে চাকরি হয়েছিল আরও কিছুদিন পরে।’৩
পল্লীকবির বাড়ির সন্নিকটে অম্বিকাপুর রেলস্টেশনে নামেন। রেললাইন তখনও ফরিদপুর স্টেশনে পৌঁছুতে পারেনি। নজরুলের সেবারের ফরিদপুর ভ্রমণেও রাজবাড়ীর আরেক জন ইতিহাসখ্যাত ছাত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সঙ্গলাভ করেছিলেন। ফরিদপুরে টেপাকোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তিনটি ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন’- এখানে এসে কবি একটি তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই সম্মেলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ছিলেন, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র কেতাব উদ্দিন আহম্মদ (১৪.৪.১৯০৮-১১.৪.১৯৮৫)। উত্তরকালে ইনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে এম.এ পাস করে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ’র আশীর্বাদপুষ্ট করটিয়া কলেজে দীর্ঘকালের অধ্যক্ষ ছিলেন, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন ফরিদপুর ইয়াছিন কলেজের। ১৯২৫ সালের ওই ‘ফরিদপুর সম্মেলনে’ই কবির সাথে প্রথম পরিচয় ঘটেছিল কেতাবউদ্দিন আহমদের। কবি নজরুল স্বরচিত গান গেয়ে ৩ দিনের সম্মেলন মাতিয়েছিলেন আর বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব উত্থাপন করে ইতিহাসে স্মরণীয় হন কেতাবউদ্দিন। ফরিদপুর কনফারেন্সের স্মৃতিচরণ করে কবি নজরুল প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন তিনি-
“আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। সব কনফারেন্সগুলিতে আমি অংশগ্রহণ করি। অল বেঙ্গল ছাত্র কনফারেন্সে বালিয়াকান্দি স্কুল থেকে ডেলিগেট হিসাবে আমি অংশ নেই।... অল বেঙ্গল ছাত্র কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। ঐ ছাত্র কনফারেন্সে আমি বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম) করার জন্য উত্থাপন করি। প্রস্তাবটি কনফারেন্সে পাশ হয়ে যায়।... কংগ্রেস কনফারেন্সের সভাপতি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও প্রধান অতিথি মহাত্মা গান্ধী। এই কনফারেন্সে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমি প্রথম দেখি। তাঁর নিজের তৈরি, নিজের কণ্ঠে গাওয়া কয়েকটি গান শুনে আমি বাস্তবিকই মুগ্ধ হই। এগুলির মধ্যে একটা ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।৪
রাজবাড়ীর হাবাসপুর ইউনিয়নের বাগমারা গ্রামের কৃতিসন্তান কাজী আব্দুল ওদুদও চাকরি নিয়ে তখন ঢাকা কলেজে যোগদান করেন, পরে চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে তিনি কলিকাতাবাসি হন। এ সময় কাজী নজরুল ও তাঁর পরিবারের সাথে অতি ঘনিষ্ট হয়ে পড়েন।
উত্তরকালে ওদুদ ‘নজরুল প্রতিভা’ (১৯৪৯ খ্রীঃ) রচনা করেন। ১৯৫২ সালে নজরুল পরিবারে আর্থিক অনটন লেগেই আছে, তিনি আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে আসছিলেন কিন্তু তাতেও কবির কোন উন্নতি হয়নি।
এয়াকুব আলী চৌধুরীর অপ্রকাশিত রচনাবলী : আব্দুল কাদির, বাঙলা একাডেমি, কার্তিক-১৩৭০। পৃঃ ‘গ’
পূর্বোক্ত।
মুহম্মদ মতিউর রহমান : বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতি’র-শতবর্ষ : ফিরে দেখি সেই ইতিহাস, দৈনিক আমার দেশ-৯ ডিসেম্বর’২০১১
মুজফ্ফর আহম্মদ : কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পৃঃ ১৭