গৌতম গুহ রায়
কিছু খবরের প্রত্যাশা থাকে, কিছু কিছু প্রিয় মানুষ কথায়-আলাপে বারেবারেই আসেন। কিন্তু মানুষটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুতো ছিঁড়ে যায়, কখনও দূরত্বের কারণে কখনও তাঁর বয়সজনিত নীরবতায়। বশীর আল হেলাল তেমনি, আমার জন্মশহরের সাহিত্য আলোচনায় তিনি বারংবার আলোচিত হন। আমার স্মৃতিসত্তা জুড়ে তিনি থাকেন নিয়মিত উপস্থিতি নিয়ে। তবুও তিনি সামগ্রিক সাহিত্য আলোচনায় অনুপস্থিত থেকে যান। তাঁর শহরে তিনি অপরিচিত হয়ে যান। দুদিন আগে তাঁর প্রয়াণের খবর একটা ঝটকা দিলো। টলিয়ে দিলো আমার নিজেরই স্থায়িত্ব।
আমরা যখন জলপাইগুড়ি শহর থেকে সাহিত্যচর্চা করতে স্থানীয় সাহিত্য ঐতিহ্যের রসদ খুজছি তখন যে কটি নাম প্রবলভাবে উঠে আসছিলো তাঁর অন্যতম বশীর আল হেলাল। স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও সুসাহিত্যিক। আসলে পঞ্চাশের জলপাইগুড়ি সুবর্ণখচিত সময় নিয়ে উজ্জ্বল। দেবেশ রায়, সুরজিত দাশগুপ্ত, অশ্রুকুমার সিকদার, অর্ণব সেন, অমিতাভ দাশগুপ্ত, সুরজিত বসু, কার্তিক লাহিড়ী, ভবানী সরকার প্রমুখ তখন এই শহরের মানুষ। একই আড্ডার, এবং স্পষ্টতই সবাই বামপন্থী আদর্শের সৃজনসেনা। বশীর আল হেলালরা থাকতেন নবাববাড়ি সংলগ্ন মুর্শিদাবাদ হাউসে, পরে স্টেশন রোডে। তাঁদের আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদ। আনন্দ চন্দ্র কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান কলকাতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। সাথীদের মধ্যে একমাত্র বশীর আল হেলাল মুক্তিযুদ্ধের প্রাক-মুহূর্তে সেসময়ের পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। তাঁর বড়দাকে পাকবাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যার সময় হত্য করা হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা কাজ করেন তিনি। এছাড়াও বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
সমৃদ্ধ সাহিত্যকর্ম রেখে গেছেন বশীর। তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ যেমন ‘নূরজাহানদের মধুমাস’, ‘শেষ পানপাত্র’, ‘কালো ইলিশ’, ‘আনারসের হাসি’ প্রভৃতি। গল্প, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্যে সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি। ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ এবং ‘বাংলা একাডেমির ইতিহাস’ তার দুটি অপরিহার্য গ্রন্থ।
আমার প্রথম পিতৃপুরুষের ভিটাযাত্রার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করার বাসনা ছিলো।
কথাসাহিত্যিক সাদ কামালী আমাকে নিয়ে যান বশীর আল হেলালের বাসায়। সেই স্মৃতি আমার অন্যতম আবেগঘন সময়ের স্মৃতি। বশীর আল হেলালের স্ত্রী ছিলেন জলপাইগুড়ির প্রধান নারী শিক্ষায়তন সদর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। দেশ ভাগের পর আর এই দিকের কোনো খবর জানেন না। আমাকে পেয়ে যেন তাঁর কৈশোরকাল সামনে পেলেন। কত কথা, কত খোঁজ নিলেন এই শহরের বর্তমানের। নিজে হাতে করে খাইয়েছিলেন গাজরের হালুয়া। সেদিন তাঁর চোখে দু’ফোঁটা জলে কি ক্রোধ ছিলো কাঁটাতারের প্রতি?
ফিরে আসার কিছু দিনের মধ্যেই বশীর আল হেলালের চিঠি আসে আমার ঠিকানায়। তাঁর সময়ে জলপাইগুড়ির বীনা প্রেস থেকে ছাপা তাঁর প্রথম বই, তাঁর গবেষণার বিষয় মধুসূদনকে নিয়ে। সেটি ও ‘দ্যোতনা’র জন্য একটি প্রবন্ধের হাতে লেখা পা-ুলিপি। এবং এক দীর্ঘ চিঠি ও প্রচুর ছড়া। ‘দ্যোতনা’য় সেই প্রবন্ধ ছাপা হয়।
বশীর আল হেলালের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা কলকাতার এক সাহিত্য উৎসবে। বামপন্থীদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সেই সাহিত্য উৎসবে অঘোষিত জলপাইগুড়ি ব্লক তৈরি হয়ে যায় আড্ডায়। দেবেশ রায়, অর্ণব সেন, সুরজিত দাশগুপ্ত, বশীর আল হেলাল প্রমুখ। সেখানেই দেবেশ রায় তাঁর সাথে পরিচয় করান, আমিও পেয়ে যাই সেই মানুষটাকে, যাঁকে খুঁজছি অনেক বছর ধরে। আজ তিনি চলে গেলেন অমৃতের পথে। জলপাইগুড়ি ও পরবর্তীতে তাঁর প্রিয় বন্ধু ছিলেন সুরজিত দাশগুপ্ত, কিছুদিন আগে তিনি চলে গেছেন, আজ বন্ধুও চলে গেলেন। আমাদের প্রিয় বিয়োগের ভবিতব্য নিয়ে আমরা রয়ে গেছি।
গৌতম গুহ রায়
সোমবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
কিছু খবরের প্রত্যাশা থাকে, কিছু কিছু প্রিয় মানুষ কথায়-আলাপে বারেবারেই আসেন। কিন্তু মানুষটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুতো ছিঁড়ে যায়, কখনও দূরত্বের কারণে কখনও তাঁর বয়সজনিত নীরবতায়। বশীর আল হেলাল তেমনি, আমার জন্মশহরের সাহিত্য আলোচনায় তিনি বারংবার আলোচিত হন। আমার স্মৃতিসত্তা জুড়ে তিনি থাকেন নিয়মিত উপস্থিতি নিয়ে। তবুও তিনি সামগ্রিক সাহিত্য আলোচনায় অনুপস্থিত থেকে যান। তাঁর শহরে তিনি অপরিচিত হয়ে যান। দুদিন আগে তাঁর প্রয়াণের খবর একটা ঝটকা দিলো। টলিয়ে দিলো আমার নিজেরই স্থায়িত্ব।
আমরা যখন জলপাইগুড়ি শহর থেকে সাহিত্যচর্চা করতে স্থানীয় সাহিত্য ঐতিহ্যের রসদ খুজছি তখন যে কটি নাম প্রবলভাবে উঠে আসছিলো তাঁর অন্যতম বশীর আল হেলাল। স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও সুসাহিত্যিক। আসলে পঞ্চাশের জলপাইগুড়ি সুবর্ণখচিত সময় নিয়ে উজ্জ্বল। দেবেশ রায়, সুরজিত দাশগুপ্ত, অশ্রুকুমার সিকদার, অর্ণব সেন, অমিতাভ দাশগুপ্ত, সুরজিত বসু, কার্তিক লাহিড়ী, ভবানী সরকার প্রমুখ তখন এই শহরের মানুষ। একই আড্ডার, এবং স্পষ্টতই সবাই বামপন্থী আদর্শের সৃজনসেনা। বশীর আল হেলালরা থাকতেন নবাববাড়ি সংলগ্ন মুর্শিদাবাদ হাউসে, পরে স্টেশন রোডে। তাঁদের আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদ। আনন্দ চন্দ্র কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান কলকাতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। সাথীদের মধ্যে একমাত্র বশীর আল হেলাল মুক্তিযুদ্ধের প্রাক-মুহূর্তে সেসময়ের পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। তাঁর বড়দাকে পাকবাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যার সময় হত্য করা হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা কাজ করেন তিনি। এছাড়াও বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
সমৃদ্ধ সাহিত্যকর্ম রেখে গেছেন বশীর। তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ যেমন ‘নূরজাহানদের মধুমাস’, ‘শেষ পানপাত্র’, ‘কালো ইলিশ’, ‘আনারসের হাসি’ প্রভৃতি। গল্প, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্যে সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি। ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ এবং ‘বাংলা একাডেমির ইতিহাস’ তার দুটি অপরিহার্য গ্রন্থ।
আমার প্রথম পিতৃপুরুষের ভিটাযাত্রার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করার বাসনা ছিলো।
কথাসাহিত্যিক সাদ কামালী আমাকে নিয়ে যান বশীর আল হেলালের বাসায়। সেই স্মৃতি আমার অন্যতম আবেগঘন সময়ের স্মৃতি। বশীর আল হেলালের স্ত্রী ছিলেন জলপাইগুড়ির প্রধান নারী শিক্ষায়তন সদর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। দেশ ভাগের পর আর এই দিকের কোনো খবর জানেন না। আমাকে পেয়ে যেন তাঁর কৈশোরকাল সামনে পেলেন। কত কথা, কত খোঁজ নিলেন এই শহরের বর্তমানের। নিজে হাতে করে খাইয়েছিলেন গাজরের হালুয়া। সেদিন তাঁর চোখে দু’ফোঁটা জলে কি ক্রোধ ছিলো কাঁটাতারের প্রতি?
ফিরে আসার কিছু দিনের মধ্যেই বশীর আল হেলালের চিঠি আসে আমার ঠিকানায়। তাঁর সময়ে জলপাইগুড়ির বীনা প্রেস থেকে ছাপা তাঁর প্রথম বই, তাঁর গবেষণার বিষয় মধুসূদনকে নিয়ে। সেটি ও ‘দ্যোতনা’র জন্য একটি প্রবন্ধের হাতে লেখা পা-ুলিপি। এবং এক দীর্ঘ চিঠি ও প্রচুর ছড়া। ‘দ্যোতনা’য় সেই প্রবন্ধ ছাপা হয়।
বশীর আল হেলালের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা কলকাতার এক সাহিত্য উৎসবে। বামপন্থীদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সেই সাহিত্য উৎসবে অঘোষিত জলপাইগুড়ি ব্লক তৈরি হয়ে যায় আড্ডায়। দেবেশ রায়, অর্ণব সেন, সুরজিত দাশগুপ্ত, বশীর আল হেলাল প্রমুখ। সেখানেই দেবেশ রায় তাঁর সাথে পরিচয় করান, আমিও পেয়ে যাই সেই মানুষটাকে, যাঁকে খুঁজছি অনেক বছর ধরে। আজ তিনি চলে গেলেন অমৃতের পথে। জলপাইগুড়ি ও পরবর্তীতে তাঁর প্রিয় বন্ধু ছিলেন সুরজিত দাশগুপ্ত, কিছুদিন আগে তিনি চলে গেছেন, আজ বন্ধুও চলে গেলেন। আমাদের প্রিয় বিয়োগের ভবিতব্য নিয়ে আমরা রয়ে গেছি।