কামাল রাহমান
ত্রিমাত্রিক বিশ্বে সময় সরলরেখা ধরে এগোয়। ঘটনা প্রবাহিত হয় সময়ের হাত ধরে। সময়কে চতুর্থ মাত্রা ধরে বিজ্ঞানের যে গবেষণা এগিয়ে চলেছে তার সফলতা এলে চতুর্মাত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় হয়তো নতুনভাবে সবকিছু ভাবতে হবে। একজন লেখক সচেতনভাবে সময়কে এগিয়ে পিছিয়ে তাঁর গল্প সাজাতে পারেন। বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য তিনি ঘটনাগুলোকে সরলরেখায় না সাজিয়ে জ্যামিতিক নক্সা তৈরি করতে পারেন। সন্দেহ নেই এক্ষেত্রে মার্কেজ একজন কুশলী। এই শিল্পকৌশলের সফল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় তাঁর উপন্যাস ‘দ্য অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক’-এ। সময় এখানে সরল রেখা ধরে এগোয় না। এবং আমাদের হিসেবমত বর্তমান, ভবিষ্যত ও অতীতের মধ্যে সীমিত থাকে না। ঘটনা বিন্যাসে বর্তমান একইসঙ্গে অতীত ও ভবিষ্যতকে ধারণ করে। মুহূর্তগুলি কখনো সনাতন, অথবা চিরকালীনভাবে দেখা দেয়। জীবিত ও মৃত একই সময়ে অবস্থান করে। প্রস্তরীভূত সময়ে অনেকটা বিভ্রান্তির ভেতর সচল থাকে অন্যমাত্রাগুলো। যেমন “... জানুয়ারির এক বিকেলে আমরা দেখেছিলাম একটা গাভী প্রেসিডেন্ট ভবনের ঝুলবারান্দা থেকে সূর্যাস্ত উপভোগ করছিল, কল্পনা করুন তো, একটা জাতির ঝুলবারান্দায় একটা গাভী, কেমন একটা ভয়ানক দৃশ্য, কেমন একটা গোবরলেপা দেশ, এবং তখন সব রকম ধারণাই খতিয়ে দেখা হয় যে কেমন করে একটা গাভীর ঝুলবারান্দায় পৌঁছানো সম্ভব যখন সবাই জানে যে একটা গাভী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারে না, এমনকি সবচেয়ে কম গালিচা বিছানো সিঁড়ি দিয়েও না, অতএব চূড়ান্তে আমরা কখনোই জানতে পারি না যে, সত্যিই এটা দেখেছিলাম কিনা, অথবা একটা বিকেল আমরা মূল প্রাসাদ প্রাঙ্গণে কাটিয়েছিলাম কিনা অথবা আমাদের বৈকালিক ভ্রমণে কোন স্বপ্নের ভেতর ছিলাম কিনা যে আমাদের মনে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ভবনের ঝুলবারান্দায় একটা গাভী দেখেছিলাম যেখানে অনেক দিন কিছুই দেখা যায়নি অথবা আবার অনেক বৎসর পর হয়তো দেখা যাবে...”
একজন গাণিতিক ফলাফলে পৌঁছানোর জন্য কোন একটা উপাদানকে ধ্রুব ধরে অন্য উপাদানগুলোর মান নির্ণয় করেন। কিন্তু মার্কেজের গণিতের মধ্যে কোনো উপাদানই ধ্রুব নয়। তাঁর জগতে প্রবেশের জন্য কোনো একটা বা দুটা দরোজা তিনি খুলে রাখেন না। পাঠককে প্রবেশপথ খুঁজে নিতে হয়। শহীদুলও অনেকটা তা-ই। যদিও তাঁর সাহিত্যবিশ্ব দুরূহ কিছু নয়, তবে ভিন্ন তো বটেই। একজন পাঠক কেন তাঁর জগতে প্রবেশ করবে? তাঁর গল্পের প্লট বিশ্লেষণ করে দেখলে আহামরি কিছুই পাওয়া যায় না। ভাষা? যদিও নিজের নিয়মে একটা ভাষাভঙ্গি তিনি গ্রহণ করেছেন কিন্তু এটা কতটুকু স্বাদুভাষা তা বিচারযোগ্য। একই সময়ে তিনি লেখকের চিন্তাস্রোত উৎসারিত ভাষা ও চরিত্রের ভাষা দুটোই ব্যবহার করেন ‘এই মাইয়াটা মাঙ্কি বয়কে এত খোঁজে কেন? ক্যালা?’ স্বাভাবিকভাবে যেখানে নিয়ে, দিয়ে প্রভৃতি আসে সেখানে নিয়া, দিয়া প্রভৃতি আরোপিত মনে হয়। এ কারণে যে, বর্ণনার অন্য শব্দগুলো স্বাভাবিক। যেখানে চরিত্রের ভাষায়ও খাড়ায়া, ফালায়া ইত্যাদি আরোপিত মনে হয় সেখানে তিনি অবলীলায় এসব ব্যবহার করেন বর্ণনায়। ভূতের গলির মানুষেরা পঞ্চাশ বছর আগেও এমন ভাষা ব্যবহার করতেন না, বর্তমানেও করেন না। অবশ্য গল্প বা উপন্যাসের জন্য ওটা জরুরিও নয়। এই ভাষা একান্তই তাঁর নিজস্ব নির্মাণ।
তাহলে কেন আমরা শহীদুল জহিরের গল্পের আকর্ষণে ডুবে থাকি? এটা কি তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে গল্প বলার জন্য নয়? গল্পের অনেকটা আকর্ষণ উপস্থাপনভঙ্গির ভেতর লুকিয়ে থাকে। এখানে গল্পকথকদের প্রসঙ্গ এনে বলা যায় একটা সাধারণ গল্পও যখন একজন সরস উপস্থাপক তাঁর অভিনব বাচনভঙ্গির মাধ্যমে পরিবেশন করেন আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। হয়তো তাঁর উচ্চারণে ত্রুটি থাকে, ভাষার শৃঙ্খলাও নিয়ম মেনে চলে না। কিন্তু তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি অথবা শৈলী শ্রোতাকে আকর্ষণ করে। এমনকি সেই উপস্থাপক শ্রোতাকেও গল্পের ভেতর নিজের মতো করে টেনে নেয়। গল্প লেখকের উপস্থাপনভঙ্গি পাঠকের জন্য একই রকমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শহীদুলেরও তেমনি লেখনভঙ্গির ভেতর পাঠক ভুলে যান অন্য সব কিছু। মনে হয় এখানেই তাঁর কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি। তাঁর অভিনব গল্পশৈলী পাঠককে নিবিষ্ট করে। গল্প পাঠের মাধ্যমে নতুন কিছু অন্বেষণ, অথবা কোন দার্শনিক পুলক, বা লেখকের দায়বদ্ধতা খোঁজা, বৌদ্ধিক প্রাপ্তি, প্রভৃতি সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য শহীদুলে কিছু নেই। যে অর্থে জনপ্রিয়, সে অর্থে তিনি জনপ্রিয় নন। কিন্তু তাঁর গল্প অনেকেই পড়েন। যা সমসাময়িক অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে না। এই আকর্ষণ তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর বিচিত্র লেখনশৈলীর মাধ্যমে।
“আব্দুল গনির মনে হয় যে, খৈমন ইচ্ছা করে এসে জানালার পাশে বসে থাকে, চেহারা দেখায়, ফলে আব্দুল গনির সাহস বাড়ে সে বলে, আপনের মাইয়ারে ডাকেন, কথা জিগাই।
খৈমন নিশ্চয়ই সব শোনে, সে জানালার ভিতর থেকেই বলে, কি বলতে চান বলেন, এবং আব্দুল গনি হয়তো বিচলিত হয়া পড়ে, সে বলে, আপনের নাম খৈমন?
: আমার মায় আমার নাম কয় নাইকা আপনেরে? আপনে কি বয়রা, হুনেন না কানে?
আব্দুল গনি ঘাবরায়া যায়।
: কইছে, তবু জিগাইলাম।”
খৈমনের গল্পের এই আকর্ষণ ছেড়ে পাঠক দূরে যেতে পারেন না। এক গল্প থেকে অন্য গল্পে নাটকীয়ভাবে চলাচল করেন তিনি। পাঠকও নতুন গল্পের ফাঁদে আটকে পড়েন “কিন্তু পোলার বাপে প্যাঁচটা লাগায়া রেখে যায়, এবং জোবেদা রহমান শুনে বলে, খুবই ছুন্দর নাম, আমরা চান্দু কয়া ডাকা পারুম; ফলে সিলভারডেল কেজি স্কুলের টিচার মেরি জয়েসও হয়তো চানমিঞাকে একদিন চান্দু বলে ডাকে, হয়তো মামুন কিংবা লেদু কিংবা অভিজিৎকে সে চানমিঞাকে চান্দু বলে ডাকতে শোনে, এবং তার হয়তো মনে হয়, পেট নেম ধরে ডেকে একটু আদর করি পোলাটাকে! এর ফল হয় উল্টা, মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্কের এদেশের অনেক কিছুই জানা হয়া ওঠে নাই, যদিও তার জন্ম এদেশেই, ঢাকার তেজকুনি পাড়ায়।” শুরু হয় আবার মেরি জয়েসের গল্প। কিন্তু কোন গল্পই পাঠককে নিশ্চিত করে কিছু বলে না। ‘হয়তো’ শব্দ দিয়ে হেঁয়ালি সৃষ্টি করেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই পাঠককে দোলাচলের ভেতর রাখেন। একজন লেখক তার গল্পকে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রয়াস রাখেন। কিন্তু শহীদুল পাঠককে ছেড়ে দেন অনিশ্চয়তার ভেতর। বাস্তবতা, ও অবাস্তবতার মধ্যে আনাগোনার ভেতর যার যেমন বাস্তবতা সে তেমনটা বেছে নেবে। অবাস্তবতাও এক ধরনের বাস্তবতা। এর অস্তিত্ব না থাকলে বাস্তব বলেও কিছু নেই। এটা হচ্ছে শহীদুলের গল্পবিশ্বের মোটা দাগের দর্শন। সূক্ষ্ম দর্শন শহীদুলে খুঁজতে গেলে পাঠক হতাশ হবেন। যারা উপন্যাসের মধ্য দিয়ে দার্শনিক পুলক পেতে চান তারা বরং টলস্টয়, সিঙ্গার, কিংবা হেসে পড়ুন। বাংলা সাহিত্যে অধিবিদ্যক কিছুও আমরা লিখতে চাই না। চিন্তার জগৎ আমাদের নয়। কারণ দর্শন আমরা ভালোবাসি না। এক রবীন্দ্রনাথ আর কতদিকে নিজেকে প্রসারিত করতে পারতেন? সাহিত্যে আমাদের দার্শনিক প্রাপ্তি যতটুকু তারও অনেকটাই বোধ হয় তাঁর!
‘মুখের দিকে দেখি’র বিভিন্ন নক্সাগুলো অনেক সময় একেবারে খাপছাড়া ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থিত হয়। যদিও পাঠক এতে বিভ্রান্ত হয় না। চান মিঞার স্কুলসাথীদের এক ঘরোয়া আলোচনার মধ্যে ওর নামকরণের প্রসঙ্গ ধরে গল্প অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার এই বিষয়টা শহীদুল কিন্তু বেশ দক্ষতার সঙ্গে করেন। কারণ সেই নতুন গল্পখণ্ডে পাঠক এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে আগের খণ্ডের অসমাপ্তি তাকে অন্য অবস্থানে নেয় না।
“জুলি ফ্লোরেন্স আপ্যায়নের জন্য একদম ব্যস্ত হয় না, ঘরে বিস্কুট টিস্কুট হয়তো নাই-ও, সে তার মার এই দুই প্রাক্তন ছাত্রের কাছ থেকে একটু দূরে বসে থাকে এবং তারপর হঠাৎ কেন যেন বলে, মম লাইকড দা মাঙ্কি বয় মোস্ট, হোয়্যার ইজ হি? হয়তো লেদুর মনে হয় যে, এই মাইয়াটা মাঙ্কি বয়কে এত খোঁজে কেন? ক্যালা? তখন খৈমনের পোলার নামকরণের প্রসঙ্গটা এসে যায়, কারণ একাত্তর সনে জিঞ্জিরা থেকে পাকিস্তানি মিলিটারির ধাওয়া খায়া ফিরা আসার পর জুন/জুলাই কিংবা আগস্ট মাসে খৈমনের সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় হয়, মনে হতে থাকে তার পেট ছিঁড়া ভুঁড়ি খসে পড়বে, তার পায়ের পাতায় পানি জমে ফুলে ওঠে, কিন্তু আব্দুল জলিল বলে, অখনোই হইবো, আর দেরি করা পারে না কয়েকদিন।”
একটা গল্পের শুরু কোথায়? একরৈখিক গল্পের ক্ষেত্রে প্রশ্নটা হয়তো অবান্তর। কিন্তু একটা জটিল গল্পের ক্ষেত্রে শুরু ও শেষ খোঁজার খুব একটা দরকার নেই। গল্পটা যদি হয় বৃত্তীয় অথবা আবর্তনিক, তাহলে যে কোন জায়গা থেকে শুরু করা যায়। আবার যেখানে ইচ্ছে শেষ করা যায়। এমন গল্পলেখক তিনিই হতে পারেন যাঁর পাঠকের সঙ্গে একটা যোগসাজশ রয়েছে। নতুন করে পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য গল্প শুরুর বিষয়টা তার ভাবনায় এতটা গুরুত্ব নিয়ে থাকে না। ফলে শুরু করতে পারেন এভাবে : ‘ভূতের গল্লির চানমিঞা হয়তো বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা।’ পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটা শহীদুলের গল্প। শহীদুল মার্কেজের শিল্পশৈলী অনুসরণ করেন। কিন্তু তিনি সর্বাংশে অননুকরণীয়। গল্পের শুরু বাক্য, অথবা প্রথম অনুচ্ছেদ, এমনকি প্রথম পরিচ্ছদ অনেক লেখকই খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। আলবেয়ার কামু তাঁর ‘দ্য প্ল্যাগ’ উপন্যাসের প্রথম বাক্য শতাধিকবার লিখেছিলেন। যদিও প্রথমবারেরটা কখনো অতিক্রম করতে পারেননি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামার প্রথম বাক্য ও অনুচ্ছেদ সমগ্র উপন্যাস সম্পর্কে পাঠককে প্রস্তুতি এনে দেয়। একটা উচ্চাঙ্গের গ্রন্থপাঠের বিষয়ে পাঠকের কোন দ্বিধা থাকে না। কিংবা টলস্টয়ের ‘আনা কারেনিনা’ উপন্যাসের সেই বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক বাক্য দিয়ে শুরু “প্রতিটি সুখি পরিবার একে অন্যের মতো; কিন্তু অসুখি প্রত্যেক পরিবার নিজেদের মতো অসুখি।”
একজন লেখক সচেতনভাবে তার গল্পের ভেতর দ্বন্দ্ব তৈরি করেন। ঘাতপ্রতিঘাত ও অন্তর্দ্বন্দ্ব যত জোরালো হয় পাঠক তত নিবিড়ভাবে পাঠসংশ্লিষ্ট হয়। মানুষের মূল স্বভাব সংঘাত উপভোগ, হতে পারে সেটা পাশবিক, এরেনায় যেমন, গ্লাডিয়েটরদের রক্তক্ষরণের মধ্য থেকে শুরু করে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ পর্যন্ত বিস্তৃত, অথবা টলস্টয় বা গোগলের গল্পের চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অন্তক্ষরণ। শহীদুল নিজস্ব ভঙ্গিতে তাঁর গল্পের চরিত্রদের মধ্যে এই সংঘাতের জন্ম দেন। অবশ্য এই উপন্যাসে সংঘাত সৃষ্টি করে এমন প্রতিপক্ষ চরিত্রগুলো শেষ পর্যন্ত তা চালিয়ে যায় না। যেমন খৈমন ও জোবেদা রহমানের কলহ উপন্যাসে বেশি দূর এগোয় না এবং তা পাঠকের আগ্রহও সৃষ্টি করে না। এমনকি উপন্যাসের শেষে খরকোস ও চানমিঞাকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু সেটার পরিণতি একেবারেই ভিন্ন।
তাহলে তাঁর উপন্যাসে চরিত্রেরা দাঁড়িয়েছে কীভাবে? অনেকটা নিজের মতই। খরকোসের প্রতিপক্ষে কোন একক উপস্থিতি নেই। নিজের ব্যক্তিসত্তার বাইরে সমস্ত জগৎসংসারই তার প্রতিপক্ষ। এমনকি সে নিজেও। সে কখনো নিজেকে গলায় দড়ি বেঁধে তুলে দেয় আসমানতারার হাতে। ঠাণ্ডা মাথায় তিন তিনটি খুন করে জীবনের শুরুতেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে। সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে প্রায় কোন কলাকৌশল না জেনেই। অবলীলায় শরীরের ক্ষুধা মেটায়। সবকিছুই যেন অনায়াসে সম্পন্ন করার মেধা নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে সে। আবার র্যাবের অসাধ্য নিজেকে আসমানতারার বানানো খাঁচার ভেতর পুরে দেয় নির্লিপ্তভাবে। আসমানতারার প্রতি মানবিক ভালোবাসার কোন আকুতি তার ভেতর নেই। নিজের ভেতর কোন মানবিক বোধই খরকোসের তৈরি হয়নি। হয়তো সে এখনো জন্মেইনি। এক অনিশ্চিত জগৎ থেকে পিছিয়ে আরেক অনিশ্চিত জগতের ভেতর প্রবেশ করে। কুতুব উদ্দিন আইবেকের মতো একটা বংশ প্রতিষ্ঠা তার আর হয়ে ওঠে না।
শহীদুলের প্রায় সব গল্পেই এই অনিশ্চয়তার দ্বন্দ্ব। কোথাও তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলেন না। দার্শনিকভাবে প্রকাশ করলে- এই বস্তুবিশ্ব হচ্ছে মায়ার জগত, এসব কিছুই ঘটছে না, পৃথিবীতে সব কিছুই রয়েছে, যদি আমি চোখ মেলে দেখি, না দেখলে কিছুই নেই। এই ভ্রান্তির ফাঁদে জড়িয়ে শহীদুল তাঁর গল্প বলেন। এমনকি চানমিঞাও ‘হয়তো’ বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা, নয়তো, কেউ না। গল্পের মূল চরিত্র দুটো দেখা যায় কখনো পাশাপাশি চলে, প্রায় সমান্তরাল, আবার কখনো স্ক্রুর মতো পেঁচিয়ে এগোয়। একেবারে শেষ পরিচ্ছদে স্ক্রুর সুচাগ্র মাথায় শেষ হয়ে যায় প্রায় হঠাৎ করেই : ‘চানমিঞা বলে আমি আসব টিচার, এবং সে জুলিদের বাসা থেকে বের হয়া দেখে, গল্লির মোড়ে দুইটা ধূসর রঙের নিসান সানি পড়ে আছে- রঙকানা পোলাটা বোঝে না যে দুইটাই লাল রঙের গাড়ি- তার ভিতরে গাড়ি চোরের স্বভাব জেগে ওঠে, অন্যের মাল লোপাট করার স্পৃহা আকুলি বিকুলি করে, তখন খাঁচার ভিতরে খরকোস দুই হাত মাথার দুই পাশে দিয়া চোখ বন্ধ করে রাখে, মনে হয় মায়ের জরায়ুতে থাকা ভ্রƒণের মতো আরেকটা জন্মের জন্য সে নিজেকে গোল করে আনে- খাঁচা তার মা হয়।’ এখানে ‘খাঁচা তার মা হয়’ লেখার কি প্রয়োজন বোঝা যায়নি। বর্ণনাপ্রধান লেখার ধারায় লেখক গল্প বলেন, পাঠক শোনেন। কিন্তু বর্তমান সময়ের লেখক বলার চেয়ে দেখানো বেশি কার্যকর মনে করেন। শীতল অথবা উষ্ণ আবহাওয়ার বর্ণনায় না যেয়ে চরিত্রের আচরণের মধ্য দিয়ে তা ফুটিয়ে তোলার মধ্যে অনেক বেশি কুশলতা রয়েছে। এতে বিষয় ভিন্ন মাত্রা পায় এবং প্রাণবন্ত হয়।
‘মুখের দিকে দেখি’ উপন্যাসের প্লট কী? একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত স্বামী মনি মিঞার সন্তান চানমিঞাকে উপলক্ষ করে খৈমনের বেঁচে থাকার চেষ্টা, যা ব্যর্থতায় অবসিত। জীবনযুদ্ধে পরাজিত চানমিঞা টিঁকে থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত গাড়ি চোরে পরিণত। হারিয়ে যাওয়া পরিচয়হীন মামুনের অর্দ্ধমানব হিসেবে বেড়ে ওঠা ও একইভাবে খরকোস নাম নিয়ে ব্যর্থ হয়ে যাওয়া। আসল বা নকল মামুনের জুলির সঙ্গে প্রেমের ব্যর্থতা। মেরি ক্লার্কের ব্যর্থ জীবন। ওদুদ চৌধুরির পুরো পরিবারের সমুদ্রে সলিল সমাধি। সমগ্র উপন্যাসে এমন সব নঞর্থক ঘটনাপ্রবাহের সমারোহ।
একটা উপন্যাসের আঙ্গিক, ভাষা, চরিত্র নির্মাণ, শিল্পনৈপুণ্য প্রভৃতির পাশাপাশি দুটো বিষয় লেখকের মাহাত্ম্য প্রকাশ করে। লেখকের স্বপ্নকল্প ও দূরদৃষ্টি। ইংরেজিতে শব্দ দুটোকে ফ্যান্টাসি ও প্রফেসি দিয়ে প্রকাশ করা যায়। কিন্তু বাংলাতে স্বপ্নকল্প ও দূরদৃষ্টি ঠিক একই অর্থ বোঝাতে চায় না। ফ্যান্টাসি ও প্রফেসি উপন্যাসের ভেতর কোমল আলোর মতো ছড়িয়ে থাকে। পাঠক ভালোবাসে ফ্যান্টাসির জগত। ফ্যান্টাসি পাঠককে এক অতিপ্রাকৃতিক জগতে নিয়ে যায়। ফ্যান্টাসি নির্মাণে লেখক এক জটিল মিশ্রণের ব্যবহার করেন। বাস্তব, অবাস্তব, বিভিন্ন সাহিত্যরস, শব্দকৌতুক, আনন্দযাত্রা, মিথ প্রভৃতির মাধ্যমে। লেখকের দূরদৃষ্টি উপন্যাসে দেয় গভীরতা। এই দূরদৃষ্টি বা প্রফেসি প্রজ্ঞানির্ভর। অতিলৌকিক বা অলৌকিক পয়গম্বরী কৌশল নয়। সাধারণ মানুষকে অপার্থিব ভয় দেখিয়ে বাগে এনে নিজেদের পার্থিব যাবতীয় ভোগ লালসা ষোল আনা চরিতার্থ করার বিষয় এখানে নেই। সাহিত্যিকের প্রফেসি পাঠকের ভেতর জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। কিন্তু অন্ধবিশ্বাসের কথা বলে না। অজানাকে হয়তো রহস্যের ভেতর রেখে দেয়। অথচ পাঠককে বিভ্রান্ত করে না। শহীদুলের উপন্যাসে ফ্যান্টাসি রয়েছে; যদি প্রফেসিও থাকতো!
শহীদুলের গল্প বর্ণনাশৈলী নির্ভর। চরিত্রেরা কথা বলে বর্ণনার সহায়ক হিসেবে। বর্ণনা দেয়ার সময় একজন গদ্যশিল্পীর আয়ত্বে থাকে মূলত দুটো বিষয়- দৃষ্টিকোণ ও গতি। ঘটনাপ্রবাহে লেখকের ও পাঠকের দৃষ্টিকোণ ভিন্ন হতে পারে, অথবা একই হতে পারে। বিষয়টা নির্ভর করে অনেকটা লেখকের, কিছুটা বিষয়ের উপর। পরিষ্কারভাবে বলা যেতে পারে, টেলিভিশনের হরতাল দৃশ্য প্রদর্শনের দিক থেকে। এখানে দর্শক বিপরীত দিক থেকে অংশগ্রহণকারীদের কার্যক্রম দেখে। অপর দিকে খেলার মাঠের দৃশ্য দেখে দর্শক সারি থেকে। একজন লেখকও অংশক, নয়তো দর্শক হিসেবে বিষয় বর্ণনা করতে পারেন। শহীদুলে বিষয়টা আসে উভয়দিক থেকে। কখনো অংশক হিসেবে, কখনো দর্শক, আবার কখনো একই সঙ্গে অংশক ও দর্শক। চরিত্রের কথোপকথনেও তিনি এটা প্রকাশ করেন কখনো :
“: বানায়া মিছা কথা বল তুমি খামাকা!
: বানায়া বলব কেন- আপনে তাকে চেনেন!
: কে সে- কেউগা?”
যতিচিহ্ন বিষয়ে শহীদুল যে ল্যাটিন আমেরিকানদের অনুসারি তা বোঝা যায়। কমলকুমার মজুমদার এটা অন্যভাবে করতেন। শহীদুলের কমা ব্যবহার দেখা যাক :
“কিন্তু এইবার গানবোটের গতির সঙ্গে ‘খোদার দান’ পারে না, কোস্টগার্ড তাদের ধরে ফেলতে থাকে, তারা ওয়ার্নিং শট ছোঁড়ে, কিন্তু খরকোস থামে না, তখন ওদুদ চৌধুরী এবং তার পরিবার নিচে নেমে জাহাজের হোল্ডের ভিতরে যায়া আশ্রয় নেয়, এবং খরকোস মাস্টার সারেঙের গদির তলা থেকে একটা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র কোস্টগার্ডের গান লক্ষ করে গুলি ছোঁড়ে, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার ফলে তখন তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়া যায়, কোস্টগার্ড নিশ্চিত হয় যে, দুর্বৃত্ত ভেসেলটা সশস্ত্র এবং কোন দুষ্কর্মে লিপ্ত, তারা এবার সরাসরি টার্গেটের দিকে কামানের নল ঘুরায়, প্রথম গোলাটা হুইল কেবিন উড়ায়া দিলে খরকোস একটা বয়া নিয়া ট্রলারের এক সাইডে ঝুলে পড়ে এবং এভাবে আবার গুলি চালায়, ফলে কোস্টগার্ডের গানবোট টার্গেট ধ্বংস করার ব্যবস্থা করে, কামানের গোলায় ‘এম ভি খোদার দান’ ছিন্ন ভিন্ন হয়া যায়, ট্রলারের সঙ্গে পানির নিচে হারায়া যায় আব্দুল ওদুদ চৌং এবং তার স্ত্রী ও ছেলেরা- কেবল সাতকানিয়ায় আসমানতারা বেঁচে থাকে।”
অন্তত এক ডজন পূর্ণ বাক্যকে কমা দিয়ে জুড়ে একটা দীর্ঘ বাক্য রচনা করা হয়েছে। পুরো উপন্যাসেই এটা করা হয়েছে। এটা কি কোনভাবে পাঠের গতি বাড়িয়ে দেয়? অথবা লেখকের চিন্তাস্রোতকে পাঠকের কাছে গতিশীল করে তোলে? কমা বিষয়ে যদিও অনেক কৌতুক রয়েছে, যার একটা : একজন লেখক কমাগুলো প্রথমে বসান তার চিন্তাস্রোতের গতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। প্রথম সংশোধনীতে তিনি ওগুলোকে পরিবর্তন করে ঠিক জায়গায় নিয়ে আসেন। এভাবে প্রতিবার সংশোধনের সময় আবার ঠিক জায়গায় নিয়ে আসেন। লেখার চূড়ান্ত রূপ দেয়ার সময় আবার ঠিক জায়গায় নিয়ে আসেন। এরপর সহসম্পাদক থেকে প্রধান সম্পাদক পর্যন্ত যারাই এটা পড়েন তারাও ওগুলোকে নিজেদের মত ঠিক জায়গায় বসান। অবশেষে পাঠকের হাতে এসে পোঁছোয় প্রুফ রিডারের সঠিক বসানো কমাগুলো। তাহলে কমার মাহাত্ম্য কোথায়? শহীদুল এটা ভালোভাবেই জানেন এবং প্রয়োগ করেন। গল্পের গতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল তাঁর আয়ত্বে রয়েছে। নিচের অনুচ্ছেদে দাঁড়ি বসিয়ে পড়ে দেখুন-
“বাবুল মিঞার কথায় আব্দুল জলিলের আগ্রহ হয়, যদিও পোলা দোকানদার; তারপর আব্দুল জলিলের কাছ থেকে শুনে হয়তো জরিমনেরও ভালই লাগে, এবং তখন কোন একদিন রাইতে জরিমন যখন খৈমনকে ময়না মিঞার কথা বলে, খৈমনের দেহে কাঁপুনি ধরে, তার জ্বরের মত মত লাগে, সে দেখে অরুণ বরুণ কিরণমালা ছবির মত এক সওদাগরপুত্র তার সামনে এসে খাড়ায়, তখন তার চোখ বুজে ঘুম আসে।”
প্রায় সকল সাহিত্যকর্মে দুটো উপাদান মিলেমিশে থাকে। সৃষ্ট চরিত্র ও শিল্পব্যঞ্জনা। শহীদুলের চরিত্ররা শিল্পের প্রতিরূপ নয়। তারাশঙ্করের কবি যখন বলে, ‘জীবন এতো ছোটো কেনে?’ তখন এটা একটা শিল্প। মানবমনের একটা শৈল্পিক জিজ্ঞাসা ছোট্ট ঐ বাক্যটা ধারণ করে। গ্রামের এক ক্ষুদ্র কবির সামান্য জিজ্ঞাসার মধ্যে এটা সীমিত থাকে না। শহীদুলের চরিত্রেরা কি তেমন কোন সার্বজনীন শিল্প ভাবনার জন্ম দেয়?
সাদামাটা চরিত্র চিত্রণ ডকুমেন্টারির উদ্দেশ্য হতে পারে। কিন্তু উপন্যাসের চরিত্র বহুবর্ণিল। কোন কোন চরিত্রকে স্বরূপে সঠিকভাবে প্রকাশের জন্য অনেকসময় স্ল্যাঙ বা ইতরশব্দ ব্যবহার করতে হয়। স্ল্যাঙ মানুষের বিরূপ জটাজাল ছিন্ন করে কখনো তাকে হালকা অবস্থানে নিয়ে যায়। ইতরশব্দ সাধারণত সমাজের নীচু শ্রেণীর মানুষেরা ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু প্রায় সবসময়ই এটা নিজেদের মধ্যে সীমিত রাখে। এমনকি কেউ যদি ভুলক্রমে কোন ভদ্রজনের সঙ্গে ইতরশব্দ ব্যবহার করে ফেলে, বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে জিভ কাটে। ক্রোধ প্রকাশে অনেক ভদ্রজনও স্ল্যাঙ ব্যবহার করেন। স্ল্যাঙ ও গালি এক নয়। ভদ্র ভাষায়ও গাল দেয়া যায়। অপ্রয়োজনে স্ল্যাঙ-এর ব্যবহার সাহিত্যকে হালকা করে। চলিষ্ণু একটা ভাষায় নিয়মিতভাবে স্ল্যাঙ এসে যায়। স্ল্যাঙ খুব অল্প সময়ে বাসি ভাষায় পরিণত হয়। ফলে স্ল্যাঙ ব্যবহার বিষয়ে লেখককে যত্ন নিতে হয়। এবিষয়ে শহীদুল সম্ভবত যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি।
গল্প লেখার জন্য অনেক বেশি শ্রম দিতে হয়। একটা উপন্যাস অনেক ধৈর্য ধরে সম্পাদনা করতে হয়। ক্লান্তি সম্ভবত উপন্যাসটি সম্পাদনা করার অবসর শহীদুলকে দেয়নি। ফলে অনেক অহেতুক বাক্য রয়ে গেছে। ‘সেদিন বৃষ্টি থাকায় ট্রাকগুলো ত্রিপল দিয়া ঢাকা দেওয়া ছিল’ এটা মামুনের জীবিত থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। এরকম অনেক বাক্য চরিত্রের জন্য ক্ষতিকর। অসম্ভব কোন কিছুকেও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রয়াস লেখকের থাকে। বিপরীতটি সাধারণত নয়। জুলিকে চেস্টিটি বেল্ট পরানোর ধারণা চানমিঞা পায় জুলির দেয়া ‘ইন্নোসেন্ট ইরেন্দিয়া’ বই থেকে- এটা বোঝা যায়। কামার দিয়ে একটা চেস্টিটি বেল্ট বানানোর বিষয়টাও নাহয় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু ‘দেহ বর্জ্য ত্যাগের জন্য নিচের দিকে ব্যবস্থা রাখা’-র মতো ডিটেল্সের প্রয়োজন এখানে দেখা দেয় না। চেস্টিটি বেল্টে ঐ ব্যবস্থাটা থাকতোই। যদিও এটা শতাব্দী পুরানো একটা বিষয়! শহীদুল ক্যারিবিয়ান-ল্যাটিন আমেরিকান লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত- এটা না, বা নতুন করে লেখার বিষয় নয়। ঐ প্রভাবে বর্তমান অনেক পেছনে চলে যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান সময়ের আচরণ অতীতের মত নয়। এটা তিনি কতটা লক্ষ্য রাখতেন, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা যায়।
প্রত্যেক মানুষেরই একটা গল্প বলার থাকে। সম্ভবত একটাই। সেটা তার নিজেকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। নিজের জানার বাইরে তো কোনো গল্প তার থাকতে পারে না। ঐ গল্পটাই অনেকে বলে। নিজের মতো করে। এছাড়াও সে অন্য অনেক গল্প বলে। সেগুলো হয় ঐ একটার সম্প্রসারণ অথবা ভিন্নমাত্রা, নয়তো ওগুলো অন্যের। বানানো গল্প। শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘মুখের দিকে দেখি’ তাঁর মূল গল্প নয়। ভূতের গলির গল্পের সম্প্রসারণ। তাঁর মূল গল্পটা বলার সময় সম্ভবত তিনি পাননি। তার আগেই অকারণে চলে গেলেন।
‘মুখের দিকে দেখি’ অনেকগুলো গল্পের সমন্বয়। এটাকে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস বলা যায় কিনা ভেবে দেখার বিষয়। কেন্দ্রীয় দুই চরিত্রের একটা, মামুন বা কুতুবমিনার বা কুতুব উদ্দিন আইবেকের নাবিক জীবনের শুরু এক বিশাল সম্ভাবনার জন্ম দেয়, যা জ্যাক লন্ডনের ‘দ্য সি উলফ’ উপন্যাসের বাঘা লারসেনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু ‘দ্য সি উলফ’-এর মত উপন্যাস সৃষ্টির মেধা আমাদের থাকলেও একজন লারসেন নির্মাণের জন্য যে শ্রম, গবেষণা ও সময় দিতে হয় তা বোধ হয় আমাদের ধাঁতে নেই। ফলে সম্ভাবনা ওখানেই থেকে যায়। বাঘা লারসেন, সান্তিয়াগো, কিংবা কুবের অথবা একজন ময়না মিঞার চরিত্রের জন্য আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে হয়তো। আমাদের দুর্ভাগ্য যাঁরা আমাদের মধ্যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করেন তাঁরা খুব দ্রুত আমাদের ছেড়ে চলে যান।
যে কোন সমালোচনাই কিছুটা হলেও বিভ্রান্তিকর। পাঠকের উচিত প্রথমে প্রিয় লেখকের বইটি পড়ে নেয়া। একটা ভালো বই নিঃসন্দেহে পাঠককে তৃপ্তি এনে দেয়। ঐ তৃপ্তিকে হয়তো পূর্ণতা দিতে পারে কোন ভালো সমালোচনা। যেমন বাঙালির ভূরিভোজনের পর এক খিলি পান সেবন। কারও পানের খিলিতে থাকে সুগন্ধি চমনবাহার, কারো বা একটু বেশি কিমাম জর্দ্দা, অথবা দোক্তা, নিদেনপক্ষে পানমশলা!
কামাল রাহমান
শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১
ত্রিমাত্রিক বিশ্বে সময় সরলরেখা ধরে এগোয়। ঘটনা প্রবাহিত হয় সময়ের হাত ধরে। সময়কে চতুর্থ মাত্রা ধরে বিজ্ঞানের যে গবেষণা এগিয়ে চলেছে তার সফলতা এলে চতুর্মাত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় হয়তো নতুনভাবে সবকিছু ভাবতে হবে। একজন লেখক সচেতনভাবে সময়কে এগিয়ে পিছিয়ে তাঁর গল্প সাজাতে পারেন। বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য তিনি ঘটনাগুলোকে সরলরেখায় না সাজিয়ে জ্যামিতিক নক্সা তৈরি করতে পারেন। সন্দেহ নেই এক্ষেত্রে মার্কেজ একজন কুশলী। এই শিল্পকৌশলের সফল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় তাঁর উপন্যাস ‘দ্য অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক’-এ। সময় এখানে সরল রেখা ধরে এগোয় না। এবং আমাদের হিসেবমত বর্তমান, ভবিষ্যত ও অতীতের মধ্যে সীমিত থাকে না। ঘটনা বিন্যাসে বর্তমান একইসঙ্গে অতীত ও ভবিষ্যতকে ধারণ করে। মুহূর্তগুলি কখনো সনাতন, অথবা চিরকালীনভাবে দেখা দেয়। জীবিত ও মৃত একই সময়ে অবস্থান করে। প্রস্তরীভূত সময়ে অনেকটা বিভ্রান্তির ভেতর সচল থাকে অন্যমাত্রাগুলো। যেমন “... জানুয়ারির এক বিকেলে আমরা দেখেছিলাম একটা গাভী প্রেসিডেন্ট ভবনের ঝুলবারান্দা থেকে সূর্যাস্ত উপভোগ করছিল, কল্পনা করুন তো, একটা জাতির ঝুলবারান্দায় একটা গাভী, কেমন একটা ভয়ানক দৃশ্য, কেমন একটা গোবরলেপা দেশ, এবং তখন সব রকম ধারণাই খতিয়ে দেখা হয় যে কেমন করে একটা গাভীর ঝুলবারান্দায় পৌঁছানো সম্ভব যখন সবাই জানে যে একটা গাভী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারে না, এমনকি সবচেয়ে কম গালিচা বিছানো সিঁড়ি দিয়েও না, অতএব চূড়ান্তে আমরা কখনোই জানতে পারি না যে, সত্যিই এটা দেখেছিলাম কিনা, অথবা একটা বিকেল আমরা মূল প্রাসাদ প্রাঙ্গণে কাটিয়েছিলাম কিনা অথবা আমাদের বৈকালিক ভ্রমণে কোন স্বপ্নের ভেতর ছিলাম কিনা যে আমাদের মনে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ভবনের ঝুলবারান্দায় একটা গাভী দেখেছিলাম যেখানে অনেক দিন কিছুই দেখা যায়নি অথবা আবার অনেক বৎসর পর হয়তো দেখা যাবে...”
একজন গাণিতিক ফলাফলে পৌঁছানোর জন্য কোন একটা উপাদানকে ধ্রুব ধরে অন্য উপাদানগুলোর মান নির্ণয় করেন। কিন্তু মার্কেজের গণিতের মধ্যে কোনো উপাদানই ধ্রুব নয়। তাঁর জগতে প্রবেশের জন্য কোনো একটা বা দুটা দরোজা তিনি খুলে রাখেন না। পাঠককে প্রবেশপথ খুঁজে নিতে হয়। শহীদুলও অনেকটা তা-ই। যদিও তাঁর সাহিত্যবিশ্ব দুরূহ কিছু নয়, তবে ভিন্ন তো বটেই। একজন পাঠক কেন তাঁর জগতে প্রবেশ করবে? তাঁর গল্পের প্লট বিশ্লেষণ করে দেখলে আহামরি কিছুই পাওয়া যায় না। ভাষা? যদিও নিজের নিয়মে একটা ভাষাভঙ্গি তিনি গ্রহণ করেছেন কিন্তু এটা কতটুকু স্বাদুভাষা তা বিচারযোগ্য। একই সময়ে তিনি লেখকের চিন্তাস্রোত উৎসারিত ভাষা ও চরিত্রের ভাষা দুটোই ব্যবহার করেন ‘এই মাইয়াটা মাঙ্কি বয়কে এত খোঁজে কেন? ক্যালা?’ স্বাভাবিকভাবে যেখানে নিয়ে, দিয়ে প্রভৃতি আসে সেখানে নিয়া, দিয়া প্রভৃতি আরোপিত মনে হয়। এ কারণে যে, বর্ণনার অন্য শব্দগুলো স্বাভাবিক। যেখানে চরিত্রের ভাষায়ও খাড়ায়া, ফালায়া ইত্যাদি আরোপিত মনে হয় সেখানে তিনি অবলীলায় এসব ব্যবহার করেন বর্ণনায়। ভূতের গলির মানুষেরা পঞ্চাশ বছর আগেও এমন ভাষা ব্যবহার করতেন না, বর্তমানেও করেন না। অবশ্য গল্প বা উপন্যাসের জন্য ওটা জরুরিও নয়। এই ভাষা একান্তই তাঁর নিজস্ব নির্মাণ।
তাহলে কেন আমরা শহীদুল জহিরের গল্পের আকর্ষণে ডুবে থাকি? এটা কি তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে গল্প বলার জন্য নয়? গল্পের অনেকটা আকর্ষণ উপস্থাপনভঙ্গির ভেতর লুকিয়ে থাকে। এখানে গল্পকথকদের প্রসঙ্গ এনে বলা যায় একটা সাধারণ গল্পও যখন একজন সরস উপস্থাপক তাঁর অভিনব বাচনভঙ্গির মাধ্যমে পরিবেশন করেন আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। হয়তো তাঁর উচ্চারণে ত্রুটি থাকে, ভাষার শৃঙ্খলাও নিয়ম মেনে চলে না। কিন্তু তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি অথবা শৈলী শ্রোতাকে আকর্ষণ করে। এমনকি সেই উপস্থাপক শ্রোতাকেও গল্পের ভেতর নিজের মতো করে টেনে নেয়। গল্প লেখকের উপস্থাপনভঙ্গি পাঠকের জন্য একই রকমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শহীদুলেরও তেমনি লেখনভঙ্গির ভেতর পাঠক ভুলে যান অন্য সব কিছু। মনে হয় এখানেই তাঁর কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি। তাঁর অভিনব গল্পশৈলী পাঠককে নিবিষ্ট করে। গল্প পাঠের মাধ্যমে নতুন কিছু অন্বেষণ, অথবা কোন দার্শনিক পুলক, বা লেখকের দায়বদ্ধতা খোঁজা, বৌদ্ধিক প্রাপ্তি, প্রভৃতি সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য শহীদুলে কিছু নেই। যে অর্থে জনপ্রিয়, সে অর্থে তিনি জনপ্রিয় নন। কিন্তু তাঁর গল্প অনেকেই পড়েন। যা সমসাময়িক অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে না। এই আকর্ষণ তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর বিচিত্র লেখনশৈলীর মাধ্যমে।
“আব্দুল গনির মনে হয় যে, খৈমন ইচ্ছা করে এসে জানালার পাশে বসে থাকে, চেহারা দেখায়, ফলে আব্দুল গনির সাহস বাড়ে সে বলে, আপনের মাইয়ারে ডাকেন, কথা জিগাই।
খৈমন নিশ্চয়ই সব শোনে, সে জানালার ভিতর থেকেই বলে, কি বলতে চান বলেন, এবং আব্দুল গনি হয়তো বিচলিত হয়া পড়ে, সে বলে, আপনের নাম খৈমন?
: আমার মায় আমার নাম কয় নাইকা আপনেরে? আপনে কি বয়রা, হুনেন না কানে?
আব্দুল গনি ঘাবরায়া যায়।
: কইছে, তবু জিগাইলাম।”
খৈমনের গল্পের এই আকর্ষণ ছেড়ে পাঠক দূরে যেতে পারেন না। এক গল্প থেকে অন্য গল্পে নাটকীয়ভাবে চলাচল করেন তিনি। পাঠকও নতুন গল্পের ফাঁদে আটকে পড়েন “কিন্তু পোলার বাপে প্যাঁচটা লাগায়া রেখে যায়, এবং জোবেদা রহমান শুনে বলে, খুবই ছুন্দর নাম, আমরা চান্দু কয়া ডাকা পারুম; ফলে সিলভারডেল কেজি স্কুলের টিচার মেরি জয়েসও হয়তো চানমিঞাকে একদিন চান্দু বলে ডাকে, হয়তো মামুন কিংবা লেদু কিংবা অভিজিৎকে সে চানমিঞাকে চান্দু বলে ডাকতে শোনে, এবং তার হয়তো মনে হয়, পেট নেম ধরে ডেকে একটু আদর করি পোলাটাকে! এর ফল হয় উল্টা, মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্কের এদেশের অনেক কিছুই জানা হয়া ওঠে নাই, যদিও তার জন্ম এদেশেই, ঢাকার তেজকুনি পাড়ায়।” শুরু হয় আবার মেরি জয়েসের গল্প। কিন্তু কোন গল্পই পাঠককে নিশ্চিত করে কিছু বলে না। ‘হয়তো’ শব্দ দিয়ে হেঁয়ালি সৃষ্টি করেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই পাঠককে দোলাচলের ভেতর রাখেন। একজন লেখক তার গল্পকে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রয়াস রাখেন। কিন্তু শহীদুল পাঠককে ছেড়ে দেন অনিশ্চয়তার ভেতর। বাস্তবতা, ও অবাস্তবতার মধ্যে আনাগোনার ভেতর যার যেমন বাস্তবতা সে তেমনটা বেছে নেবে। অবাস্তবতাও এক ধরনের বাস্তবতা। এর অস্তিত্ব না থাকলে বাস্তব বলেও কিছু নেই। এটা হচ্ছে শহীদুলের গল্পবিশ্বের মোটা দাগের দর্শন। সূক্ষ্ম দর্শন শহীদুলে খুঁজতে গেলে পাঠক হতাশ হবেন। যারা উপন্যাসের মধ্য দিয়ে দার্শনিক পুলক পেতে চান তারা বরং টলস্টয়, সিঙ্গার, কিংবা হেসে পড়ুন। বাংলা সাহিত্যে অধিবিদ্যক কিছুও আমরা লিখতে চাই না। চিন্তার জগৎ আমাদের নয়। কারণ দর্শন আমরা ভালোবাসি না। এক রবীন্দ্রনাথ আর কতদিকে নিজেকে প্রসারিত করতে পারতেন? সাহিত্যে আমাদের দার্শনিক প্রাপ্তি যতটুকু তারও অনেকটাই বোধ হয় তাঁর!
‘মুখের দিকে দেখি’র বিভিন্ন নক্সাগুলো অনেক সময় একেবারে খাপছাড়া ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থিত হয়। যদিও পাঠক এতে বিভ্রান্ত হয় না। চান মিঞার স্কুলসাথীদের এক ঘরোয়া আলোচনার মধ্যে ওর নামকরণের প্রসঙ্গ ধরে গল্প অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার এই বিষয়টা শহীদুল কিন্তু বেশ দক্ষতার সঙ্গে করেন। কারণ সেই নতুন গল্পখণ্ডে পাঠক এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে আগের খণ্ডের অসমাপ্তি তাকে অন্য অবস্থানে নেয় না।
“জুলি ফ্লোরেন্স আপ্যায়নের জন্য একদম ব্যস্ত হয় না, ঘরে বিস্কুট টিস্কুট হয়তো নাই-ও, সে তার মার এই দুই প্রাক্তন ছাত্রের কাছ থেকে একটু দূরে বসে থাকে এবং তারপর হঠাৎ কেন যেন বলে, মম লাইকড দা মাঙ্কি বয় মোস্ট, হোয়্যার ইজ হি? হয়তো লেদুর মনে হয় যে, এই মাইয়াটা মাঙ্কি বয়কে এত খোঁজে কেন? ক্যালা? তখন খৈমনের পোলার নামকরণের প্রসঙ্গটা এসে যায়, কারণ একাত্তর সনে জিঞ্জিরা থেকে পাকিস্তানি মিলিটারির ধাওয়া খায়া ফিরা আসার পর জুন/জুলাই কিংবা আগস্ট মাসে খৈমনের সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় হয়, মনে হতে থাকে তার পেট ছিঁড়া ভুঁড়ি খসে পড়বে, তার পায়ের পাতায় পানি জমে ফুলে ওঠে, কিন্তু আব্দুল জলিল বলে, অখনোই হইবো, আর দেরি করা পারে না কয়েকদিন।”
একটা গল্পের শুরু কোথায়? একরৈখিক গল্পের ক্ষেত্রে প্রশ্নটা হয়তো অবান্তর। কিন্তু একটা জটিল গল্পের ক্ষেত্রে শুরু ও শেষ খোঁজার খুব একটা দরকার নেই। গল্পটা যদি হয় বৃত্তীয় অথবা আবর্তনিক, তাহলে যে কোন জায়গা থেকে শুরু করা যায়। আবার যেখানে ইচ্ছে শেষ করা যায়। এমন গল্পলেখক তিনিই হতে পারেন যাঁর পাঠকের সঙ্গে একটা যোগসাজশ রয়েছে। নতুন করে পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য গল্প শুরুর বিষয়টা তার ভাবনায় এতটা গুরুত্ব নিয়ে থাকে না। ফলে শুরু করতে পারেন এভাবে : ‘ভূতের গল্লির চানমিঞা হয়তো বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা।’ পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটা শহীদুলের গল্প। শহীদুল মার্কেজের শিল্পশৈলী অনুসরণ করেন। কিন্তু তিনি সর্বাংশে অননুকরণীয়। গল্পের শুরু বাক্য, অথবা প্রথম অনুচ্ছেদ, এমনকি প্রথম পরিচ্ছদ অনেক লেখকই খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। আলবেয়ার কামু তাঁর ‘দ্য প্ল্যাগ’ উপন্যাসের প্রথম বাক্য শতাধিকবার লিখেছিলেন। যদিও প্রথমবারেরটা কখনো অতিক্রম করতে পারেননি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামার প্রথম বাক্য ও অনুচ্ছেদ সমগ্র উপন্যাস সম্পর্কে পাঠককে প্রস্তুতি এনে দেয়। একটা উচ্চাঙ্গের গ্রন্থপাঠের বিষয়ে পাঠকের কোন দ্বিধা থাকে না। কিংবা টলস্টয়ের ‘আনা কারেনিনা’ উপন্যাসের সেই বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক বাক্য দিয়ে শুরু “প্রতিটি সুখি পরিবার একে অন্যের মতো; কিন্তু অসুখি প্রত্যেক পরিবার নিজেদের মতো অসুখি।”
একজন লেখক সচেতনভাবে তার গল্পের ভেতর দ্বন্দ্ব তৈরি করেন। ঘাতপ্রতিঘাত ও অন্তর্দ্বন্দ্ব যত জোরালো হয় পাঠক তত নিবিড়ভাবে পাঠসংশ্লিষ্ট হয়। মানুষের মূল স্বভাব সংঘাত উপভোগ, হতে পারে সেটা পাশবিক, এরেনায় যেমন, গ্লাডিয়েটরদের রক্তক্ষরণের মধ্য থেকে শুরু করে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ পর্যন্ত বিস্তৃত, অথবা টলস্টয় বা গোগলের গল্পের চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অন্তক্ষরণ। শহীদুল নিজস্ব ভঙ্গিতে তাঁর গল্পের চরিত্রদের মধ্যে এই সংঘাতের জন্ম দেন। অবশ্য এই উপন্যাসে সংঘাত সৃষ্টি করে এমন প্রতিপক্ষ চরিত্রগুলো শেষ পর্যন্ত তা চালিয়ে যায় না। যেমন খৈমন ও জোবেদা রহমানের কলহ উপন্যাসে বেশি দূর এগোয় না এবং তা পাঠকের আগ্রহও সৃষ্টি করে না। এমনকি উপন্যাসের শেষে খরকোস ও চানমিঞাকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু সেটার পরিণতি একেবারেই ভিন্ন।
তাহলে তাঁর উপন্যাসে চরিত্রেরা দাঁড়িয়েছে কীভাবে? অনেকটা নিজের মতই। খরকোসের প্রতিপক্ষে কোন একক উপস্থিতি নেই। নিজের ব্যক্তিসত্তার বাইরে সমস্ত জগৎসংসারই তার প্রতিপক্ষ। এমনকি সে নিজেও। সে কখনো নিজেকে গলায় দড়ি বেঁধে তুলে দেয় আসমানতারার হাতে। ঠাণ্ডা মাথায় তিন তিনটি খুন করে জীবনের শুরুতেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে। সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে প্রায় কোন কলাকৌশল না জেনেই। অবলীলায় শরীরের ক্ষুধা মেটায়। সবকিছুই যেন অনায়াসে সম্পন্ন করার মেধা নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে সে। আবার র্যাবের অসাধ্য নিজেকে আসমানতারার বানানো খাঁচার ভেতর পুরে দেয় নির্লিপ্তভাবে। আসমানতারার প্রতি মানবিক ভালোবাসার কোন আকুতি তার ভেতর নেই। নিজের ভেতর কোন মানবিক বোধই খরকোসের তৈরি হয়নি। হয়তো সে এখনো জন্মেইনি। এক অনিশ্চিত জগৎ থেকে পিছিয়ে আরেক অনিশ্চিত জগতের ভেতর প্রবেশ করে। কুতুব উদ্দিন আইবেকের মতো একটা বংশ প্রতিষ্ঠা তার আর হয়ে ওঠে না।
শহীদুলের প্রায় সব গল্পেই এই অনিশ্চয়তার দ্বন্দ্ব। কোথাও তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলেন না। দার্শনিকভাবে প্রকাশ করলে- এই বস্তুবিশ্ব হচ্ছে মায়ার জগত, এসব কিছুই ঘটছে না, পৃথিবীতে সব কিছুই রয়েছে, যদি আমি চোখ মেলে দেখি, না দেখলে কিছুই নেই। এই ভ্রান্তির ফাঁদে জড়িয়ে শহীদুল তাঁর গল্প বলেন। এমনকি চানমিঞাও ‘হয়তো’ বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা, নয়তো, কেউ না। গল্পের মূল চরিত্র দুটো দেখা যায় কখনো পাশাপাশি চলে, প্রায় সমান্তরাল, আবার কখনো স্ক্রুর মতো পেঁচিয়ে এগোয়। একেবারে শেষ পরিচ্ছদে স্ক্রুর সুচাগ্র মাথায় শেষ হয়ে যায় প্রায় হঠাৎ করেই : ‘চানমিঞা বলে আমি আসব টিচার, এবং সে জুলিদের বাসা থেকে বের হয়া দেখে, গল্লির মোড়ে দুইটা ধূসর রঙের নিসান সানি পড়ে আছে- রঙকানা পোলাটা বোঝে না যে দুইটাই লাল রঙের গাড়ি- তার ভিতরে গাড়ি চোরের স্বভাব জেগে ওঠে, অন্যের মাল লোপাট করার স্পৃহা আকুলি বিকুলি করে, তখন খাঁচার ভিতরে খরকোস দুই হাত মাথার দুই পাশে দিয়া চোখ বন্ধ করে রাখে, মনে হয় মায়ের জরায়ুতে থাকা ভ্রƒণের মতো আরেকটা জন্মের জন্য সে নিজেকে গোল করে আনে- খাঁচা তার মা হয়।’ এখানে ‘খাঁচা তার মা হয়’ লেখার কি প্রয়োজন বোঝা যায়নি। বর্ণনাপ্রধান লেখার ধারায় লেখক গল্প বলেন, পাঠক শোনেন। কিন্তু বর্তমান সময়ের লেখক বলার চেয়ে দেখানো বেশি কার্যকর মনে করেন। শীতল অথবা উষ্ণ আবহাওয়ার বর্ণনায় না যেয়ে চরিত্রের আচরণের মধ্য দিয়ে তা ফুটিয়ে তোলার মধ্যে অনেক বেশি কুশলতা রয়েছে। এতে বিষয় ভিন্ন মাত্রা পায় এবং প্রাণবন্ত হয়।
‘মুখের দিকে দেখি’ উপন্যাসের প্লট কী? একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত স্বামী মনি মিঞার সন্তান চানমিঞাকে উপলক্ষ করে খৈমনের বেঁচে থাকার চেষ্টা, যা ব্যর্থতায় অবসিত। জীবনযুদ্ধে পরাজিত চানমিঞা টিঁকে থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত গাড়ি চোরে পরিণত। হারিয়ে যাওয়া পরিচয়হীন মামুনের অর্দ্ধমানব হিসেবে বেড়ে ওঠা ও একইভাবে খরকোস নাম নিয়ে ব্যর্থ হয়ে যাওয়া। আসল বা নকল মামুনের জুলির সঙ্গে প্রেমের ব্যর্থতা। মেরি ক্লার্কের ব্যর্থ জীবন। ওদুদ চৌধুরির পুরো পরিবারের সমুদ্রে সলিল সমাধি। সমগ্র উপন্যাসে এমন সব নঞর্থক ঘটনাপ্রবাহের সমারোহ।
একটা উপন্যাসের আঙ্গিক, ভাষা, চরিত্র নির্মাণ, শিল্পনৈপুণ্য প্রভৃতির পাশাপাশি দুটো বিষয় লেখকের মাহাত্ম্য প্রকাশ করে। লেখকের স্বপ্নকল্প ও দূরদৃষ্টি। ইংরেজিতে শব্দ দুটোকে ফ্যান্টাসি ও প্রফেসি দিয়ে প্রকাশ করা যায়। কিন্তু বাংলাতে স্বপ্নকল্প ও দূরদৃষ্টি ঠিক একই অর্থ বোঝাতে চায় না। ফ্যান্টাসি ও প্রফেসি উপন্যাসের ভেতর কোমল আলোর মতো ছড়িয়ে থাকে। পাঠক ভালোবাসে ফ্যান্টাসির জগত। ফ্যান্টাসি পাঠককে এক অতিপ্রাকৃতিক জগতে নিয়ে যায়। ফ্যান্টাসি নির্মাণে লেখক এক জটিল মিশ্রণের ব্যবহার করেন। বাস্তব, অবাস্তব, বিভিন্ন সাহিত্যরস, শব্দকৌতুক, আনন্দযাত্রা, মিথ প্রভৃতির মাধ্যমে। লেখকের দূরদৃষ্টি উপন্যাসে দেয় গভীরতা। এই দূরদৃষ্টি বা প্রফেসি প্রজ্ঞানির্ভর। অতিলৌকিক বা অলৌকিক পয়গম্বরী কৌশল নয়। সাধারণ মানুষকে অপার্থিব ভয় দেখিয়ে বাগে এনে নিজেদের পার্থিব যাবতীয় ভোগ লালসা ষোল আনা চরিতার্থ করার বিষয় এখানে নেই। সাহিত্যিকের প্রফেসি পাঠকের ভেতর জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। কিন্তু অন্ধবিশ্বাসের কথা বলে না। অজানাকে হয়তো রহস্যের ভেতর রেখে দেয়। অথচ পাঠককে বিভ্রান্ত করে না। শহীদুলের উপন্যাসে ফ্যান্টাসি রয়েছে; যদি প্রফেসিও থাকতো!
শহীদুলের গল্প বর্ণনাশৈলী নির্ভর। চরিত্রেরা কথা বলে বর্ণনার সহায়ক হিসেবে। বর্ণনা দেয়ার সময় একজন গদ্যশিল্পীর আয়ত্বে থাকে মূলত দুটো বিষয়- দৃষ্টিকোণ ও গতি। ঘটনাপ্রবাহে লেখকের ও পাঠকের দৃষ্টিকোণ ভিন্ন হতে পারে, অথবা একই হতে পারে। বিষয়টা নির্ভর করে অনেকটা লেখকের, কিছুটা বিষয়ের উপর। পরিষ্কারভাবে বলা যেতে পারে, টেলিভিশনের হরতাল দৃশ্য প্রদর্শনের দিক থেকে। এখানে দর্শক বিপরীত দিক থেকে অংশগ্রহণকারীদের কার্যক্রম দেখে। অপর দিকে খেলার মাঠের দৃশ্য দেখে দর্শক সারি থেকে। একজন লেখকও অংশক, নয়তো দর্শক হিসেবে বিষয় বর্ণনা করতে পারেন। শহীদুলে বিষয়টা আসে উভয়দিক থেকে। কখনো অংশক হিসেবে, কখনো দর্শক, আবার কখনো একই সঙ্গে অংশক ও দর্শক। চরিত্রের কথোপকথনেও তিনি এটা প্রকাশ করেন কখনো :
“: বানায়া মিছা কথা বল তুমি খামাকা!
: বানায়া বলব কেন- আপনে তাকে চেনেন!
: কে সে- কেউগা?”
যতিচিহ্ন বিষয়ে শহীদুল যে ল্যাটিন আমেরিকানদের অনুসারি তা বোঝা যায়। কমলকুমার মজুমদার এটা অন্যভাবে করতেন। শহীদুলের কমা ব্যবহার দেখা যাক :
“কিন্তু এইবার গানবোটের গতির সঙ্গে ‘খোদার দান’ পারে না, কোস্টগার্ড তাদের ধরে ফেলতে থাকে, তারা ওয়ার্নিং শট ছোঁড়ে, কিন্তু খরকোস থামে না, তখন ওদুদ চৌধুরী এবং তার পরিবার নিচে নেমে জাহাজের হোল্ডের ভিতরে যায়া আশ্রয় নেয়, এবং খরকোস মাস্টার সারেঙের গদির তলা থেকে একটা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র কোস্টগার্ডের গান লক্ষ করে গুলি ছোঁড়ে, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার ফলে তখন তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়া যায়, কোস্টগার্ড নিশ্চিত হয় যে, দুর্বৃত্ত ভেসেলটা সশস্ত্র এবং কোন দুষ্কর্মে লিপ্ত, তারা এবার সরাসরি টার্গেটের দিকে কামানের নল ঘুরায়, প্রথম গোলাটা হুইল কেবিন উড়ায়া দিলে খরকোস একটা বয়া নিয়া ট্রলারের এক সাইডে ঝুলে পড়ে এবং এভাবে আবার গুলি চালায়, ফলে কোস্টগার্ডের গানবোট টার্গেট ধ্বংস করার ব্যবস্থা করে, কামানের গোলায় ‘এম ভি খোদার দান’ ছিন্ন ভিন্ন হয়া যায়, ট্রলারের সঙ্গে পানির নিচে হারায়া যায় আব্দুল ওদুদ চৌং এবং তার স্ত্রী ও ছেলেরা- কেবল সাতকানিয়ায় আসমানতারা বেঁচে থাকে।”
অন্তত এক ডজন পূর্ণ বাক্যকে কমা দিয়ে জুড়ে একটা দীর্ঘ বাক্য রচনা করা হয়েছে। পুরো উপন্যাসেই এটা করা হয়েছে। এটা কি কোনভাবে পাঠের গতি বাড়িয়ে দেয়? অথবা লেখকের চিন্তাস্রোতকে পাঠকের কাছে গতিশীল করে তোলে? কমা বিষয়ে যদিও অনেক কৌতুক রয়েছে, যার একটা : একজন লেখক কমাগুলো প্রথমে বসান তার চিন্তাস্রোতের গতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। প্রথম সংশোধনীতে তিনি ওগুলোকে পরিবর্তন করে ঠিক জায়গায় নিয়ে আসেন। এভাবে প্রতিবার সংশোধনের সময় আবার ঠিক জায়গায় নিয়ে আসেন। লেখার চূড়ান্ত রূপ দেয়ার সময় আবার ঠিক জায়গায় নিয়ে আসেন। এরপর সহসম্পাদক থেকে প্রধান সম্পাদক পর্যন্ত যারাই এটা পড়েন তারাও ওগুলোকে নিজেদের মত ঠিক জায়গায় বসান। অবশেষে পাঠকের হাতে এসে পোঁছোয় প্রুফ রিডারের সঠিক বসানো কমাগুলো। তাহলে কমার মাহাত্ম্য কোথায়? শহীদুল এটা ভালোভাবেই জানেন এবং প্রয়োগ করেন। গল্পের গতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল তাঁর আয়ত্বে রয়েছে। নিচের অনুচ্ছেদে দাঁড়ি বসিয়ে পড়ে দেখুন-
“বাবুল মিঞার কথায় আব্দুল জলিলের আগ্রহ হয়, যদিও পোলা দোকানদার; তারপর আব্দুল জলিলের কাছ থেকে শুনে হয়তো জরিমনেরও ভালই লাগে, এবং তখন কোন একদিন রাইতে জরিমন যখন খৈমনকে ময়না মিঞার কথা বলে, খৈমনের দেহে কাঁপুনি ধরে, তার জ্বরের মত মত লাগে, সে দেখে অরুণ বরুণ কিরণমালা ছবির মত এক সওদাগরপুত্র তার সামনে এসে খাড়ায়, তখন তার চোখ বুজে ঘুম আসে।”
প্রায় সকল সাহিত্যকর্মে দুটো উপাদান মিলেমিশে থাকে। সৃষ্ট চরিত্র ও শিল্পব্যঞ্জনা। শহীদুলের চরিত্ররা শিল্পের প্রতিরূপ নয়। তারাশঙ্করের কবি যখন বলে, ‘জীবন এতো ছোটো কেনে?’ তখন এটা একটা শিল্প। মানবমনের একটা শৈল্পিক জিজ্ঞাসা ছোট্ট ঐ বাক্যটা ধারণ করে। গ্রামের এক ক্ষুদ্র কবির সামান্য জিজ্ঞাসার মধ্যে এটা সীমিত থাকে না। শহীদুলের চরিত্রেরা কি তেমন কোন সার্বজনীন শিল্প ভাবনার জন্ম দেয়?
সাদামাটা চরিত্র চিত্রণ ডকুমেন্টারির উদ্দেশ্য হতে পারে। কিন্তু উপন্যাসের চরিত্র বহুবর্ণিল। কোন কোন চরিত্রকে স্বরূপে সঠিকভাবে প্রকাশের জন্য অনেকসময় স্ল্যাঙ বা ইতরশব্দ ব্যবহার করতে হয়। স্ল্যাঙ মানুষের বিরূপ জটাজাল ছিন্ন করে কখনো তাকে হালকা অবস্থানে নিয়ে যায়। ইতরশব্দ সাধারণত সমাজের নীচু শ্রেণীর মানুষেরা ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু প্রায় সবসময়ই এটা নিজেদের মধ্যে সীমিত রাখে। এমনকি কেউ যদি ভুলক্রমে কোন ভদ্রজনের সঙ্গে ইতরশব্দ ব্যবহার করে ফেলে, বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে জিভ কাটে। ক্রোধ প্রকাশে অনেক ভদ্রজনও স্ল্যাঙ ব্যবহার করেন। স্ল্যাঙ ও গালি এক নয়। ভদ্র ভাষায়ও গাল দেয়া যায়। অপ্রয়োজনে স্ল্যাঙ-এর ব্যবহার সাহিত্যকে হালকা করে। চলিষ্ণু একটা ভাষায় নিয়মিতভাবে স্ল্যাঙ এসে যায়। স্ল্যাঙ খুব অল্প সময়ে বাসি ভাষায় পরিণত হয়। ফলে স্ল্যাঙ ব্যবহার বিষয়ে লেখককে যত্ন নিতে হয়। এবিষয়ে শহীদুল সম্ভবত যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি।
গল্প লেখার জন্য অনেক বেশি শ্রম দিতে হয়। একটা উপন্যাস অনেক ধৈর্য ধরে সম্পাদনা করতে হয়। ক্লান্তি সম্ভবত উপন্যাসটি সম্পাদনা করার অবসর শহীদুলকে দেয়নি। ফলে অনেক অহেতুক বাক্য রয়ে গেছে। ‘সেদিন বৃষ্টি থাকায় ট্রাকগুলো ত্রিপল দিয়া ঢাকা দেওয়া ছিল’ এটা মামুনের জীবিত থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। এরকম অনেক বাক্য চরিত্রের জন্য ক্ষতিকর। অসম্ভব কোন কিছুকেও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রয়াস লেখকের থাকে। বিপরীতটি সাধারণত নয়। জুলিকে চেস্টিটি বেল্ট পরানোর ধারণা চানমিঞা পায় জুলির দেয়া ‘ইন্নোসেন্ট ইরেন্দিয়া’ বই থেকে- এটা বোঝা যায়। কামার দিয়ে একটা চেস্টিটি বেল্ট বানানোর বিষয়টাও নাহয় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু ‘দেহ বর্জ্য ত্যাগের জন্য নিচের দিকে ব্যবস্থা রাখা’-র মতো ডিটেল্সের প্রয়োজন এখানে দেখা দেয় না। চেস্টিটি বেল্টে ঐ ব্যবস্থাটা থাকতোই। যদিও এটা শতাব্দী পুরানো একটা বিষয়! শহীদুল ক্যারিবিয়ান-ল্যাটিন আমেরিকান লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত- এটা না, বা নতুন করে লেখার বিষয় নয়। ঐ প্রভাবে বর্তমান অনেক পেছনে চলে যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান সময়ের আচরণ অতীতের মত নয়। এটা তিনি কতটা লক্ষ্য রাখতেন, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা যায়।
প্রত্যেক মানুষেরই একটা গল্প বলার থাকে। সম্ভবত একটাই। সেটা তার নিজেকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। নিজের জানার বাইরে তো কোনো গল্প তার থাকতে পারে না। ঐ গল্পটাই অনেকে বলে। নিজের মতো করে। এছাড়াও সে অন্য অনেক গল্প বলে। সেগুলো হয় ঐ একটার সম্প্রসারণ অথবা ভিন্নমাত্রা, নয়তো ওগুলো অন্যের। বানানো গল্প। শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘মুখের দিকে দেখি’ তাঁর মূল গল্প নয়। ভূতের গলির গল্পের সম্প্রসারণ। তাঁর মূল গল্পটা বলার সময় সম্ভবত তিনি পাননি। তার আগেই অকারণে চলে গেলেন।
‘মুখের দিকে দেখি’ অনেকগুলো গল্পের সমন্বয়। এটাকে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস বলা যায় কিনা ভেবে দেখার বিষয়। কেন্দ্রীয় দুই চরিত্রের একটা, মামুন বা কুতুবমিনার বা কুতুব উদ্দিন আইবেকের নাবিক জীবনের শুরু এক বিশাল সম্ভাবনার জন্ম দেয়, যা জ্যাক লন্ডনের ‘দ্য সি উলফ’ উপন্যাসের বাঘা লারসেনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু ‘দ্য সি উলফ’-এর মত উপন্যাস সৃষ্টির মেধা আমাদের থাকলেও একজন লারসেন নির্মাণের জন্য যে শ্রম, গবেষণা ও সময় দিতে হয় তা বোধ হয় আমাদের ধাঁতে নেই। ফলে সম্ভাবনা ওখানেই থেকে যায়। বাঘা লারসেন, সান্তিয়াগো, কিংবা কুবের অথবা একজন ময়না মিঞার চরিত্রের জন্য আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে হয়তো। আমাদের দুর্ভাগ্য যাঁরা আমাদের মধ্যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করেন তাঁরা খুব দ্রুত আমাদের ছেড়ে চলে যান।
যে কোন সমালোচনাই কিছুটা হলেও বিভ্রান্তিকর। পাঠকের উচিত প্রথমে প্রিয় লেখকের বইটি পড়ে নেয়া। একটা ভালো বই নিঃসন্দেহে পাঠককে তৃপ্তি এনে দেয়। ঐ তৃপ্তিকে হয়তো পূর্ণতা দিতে পারে কোন ভালো সমালোচনা। যেমন বাঙালির ভূরিভোজনের পর এক খিলি পান সেবন। কারও পানের খিলিতে থাকে সুগন্ধি চমনবাহার, কারো বা একটু বেশি কিমাম জর্দ্দা, অথবা দোক্তা, নিদেনপক্ষে পানমশলা!