alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : সতের

শিকিবু

আবুল কাসেম

: শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

একত্রিশ.

সম্রাজ্ঞী শোশি মুরাসাকিকে নিয়ে একান্তে বসেছেন তার দরবারে। ব্যাপারটি খুবই গোপনীয়। সম্রাজ্ঞী মুরাসাকির কাছে চীনা ধ্রুপদী ভাষা শিখবেন। এদের দুজনের বাইরে কথাটি তিন কান হলেই সর্বনাশ। একেবারে আইন করে বলে দেয়া আছে হেইয়ান সম্রাজ্যের কোনো নারী এই ভাষা শিখতে পারবে না। এটি শুধু অভিজাত পুরুষদের ভাষা এবং সম্রাটের দরবারি ভাষা। অন্য কথায় রাজভাষা। নারীদের এ ভাষা শিক্ষা রাষ্ট্রােদ্রাহের কাজ।

সম্রাজ্ঞী শোশি বললেন, আমার জানা দরকার এ ভাষায় কী এমন রহস্য রয়েছে, যা সম্রাজ্ঞীরাও শিখতে পারবে না।

ভাষা তো ভাষাই মহামান্যা। তা দ্বারা নারী-পুরুষে বিভেদ সৃষ্টি করে রাখা এই যা। শক্ত আইনটা সম্ভবত এ জন্যই।

তবুও আমি এ ভাষা শিখবই। তুমি আমাকে শেখাবে।

তবে চীনা ধ্রুপদী ভাষায় লেখা সাহিত্য চমৎকার; যা এখনো আমাদের এখানে লেখা হয়নি।

যেমন?

চীনা গীতিকা।

তা তুমি আমাকে শোনাবে।

আপনি তো চীনা ভাষা এখন বুঝবেন না।

তুমি কানাভাষায় বুঝাবে।

তা ঠিক আছে।

এমন সময় লেডি সাইশি দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে আসতে চাইলেন। শোশি রাগান্বিত হয়ে বললেন, কী এমন দরকার বিরক্ত করছ?

সাইশি বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসেছেন।

সম্রাজ্ঞী স্বগতভাবে বললেন, তিনি আর সময় পেলেন না। মুরাসাকিকে বললেন, তুমি এখন এসো। পরে আমরা আবার বসবো। সাইশিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তাকে বসতে দাও আমি আসছি।

মুরাসাকি নিজের দপ্তরে ফিরে গেলেন। ‘গেঞ্জি’র পরের পর্বে কী লিখবেন, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। এ সময় ইমন এসে হাজির হলেন। ইমনকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন।

ইমন বললেন, আমি একবার এসে ফিরে গেছি। তুমি এসেছ শুনে আবার এলাম।

ভালোই হলো। বেশ কিছু দিন আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই। ওদিককার কী খবর?

কার কথা বলছ?

ইঝোমি, শোনাগন দুজনেরই।

ইঝোমি, হায় বেচারি। ভালো শুনছি না। তার প্রতিবেশী এক মহিলার সঙ্গে আমার জানা শোনা আছে। তিনি সেদিন হাসতে হাসতে নানা ইঙ্গিত করে বলছিলেন, রাতের বেলায় প্রিন্স অতসুমিচি রাজীয় শকটে চড়ে এসেছেন তাকে নিয়ে যেতে। প্রায় প্রতি রাতেই নাকি তিনি এসে ইঝোমিকে নিয়ে যান এবং ভোরবেলা পৌঁছে দেন। সেদিন প্রিন্স এসে দেখলেন তার বাড়ির সামনে একটি শকট। প্রিন্স তার শকটে বসে রইলেন। তার লোক প্রিন্সকে বললেন, ভেতরে একজন আছেন, মনে হয় না আপনি আজ সুযোগ পাবেন। তা শুনে প্রিন্স ফিরে গেছেন।

এ অবস্থা তার?

সমস্যা হচ্ছে তাকে বোঝাবার কেউ নেই।

আপনার কথাও শোনে না?

যে বাবা-মা, নানি-দাদি কারো কথাই শোনে না, সে আমার কথা শুনবে কেন? আমিই বা বলতে যাব কেন?

তার মেয়েটা কোথায়?

তার অসামাজিক কার্যকলাপের কথা শুনে মেয়ের বাবা নিয়ে গেছে।

ভালোই হয়েছে। মেয়েটা অন্তত রক্ষা পেল।

তার প্রতিভা ছিল। তা কি নষ্ট হয়ে যাবে?

বুঝতে পারছি না। শোনাগনের কী অবস্থা? স্বামী নাকি সম্রাটের প্রাসাদ ছেড়ে প্রদেশে চলে গেছেন।

বেচারির বড় বিরহের দিন। সম্রাজ্ঞী তেইশিও তার স্বামীর বদলি ঠেকাতে পারলেন না।

আগের স্বামীর সঙ্গে এতটা বছর কাটিয়ে তাকে বিনা অজুহাতে ত্যাগ করতে পারলো?

শুধু উচ্চাভিলাষের জন্যই তা করেছে। কিন্তু যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে করেছে তা আর সফল হলো কই? প্রদেশ থেকে প্রাসাদে প্রভাব খাটানো সহজ নয়।

কাছের প্রদেশে গেছে।

সম্রাজ্ঞী প্রভাব খাটিয়ে কাছে দিয়েছেন মনে হয়। আমি তোমাকে জানাতে এসেছি জাপানের প্রাচীন ইতিহাসের কিছু নিদর্শন পেয়েছি, তার জন্য খুব আনন্দ হচ্ছে।

হ্যাঁ, আমি তো জানি আপনি প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেন।

তা সবার কৌতূহল জাগাতে সমর্থ হবে। লেখা শেষ করি তোমাকেও পড়তে দেব।

অপেক্ষায় থাকলাম। আপনার ইতিহাস চর্চায় আমি ‘গেঞ্জি’র উপাদান খুঁজে পাই।

বর্তমান প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলো আঁচ করা যায়।

আমার পরিবেশ আমার ওপর প্রভাব ফেলবে না? তারপরও আমি সচেতন। এড়িয়ে চলতে চাই।

সম্রাটের দরবারকেন্দ্রিক মনোগাতারিতে কতটা উপেক্ষা করা যায়? তুমি সংযমী বলে পারছো। আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। তার কারণ সম্ভবত ইতিহাস চর্চা। সাহিত্যে তুমি যা পারছো ইতিহাসে তা সম্ভব না। এখানে কল্পনার স্থান নেই। আমি এখন আসি, তাকাকু।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান

ইমন চলে গেলে ইঝোমিকে নিয়ে ভাবতে বসলেন মুরাসাকি। সেই শৈশব থেকে দেখে আসছেন তাকে। সেই সময় থেকেই সে বেপরোয়া। কিন্তু কী পরিণতি তার ভাগ্যে লেখা আছে। শুধু ভোগময় জীবনের বিপরীতে কী কোনো ত্যাগ বা বেদনার কথা লেখা নেই? মহাযানী বৌদ্ধশাস্ত্র কী মিথ্যে প্রমাণিত যে ভোগের বিপরীতে দুর্ভোগ নেই? দুঃখ দুর্দশা তাহলে কেন?

আসলে দুর্ভোগটাই কী। তা কি নিয়তি নির্ভর? নাকি কর্মফলের সঙ্গেই তার সম্পর্ক? মনস্তত্বের দিক থেকে ধর্ম, নিয়তি, ভাগ্য ও কর্মফলের বাইরে কী মানব পরিণতি চিন্তার কোনো ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছে? ‘গোঞ্জি’তে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। ভাবলেন তিনি তার চিন্তার উচ্চতাকে এখানে লালন করবেন।

নিজে একাকী থেকে ভোগ নয়, ত্যাগের পথই বেছে নিয়েছেন। তবে বৈরাগ্য সাধনের জীবন বেছে নেননি। তার সঙ্গে নিজের ব্যক্তিত্বকে আলাদা ধাঁচে গড়ে তুলেছেন। যা নানা আলোচনা এবং সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

তিনি লিখলেন যে, নতুন সম্রাট সুজেকো গেঞ্জিকে বিশ্বাস করে একটি গোপন কথা বললেন।

গেঞ্জি অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি? পরক্ষণে বললেন, সম্রাটদের এসব থাকতে হয়। আমি কাউকে বলব না।

গেঞ্জির কৌতূহল বাড়ে সম্রাটের এই রক্ষিতার প্রতি। সে রক্ষিতাকে ভোগ করতে চায়। রক্ষিতার সঙ্গে তার মিলন দৃশ্য সম্রাট দেখে ফেলেন।

গেঞ্জি বিশ্বাস ভঙ্গ করে ফেলেছে। অন্যায় করেছে। এজন্য তার কোনো অনুশোচনা নেই।

রাগে সম্রাট কাঁপতে থাকেন, পরে গেঞ্জিকে শান্তি স্বরূপ প্রত্যন্ত হারিমা প্রদেশের সুমা নগরীতে পাঠিয়ে দেন।

‘গেঞ্জি’র তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে নীরবে চলে যায় সেখানে। পাঠক ভাবতে পারেন তার বুঝি অনুশোচনা হবে। কিংবা বোধোদয় হবে। সে যা করেছে ভুল করেছে এবং সে তার জন্য অনুতপ্ত।

না। তা একোবরেই নয়। গেঞ্জি প্রয়াত সম্রাটের পুত্র, তার কথা শুনে আকাশি নভিস নামে পরিচিত এক ভদ্রলোক গেঞ্জিকে তার বাড়িতে আতিথ্য দেন। আকাশির এক কন্যা আছে। গেঞ্জি তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে, পরে প্রেম এবং দৈহিক সম্পর্ক। তার ফল এক কন্যাসন্তানের জন্ম (সংক্ষেপিত)।

মুরাসাকি ভাবলেন, গেঞ্জি তো পাপ করে ভালোই আছে। তিনি তাকে আরো ভালো থাকতে দিলেন। সমাজ দিচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা দিচ্ছে, তার না দেয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এখানে লেখিকা কী আত্মহত্যা করলেন? এখন তার মনে হল, লেখিকা কাউকে অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়ার মালিক নন। তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন সমাজের সর্বোচ্চ মহলে কী ঘটছে। অভিজাত পরুষেরা কী করতে পারছে।

মুরাসাকি আজকের লেখা এখানে শেষ করলেন। তবে ভাবনায় তার ইতি ঘটলো না। ভাবতে ভাবতে স্ক্রলের মধ্যে ছবি আঁকলেন। লেখার পাশাপাশি ছবি, অলঙ্করণ। নিজেই বললেন, ছবিটা তো সুন্দর হয়েছে।

গত দিনে নিয়ে যাওয়া স্ক্রলগুলো মিচিনাগা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। উল্টেপাল্টে দেখলেন, না সব ঠিকই আছে। সঙ্গে একটি পত্র। পত্রে লেখার খুব প্রশংসা আছে। তবে অনেকটা না বুঝে। একটি কবিতাও আছে পত্রে :

শরতের দিনগুলো

মাতাল হাওয়ায় কী যেন বার্তা দেয়

মিষ্টি মানুষের প্রতিশ্রুতি পাওয়া?

হৃদয় কত আলাদা!

মুরাসাকি তা পড়ে হাসলেন। তিনি এই পত্রের জবাব দেবেন না। তাকে এখনো বুঝতে বাকি। খুব ক্ষমতাশালী মানুষ। সতর্কভাবে চলতে হবে। সতর্কভাবে চলার অর্থ হলো ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলা, কোথাও চরিত্রের দুর্বলতা প্রকাশ না পাওয়া।

বত্রিশ.

প্রিন্স অতসুমিচি গেছেন সম্রাটের দরবারে। এরা প্রায় সমবয়সী। সম্রাট ইচিজো প্রিন্স সম্পর্কে জানেন। তার সঙ্গে রসরসিকতাও করেন। প্রিন্স সেরাতের ঘটনাটা ভুলতে পারছেন না। তাই সম্রাটের রসিকতাটা ভালো লাগছে না। সম্রাটের স্ত্রী পাঁচজন। এছাড়া রক্ষিতা কিছু আছে কিনা জানার উপায় নেই। সে তুলনায় প্রিন্সদের সুযোগটা কম। সেখানেও বিপত্তি। যাকে ভালোবেসে সম্পর্ক করলেন সে কিনা দ্বিচারিণী, নাকি বহুচারিণী, এসব ভেবে আনমনা হয়ে যান। সম্রাটের দরবার থেকে উঠে যেতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলেন না।

এ সময় উকোন-নো-ঝো এলো। বলল, লেডি ইঝোমি পত্র পাঠিয়েছেন। সেদিন থেকে দীর্ঘদিন প্রিন্স সেখানে যাচ্ছেন না। রাগ হয়েছে, প্রচুর রাগ। তাৎক্ষণিক পত্র লিখে পরদিন পাঠিয়ে দিলেন, গত রাতে আমি গিয়েছিলাম, তুমি কি তা শুনেছ? এটা যে আমাকে কত ব্যথিত করেছে তাও তুমি জানো না।

সঙ্গে একটি কবিতা :

পাইন-পাহাড়ের উল্টোদিকে যেখানে আমার

জন্য বেদনার সবুজ চত্বর

ঢেউগুলো অনেক উঁচু, তা আমি দেখেছি

আজকের দৃশ্যঅবধি, ওহ্ অলক্ষুণে!

বর্ষা চলে গেলেও বৃষ্টির দিন ছিল। ইঝোমি পত্র পেলেন। মনে হলো অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ। তার সন্দেহ হলো, অপবাদজনক ভাষায় তাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তিনি লিখলেন-

শুধু আপনি আমার সার্বক্ষণিক প্রতীক্ষার দ্বীপ

কোনো ঢেউ কি তাকে ভাসিয়ে নিতে পারে?

প্রিন্স তার উত্তর দিলেন না। দীর্ঘ দিন পত্রও লিখলেন না। তার মনের রাগ-ক্ষোভ-ব্যথা যেন সে দুঃস্বপ্ন রাতের স্মৃতি হয়ে গেঁথে আছে।

ব্যাপারটা ইঝোমি তখনো বুঝতে পারেননি। কারণ তিনি জানেন না আসলে ফিরে যাবার রাতে কী ঘটেছিল।

দীর্ঘদিন পর প্রিন্স হঠাৎ করেই লিখলেন-

ভালোবাসা ও দুঃখ যন্ত্রণার নানারূপ

আমার মনের ওপর দিয়েই যায়। কখনো বিশ্রাম দেয় না।

ইঝোমি ভাবলেন উত্তর দেবেন। কিন্তু কী লিখবেন তিনি। নিজেকে ব্যাখ্যা করতে কুণ্ঠিত হলেন, কেবল লিখতে পারলেন, আপনি যেমনটি চান, আসুন বা না আসুন, তা তিক্ত অনুভূতি ছাড়াই আমার দুঃখকে হালকা করে দেবে।

সেই থেকে প্রিন্সকে ইঝোমি তেমন পত্র লিখছেন না। এক উচ্ছ্বল জ্যোৎস্না রাতে বিষণ্ন অবস্থায় শুয়েছিলেন ইঝোমি। চাঁদকে দেখে তার ঈর্ষাই হলো। তিনি আর প্রিন্সকে না লিখে পারলেন না। লিখলেন :

তার বিরাণবাড়িতে

সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে

তিনি আসছেন না

সে তার হৃদয় খুলে দেখাতে পারছে না।

কেউ নেই যে তা শুনবে।

ইঝোমি তার বার্তা বাহকের মাধ্যমে কবিতাটি উকোন-নো-ঝো-র কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এ সময়ই প্রিন্স সম্রাটের দরবারে ছিলেন। তিনি বের হয়ে পত্রটি পেয়ে বললেন, বাহন প্রস্তুত করো। আমি এখনই বের হব।

তিনি পৌঁছে গেলেন ইঝোমির বাড়িতে। ইঝোমি বারান্দায় বসে আকাশ দেখছিলেন। কেউ আসছে মনে করে বারান্দার রুল করা চামড়ার পর্দাটা নামিয়ে দিলেন। তিনি দরবারি পোশাক পরে না এসে, প্রতিদিনকার হালকা পোশাক পরে এসেছেন। দেখতে বেশ ভালো লাগছে। প্রিন্স মজা করে কিছু একটা বলে তার কবিতাটি সামনে রেখে বললেন, তোমার বার্তাবাহক অতিদ্রুত ফিরে আসছে, এই আমার উত্তর।

ইঝোমি পত্রটি নিজের করে নিয়ে নিলেন। প্রিন্স ভেতরে আসবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু না এসে বাগানের দিকে চলে গেলেন এবং গাইতে শুরু করলেন, আমার ভালোবাসা দেখতে পাতার ওপর এক শিশির বিন্দু যেন। পরে ইঝোমির কাছে এলেন এবং বললেন, আমাকে আজ রাতে অবশ্যই যেতে হবে। গোপনে আসব। কিন্তু এরকম চন্দ্রালোক উজ্জ্বল রাতে কেউই নিজেকে দর্শন থেকে আড়াল করতে পারবে না। আগামীকাল আমাকে অবশ্যই ধর্মীয় কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। আমি যদি প্রাসাদে না থাকি লোকজন সন্দেহ করবে।

ইঝোমি বললেন, আর বৃষ্টি অবশ্যই আসবে। বসুন তো। আরেক বিজলী চমকানোর স্বর্গীয় আলো ঔজ্জ্বল্য ছড়াবে। অনেকক্ষণ থাকবে, আপনি অপেক্ষা করুন, প্রার্থনা করছি।

প্রিন্স দেখলেন ইঝোমি অন্যদের চাইতে আরো অনেক সৌহার্দপূর্ণ। বললেন, আহ! প্রিয়তমা, বলে একটু এগিয়ে এলেন, আবার চলে গেলেন। যেতে যেতে বললেন,

চাঁদ তার মেঘাচ্ছন্ন পথে অনিচ্ছার তীব্রবাসনা জাগায়, তার শরীরটাই চলে যাচ্ছে, কিন্তু মনটা নয়। প্রিন্স চলে যাবার পর ইঝোমি রুল করা পর্দাটা আবার তুলে দিয়ে চাঁদের আলোয় প্রিন্সের দেয়া কবিতাটি পড়লেন :

সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে

কিন্তু তার সকল চিন্তা আমাকে ঘিরে

এই শুনে তা তার পক্ষে টানে আমাকে।

ইঝোমি ভাবলেন, কত সুখী। প্রিন্স হয়ত তাকে অপদার্থই ভাবতেন, এখন বুঝি তার মতের পরিবর্তন হয়েছে। অথচ তিনি তাকে বলেছিলেন যে, মেজর জেনারেল তার প্রিয়, দিনের বেলায় আসেন। এখনো অন্যেরা বলে, হিরো বুকিয়ো তার আরেকজন প্রেমিক। এসব শুনে প্রিন্স তাকে আর কিছু লেখেননি।

একদিন প্রিন্সের ছোট বার্তা বাহক এল, সে কিনা আবার ইঝোমির দাসির প্রেমিক। ইঝোমি জিজ্ঞেস করলেন কোনো পত্রটত্র?

সে বলল, না, একদিন আমার প্রভু আপনার এখানে এসে দেখলেন দরজায় একটি শকট। ফিরে গেলেন। সে সময় থেকে তিনি আর লিখছেন না। এছাড়া তিনি শুনেছেন যে, অন্যেরা এখানে আসে। শেষের কথাটা বলল সে যেতে যেতে।

তাতে ইঝোমি খুবই অপমানিত বোধ করলেন। কোনো অহংকারের চিন্তা নেই, কোনো বস্তুগত স্বার্থ নেই, শুধু ভালোবাসা আর নেয়া যায়না, তাই বলে অন্তত বিদীর্ণ করা লজ্জাজনক অপবাদের সন্দেহ? তার দু’চোখ অশ্রুতে ভরে এলো। দুঃখ-শোকের বাষ্প যখন বের হচ্ছে ঘনঘন, তখনই প্রিন্সের একটি পত্র এলো।

ইমনের খুব ইচ্ছে হচ্ছে একবার মিচিতাকাকে দেখেন। তিনি প্রতারণা করেছেন, ইমন তো সত্যিই তাকে ভালোবেসেছেন। তার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। নিষ্পাপ সেই ভালোবাসা। তাই ভুলতে পারেন না। কর্ণফুসিয়ান স্কলার স্বামী তাকে খুব ভালো বাসেন। এখানে কোনো খাদ নেই, তবুও স্পষ্ট প্রথম প্রেমের দিকে। মাঝেমধ্যে প্রচুর কাঁদেন, ওর জন্য নয়, নিজের প্রেমের জন্য। এ কথা তো কাউকে বলাও যায় না। অনুভূতিগুলো বাষ্প হয়ে যেন উড়ে যায় নীরবে নিভৃতে।

এই অনুভূতিটা আছে বলেই মনে হয় ইমন কবিতা লিখতে পারছেন। তার কবিতা না পাওয়ার বেদনায় শিল্প হয়ে ফুটে ওঠে। এ কথা ইমন নিজেও জানেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় তার প্রেম। তারই পূজারি তিনি, মানুষটির নয়।

তাহলে তাকে দেখতে চাওয়া কেন? প্রবল দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতের মুখোমুখি হন তিনি। সমাধানটা নিজেই খুঁজে বের করেন। শিন্টু শ্রাইনে কেন দাঁড়ান? অন্তরে তো তার ছায়ামূর্তি আছেই।

তিনি হয়ত মহাযানী বৌদ্ধধর্মের অনুশীলনের মাধ্যমে ত্যাগের দীক্ষাটা নিয়ে সবকিছু ভুলে থাকতে পারতেন। কিন্তু ইমন একজন মানবী বৌদ্ধ ভিক্ষুণী (নান) নন। বাস্তব জীবনে তৃষ্ণা তার আছে; তিনি উপলব্ধি করেন তার প্রেম তার জীবনের অনেক কিছুর মধ্যে একটি অনেক কিছুর যোগফল। একে বাদ দেবেন কেমন করে। তাহলে জীবনের মিথ্যা যোগফলকে দেখাতে হবে। তা শ্রেফ আত্মপ্রবঞ্চনা।

সে মানুষটির কাছে এখন আর ইমনের কিছু চাওয়ার নেই। শুধু দেখে যাওয়া। বয়স তো কম হয়নি, কি-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে। ওর তো দেওয়ার সামর্থ্যই নেই, সামর্থ্য থাকলে ফেলে চলে যেতো না। অন্তরে তার প্রেম ছিল না, মুখে যাই থাকুক না কেন। ইমনের সুখ দেখে হয়ত সে ঈর্ষান্বিত। হৃদয়টা দেখার সামর্থ্য নেই বলে, বিশাল সম্পদ থেকে বঞ্চিত। আর তা ইমনের প্রেম। এখনো আছে। আগের মতোই নিষ্কাম, পুতপবিত্র।

এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। হয়ত দুর্ভোগ হতো। প্রেম নিয়ে টানাহেঁচড়া হতো। ইমন ভালোবেসে যাবার জন্য নিষ্ফলক হৃদয়ের এমন সমর্থন পেতেন না। এই নিভৃত প্রেমে যে কী প্রশান্তি তা শুধু ইমনই জানেন। সুখের স্মৃতি নয়, দুঃখের স্মৃতিগুলোই মধুর হয়ে কল্পনায় আছে। ক্রমশ...

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : সতের

শিকিবু

আবুল কাসেম

শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

একত্রিশ.

সম্রাজ্ঞী শোশি মুরাসাকিকে নিয়ে একান্তে বসেছেন তার দরবারে। ব্যাপারটি খুবই গোপনীয়। সম্রাজ্ঞী মুরাসাকির কাছে চীনা ধ্রুপদী ভাষা শিখবেন। এদের দুজনের বাইরে কথাটি তিন কান হলেই সর্বনাশ। একেবারে আইন করে বলে দেয়া আছে হেইয়ান সম্রাজ্যের কোনো নারী এই ভাষা শিখতে পারবে না। এটি শুধু অভিজাত পুরুষদের ভাষা এবং সম্রাটের দরবারি ভাষা। অন্য কথায় রাজভাষা। নারীদের এ ভাষা শিক্ষা রাষ্ট্রােদ্রাহের কাজ।

সম্রাজ্ঞী শোশি বললেন, আমার জানা দরকার এ ভাষায় কী এমন রহস্য রয়েছে, যা সম্রাজ্ঞীরাও শিখতে পারবে না।

ভাষা তো ভাষাই মহামান্যা। তা দ্বারা নারী-পুরুষে বিভেদ সৃষ্টি করে রাখা এই যা। শক্ত আইনটা সম্ভবত এ জন্যই।

তবুও আমি এ ভাষা শিখবই। তুমি আমাকে শেখাবে।

তবে চীনা ধ্রুপদী ভাষায় লেখা সাহিত্য চমৎকার; যা এখনো আমাদের এখানে লেখা হয়নি।

যেমন?

চীনা গীতিকা।

তা তুমি আমাকে শোনাবে।

আপনি তো চীনা ভাষা এখন বুঝবেন না।

তুমি কানাভাষায় বুঝাবে।

তা ঠিক আছে।

এমন সময় লেডি সাইশি দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে আসতে চাইলেন। শোশি রাগান্বিত হয়ে বললেন, কী এমন দরকার বিরক্ত করছ?

সাইশি বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসেছেন।

সম্রাজ্ঞী স্বগতভাবে বললেন, তিনি আর সময় পেলেন না। মুরাসাকিকে বললেন, তুমি এখন এসো। পরে আমরা আবার বসবো। সাইশিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তাকে বসতে দাও আমি আসছি।

মুরাসাকি নিজের দপ্তরে ফিরে গেলেন। ‘গেঞ্জি’র পরের পর্বে কী লিখবেন, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। এ সময় ইমন এসে হাজির হলেন। ইমনকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন।

ইমন বললেন, আমি একবার এসে ফিরে গেছি। তুমি এসেছ শুনে আবার এলাম।

ভালোই হলো। বেশ কিছু দিন আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই। ওদিককার কী খবর?

কার কথা বলছ?

ইঝোমি, শোনাগন দুজনেরই।

ইঝোমি, হায় বেচারি। ভালো শুনছি না। তার প্রতিবেশী এক মহিলার সঙ্গে আমার জানা শোনা আছে। তিনি সেদিন হাসতে হাসতে নানা ইঙ্গিত করে বলছিলেন, রাতের বেলায় প্রিন্স অতসুমিচি রাজীয় শকটে চড়ে এসেছেন তাকে নিয়ে যেতে। প্রায় প্রতি রাতেই নাকি তিনি এসে ইঝোমিকে নিয়ে যান এবং ভোরবেলা পৌঁছে দেন। সেদিন প্রিন্স এসে দেখলেন তার বাড়ির সামনে একটি শকট। প্রিন্স তার শকটে বসে রইলেন। তার লোক প্রিন্সকে বললেন, ভেতরে একজন আছেন, মনে হয় না আপনি আজ সুযোগ পাবেন। তা শুনে প্রিন্স ফিরে গেছেন।

এ অবস্থা তার?

সমস্যা হচ্ছে তাকে বোঝাবার কেউ নেই।

আপনার কথাও শোনে না?

যে বাবা-মা, নানি-দাদি কারো কথাই শোনে না, সে আমার কথা শুনবে কেন? আমিই বা বলতে যাব কেন?

তার মেয়েটা কোথায়?

তার অসামাজিক কার্যকলাপের কথা শুনে মেয়ের বাবা নিয়ে গেছে।

ভালোই হয়েছে। মেয়েটা অন্তত রক্ষা পেল।

তার প্রতিভা ছিল। তা কি নষ্ট হয়ে যাবে?

বুঝতে পারছি না। শোনাগনের কী অবস্থা? স্বামী নাকি সম্রাটের প্রাসাদ ছেড়ে প্রদেশে চলে গেছেন।

বেচারির বড় বিরহের দিন। সম্রাজ্ঞী তেইশিও তার স্বামীর বদলি ঠেকাতে পারলেন না।

আগের স্বামীর সঙ্গে এতটা বছর কাটিয়ে তাকে বিনা অজুহাতে ত্যাগ করতে পারলো?

শুধু উচ্চাভিলাষের জন্যই তা করেছে। কিন্তু যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে করেছে তা আর সফল হলো কই? প্রদেশ থেকে প্রাসাদে প্রভাব খাটানো সহজ নয়।

কাছের প্রদেশে গেছে।

সম্রাজ্ঞী প্রভাব খাটিয়ে কাছে দিয়েছেন মনে হয়। আমি তোমাকে জানাতে এসেছি জাপানের প্রাচীন ইতিহাসের কিছু নিদর্শন পেয়েছি, তার জন্য খুব আনন্দ হচ্ছে।

হ্যাঁ, আমি তো জানি আপনি প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেন।

তা সবার কৌতূহল জাগাতে সমর্থ হবে। লেখা শেষ করি তোমাকেও পড়তে দেব।

অপেক্ষায় থাকলাম। আপনার ইতিহাস চর্চায় আমি ‘গেঞ্জি’র উপাদান খুঁজে পাই।

বর্তমান প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলো আঁচ করা যায়।

আমার পরিবেশ আমার ওপর প্রভাব ফেলবে না? তারপরও আমি সচেতন। এড়িয়ে চলতে চাই।

সম্রাটের দরবারকেন্দ্রিক মনোগাতারিতে কতটা উপেক্ষা করা যায়? তুমি সংযমী বলে পারছো। আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। তার কারণ সম্ভবত ইতিহাস চর্চা। সাহিত্যে তুমি যা পারছো ইতিহাসে তা সম্ভব না। এখানে কল্পনার স্থান নেই। আমি এখন আসি, তাকাকু।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান

ইমন চলে গেলে ইঝোমিকে নিয়ে ভাবতে বসলেন মুরাসাকি। সেই শৈশব থেকে দেখে আসছেন তাকে। সেই সময় থেকেই সে বেপরোয়া। কিন্তু কী পরিণতি তার ভাগ্যে লেখা আছে। শুধু ভোগময় জীবনের বিপরীতে কী কোনো ত্যাগ বা বেদনার কথা লেখা নেই? মহাযানী বৌদ্ধশাস্ত্র কী মিথ্যে প্রমাণিত যে ভোগের বিপরীতে দুর্ভোগ নেই? দুঃখ দুর্দশা তাহলে কেন?

আসলে দুর্ভোগটাই কী। তা কি নিয়তি নির্ভর? নাকি কর্মফলের সঙ্গেই তার সম্পর্ক? মনস্তত্বের দিক থেকে ধর্ম, নিয়তি, ভাগ্য ও কর্মফলের বাইরে কী মানব পরিণতি চিন্তার কোনো ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছে? ‘গোঞ্জি’তে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। ভাবলেন তিনি তার চিন্তার উচ্চতাকে এখানে লালন করবেন।

নিজে একাকী থেকে ভোগ নয়, ত্যাগের পথই বেছে নিয়েছেন। তবে বৈরাগ্য সাধনের জীবন বেছে নেননি। তার সঙ্গে নিজের ব্যক্তিত্বকে আলাদা ধাঁচে গড়ে তুলেছেন। যা নানা আলোচনা এবং সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

তিনি লিখলেন যে, নতুন সম্রাট সুজেকো গেঞ্জিকে বিশ্বাস করে একটি গোপন কথা বললেন।

গেঞ্জি অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি? পরক্ষণে বললেন, সম্রাটদের এসব থাকতে হয়। আমি কাউকে বলব না।

গেঞ্জির কৌতূহল বাড়ে সম্রাটের এই রক্ষিতার প্রতি। সে রক্ষিতাকে ভোগ করতে চায়। রক্ষিতার সঙ্গে তার মিলন দৃশ্য সম্রাট দেখে ফেলেন।

গেঞ্জি বিশ্বাস ভঙ্গ করে ফেলেছে। অন্যায় করেছে। এজন্য তার কোনো অনুশোচনা নেই।

রাগে সম্রাট কাঁপতে থাকেন, পরে গেঞ্জিকে শান্তি স্বরূপ প্রত্যন্ত হারিমা প্রদেশের সুমা নগরীতে পাঠিয়ে দেন।

‘গেঞ্জি’র তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে নীরবে চলে যায় সেখানে। পাঠক ভাবতে পারেন তার বুঝি অনুশোচনা হবে। কিংবা বোধোদয় হবে। সে যা করেছে ভুল করেছে এবং সে তার জন্য অনুতপ্ত।

না। তা একোবরেই নয়। গেঞ্জি প্রয়াত সম্রাটের পুত্র, তার কথা শুনে আকাশি নভিস নামে পরিচিত এক ভদ্রলোক গেঞ্জিকে তার বাড়িতে আতিথ্য দেন। আকাশির এক কন্যা আছে। গেঞ্জি তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে, পরে প্রেম এবং দৈহিক সম্পর্ক। তার ফল এক কন্যাসন্তানের জন্ম (সংক্ষেপিত)।

মুরাসাকি ভাবলেন, গেঞ্জি তো পাপ করে ভালোই আছে। তিনি তাকে আরো ভালো থাকতে দিলেন। সমাজ দিচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা দিচ্ছে, তার না দেয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এখানে লেখিকা কী আত্মহত্যা করলেন? এখন তার মনে হল, লেখিকা কাউকে অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়ার মালিক নন। তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন সমাজের সর্বোচ্চ মহলে কী ঘটছে। অভিজাত পরুষেরা কী করতে পারছে।

মুরাসাকি আজকের লেখা এখানে শেষ করলেন। তবে ভাবনায় তার ইতি ঘটলো না। ভাবতে ভাবতে স্ক্রলের মধ্যে ছবি আঁকলেন। লেখার পাশাপাশি ছবি, অলঙ্করণ। নিজেই বললেন, ছবিটা তো সুন্দর হয়েছে।

গত দিনে নিয়ে যাওয়া স্ক্রলগুলো মিচিনাগা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। উল্টেপাল্টে দেখলেন, না সব ঠিকই আছে। সঙ্গে একটি পত্র। পত্রে লেখার খুব প্রশংসা আছে। তবে অনেকটা না বুঝে। একটি কবিতাও আছে পত্রে :

শরতের দিনগুলো

মাতাল হাওয়ায় কী যেন বার্তা দেয়

মিষ্টি মানুষের প্রতিশ্রুতি পাওয়া?

হৃদয় কত আলাদা!

মুরাসাকি তা পড়ে হাসলেন। তিনি এই পত্রের জবাব দেবেন না। তাকে এখনো বুঝতে বাকি। খুব ক্ষমতাশালী মানুষ। সতর্কভাবে চলতে হবে। সতর্কভাবে চলার অর্থ হলো ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলা, কোথাও চরিত্রের দুর্বলতা প্রকাশ না পাওয়া।

বত্রিশ.

প্রিন্স অতসুমিচি গেছেন সম্রাটের দরবারে। এরা প্রায় সমবয়সী। সম্রাট ইচিজো প্রিন্স সম্পর্কে জানেন। তার সঙ্গে রসরসিকতাও করেন। প্রিন্স সেরাতের ঘটনাটা ভুলতে পারছেন না। তাই সম্রাটের রসিকতাটা ভালো লাগছে না। সম্রাটের স্ত্রী পাঁচজন। এছাড়া রক্ষিতা কিছু আছে কিনা জানার উপায় নেই। সে তুলনায় প্রিন্সদের সুযোগটা কম। সেখানেও বিপত্তি। যাকে ভালোবেসে সম্পর্ক করলেন সে কিনা দ্বিচারিণী, নাকি বহুচারিণী, এসব ভেবে আনমনা হয়ে যান। সম্রাটের দরবার থেকে উঠে যেতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলেন না।

এ সময় উকোন-নো-ঝো এলো। বলল, লেডি ইঝোমি পত্র পাঠিয়েছেন। সেদিন থেকে দীর্ঘদিন প্রিন্স সেখানে যাচ্ছেন না। রাগ হয়েছে, প্রচুর রাগ। তাৎক্ষণিক পত্র লিখে পরদিন পাঠিয়ে দিলেন, গত রাতে আমি গিয়েছিলাম, তুমি কি তা শুনেছ? এটা যে আমাকে কত ব্যথিত করেছে তাও তুমি জানো না।

সঙ্গে একটি কবিতা :

পাইন-পাহাড়ের উল্টোদিকে যেখানে আমার

জন্য বেদনার সবুজ চত্বর

ঢেউগুলো অনেক উঁচু, তা আমি দেখেছি

আজকের দৃশ্যঅবধি, ওহ্ অলক্ষুণে!

বর্ষা চলে গেলেও বৃষ্টির দিন ছিল। ইঝোমি পত্র পেলেন। মনে হলো অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ। তার সন্দেহ হলো, অপবাদজনক ভাষায় তাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তিনি লিখলেন-

শুধু আপনি আমার সার্বক্ষণিক প্রতীক্ষার দ্বীপ

কোনো ঢেউ কি তাকে ভাসিয়ে নিতে পারে?

প্রিন্স তার উত্তর দিলেন না। দীর্ঘ দিন পত্রও লিখলেন না। তার মনের রাগ-ক্ষোভ-ব্যথা যেন সে দুঃস্বপ্ন রাতের স্মৃতি হয়ে গেঁথে আছে।

ব্যাপারটা ইঝোমি তখনো বুঝতে পারেননি। কারণ তিনি জানেন না আসলে ফিরে যাবার রাতে কী ঘটেছিল।

দীর্ঘদিন পর প্রিন্স হঠাৎ করেই লিখলেন-

ভালোবাসা ও দুঃখ যন্ত্রণার নানারূপ

আমার মনের ওপর দিয়েই যায়। কখনো বিশ্রাম দেয় না।

ইঝোমি ভাবলেন উত্তর দেবেন। কিন্তু কী লিখবেন তিনি। নিজেকে ব্যাখ্যা করতে কুণ্ঠিত হলেন, কেবল লিখতে পারলেন, আপনি যেমনটি চান, আসুন বা না আসুন, তা তিক্ত অনুভূতি ছাড়াই আমার দুঃখকে হালকা করে দেবে।

সেই থেকে প্রিন্সকে ইঝোমি তেমন পত্র লিখছেন না। এক উচ্ছ্বল জ্যোৎস্না রাতে বিষণ্ন অবস্থায় শুয়েছিলেন ইঝোমি। চাঁদকে দেখে তার ঈর্ষাই হলো। তিনি আর প্রিন্সকে না লিখে পারলেন না। লিখলেন :

তার বিরাণবাড়িতে

সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে

তিনি আসছেন না

সে তার হৃদয় খুলে দেখাতে পারছে না।

কেউ নেই যে তা শুনবে।

ইঝোমি তার বার্তা বাহকের মাধ্যমে কবিতাটি উকোন-নো-ঝো-র কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এ সময়ই প্রিন্স সম্রাটের দরবারে ছিলেন। তিনি বের হয়ে পত্রটি পেয়ে বললেন, বাহন প্রস্তুত করো। আমি এখনই বের হব।

তিনি পৌঁছে গেলেন ইঝোমির বাড়িতে। ইঝোমি বারান্দায় বসে আকাশ দেখছিলেন। কেউ আসছে মনে করে বারান্দার রুল করা চামড়ার পর্দাটা নামিয়ে দিলেন। তিনি দরবারি পোশাক পরে না এসে, প্রতিদিনকার হালকা পোশাক পরে এসেছেন। দেখতে বেশ ভালো লাগছে। প্রিন্স মজা করে কিছু একটা বলে তার কবিতাটি সামনে রেখে বললেন, তোমার বার্তাবাহক অতিদ্রুত ফিরে আসছে, এই আমার উত্তর।

ইঝোমি পত্রটি নিজের করে নিয়ে নিলেন। প্রিন্স ভেতরে আসবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু না এসে বাগানের দিকে চলে গেলেন এবং গাইতে শুরু করলেন, আমার ভালোবাসা দেখতে পাতার ওপর এক শিশির বিন্দু যেন। পরে ইঝোমির কাছে এলেন এবং বললেন, আমাকে আজ রাতে অবশ্যই যেতে হবে। গোপনে আসব। কিন্তু এরকম চন্দ্রালোক উজ্জ্বল রাতে কেউই নিজেকে দর্শন থেকে আড়াল করতে পারবে না। আগামীকাল আমাকে অবশ্যই ধর্মীয় কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। আমি যদি প্রাসাদে না থাকি লোকজন সন্দেহ করবে।

ইঝোমি বললেন, আর বৃষ্টি অবশ্যই আসবে। বসুন তো। আরেক বিজলী চমকানোর স্বর্গীয় আলো ঔজ্জ্বল্য ছড়াবে। অনেকক্ষণ থাকবে, আপনি অপেক্ষা করুন, প্রার্থনা করছি।

প্রিন্স দেখলেন ইঝোমি অন্যদের চাইতে আরো অনেক সৌহার্দপূর্ণ। বললেন, আহ! প্রিয়তমা, বলে একটু এগিয়ে এলেন, আবার চলে গেলেন। যেতে যেতে বললেন,

চাঁদ তার মেঘাচ্ছন্ন পথে অনিচ্ছার তীব্রবাসনা জাগায়, তার শরীরটাই চলে যাচ্ছে, কিন্তু মনটা নয়। প্রিন্স চলে যাবার পর ইঝোমি রুল করা পর্দাটা আবার তুলে দিয়ে চাঁদের আলোয় প্রিন্সের দেয়া কবিতাটি পড়লেন :

সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে

কিন্তু তার সকল চিন্তা আমাকে ঘিরে

এই শুনে তা তার পক্ষে টানে আমাকে।

ইঝোমি ভাবলেন, কত সুখী। প্রিন্স হয়ত তাকে অপদার্থই ভাবতেন, এখন বুঝি তার মতের পরিবর্তন হয়েছে। অথচ তিনি তাকে বলেছিলেন যে, মেজর জেনারেল তার প্রিয়, দিনের বেলায় আসেন। এখনো অন্যেরা বলে, হিরো বুকিয়ো তার আরেকজন প্রেমিক। এসব শুনে প্রিন্স তাকে আর কিছু লেখেননি।

একদিন প্রিন্সের ছোট বার্তা বাহক এল, সে কিনা আবার ইঝোমির দাসির প্রেমিক। ইঝোমি জিজ্ঞেস করলেন কোনো পত্রটত্র?

সে বলল, না, একদিন আমার প্রভু আপনার এখানে এসে দেখলেন দরজায় একটি শকট। ফিরে গেলেন। সে সময় থেকে তিনি আর লিখছেন না। এছাড়া তিনি শুনেছেন যে, অন্যেরা এখানে আসে। শেষের কথাটা বলল সে যেতে যেতে।

তাতে ইঝোমি খুবই অপমানিত বোধ করলেন। কোনো অহংকারের চিন্তা নেই, কোনো বস্তুগত স্বার্থ নেই, শুধু ভালোবাসা আর নেয়া যায়না, তাই বলে অন্তত বিদীর্ণ করা লজ্জাজনক অপবাদের সন্দেহ? তার দু’চোখ অশ্রুতে ভরে এলো। দুঃখ-শোকের বাষ্প যখন বের হচ্ছে ঘনঘন, তখনই প্রিন্সের একটি পত্র এলো।

ইমনের খুব ইচ্ছে হচ্ছে একবার মিচিতাকাকে দেখেন। তিনি প্রতারণা করেছেন, ইমন তো সত্যিই তাকে ভালোবেসেছেন। তার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। নিষ্পাপ সেই ভালোবাসা। তাই ভুলতে পারেন না। কর্ণফুসিয়ান স্কলার স্বামী তাকে খুব ভালো বাসেন। এখানে কোনো খাদ নেই, তবুও স্পষ্ট প্রথম প্রেমের দিকে। মাঝেমধ্যে প্রচুর কাঁদেন, ওর জন্য নয়, নিজের প্রেমের জন্য। এ কথা তো কাউকে বলাও যায় না। অনুভূতিগুলো বাষ্প হয়ে যেন উড়ে যায় নীরবে নিভৃতে।

এই অনুভূতিটা আছে বলেই মনে হয় ইমন কবিতা লিখতে পারছেন। তার কবিতা না পাওয়ার বেদনায় শিল্প হয়ে ফুটে ওঠে। এ কথা ইমন নিজেও জানেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় তার প্রেম। তারই পূজারি তিনি, মানুষটির নয়।

তাহলে তাকে দেখতে চাওয়া কেন? প্রবল দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতের মুখোমুখি হন তিনি। সমাধানটা নিজেই খুঁজে বের করেন। শিন্টু শ্রাইনে কেন দাঁড়ান? অন্তরে তো তার ছায়ামূর্তি আছেই।

তিনি হয়ত মহাযানী বৌদ্ধধর্মের অনুশীলনের মাধ্যমে ত্যাগের দীক্ষাটা নিয়ে সবকিছু ভুলে থাকতে পারতেন। কিন্তু ইমন একজন মানবী বৌদ্ধ ভিক্ষুণী (নান) নন। বাস্তব জীবনে তৃষ্ণা তার আছে; তিনি উপলব্ধি করেন তার প্রেম তার জীবনের অনেক কিছুর মধ্যে একটি অনেক কিছুর যোগফল। একে বাদ দেবেন কেমন করে। তাহলে জীবনের মিথ্যা যোগফলকে দেখাতে হবে। তা শ্রেফ আত্মপ্রবঞ্চনা।

সে মানুষটির কাছে এখন আর ইমনের কিছু চাওয়ার নেই। শুধু দেখে যাওয়া। বয়স তো কম হয়নি, কি-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে। ওর তো দেওয়ার সামর্থ্যই নেই, সামর্থ্য থাকলে ফেলে চলে যেতো না। অন্তরে তার প্রেম ছিল না, মুখে যাই থাকুক না কেন। ইমনের সুখ দেখে হয়ত সে ঈর্ষান্বিত। হৃদয়টা দেখার সামর্থ্য নেই বলে, বিশাল সম্পদ থেকে বঞ্চিত। আর তা ইমনের প্রেম। এখনো আছে। আগের মতোই নিষ্কাম, পুতপবিত্র।

এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। হয়ত দুর্ভোগ হতো। প্রেম নিয়ে টানাহেঁচড়া হতো। ইমন ভালোবেসে যাবার জন্য নিষ্ফলক হৃদয়ের এমন সমর্থন পেতেন না। এই নিভৃত প্রেমে যে কী প্রশান্তি তা শুধু ইমনই জানেন। সুখের স্মৃতি নয়, দুঃখের স্মৃতিগুলোই মধুর হয়ে কল্পনায় আছে। ক্রমশ...

back to top