আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
তেত্রিশ.
সেদিন সম্ভব না হলেও আজ সম্রাজ্ঞী শোশি মুরাসাকির কাছ থেকে চীনা ধ্রুপদী ভাষার প্রথম পাঠ গ্রহণ করলেন। ভাষাটা বেশ শক্ত। কিন্তু সম্রাজ্ঞীর আগ্রহ আরো বেশি সংকল্প বদ্ধ। সম্রাজ্ঞী আগ্রহ দেখে মুরাসাকি নিজেও উৎসাহী হয়ে উঠলেন।
তখন পর্যন্ত চীনা ভাষার প্রধান করি বাই যুয়ী। তাঁর গীতিকাগুলো বেশ বিখ্যাত। মুরাসাকি গীতিকাগুলো মুখস্ত করে রেখেছেন। চীন, জাপান এবং কোরিয়ায় এই গীতিকাগুলো খুবই জনপ্রিয়।
সম্রাজ্ঞী সে কথা জানেন। তিনি কবি বাইযুয়ী এবং তাঁর গীতিকা (ব্যালাড) সম্পর্কে জানতে চাইলেন।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, মহামান্যা অনেক ভালো সাহিত্যের খোঁজ রাখেন দেখছি।
অনেকেই জানে। সম্রাটও জানেন। তা নিয়ে সভা কবি কিন্তুর সঙ্গে কথা বলছিলেন, আমি সামনে কিছু বুঝতে পারছিলাম না শুধু কবি বাইযুয়ীর নামটাই বারবার শুনতে পেয়েছিলাম।
বাইয়ুয়ীকে বো যুয়ী এবং চুইও বলা হয়। নবম শতকের তেঙ সাম্রাজ্যে একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। সম্রাটের সদর দপ্তরে ছোট চাকরি দিয়ে শুরু করে তিনটি প্রদেশে বড় চাকরি। গীতিকাসহ কবিতাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই তাঁর চাকরি জীবন এবং সম্রাটের দরবারের পর্যবেক্ষণমূলক। এসব কবিতার জন্যও তাঁকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি, তার পদাবনতি এবং তাকে শাস্তিমূলক বদলিও হতে হয়েছে।
মুরাসাকি একথা জানেন। কথাগুলো সম্রাজ্ঞীকে বললেনও। সম্রাটের সমালোচনা, তাঁর দরবারের সমালোচনা, কোনো সম্রাটই পছন্দ করেন না। কথাটা স্মরণ করিয়ে দিলেন শোশি।
মুরাসাকি বললেন, আমি এ ব্যাপারে সচেতন আছি।
তোমার লেখা পড়ে মনে হয় তুমি বাইযুয়ীর মতোই সম্রাটের দরবার, সম্রাটের প্রাসাদ, যুবরাজ, রাজকুমারী এবং সভাষদদের নিয়ে গল্প করতে পছন্দ কর।
বাইযুয়ী থেকে বিষয় নির্বাচনের প্রেরণা আমি পেয়েছি তা ঠিক। পুরো ব্যাপারটাই কাল্পনিক।
প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করতে মুরাসাকি দ্রুতই ফিরে গেলেন বাইযুয়ীর কবিতা আলোচনায়। বললেন, ‘চাঙ হেন গে’ (চিরঞ্জীব দুঃখের গান) তার বিখ্যাত কবিকীর্তি। এটি একটি বর্ণনামূলক বড় কবিতা। এতে রয়েছে ইয়াঙ গইফেই এবং পিপা জিং এর গান। বলাইবাহুল্য এগুলো তাদের দুঃখের গান। যন্ত্রণাবিদ্ধ জীবনের কথা। বর্ণনাগুণ এবং গাল্পিক আঙ্গিকে এটি গীতিকার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শোশি বললেন, মহামান্য সম্রাট এবং সভাকবি কিন্তু মনে হয় এই নিয়েই কথা বলছিলেন।
হতে পারে। বললেন মুরাসাকি।
তুমি আমাকে ভাষা শিক্ষা দিলে আমি পড়তে পারব তো?
নিশ্চয়।
তাহলে এ নিয়ে সম্রাটের সঙ্গে আলোচনায়ও প্রবৃত্ত হাত পারব।
তা বোধ হয় ঠিক হবে না। তিনি জানতে চাইবেন, কিভাবে আপনি তা জানেন। ভাষা শিক্ষার কথা তো বলা যাবে না।
ঠিক বলেছ। আমি শুধু শুনব, কিছু বলব না।
সেই ভালো মহামান্য।
সম্রাজ্ঞী বললেন, আজ তাইলে এ পর্যন্তই।
বড় উপন্যাস লিখছেন বলে অন্য লেডিদের মতো অন্যদের দপ্তরে ঘুরে বেড়াতে, আড্ডা দিতে কিংবা অন্যদের নিয়ে মুখরোচক গল্প বলতে পারেন না মুরাসাকি। এছাড়া অন্যদের নিয়ে মুখরোচক গল্প বলা, দোষ খুঁজে বেড়ানো এসব তাঁর স্বভাবে নেই। এর যেমন ভালো দিক আছে মন্দ দিকও আছে। এতে কেউ কেউ ভাবতে বসেছেন মুরাসাকি ‘গেঞ্জি’ লিখে বিরাট কৃতিত্বের অধিকারী, তাই আত্মঅভিমানী, উদ্ধত অহংকারী, তাচ্ছিল্যভাবাপন্ন, বদমেজাজি, সান্নিধ্যের অতীত, বিশাল ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলেন, চারপাশে ভাবগাম্ভীর্যের দেয়াল তুলে রাখেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাপারগুলো যে বেশি উঠে আসে সেই শোনাগনের দপ্তর থেকে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এগুলো স্বাভাবিকভাবেই পীড়া দেয় মুরাসাকিকে। কিন্তু তিনি তা হজম করেন।
প্রত্যেক রাজপ্রাসাদ, সম্রাটের দরবার এবং প্রশাসনিক কেন্দ্রে একটা রাজকীয় পাথর চাপা ভাব থাকে। এখানেও আছে। স্বাধীন লেখক সত্তা নিয়ে কারো পক্ষে তা মানিয়ে নেয়া সহজ নয়। এখানে মুরাসাকি যেন হাফিয়ে উঠছেন। প্রাসাদ জীবনকে পছন্দ করছেন না। অথচ এখানে সম্রাজ্ঞী তাকে পছন্দই করেন না, খুবই গুরুত্ব দেন। সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগা ভাব জমাতে চান। সম্রাটের মাতা সেনশি, যিনি কেতাদুরস্ত এবং বিদগ্ধ রমনীরূপে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। তিনিও তাঁকে পছন্দ করেন এবং তাঁর দ্বার মুরাসাকির জন্য সবসময় অবারিত থাকে। লেখিকা হিসেবে সেখানে তিনি বড় সম্মানের অধিকারী।
লেডি সেনশি সম্রাটের মাতা বলে এখন সকলের দিকেই তাঁকে সমান দৃষ্টি দিতে হয়। সম্রাজ্ঞী শোশিকে পক্ষপাতিত্ব করবেন সে অবস্থা আর নেই। শোশির বাবা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার অধিকারী হলেও তাকে তিনি যে খুব একটা মূল্য দিয়ে চলেন ব্যাপারটা এমন না। তাঁর মুরাসাকিকে পছন্দ করা এবং স্নেহ ও সম্মান দেয়া গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
মুরাসাকির সম্রাটের প্রাসাদ কেন্দ্রিক লেখা নিয়ে কথা বলছিলেন সম্রাজ্ঞী শোশি। তা তার ভালো লাগেনি। প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়েও অস্বস্তিবোধ করছেন। ভাবলেন, কোথাও যাবেন।
সাইশোর ওখানে যাওয়া যায়।
সাইশো মুরাসাকিকে দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন, আত্মার একটি টান আছে। ভালো হয়েছে এসেছ, তোমার কথাই ভাবছিলাম। লেখা কতদূর এগোলো?
এগোচ্ছে। তবে মাঝে মধ্যে শঙ্কার মধ্যে পড়ে যাই জানো?
কি রকম?
একজন প্রিন্সের অনৈতিক এবং ভোগবাদী জীবন চিত্রিত করতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই মনে হয় ন্যায়ের বিরুদ্ধে সে জয়ী হয়ে যাচ্ছে।
পরাজয় তো তোমার হাতে, তাকে পরাজিত করে দাও।
সেখানেই তো সমস্যা।
বুঝলাম না।
ভালো খারাপ যিনি সৃষ্টি করেন উভয়ের প্রতিই স্রষ্টার দরদ থাকে। না হয় সৃষ্টি ভালো হয় না।
তা হলে কি সে শুধু যৌন অপরাধ করেই যাবে?
কেউ কেউ তো করেই যাচ্ছে।
সাইশো ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। বললেন, এর সাজাও এরা ভোগ করছে।
কীভাবে?
আদালত বা সম্রাটের দরবারে তাদের শাস্তি হচ্ছে না বটে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এটা কি সাজা নয়?
কী হয়েছে ওর?
ইঝোমির কথা বলছ?
তা-ই মনে হয় বললে তুমি।
সে ভালো নেই। মনে হয় প্রিন্সের সঙ্গে ভালো যাচ্ছে না। এছাড়া প্রচুর দুর্নাম হয়ে গেছে।
খুব কষ্ট হয়। একসঙ্গে বড় হয়েছি টেরামাচি লেনে।
ও ঠিকই সব মানিয়ে নেবে।
তাই যেন হয়।
তোমার সঙ্গে সম্রাজ্ঞী সম্রাটের মাতা সেনশি এবং মিচিনাগার চমৎকার সম্পর্ক, ভালো একটা পদ বাগিয়ে নাও। আমি তোমার জায়গায় থাকলে সরাসরি সম্রাটের দরবারে গিয়ে বসতাম।
সাইশোর কথা শুনে মুরাসাকি হাসলেন। বললেন, হাসালে তুমি।
এতে, হাসির কী হলো? এখানে এই-ই তো হচ্ছে। তুমি সম্রাটের দরবারে যেতে চাও না?
সম্রাটের দরবারে ভালো পদের অধিকারী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি উচ্চ পদের জন্য তদ্বির করব না।
প্রয়োজন আছে তাকাকু। উচ্চপদের জন্য ফুজিওয়ারারা কত তৎপর, তা তোমার না জানার কথা নয়।
না জানব কেন? তবুও গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যেতে মন চায় না। এখানেই যে রাজকীয় পাথরচাপা অবস্থা, সম্রাটের দরবার আরও নিশ্চয়ই ভারী।
সে ভার বহনের ক্ষমতা তোমার আছে।
কিন্তু কি জানো আমি উপলব্ধি করি অতীতে আমার পরিবারের লোকজন ছিলেন বিনয়ী এবং ভদ্র। এ ব্যাপারটাই আমাকে ভোগায়। সম্রাট তো সে কথা মনে করেন না। থাক এসব। খুব ভালো আছি।
মান-অভিমানের জায়গা এটা নয়।
চৌত্রিশ.
সেই শোনাগন সে তুলনায় অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী। দ্বিতীয় বিয়ে করার উদ্দেশ্যও তাই-সে কথা আগেই জেনেছি। কিন্তু প্রথমেই একটা হোঁচট খেয়ে ফেললেন। স্বামী প্রদেশে বদলি হয়ে যাওয়ায় ক্ষমতার রজ্জু ছিঁড়ে গেল। তবে আশা ছাড়েননি। ওপরের মহলে যোগাযোগ রাখছেন যাতে আবার তার স্বামী রাজধানী হেইয়ান কিয়োতে ফিরে আসেন।
তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। লেখায় এবং জনপ্রিয়তায় মুরাসাকি তাকে ছাড়িয়ে গেছেন। ইমন এবং ইঝোমিকে টেক্কা দিতে পারলেও মুরাসাকিকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দিন দিন তার নামের সুনামের প্রসার ঘটছে। শুধু তাই না। সম্রাটের দরবার এবং প্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তার কদর করছেন। সেই শোনাগন কি হারিয়ে যাবেন?
রাতে সম্রাটের দরবারে প্রায়ই ভোজানুষ্ঠান হয়। সম্রাজ্ঞীদের সঙ্গে লেডিরা উপস্থিত থাকেন। এসব অনুষ্ঠানে নাচ-গানের আয়োজন থাকে। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু থাকে অতিরিক্ত মদ্যপান করে প্রিন্সদের মাতলামি এবং অবভ্য আচরণ। প্রথম এ রকম অনুষ্ঠানে এসে মুরাসাকি যা দেখলেন তাতে তার সম্ভ্রম নিয়েই শঙ্কা হলো। এ রকমটা তার ভারী অপছন্দ। অথচ সেই শোনাগনরা আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করছেন, যুবরাজ বা প্রিন্সদের সঙ্গে মদ্যপানে আসর জমাচ্ছেন। তিনি একা না আরো অনেকে। অনেক রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলতে থাকে। প্রিন্সদের খুশি করার জন্য তারা সবই করেন। কারণ এই যুবরাজেরাই তাদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি। সঙ্গীদের টপকে যাবার সহায়।
সম্রাজ্ঞী, সম্রাট এবং বড় বড় লেডিরা তা দেখেও না দেখার ভান করেন। কিচ্ছুটি বলেন না। এরা প্রিন্সদের খেপাতে চান না, কারণ এটা সম্রাটের ক্ষমতা সংহত বা ব্যর্থ করে দিতে পারে। এছাড়া তা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন সবাই। এসবকে অনুষ্ঠানের অংশ বলেই মনে করেন।
এসব দেখে মুরাসাকির মনে হতে থাকে রাজপ্রাসাদের কোলাহল, বেহায়াপনা, ষড়যন্ত্র এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাতে মধ্যে তিনি বেমানান। অথচ অন্য পক্ষটি এসব শুধু উপভোগই করছে না, এসবের মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্ববান করে তুলছে।
অনুষ্ঠানে ইমনও থাকেন। তার অবস্থান স্বচ্ছ। প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগার পরিবারের সঙ্গে যার সম্পর্ক তাকে কেউ ঘাটাতে আসে না। যুবরাজরাও হিসাব করে চলেন। মুরাসাকি তা লক্ষ করেছেন।
পরদিন ইমনের দপ্তরে উপস্থিত হলেন। ইমন ইতিহাস লেখার কাজ করছেন। সময় দিয়েছেন সেদিকেই বেশি। ইমন বললেন, গত রাতের অনুষ্ঠানে তোমাকে নিষ্প্রভ মনে হয়েছে।
ঠিক বলেছেন। প্রিন্সদের আচরণ এবং ওদের বেহায়াপনা আমার ভালো লাগেনি। লেডিদের সঙ্গে যেসব কথা বলেছেন, মাতলামি করে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তা শিষ্টতাবর্জিত। আমার ভয় হচ্ছিল কখন আবার আমার সঙ্গে এসব করে।
প্রথম প্রথম এ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়, পরে সব ঠিক হয়ে যায়।
আমি এসবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব না।
তা হলে সমস্যায় পড়তে হবে।
আপনি কি সমস্যায় পড়েছেন?
ওরা জানে আমার ওপর মিচিনাগা পরিবারের ছায়া আছে। ঠিক আছে দেখি, তোমার জন্য কী করা যায়।
যা করবেন আগামী অনুষ্ঠানের আগেই করবেন।
আচ্ছা, আচ্ছা। জানো, মাসাহিরার সঙ্গে ওয়ারি প্রদেশে গিয়েছিলাম।
কেমন সে জায়গাটা?
ভালো লাগার মতো। আমি বেশ কবার গেছি। ও দুবার গেছে চাকরি করার জন্য।
আমার ইচিঝেনের কথা খুব মনে হয়। চমৎকার ছিল সে দিনগুলো।
ইঝোমির কাছে আমি ইচিঝেন প্রদেশ সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি।
সেখানে একটি কাগজ তৈরির গ্রাম আছে। ঐ গ্রামের লোকজন ভাবলো আমি তাদের ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়া সেই রাজকন্যা, যে কিনা তাদের কাগজ বানানোর কৌশল বাতলে দিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে।
চমৎকার তো। ইঝোমি তা বলেনি।
চমৎকারই বলতে হবে। বলে মুরাসাকি গম্ভীর হয়ে গেলেন।
তা ইমনের দৃষ্টি এড়ালো না। বললেন, কোনো সমস্যা হয়েছিল?
না। ভাগ্যের একটা পরিহাস আমার সঙ্গে তামাসা করেছিল।
ইমন অবাক হয়ে বললেন, কী রকম?
মুরাসাকি রাজকীয় ফুল ক্রাইসানথ্যমম, কাগজ দেবতার কামু শ্রাইন, ফুলবাগানের মালিকাসহ সকল ঘটনা বর্ণনা করলেন। শেষে বললেন, দেবতারা কি জানতেন না যে, আমি অকালে বৈধব্যরবণ করব?
মন খারাপ করো না, যা হবার তা হয়ে গেছে। তবে অবাক লাগছে একটি বিশ্বাস একটি অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। তার পরিণামের জন্য ওরা কেউ দায়ী নয়, না ফুল বাগানের মালিকা, না দেবতার শ্রাইন।
সবই ভাগ্য।
তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত তার চেয়ে খারাপ কিছু হতো।
কী জানি। বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন মুরাসাকি। পরে বললেন, কথাটা আমি আর কাউকে বলিনি।
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান
আমিও বলব না। গেঞ্জিতে ইচিঝেনের অন্যসব বর্ণনা পরে অভিভূত হয়েছি।
সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভোলা যায় না।
যা শুনিয়েছ, সেখানকার কথা জীবনের ভুলবে না।
বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎই সেই শোনাগন সেখানে উপস্থিত হলেন। এরা দুজন চমকে উঠলেন। সেই শোনাগন বললেন, চমকে দেয়ার জন্যই এলাম।
তাঁর মুখে আর সেই গাম্ভীর্য নেই, তবে নিজেকে আর সবার চেয়ে উচ্চে তুলে ধরার প্রয়াস আছে ভাবভঙ্গিতে। ইমন বললেন, দুই বিখ্যাত লেখিকাকে একসঙ্গে পেয়ে আমি উচ্ছ্বসিত।
এ কথায় শোনাগনের খোলামেলা ভাবটা উবে গেল। তিনি যেন সংযত আচরণ করতে শুরু কলেন। তিনি মুরাসাকিকে তার সমপর্যায়ের ভাবতেই পারেন না। তার বিশ্বাস ‘দ্য পিলুবুক’ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য।
ইমন এসব জানেন। পরিবর্তনটাও বুঝতে পারেন। পরিবেশকে সহজ করার ক্ষমতাও রাখেন। বললেন, তোমার লেখার ব্যাপারে কথা হচ্ছিল। উপস্থিত সবাই একবাক্যে বলল, শোনাগন সাহসী লেখিকা, অবাক ব্যাপার হচ্ছে তার অভিনব আঙ্গিক ভাবনা। আমরা যে ডায়েরি লিখি তোমারটা সে রকম না। ব্যক্তিগত কথা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, প্রাসাদের কথা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কথা অবলীলায় হাস্যরসাত্মক ভাষায় বলে যেতে পার।’
বই বা লেখা নিয়ে আলোচনা থাক না আদা। বলরেন শোনাগন।
মুরাসাকি বললেন, কেন আলোচনা হবে না। লেখকের প্রাপ্য প্রশংসা তাকে দিতে হবে।
ইমন যোগ করলেন, আমরা যারা লেখালেখি করি আমরা যদি একে অন্যের লেখার মূল্যায়ন না করি তাহলে যারা লেখা বোঝে না, না বুঝে প্রশংসা করে, এদের মূল্যহীন প্রশংসাই গ্রহণ করতে হবে। তাতে কোনো আনন্দ নেই।
তাকাকুর লেখা কেমন চলছে?
তাকাকু ভালোই তো লিখে যাচ্ছে। তোমরা দুজন কবিতা লিখলেও গদ্যে দুই মেরুর লেখক। একজন লিখছ মনোগাতারি, আরেকজন প্রাণময় ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতার কথা। আমার মনে হয় দুজনই কালকে অতিক্রম করে যাবে।
মুরাসাকি বললেন, সমকালের খেয়ায় উঠতে না পারলে কালকে অতিক্রম করে যাব কি করে?
প্রসঙ্গটাকে এড়িয়ে যেতে শোনাগন বললেন, আপা, কনফুসিয়ান স্কলারের খবর কি?
আছে, ভালো আছে। আমি তার পা-িত্যের কিছুই বুঝি না। তবে সে চমৎকার মানুষ।
আমারও তা মনে হয়। আপনার ভাগ্য ভালো। আমি তো ‘ভালোবেসে যাকে ছুই সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে’।
মুরাসাকি এনিয়ে কোনো মন্তব্য করলেন না। অর্থপূর্ণভাবে শুধু ইমনের দিকে তাকলেন।
ইমন বললেন, ক’দিন আগে ওয়ারি গিয়েছিলাম, যা মজা হয়েছে না। কনফুসিয়ান স্কলার কাজকর্ম বাদ দিয়ে সারাটা সময় আমাকে নিয়েই ঘুরলেন।
শোনাগনের মনে হলো তিনিও গিয়েছিলেন স্বামীর কাছে। তাকে বিয়ে করে স্বামী যেন রাজসিংহাসন হারিয়েছেন, এ রকম আচরণই করলেন। ভাগ্যকে দুষলেন তিনি।
মুরাসাকি বললেন, শোনাগনও নিশ্চয়ই গভর্নর সাহেবের নতুন কর্মস্থলে মধুচন্দ্রিমা উদযাপন করে এসেছেন।
শোনাগন এ কথার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ইমনকে বললেন, আপনার সঙ্গে কথা ছিল।
বেশ তো এসো। এরা অন্য কক্ষে গেলেন।
শোনাগন বললেন, প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগা এবং তার পরিবারের সঙ্গে আপনার ভালো সম্পর্ক। গভর্নরকে আবার দরবারে এনে দিন না। বেচারা সেখানে হাঁফিয়ে উঠেছে।
আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব। তুমি নিশ্চিত থাকো।
মুরাসাকিকে কিছু না বলে শোনাগন সেখান থেকেই বিদায় নিলেন। সৌজন্যটুকুও দেখালেন না।
ইমন ফিরে এসে বললেন, তদ্বির। তদ্বির করতে এসেছিল সে। স্বামীকে যেন প্রাসাদে আবার এনে দিই প্রধানমন্ত্রীকে বলে।
বেশ তো। এনে দিন।
তা কি সম্ভব?
চেষ্টা করতে সমস্যা কোথায়?
তুমি বলছ?
কেন?
তোমাকে সে সহ্যই করতে পারে না।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, আমি তো তাকে সহ্য করে চলেছি। সম্মানও করি। ক্রমশ...
আবুল কাসেম
সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১
(পূর্ব প্রকাশের পর)
তেত্রিশ.
সেদিন সম্ভব না হলেও আজ সম্রাজ্ঞী শোশি মুরাসাকির কাছ থেকে চীনা ধ্রুপদী ভাষার প্রথম পাঠ গ্রহণ করলেন। ভাষাটা বেশ শক্ত। কিন্তু সম্রাজ্ঞীর আগ্রহ আরো বেশি সংকল্প বদ্ধ। সম্রাজ্ঞী আগ্রহ দেখে মুরাসাকি নিজেও উৎসাহী হয়ে উঠলেন।
তখন পর্যন্ত চীনা ভাষার প্রধান করি বাই যুয়ী। তাঁর গীতিকাগুলো বেশ বিখ্যাত। মুরাসাকি গীতিকাগুলো মুখস্ত করে রেখেছেন। চীন, জাপান এবং কোরিয়ায় এই গীতিকাগুলো খুবই জনপ্রিয়।
সম্রাজ্ঞী সে কথা জানেন। তিনি কবি বাইযুয়ী এবং তাঁর গীতিকা (ব্যালাড) সম্পর্কে জানতে চাইলেন।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, মহামান্যা অনেক ভালো সাহিত্যের খোঁজ রাখেন দেখছি।
অনেকেই জানে। সম্রাটও জানেন। তা নিয়ে সভা কবি কিন্তুর সঙ্গে কথা বলছিলেন, আমি সামনে কিছু বুঝতে পারছিলাম না শুধু কবি বাইযুয়ীর নামটাই বারবার শুনতে পেয়েছিলাম।
বাইয়ুয়ীকে বো যুয়ী এবং চুইও বলা হয়। নবম শতকের তেঙ সাম্রাজ্যে একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। সম্রাটের সদর দপ্তরে ছোট চাকরি দিয়ে শুরু করে তিনটি প্রদেশে বড় চাকরি। গীতিকাসহ কবিতাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই তাঁর চাকরি জীবন এবং সম্রাটের দরবারের পর্যবেক্ষণমূলক। এসব কবিতার জন্যও তাঁকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি, তার পদাবনতি এবং তাকে শাস্তিমূলক বদলিও হতে হয়েছে।
মুরাসাকি একথা জানেন। কথাগুলো সম্রাজ্ঞীকে বললেনও। সম্রাটের সমালোচনা, তাঁর দরবারের সমালোচনা, কোনো সম্রাটই পছন্দ করেন না। কথাটা স্মরণ করিয়ে দিলেন শোশি।
মুরাসাকি বললেন, আমি এ ব্যাপারে সচেতন আছি।
তোমার লেখা পড়ে মনে হয় তুমি বাইযুয়ীর মতোই সম্রাটের দরবার, সম্রাটের প্রাসাদ, যুবরাজ, রাজকুমারী এবং সভাষদদের নিয়ে গল্প করতে পছন্দ কর।
বাইযুয়ী থেকে বিষয় নির্বাচনের প্রেরণা আমি পেয়েছি তা ঠিক। পুরো ব্যাপারটাই কাল্পনিক।
প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করতে মুরাসাকি দ্রুতই ফিরে গেলেন বাইযুয়ীর কবিতা আলোচনায়। বললেন, ‘চাঙ হেন গে’ (চিরঞ্জীব দুঃখের গান) তার বিখ্যাত কবিকীর্তি। এটি একটি বর্ণনামূলক বড় কবিতা। এতে রয়েছে ইয়াঙ গইফেই এবং পিপা জিং এর গান। বলাইবাহুল্য এগুলো তাদের দুঃখের গান। যন্ত্রণাবিদ্ধ জীবনের কথা। বর্ণনাগুণ এবং গাল্পিক আঙ্গিকে এটি গীতিকার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শোশি বললেন, মহামান্য সম্রাট এবং সভাকবি কিন্তু মনে হয় এই নিয়েই কথা বলছিলেন।
হতে পারে। বললেন মুরাসাকি।
তুমি আমাকে ভাষা শিক্ষা দিলে আমি পড়তে পারব তো?
নিশ্চয়।
তাহলে এ নিয়ে সম্রাটের সঙ্গে আলোচনায়ও প্রবৃত্ত হাত পারব।
তা বোধ হয় ঠিক হবে না। তিনি জানতে চাইবেন, কিভাবে আপনি তা জানেন। ভাষা শিক্ষার কথা তো বলা যাবে না।
ঠিক বলেছ। আমি শুধু শুনব, কিছু বলব না।
সেই ভালো মহামান্য।
সম্রাজ্ঞী বললেন, আজ তাইলে এ পর্যন্তই।
বড় উপন্যাস লিখছেন বলে অন্য লেডিদের মতো অন্যদের দপ্তরে ঘুরে বেড়াতে, আড্ডা দিতে কিংবা অন্যদের নিয়ে মুখরোচক গল্প বলতে পারেন না মুরাসাকি। এছাড়া অন্যদের নিয়ে মুখরোচক গল্প বলা, দোষ খুঁজে বেড়ানো এসব তাঁর স্বভাবে নেই। এর যেমন ভালো দিক আছে মন্দ দিকও আছে। এতে কেউ কেউ ভাবতে বসেছেন মুরাসাকি ‘গেঞ্জি’ লিখে বিরাট কৃতিত্বের অধিকারী, তাই আত্মঅভিমানী, উদ্ধত অহংকারী, তাচ্ছিল্যভাবাপন্ন, বদমেজাজি, সান্নিধ্যের অতীত, বিশাল ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলেন, চারপাশে ভাবগাম্ভীর্যের দেয়াল তুলে রাখেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাপারগুলো যে বেশি উঠে আসে সেই শোনাগনের দপ্তর থেকে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এগুলো স্বাভাবিকভাবেই পীড়া দেয় মুরাসাকিকে। কিন্তু তিনি তা হজম করেন।
প্রত্যেক রাজপ্রাসাদ, সম্রাটের দরবার এবং প্রশাসনিক কেন্দ্রে একটা রাজকীয় পাথর চাপা ভাব থাকে। এখানেও আছে। স্বাধীন লেখক সত্তা নিয়ে কারো পক্ষে তা মানিয়ে নেয়া সহজ নয়। এখানে মুরাসাকি যেন হাফিয়ে উঠছেন। প্রাসাদ জীবনকে পছন্দ করছেন না। অথচ এখানে সম্রাজ্ঞী তাকে পছন্দই করেন না, খুবই গুরুত্ব দেন। সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগা ভাব জমাতে চান। সম্রাটের মাতা সেনশি, যিনি কেতাদুরস্ত এবং বিদগ্ধ রমনীরূপে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। তিনিও তাঁকে পছন্দ করেন এবং তাঁর দ্বার মুরাসাকির জন্য সবসময় অবারিত থাকে। লেখিকা হিসেবে সেখানে তিনি বড় সম্মানের অধিকারী।
লেডি সেনশি সম্রাটের মাতা বলে এখন সকলের দিকেই তাঁকে সমান দৃষ্টি দিতে হয়। সম্রাজ্ঞী শোশিকে পক্ষপাতিত্ব করবেন সে অবস্থা আর নেই। শোশির বাবা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার অধিকারী হলেও তাকে তিনি যে খুব একটা মূল্য দিয়ে চলেন ব্যাপারটা এমন না। তাঁর মুরাসাকিকে পছন্দ করা এবং স্নেহ ও সম্মান দেয়া গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
মুরাসাকির সম্রাটের প্রাসাদ কেন্দ্রিক লেখা নিয়ে কথা বলছিলেন সম্রাজ্ঞী শোশি। তা তার ভালো লাগেনি। প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়েও অস্বস্তিবোধ করছেন। ভাবলেন, কোথাও যাবেন।
সাইশোর ওখানে যাওয়া যায়।
সাইশো মুরাসাকিকে দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন, আত্মার একটি টান আছে। ভালো হয়েছে এসেছ, তোমার কথাই ভাবছিলাম। লেখা কতদূর এগোলো?
এগোচ্ছে। তবে মাঝে মধ্যে শঙ্কার মধ্যে পড়ে যাই জানো?
কি রকম?
একজন প্রিন্সের অনৈতিক এবং ভোগবাদী জীবন চিত্রিত করতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই মনে হয় ন্যায়ের বিরুদ্ধে সে জয়ী হয়ে যাচ্ছে।
পরাজয় তো তোমার হাতে, তাকে পরাজিত করে দাও।
সেখানেই তো সমস্যা।
বুঝলাম না।
ভালো খারাপ যিনি সৃষ্টি করেন উভয়ের প্রতিই স্রষ্টার দরদ থাকে। না হয় সৃষ্টি ভালো হয় না।
তা হলে কি সে শুধু যৌন অপরাধ করেই যাবে?
কেউ কেউ তো করেই যাচ্ছে।
সাইশো ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। বললেন, এর সাজাও এরা ভোগ করছে।
কীভাবে?
আদালত বা সম্রাটের দরবারে তাদের শাস্তি হচ্ছে না বটে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এটা কি সাজা নয়?
কী হয়েছে ওর?
ইঝোমির কথা বলছ?
তা-ই মনে হয় বললে তুমি।
সে ভালো নেই। মনে হয় প্রিন্সের সঙ্গে ভালো যাচ্ছে না। এছাড়া প্রচুর দুর্নাম হয়ে গেছে।
খুব কষ্ট হয়। একসঙ্গে বড় হয়েছি টেরামাচি লেনে।
ও ঠিকই সব মানিয়ে নেবে।
তাই যেন হয়।
তোমার সঙ্গে সম্রাজ্ঞী সম্রাটের মাতা সেনশি এবং মিচিনাগার চমৎকার সম্পর্ক, ভালো একটা পদ বাগিয়ে নাও। আমি তোমার জায়গায় থাকলে সরাসরি সম্রাটের দরবারে গিয়ে বসতাম।
সাইশোর কথা শুনে মুরাসাকি হাসলেন। বললেন, হাসালে তুমি।
এতে, হাসির কী হলো? এখানে এই-ই তো হচ্ছে। তুমি সম্রাটের দরবারে যেতে চাও না?
সম্রাটের দরবারে ভালো পদের অধিকারী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি উচ্চ পদের জন্য তদ্বির করব না।
প্রয়োজন আছে তাকাকু। উচ্চপদের জন্য ফুজিওয়ারারা কত তৎপর, তা তোমার না জানার কথা নয়।
না জানব কেন? তবুও গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যেতে মন চায় না। এখানেই যে রাজকীয় পাথরচাপা অবস্থা, সম্রাটের দরবার আরও নিশ্চয়ই ভারী।
সে ভার বহনের ক্ষমতা তোমার আছে।
কিন্তু কি জানো আমি উপলব্ধি করি অতীতে আমার পরিবারের লোকজন ছিলেন বিনয়ী এবং ভদ্র। এ ব্যাপারটাই আমাকে ভোগায়। সম্রাট তো সে কথা মনে করেন না। থাক এসব। খুব ভালো আছি।
মান-অভিমানের জায়গা এটা নয়।
চৌত্রিশ.
সেই শোনাগন সে তুলনায় অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী। দ্বিতীয় বিয়ে করার উদ্দেশ্যও তাই-সে কথা আগেই জেনেছি। কিন্তু প্রথমেই একটা হোঁচট খেয়ে ফেললেন। স্বামী প্রদেশে বদলি হয়ে যাওয়ায় ক্ষমতার রজ্জু ছিঁড়ে গেল। তবে আশা ছাড়েননি। ওপরের মহলে যোগাযোগ রাখছেন যাতে আবার তার স্বামী রাজধানী হেইয়ান কিয়োতে ফিরে আসেন।
তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। লেখায় এবং জনপ্রিয়তায় মুরাসাকি তাকে ছাড়িয়ে গেছেন। ইমন এবং ইঝোমিকে টেক্কা দিতে পারলেও মুরাসাকিকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দিন দিন তার নামের সুনামের প্রসার ঘটছে। শুধু তাই না। সম্রাটের দরবার এবং প্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তার কদর করছেন। সেই শোনাগন কি হারিয়ে যাবেন?
রাতে সম্রাটের দরবারে প্রায়ই ভোজানুষ্ঠান হয়। সম্রাজ্ঞীদের সঙ্গে লেডিরা উপস্থিত থাকেন। এসব অনুষ্ঠানে নাচ-গানের আয়োজন থাকে। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু থাকে অতিরিক্ত মদ্যপান করে প্রিন্সদের মাতলামি এবং অবভ্য আচরণ। প্রথম এ রকম অনুষ্ঠানে এসে মুরাসাকি যা দেখলেন তাতে তার সম্ভ্রম নিয়েই শঙ্কা হলো। এ রকমটা তার ভারী অপছন্দ। অথচ সেই শোনাগনরা আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করছেন, যুবরাজ বা প্রিন্সদের সঙ্গে মদ্যপানে আসর জমাচ্ছেন। তিনি একা না আরো অনেকে। অনেক রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলতে থাকে। প্রিন্সদের খুশি করার জন্য তারা সবই করেন। কারণ এই যুবরাজেরাই তাদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি। সঙ্গীদের টপকে যাবার সহায়।
সম্রাজ্ঞী, সম্রাট এবং বড় বড় লেডিরা তা দেখেও না দেখার ভান করেন। কিচ্ছুটি বলেন না। এরা প্রিন্সদের খেপাতে চান না, কারণ এটা সম্রাটের ক্ষমতা সংহত বা ব্যর্থ করে দিতে পারে। এছাড়া তা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন সবাই। এসবকে অনুষ্ঠানের অংশ বলেই মনে করেন।
এসব দেখে মুরাসাকির মনে হতে থাকে রাজপ্রাসাদের কোলাহল, বেহায়াপনা, ষড়যন্ত্র এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাতে মধ্যে তিনি বেমানান। অথচ অন্য পক্ষটি এসব শুধু উপভোগই করছে না, এসবের মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্ববান করে তুলছে।
অনুষ্ঠানে ইমনও থাকেন। তার অবস্থান স্বচ্ছ। প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগার পরিবারের সঙ্গে যার সম্পর্ক তাকে কেউ ঘাটাতে আসে না। যুবরাজরাও হিসাব করে চলেন। মুরাসাকি তা লক্ষ করেছেন।
পরদিন ইমনের দপ্তরে উপস্থিত হলেন। ইমন ইতিহাস লেখার কাজ করছেন। সময় দিয়েছেন সেদিকেই বেশি। ইমন বললেন, গত রাতের অনুষ্ঠানে তোমাকে নিষ্প্রভ মনে হয়েছে।
ঠিক বলেছেন। প্রিন্সদের আচরণ এবং ওদের বেহায়াপনা আমার ভালো লাগেনি। লেডিদের সঙ্গে যেসব কথা বলেছেন, মাতলামি করে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তা শিষ্টতাবর্জিত। আমার ভয় হচ্ছিল কখন আবার আমার সঙ্গে এসব করে।
প্রথম প্রথম এ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়, পরে সব ঠিক হয়ে যায়।
আমি এসবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব না।
তা হলে সমস্যায় পড়তে হবে।
আপনি কি সমস্যায় পড়েছেন?
ওরা জানে আমার ওপর মিচিনাগা পরিবারের ছায়া আছে। ঠিক আছে দেখি, তোমার জন্য কী করা যায়।
যা করবেন আগামী অনুষ্ঠানের আগেই করবেন।
আচ্ছা, আচ্ছা। জানো, মাসাহিরার সঙ্গে ওয়ারি প্রদেশে গিয়েছিলাম।
কেমন সে জায়গাটা?
ভালো লাগার মতো। আমি বেশ কবার গেছি। ও দুবার গেছে চাকরি করার জন্য।
আমার ইচিঝেনের কথা খুব মনে হয়। চমৎকার ছিল সে দিনগুলো।
ইঝোমির কাছে আমি ইচিঝেন প্রদেশ সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি।
সেখানে একটি কাগজ তৈরির গ্রাম আছে। ঐ গ্রামের লোকজন ভাবলো আমি তাদের ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়া সেই রাজকন্যা, যে কিনা তাদের কাগজ বানানোর কৌশল বাতলে দিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে।
চমৎকার তো। ইঝোমি তা বলেনি।
চমৎকারই বলতে হবে। বলে মুরাসাকি গম্ভীর হয়ে গেলেন।
তা ইমনের দৃষ্টি এড়ালো না। বললেন, কোনো সমস্যা হয়েছিল?
না। ভাগ্যের একটা পরিহাস আমার সঙ্গে তামাসা করেছিল।
ইমন অবাক হয়ে বললেন, কী রকম?
মুরাসাকি রাজকীয় ফুল ক্রাইসানথ্যমম, কাগজ দেবতার কামু শ্রাইন, ফুলবাগানের মালিকাসহ সকল ঘটনা বর্ণনা করলেন। শেষে বললেন, দেবতারা কি জানতেন না যে, আমি অকালে বৈধব্যরবণ করব?
মন খারাপ করো না, যা হবার তা হয়ে গেছে। তবে অবাক লাগছে একটি বিশ্বাস একটি অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। তার পরিণামের জন্য ওরা কেউ দায়ী নয়, না ফুল বাগানের মালিকা, না দেবতার শ্রাইন।
সবই ভাগ্য।
তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত তার চেয়ে খারাপ কিছু হতো।
কী জানি। বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন মুরাসাকি। পরে বললেন, কথাটা আমি আর কাউকে বলিনি।
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান
আমিও বলব না। গেঞ্জিতে ইচিঝেনের অন্যসব বর্ণনা পরে অভিভূত হয়েছি।
সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভোলা যায় না।
যা শুনিয়েছ, সেখানকার কথা জীবনের ভুলবে না।
বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎই সেই শোনাগন সেখানে উপস্থিত হলেন। এরা দুজন চমকে উঠলেন। সেই শোনাগন বললেন, চমকে দেয়ার জন্যই এলাম।
তাঁর মুখে আর সেই গাম্ভীর্য নেই, তবে নিজেকে আর সবার চেয়ে উচ্চে তুলে ধরার প্রয়াস আছে ভাবভঙ্গিতে। ইমন বললেন, দুই বিখ্যাত লেখিকাকে একসঙ্গে পেয়ে আমি উচ্ছ্বসিত।
এ কথায় শোনাগনের খোলামেলা ভাবটা উবে গেল। তিনি যেন সংযত আচরণ করতে শুরু কলেন। তিনি মুরাসাকিকে তার সমপর্যায়ের ভাবতেই পারেন না। তার বিশ্বাস ‘দ্য পিলুবুক’ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য।
ইমন এসব জানেন। পরিবর্তনটাও বুঝতে পারেন। পরিবেশকে সহজ করার ক্ষমতাও রাখেন। বললেন, তোমার লেখার ব্যাপারে কথা হচ্ছিল। উপস্থিত সবাই একবাক্যে বলল, শোনাগন সাহসী লেখিকা, অবাক ব্যাপার হচ্ছে তার অভিনব আঙ্গিক ভাবনা। আমরা যে ডায়েরি লিখি তোমারটা সে রকম না। ব্যক্তিগত কথা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, প্রাসাদের কথা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কথা অবলীলায় হাস্যরসাত্মক ভাষায় বলে যেতে পার।’
বই বা লেখা নিয়ে আলোচনা থাক না আদা। বলরেন শোনাগন।
মুরাসাকি বললেন, কেন আলোচনা হবে না। লেখকের প্রাপ্য প্রশংসা তাকে দিতে হবে।
ইমন যোগ করলেন, আমরা যারা লেখালেখি করি আমরা যদি একে অন্যের লেখার মূল্যায়ন না করি তাহলে যারা লেখা বোঝে না, না বুঝে প্রশংসা করে, এদের মূল্যহীন প্রশংসাই গ্রহণ করতে হবে। তাতে কোনো আনন্দ নেই।
তাকাকুর লেখা কেমন চলছে?
তাকাকু ভালোই তো লিখে যাচ্ছে। তোমরা দুজন কবিতা লিখলেও গদ্যে দুই মেরুর লেখক। একজন লিখছ মনোগাতারি, আরেকজন প্রাণময় ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতার কথা। আমার মনে হয় দুজনই কালকে অতিক্রম করে যাবে।
মুরাসাকি বললেন, সমকালের খেয়ায় উঠতে না পারলে কালকে অতিক্রম করে যাব কি করে?
প্রসঙ্গটাকে এড়িয়ে যেতে শোনাগন বললেন, আপা, কনফুসিয়ান স্কলারের খবর কি?
আছে, ভালো আছে। আমি তার পা-িত্যের কিছুই বুঝি না। তবে সে চমৎকার মানুষ।
আমারও তা মনে হয়। আপনার ভাগ্য ভালো। আমি তো ‘ভালোবেসে যাকে ছুই সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে’।
মুরাসাকি এনিয়ে কোনো মন্তব্য করলেন না। অর্থপূর্ণভাবে শুধু ইমনের দিকে তাকলেন।
ইমন বললেন, ক’দিন আগে ওয়ারি গিয়েছিলাম, যা মজা হয়েছে না। কনফুসিয়ান স্কলার কাজকর্ম বাদ দিয়ে সারাটা সময় আমাকে নিয়েই ঘুরলেন।
শোনাগনের মনে হলো তিনিও গিয়েছিলেন স্বামীর কাছে। তাকে বিয়ে করে স্বামী যেন রাজসিংহাসন হারিয়েছেন, এ রকম আচরণই করলেন। ভাগ্যকে দুষলেন তিনি।
মুরাসাকি বললেন, শোনাগনও নিশ্চয়ই গভর্নর সাহেবের নতুন কর্মস্থলে মধুচন্দ্রিমা উদযাপন করে এসেছেন।
শোনাগন এ কথার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ইমনকে বললেন, আপনার সঙ্গে কথা ছিল।
বেশ তো এসো। এরা অন্য কক্ষে গেলেন।
শোনাগন বললেন, প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগা এবং তার পরিবারের সঙ্গে আপনার ভালো সম্পর্ক। গভর্নরকে আবার দরবারে এনে দিন না। বেচারা সেখানে হাঁফিয়ে উঠেছে।
আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব। তুমি নিশ্চিত থাকো।
মুরাসাকিকে কিছু না বলে শোনাগন সেখান থেকেই বিদায় নিলেন। সৌজন্যটুকুও দেখালেন না।
ইমন ফিরে এসে বললেন, তদ্বির। তদ্বির করতে এসেছিল সে। স্বামীকে যেন প্রাসাদে আবার এনে দিই প্রধানমন্ত্রীকে বলে।
বেশ তো। এনে দিন।
তা কি সম্ভব?
চেষ্টা করতে সমস্যা কোথায়?
তুমি বলছ?
কেন?
তোমাকে সে সহ্যই করতে পারে না।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, আমি তো তাকে সহ্য করে চলেছি। সম্মানও করি। ক্রমশ...