আহাম্মেদ কবীর
[বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের কয়েকজন বিশিষ্ট কবির কবিতার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ রয়েছে এ প্রবন্ধে]
কবিতা সত্যের মতো সুন্দরম, সুন্দরের সঞ্চয়িতা, কবিতা সঞ্চিতা-মন রূপসী বাংলার পথ ধরে হেঁটে চলা নকশী কাঁথার রূপে আঁকা বাঙালির স্বাধীনতা তুমি। তাই কবি বলে মন-মননে কবিতা সুন্দরের রথে চড়া অনন্তের নভোযান, গতিতে স্বপ্নের মতো, রীতিতে স্মৃতির জ্বর, বিলাসিতা বালখিল্য, উপমার জানালাতে উড়ে চলা বলাকার গতিতে অঙ্কিতা এক বঙ্গ জনপথ, এ ব-দ্বীপ ভূমি, অসীম অশ্বত্থ। তাই কবিতার পথে পথে বাঙালির ইচ্ছে আর স্মৃতিসিক্ত ব্যথা-বেদনার, আনন্দের ভুবন-ডাঙায় হাঁটে কবি, হাঁটে কাব্য, হাঁটে উচ্চারণ
আকাক্সক্ষা বৈধতা সুন্দরের পথে কবিতারা ছুটে
কবিতা কুমারী দেহে ভাস্করের আঁকা ষড়ঋতু
ছন্দে টিকটিক স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা প্রাণের ঘড়ি...
সেই ঘড়ির রথে চড়া সারথী সম্ভ্রম, সুন্দরের সত্যকামী শব্দ-ব্রহ্মার আদিষ্ট রূপকার কবি ও কবিতার মতোই নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবিরাও। এই উত্তরাধিকার বহন করছে বলেই তারাও ধারাক্রমী এবং ধারাবাহিকতার ধ্রুপদী ও ধ্রুবতারা এমনি প্রত্যাশা আজ কাক্সিক্ষত ও ব্যাখ্যায়। তবে যে তারার আলোতে আলোকিত রাতের অভিসার, ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের সুরে সুরে তারাবাতি সঙ্গে উড়ে উড়ে উড়ে চলা জোনাকি প্রণতি আর জীবন ও কবির কাব্যপ্রয়াস তার সঙ্গে নব্বইয়ের প্রধান কবিদের মেলবন্ধন কেমন সেটাও একটি জিজ্ঞাসা বটে, তবে উল্লম্ফন নয়। তাইতো বলা যেতে পারে দশকওয়ারি এই প্রয়াস, বাছাই ও বিভাজনে বিভক্ত ও অনুরক্ত দুই বাংলার নির্বাচিত ক’জন কবি এবং তাদের কবিতাকর্মের ব্যাখ্যাক্রম, ধ্বনিবোধ, অলঙ্কার, রস ও ছন্দের নান্দনিকতা, প্রকরণ, বিষয়বস্তু ইত্যাদির বিবিধ অনুষঙ্গেই উপক্রমণীয় কি এ লেখা কিংবা এর দ্বান্দ্বিকতা ও প্যারাডক্স?...
এরপর প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলাদেশের নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবি কারা?...
প্রাগুক্ত প্রশ্নের উত্তর একটি ধারাক্রম ও আপেক্ষিকতা-তাড়িত বিধায় উত্তর অপ্রাসঙ্গিক। তবে বিকাশের অর্থে দ্বান্দ্বিক (গ্রহণ-বর্জনের সমান বিধি ও বিধান সাপেক্ষে) বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। সেই অর্থে নির্বাচিতরাই এখানে প্রধান কবি।
আমরা জানি, কবিতা একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যম-িত স্বকীয়তাসিক্ত সাহিত্যধারা। বাংলাদেশের নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবিদের কবিতায় সেই সাহিত্যধারা যুগপৎভাবে বা সমান্তরাল বা স্বতন্ত্রভাবে ভিন্নতার কারুকার্যে দৃশ্যমান এবং দীপ্তিমান। তবে ওপার বাংলার কবিতায় ’৪৭ পরবর্তী ধারাক্রমকে অতিক্রমণ, তেমন অর্থে দৃশ্যমান নয় শুধুমাত্র আধুনিকতা ও জীবনবোধের বিকাশের সাপেক্ষে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯, ’৭০, ’৭১... যেন পরিবর্তন, বিকাশ আর প্রগতির পথ পরিক্রমণ। যেন শুধু বদলে যাবার, বদলে দেবার প্রত্যয়ে প্রত্যাশী কবি ও কবিতার প্রাগ্রসরতা। তাইতো এপারের কবিদের কাব্যপ্রয়াসও অভিজ্ঞান-স্বকীয়তা অবশ্যই ওপারের কবিদের কাব্য-স্বকীয়তা ও বিম্বিত বিকাশ থেকে কিছুটা হলেও স্বতন্ত্র এবং স্বকীয়তাপূর্ণ। কিন্তু সবকিছুর পরেও মহাসত্য হলো দুই বাংলার কবিদেরই প্রাণান্তকর প্রয়াস, বিশ্বাস, প্রেম, চর্চা ও সাধনা হলো বাঙালি-স্বকীয়তার স্বপক্ষে দেশজ এবং বিশ্বজনীন হয়ে ওঠা।
বাংলাদেশের কবিদের কাব্যপ্রয়াস ও অভিজ্ঞান-স্বকীয়তা
কবিতা রচনার সদিচ্ছা বাঙালির একটি স্বতঃস্ফূর্ত স্বকীয়তা। এই স্বকীয়তাসিক্ত হয়ে কবিদের পথচলা এবং কাব্যপ্রয়াসের সূচনা। পরে সেটা চর্চা আর জ্ঞানের বিকাশে বোধ ও কৃষ্টির সাহচর্যে পরিণতি বা পরিপক্বতায় গিয়ে পৌঁছে। সেই পর্যায় বা কালজ্ঞে সৃষ্ট কবিতার অভিজ্ঞান মাত্রা ছেড়ে বহুমাত্রায়, বোধে, জ্ঞানে, ছন্দে, রসে, অলঙ্কারে ও প্রকরণে (ঋড়ৎস) সাধনাধারায় চলিষ্ণু এবং প্রাগ্রসরও বটে। নব্বইয়ের কবিরাও সে ধারাক্রমে এগিয়ে গেলেও তাদের সামগ্রিকতা কোন পর্যায়ে, কেমন প্রয়াস আর কতটা সাধনা-স্নাত সেটা বলাটাও অসম্ভব! ...তবুও অপেক্ষমাণ কালের দিকে পরোক্ষ দৃষ্টি দিয়ে প্রত্যক্ষ বাস্তবের সীমাবদ্ধ পরিসরে কিছু ধারণা ও বোধ নিয়ে দ্বান্দ্বিক আলোচনা কিংবা গ্রহণ-বর্জনের বিধান-সাপেক্ষে কিছু কিছু প্রকল্প-প্রস্তাবনা বা অভিজ্ঞান-স্বকীয়তা তুলে ধরা যেতে পারে। কিন্তু সেটা আপেক্ষিক নয়তো চূড়ান্ত যদি না কবিদের ধারাক্রমে উল্লম্ফন (খবধঢ়) পরিদৃষ্ট না হয়?
বাংলাদেশের ২১ জন প্রধান কবি এ আলোচনায় সীমাবদ্ধ বিধায় তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো অনেকটাই এভাবে শ্রেণীকরণ বা বিভাজন করা যেতে পারে। যেমন
(১) কবিদের নাম প্রধানত অক্ষরবৃত্তের চারমাত্রা থেকে আট মাত্রায় সীমাবদ্ধ হলেও চার ও পাঁচ মাত্রারই আধিক্য বেশি।
(২) কবিতা ও কবিতার বইয়ের নামের মধ্যে উপমা, ব্যঞ্জনা ও ভিন্নতার রহস্য-মাখা যাতে জাদু-বাস্তবতা এবং অধিবাস্তবের (অনংঁৎফ) রঙই নিঃসারিত।
(৩) কবিদের শৈশব ও নস্টালজিয়ার অনুষঙ্গ অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চকিত এবং উত্তুঙ্গবাদী।
(৪) বয়সের প্রাবল্যে যতটা না আদিরস দৃশ্যমান তারচেয়ে বেশি মাত্রায় সংস্কারবাদী মন ও মননের কারুকার্য উপমাশ্রিত স্রোতে স্রোতস্বতী।
(৫) কারো কারো কবিতায় মরমিবাদ, বাউলতত্ত্ব ও লোকজধারা দৃশ্যমান হলেও সেটা চর্চা পর্যায়ে চর্চিত তবে সাধনা-অভিজ্ঞানের ধারাক্রম খুব একটা পরিদৃষ্ট নয়।
(৬) নাগরিকবোধ আর জৈবিক স্খলন ও সংকটের আবর্তে জীবনের রহস্যময়তা এবং বিমূর্ত ভাবকল্পই বেশি লক্ষণীয়।
(৭) জাদু-বাস্তবতা, অধিবাস্তববাদ, উত্তরাধুনিকতা, কাঠামোবাদ, বিনির্মাণবাদ ও ডিসকোর্সের অনুষঙ্গ-তাড়িত প্রকরণশৈলী ব্যাপক অর্থে দেখা না গেলেও কারো কারো সীমিত ব্যবহার-প্রবণতা ঈর্ষণীয় এবং বাক্সময়ও বটে।
(৮) গদ্য-ছন্দের ব্যবহারে অনেকেই সাবলীল তবে তারও পরিমিতি প্রশ্নসাপেক্ষ হতে কতক্ষণ?... তিন ছন্দ রপ্ত করা হয়তো-বা প্যারাডক্সের মতই আপাতঃ বিরোধী, তবে ফলাফল?
(৯) মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী ভাব ও স্বদেশপ্রেম ইত্যাদি নব্বইয়ের দশকের কবিতায় খুবই সীমিতভাবে প্রতিভাত।
প্রথমে আসা যাক কবিতার বইয়ের নাম প্রসঙ্গে। যদিও এটি একটি উপলক্ষ, প্রধান অনুষঙ্গ নয়, তবুও নামের ব্যঞ্জনা ও অর্থের গূঢ়ার্থ এবং রহস্যময়তাও কবিদের স্বকীয়তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কবি ওবায়েদ আকাশের কবিতার বই (১) পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ, (২) নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ, (৩) কুয়াশা উড়ালো যারা, (৪) বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা (৫) ঋতুভেদে, পালকের মনোবৃত্তিগুলি, (৬) শীতের প্রকার, (৭) পাতাল নির্মাণের প্রণালী, (৮) তারপরে, তারকার হাসি, (৯) যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময়, (১০) প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায়, (১১) (১২) রঙ করা দুঃখের তাঁবু, (১৩) বিবিধ জন্মের মাছরাঙা (একটি দীর্ঘ কবিতা), (১৪) তৃতীয় লিঙ্গ (কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা,) (১৫) হাসপাতাল থেকে ফিরে, (কলকাতা), (১৬) ৯৯ নতুন কবিতা, (১৭) পাতাগুলি আলো, (১৮) তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর, (১৯) সর্বনামের সুখদুঃখ, (২০) পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর, (২১) নির্জনতা শুয়ে আছে সমুদ্র প্রহরায়। কবি মিহির মুসাফীর কবিতার বই (১) কুঠার সম্প্রদায়, (২) বহুকৌণিক বাতাসের মুখ। কবি মুজিব ইরমের কবিতার বই (১) মুজিব ইরম ভবে শোনে কাব্যবান, (২) ইরমকথা, (৩) সাং নালিহুরী, (৪) শ্রী। কবি শাহ্নাজ মুন্নীর কবিতার বই (১) রুদ্ধশ্বাস বৈঠকের পর (যৌথ), (২) ক্ষমঃ হে শ্বেত দুগ্ধ, (৩) আত্মঘাতী সুখ। কবি সরকার আমিনের কবিতার বই (১) রুদ্ধশ্বাস বৈঠকের পর (যৌথ), (২) সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, (৩) ইহকাব্য, (৪) আত্মহত্যার পরিবর্তে এক কাপ চা খাও, (৫) ব্লেড দিয়ে কেটেছিলে জল, (৬) চার পাঁচ হাজার পিঁপড়ার দুঃখ, (৭) আমাদের পোষা ট্রেন (৮) যাকে খুন করার কথা তাকে দেখে হেসে ফেলি (৯) বিবাহিত প্রেমের কবিতা। কবি কাজল কাননের কবিতার বই (১) মাটির মড়মড়, (২) পইখ উড়ে যাও। কবি কামরুল ইসলামের কবিতা (১) দ্বিধান্বিত সুখে আছি যমজ পিরিতে, (২) ঘাসবেলাকার কথা, (৩) সেইসব ঝড়ের মন্দিরা, (৪) চারদিকে শব্দের লীলা। কবি কুমার চক্রবর্তীর কবিতার বই (১) লগপুস্তকের পাতা, (২) সমুদ্র, বিষণœতা ও অলীক বাতিঘর, (৩) পাখিদের নির্মিত সাঁকো। কবি খলিল মজিদের কবিতার বই (১) পালকাপ্য। কবি জফির সেতুর কবিতার বই (১) বহুবর্ণ রক্তবীজ, (২) সহস্র ভোল্টের বাঘ, (৩) স্যানাটোরিয়াম। কবি তাপস গায়েনের কবিতার বই (১) সাঁকোশূন্য মহাদেশ, (২) একলব্য নিঃসীম নগরে। কবি তুষার গায়েনের কবিতার বই (১) নীলভব হ্রদ, (২) বৃষ্টির অন্তর ত্রাস। কবি নেহাল আহমেদের কবিতার বই (১) অসম্পূর্ণ দুপুর। কবি বায়তুল্লাহ কাদেরীর কবিতার বই (১) দুঃখের আঙুল নড়েচড়ে, (২) বাতাস তোমার রক্ত পান কর, (৩) ত্রিণাচিকেতের নাচ, (৪) প্রজন্ম লোহিত। কবি মজনু শাহর কবিতার বই (১) আনকা মেঘের জীবনী, (২) লীলাচূর্ণ, (৩) মধু ও মসলার বনে। কবি মামুন মুস্তাফার কবিতার বই (১) কুহকের প্রতœলিপি, (২) পিপাসার জলসত্র। কবি মাহবুব কবিরের কবিতার বই (১) কৈ ও মেঘের কবিতা, (২) ফুলচাষি মালি যাই বলি। কবি হেনরী স্বপনের কবিতার বই (১) মাটির বুকেও রৌদ্রজ্বলে (২) বাল্যকাল ও মোমের শরীরে আগুন, (৩) জংধরা ধূলি, (৪) কাস্তে শানানো মোজার্ট, (৫) ঘটনার পোড়া মাংস। কবি মোস্তাক আহমাদ দীনের কবিতার বই (১) কথা ও হাড়ের বেদনা, (২) জল ও ত্রিকালদর্শী, (৩) জল ও শ্রীমতী ইত্যাদি।
এবার দেখা যাক কবিদের ব্যক্তিক-বিকাশ ও বৈশিষ্ট্য-স্বকীয়তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অথবা দৃশ্যমান অনুষঙ্গ-প্রবণতা। কবি ওবায়েদ আকাশ কবিতার গদ্যে বিকশিত এক কবিসত্তা। তবে তার পদ্যের বিনুনীও অনুধ্যেয়। তিনি অতীতবোধ, রাজনীতি, সংকট আর প্রধানত লোকজ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আবার কখনো কখনো নগরজীবনের বাস্তবতাকেই বাক্সময় ও বিকশিত করতে বেশি মাত্রায় পারঙ্গম। যেমন
১। কেউ ফুটপাত ধরে হাঁটছে
যাবজ্জীবন ঘুমের কথা আপনার মনে পড়ছে নাতো!
[কবিতা : একটি সাম্প্রতিক কবিতার খসড়া; বৈশিষ্ট্য : নগর সংকট ও মরমিতত্ত্ব]
২। প্রতীক বিশ্বের দিকে আমার অন্ধত্বকে খুঁজে দেবো ভাষা
আর যাদুবাস্তবতা, তুমি দেখো এই মায়াবিশ্বের ব্যাপারগুলো
পরস্পর সম্বন্ধতাড়িত হয়ে
আমার যে পরস্ত্রীকাতরতা ভর করেছিলো
আর আমার মহাত্মা ধানজমিগুলো
এক এক করে
জলের দামে বিকিয়ে দিয়েছিলাম...
ঐ ধানের জন্য মায়া, আর
ঋণের জন্য খুলে দিয়েছিলাম অন্দরের সিঁড়ি...
[কবিতা : সাম্প্রতিকগুলো; বৈশিষ্ট্য : অধিবিদ্যা ও নাগরিক ঈর্ষাবোধ]
পাশাপাশি তার গদ্যধারার কবিতাগুলিতে তিনি জীবনের সামগ্রিকতাকে প্রতীকী ও উপমাতাড়িত করে প্রকাশে যেন উৎসাহী। ‘শূন্যতার রাত্রিদিন’, ‘প্রিয় কবিদের রন্ধনশায়’...ইত্যাদি কবিতায় গল্প, চিত্র বর্ণনার মাধ্যমে তিনি যেন পদ্য আর গদ্যের দূরত্বকে প্রশমিত করে চলেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য আরো কাব্যগ্রন্থের নাম পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর, তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর, সর্বনামের সুখদুঃখ, পাতাগুলি আলো এবং নির্জনতা শুয়ে আছে সমুদ্র প্রহরায়। প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে সম্পূর্ণ নিজস্বতা ও অনন্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
কবি মিহির মুসাকী প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা, রসবোধ ও লোকজ-বাস্তবতায় জীবনকে কাব্যময় করার সদিচ্ছায় উদ্বুদ্ধ। তিনি ঐতিহ্য আর সরলতাকে উপজীব্য করে নাগরিক-জটিলতাসিক্ত জীবনকে তার কবিতায় তুলে আনেন। মূলত গদ্যধর্মী হলেও মুক্তক অক্ষববৃত্তের কিছুটা ছোঁয়াচ তার কবিতার পদ্য-স্বকীয়তাকে নান্দনিক করেছে।
১। পরিত্যক্ত বাসাবাড়ি, হেমলক
পড়ে আছে ধূপছায়া স্বপ্ন
সবকিছু হবে আজ পোস্টমর্টেম
[কবিতা : বাসাবাড়ি হেমলক, বৈশিষ্ট্য : প্রাত্যহিক জীবন, তিক্ততা ও জৈবিক সংকট]
২। মেঘের ওপাশ থেকে কি দেখ তোমরা?
অলীক-কাকের উড়ে যাওয়া ধূসর অতীত?
কুয়াশার কুটিল কাঠামো ভেঙে
ছায়ারা কি হেঁটে যায় ধাতব বৃক্ষের দিকে?
জিরাফের মত বাড়ায় গ্রীবা আগুন-বৃষ্টিতে?
[কবিতা : নির্বাহী আত্মা, বৈশিষ্ট্য : দার্শনিক জিজ্ঞাসা ও অধিবিদ্যাবোধ]
কবি মুজিব ইরম লোক-ঐতিহ্যতাড়িত সরল পদ্যের কথক। জীবনকে গ্রামীণ-চেতনাবোধ, লোকযান ও পুঁথিকারদের ঢঙে কাব্যময় করার একটা প্রয়াস তার কবিতায় লক্ষণীয়। তিনি শেকড়বোধকে বর্ণনে, কথনে, সারল্যে, গদ্যভাব ও ভাষায় বিম্বিত করে তার পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। বিষয়ের অভিনবত্ব ও জটিলতার চাইতেও সারল্য, বিমূর্ত-অভিকল্পই বেশি বেশি প্রকটিত তার কাব্যে।
১। কী করে ফেরাবে মাগো! নই শিশু, ঝরে গেছে পরীদের ডানা। শানেবান্ধা ক্ষত নিয়ে সপ্তডিঙ্গা নগরে ভাসে।
[কবিতা : আঁতুড়ভয়, বৈশিষ্ট্য : জন্মসত্য ও পুঁথিতত্ত্বের অধিবিদ্যার সারল্য]
২। এই পাতাবাহারে আমার মজে গেছে মন
ফলে তার পাশে যতো সুবাস রয়েছে কৌলীন্য সকাশে
দেখি না কখনো তার সুঘ্রাণ মধুর
[কবিতা : পাতাবাহার, বৈশিষ্ট্য : প্রকৃতিবোধ ও সরলতা]
কবি শাহ্নাজ মুন্নীর কবিতায় গতি ও প্রগতির সম্মিলন রয়েছে। তিনি দেখার বোধ ও বিশ্বাসকে প্রশ্নসত্যে চিত্র আর সংকটের প্রেক্ষিতে উপলব্ধিজাত করে তুলেছেন। যেমন
১। গরুর শিং-এর উপর ঘুরছে যে পৃথিবী
সেই পৃথিবীতে বাসা বেধেছি
যখন সূর্য হারিয়ে ফেলে আলো
তখন তোমার আলোয় সে বাসায় ফিরে আসি,
[কবিতা : সেই পৃথিবীতে, বৈশিষ্ট্য : সংসার ধর্মবোধ ও মানবের প্রেমাশঙ্কা এবং চিত্রকাব্য।]
২। সারিন্দা বাজায় বুঝি কোন নিরাকারে
কপাটে কখনো দেখি তাহাকে সাকারে
তুমি কি মৃন্ময় প্রভু, তুমি কি চিন্ময়?
[কবিতা : সুর বন্দনা, বৈশিষ্ট্য : লোকতত্ত্বে জীবনের আধুনিকতা ও কাব্যধারা।]
কবি শিবলী সাদিক জীবনের জটিলতাকে ঋতুবোধে, লোকতত্ত্বে এবং নাগরিক দৃষ্টিদৃক্ষায় কাব্যময় করার প্রয়াস চালিয়েছেন। তার কবিতা প্রকৃতিজাত, দেশজ ও প্রতীকধর্মী অভিকর্ষে যেন চলিষ্ণু ও বাক্সময়।
১।কৌম নৌকা নিয়ে ঘুরব আমরা নগ্ন দেহে
জলের অলীক নম্রতায়, বালুগ্রহে, পাতার সীমান্তে
উৎসবের মুখে তোমাতে আমাতে যূথবদ্ধতায়।
[কবিতা : সবুজ আলোকবর্ষ, বৈশিষ্ট্য : মিলন ও প্রকৃতিতত্ত্ব]
২। অন্ধ প্রজাপতি মত্ত হয়ে রসে দেখি না কিছু,
জাগছে সবখানে নিমেষে ফুলরঙে ফুল সকাল,
মুহুর্মুহু ফুল আমাকে সবটুকু দেখে ফুটছে।
[কবিতা : কারা যেন আমাকে দেখে ফেললো, বৈশিষ্ট্য : প্রকৃতিবোধে জৈবিক সংকট।]
কবি সরকার আমিন শূন্যতার আঁধারে আঁকেন চিত্রময় কবিতার জগৎ। তবে তার চিন্তায় সংকটের প্রকাশ, জীবনবাদ, মরমিতত্ত্ব, নস্টালজিয়া, অধিবিদ্যা আর নাগরিক জটিলতারই প্রাধান্য বেশি। যেমন
১। রাতের তোষকে ডাকে আমাকে বৃষ্টির বিষফল
নিখিল স্তনাগ্রে যেন আঙুর ফল যেন নিখাদ কামড়
[কবিতা : হলুদ শখ, বৈশিষ্ট্য : ব্যক্তিগতবোধের বিশ্ব বৈশ্বিক চেতনা]
২। আত্মহত্যার পরিবর্তে তুমি যদি আত্মহত্যাই করো, করো
কিন্তু তার আগে জেনে নাও হত্যাকা- কাকে বলে
হত্যাকে আত্মসঙ্গত করার জন্য কতগুলো
হত্যাকা- ঘটেছে এবং ঘটতে থাকবে।
[কবিতা : আত্মহত্যার পরিবর্তে ১ কাপ চা খাও, বৈশিষ্ট্য : বোধের বিকাশ ও বিবেকী আধুনিকায়ন]
কবি তাপস গায়েন বৈশ্বিকবোধে তার অভিবাসী জীবন ও দেখার নিপুণ চোখে মিথের শক্তি, লোকযান, জাদু-বাস্তবতা আর অন্তর্লীন শূন্যতা বোধে এঁকেছেন তার কাব্যকলা ও কথন-রথ। একদিকে যেমন ছন্দোবোধ অন্যদিকে ভাঙনের গদ্য-কল্পে বিম্বিত তার কাব্যময়তা।
১। যুদ্ধশেষে পৌরাণিক দেহ কারা নেবে তুলে
প্রজাপতি লুপ্ত করো কাল, অনামিকা দেহ
বিভ্রমের রূপ লিখে রেখো ছায়াপথ জুড়ে
তোর দেহের ছায়ায় অনঙ্গ হয়েছি বহুকাল
দৃষ্টির লাবণ্যে দিকভ্রষ্ট, অন্ধ আমি গ্রহান্তরে
[কবিতা : সাঁকোশূন্য মহাদেশ, বৈশিষ্ট্য : অন্তর্লীন-শূন্যতা]
২। চক্রব্যূহে আমি : অভিমন্যু মাতৃহীন, বর্মহীন।
[কবিতা : অভিমন্যু, বৈশিষ্ট্য : পৌরাণিক আধুনিকতা]
কবি তুষার গায়েনও শেকড়জাত বোধে, শূন্য সংকটতাড়িত জাগতিক বাস্তবতার চিত্র তুলে আনতে পারঙ্গম। তার চিন্তায় যেমন উড্ডীন-বাস্তবতা উঠে আসে তেমনি জীবনের প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ, মুক্তিযুদ্ধ ও লোকযানের আধুনিকায়নও বিম্বিত। তিনি ছন্দকে উপলক্ষ করে গদ্যের বিনুনী দিতেই সিদ্ধহস্ত। তবে তার দেখার চোখ এবং বিষয়বস্তু নির্বাচনের বহুমাত্রিকতা তার পাঠককে দৈশ্বিক ও বৈশ্বিক অভিজ্ঞানে পরিপক্ব হয়ে উঠতেই উৎসাহী করে তোলে। যেমন
১। ভাঙা চুড়ি দেখতে পাই ... ‘কার এ শাঁখা
ভাঙা চুড়ি? কেঁদে ওঠেন কাজলদিদি
‘একাত্তরে মাঠ পেরোতে, খানসেনারা
আমায় ধরে!’...
[কবিতা : একাত্তরের খনি, বৈশিষ্ট্য : মুক্তিযুদ্ধ অনুষঙ্গ ও বাস্তবতা]
২। ঠাকুর্মা গল্পের মতো কথা বলে যেন এক পৌরাণিক পাখি
গেয়ে ওঠে গান, কণ্ঠে সোনালী তরঙ্গ তার শুধু পাকা ধান হয়ে ঝরে
ঠাকুর্মা ধানের কথা বলে কতদিন বলেছে এমন!
ধানগুলো ধীরে ধীরে আঁধারের গায়ে সাদা খই হয়ে ফুটে গেছে
স্বপ্নের মতোন ঝরে গেছে তারপর ঠোঁটে তার সাদা খই
[কবিতা : বাউল গাইতে পারি যেন, বৈশিষ্ট্য : জাদু ও লোক-আধুনিকতা]
কবি নেহাল আহমেদের কবিতাভুবন প্রেম ও শেকড়জাত বিশ্বাসের অনুষঙ্গে নাগরিক সংকট, জিজ্ঞাসা আর আত্মপীড়নের কথকতায় চলিষ্ণু। তিনি স্মৃতিচারণবাদী তবে অসম্পূর্ণ দুপুরের মতোই দ্বান্দ্বিক ও বিকাশমান, প্রশ্নবাণ। যেমন
১। এখন আত্মহত্যা পরিত্যাগ করার কোনো গ্লানি নেই আমার।
অন্ধকার আকাশে চেয়ে, আমি তার
স্তদ্ধতার গান শুনলাম।
ঈশ্বরের দেবতারা নাস্তার টেবিলে খুঁজবে তার সান্নিধ্য।
আর জানতে চাইবে নির্বাসনের পথ।
[কবিতা : স্তব্ধতার গান, বৈশিষ্ট্য : সংকট ও উপমা-উদ্ভাবনবাদী]
২। যে বন্ধ্যা মৃত্তিকায় রোপণ করেছিলাম
সারারাত কুড়িয়ে আনা কুমারী বিশ্বাস
মহৎ বৃক্ষের মত
প্রতিদিন যা আমরা আলিঙ্গন করতাম।
[কবিতা : কুমারী, বৈশিষ্ট্য : প্রেম ও শেকড়বিশ্বাস]
কবি বায়তুল্লাহ্ কাদেরী লোকরীতির অনুষঙ্গে জীবনের সরলতাকে তার কবিতার অনুষঙ্গ করতেই পারঙ্গম। তার বোধের বাস্তবতাই হলো নগরের চোখে গ্রামীণতার উত্তরণ। যেমন
১। বায়োস্কোপে চোখ রেখে দেখে আছি অতি অভিভূত
চলছে গাড়ির সারি, চলে যাচ্ছে শহরে শহর
বায়োস্কোপে যাচ্ছে নারী, যাচ্ছে তার আয়নাটি, যায়
লালফিতে-সুটকেশ, বেঢপ ডোলের মতো যাচ্ছে
[কবিতা : বায়োস্কোপ, বৈশিষ্ট্য : লোক-আধুনিকতা]
২। ঘুমায়ে আছেন তিনি, জেগেছেন চোখের মস্তিষ্কে
আঙুল উঁচায়ে পৃথিবীর দাম হেঁকে বলিলেন : পাঁচসিকে
জাগিয়া আছেন তিনি ঘুমায়েছিলেন হয়তো ক্ষণিকে
পা-ফেলিয়া চলে গেছে ইতোমধ্যে বহুদিবসের পূজারী শালিকে!
[কবিতা : অধিজগৎ, বৈশিষ্ট্য : মাজার ও মরমি-আধুনিকতা]
কবি মজনু শাহর কবিতা মিথ-ঐতিহ্য, লোকযান আর জাদু-বাস্তবতার মিশেলে নাগরিক দৃষ্টিবোধের চিত্রকল্প। পুঁথির বয়ান, আদিকথন লোকধারাকে তিনি তার গদ্য ও পদ্যরীতির শৈলী-সাপেক্ষ কাব্যশক্তি দিয়ে চিত্রিত এবং বিম্বিত করেছেন। যেমন
১। যখন কাঠের ঘোড়া লাফ দেয় তমসার জলে,
জাগে বাতিঘরে কেউ, বিশুদ্ধ ঘুমের মদে ডুবে
আর আমি কেন দেখি বারবার দেবতার রোষ!
কাঠের ঘোড়ার পিঠে একদিন স্মৃতিশস্য নিয়ে
চূড়ান্তে পৌঁছব বলে ধূলিতীর্থে ঘুরেছি ব্যাপক;
[কবিতা : লীলাচূর্ণ ২, বৈশিষ্ট্য : সনেট রীতিতে লোকধারার আধুনিকায়ন]
২। আমি পড়াই জেব্রাদের স্কুলে। আমার মা বাবা ভাই বোন কেউ নাই, বস্তুত, আমি বড় হয়েছি একটা লাল রঙের মাদী শেয়ালের কাছে। পাহাড়ের হা-য়ের মধ্যে যেখানে আমাদের বাড়ি, তার সামনে বসে দেখা যায় জলত্যাগী একঝাঁক কৈমাছ কান দিয়ে হেঁটে কাব্যসমালোচককে ধাওয়া করছে।
[কবিতা : জেব্রা মাস্টার, বৈশিষ্ট্য : জাদুবাস্তবতা]
কবি মামুন মুস্তাফা তার কবিতায় জীবনের বালখিল্য ধারাক্রমকে ইতিহাসবোধ, রাজনীতি, যৌনতা আর সংকটের আবর্তে বিম্বিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি রহস্যময়তার অন্তরালে মানুষের বিবেকে প্রশ্ন সৃষ্টি ও ব্যঞ্জনাভাবের বিকাশের সপক্ষেই যেন কাব্যধারার প্রবর্তক। যেমন
১। সাবিত্রীর জানালা খোলা
জোছনা তার সবটুকু শরীর
ঢেলেছে সাবিত্রীর বিছানায়।
সাবিত্রী নবজাতককে দুগ্ধ দ্যায়।
[কবিতা : সাবিত্রীর জানালা খোলা, বৈশিষ্ট্য : প্রেম ও অবিশ্বাসের মাঝে জীবনাচার]
২। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে কণ্ঠিনালার পাড়ে
ওকে হাত ধরে নিয়ে এসো কেউ
চৈত্রসংক্রান্তির আগে।
[কবিতা : কণ্ঠিনালার পাড়ে, বৈশিষ্ট্য : জীবন ও সংকটের বাস্তবতায় ইচ্ছে প্রকাশ]
কবি মাহবুব কবির জীবনকে প্রতীক আর উপমাতাড়িত চোখে দেখার সরলতাসিক্ত প্রত্যয়ে যেন প্রদীপ্ত। একদিকে তার মারফতি (মরমি) ইচ্ছে অন্যদিকে স্বপ্নসংকট, পলায়নবাদী মানসশৈলী বিম্বিত করেছে তার কবিতার নতুন অভিযাত্রা। স্ব-কথন, স্বল্পবাক্য আর দেখার ভিন্নতাই তার কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তবে তিনি আদি বাৎসল্য ধারার অনুষঙ্গেও পারঙ্গম। যেমন
১। এখন আমি মগড়ার ব্রিজে, রেলিতে হেলান দিয়ে
হাওয়া খাচ্ছি, ফলে
অজস্র মেঘের জন্ম হচ্ছে হৃদয়ে আমার
আকাশ উপুড় করে বৃষ্টি হবে বলে।
[কবিতা : বৃষ্টি হবে, বৈশিষ্ট্য : প্রকৃতিবাদ ও আত্মতৃপ্তিবোধ]
২। বউ লুঙ্গি দিয়ে বেঁধে ভাত পাঠায়।
চড়–ইয়ের মাংস খেতে খেতে কোকিলের গান গাই।
[কবিতা : বীজধান চড়ুইয়ে খায়, বৈশিষ্ট্য : লোকধারা ও সংকট চিত্রকল্প]
কবি মোস্তাক আহমাদ দীনের কবিতায় জীবনের ছোট ছোট বিষয়ের সাথে শূন্যতা, বৈষম্য, যৌনতা, প্রেম ইত্যাদি বহু অনুষঙ্গই সম্পৃক্ত। তিনি তার কবিতায় মরমিবাদ থেকে শুরু করে চিত্রকল্পবাদ ও প্রতীকধর্মিতার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন ক্ষেত্রবিশেষে মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।
১। আজ বিস্মরণের দিন, আজ এংকা পথে ঘুরিতেছি
আনত দু-হাত নিয়ে
জন্মলজ্জা ফেলে দিতে শূন্যে শূন্যে খুঁজিতেছি গলা
[কবিতা : জন্মলজ্জা, বৈশিষ্ট্য : বাস্তবতা ও বিমূর্তের যৌথ সম্মিলন। সমাপ্তিহীন।]
২। তুমি ক্লান্ত আর বহু দূরাগতা,
চুপে চুপে এসে মিশে গেছ
শান্ত আতরদানে, মর্জিমহলে
[কবিতা : ময়ূর, বৈশিষ্ট্য : চিত্রকল্পবাদ ও সংসারতত্ত্ব]
কবি কাজল কানন তার কবিতায় মানবিক সমর্পণবোধ দেখা না দেখার অনুভূতি আর স্বপ্নময়তা ও নারীবাদী চিন্তার বেড়ে ওঠাকে বিম্বিত করেছেন। মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নেপথ্যে গদ্যধারাই তার কবিতার উপজীব্য। যেমন
১। নাছিমা খালা, রাশিদা আপা ভরসাভরা নদী
জীবন থেকে জীবনে গ্যাছে যাদের কীর্তি
মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি গাঁওয়ালের ছায়া
কোনদিনই বড়ো হতে চাইনি
চেয়েছিলাম ফাটা ফালগুনের মাঠ
এক ধরনের রমণীয় তন্দ্রাছাওয়া খেলনাপাতি
[কবিতা : লক্ষ্য উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য : নারীর বেড়ে ওঠা ও শৈশবচিত্র]
২। ঘুড়ি উড়িয়েছে যে ছেলেটি
মহাশূন্যের দিকে যার চোখ বাড়ানো
তার সঙ্গে ঈশ্বরের ভাবগল্পে
ধরা পড়েছিল যাদুময়তার ঘোর!
[কবিতা : তত্ত্ব, বৈশিষ্ট্য : জাদু-বাস্তবতা]
কবি কামরুল ইসলাম তার কবিতায় পদ্য ও গদ্যধারা ব্যবহার করেছেন যেন অক্ষরবৃত্তীয় আদলে। অনুষঙ্গ হিসেবে নস্টালজিয়া, জীবনের বাস্তবতা, সংকট, শেকড় সন্ধানী অভীপ্সা, শূন্যতাবোধ, জাদু-বাস্তবতা এবং মরমিতত্ত্বের ইতিধারা। যেমন
১। আমাদের বীজ বপনের আদিম কৌশল পাশে এসে বসে আর
আমাদের বাহুগুলো ঢিল-ভাঙা শব্দের ভেতর নবীন দোতারা
বেজে ওঠে বাবলা পাতার শৈশব দাঁড়ভাঙা রোদের খোলসে
শব্দের বিবিধ লীলায় উজানে ডিঙা বায় অচিন সাধুরা ভজনে, সাধনে
[কবিতা : চারদিকে শব্দের লীলা, বৈশিষ্ট্য : মারফতি বাস্তবতা]
২। ঘোড়ারা ঘাসহীন দলে দলে
ঘাসের পরানে বাজে শূন্যতা
ও ঘাস, ও শূন্যতা, তোমরা আমাদের উঠোনে আজো
বিবিধ তৈজস
[কবিতা : আমাদের কিছু ঘাস ছিল, বৈশিষ্ট্য : শূন্যতাবোধ ও চিত্রময়তা ]
কবি কুমার চক্রবর্তী গদ্যধারার রীতিতে পদ্যে কবিকথন, নস্টালজিয়াবোধ, জিজ্ঞাসা তথা আদিরস ও সংকটে কখনো কখনো মায়াবাদী জৈবিকতায় জীবনকে এঁকেছেন। যেমন
১। পাখি আর আকাশের হাহাকার
অজ্ঞাত আর বিষণœ
অবলম্বনের মতো গুনগুন
আর এই নিঃসঙ্গ চিহ্ন ইচ্ছাহীন অস্তিত্বের ভেতর এখন
স্তব্ধতার সংকেত সাজায়।
[কবিতা : স্তব্ধতার সংকেত; বৈশিষ্ট্য : সংকট সৃষ্টিক্রম]
তোমার সাথে কথা বলা মানে সময়ের সাথে কথা বলা
তোমার সাথে পথ চলা মানে নদীর সাথে পথচলা
[কবিতা : কুহক; বৈশিষ্ট্য : মায়াবাদী জৈবিকতা]
কবি খলিল মজিদ স্মৃতিতাড়িত ভাবনায় লোকজ ধারার সম্মিলনে, প্রেম, মরমিতত্ত্ব আর নাগরিক সংকটবোধের শব্দসিক্ত গভীরতাকে অঙ্কন করেছেন। কবিতার বহুরঙা শৈলী কখনো মুক্তক অক্ষরবৃত্তের ধারাপাতে বিম্বিত তবে পরিব্যাপ্ত নয়।
১। পড়ো মন্ত্র দাহো মুখ
স্তোত্র সংস্কার স্বপ্ন সুখ
পুচ্ছ শিখায় তুচ্ছ জ্ঞান
জ্বালো জপ-তপ-ধ্যান
আনো জন্ম গুপ্তকাল
অগ্নি মাথা জয়-মশাল
[কবিতা : প্রিয় সর্পিণী, বৈশিষ্ট্য : গুপ্তিমন্ত্র ও প্রেম]
২। কলকল গোমতী জল অতল পাতাল থেকে ফুঁসে ওঠে
উঠিছে ফুঁসিয়া, শরীরের তন্ত্রী বেয়ে বিস্তারিছে বিদ্যুতের ফণা
একটি নিপুণ প্যাঁচ ও পদ্মিনী তোমার কোমর ঘিরে
একটি দারুণ প্যাঁচ ও শঙ্খিনী কু-লিত কানুর সাধন
[কবিতা : প্রিয় সর্পিণী, বৈশিষ্ট্য : লোকজধারা]
কবি জফির সেতু শৈশব ও পারিবারিক অনুষঙ্গে প্রেম ও বাড়ন ঋতুবোধের সারল্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে ছান্দসিক নান্দনিকতাতাড়িত সৌকর্যকে প্রাধান্য দিয়েই তার কাব্যভুবন সৃষ্টি করেছেন। যেমন
১। উঠোনে কবুতরের রক্ত
সারা বুবুর হাতে কাঁপছে নীল পাখি
এ বছর তার বিয়ে;
[কবিতা : দৃশ্য, বৈশিষ্ট্য : লোকজধারার চিত্রকল্প]
২। অদিতি টোটকা করে আমাকে পাথররূপে রেখে
গেছে ধ্বংসস্তূপের কাছে। অদিতির বিরল প্রস্থান
আমি নীরবে দেখেছি কেঁদেছি-কুদেছি আর যত
রাতজাগা ঘোড়া হয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে জাবর
কেটেছি।
[কবিতা : টোটকা, বৈশিষ্ট্য : মায়াবাদ]
কবি হেনরী স্বপন অসম্ভব বাস্তবতাকে নাগরিক দেখন হাসির অনুকল্পে, লোকজধারা ও মিথের নব-ব্যবহারে পারঙ্গম। তবে উপমা সৃষ্টি ও জাদুবাস্তবের সাপেক্ষে বিমূর্ততাকে উপজীব্য করাই তার কবিতার অন্যতম একটি বিশেষ দিক।
১। জড়িয়ে ধরবে আঁশে; পাটক্ষেতে পালালে
হাওয়ায় আঁচড়াবে কুমারী আয়নার সম্মুখে
[কবিতা : দুধ বানের তরল, বৈশিষ্ট্য : কুমারীতত্ত্ব ও কাব্যচিত্র]
২। পদ্ম-গোক্ষুর সাপের কামড়ে
ভ্রমরের বিষ পর্যন্ত নামিয়েছিলে পুকুরের জলে...
[কবিতা : বেসিনের সিরামিকে সাদা পা-ুলিপি, বৈশিষ্ট্য : লোকবিশ্বাস]
কবিদের ছন্দোজ্ঞান ও প্রকরণ শৈলী নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। এর সদুত্তর নব্বইয়ের কবিদের মধ্যে বিশেষভাবে বা বিশেষ অর্থে লক্ষ্যণীয় নয়। বাংলা কবিতার তিনটি প্রধান ছন্দ যেমন ১. অক্ষরবৃত্ত ২. মাত্রাবৃত্ত ৩. স্বরবৃত্ত। এই তিনটি ছন্দ আবার মুক্তক হতে পারে, মিশেল হতে পারে, গদ্য ধারার বিনুনীর মতোও হতে পারে। তবে এসব সত্ত্বেও মূলত ছন্দই কবিতার প্রাণ বা অন্তরের অবকাঠামো। কেননা কবিতা যদি ছন্দহীন হয়ে যায় তবে তার ভেতরে কবিদের কাব্যশক্তি প্রকটিত কিংবা শক্তি সৌকর্যপূর্ণ হতেই পারবে না। একজন কবি তার কবিতা লেখার প্রথম দশক তো ব্যয় করেন ছন্দ রপ্ত করারই কাজে। তাই ব্যাপক অর্থে ছন্দ আয়ত্তে না থাকলে কবি তো বুঝতেই পারবেন না ব্যঞ্জনাবোধ, চিত্রকল্পশক্তি তথা শব্দব্রহ্মাকে। আসলে ছন্দই কবিকে কবিতা লেখার সময়ে দিকভ্রান্ত হবার হাত থেকে রক্ষা করে। ছন্দই কবিকে শিক্ষা দেয় শব্দ ব্যবহার এবং এর পরিমিতিবোধ। ছন্দই কবিতার চরণের লাগাম টানতে পারে ও রক্ষা করতে পারে ভারসাম্যহীনতার জটিলতা থেকে। ছন্দই পারে কবিতাকে গদ্যের সারল্য দোষ ও গদ্যগন্ধ থেকে মুক্ত করে ব্যঞ্জিত করতে। সেজন্যই ছন্দ পরিত্যাজ্য তো হতেই পারে না বরং অলঙ্কারের স্বরূপকাঠী এবং কবিতার বিষয় ও প্রকরণের ব্রহ্মাস্ত্র। ছন্দোবদ্ধ কয়েকটি চরণের উদাহরণ দেওয়া হলো
১। কফি হাউসের রোদে।৮
ফোলা ফোলা গাল বসে।৮ থাকে মরুভূমির নাভি।৮
ধারী ধারী পাছা
কবি : ওবায়েদ আকাশ
ছন্দ : অক্ষরবৃত্ত
২। আমার মজেছে মন।৮ পাতায় পাতায়।৬, সকল ফুলের চেয়ে।৮, পাতাবাহারের ঘ্রাণ।৮ কেউ কি পেয়েছে টের।৮ এতোসব ফুলনারীদের পাশে!৮
কবি : মুজিব ইরম
ছন্দ : অক্ষরবৃত্ত
৩। ঝড়োল্লাসেই/৬ এসো এসো চুল্লিকা,/রসোল্লসিত হল্লামুখর/৬
কবি : বায়তুল্লাহ কাদেরী
ছন্দ : মাত্রাবৃত্ত/ছয় মাত্রা
৪। ঘুমের ভেতর/৪ এসে পরী
যাদুকরী/৪ হাসে মৃদু/৪ হাসে হাতে দ-/৪ ইচ্ছা পূরণ/৪ চাও কি কবি/৪ অন্য জীবন?
কবি : শাহনাজ মুন্নী
ছন্দ : স্বরবৃত্ত
আমরা জানি, আদিরসাত্মক ভাবনাবোধ ও যৌন চিন্তায় কাব্য স্বকীয়তা সৃষ্টির প্রয়োগ কবিদের একটি চিরন্তন ধারাক্রম। তবে নব্বইয়ের দশকের কবিরা এ ধারায় প্রাগ্রসর কিন্তু ব্যাপক অর্থে নয়। কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো
১. সিস্টার (নার্স) আপনার ফ্রকের হুঁকগুলো খুলে যাচ্ছে কেন?
ম্যাডাম (ডাক্তার) আপনার অ্যাপ্রোনটি ভীষণ উড়ছে বাতাসে
(একটি সাম্প্রতিক কবিতার খসড়া : ওবায়েদ আকাশ)
২. কুয়াশার ফালি আর সময়ের সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে
ডাবকথার পরের কথারা অতঃপর শিশ্নবাজ মাঝির চোখে
জাল ও জলের গল্প বিনির্মিত পিতৃত্বের তলে ডুবে যায়
(নিষ্প্রাণ ডাবের ভাসান : কামরুল ইসলাম)
৩. স্তব্ধতার ভেতর জেগে থাকা দেবতা আমার
চর্তুদিকে ঋতুর গভীরে জেগে ছিল খামালের মতো
বিশাল জোনাকির স্তন।
(ঠিক এভাবেই আমরা চেয়েছিলাম নক্ষত্রের পানে : কুমার চক্রবর্তী)
৪. আসিবে আশ্বিন মাস, ক্ষীণস্তনা বৃদ্ধা রাধিকা ও গ্রামে যবে
মনুর মন্ত্রের মতো ধান ভরে বিশল্যকরণী হবে।
(ধানসত্য কবিতা সিরিজ : এক : খলিল মজিদ)
৫. আমাদের এই যে আসঙ্গলিপ্সা ও যৌনতা
তা শৈশবেরই পুনরাবৃত্তি
(শরীরের সব তীর খুলে : জফির সেতু)
৬. রতিধর্মে গাঢ়রসে হৈল মাটি ফাঁক
ঊর্ধ্বমুখী দেহধারী প্রগাঢ় প্রচাপে
সাঙ্গা করে ডুবে যাই আলিঙ্গ আধার
(নীলভবহ্রদ : তুষার গায়েন)
৭. যে অমিত সরস্বতী পূজায়
সরস্বতীর স্তন দেখে শরীরী উত্তেজনার মতো।
(হঠাৎ কনিকার সাথে দেখা : নেহাল আহমেদ)
৮. শাড়ি-ব্লাউজের বেলাল্লাপনা জাগবে নটীতে
এসো শিখা-তেজা! রসোল্লসিত যোনি-ভোতৃকা-ধোঁয়া-কু-লে
হৈ-হুল্লুড়ের চিল্লাবিল্লা শেষে
ভাল্লাগে যত, তুল্য ওজোনাঙ্কে...
(প্রজন্ম লোহিত ৩১ : বায়তুল্লাহ কাদেরী)
০৯. নারী-যৌনচুলা। ঘুঙুর পরা বেড়াল হয়ে থাকে
প্রদক্ষিণ করি। সারারাত জ্বলে সবুজ লণ্ঠন,
পিপুল গাছের থেকে জন্ম নেয় আরো অন্ধকার।
(লীলাচূর্ণ ৪ : মজনু শাহ)
১০. অবশিষ্ট শুধুই শরীরাংশ, ঈষৎ বাঁকা
পশ্চিমগামী সূর্যের নিভে আসা রোদে
চুম্বনের গাঢ় মসীলেপ।
(কণ্ঠিনারার পাড় : মামুন মুস্তাফা)
১১. যেন জন্তু মেয়েটি
মানুষ ও জন্তুর শীৎকার একই।
(পাকা ধানে মই : মাহবুব কবির)
১২. আমি মণিপুরী কৃষানীর চাষের কৌশল দেখে হেঁটে গেছি পাড়ায় পাড়ায়। আমার কবিতা তাই ফর্সা উরুতে লাগা মণিপুরী রমণীর পেঁক। থকথকে লুদ।
(ইরম যখন ইরমকথা কয় : মুজিব ইরম)
১৩. জলের শরীর নিয়ে
ও বধূ সূর্যের প্রেমে পড়েছি
প্রবল দুপুর দেখো এই বেলা ভেসে যাই
প্রেম-টানে পাই পাখা, বাষ্পজীবন
(সূর্য প্রেমিকা : শাহ্নাজ মুন্নী)
১৪. পিউরির বেদনাও অন্ত্যমিলে যায়
তিসিক্ষেতে চর্বি গলে গর্ভবতী প্রেমিকার তেলরঙ শুকিয়ে ঝরবে
(তিসি ক্ষেত্রের চর্বিতে : হেনরী স্বপন)
তবে যৌনতা প্রকাশে এ সময়ের কবিদের শালীনতাজ্ঞান ও ব্যক্তিসত্তার নিজস্বতা এবং মার্জিত মার্জনাবোধই যেন প্রকটিত। এটাই এখানকার বিশেষত্ব হলেও বাস্তবতা কিন্তু অনেকটাই এগিয়ে আছে।...
[লেখাটি নব্বইয়ের দশকের ব্যতিক্রমী কবি ওবায়েদ আকাশ সম্পাদিত বিকল্প চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন “শালুক”-এর ‘বাংলা ভাষার নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবিদের কবিতা’ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধের বাংলাদেশ অংশ]
আহাম্মেদ কবীর
মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
[বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের কয়েকজন বিশিষ্ট কবির কবিতার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ রয়েছে এ প্রবন্ধে]
কবিতা সত্যের মতো সুন্দরম, সুন্দরের সঞ্চয়িতা, কবিতা সঞ্চিতা-মন রূপসী বাংলার পথ ধরে হেঁটে চলা নকশী কাঁথার রূপে আঁকা বাঙালির স্বাধীনতা তুমি। তাই কবি বলে মন-মননে কবিতা সুন্দরের রথে চড়া অনন্তের নভোযান, গতিতে স্বপ্নের মতো, রীতিতে স্মৃতির জ্বর, বিলাসিতা বালখিল্য, উপমার জানালাতে উড়ে চলা বলাকার গতিতে অঙ্কিতা এক বঙ্গ জনপথ, এ ব-দ্বীপ ভূমি, অসীম অশ্বত্থ। তাই কবিতার পথে পথে বাঙালির ইচ্ছে আর স্মৃতিসিক্ত ব্যথা-বেদনার, আনন্দের ভুবন-ডাঙায় হাঁটে কবি, হাঁটে কাব্য, হাঁটে উচ্চারণ
আকাক্সক্ষা বৈধতা সুন্দরের পথে কবিতারা ছুটে
কবিতা কুমারী দেহে ভাস্করের আঁকা ষড়ঋতু
ছন্দে টিকটিক স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা প্রাণের ঘড়ি...
সেই ঘড়ির রথে চড়া সারথী সম্ভ্রম, সুন্দরের সত্যকামী শব্দ-ব্রহ্মার আদিষ্ট রূপকার কবি ও কবিতার মতোই নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবিরাও। এই উত্তরাধিকার বহন করছে বলেই তারাও ধারাক্রমী এবং ধারাবাহিকতার ধ্রুপদী ও ধ্রুবতারা এমনি প্রত্যাশা আজ কাক্সিক্ষত ও ব্যাখ্যায়। তবে যে তারার আলোতে আলোকিত রাতের অভিসার, ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের সুরে সুরে তারাবাতি সঙ্গে উড়ে উড়ে উড়ে চলা জোনাকি প্রণতি আর জীবন ও কবির কাব্যপ্রয়াস তার সঙ্গে নব্বইয়ের প্রধান কবিদের মেলবন্ধন কেমন সেটাও একটি জিজ্ঞাসা বটে, তবে উল্লম্ফন নয়। তাইতো বলা যেতে পারে দশকওয়ারি এই প্রয়াস, বাছাই ও বিভাজনে বিভক্ত ও অনুরক্ত দুই বাংলার নির্বাচিত ক’জন কবি এবং তাদের কবিতাকর্মের ব্যাখ্যাক্রম, ধ্বনিবোধ, অলঙ্কার, রস ও ছন্দের নান্দনিকতা, প্রকরণ, বিষয়বস্তু ইত্যাদির বিবিধ অনুষঙ্গেই উপক্রমণীয় কি এ লেখা কিংবা এর দ্বান্দ্বিকতা ও প্যারাডক্স?...
এরপর প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলাদেশের নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবি কারা?...
প্রাগুক্ত প্রশ্নের উত্তর একটি ধারাক্রম ও আপেক্ষিকতা-তাড়িত বিধায় উত্তর অপ্রাসঙ্গিক। তবে বিকাশের অর্থে দ্বান্দ্বিক (গ্রহণ-বর্জনের সমান বিধি ও বিধান সাপেক্ষে) বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। সেই অর্থে নির্বাচিতরাই এখানে প্রধান কবি।
আমরা জানি, কবিতা একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যম-িত স্বকীয়তাসিক্ত সাহিত্যধারা। বাংলাদেশের নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবিদের কবিতায় সেই সাহিত্যধারা যুগপৎভাবে বা সমান্তরাল বা স্বতন্ত্রভাবে ভিন্নতার কারুকার্যে দৃশ্যমান এবং দীপ্তিমান। তবে ওপার বাংলার কবিতায় ’৪৭ পরবর্তী ধারাক্রমকে অতিক্রমণ, তেমন অর্থে দৃশ্যমান নয় শুধুমাত্র আধুনিকতা ও জীবনবোধের বিকাশের সাপেক্ষে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯, ’৭০, ’৭১... যেন পরিবর্তন, বিকাশ আর প্রগতির পথ পরিক্রমণ। যেন শুধু বদলে যাবার, বদলে দেবার প্রত্যয়ে প্রত্যাশী কবি ও কবিতার প্রাগ্রসরতা। তাইতো এপারের কবিদের কাব্যপ্রয়াসও অভিজ্ঞান-স্বকীয়তা অবশ্যই ওপারের কবিদের কাব্য-স্বকীয়তা ও বিম্বিত বিকাশ থেকে কিছুটা হলেও স্বতন্ত্র এবং স্বকীয়তাপূর্ণ। কিন্তু সবকিছুর পরেও মহাসত্য হলো দুই বাংলার কবিদেরই প্রাণান্তকর প্রয়াস, বিশ্বাস, প্রেম, চর্চা ও সাধনা হলো বাঙালি-স্বকীয়তার স্বপক্ষে দেশজ এবং বিশ্বজনীন হয়ে ওঠা।
বাংলাদেশের কবিদের কাব্যপ্রয়াস ও অভিজ্ঞান-স্বকীয়তা
কবিতা রচনার সদিচ্ছা বাঙালির একটি স্বতঃস্ফূর্ত স্বকীয়তা। এই স্বকীয়তাসিক্ত হয়ে কবিদের পথচলা এবং কাব্যপ্রয়াসের সূচনা। পরে সেটা চর্চা আর জ্ঞানের বিকাশে বোধ ও কৃষ্টির সাহচর্যে পরিণতি বা পরিপক্বতায় গিয়ে পৌঁছে। সেই পর্যায় বা কালজ্ঞে সৃষ্ট কবিতার অভিজ্ঞান মাত্রা ছেড়ে বহুমাত্রায়, বোধে, জ্ঞানে, ছন্দে, রসে, অলঙ্কারে ও প্রকরণে (ঋড়ৎস) সাধনাধারায় চলিষ্ণু এবং প্রাগ্রসরও বটে। নব্বইয়ের কবিরাও সে ধারাক্রমে এগিয়ে গেলেও তাদের সামগ্রিকতা কোন পর্যায়ে, কেমন প্রয়াস আর কতটা সাধনা-স্নাত সেটা বলাটাও অসম্ভব! ...তবুও অপেক্ষমাণ কালের দিকে পরোক্ষ দৃষ্টি দিয়ে প্রত্যক্ষ বাস্তবের সীমাবদ্ধ পরিসরে কিছু ধারণা ও বোধ নিয়ে দ্বান্দ্বিক আলোচনা কিংবা গ্রহণ-বর্জনের বিধান-সাপেক্ষে কিছু কিছু প্রকল্প-প্রস্তাবনা বা অভিজ্ঞান-স্বকীয়তা তুলে ধরা যেতে পারে। কিন্তু সেটা আপেক্ষিক নয়তো চূড়ান্ত যদি না কবিদের ধারাক্রমে উল্লম্ফন (খবধঢ়) পরিদৃষ্ট না হয়?
বাংলাদেশের ২১ জন প্রধান কবি এ আলোচনায় সীমাবদ্ধ বিধায় তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো অনেকটাই এভাবে শ্রেণীকরণ বা বিভাজন করা যেতে পারে। যেমন
(১) কবিদের নাম প্রধানত অক্ষরবৃত্তের চারমাত্রা থেকে আট মাত্রায় সীমাবদ্ধ হলেও চার ও পাঁচ মাত্রারই আধিক্য বেশি।
(২) কবিতা ও কবিতার বইয়ের নামের মধ্যে উপমা, ব্যঞ্জনা ও ভিন্নতার রহস্য-মাখা যাতে জাদু-বাস্তবতা এবং অধিবাস্তবের (অনংঁৎফ) রঙই নিঃসারিত।
(৩) কবিদের শৈশব ও নস্টালজিয়ার অনুষঙ্গ অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চকিত এবং উত্তুঙ্গবাদী।
(৪) বয়সের প্রাবল্যে যতটা না আদিরস দৃশ্যমান তারচেয়ে বেশি মাত্রায় সংস্কারবাদী মন ও মননের কারুকার্য উপমাশ্রিত স্রোতে স্রোতস্বতী।
(৫) কারো কারো কবিতায় মরমিবাদ, বাউলতত্ত্ব ও লোকজধারা দৃশ্যমান হলেও সেটা চর্চা পর্যায়ে চর্চিত তবে সাধনা-অভিজ্ঞানের ধারাক্রম খুব একটা পরিদৃষ্ট নয়।
(৬) নাগরিকবোধ আর জৈবিক স্খলন ও সংকটের আবর্তে জীবনের রহস্যময়তা এবং বিমূর্ত ভাবকল্পই বেশি লক্ষণীয়।
(৭) জাদু-বাস্তবতা, অধিবাস্তববাদ, উত্তরাধুনিকতা, কাঠামোবাদ, বিনির্মাণবাদ ও ডিসকোর্সের অনুষঙ্গ-তাড়িত প্রকরণশৈলী ব্যাপক অর্থে দেখা না গেলেও কারো কারো সীমিত ব্যবহার-প্রবণতা ঈর্ষণীয় এবং বাক্সময়ও বটে।
(৮) গদ্য-ছন্দের ব্যবহারে অনেকেই সাবলীল তবে তারও পরিমিতি প্রশ্নসাপেক্ষ হতে কতক্ষণ?... তিন ছন্দ রপ্ত করা হয়তো-বা প্যারাডক্সের মতই আপাতঃ বিরোধী, তবে ফলাফল?
(৯) মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী ভাব ও স্বদেশপ্রেম ইত্যাদি নব্বইয়ের দশকের কবিতায় খুবই সীমিতভাবে প্রতিভাত।
প্রথমে আসা যাক কবিতার বইয়ের নাম প্রসঙ্গে। যদিও এটি একটি উপলক্ষ, প্রধান অনুষঙ্গ নয়, তবুও নামের ব্যঞ্জনা ও অর্থের গূঢ়ার্থ এবং রহস্যময়তাও কবিদের স্বকীয়তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কবি ওবায়েদ আকাশের কবিতার বই (১) পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ, (২) নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ, (৩) কুয়াশা উড়ালো যারা, (৪) বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা (৫) ঋতুভেদে, পালকের মনোবৃত্তিগুলি, (৬) শীতের প্রকার, (৭) পাতাল নির্মাণের প্রণালী, (৮) তারপরে, তারকার হাসি, (৯) যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময়, (১০) প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায়, (১১) (১২) রঙ করা দুঃখের তাঁবু, (১৩) বিবিধ জন্মের মাছরাঙা (একটি দীর্ঘ কবিতা), (১৪) তৃতীয় লিঙ্গ (কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা,) (১৫) হাসপাতাল থেকে ফিরে, (কলকাতা), (১৬) ৯৯ নতুন কবিতা, (১৭) পাতাগুলি আলো, (১৮) তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর, (১৯) সর্বনামের সুখদুঃখ, (২০) পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর, (২১) নির্জনতা শুয়ে আছে সমুদ্র প্রহরায়। কবি মিহির মুসাফীর কবিতার বই (১) কুঠার সম্প্রদায়, (২) বহুকৌণিক বাতাসের মুখ। কবি মুজিব ইরমের কবিতার বই (১) মুজিব ইরম ভবে শোনে কাব্যবান, (২) ইরমকথা, (৩) সাং নালিহুরী, (৪) শ্রী। কবি শাহ্নাজ মুন্নীর কবিতার বই (১) রুদ্ধশ্বাস বৈঠকের পর (যৌথ), (২) ক্ষমঃ হে শ্বেত দুগ্ধ, (৩) আত্মঘাতী সুখ। কবি সরকার আমিনের কবিতার বই (১) রুদ্ধশ্বাস বৈঠকের পর (যৌথ), (২) সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, (৩) ইহকাব্য, (৪) আত্মহত্যার পরিবর্তে এক কাপ চা খাও, (৫) ব্লেড দিয়ে কেটেছিলে জল, (৬) চার পাঁচ হাজার পিঁপড়ার দুঃখ, (৭) আমাদের পোষা ট্রেন (৮) যাকে খুন করার কথা তাকে দেখে হেসে ফেলি (৯) বিবাহিত প্রেমের কবিতা। কবি কাজল কাননের কবিতার বই (১) মাটির মড়মড়, (২) পইখ উড়ে যাও। কবি কামরুল ইসলামের কবিতা (১) দ্বিধান্বিত সুখে আছি যমজ পিরিতে, (২) ঘাসবেলাকার কথা, (৩) সেইসব ঝড়ের মন্দিরা, (৪) চারদিকে শব্দের লীলা। কবি কুমার চক্রবর্তীর কবিতার বই (১) লগপুস্তকের পাতা, (২) সমুদ্র, বিষণœতা ও অলীক বাতিঘর, (৩) পাখিদের নির্মিত সাঁকো। কবি খলিল মজিদের কবিতার বই (১) পালকাপ্য। কবি জফির সেতুর কবিতার বই (১) বহুবর্ণ রক্তবীজ, (২) সহস্র ভোল্টের বাঘ, (৩) স্যানাটোরিয়াম। কবি তাপস গায়েনের কবিতার বই (১) সাঁকোশূন্য মহাদেশ, (২) একলব্য নিঃসীম নগরে। কবি তুষার গায়েনের কবিতার বই (১) নীলভব হ্রদ, (২) বৃষ্টির অন্তর ত্রাস। কবি নেহাল আহমেদের কবিতার বই (১) অসম্পূর্ণ দুপুর। কবি বায়তুল্লাহ কাদেরীর কবিতার বই (১) দুঃখের আঙুল নড়েচড়ে, (২) বাতাস তোমার রক্ত পান কর, (৩) ত্রিণাচিকেতের নাচ, (৪) প্রজন্ম লোহিত। কবি মজনু শাহর কবিতার বই (১) আনকা মেঘের জীবনী, (২) লীলাচূর্ণ, (৩) মধু ও মসলার বনে। কবি মামুন মুস্তাফার কবিতার বই (১) কুহকের প্রতœলিপি, (২) পিপাসার জলসত্র। কবি মাহবুব কবিরের কবিতার বই (১) কৈ ও মেঘের কবিতা, (২) ফুলচাষি মালি যাই বলি। কবি হেনরী স্বপনের কবিতার বই (১) মাটির বুকেও রৌদ্রজ্বলে (২) বাল্যকাল ও মোমের শরীরে আগুন, (৩) জংধরা ধূলি, (৪) কাস্তে শানানো মোজার্ট, (৫) ঘটনার পোড়া মাংস। কবি মোস্তাক আহমাদ দীনের কবিতার বই (১) কথা ও হাড়ের বেদনা, (২) জল ও ত্রিকালদর্শী, (৩) জল ও শ্রীমতী ইত্যাদি।
এবার দেখা যাক কবিদের ব্যক্তিক-বিকাশ ও বৈশিষ্ট্য-স্বকীয়তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অথবা দৃশ্যমান অনুষঙ্গ-প্রবণতা। কবি ওবায়েদ আকাশ কবিতার গদ্যে বিকশিত এক কবিসত্তা। তবে তার পদ্যের বিনুনীও অনুধ্যেয়। তিনি অতীতবোধ, রাজনীতি, সংকট আর প্রধানত লোকজ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আবার কখনো কখনো নগরজীবনের বাস্তবতাকেই বাক্সময় ও বিকশিত করতে বেশি মাত্রায় পারঙ্গম। যেমন
১। কেউ ফুটপাত ধরে হাঁটছে
যাবজ্জীবন ঘুমের কথা আপনার মনে পড়ছে নাতো!
[কবিতা : একটি সাম্প্রতিক কবিতার খসড়া; বৈশিষ্ট্য : নগর সংকট ও মরমিতত্ত্ব]
২। প্রতীক বিশ্বের দিকে আমার অন্ধত্বকে খুঁজে দেবো ভাষা
আর যাদুবাস্তবতা, তুমি দেখো এই মায়াবিশ্বের ব্যাপারগুলো
পরস্পর সম্বন্ধতাড়িত হয়ে
আমার যে পরস্ত্রীকাতরতা ভর করেছিলো
আর আমার মহাত্মা ধানজমিগুলো
এক এক করে
জলের দামে বিকিয়ে দিয়েছিলাম...
ঐ ধানের জন্য মায়া, আর
ঋণের জন্য খুলে দিয়েছিলাম অন্দরের সিঁড়ি...
[কবিতা : সাম্প্রতিকগুলো; বৈশিষ্ট্য : অধিবিদ্যা ও নাগরিক ঈর্ষাবোধ]
পাশাপাশি তার গদ্যধারার কবিতাগুলিতে তিনি জীবনের সামগ্রিকতাকে প্রতীকী ও উপমাতাড়িত করে প্রকাশে যেন উৎসাহী। ‘শূন্যতার রাত্রিদিন’, ‘প্রিয় কবিদের রন্ধনশায়’...ইত্যাদি কবিতায় গল্প, চিত্র বর্ণনার মাধ্যমে তিনি যেন পদ্য আর গদ্যের দূরত্বকে প্রশমিত করে চলেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য আরো কাব্যগ্রন্থের নাম পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর, তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর, সর্বনামের সুখদুঃখ, পাতাগুলি আলো এবং নির্জনতা শুয়ে আছে সমুদ্র প্রহরায়। প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে সম্পূর্ণ নিজস্বতা ও অনন্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
কবি মিহির মুসাকী প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা, রসবোধ ও লোকজ-বাস্তবতায় জীবনকে কাব্যময় করার সদিচ্ছায় উদ্বুদ্ধ। তিনি ঐতিহ্য আর সরলতাকে উপজীব্য করে নাগরিক-জটিলতাসিক্ত জীবনকে তার কবিতায় তুলে আনেন। মূলত গদ্যধর্মী হলেও মুক্তক অক্ষববৃত্তের কিছুটা ছোঁয়াচ তার কবিতার পদ্য-স্বকীয়তাকে নান্দনিক করেছে।
১। পরিত্যক্ত বাসাবাড়ি, হেমলক
পড়ে আছে ধূপছায়া স্বপ্ন
সবকিছু হবে আজ পোস্টমর্টেম
[কবিতা : বাসাবাড়ি হেমলক, বৈশিষ্ট্য : প্রাত্যহিক জীবন, তিক্ততা ও জৈবিক সংকট]
২। মেঘের ওপাশ থেকে কি দেখ তোমরা?
অলীক-কাকের উড়ে যাওয়া ধূসর অতীত?
কুয়াশার কুটিল কাঠামো ভেঙে
ছায়ারা কি হেঁটে যায় ধাতব বৃক্ষের দিকে?
জিরাফের মত বাড়ায় গ্রীবা আগুন-বৃষ্টিতে?
[কবিতা : নির্বাহী আত্মা, বৈশিষ্ট্য : দার্শনিক জিজ্ঞাসা ও অধিবিদ্যাবোধ]
কবি মুজিব ইরম লোক-ঐতিহ্যতাড়িত সরল পদ্যের কথক। জীবনকে গ্রামীণ-চেতনাবোধ, লোকযান ও পুঁথিকারদের ঢঙে কাব্যময় করার একটা প্রয়াস তার কবিতায় লক্ষণীয়। তিনি শেকড়বোধকে বর্ণনে, কথনে, সারল্যে, গদ্যভাব ও ভাষায় বিম্বিত করে তার পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। বিষয়ের অভিনবত্ব ও জটিলতার চাইতেও সারল্য, বিমূর্ত-অভিকল্পই বেশি বেশি প্রকটিত তার কাব্যে।
১। কী করে ফেরাবে মাগো! নই শিশু, ঝরে গেছে পরীদের ডানা। শানেবান্ধা ক্ষত নিয়ে সপ্তডিঙ্গা নগরে ভাসে।
[কবিতা : আঁতুড়ভয়, বৈশিষ্ট্য : জন্মসত্য ও পুঁথিতত্ত্বের অধিবিদ্যার সারল্য]
২। এই পাতাবাহারে আমার মজে গেছে মন
ফলে তার পাশে যতো সুবাস রয়েছে কৌলীন্য সকাশে
দেখি না কখনো তার সুঘ্রাণ মধুর
[কবিতা : পাতাবাহার, বৈশিষ্ট্য : প্রকৃতিবোধ ও সরলতা]
কবি শাহ্নাজ মুন্নীর কবিতায় গতি ও প্রগতির সম্মিলন রয়েছে। তিনি দেখার বোধ ও বিশ্বাসকে প্রশ্নসত্যে চিত্র আর সংকটের প্রেক্ষিতে উপলব্ধিজাত করে তুলেছেন। যেমন
১। গরুর শিং-এর উপর ঘুরছে যে পৃথিবী
সেই পৃথিবীতে বাসা বেধেছি
যখন সূর্য হারিয়ে ফেলে আলো
তখন তোমার আলোয় সে বাসায় ফিরে আসি,
[কবিতা : সেই পৃথিবীতে, বৈশিষ্ট্য : সংসার ধর্মবোধ ও মানবের প্রেমাশঙ্কা এবং চিত্রকাব্য।]
২। সারিন্দা বাজায় বুঝি কোন নিরাকারে
কপাটে কখনো দেখি তাহাকে সাকারে
তুমি কি মৃন্ময় প্রভু, তুমি কি চিন্ময়?
[কবিতা : সুর বন্দনা, বৈশিষ্ট্য : লোকতত্ত্বে জীবনের আধুনিকতা ও কাব্যধারা।]
কবি শিবলী সাদিক জীবনের জটিলতাকে ঋতুবোধে, লোকতত্ত্বে এবং নাগরিক দৃষ্টিদৃক্ষায় কাব্যময় করার প্রয়াস চালিয়েছেন। তার কবিতা প্রকৃতিজাত, দেশজ ও প্রতীকধর্মী অভিকর্ষে যেন চলিষ্ণু ও বাক্সময়।
১।কৌম নৌকা নিয়ে ঘুরব আমরা নগ্ন দেহে
জলের অলীক নম্রতায়, বালুগ্রহে, পাতার সীমান্তে
উৎসবের মুখে তোমাতে আমাতে যূথবদ্ধতায়।
[কবিতা : সবুজ আলোকবর্ষ, বৈশিষ্ট্য : মিলন ও প্রকৃতিতত্ত্ব]
২। অন্ধ প্রজাপতি মত্ত হয়ে রসে দেখি না কিছু,
জাগছে সবখানে নিমেষে ফুলরঙে ফুল সকাল,
মুহুর্মুহু ফুল আমাকে সবটুকু দেখে ফুটছে।
[কবিতা : কারা যেন আমাকে দেখে ফেললো, বৈশিষ্ট্য : প্রকৃতিবোধে জৈবিক সংকট।]
কবি সরকার আমিন শূন্যতার আঁধারে আঁকেন চিত্রময় কবিতার জগৎ। তবে তার চিন্তায় সংকটের প্রকাশ, জীবনবাদ, মরমিতত্ত্ব, নস্টালজিয়া, অধিবিদ্যা আর নাগরিক জটিলতারই প্রাধান্য বেশি। যেমন
১। রাতের তোষকে ডাকে আমাকে বৃষ্টির বিষফল
নিখিল স্তনাগ্রে যেন আঙুর ফল যেন নিখাদ কামড়
[কবিতা : হলুদ শখ, বৈশিষ্ট্য : ব্যক্তিগতবোধের বিশ্ব বৈশ্বিক চেতনা]
২। আত্মহত্যার পরিবর্তে তুমি যদি আত্মহত্যাই করো, করো
কিন্তু তার আগে জেনে নাও হত্যাকা- কাকে বলে
হত্যাকে আত্মসঙ্গত করার জন্য কতগুলো
হত্যাকা- ঘটেছে এবং ঘটতে থাকবে।
[কবিতা : আত্মহত্যার পরিবর্তে ১ কাপ চা খাও, বৈশিষ্ট্য : বোধের বিকাশ ও বিবেকী আধুনিকায়ন]
কবি তাপস গায়েন বৈশ্বিকবোধে তার অভিবাসী জীবন ও দেখার নিপুণ চোখে মিথের শক্তি, লোকযান, জাদু-বাস্তবতা আর অন্তর্লীন শূন্যতা বোধে এঁকেছেন তার কাব্যকলা ও কথন-রথ। একদিকে যেমন ছন্দোবোধ অন্যদিকে ভাঙনের গদ্য-কল্পে বিম্বিত তার কাব্যময়তা।
১। যুদ্ধশেষে পৌরাণিক দেহ কারা নেবে তুলে
প্রজাপতি লুপ্ত করো কাল, অনামিকা দেহ
বিভ্রমের রূপ লিখে রেখো ছায়াপথ জুড়ে
তোর দেহের ছায়ায় অনঙ্গ হয়েছি বহুকাল
দৃষ্টির লাবণ্যে দিকভ্রষ্ট, অন্ধ আমি গ্রহান্তরে
[কবিতা : সাঁকোশূন্য মহাদেশ, বৈশিষ্ট্য : অন্তর্লীন-শূন্যতা]
২। চক্রব্যূহে আমি : অভিমন্যু মাতৃহীন, বর্মহীন।
[কবিতা : অভিমন্যু, বৈশিষ্ট্য : পৌরাণিক আধুনিকতা]
কবি তুষার গায়েনও শেকড়জাত বোধে, শূন্য সংকটতাড়িত জাগতিক বাস্তবতার চিত্র তুলে আনতে পারঙ্গম। তার চিন্তায় যেমন উড্ডীন-বাস্তবতা উঠে আসে তেমনি জীবনের প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ, মুক্তিযুদ্ধ ও লোকযানের আধুনিকায়নও বিম্বিত। তিনি ছন্দকে উপলক্ষ করে গদ্যের বিনুনী দিতেই সিদ্ধহস্ত। তবে তার দেখার চোখ এবং বিষয়বস্তু নির্বাচনের বহুমাত্রিকতা তার পাঠককে দৈশ্বিক ও বৈশ্বিক অভিজ্ঞানে পরিপক্ব হয়ে উঠতেই উৎসাহী করে তোলে। যেমন
১। ভাঙা চুড়ি দেখতে পাই ... ‘কার এ শাঁখা
ভাঙা চুড়ি? কেঁদে ওঠেন কাজলদিদি
‘একাত্তরে মাঠ পেরোতে, খানসেনারা
আমায় ধরে!’...
[কবিতা : একাত্তরের খনি, বৈশিষ্ট্য : মুক্তিযুদ্ধ অনুষঙ্গ ও বাস্তবতা]
২। ঠাকুর্মা গল্পের মতো কথা বলে যেন এক পৌরাণিক পাখি
গেয়ে ওঠে গান, কণ্ঠে সোনালী তরঙ্গ তার শুধু পাকা ধান হয়ে ঝরে
ঠাকুর্মা ধানের কথা বলে কতদিন বলেছে এমন!
ধানগুলো ধীরে ধীরে আঁধারের গায়ে সাদা খই হয়ে ফুটে গেছে
স্বপ্নের মতোন ঝরে গেছে তারপর ঠোঁটে তার সাদা খই
[কবিতা : বাউল গাইতে পারি যেন, বৈশিষ্ট্য : জাদু ও লোক-আধুনিকতা]
কবি নেহাল আহমেদের কবিতাভুবন প্রেম ও শেকড়জাত বিশ্বাসের অনুষঙ্গে নাগরিক সংকট, জিজ্ঞাসা আর আত্মপীড়নের কথকতায় চলিষ্ণু। তিনি স্মৃতিচারণবাদী তবে অসম্পূর্ণ দুপুরের মতোই দ্বান্দ্বিক ও বিকাশমান, প্রশ্নবাণ। যেমন
১। এখন আত্মহত্যা পরিত্যাগ করার কোনো গ্লানি নেই আমার।
অন্ধকার আকাশে চেয়ে, আমি তার
স্তদ্ধতার গান শুনলাম।
ঈশ্বরের দেবতারা নাস্তার টেবিলে খুঁজবে তার সান্নিধ্য।
আর জানতে চাইবে নির্বাসনের পথ।
[কবিতা : স্তব্ধতার গান, বৈশিষ্ট্য : সংকট ও উপমা-উদ্ভাবনবাদী]
২। যে বন্ধ্যা মৃত্তিকায় রোপণ করেছিলাম
সারারাত কুড়িয়ে আনা কুমারী বিশ্বাস
মহৎ বৃক্ষের মত
প্রতিদিন যা আমরা আলিঙ্গন করতাম।
[কবিতা : কুমারী, বৈশিষ্ট্য : প্রেম ও শেকড়বিশ্বাস]
কবি বায়তুল্লাহ্ কাদেরী লোকরীতির অনুষঙ্গে জীবনের সরলতাকে তার কবিতার অনুষঙ্গ করতেই পারঙ্গম। তার বোধের বাস্তবতাই হলো নগরের চোখে গ্রামীণতার উত্তরণ। যেমন
১। বায়োস্কোপে চোখ রেখে দেখে আছি অতি অভিভূত
চলছে গাড়ির সারি, চলে যাচ্ছে শহরে শহর
বায়োস্কোপে যাচ্ছে নারী, যাচ্ছে তার আয়নাটি, যায়
লালফিতে-সুটকেশ, বেঢপ ডোলের মতো যাচ্ছে
[কবিতা : বায়োস্কোপ, বৈশিষ্ট্য : লোক-আধুনিকতা]
২। ঘুমায়ে আছেন তিনি, জেগেছেন চোখের মস্তিষ্কে
আঙুল উঁচায়ে পৃথিবীর দাম হেঁকে বলিলেন : পাঁচসিকে
জাগিয়া আছেন তিনি ঘুমায়েছিলেন হয়তো ক্ষণিকে
পা-ফেলিয়া চলে গেছে ইতোমধ্যে বহুদিবসের পূজারী শালিকে!
[কবিতা : অধিজগৎ, বৈশিষ্ট্য : মাজার ও মরমি-আধুনিকতা]
কবি মজনু শাহর কবিতা মিথ-ঐতিহ্য, লোকযান আর জাদু-বাস্তবতার মিশেলে নাগরিক দৃষ্টিবোধের চিত্রকল্প। পুঁথির বয়ান, আদিকথন লোকধারাকে তিনি তার গদ্য ও পদ্যরীতির শৈলী-সাপেক্ষ কাব্যশক্তি দিয়ে চিত্রিত এবং বিম্বিত করেছেন। যেমন
১। যখন কাঠের ঘোড়া লাফ দেয় তমসার জলে,
জাগে বাতিঘরে কেউ, বিশুদ্ধ ঘুমের মদে ডুবে
আর আমি কেন দেখি বারবার দেবতার রোষ!
কাঠের ঘোড়ার পিঠে একদিন স্মৃতিশস্য নিয়ে
চূড়ান্তে পৌঁছব বলে ধূলিতীর্থে ঘুরেছি ব্যাপক;
[কবিতা : লীলাচূর্ণ ২, বৈশিষ্ট্য : সনেট রীতিতে লোকধারার আধুনিকায়ন]
২। আমি পড়াই জেব্রাদের স্কুলে। আমার মা বাবা ভাই বোন কেউ নাই, বস্তুত, আমি বড় হয়েছি একটা লাল রঙের মাদী শেয়ালের কাছে। পাহাড়ের হা-য়ের মধ্যে যেখানে আমাদের বাড়ি, তার সামনে বসে দেখা যায় জলত্যাগী একঝাঁক কৈমাছ কান দিয়ে হেঁটে কাব্যসমালোচককে ধাওয়া করছে।
[কবিতা : জেব্রা মাস্টার, বৈশিষ্ট্য : জাদুবাস্তবতা]
কবি মামুন মুস্তাফা তার কবিতায় জীবনের বালখিল্য ধারাক্রমকে ইতিহাসবোধ, রাজনীতি, যৌনতা আর সংকটের আবর্তে বিম্বিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি রহস্যময়তার অন্তরালে মানুষের বিবেকে প্রশ্ন সৃষ্টি ও ব্যঞ্জনাভাবের বিকাশের সপক্ষেই যেন কাব্যধারার প্রবর্তক। যেমন
১। সাবিত্রীর জানালা খোলা
জোছনা তার সবটুকু শরীর
ঢেলেছে সাবিত্রীর বিছানায়।
সাবিত্রী নবজাতককে দুগ্ধ দ্যায়।
[কবিতা : সাবিত্রীর জানালা খোলা, বৈশিষ্ট্য : প্রেম ও অবিশ্বাসের মাঝে জীবনাচার]
২। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে কণ্ঠিনালার পাড়ে
ওকে হাত ধরে নিয়ে এসো কেউ
চৈত্রসংক্রান্তির আগে।
[কবিতা : কণ্ঠিনালার পাড়ে, বৈশিষ্ট্য : জীবন ও সংকটের বাস্তবতায় ইচ্ছে প্রকাশ]
কবি মাহবুব কবির জীবনকে প্রতীক আর উপমাতাড়িত চোখে দেখার সরলতাসিক্ত প্রত্যয়ে যেন প্রদীপ্ত। একদিকে তার মারফতি (মরমি) ইচ্ছে অন্যদিকে স্বপ্নসংকট, পলায়নবাদী মানসশৈলী বিম্বিত করেছে তার কবিতার নতুন অভিযাত্রা। স্ব-কথন, স্বল্পবাক্য আর দেখার ভিন্নতাই তার কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তবে তিনি আদি বাৎসল্য ধারার অনুষঙ্গেও পারঙ্গম। যেমন
১। এখন আমি মগড়ার ব্রিজে, রেলিতে হেলান দিয়ে
হাওয়া খাচ্ছি, ফলে
অজস্র মেঘের জন্ম হচ্ছে হৃদয়ে আমার
আকাশ উপুড় করে বৃষ্টি হবে বলে।
[কবিতা : বৃষ্টি হবে, বৈশিষ্ট্য : প্রকৃতিবাদ ও আত্মতৃপ্তিবোধ]
২। বউ লুঙ্গি দিয়ে বেঁধে ভাত পাঠায়।
চড়–ইয়ের মাংস খেতে খেতে কোকিলের গান গাই।
[কবিতা : বীজধান চড়ুইয়ে খায়, বৈশিষ্ট্য : লোকধারা ও সংকট চিত্রকল্প]
কবি মোস্তাক আহমাদ দীনের কবিতায় জীবনের ছোট ছোট বিষয়ের সাথে শূন্যতা, বৈষম্য, যৌনতা, প্রেম ইত্যাদি বহু অনুষঙ্গই সম্পৃক্ত। তিনি তার কবিতায় মরমিবাদ থেকে শুরু করে চিত্রকল্পবাদ ও প্রতীকধর্মিতার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন ক্ষেত্রবিশেষে মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।
১। আজ বিস্মরণের দিন, আজ এংকা পথে ঘুরিতেছি
আনত দু-হাত নিয়ে
জন্মলজ্জা ফেলে দিতে শূন্যে শূন্যে খুঁজিতেছি গলা
[কবিতা : জন্মলজ্জা, বৈশিষ্ট্য : বাস্তবতা ও বিমূর্তের যৌথ সম্মিলন। সমাপ্তিহীন।]
২। তুমি ক্লান্ত আর বহু দূরাগতা,
চুপে চুপে এসে মিশে গেছ
শান্ত আতরদানে, মর্জিমহলে
[কবিতা : ময়ূর, বৈশিষ্ট্য : চিত্রকল্পবাদ ও সংসারতত্ত্ব]
কবি কাজল কানন তার কবিতায় মানবিক সমর্পণবোধ দেখা না দেখার অনুভূতি আর স্বপ্নময়তা ও নারীবাদী চিন্তার বেড়ে ওঠাকে বিম্বিত করেছেন। মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নেপথ্যে গদ্যধারাই তার কবিতার উপজীব্য। যেমন
১। নাছিমা খালা, রাশিদা আপা ভরসাভরা নদী
জীবন থেকে জীবনে গ্যাছে যাদের কীর্তি
মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি গাঁওয়ালের ছায়া
কোনদিনই বড়ো হতে চাইনি
চেয়েছিলাম ফাটা ফালগুনের মাঠ
এক ধরনের রমণীয় তন্দ্রাছাওয়া খেলনাপাতি
[কবিতা : লক্ষ্য উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য : নারীর বেড়ে ওঠা ও শৈশবচিত্র]
২। ঘুড়ি উড়িয়েছে যে ছেলেটি
মহাশূন্যের দিকে যার চোখ বাড়ানো
তার সঙ্গে ঈশ্বরের ভাবগল্পে
ধরা পড়েছিল যাদুময়তার ঘোর!
[কবিতা : তত্ত্ব, বৈশিষ্ট্য : জাদু-বাস্তবতা]
কবি কামরুল ইসলাম তার কবিতায় পদ্য ও গদ্যধারা ব্যবহার করেছেন যেন অক্ষরবৃত্তীয় আদলে। অনুষঙ্গ হিসেবে নস্টালজিয়া, জীবনের বাস্তবতা, সংকট, শেকড় সন্ধানী অভীপ্সা, শূন্যতাবোধ, জাদু-বাস্তবতা এবং মরমিতত্ত্বের ইতিধারা। যেমন
১। আমাদের বীজ বপনের আদিম কৌশল পাশে এসে বসে আর
আমাদের বাহুগুলো ঢিল-ভাঙা শব্দের ভেতর নবীন দোতারা
বেজে ওঠে বাবলা পাতার শৈশব দাঁড়ভাঙা রোদের খোলসে
শব্দের বিবিধ লীলায় উজানে ডিঙা বায় অচিন সাধুরা ভজনে, সাধনে
[কবিতা : চারদিকে শব্দের লীলা, বৈশিষ্ট্য : মারফতি বাস্তবতা]
২। ঘোড়ারা ঘাসহীন দলে দলে
ঘাসের পরানে বাজে শূন্যতা
ও ঘাস, ও শূন্যতা, তোমরা আমাদের উঠোনে আজো
বিবিধ তৈজস
[কবিতা : আমাদের কিছু ঘাস ছিল, বৈশিষ্ট্য : শূন্যতাবোধ ও চিত্রময়তা ]
কবি কুমার চক্রবর্তী গদ্যধারার রীতিতে পদ্যে কবিকথন, নস্টালজিয়াবোধ, জিজ্ঞাসা তথা আদিরস ও সংকটে কখনো কখনো মায়াবাদী জৈবিকতায় জীবনকে এঁকেছেন। যেমন
১। পাখি আর আকাশের হাহাকার
অজ্ঞাত আর বিষণœ
অবলম্বনের মতো গুনগুন
আর এই নিঃসঙ্গ চিহ্ন ইচ্ছাহীন অস্তিত্বের ভেতর এখন
স্তব্ধতার সংকেত সাজায়।
[কবিতা : স্তব্ধতার সংকেত; বৈশিষ্ট্য : সংকট সৃষ্টিক্রম]
তোমার সাথে কথা বলা মানে সময়ের সাথে কথা বলা
তোমার সাথে পথ চলা মানে নদীর সাথে পথচলা
[কবিতা : কুহক; বৈশিষ্ট্য : মায়াবাদী জৈবিকতা]
কবি খলিল মজিদ স্মৃতিতাড়িত ভাবনায় লোকজ ধারার সম্মিলনে, প্রেম, মরমিতত্ত্ব আর নাগরিক সংকটবোধের শব্দসিক্ত গভীরতাকে অঙ্কন করেছেন। কবিতার বহুরঙা শৈলী কখনো মুক্তক অক্ষরবৃত্তের ধারাপাতে বিম্বিত তবে পরিব্যাপ্ত নয়।
১। পড়ো মন্ত্র দাহো মুখ
স্তোত্র সংস্কার স্বপ্ন সুখ
পুচ্ছ শিখায় তুচ্ছ জ্ঞান
জ্বালো জপ-তপ-ধ্যান
আনো জন্ম গুপ্তকাল
অগ্নি মাথা জয়-মশাল
[কবিতা : প্রিয় সর্পিণী, বৈশিষ্ট্য : গুপ্তিমন্ত্র ও প্রেম]
২। কলকল গোমতী জল অতল পাতাল থেকে ফুঁসে ওঠে
উঠিছে ফুঁসিয়া, শরীরের তন্ত্রী বেয়ে বিস্তারিছে বিদ্যুতের ফণা
একটি নিপুণ প্যাঁচ ও পদ্মিনী তোমার কোমর ঘিরে
একটি দারুণ প্যাঁচ ও শঙ্খিনী কু-লিত কানুর সাধন
[কবিতা : প্রিয় সর্পিণী, বৈশিষ্ট্য : লোকজধারা]
কবি জফির সেতু শৈশব ও পারিবারিক অনুষঙ্গে প্রেম ও বাড়ন ঋতুবোধের সারল্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে ছান্দসিক নান্দনিকতাতাড়িত সৌকর্যকে প্রাধান্য দিয়েই তার কাব্যভুবন সৃষ্টি করেছেন। যেমন
১। উঠোনে কবুতরের রক্ত
সারা বুবুর হাতে কাঁপছে নীল পাখি
এ বছর তার বিয়ে;
[কবিতা : দৃশ্য, বৈশিষ্ট্য : লোকজধারার চিত্রকল্প]
২। অদিতি টোটকা করে আমাকে পাথররূপে রেখে
গেছে ধ্বংসস্তূপের কাছে। অদিতির বিরল প্রস্থান
আমি নীরবে দেখেছি কেঁদেছি-কুদেছি আর যত
রাতজাগা ঘোড়া হয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে জাবর
কেটেছি।
[কবিতা : টোটকা, বৈশিষ্ট্য : মায়াবাদ]
কবি হেনরী স্বপন অসম্ভব বাস্তবতাকে নাগরিক দেখন হাসির অনুকল্পে, লোকজধারা ও মিথের নব-ব্যবহারে পারঙ্গম। তবে উপমা সৃষ্টি ও জাদুবাস্তবের সাপেক্ষে বিমূর্ততাকে উপজীব্য করাই তার কবিতার অন্যতম একটি বিশেষ দিক।
১। জড়িয়ে ধরবে আঁশে; পাটক্ষেতে পালালে
হাওয়ায় আঁচড়াবে কুমারী আয়নার সম্মুখে
[কবিতা : দুধ বানের তরল, বৈশিষ্ট্য : কুমারীতত্ত্ব ও কাব্যচিত্র]
২। পদ্ম-গোক্ষুর সাপের কামড়ে
ভ্রমরের বিষ পর্যন্ত নামিয়েছিলে পুকুরের জলে...
[কবিতা : বেসিনের সিরামিকে সাদা পা-ুলিপি, বৈশিষ্ট্য : লোকবিশ্বাস]
কবিদের ছন্দোজ্ঞান ও প্রকরণ শৈলী নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। এর সদুত্তর নব্বইয়ের কবিদের মধ্যে বিশেষভাবে বা বিশেষ অর্থে লক্ষ্যণীয় নয়। বাংলা কবিতার তিনটি প্রধান ছন্দ যেমন ১. অক্ষরবৃত্ত ২. মাত্রাবৃত্ত ৩. স্বরবৃত্ত। এই তিনটি ছন্দ আবার মুক্তক হতে পারে, মিশেল হতে পারে, গদ্য ধারার বিনুনীর মতোও হতে পারে। তবে এসব সত্ত্বেও মূলত ছন্দই কবিতার প্রাণ বা অন্তরের অবকাঠামো। কেননা কবিতা যদি ছন্দহীন হয়ে যায় তবে তার ভেতরে কবিদের কাব্যশক্তি প্রকটিত কিংবা শক্তি সৌকর্যপূর্ণ হতেই পারবে না। একজন কবি তার কবিতা লেখার প্রথম দশক তো ব্যয় করেন ছন্দ রপ্ত করারই কাজে। তাই ব্যাপক অর্থে ছন্দ আয়ত্তে না থাকলে কবি তো বুঝতেই পারবেন না ব্যঞ্জনাবোধ, চিত্রকল্পশক্তি তথা শব্দব্রহ্মাকে। আসলে ছন্দই কবিকে কবিতা লেখার সময়ে দিকভ্রান্ত হবার হাত থেকে রক্ষা করে। ছন্দই কবিকে শিক্ষা দেয় শব্দ ব্যবহার এবং এর পরিমিতিবোধ। ছন্দই কবিতার চরণের লাগাম টানতে পারে ও রক্ষা করতে পারে ভারসাম্যহীনতার জটিলতা থেকে। ছন্দই পারে কবিতাকে গদ্যের সারল্য দোষ ও গদ্যগন্ধ থেকে মুক্ত করে ব্যঞ্জিত করতে। সেজন্যই ছন্দ পরিত্যাজ্য তো হতেই পারে না বরং অলঙ্কারের স্বরূপকাঠী এবং কবিতার বিষয় ও প্রকরণের ব্রহ্মাস্ত্র। ছন্দোবদ্ধ কয়েকটি চরণের উদাহরণ দেওয়া হলো
১। কফি হাউসের রোদে।৮
ফোলা ফোলা গাল বসে।৮ থাকে মরুভূমির নাভি।৮
ধারী ধারী পাছা
কবি : ওবায়েদ আকাশ
ছন্দ : অক্ষরবৃত্ত
২। আমার মজেছে মন।৮ পাতায় পাতায়।৬, সকল ফুলের চেয়ে।৮, পাতাবাহারের ঘ্রাণ।৮ কেউ কি পেয়েছে টের।৮ এতোসব ফুলনারীদের পাশে!৮
কবি : মুজিব ইরম
ছন্দ : অক্ষরবৃত্ত
৩। ঝড়োল্লাসেই/৬ এসো এসো চুল্লিকা,/রসোল্লসিত হল্লামুখর/৬
কবি : বায়তুল্লাহ কাদেরী
ছন্দ : মাত্রাবৃত্ত/ছয় মাত্রা
৪। ঘুমের ভেতর/৪ এসে পরী
যাদুকরী/৪ হাসে মৃদু/৪ হাসে হাতে দ-/৪ ইচ্ছা পূরণ/৪ চাও কি কবি/৪ অন্য জীবন?
কবি : শাহনাজ মুন্নী
ছন্দ : স্বরবৃত্ত
আমরা জানি, আদিরসাত্মক ভাবনাবোধ ও যৌন চিন্তায় কাব্য স্বকীয়তা সৃষ্টির প্রয়োগ কবিদের একটি চিরন্তন ধারাক্রম। তবে নব্বইয়ের দশকের কবিরা এ ধারায় প্রাগ্রসর কিন্তু ব্যাপক অর্থে নয়। কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো
১. সিস্টার (নার্স) আপনার ফ্রকের হুঁকগুলো খুলে যাচ্ছে কেন?
ম্যাডাম (ডাক্তার) আপনার অ্যাপ্রোনটি ভীষণ উড়ছে বাতাসে
(একটি সাম্প্রতিক কবিতার খসড়া : ওবায়েদ আকাশ)
২. কুয়াশার ফালি আর সময়ের সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে
ডাবকথার পরের কথারা অতঃপর শিশ্নবাজ মাঝির চোখে
জাল ও জলের গল্প বিনির্মিত পিতৃত্বের তলে ডুবে যায়
(নিষ্প্রাণ ডাবের ভাসান : কামরুল ইসলাম)
৩. স্তব্ধতার ভেতর জেগে থাকা দেবতা আমার
চর্তুদিকে ঋতুর গভীরে জেগে ছিল খামালের মতো
বিশাল জোনাকির স্তন।
(ঠিক এভাবেই আমরা চেয়েছিলাম নক্ষত্রের পানে : কুমার চক্রবর্তী)
৪. আসিবে আশ্বিন মাস, ক্ষীণস্তনা বৃদ্ধা রাধিকা ও গ্রামে যবে
মনুর মন্ত্রের মতো ধান ভরে বিশল্যকরণী হবে।
(ধানসত্য কবিতা সিরিজ : এক : খলিল মজিদ)
৫. আমাদের এই যে আসঙ্গলিপ্সা ও যৌনতা
তা শৈশবেরই পুনরাবৃত্তি
(শরীরের সব তীর খুলে : জফির সেতু)
৬. রতিধর্মে গাঢ়রসে হৈল মাটি ফাঁক
ঊর্ধ্বমুখী দেহধারী প্রগাঢ় প্রচাপে
সাঙ্গা করে ডুবে যাই আলিঙ্গ আধার
(নীলভবহ্রদ : তুষার গায়েন)
৭. যে অমিত সরস্বতী পূজায়
সরস্বতীর স্তন দেখে শরীরী উত্তেজনার মতো।
(হঠাৎ কনিকার সাথে দেখা : নেহাল আহমেদ)
৮. শাড়ি-ব্লাউজের বেলাল্লাপনা জাগবে নটীতে
এসো শিখা-তেজা! রসোল্লসিত যোনি-ভোতৃকা-ধোঁয়া-কু-লে
হৈ-হুল্লুড়ের চিল্লাবিল্লা শেষে
ভাল্লাগে যত, তুল্য ওজোনাঙ্কে...
(প্রজন্ম লোহিত ৩১ : বায়তুল্লাহ কাদেরী)
০৯. নারী-যৌনচুলা। ঘুঙুর পরা বেড়াল হয়ে থাকে
প্রদক্ষিণ করি। সারারাত জ্বলে সবুজ লণ্ঠন,
পিপুল গাছের থেকে জন্ম নেয় আরো অন্ধকার।
(লীলাচূর্ণ ৪ : মজনু শাহ)
১০. অবশিষ্ট শুধুই শরীরাংশ, ঈষৎ বাঁকা
পশ্চিমগামী সূর্যের নিভে আসা রোদে
চুম্বনের গাঢ় মসীলেপ।
(কণ্ঠিনারার পাড় : মামুন মুস্তাফা)
১১. যেন জন্তু মেয়েটি
মানুষ ও জন্তুর শীৎকার একই।
(পাকা ধানে মই : মাহবুব কবির)
১২. আমি মণিপুরী কৃষানীর চাষের কৌশল দেখে হেঁটে গেছি পাড়ায় পাড়ায়। আমার কবিতা তাই ফর্সা উরুতে লাগা মণিপুরী রমণীর পেঁক। থকথকে লুদ।
(ইরম যখন ইরমকথা কয় : মুজিব ইরম)
১৩. জলের শরীর নিয়ে
ও বধূ সূর্যের প্রেমে পড়েছি
প্রবল দুপুর দেখো এই বেলা ভেসে যাই
প্রেম-টানে পাই পাখা, বাষ্পজীবন
(সূর্য প্রেমিকা : শাহ্নাজ মুন্নী)
১৪. পিউরির বেদনাও অন্ত্যমিলে যায়
তিসিক্ষেতে চর্বি গলে গর্ভবতী প্রেমিকার তেলরঙ শুকিয়ে ঝরবে
(তিসি ক্ষেত্রের চর্বিতে : হেনরী স্বপন)
তবে যৌনতা প্রকাশে এ সময়ের কবিদের শালীনতাজ্ঞান ও ব্যক্তিসত্তার নিজস্বতা এবং মার্জিত মার্জনাবোধই যেন প্রকটিত। এটাই এখানকার বিশেষত্ব হলেও বাস্তবতা কিন্তু অনেকটাই এগিয়ে আছে।...
[লেখাটি নব্বইয়ের দশকের ব্যতিক্রমী কবি ওবায়েদ আকাশ সম্পাদিত বিকল্প চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন “শালুক”-এর ‘বাংলা ভাষার নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবিদের কবিতা’ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধের বাংলাদেশ অংশ]