‘তিন সঙ্কট’ নিয়ে চিন্তিত যশোরের চামড়া ব্যবসায়ীরা। ট্যানারি মালিক ও ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে পাওনা বকেয়া; লবণের দাম বৃদ্ধি এবং শ্রমিক সঙ্কট । এছাড়া চামড়া পাচারের আশঙ্কাও রয়েছে ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে দরকার ঋণ সুবিধা। একইসঙ্গে বাজার চাঙ্গা করতে ইউরোপের বাজার ধরতে সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশাসন বাজার স্থিতিশীল ও চামড়া পাচার বন্ধে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে। একই সাথে চামড়া সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণে লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোতে বিনামূল্যে লবণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
রাজারহাট দেশের বড় চামড়ার মোকাম। এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে তিন শতাধিক আড়ৎ রয়েছে। শনি ও মঙ্গলবার দুইদিন বসে হাট। এখানে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ছাড়াও ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর এবং ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীরা চামড়া বেচাকেনা করেন। এই হাট ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার ছোট বড় ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। ঈদ পরবর্তী প্রায় শত কোটি টাকার চামড়া হাতবদল হয় এখানে। কিন্তু ট্যানারি মালিক ও মহাজনদের কাছে থাকা বকেয়া আদায় না হওয়ার পাশাপাশি হঠাৎ লবণের মূল্যসহ শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিতে চামড়ার ব্যবসায়ীরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।
বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সহসভাপতি সাঈদ আহমেদ নাসির শেফার্ড বলেন, সরকার মফঃস্বলে গরুর চামড়া ৫৫ টাকা বর্গফুট নির্ধারণ করেছে। তবে সরকার নির্ধারিত দামে ট্যানারি মালিকরা যেন চামড়া ক্রয় করেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরাসহ সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ঢাকার ট্যানারি মালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের কাছে এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের শত কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে। এর সাথে ঈদের আগেই লবণের প্রতিবস্তার দাম ৭শ’-সাড়ে ৭শ’ টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে ১১শ’ টাকায় দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের বাড়তি মজুর ও সঙ্কটও দুশ্চিন্তার কারণ।
রাজারহাটে হাটে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ব্যবসার অবস্থা এবারও খারাপ হবে মনে হচ্ছে। গত বছরের ট্যানারি মালিকদের প্রতিনিধিদের কাছে চামড়া দিয়েছিলাম, এখনও সেই বকেয়া পাওয়া যায়নি। তারপরও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এবারও প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকার এবার গরুর ৫৫ থেকে ৬০ টাকা বর্গ ফুট বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু সেই দামে চামড়া কিনলে লসের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ একটি কাঁচা চামড়ায় ৩শ’-সাড়ে ৩শ’ টাকার লবণ, শ্রমিক মজুরি ও পরিবহণ খরচ রয়েছে। ফলে ৪শ’-৫শ’ টাকায় চামড়া কিনলে খরচসহ এর দাম ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা পড়ে যায়। কিন্তু এই দামে যদি ট্যানারি মালিকরা না কেনেন তাহলে লোকসানে পড়তে হবে। ফলে এবার চামড়া খুব হিসাব করে কিনতে হবে।’
রাকিবুজ্জামান রাকিব নামে আরেক ব্যবসায়ী জানান, ‘সবচেয়ে দুঃখের খবর হলো, প্রতি কুরবানি ঈদের সপ্তাহ খানিক আগে থেকে লবণের দাম দ্বিগুণ হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হঠাৎ করে প্রতি বস্তায় চারশ’ টাকা দাম বেড়েছে। সরকার সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে পারেনি। আমাদের দাবি, ট্যারানি মালিকদের কোটি কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। কিন্তু এ রকম না দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী-ফাড়িয়াদের যদি অল্প সুদে ঋণ দিতো, তাহলে এই ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারতো।’ একইসঙ্গে বাজার চাঙ্গা করতে ইউরোপের বাজার ধরতে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকার চামড়ার দাম বেঁধে দিলেও ক্রয়-বিক্রয়ে সেই দামে ব্যবসায়ীদের মধ্যে তেমন সাড়া থাকে না। ফলে স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এ সময়টায় চামড়ার দাম ভারতে একটু বেশি থাকবে। সে জন্য বেশি মুনাফার আশায় চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতে চামড়া পাচার রোধে শার্শা ও বেনাপোল সীমান্তে সতর্কতা জারি করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমাদের টহল অব্যহত রয়েছে। ঈদের মৌসুমে সেটা আরোও জোরদার করা হবে। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে বিজিবি পোস্টে কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে।’
চামড়ার বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ও সিন্ডিকেট ভাঙতে উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘লবণকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে জেলায় ৩৭৭টি লিল্লাহ বোডিংয়ে জন্য আড়াইশ’ মেট্রিকটন লবণ ক্রয় করা হয়েছে। বিনামূল্যে এই লবণ লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে বিতরণ করা হবে। এছাড়া চামড়া নিয়ে যেন কোনো নৈরাজ্য না হয়, চামড়া যেন পচে না যায়, শৃঙ্খলার সঙ্গে যাতে বেচাকেনা হয় সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা আছে বলে জানান তিনি।’
শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫
‘তিন সঙ্কট’ নিয়ে চিন্তিত যশোরের চামড়া ব্যবসায়ীরা। ট্যানারি মালিক ও ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে পাওনা বকেয়া; লবণের দাম বৃদ্ধি এবং শ্রমিক সঙ্কট । এছাড়া চামড়া পাচারের আশঙ্কাও রয়েছে ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে দরকার ঋণ সুবিধা। একইসঙ্গে বাজার চাঙ্গা করতে ইউরোপের বাজার ধরতে সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশাসন বাজার স্থিতিশীল ও চামড়া পাচার বন্ধে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে। একই সাথে চামড়া সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণে লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোতে বিনামূল্যে লবণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
রাজারহাট দেশের বড় চামড়ার মোকাম। এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে তিন শতাধিক আড়ৎ রয়েছে। শনি ও মঙ্গলবার দুইদিন বসে হাট। এখানে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ছাড়াও ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর এবং ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীরা চামড়া বেচাকেনা করেন। এই হাট ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার ছোট বড় ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। ঈদ পরবর্তী প্রায় শত কোটি টাকার চামড়া হাতবদল হয় এখানে। কিন্তু ট্যানারি মালিক ও মহাজনদের কাছে থাকা বকেয়া আদায় না হওয়ার পাশাপাশি হঠাৎ লবণের মূল্যসহ শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিতে চামড়ার ব্যবসায়ীরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।
বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সহসভাপতি সাঈদ আহমেদ নাসির শেফার্ড বলেন, সরকার মফঃস্বলে গরুর চামড়া ৫৫ টাকা বর্গফুট নির্ধারণ করেছে। তবে সরকার নির্ধারিত দামে ট্যানারি মালিকরা যেন চামড়া ক্রয় করেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরাসহ সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ঢাকার ট্যানারি মালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের কাছে এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের শত কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে। এর সাথে ঈদের আগেই লবণের প্রতিবস্তার দাম ৭শ’-সাড়ে ৭শ’ টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে ১১শ’ টাকায় দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের বাড়তি মজুর ও সঙ্কটও দুশ্চিন্তার কারণ।
রাজারহাটে হাটে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ব্যবসার অবস্থা এবারও খারাপ হবে মনে হচ্ছে। গত বছরের ট্যানারি মালিকদের প্রতিনিধিদের কাছে চামড়া দিয়েছিলাম, এখনও সেই বকেয়া পাওয়া যায়নি। তারপরও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এবারও প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকার এবার গরুর ৫৫ থেকে ৬০ টাকা বর্গ ফুট বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু সেই দামে চামড়া কিনলে লসের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ একটি কাঁচা চামড়ায় ৩শ’-সাড়ে ৩শ’ টাকার লবণ, শ্রমিক মজুরি ও পরিবহণ খরচ রয়েছে। ফলে ৪শ’-৫শ’ টাকায় চামড়া কিনলে খরচসহ এর দাম ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা পড়ে যায়। কিন্তু এই দামে যদি ট্যানারি মালিকরা না কেনেন তাহলে লোকসানে পড়তে হবে। ফলে এবার চামড়া খুব হিসাব করে কিনতে হবে।’
রাকিবুজ্জামান রাকিব নামে আরেক ব্যবসায়ী জানান, ‘সবচেয়ে দুঃখের খবর হলো, প্রতি কুরবানি ঈদের সপ্তাহ খানিক আগে থেকে লবণের দাম দ্বিগুণ হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হঠাৎ করে প্রতি বস্তায় চারশ’ টাকা দাম বেড়েছে। সরকার সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে পারেনি। আমাদের দাবি, ট্যারানি মালিকদের কোটি কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। কিন্তু এ রকম না দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী-ফাড়িয়াদের যদি অল্প সুদে ঋণ দিতো, তাহলে এই ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারতো।’ একইসঙ্গে বাজার চাঙ্গা করতে ইউরোপের বাজার ধরতে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকার চামড়ার দাম বেঁধে দিলেও ক্রয়-বিক্রয়ে সেই দামে ব্যবসায়ীদের মধ্যে তেমন সাড়া থাকে না। ফলে স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এ সময়টায় চামড়ার দাম ভারতে একটু বেশি থাকবে। সে জন্য বেশি মুনাফার আশায় চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতে চামড়া পাচার রোধে শার্শা ও বেনাপোল সীমান্তে সতর্কতা জারি করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমাদের টহল অব্যহত রয়েছে। ঈদের মৌসুমে সেটা আরোও জোরদার করা হবে। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে বিজিবি পোস্টে কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে।’
চামড়ার বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ও সিন্ডিকেট ভাঙতে উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘লবণকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে জেলায় ৩৭৭টি লিল্লাহ বোডিংয়ে জন্য আড়াইশ’ মেট্রিকটন লবণ ক্রয় করা হয়েছে। বিনামূল্যে এই লবণ লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে বিতরণ করা হবে। এছাড়া চামড়া নিয়ে যেন কোনো নৈরাজ্য না হয়, চামড়া যেন পচে না যায়, শৃঙ্খলার সঙ্গে যাতে বেচাকেনা হয় সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা আছে বলে জানান তিনি।’