alt

সংস্কৃতি

বিদায় বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’

ইসমাইল মাহমুদ

: শনিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২১

‘তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে, ভালোবাসবে ওগো শুধু মোরে, তাই চম্পা বকুল, করে গন্ধে আকুল এই জোসনা রাতে, তারে মনে পড়ে’-ভালোবাসার এমন আকুতিমাখা গান বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে অভিনেত্রী কবরীর মুখে শুনে অনেকেই ভক্ত হয়ে যান।

কবরী অভিনীত প্রথম ছবি ‘সুতরাং’-এর জনপ্রিয় একটি গান এটি। কবরীর নজরকাড়া অভিনয়ের কারণে ছবিটি দর্শকের হৃদয় তোলপাড় সৃষ্টি করে। এ ছবিটিই চট্টগ্রামের কিশোরী মিনা পাল রাতারাতি বাংলা চলচ্চিত্রের সুঅভিনেত্রী কবরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। এক সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রীর মর্যাদা লাভ করেন তিনি।

এই কিংবদন্তি নায়িকা আর আমাদের মাঝে নেই। ১৬ এপ্রিল শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসে দেশের আকাশ থেকে খসে পড়ছে একের পর এক তারকা। করোনার মৃত্যুর এ মিছিলে যোগ দিলেন বিংশ শতাব্দীর ষাট ও সত্তর দশকের বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নায়িকা কবরী।

সারাহ বেগম কবরী ওরফে কবরী সরোয়ার ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম মিনা পাল। তাঁর পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল ও মাতা লাবণ্য প্রভা পাল।

কবরীর জন্ম বোয়ালখালি হলেও তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর সে সময়ে ১৯৬৩ সালে তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভূত হন। কবরী বড় হয়েছেন সাংস্কৃতিক পরিবারে। তাঁর মা লাবণ্য প্রভা পাল পুঁথি পড়তেন। কবরীর ভাই-বোনেরা নাচতেন-গাইতেন। সবচেয়ে ছোট ভাই ছিলেন তবলা বাদক। কবরী নাচ করতেন। তবে অভিনয় করার সুযোগ পাননি।

অভিনয় সম্পর্কে কোন জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ১৯৬৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে সুভাষ দত্তের বিপরীতে ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করেন। সুতরাং ছবিটি মুক্তি পাবার পর এ ছবি এবং ছবির নায়িকা হিসেবে কবরী চলচ্চিত্রামোদী মানুষের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হন। জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে এ দেশের চলচ্চিত্র দুনিয়ায় কবরীর দুর্বারগতিতে পথচলা শুরু হয়।

একদিকে অভিনয়শৈলী অন্যদিকে মনকাড়া হাসি দিয়ে তিনি সহজেই দর্শকদের দৃষ্টি কেড়ে নেন। চলচ্চিত্র দর্শকরা তাঁকে ‘মিষ্টি মেয়ে’ উপাধি দেন। এরপর ১৯৬৫ ‘জলছবি’ ও ‘বাহানা’; ১৯৬৮ সালে ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরী’ ও ‘যে আগুনে পুড়ি’; ১৯৭০ সালে ‘দ্বীপ নেভে নাই’, ‘দর্প চূর্ণ’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’ ও ‘বিনিময়’ করে ব্যাপক প্রশংসিত হন কবরী।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমাদের দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় কবরী তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে চলে যান গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে। সেখান থেকে শ্মরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন ভারতের কলকাতায়। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তিনি কীভাবে মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তার বর্ণনা করেন এবং তাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশকে সাহায্যের আবেদন করেন।

দেশ স্বাধীন হবার পর কবরী পুনরায় ফিরে আসেন প্রিয় জন্মভূমিতে। আবারও চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। স্বাধীনতা লাভের পর তাঁর প্রথম ছবি ‘লালন ফকির’ মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। ওই বছরই মুক্তি পায় অপর দুই ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ও ‘রঙ্গবাজ’; ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ‘মাসুদ রানা’; ১৯৭৫ সালে ‘সুজন সখী’ ও ‘সাধারণ মেয়ে’; ১৯৭৬ সালে ‘গুন্ডা’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘আগন্তুক’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘কত যে মিনতি’, ‘অধিকার’ ও ‘স্মৃতিটুকু থাক’; ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ ও ‘বধু বিদায়’; ১৯৭৯ সালে ‘আরাধনা’, ‘বেইমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, কাচ কাঁটা হীরা’, ‘উপহার’, ‘আমাদের সন্তান’, ‘মতিমহল’, ‘পারুলের সংসার’, ‘অরুন বরুন কিরণমালা’, ‘হীরামন’, ‘দেবদাস’ ও ‘আমার জন্মভূমি’; ১৯৮৭ সালে ‘দুই জীবন’ ছবিতে মূল নায়িতা চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সফলতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি।

এক সময় বাংলাদেশের চলচিত্র শিল্পে রাজ্জাক-কবরী জুটি সুপার-ডুপার হিট জুটি হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রথম ছবিতে অভিনয়ের কয়েক বছর পরই কবরী বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। ১৯৭৮ সালে তাঁকে ছেড়ে তিনি বিয়ে করেন নারায়নগঞ্জের শফিউদ্দিন সারোয়ার ওরফে বাবু সারোয়ারকে। দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে পাঁচ পুত্র সন্তানের জননী কবরীকে রাজনৈতিক কারনে ছাড়তে হয় দ্বিতীয় স্বামীকেও।

সারাহ বেগম কবরী ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বউ’ চলচ্চিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ সন্মাননা পান। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি কর্তৃক ১৯৭৩ সালে ‘লালন ফকির’, ১৯৭৫ সালে ‘সুজন সখী’, ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বউ’, ১৯৮৮ সালে ‘দুই জীবন’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া একই সংগঠন কর্তৃক ২০০৮ সালে অনারারি অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৯ সালে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ সন্মাননা লাভ করেন।

কবরী পরিচালিত ‘এই তুমি সেই তুমি’ সিনেমার ডাবিং ও সম্পাদনার কাজ চলছে। সরকারি অনুদানের এই ছবিটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিশাত সালওয়া ও রিয়াদ রায়হান। ছবিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করবেন কবরীও। এই ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন সাবিনা ইয়াসমীন। এরই মধ্যে নতুন আরেকটি সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছিলেন কবরী।

চলচ্চিত্র অভিনয়, প্রযোজনা, পরিচালনার পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও সক্রিয় ছিলেন সারাহ বেগম কবরী। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও স্টিয়ারিং কমিটির সভাপতি। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে নারায়নগঞ্জ-৪ আসন থেকে ১ লক্ষ ৪১ হাজার ৭৫ ভোট পেয়ে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কবরীর মৃত্যু দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের বিকাশে তাঁর অবদান এ দেশের মানুষ আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। কবরীর দেহের মৃত্যু হলেও তিনি যুগ যুগ ধরে থাকবেন এ দেশের মানুষের অন্তরে।

সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে হবে

ছবি

রোটারি ঢাকা নর্থ ওয়েস্ট ভোকেশনাল এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ প্রদান

ছবি

দর্শক নে, ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে ময়মনসিংহের পূরবী সিনেমা হল

প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে পদত্যাগপত্র, চার শর্ত মানলে ফিরবেন জামিল আহমেদ

ছবি

বইমেলায় তপন কান্তি সরকারের বই ‘নতুন বিশ্বের নতুন ক্যারিয়ার’

ছবি

পর্দা নেমেছে সোনারগাঁয়ে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের

ছবি

পাঠাও-এর ‘অগ্রযাত্রার অগ্রদূত’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন

শেষ মুহূর্তে স্থগিত ঘোষণা ঢাকা মহানগর নাট্যোৎসব

ছবি

হুমকির মুখে স্থগিত ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব

ছবি

শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব

ছবি

বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কবি আয়েশা মুন্নির ‘গুলবাহার ভোর’

ছবি

সোনারগাঁয়ে লোককারুশিল্প মেলা, লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য শীতল পাটির প্রদর্শনী

ছবি

সোনারগাঁয়ে ছুটির দিনে লোকারন্য লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব

ছবি

বাংলা একাডেমি পুরস্কারের খবর নেই, এবার সরে গেলেন জুরি সদস্য

ছবি

কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ প্রত্যাখ্যান করেছেন

এবার দশজন পাচ্ছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।

ছবি

সোনারগাঁয়ে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের উদ্বোধন

ছবি

বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদীচী যশোর জেলা সংসদের ২২তম সম্মেলন শুরু

ছবি

ভিভো ও এসওএস এর যৌথ উদ্যোগে ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী

ছবি

ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দিনব্যাপী চ্যারিটি মেলা

ছবি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাপতি মেলা অনুষ্ঠিত

অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হককে জাতীয় অধ্যাপক করার দাবি

ছবি

শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্রের জন্য পৃথক বিভাগ চায় চলচ্চিত্রকর্মীরা

ছবি

শিল্পকর্মে বুড়িগঙ্গা পাড়ের জীবন

ছবি

শিল্পকর্মে বুড়িগঙ্গা পাড়ের জীবন

ছবি

এবার শিল্পকলায় নাটক বন্ধের প্রতিবাদ সমাবেশে হামলা

ছবি

রাজশাহীতে ঋত্বিক ঘটকের ৯৯ তম জন্মবার্ষিকী আলোচনা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী

ছবি

শহীদদের স্মরণে সাংস্কৃতিক ঐক্যের আহ্বান: ভয়কে জয় করে চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয়

ছবি

রিয়েলমি’র আয়োজনে ন্যাশনাল মোবাইল ফটোগ্রাফি কনটেস্ট ২০২৪

ছবি

ময়মনসিংহে ৩ শতাধিক আলোকচিত্র নিয়ে ’ফ্যাসিস্ট প্রদর্শনী’

ছবি

ফ্লোরিডায় সোহরাব আলমের একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী

ছবি

ডিজিটাল মিডিয়ার আসক্তি পৃথিবীকে অশান্ত করছে

জাতীয় সাংস্কৃতিক মৈত্রী নামে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ

ছবি

মাসজুড়ে ভিভো’র ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা

ছবি

শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী পদত্যাগ

ছবি

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মো. হারুন-উর-রশীদ আসকারীর পদত্যাগ

tab

সংস্কৃতি

বিদায় বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’

ইসমাইল মাহমুদ

শনিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২১

‘তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে, ভালোবাসবে ওগো শুধু মোরে, তাই চম্পা বকুল, করে গন্ধে আকুল এই জোসনা রাতে, তারে মনে পড়ে’-ভালোবাসার এমন আকুতিমাখা গান বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে অভিনেত্রী কবরীর মুখে শুনে অনেকেই ভক্ত হয়ে যান।

কবরী অভিনীত প্রথম ছবি ‘সুতরাং’-এর জনপ্রিয় একটি গান এটি। কবরীর নজরকাড়া অভিনয়ের কারণে ছবিটি দর্শকের হৃদয় তোলপাড় সৃষ্টি করে। এ ছবিটিই চট্টগ্রামের কিশোরী মিনা পাল রাতারাতি বাংলা চলচ্চিত্রের সুঅভিনেত্রী কবরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। এক সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রীর মর্যাদা লাভ করেন তিনি।

এই কিংবদন্তি নায়িকা আর আমাদের মাঝে নেই। ১৬ এপ্রিল শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসে দেশের আকাশ থেকে খসে পড়ছে একের পর এক তারকা। করোনার মৃত্যুর এ মিছিলে যোগ দিলেন বিংশ শতাব্দীর ষাট ও সত্তর দশকের বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নায়িকা কবরী।

সারাহ বেগম কবরী ওরফে কবরী সরোয়ার ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম মিনা পাল। তাঁর পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল ও মাতা লাবণ্য প্রভা পাল।

কবরীর জন্ম বোয়ালখালি হলেও তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর সে সময়ে ১৯৬৩ সালে তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভূত হন। কবরী বড় হয়েছেন সাংস্কৃতিক পরিবারে। তাঁর মা লাবণ্য প্রভা পাল পুঁথি পড়তেন। কবরীর ভাই-বোনেরা নাচতেন-গাইতেন। সবচেয়ে ছোট ভাই ছিলেন তবলা বাদক। কবরী নাচ করতেন। তবে অভিনয় করার সুযোগ পাননি।

অভিনয় সম্পর্কে কোন জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ১৯৬৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে সুভাষ দত্তের বিপরীতে ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করেন। সুতরাং ছবিটি মুক্তি পাবার পর এ ছবি এবং ছবির নায়িকা হিসেবে কবরী চলচ্চিত্রামোদী মানুষের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হন। জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে এ দেশের চলচ্চিত্র দুনিয়ায় কবরীর দুর্বারগতিতে পথচলা শুরু হয়।

একদিকে অভিনয়শৈলী অন্যদিকে মনকাড়া হাসি দিয়ে তিনি সহজেই দর্শকদের দৃষ্টি কেড়ে নেন। চলচ্চিত্র দর্শকরা তাঁকে ‘মিষ্টি মেয়ে’ উপাধি দেন। এরপর ১৯৬৫ ‘জলছবি’ ও ‘বাহানা’; ১৯৬৮ সালে ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরী’ ও ‘যে আগুনে পুড়ি’; ১৯৭০ সালে ‘দ্বীপ নেভে নাই’, ‘দর্প চূর্ণ’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’ ও ‘বিনিময়’ করে ব্যাপক প্রশংসিত হন কবরী।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমাদের দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় কবরী তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে চলে যান গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে। সেখান থেকে শ্মরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন ভারতের কলকাতায়। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তিনি কীভাবে মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তার বর্ণনা করেন এবং তাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশকে সাহায্যের আবেদন করেন।

দেশ স্বাধীন হবার পর কবরী পুনরায় ফিরে আসেন প্রিয় জন্মভূমিতে। আবারও চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। স্বাধীনতা লাভের পর তাঁর প্রথম ছবি ‘লালন ফকির’ মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। ওই বছরই মুক্তি পায় অপর দুই ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ও ‘রঙ্গবাজ’; ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ‘মাসুদ রানা’; ১৯৭৫ সালে ‘সুজন সখী’ ও ‘সাধারণ মেয়ে’; ১৯৭৬ সালে ‘গুন্ডা’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘আগন্তুক’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘কত যে মিনতি’, ‘অধিকার’ ও ‘স্মৃতিটুকু থাক’; ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ ও ‘বধু বিদায়’; ১৯৭৯ সালে ‘আরাধনা’, ‘বেইমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, কাচ কাঁটা হীরা’, ‘উপহার’, ‘আমাদের সন্তান’, ‘মতিমহল’, ‘পারুলের সংসার’, ‘অরুন বরুন কিরণমালা’, ‘হীরামন’, ‘দেবদাস’ ও ‘আমার জন্মভূমি’; ১৯৮৭ সালে ‘দুই জীবন’ ছবিতে মূল নায়িতা চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সফলতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি।

এক সময় বাংলাদেশের চলচিত্র শিল্পে রাজ্জাক-কবরী জুটি সুপার-ডুপার হিট জুটি হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রথম ছবিতে অভিনয়ের কয়েক বছর পরই কবরী বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। ১৯৭৮ সালে তাঁকে ছেড়ে তিনি বিয়ে করেন নারায়নগঞ্জের শফিউদ্দিন সারোয়ার ওরফে বাবু সারোয়ারকে। দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে পাঁচ পুত্র সন্তানের জননী কবরীকে রাজনৈতিক কারনে ছাড়তে হয় দ্বিতীয় স্বামীকেও।

সারাহ বেগম কবরী ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বউ’ চলচ্চিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ সন্মাননা পান। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি কর্তৃক ১৯৭৩ সালে ‘লালন ফকির’, ১৯৭৫ সালে ‘সুজন সখী’, ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বউ’, ১৯৮৮ সালে ‘দুই জীবন’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া একই সংগঠন কর্তৃক ২০০৮ সালে অনারারি অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৯ সালে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ সন্মাননা লাভ করেন।

কবরী পরিচালিত ‘এই তুমি সেই তুমি’ সিনেমার ডাবিং ও সম্পাদনার কাজ চলছে। সরকারি অনুদানের এই ছবিটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিশাত সালওয়া ও রিয়াদ রায়হান। ছবিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করবেন কবরীও। এই ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন সাবিনা ইয়াসমীন। এরই মধ্যে নতুন আরেকটি সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছিলেন কবরী।

চলচ্চিত্র অভিনয়, প্রযোজনা, পরিচালনার পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও সক্রিয় ছিলেন সারাহ বেগম কবরী। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও স্টিয়ারিং কমিটির সভাপতি। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে নারায়নগঞ্জ-৪ আসন থেকে ১ লক্ষ ৪১ হাজার ৭৫ ভোট পেয়ে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কবরীর মৃত্যু দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের বিকাশে তাঁর অবদান এ দেশের মানুষ আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। কবরীর দেহের মৃত্যু হলেও তিনি যুগ যুগ ধরে থাকবেন এ দেশের মানুষের অন্তরে।

back to top