কোম্পানীগঞ্জে আ’লীগের দ্বন্দ্ব
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায় আড়াই মাস যাবত আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত, দুই জনের মৃত্যু, অতঃপর বৃহস্পতিবার এক পক্ষের নেতা মিজানুর রহমান বাদলকে আটক করেছে পুলিশ। তবে পুলিশের এ পদক্ষেপ চলমান দ্বন্দ্ব কতাটা নিরসন করতে পারবে, এ নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের এ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অনেক দিন ধরেই চলছে। নিজ এলাকায় দলীয় কোন্দল সামাল দিতে পারছেন না খোদ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সম্প্রতি ওই দুই গ্রুপের দুটি পৃথক সংঘর্ষে ঝরে গেছে দুটি তাজা প্রাণ, গুলিবিদ্ধ ১৩ জন, আহত অর্ধশতাধিক।
স্থানীয়দের মতে, ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান বাদলের চলমান দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ আগে নেয়া হলে প্রাণহানি ঠেকানো যেত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতাও বলেছেন, বিষয়টি পারিবারিক, ওবায়দুল কাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে পারতেন।
ওবায়দুল কাদের অবশ্য কাদের মির্জাকে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ডেকে এনে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তবে তাতে কাজ হয়নি। দ্বন্দ্ব এখন চরমে। গত ৯ মার্চ ওবায়দুল কাদের তার ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে লিখেছেন, ‘নোবডি নোউজ দ্যা রিজন বিহাইন্ড মাই সাইলেন্স।’ অর্থাৎ ‘আমার নীরবতার কারণ কেউ জানে না’। ওই দিনই কাদের মির্জা আর বাদল গ্রুপের সংঘাতে এক সিএনজিচালক নিহত হন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল মুহাম্মদ ফারুক খান (অব.) কোম্পানীগঞ্জের বিষয়ে বলেন, ‘যা ঘটছে তা দলের জন্য ভালো হচ্ছে না। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগে আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা রয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা বিষয়টি দেখছেন।’
নোয়াখালী জেলায় মোট সংসদীয় আসন ৬টি। এর মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলা নিয়ে গঠিত নোয়াখালী-৫ আসন। এ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ছোট ভাই কাদের মির্জা কোম্পানীগঞ্জের একটি পৌরসভা বসুরহাটের মেয়র হলেও তার রাজনীতি জেলাকে ঘিরে। উপজেলা পর্যায়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান বাদল।
কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত বেশকিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাদের মির্জার নিয়ন্ত্রণ এখন আর বড় ভাইয়ের হাতে নেই। ওবায়দুল কাদেরের কথা তিনি (কাদের মির্জা) শোনেন না। তাদের মতে, এর নেপথ্যে রয়েছে পারিবারিক কোন্দল।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বড় ভাইয়ের আশীর্বাদে নোয়াখালী-৫ আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন ছিল কাদের মির্জার। তবে নোয়াখালীর রাজনীতিতে স্ত্রী ইশরাতুন্নেছাকে ‘জনপ্রিয়’ করতে ওবায়দুল কাদেরের নানা উদ্যোগে ছোট ভাইয়ের মধ্য হতাশা তৈরি হয়। কাদের মির্জার অনুসারীদের ধারণা, ওবায়দুল কাদের স্ত্রীকে এ আসনটি ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সূত্র জানায়, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদে নৌকার মনোনয়নের ক্ষেত্রে কাদের মির্জা বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিনের পক্ষে ছিলেন। তবে ভাবী ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের পক্ষে। নৌকার মনোনয়ন নিয়ে শাহাব উদ্দিন এখন উপজেলা চেয়ারম্যান। এদিকে কোম্পানীগঞ্জ এবং কবিরহাটে দল ও সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের কমিটি গঠন নিয়েও ভাবীর পছন্দের প্রার্থীদের বিপক্ষে ছিল কাদের মির্জার অবস্থান, এমন অভিযোগও রয়েছে।
সূত্র বলছে, কোম্পানীগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন যাবত কাদের মির্জার হাতেই ছিল। তবে ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হওয়ার পর হঠাৎ করেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। প্রতিপক্ষ বাদল এবং তার কর্মী-সমর্থক কাদের মির্জার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সম্প্রতি বাদলের পক্ষে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সমর্থন থাকায় কাদের মির্জা দলে ‘একঘরে’ হয়ে পড়েন।
বসুরহাটের এক পৌর কাউন্সিলর সংবাদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বাইরে থেকে অনেক কিছুই শোনা যায়। তবে ভেতরে কী হচ্ছে তা, বুঝা কঠিন।’ কাদের মির্জার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সত্য কথা বলায় আজ তার বিপদ হয়েছে। এ এলকার প্রতিটা লোক জানেন আবদুল কাদের মির্জা সৎ মানুষ, ভালো মানুষ। ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা তাদের পারিবারিক বিষয়। আমরা ছোট মানুষ। তবে এতটুকু বলতে পারি, দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে তৃতীয় একটি পক্ষ দীর্ঘদিন যাবৎ ষড়যন্ত্র করছে’।
কাদের মির্জা প্রায় আড়াই মাস আগে প্রথমে পরিবার ও স্থানীয় নেতাদের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। গত ৩১ ডিসেম্বর এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীর অনেক সংসদ সদস্য পালানোর দরজা খুঁজে পাবেন না।’ এক পর্যায়ে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নাম উল্লেখ করে চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য ও অপরাজনীতির অভিযোগও তোলেন তিনি। ভাই ওবায়দুল কাদেরকে তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও উল্লেখ করেছেন কাদের মির্জা। ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও দলের নাম ভাঙিয়ে অনিয়ম এবং ‘অসৌজন্যতা’ প্রদর্শনের ব্যক্তিগত অভিযোগ জনসম্মুখে তুলেছেন তিনি।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কাদের মির্জা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন স্থানীয় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির। পরে তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পরদিন সন্ধ্যায় দলের সব কার্যক্রম থেকে কাদের মির্জাকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে চিঠি পাঠানোর কথা গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেয় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ।
বিজ্ঞপ্তি দেয়ার দুই ঘণ্টা পর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুল আনম চৌধুরী ফোন করে সাংবাদিকদের জানান, বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী সদর আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী জানান, সুপারিশ প্রত্যাহার হয়নি। এর ১৮ দিন পর গত ৯ মার্চ পুনরায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত, গোলাগুলির ঘটনায় সিএনজিচালক আলাউদ্দিন মারা যান। এই দুই ঘটনার মাঝখানেও বিভিন্ন সময় দলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
নোয়খালীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক কয়েকজন সহ-সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি বেশ জটিল হয়ে ওঠেছে। দুই পক্ষের সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগও বিব্রত। সাবেক এক সহ-সম্পাদক বলেন, “নিজ জেলা নিয়ে ওবায়দুল কাদেরও উদ্বিঘœ। মনে হচ্ছে পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।”
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে জেলা কমিটি বহিষ্কারের সুপারিশ করতে পারে। তবে তা অনুমোদন করার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির। অথবা কেন্দ্রীয় কমিটি চাইলে যে কাউকে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার বা অব্যাহতি দিতে পারে। নোয়াখালীর ক্ষেত্রে এর কোনটাই হয়নি। এর নেপথ্যের কারণ কী? এ নিয়েও দলে ও দলের বাইরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে যেকোন দিন দলের কেন্দ্রীয় ফোরামে নোয়াখালীর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা সংবাদকে বলেন, কাদের মির্জার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে আছে। তিনি নিজেই এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন। আবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বা সাংগঠনিক সম্পাদকও অনির্ধারিত আলোচনায় বিষয়টি উঠাতে পারেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘নোয়খালীর বিষয়টি কেন্দ্রের নজরে রয়েছে। যথাসময়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এদিকে কোম্পানীগঞ্জ ও বসুরহাটের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আতঙ্কের পাশাপাশি অস্বস্তিতে আছেন স্থানীয়রা। সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায়ও ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।
অশীতিপর হাজী রহমত উল্যাও বসুরহাটে ক্ষমতাসীন দুই গ্রুপের চলমান সংঘর্ষে নিরীহ সিএনজিচালকের প্রাণহানি মেনে নিতে পারেননি। সাংবাদিক স্টিকারযুক্ত গাড়ি দেখে এগিয়ে এসে চিৎকার করে জানতে চান, ‘আমাদের এমপি ওবায়দুল কাদেরের জন্য এলাকার মানুষ কি না করেছে। তিনি কি চান? কত রক্ত তার দরকার? দুটি লাশ পড়ল। আর কত লাশ পড়লে তার ঘুম ভাঙবে?’
‘মরেছে তো গরিব। কাদের সাহেবও মরবে না, মির্জা কাদের বা বাদলও মরবে না, মরবে নিরীহ মানুষ, গুলি খাবে গরিবের ছেলেরা।’- যোগ করেন তিনি।
কোম্পানীগঞ্জে আ’লীগের দ্বন্দ্ব
বৃহস্পতিবার, ১১ মার্চ ২০২১
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায় আড়াই মাস যাবত আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত, দুই জনের মৃত্যু, অতঃপর বৃহস্পতিবার এক পক্ষের নেতা মিজানুর রহমান বাদলকে আটক করেছে পুলিশ। তবে পুলিশের এ পদক্ষেপ চলমান দ্বন্দ্ব কতাটা নিরসন করতে পারবে, এ নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের এ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অনেক দিন ধরেই চলছে। নিজ এলাকায় দলীয় কোন্দল সামাল দিতে পারছেন না খোদ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সম্প্রতি ওই দুই গ্রুপের দুটি পৃথক সংঘর্ষে ঝরে গেছে দুটি তাজা প্রাণ, গুলিবিদ্ধ ১৩ জন, আহত অর্ধশতাধিক।
স্থানীয়দের মতে, ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান বাদলের চলমান দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ আগে নেয়া হলে প্রাণহানি ঠেকানো যেত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতাও বলেছেন, বিষয়টি পারিবারিক, ওবায়দুল কাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে পারতেন।
ওবায়দুল কাদের অবশ্য কাদের মির্জাকে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ডেকে এনে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তবে তাতে কাজ হয়নি। দ্বন্দ্ব এখন চরমে। গত ৯ মার্চ ওবায়দুল কাদের তার ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে লিখেছেন, ‘নোবডি নোউজ দ্যা রিজন বিহাইন্ড মাই সাইলেন্স।’ অর্থাৎ ‘আমার নীরবতার কারণ কেউ জানে না’। ওই দিনই কাদের মির্জা আর বাদল গ্রুপের সংঘাতে এক সিএনজিচালক নিহত হন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল মুহাম্মদ ফারুক খান (অব.) কোম্পানীগঞ্জের বিষয়ে বলেন, ‘যা ঘটছে তা দলের জন্য ভালো হচ্ছে না। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগে আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা রয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা বিষয়টি দেখছেন।’
নোয়াখালী জেলায় মোট সংসদীয় আসন ৬টি। এর মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলা নিয়ে গঠিত নোয়াখালী-৫ আসন। এ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ছোট ভাই কাদের মির্জা কোম্পানীগঞ্জের একটি পৌরসভা বসুরহাটের মেয়র হলেও তার রাজনীতি জেলাকে ঘিরে। উপজেলা পর্যায়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান বাদল।
কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত বেশকিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাদের মির্জার নিয়ন্ত্রণ এখন আর বড় ভাইয়ের হাতে নেই। ওবায়দুল কাদেরের কথা তিনি (কাদের মির্জা) শোনেন না। তাদের মতে, এর নেপথ্যে রয়েছে পারিবারিক কোন্দল।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বড় ভাইয়ের আশীর্বাদে নোয়াখালী-৫ আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন ছিল কাদের মির্জার। তবে নোয়াখালীর রাজনীতিতে স্ত্রী ইশরাতুন্নেছাকে ‘জনপ্রিয়’ করতে ওবায়দুল কাদেরের নানা উদ্যোগে ছোট ভাইয়ের মধ্য হতাশা তৈরি হয়। কাদের মির্জার অনুসারীদের ধারণা, ওবায়দুল কাদের স্ত্রীকে এ আসনটি ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সূত্র জানায়, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদে নৌকার মনোনয়নের ক্ষেত্রে কাদের মির্জা বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিনের পক্ষে ছিলেন। তবে ভাবী ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের পক্ষে। নৌকার মনোনয়ন নিয়ে শাহাব উদ্দিন এখন উপজেলা চেয়ারম্যান। এদিকে কোম্পানীগঞ্জ এবং কবিরহাটে দল ও সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের কমিটি গঠন নিয়েও ভাবীর পছন্দের প্রার্থীদের বিপক্ষে ছিল কাদের মির্জার অবস্থান, এমন অভিযোগও রয়েছে।
সূত্র বলছে, কোম্পানীগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন যাবত কাদের মির্জার হাতেই ছিল। তবে ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হওয়ার পর হঠাৎ করেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। প্রতিপক্ষ বাদল এবং তার কর্মী-সমর্থক কাদের মির্জার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সম্প্রতি বাদলের পক্ষে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সমর্থন থাকায় কাদের মির্জা দলে ‘একঘরে’ হয়ে পড়েন।
বসুরহাটের এক পৌর কাউন্সিলর সংবাদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বাইরে থেকে অনেক কিছুই শোনা যায়। তবে ভেতরে কী হচ্ছে তা, বুঝা কঠিন।’ কাদের মির্জার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সত্য কথা বলায় আজ তার বিপদ হয়েছে। এ এলকার প্রতিটা লোক জানেন আবদুল কাদের মির্জা সৎ মানুষ, ভালো মানুষ। ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা তাদের পারিবারিক বিষয়। আমরা ছোট মানুষ। তবে এতটুকু বলতে পারি, দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে তৃতীয় একটি পক্ষ দীর্ঘদিন যাবৎ ষড়যন্ত্র করছে’।
কাদের মির্জা প্রায় আড়াই মাস আগে প্রথমে পরিবার ও স্থানীয় নেতাদের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। গত ৩১ ডিসেম্বর এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীর অনেক সংসদ সদস্য পালানোর দরজা খুঁজে পাবেন না।’ এক পর্যায়ে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নাম উল্লেখ করে চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য ও অপরাজনীতির অভিযোগও তোলেন তিনি। ভাই ওবায়দুল কাদেরকে তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও উল্লেখ করেছেন কাদের মির্জা। ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও দলের নাম ভাঙিয়ে অনিয়ম এবং ‘অসৌজন্যতা’ প্রদর্শনের ব্যক্তিগত অভিযোগ জনসম্মুখে তুলেছেন তিনি।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কাদের মির্জা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন স্থানীয় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির। পরে তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পরদিন সন্ধ্যায় দলের সব কার্যক্রম থেকে কাদের মির্জাকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে চিঠি পাঠানোর কথা গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেয় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ।
বিজ্ঞপ্তি দেয়ার দুই ঘণ্টা পর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুল আনম চৌধুরী ফোন করে সাংবাদিকদের জানান, বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী সদর আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী জানান, সুপারিশ প্রত্যাহার হয়নি। এর ১৮ দিন পর গত ৯ মার্চ পুনরায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত, গোলাগুলির ঘটনায় সিএনজিচালক আলাউদ্দিন মারা যান। এই দুই ঘটনার মাঝখানেও বিভিন্ন সময় দলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
নোয়খালীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক কয়েকজন সহ-সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি বেশ জটিল হয়ে ওঠেছে। দুই পক্ষের সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগও বিব্রত। সাবেক এক সহ-সম্পাদক বলেন, “নিজ জেলা নিয়ে ওবায়দুল কাদেরও উদ্বিঘœ। মনে হচ্ছে পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।”
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে জেলা কমিটি বহিষ্কারের সুপারিশ করতে পারে। তবে তা অনুমোদন করার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির। অথবা কেন্দ্রীয় কমিটি চাইলে যে কাউকে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার বা অব্যাহতি দিতে পারে। নোয়াখালীর ক্ষেত্রে এর কোনটাই হয়নি। এর নেপথ্যের কারণ কী? এ নিয়েও দলে ও দলের বাইরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে যেকোন দিন দলের কেন্দ্রীয় ফোরামে নোয়াখালীর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা সংবাদকে বলেন, কাদের মির্জার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে আছে। তিনি নিজেই এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন। আবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বা সাংগঠনিক সম্পাদকও অনির্ধারিত আলোচনায় বিষয়টি উঠাতে পারেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘নোয়খালীর বিষয়টি কেন্দ্রের নজরে রয়েছে। যথাসময়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এদিকে কোম্পানীগঞ্জ ও বসুরহাটের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আতঙ্কের পাশাপাশি অস্বস্তিতে আছেন স্থানীয়রা। সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায়ও ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।
অশীতিপর হাজী রহমত উল্যাও বসুরহাটে ক্ষমতাসীন দুই গ্রুপের চলমান সংঘর্ষে নিরীহ সিএনজিচালকের প্রাণহানি মেনে নিতে পারেননি। সাংবাদিক স্টিকারযুক্ত গাড়ি দেখে এগিয়ে এসে চিৎকার করে জানতে চান, ‘আমাদের এমপি ওবায়দুল কাদেরের জন্য এলাকার মানুষ কি না করেছে। তিনি কি চান? কত রক্ত তার দরকার? দুটি লাশ পড়ল। আর কত লাশ পড়লে তার ঘুম ভাঙবে?’
‘মরেছে তো গরিব। কাদের সাহেবও মরবে না, মির্জা কাদের বা বাদলও মরবে না, মরবে নিরীহ মানুষ, গুলি খাবে গরিবের ছেলেরা।’- যোগ করেন তিনি।