alt

উপ-সম্পাদকীয়

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই একমাত্র উপায়

অধ্যাপক অরূপ রতন চৌধুরী

: বুধবার, ০৭ এপ্রিল ২০২১
image

দেশে এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনাভাইরাসে মৃত্যু বেড়েছে ৭১ শতাংশ। আগের সপ্তাহের তুলনায় ৫৫তম সপ্তাহে শনাক্ত বেড়েছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।

সংক্রমণ মোকাবিলায় গত ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে অর্ধেক জনবল দিয়ে অফিস পরিচালনা করা, জনসমাগম সীমিত করা, গণপরিবহনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করা ইত্যাদি। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এগুলো অন্যতম পদ্ধতি। যেহেতু ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে পরিপূর্ণভাবে তা কার্যকর করা যাচ্ছিল না, তাই লকডাউনে যেতে হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য হলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ। তবে ঝুঁকি বিবেচনায় সময়ে সময়ে পরিকল্পনা হালনাগাদ করা প্রয়োজন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চূড়ায় (পিক) উঠেছিল গত বছরের জুন-জুলাইয়ে। ওই সময়টায়, বিশেষ করে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার হাজার রোগী শনাক্ত হতো। এরপর কয়েক মাস পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকার পর এক মাসের বেশি সময় ধরে সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী।

আবারও বাড়ছে করোনার এ নতুন ধরনের সংক্রমণের হার। আগের চেয়ে ৭০ ভাগ বেশি আর জটিলতা বেশি ৩০ ভাগ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, শিশুরাও এখন নিরাপদ নয়। আগে ধারণা করা হয়েছিল, শিশুদের করোনা হওয়ার ঝুঁকি কম, হলেও খুব সামান্য জটিলতা আছে। কিন্তু ইদানীং দেখা গেছে, শিশুরাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এবারের ঢেউয়ে শিশুরা ব্যাপকসংখ্যক আক্রান্ত হচ্ছে। তাই শিশুদের করোনা থেকে বাঁচতে এখনই সতর্ক হতে হবে।

এবার করোনায় প্রচুরসংখ্যক শিশু ডায়রিয়া, পেটেব্যথা ও বমি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। অবশ্য যারা গন্ধ কম পান, করোনায় তাদের তীব্র জটিলতা কম হয়, এটা বিভিন্ন গবেষণায়ও প্রকাশিত হয়েছে। আগে যেমন অনেকেরই গন্ধহীনতার উপসর্গ হতো, এবার তেমনটি দেখা যাচ্ছে কম। বড়দের মতো জর, কাশি, গলাব্যথা তো থাকেই। তবে এবারের করোনায় মাথাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, শরীরব্যথার কথা বলছে অনেক শিশু। চোখ লাল হওয়া ও শরীরে র‌্যাশও দেখা যাচ্ছে।

লকডাউনে শুধু জরুরি সেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান এবং পণ্যবাহী যানবাহন ও শিল্প কারখানা খোলা থাকবে। বন্ধ থাকবে গণপরিবহন, যাত্রীবাহী ট্রেন, যাত্রীবাহী নৌযান। অভ্যন্তরীণ পথে বিমান চলাচলও বন্ধ থাকবে। আর যেসব অফিস চালু রাখার প্রয়োজন রয়েছে, তাদের সীমিত জনবল নিয়ে চালাতে হবে। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া লকডাউনে ঘর থেকে বের হওয়া যায় না।

সারা দেশে সরকারি ও বেসকারি ব্যবস্থাপনায় ২২৭টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১২০টি, জিন-এক্সপার্ট ৩৪টি, র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৭৩টি। দেশে এখন চলছে করোনা সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েব (দ্বিতীয় ঢেউ)। প্রথম দিকের চেয়ে এ সংক্রমণ ইতোমধ্যে রেকর্ড গড়েছে। শুধু সংক্রমণ নয়, মৃত্যুর দিক থেকেও রেকর্ড। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে সরকার করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর বিধিনিষেধ অরোপের পর সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে। করোনার সেকেন্ড ওয়েভ নিয়ে জনসাধারণের মাঝে চরম আতঙ্ক রয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এখন মূল লক্ষ্য।

ইতোমধ্যে প্রথম আঘাত শুরু হয়ে অনেকটা শেষ হওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল দেশ এ ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। এ ধারণা ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। ফলে করোনাভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সব পর্যায়ে যেভাবে নতুন নতুন প্রস্তুতি এগিয়ে যাচ্ছিল সেটি একপর্যায়ে থমকে যায়। বর্তমানে সেকেন্ড ওয়েব শুরু হওয়ার পর আবার নতুন করে থমকে যাওয়া সেই প্রয়াসকে এগিয়ে নেয়ার তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু এরই মাঝে প্রতিদিন যে হারে এ ভাইরাসে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে সেটি রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রতিনিয়ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশের চিত্র সকল মহলকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টিকা নেয়াটা যেমন জরুরি, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাও এখন জরুরি।

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ওয়েভে ঢাকা চট্টগ্রামসহ ৩০ জেলাকে উচ্চহারে সংক্রমিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিপূর্বে চট্টগ্রামে এ ধরনের সংক্রমণ না ছড়ালেও এখন তা বিপরীত ঘটনা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাষন আলাদাভাবে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সন্ধ্যা ছয়টার পর সব ধরনের দোকানপাট, শপিংমল বন্ধ করার ঘোষণা কার্যকর করেছে।

কিন্তু সংক্রমণের হার ও রোগীর সংখ্যা যখন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, তখন মনোযোগ বাড়াতে হবে কভিড রোগীদের জীবন রক্ষার প্রতি। কোভিড রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ বাড়াতে হবে; পর্যাপ্ত অক্সিজেন, আইসিইউ সেবাসহ চিকিৎসার মান উন্নত করার জন্য বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে, প্রয়োজনে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ, দায়িত্বশীল ও সুশৃঙ্খল করার উদ্যোগে সরকার সচেষ্ট।

সংক্রমণের আরও বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য মাস্ক পরা, নিয়মত হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার প্রতি সবাইকে আরও মনোযোগী ও দায়িত্বশীল করে তোলার জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বাড়াতে যেমন বাড়াতে হবে তেমনি প্রতিটি বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও এখানে তাদরে ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় সচেতনতা কার্যক্রমকে বেগবান করতে স্থানীয় নেতারা এখন বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবেন। প্রতিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে।

যারা ঘরের বাইরে বেশি সময় কাটাচ্ছেন, তারা আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন। যুবকদের মধ্যে একটা অবহেলা, উপেক্ষার ভাব রয়েছে। অযথা ঘুরে বেড়ানো আড্ডা দেয়ার কারণে করোনায় আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন তারা। ফলে হাসপাতালগুলোতে তাদের সংখ্যা বেশি।

চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তের হার ২০ শতাংশের বেশি। আক্রান্তের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সী। শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালের শয্যাও যুবকদের দখলে বেশি, প্রায় ৬৫ শতাংশ।

স্বাস্থ্যবিধি না মানা, যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো, আড্ডাবাজিসহ নানা কারণে কম বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে চিকিৎসকরা মনে করেছেন। পাশাপাশি টিকা দেয়ার পর করোনা জয় করার প্রবণতাও কাজ করছে অনেকের মধ্যে। তাদের কারণে ঘরের বয়োবৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।

বিষয়টি আতঙ্কের হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এর থেকে পরিত্রাণের মূল উপায় হিসেবে এ পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের ছোট্ট এ দেশটি বিভিন্ন দিক থেকে সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যগত বিষয়ে সমস্যা কমতি নেই। এরই মাঝে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর হানা এদেশটিতেও আঘাত হেনেছে। করোনার প্রথম ওয়েটিভ মোটামুটিভাবে সামাল দেয়া গেছে। সরকারি উদ্যোগে দ্রুত ভ্যাকসিন প্রদানের বিষয়টি প্রশংসিত, যা এখনও অব্যাহতভাবে চলছে।

বড়দের মাধ্যমেই শিশুদের করোনা হয়, তাই শিশুদের করোনা থেকে বাঁচতে বড়দের দায়িত্বই বেশি। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা পরিবারের অন্যদের অবশ্যই সামাজিক অনুষ্ঠান বিনোদন কেন্দ্র এবং যেখানে ভিড় হয় সেসব স্থান এড়িয়ে চলতে হবে। সম্ভব হলে লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। কারও সামনে মাস্ক খোলা যাবে না। কর্মক্ষেত্র থেকেই এসে বাচ্চার কাছে যাওয়া যাবে না। আগে কাপড় বদলে ভালভাবে হাত মুখ ধুয়ে, গোসল সেরে শিশুর কাছে যেতে হবে। শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে শেখাতে হবে। কীভাবে হাঁচি-কাশি দিতে হয়, কীভাবে হাত ধুতে হয়, এসব শেখানো আমাদের দায়িত্ব।

আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকা দেয়া গেলে তাতে অর্থনীতিতে ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার বা পৌনে দুই লাখ টাকার আর্থিক সুফল মিলবে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হলে টিকা কেনা থেকে শুরু করে সরবারহের ব্যয়সহ কমপক্ষে খরচ হবে ১১৭ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ খরচ করে বিপুল মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা গেলে তাতে অর্থনীতি ব্যাপকভাবে লাভবান হবে, বিশ্বব্যাংকের তৃতীয় হিসাবটিকে বিবেচনায় নিয়ে বলেছে, ৭০ শতাংশ শানুষকে টিকাদানের আওতায় আনতে বাংলাদেশের ২০২১ সালের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ১০ শতাংশ এবং পরের বছর দশমিক ২৩ শতাংশ খরচ হবে। ২০২০ ও ২০২১ সালের মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হলে তাদের মধ্যে এক ধরনের হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে, যার ব্যাপক অর্থনৈতিক সুফল রয়েছে, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার বা পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা।

মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা- এ তিন হচ্ছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল। এ তিন ছাড়া কোন কিছুতেই উপকার হবে না। বাসার বাইরে বের হলেই এগুলো মানা বাধ্যতামূলক। ‘যারা বাসার বাইরে যাচ্ছেন, তারা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানেন, তাহলে সরকারের বিধিনিষেধ আরোপ করে করোনা সংক্রমণের যে প্রচেষ্টা, তা ভেস্তে যাবে।

সেই সঙ্গে আমাদের জীবন ব্যবস্থারও পরিবর্তন করতে হবে, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত ৩০ মিনিট ব্যয়াম এবং তামাক বা ধূমপান জাতীয় মাদকদ্রব্যের নেশা থেকে মুক্ত থাকাই এখন সুস্থ থাকার একমাত্র উপায় ও অবলম্বন।

[লেখক : সাম্মানিক উপদেষ্টা, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম হাসপাতাল ]

prof.arupratanchoudhury@yahoo.com

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই একমাত্র উপায়

অধ্যাপক অরূপ রতন চৌধুরী

image

বুধবার, ০৭ এপ্রিল ২০২১

দেশে এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনাভাইরাসে মৃত্যু বেড়েছে ৭১ শতাংশ। আগের সপ্তাহের তুলনায় ৫৫তম সপ্তাহে শনাক্ত বেড়েছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।

সংক্রমণ মোকাবিলায় গত ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে অর্ধেক জনবল দিয়ে অফিস পরিচালনা করা, জনসমাগম সীমিত করা, গণপরিবহনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করা ইত্যাদি। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এগুলো অন্যতম পদ্ধতি। যেহেতু ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে পরিপূর্ণভাবে তা কার্যকর করা যাচ্ছিল না, তাই লকডাউনে যেতে হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য হলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ। তবে ঝুঁকি বিবেচনায় সময়ে সময়ে পরিকল্পনা হালনাগাদ করা প্রয়োজন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চূড়ায় (পিক) উঠেছিল গত বছরের জুন-জুলাইয়ে। ওই সময়টায়, বিশেষ করে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার হাজার রোগী শনাক্ত হতো। এরপর কয়েক মাস পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকার পর এক মাসের বেশি সময় ধরে সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী।

আবারও বাড়ছে করোনার এ নতুন ধরনের সংক্রমণের হার। আগের চেয়ে ৭০ ভাগ বেশি আর জটিলতা বেশি ৩০ ভাগ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, শিশুরাও এখন নিরাপদ নয়। আগে ধারণা করা হয়েছিল, শিশুদের করোনা হওয়ার ঝুঁকি কম, হলেও খুব সামান্য জটিলতা আছে। কিন্তু ইদানীং দেখা গেছে, শিশুরাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এবারের ঢেউয়ে শিশুরা ব্যাপকসংখ্যক আক্রান্ত হচ্ছে। তাই শিশুদের করোনা থেকে বাঁচতে এখনই সতর্ক হতে হবে।

এবার করোনায় প্রচুরসংখ্যক শিশু ডায়রিয়া, পেটেব্যথা ও বমি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। অবশ্য যারা গন্ধ কম পান, করোনায় তাদের তীব্র জটিলতা কম হয়, এটা বিভিন্ন গবেষণায়ও প্রকাশিত হয়েছে। আগে যেমন অনেকেরই গন্ধহীনতার উপসর্গ হতো, এবার তেমনটি দেখা যাচ্ছে কম। বড়দের মতো জর, কাশি, গলাব্যথা তো থাকেই। তবে এবারের করোনায় মাথাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, শরীরব্যথার কথা বলছে অনেক শিশু। চোখ লাল হওয়া ও শরীরে র‌্যাশও দেখা যাচ্ছে।

লকডাউনে শুধু জরুরি সেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান এবং পণ্যবাহী যানবাহন ও শিল্প কারখানা খোলা থাকবে। বন্ধ থাকবে গণপরিবহন, যাত্রীবাহী ট্রেন, যাত্রীবাহী নৌযান। অভ্যন্তরীণ পথে বিমান চলাচলও বন্ধ থাকবে। আর যেসব অফিস চালু রাখার প্রয়োজন রয়েছে, তাদের সীমিত জনবল নিয়ে চালাতে হবে। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া লকডাউনে ঘর থেকে বের হওয়া যায় না।

সারা দেশে সরকারি ও বেসকারি ব্যবস্থাপনায় ২২৭টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১২০টি, জিন-এক্সপার্ট ৩৪টি, র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৭৩টি। দেশে এখন চলছে করোনা সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েব (দ্বিতীয় ঢেউ)। প্রথম দিকের চেয়ে এ সংক্রমণ ইতোমধ্যে রেকর্ড গড়েছে। শুধু সংক্রমণ নয়, মৃত্যুর দিক থেকেও রেকর্ড। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে সরকার করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর বিধিনিষেধ অরোপের পর সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে। করোনার সেকেন্ড ওয়েভ নিয়ে জনসাধারণের মাঝে চরম আতঙ্ক রয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এখন মূল লক্ষ্য।

ইতোমধ্যে প্রথম আঘাত শুরু হয়ে অনেকটা শেষ হওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল দেশ এ ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। এ ধারণা ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। ফলে করোনাভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সব পর্যায়ে যেভাবে নতুন নতুন প্রস্তুতি এগিয়ে যাচ্ছিল সেটি একপর্যায়ে থমকে যায়। বর্তমানে সেকেন্ড ওয়েব শুরু হওয়ার পর আবার নতুন করে থমকে যাওয়া সেই প্রয়াসকে এগিয়ে নেয়ার তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু এরই মাঝে প্রতিদিন যে হারে এ ভাইরাসে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে সেটি রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রতিনিয়ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশের চিত্র সকল মহলকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টিকা নেয়াটা যেমন জরুরি, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাও এখন জরুরি।

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ওয়েভে ঢাকা চট্টগ্রামসহ ৩০ জেলাকে উচ্চহারে সংক্রমিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিপূর্বে চট্টগ্রামে এ ধরনের সংক্রমণ না ছড়ালেও এখন তা বিপরীত ঘটনা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাষন আলাদাভাবে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সন্ধ্যা ছয়টার পর সব ধরনের দোকানপাট, শপিংমল বন্ধ করার ঘোষণা কার্যকর করেছে।

কিন্তু সংক্রমণের হার ও রোগীর সংখ্যা যখন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, তখন মনোযোগ বাড়াতে হবে কভিড রোগীদের জীবন রক্ষার প্রতি। কোভিড রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ বাড়াতে হবে; পর্যাপ্ত অক্সিজেন, আইসিইউ সেবাসহ চিকিৎসার মান উন্নত করার জন্য বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে, প্রয়োজনে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ, দায়িত্বশীল ও সুশৃঙ্খল করার উদ্যোগে সরকার সচেষ্ট।

সংক্রমণের আরও বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য মাস্ক পরা, নিয়মত হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার প্রতি সবাইকে আরও মনোযোগী ও দায়িত্বশীল করে তোলার জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বাড়াতে যেমন বাড়াতে হবে তেমনি প্রতিটি বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও এখানে তাদরে ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় সচেতনতা কার্যক্রমকে বেগবান করতে স্থানীয় নেতারা এখন বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবেন। প্রতিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে।

যারা ঘরের বাইরে বেশি সময় কাটাচ্ছেন, তারা আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন। যুবকদের মধ্যে একটা অবহেলা, উপেক্ষার ভাব রয়েছে। অযথা ঘুরে বেড়ানো আড্ডা দেয়ার কারণে করোনায় আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন তারা। ফলে হাসপাতালগুলোতে তাদের সংখ্যা বেশি।

চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তের হার ২০ শতাংশের বেশি। আক্রান্তের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সী। শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালের শয্যাও যুবকদের দখলে বেশি, প্রায় ৬৫ শতাংশ।

স্বাস্থ্যবিধি না মানা, যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো, আড্ডাবাজিসহ নানা কারণে কম বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে চিকিৎসকরা মনে করেছেন। পাশাপাশি টিকা দেয়ার পর করোনা জয় করার প্রবণতাও কাজ করছে অনেকের মধ্যে। তাদের কারণে ঘরের বয়োবৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।

বিষয়টি আতঙ্কের হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এর থেকে পরিত্রাণের মূল উপায় হিসেবে এ পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের ছোট্ট এ দেশটি বিভিন্ন দিক থেকে সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যগত বিষয়ে সমস্যা কমতি নেই। এরই মাঝে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর হানা এদেশটিতেও আঘাত হেনেছে। করোনার প্রথম ওয়েটিভ মোটামুটিভাবে সামাল দেয়া গেছে। সরকারি উদ্যোগে দ্রুত ভ্যাকসিন প্রদানের বিষয়টি প্রশংসিত, যা এখনও অব্যাহতভাবে চলছে।

বড়দের মাধ্যমেই শিশুদের করোনা হয়, তাই শিশুদের করোনা থেকে বাঁচতে বড়দের দায়িত্বই বেশি। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা পরিবারের অন্যদের অবশ্যই সামাজিক অনুষ্ঠান বিনোদন কেন্দ্র এবং যেখানে ভিড় হয় সেসব স্থান এড়িয়ে চলতে হবে। সম্ভব হলে লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। কারও সামনে মাস্ক খোলা যাবে না। কর্মক্ষেত্র থেকেই এসে বাচ্চার কাছে যাওয়া যাবে না। আগে কাপড় বদলে ভালভাবে হাত মুখ ধুয়ে, গোসল সেরে শিশুর কাছে যেতে হবে। শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে শেখাতে হবে। কীভাবে হাঁচি-কাশি দিতে হয়, কীভাবে হাত ধুতে হয়, এসব শেখানো আমাদের দায়িত্ব।

আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকা দেয়া গেলে তাতে অর্থনীতিতে ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার বা পৌনে দুই লাখ টাকার আর্থিক সুফল মিলবে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হলে টিকা কেনা থেকে শুরু করে সরবারহের ব্যয়সহ কমপক্ষে খরচ হবে ১১৭ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ খরচ করে বিপুল মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা গেলে তাতে অর্থনীতি ব্যাপকভাবে লাভবান হবে, বিশ্বব্যাংকের তৃতীয় হিসাবটিকে বিবেচনায় নিয়ে বলেছে, ৭০ শতাংশ শানুষকে টিকাদানের আওতায় আনতে বাংলাদেশের ২০২১ সালের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ১০ শতাংশ এবং পরের বছর দশমিক ২৩ শতাংশ খরচ হবে। ২০২০ ও ২০২১ সালের মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হলে তাদের মধ্যে এক ধরনের হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে, যার ব্যাপক অর্থনৈতিক সুফল রয়েছে, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার বা পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা।

মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা- এ তিন হচ্ছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল। এ তিন ছাড়া কোন কিছুতেই উপকার হবে না। বাসার বাইরে বের হলেই এগুলো মানা বাধ্যতামূলক। ‘যারা বাসার বাইরে যাচ্ছেন, তারা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানেন, তাহলে সরকারের বিধিনিষেধ আরোপ করে করোনা সংক্রমণের যে প্রচেষ্টা, তা ভেস্তে যাবে।

সেই সঙ্গে আমাদের জীবন ব্যবস্থারও পরিবর্তন করতে হবে, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত ৩০ মিনিট ব্যয়াম এবং তামাক বা ধূমপান জাতীয় মাদকদ্রব্যের নেশা থেকে মুক্ত থাকাই এখন সুস্থ থাকার একমাত্র উপায় ও অবলম্বন।

[লেখক : সাম্মানিক উপদেষ্টা, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম হাসপাতাল ]

prof.arupratanchoudhury@yahoo.com

back to top