ডেরেক গ্রসম্যান
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে তার দেশের সব সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যদিয়ে গোটা আফগানিস্তান দখলে নেয়ার ক্ষেত্রে তালেবানদের সবচেয়ে বড় বাধা অপসারিত হলো। ইতোমধ্যেই আফগানিস্তানের ৮৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে দাবি করেছে তালেবানরা।
নানান সমালোচনা সত্ত্বেও গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা উপস্থিতি আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রেখেছে। এখন তারা সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর আবার তালেবানদের ক্ষমতা দখলের আশঙ্কায় এই অঞ্চলের রাষ্ট্রশক্তিসমূহের মধ্যে যে বড় ধরনের দুর্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে। যেমন এ মাসেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর মস্কো ও তেহরান সফর করেছেন। তিনি এমন সময় এই সফর করেন যখন তালেবানদের প্রতিনিধিরাও ওই দুই শহরেই অবস্থান করছিলেন। তাই পর্দার আড়ালে তাদের মধ্যে আলাপ চলছে বলেও অনুমান রয়েছে।
এদিকে রাশিয়া চাইছে ‘কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ নামে ছয়টি রাষ্ট্রের যে চুক্তি আছে, আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তান সীমান্ত সমস্যা সমাধানে সেটি কাজে লাগাতে। তাজিকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকা এখন তালেবানদের দখলে।
আর আফগান সরকারের সঙ্গে খুব দ্রুত দূরত্ব বেড়ে চলেছে পাকিস্তানের। নিজ দেশের তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে আফগান তালেবানদের দরকার পাকিস্তানের। তাই আফগান তালেবানদের খুশি রাখতেই যেন পাকিস্তানের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোন ঘাঁটি গাড়তে না দেয়ার ঘোষণা পাকিস্তান সরকারের।
এদিকে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনার জন্য গত সপ্তাহে অর্থনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক জোট সাংহাই করপোরেশন অর্গানাইজেশনের সদস্য হিসেবে বৈঠকে বসে চীন, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার চারটি দেশের প্রতিনিধিরা।
তবে গোটা অঞ্চলব্যাপী বিরাজমান উদ্বেগের মধ্যেই খুব নিঃশব্দে আফগানিস্তানে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে চীন।
জানা গেছে, পেশোয়ার থেকে কাবুল পর্যন্ত মোটরওয়ে প্রকল্পে আফগানিস্তান সরকারকে রাজি করাতে চেষ্টা চালাচ্ছে চীন সরকার। এই মোটরওয়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করবে। আফগানিস্তানকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নামের বিশাল অবকাঠামো ও বিনিয়োগ প্রকল্পে নিতে চায় চীন। এখন পর্যন্ত অবশ্য আফগানিস্তান সরকার তাতে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি। কেননা নিশ্চিতভাবেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেতে চায় না।
চীন তার ওয়াখান করিডোরের মধ্যদিয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ জিনজিয়ানের সঙ্গে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার একটি সংযোগ সড়ক স্থাপনে কাজ করছে। এটা সম্পন্ন হলে এই অঞ্চলের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। আফগানিস্তান থেকে সম্পদ আহরণ করতে পারবে তারা।
২০১৪ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানের পার্বত্য এলাকায় ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থাৎ লক্ষ কোটি ডলারের কাছাকাছি মূল্যের খনিজ ধাতু প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে। তবে এসব সুবিধা নিতে হলে আফগানিস্তানকে আগে স্থিতিশীল ও নিরাপদ করতে হবে।
এখন তালেবানদের ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহীন এক সাক্ষাৎকারে যে কথা বলেছেন, তা চীন সুখবর হিসেবেই নিতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘চীন একটি বন্ধু রাষ্ট্র এবং আফগানিস্তান পুনর্গঠন ও উন্নয়নের কাজে আমরা তাদের স্বাগত জানাই। যদি তারা এদেশে বিনিয়োগ করে, অবশ্যই আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।’ চীনের উইঘুর মুসলমানদের সমর্থন দেবে কিনা জানতে চাইলে ওই তালেবান নেতা বলেন, ‘মুসলমানরা অত্যাচারিত হলে আমরা চিন্তিত হই। সেটা ফিলিস্তিনে হোক, মায়ানমার বা চীন, যেখানেই হোক। এমনকি কোথাও অমুসলমানরা অত্যাচারিত হলেও আমরা বিচলিত হই। তবে আমরা চীনের অভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছি না।’ তালেবানদের এ কথায় নিশ্চয় আশ্বস্ত হবে চীন। আর এই অঞ্চলে ক্ষমতার জন্য চীনকে খুশি রাখাই হবে তালেবানদের প্রথম কাজ।
আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে চলমান সংঘাতের নিরসন চায় চীন। তা সত্ত্বেও তারা এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, যদি তালেবানরা সরকার গঠন করতে পারে তাহলে চীন তাদের আফগানিস্তানের বৈধ সরকার হিসেবেই গ্রহণ করবে।
সম্প্রতি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে যুক্তি দিয়ে বলা হয়, ‘তালেবানকে শত্রু বানানোয় কোন আগ্রহ নেই চীনের’। গত সপ্তাহেই একজন বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি ছাপা হয় পত্রিকাটিতে। তাতে তিনি বলেন, ‘তালেবানরা সবার অলক্ষ্যেই রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হচ্ছে। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়-আশয়ই এখন তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা দেশটির ক্ষমতা গ্রহণে প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়্যাং ইয়ি তালেবানদের প্রতি আফগানিস্তানে আবার ক্ষমতা নেয়ার জন্য সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যে কোন ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন। ধারণা করা যায়, চীন এ ধরনের একটি পরিস্থিতিই চাইছে। ২০১৯ সালে তারা প্রথম তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ সম্ভবত তার আগে থেকেই চলছে।
আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতার যে কোন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব যাতে নিজেদের ওপর না পড়ে, তা নিশ্চিতে চীন সরকার এর মধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে তার শক্তিশালী সম্পর্ক আরও জোরালো করার উদ্যোগ নিয়েছে। চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়্যাং বলেন, ‘আঞ্চলিক শান্তির সুরক্ষার কাজে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত। আফগানিস্তানের যে সমস্ত দল আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজছে তাদের সহায়তা করা উচিত। আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রভাব যাতে বিস্তৃত হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এ অঞ্চলের সার্বিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।’
ধারণা করা যায়, তালেবানদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য বা তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তানের ওপরই ব্যাপকভাবে নির্ভর করবে চীন।
তালেবানরা যদি আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই নেয়, তাহলে তালেবানদের সঙ্গে চীনের ভূরাজনৈতিক সম্পর্কটি হবে তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের মধ্যে টেকসই ইতিবাচক সম্পর্ক আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা বাড়াবে।
ইতোমধ্যেই এই অঞ্চলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক আছে চীনের। তা শুধু সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন দিয়ে না। তার ওপর আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক হলে লাভ বেশি হবে চীনেরই। যদি সত্যি সত্যিই তালেবানরা তাদের দেয়া কথা রক্ষা করে, তাহলে আফগানিস্তানের মধ্যদিয়ে যাওয়া বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রজেক্ট থেকে চীনারা তো লাভবান হবেই, উইঘুর উগ্রবাদীদের দমনও সহজ হবে তাদের জন্য।
এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়ছে। যা আরও জোরালো হচ্ছে তালেবান-সখ্যের কারণে। এ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই মধ্য এশিয়ায় চীনের কাছে প্রভাব হারানোর বিষয়ে চিন্তিত হয়ে ওঠবে রাশিয়া। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের নতুন জায়গা তৈরি হবে তখন। যদিও ভারত আড়ালে তালেবানদের সঙ্গে আলাপ চালাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তবুও চীনের পক্ষ থেকে তালেবানদের আনুষ্ঠানিক কোন স্বীকৃতি দেয়া হলে তাতে চীনের সঙ্গে ভারতের বিদ্যমান বৈরিতা আরও ঘোরতর হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক তো আছেই, তার ওপর হিমালয় অঞ্চলে সীমান্ত সমস্যা ভারত-চীনের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে সম্প্রতি।
তালেবানরা যদি ক্ষমতা আবার দখল করেও ফেলে, এটা পরিষ্কার নয় যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বীকৃতি দেবে কিনা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের অনেকগুলো বিষয়ে বিরোধ চলছে। তবে এখন পর্যন্ত আফগানিস্তান প্রশ্নে তাদের ঐকমত্য আছে। দুপক্ষই আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিরোধের সমাপ্তি চায়। এখন যদি চীন তালেবানদের স্বীকৃতি দেয়, আর যুক্তরাষ্ট্র যদি না দেয়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটা একটা ব্যাপার।
আবার অন্যভাবে যদি দেখি, তালেবানদের সঙ্গে যদি চীনের সম্পর্ক খারাপই হয়, তাহলে তার প্রভাব চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্কে কিরকম প্রভাব ফেলবে? চীন চাইবে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ দমনে ভূমিকা নিক, সেক্ষেত্রে দেখা গেল পাকিস্তান তা করতে অনিচ্ছুক। কেননা পাকিস্তান দেখবে তার নিজের দেশের জঙ্গি সংগঠন- তেহরিক-ই-তালেবান, লস্কর-ই তৈয়েবা, জৈশ-ই-মোহাম্মাদকে যদি আফগানিস্তানে তৎপরতা চালাতে না দেয়া হয়, তাহলে চাপ এসে পড়বে পাকিস্তানের ওপর।
গত সপ্তাহেই একটি বাস বিস্ফোরণের ঘটনায় বিপরীত অবস্থান নেয় চীন ও পাকিস্তান। ওই বিস্ফোরণে বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে কর্মরত বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক নিহত হন। পাকিস্তান গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলে, কিন্তু চীন বলে এটা হামলা। যদিও পরে পাকিস্তান স্বীকার করে যে, এটা হামলাই ছিল। এই ঘটনা থেকে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে, উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলেও সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে তাদের মধ্যে অমিল আছে। তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করে ফেললে এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে আরও সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে, পাকিস্তান কিন্তু নিজেদের দেশে বা আফগানিস্তান কোথাও চীনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে যেহেতু পাকিস্তানের সঙ্গে কয়েক দশকের সুসম্পর্ক চীনের, তালেবানদের নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে উভয় দেশ তার সমাধানও খুঁজে বের করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
সব মিলিয়ে, আফগানিস্তানে যদি তালেবানরা ক্ষমতা নিতে পারে, চীন তাদের কাছ থেকে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করবে। এসব কারণেই আগামী দিনে কী হয়, তা দেখার বিষয়।
(লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের খ-কালীন অধ্যাপক, ফরেইন পলিসিতে প্রকাশিত নিবন্ধ; ভাষান্তর মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক)
ডেরেক গ্রসম্যান
বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে তার দেশের সব সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যদিয়ে গোটা আফগানিস্তান দখলে নেয়ার ক্ষেত্রে তালেবানদের সবচেয়ে বড় বাধা অপসারিত হলো। ইতোমধ্যেই আফগানিস্তানের ৮৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে দাবি করেছে তালেবানরা।
নানান সমালোচনা সত্ত্বেও গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা উপস্থিতি আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রেখেছে। এখন তারা সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর আবার তালেবানদের ক্ষমতা দখলের আশঙ্কায় এই অঞ্চলের রাষ্ট্রশক্তিসমূহের মধ্যে যে বড় ধরনের দুর্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে। যেমন এ মাসেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর মস্কো ও তেহরান সফর করেছেন। তিনি এমন সময় এই সফর করেন যখন তালেবানদের প্রতিনিধিরাও ওই দুই শহরেই অবস্থান করছিলেন। তাই পর্দার আড়ালে তাদের মধ্যে আলাপ চলছে বলেও অনুমান রয়েছে।
এদিকে রাশিয়া চাইছে ‘কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ নামে ছয়টি রাষ্ট্রের যে চুক্তি আছে, আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তান সীমান্ত সমস্যা সমাধানে সেটি কাজে লাগাতে। তাজিকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকা এখন তালেবানদের দখলে।
আর আফগান সরকারের সঙ্গে খুব দ্রুত দূরত্ব বেড়ে চলেছে পাকিস্তানের। নিজ দেশের তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে আফগান তালেবানদের দরকার পাকিস্তানের। তাই আফগান তালেবানদের খুশি রাখতেই যেন পাকিস্তানের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোন ঘাঁটি গাড়তে না দেয়ার ঘোষণা পাকিস্তান সরকারের।
এদিকে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনার জন্য গত সপ্তাহে অর্থনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক জোট সাংহাই করপোরেশন অর্গানাইজেশনের সদস্য হিসেবে বৈঠকে বসে চীন, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার চারটি দেশের প্রতিনিধিরা।
তবে গোটা অঞ্চলব্যাপী বিরাজমান উদ্বেগের মধ্যেই খুব নিঃশব্দে আফগানিস্তানে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে চীন।
জানা গেছে, পেশোয়ার থেকে কাবুল পর্যন্ত মোটরওয়ে প্রকল্পে আফগানিস্তান সরকারকে রাজি করাতে চেষ্টা চালাচ্ছে চীন সরকার। এই মোটরওয়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করবে। আফগানিস্তানকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নামের বিশাল অবকাঠামো ও বিনিয়োগ প্রকল্পে নিতে চায় চীন। এখন পর্যন্ত অবশ্য আফগানিস্তান সরকার তাতে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি। কেননা নিশ্চিতভাবেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেতে চায় না।
চীন তার ওয়াখান করিডোরের মধ্যদিয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ জিনজিয়ানের সঙ্গে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার একটি সংযোগ সড়ক স্থাপনে কাজ করছে। এটা সম্পন্ন হলে এই অঞ্চলের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। আফগানিস্তান থেকে সম্পদ আহরণ করতে পারবে তারা।
২০১৪ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানের পার্বত্য এলাকায় ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থাৎ লক্ষ কোটি ডলারের কাছাকাছি মূল্যের খনিজ ধাতু প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে। তবে এসব সুবিধা নিতে হলে আফগানিস্তানকে আগে স্থিতিশীল ও নিরাপদ করতে হবে।
এখন তালেবানদের ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহীন এক সাক্ষাৎকারে যে কথা বলেছেন, তা চীন সুখবর হিসেবেই নিতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘চীন একটি বন্ধু রাষ্ট্র এবং আফগানিস্তান পুনর্গঠন ও উন্নয়নের কাজে আমরা তাদের স্বাগত জানাই। যদি তারা এদেশে বিনিয়োগ করে, অবশ্যই আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।’ চীনের উইঘুর মুসলমানদের সমর্থন দেবে কিনা জানতে চাইলে ওই তালেবান নেতা বলেন, ‘মুসলমানরা অত্যাচারিত হলে আমরা চিন্তিত হই। সেটা ফিলিস্তিনে হোক, মায়ানমার বা চীন, যেখানেই হোক। এমনকি কোথাও অমুসলমানরা অত্যাচারিত হলেও আমরা বিচলিত হই। তবে আমরা চীনের অভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছি না।’ তালেবানদের এ কথায় নিশ্চয় আশ্বস্ত হবে চীন। আর এই অঞ্চলে ক্ষমতার জন্য চীনকে খুশি রাখাই হবে তালেবানদের প্রথম কাজ।
আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে চলমান সংঘাতের নিরসন চায় চীন। তা সত্ত্বেও তারা এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, যদি তালেবানরা সরকার গঠন করতে পারে তাহলে চীন তাদের আফগানিস্তানের বৈধ সরকার হিসেবেই গ্রহণ করবে।
সম্প্রতি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে যুক্তি দিয়ে বলা হয়, ‘তালেবানকে শত্রু বানানোয় কোন আগ্রহ নেই চীনের’। গত সপ্তাহেই একজন বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি ছাপা হয় পত্রিকাটিতে। তাতে তিনি বলেন, ‘তালেবানরা সবার অলক্ষ্যেই রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হচ্ছে। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়-আশয়ই এখন তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা দেশটির ক্ষমতা গ্রহণে প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়্যাং ইয়ি তালেবানদের প্রতি আফগানিস্তানে আবার ক্ষমতা নেয়ার জন্য সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যে কোন ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন। ধারণা করা যায়, চীন এ ধরনের একটি পরিস্থিতিই চাইছে। ২০১৯ সালে তারা প্রথম তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ সম্ভবত তার আগে থেকেই চলছে।
আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতার যে কোন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব যাতে নিজেদের ওপর না পড়ে, তা নিশ্চিতে চীন সরকার এর মধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে তার শক্তিশালী সম্পর্ক আরও জোরালো করার উদ্যোগ নিয়েছে। চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়্যাং বলেন, ‘আঞ্চলিক শান্তির সুরক্ষার কাজে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত। আফগানিস্তানের যে সমস্ত দল আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজছে তাদের সহায়তা করা উচিত। আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রভাব যাতে বিস্তৃত হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এ অঞ্চলের সার্বিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।’
ধারণা করা যায়, তালেবানদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য বা তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তানের ওপরই ব্যাপকভাবে নির্ভর করবে চীন।
তালেবানরা যদি আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই নেয়, তাহলে তালেবানদের সঙ্গে চীনের ভূরাজনৈতিক সম্পর্কটি হবে তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের মধ্যে টেকসই ইতিবাচক সম্পর্ক আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা বাড়াবে।
ইতোমধ্যেই এই অঞ্চলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক আছে চীনের। তা শুধু সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন দিয়ে না। তার ওপর আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক হলে লাভ বেশি হবে চীনেরই। যদি সত্যি সত্যিই তালেবানরা তাদের দেয়া কথা রক্ষা করে, তাহলে আফগানিস্তানের মধ্যদিয়ে যাওয়া বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রজেক্ট থেকে চীনারা তো লাভবান হবেই, উইঘুর উগ্রবাদীদের দমনও সহজ হবে তাদের জন্য।
এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়ছে। যা আরও জোরালো হচ্ছে তালেবান-সখ্যের কারণে। এ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই মধ্য এশিয়ায় চীনের কাছে প্রভাব হারানোর বিষয়ে চিন্তিত হয়ে ওঠবে রাশিয়া। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের নতুন জায়গা তৈরি হবে তখন। যদিও ভারত আড়ালে তালেবানদের সঙ্গে আলাপ চালাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তবুও চীনের পক্ষ থেকে তালেবানদের আনুষ্ঠানিক কোন স্বীকৃতি দেয়া হলে তাতে চীনের সঙ্গে ভারতের বিদ্যমান বৈরিতা আরও ঘোরতর হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক তো আছেই, তার ওপর হিমালয় অঞ্চলে সীমান্ত সমস্যা ভারত-চীনের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে সম্প্রতি।
তালেবানরা যদি ক্ষমতা আবার দখল করেও ফেলে, এটা পরিষ্কার নয় যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বীকৃতি দেবে কিনা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের অনেকগুলো বিষয়ে বিরোধ চলছে। তবে এখন পর্যন্ত আফগানিস্তান প্রশ্নে তাদের ঐকমত্য আছে। দুপক্ষই আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিরোধের সমাপ্তি চায়। এখন যদি চীন তালেবানদের স্বীকৃতি দেয়, আর যুক্তরাষ্ট্র যদি না দেয়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটা একটা ব্যাপার।
আবার অন্যভাবে যদি দেখি, তালেবানদের সঙ্গে যদি চীনের সম্পর্ক খারাপই হয়, তাহলে তার প্রভাব চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্কে কিরকম প্রভাব ফেলবে? চীন চাইবে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ দমনে ভূমিকা নিক, সেক্ষেত্রে দেখা গেল পাকিস্তান তা করতে অনিচ্ছুক। কেননা পাকিস্তান দেখবে তার নিজের দেশের জঙ্গি সংগঠন- তেহরিক-ই-তালেবান, লস্কর-ই তৈয়েবা, জৈশ-ই-মোহাম্মাদকে যদি আফগানিস্তানে তৎপরতা চালাতে না দেয়া হয়, তাহলে চাপ এসে পড়বে পাকিস্তানের ওপর।
গত সপ্তাহেই একটি বাস বিস্ফোরণের ঘটনায় বিপরীত অবস্থান নেয় চীন ও পাকিস্তান। ওই বিস্ফোরণে বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে কর্মরত বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক নিহত হন। পাকিস্তান গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলে, কিন্তু চীন বলে এটা হামলা। যদিও পরে পাকিস্তান স্বীকার করে যে, এটা হামলাই ছিল। এই ঘটনা থেকে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে, উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলেও সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে তাদের মধ্যে অমিল আছে। তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করে ফেললে এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে আরও সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে, পাকিস্তান কিন্তু নিজেদের দেশে বা আফগানিস্তান কোথাও চীনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে যেহেতু পাকিস্তানের সঙ্গে কয়েক দশকের সুসম্পর্ক চীনের, তালেবানদের নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে উভয় দেশ তার সমাধানও খুঁজে বের করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
সব মিলিয়ে, আফগানিস্তানে যদি তালেবানরা ক্ষমতা নিতে পারে, চীন তাদের কাছ থেকে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করবে। এসব কারণেই আগামী দিনে কী হয়, তা দেখার বিষয়।
(লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের খ-কালীন অধ্যাপক, ফরেইন পলিসিতে প্রকাশিত নিবন্ধ; ভাষান্তর মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক)