ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
আলবেনীয় বংশোদ্ভূত মাদার তেরেসার জন্ম ২৬ আগস্ট ১৯১০ মেসিডোনিয়ার স্কোপিতে। পরিবার প্রদত্ত নাম আগ্নেস বোইয়াক্সিউ এবং ডাক নাম গোস্কসা। গোস্কসা মূলত একটি তুর্কি শব্দ, যার অর্থ ‘কুসুমকলি’। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার বাবা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তাদের পরিবারটি ছিল অত্যন্ত সুখী। কিন্তু ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস, মাত্র ৯ বছর বয়সে মাদার তেরেসাকে পিতৃহারা হতে হয়। শুধু বাসস্থানটুকু ছাড়া সর্বস্ব হারিয়ে মহাবিপদের সম্মুখীন হতে হয় পরিবারটিকে। আকস্মিক এই বিপর্যয়ের ফলে তেরেসার মা ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েন। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব এসে পড়ল তেরেসার বড় বোন অ্যাগের ওপর। কাপড় বিক্রি ও এ্যাম্ব্রয়ডারির ব্যবসা দিয়ে তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু হলো। জীবনের এই সংগ্রাম থেকে দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতাকে সাহস ও উদ্দীপনার সঙ্গে গ্রহণ করার তৎপরতা আবিষ্কার করেন মাদার তেরেসা।
তেরেসার লেখালেখির হাত খুব ভালো ছিল। তাই অনেকেই ধারণা করেছিলেন, লেখালেখি করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করবেন। কিন্তু তার আগ্রহ ছিল মানবসেবায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ঠিক করলেন সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করার। তৎকালীন সময়ে ভারতে বাংলায় ধর্মীয় কাজ করতেন যুগোশ্লাভীয় ধর্মযাজকরা। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, লরেটা সিস্টারদের মধ্যে যারা আইরিশ সম্প্রদায়ভুক্ত তারা যাবেন ভারতবর্ষের মতো এলাকায় কাজ করতে। এ্যাগনেস (মাদার তেরেসা) তাই তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করতে চাইলেন। কিন্তু এই কাজ পেতে হলে, তাকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হবে প্যারিসে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বিনয়ী, নম্র এবং পরোপকারে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা, তাকে কি কোন পরীক্ষায় পেছনে ফেলা যায়? আর যায় না বলেই হয়ত প্যারিসের সাক্ষাৎকারে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তেরেসা ও তার সঙ্গীকে পাঠানো হলো আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে তাদের সন্ন্যাস জীবনের প্রশিক্ষণ এবং ইংরেজি শিক্ষার জন্য। সেখানে মিশনারি মেয়েদের দল ‘সিস্টার্স অব লোরেটো’তে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষ করে প্রায় ছয় সপ্তাহ শেষে ১৯২৮ সালের পহেলা ডিসেম্বর দুই সন্ন্যাসিনী সুদূর ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে সমুদ্র পথে পাড়ি দিলেন। ভারতে এসে দার্জিলিংয়ে নবদীক্ষিত হিসেবে কাজ শুরু করেন।
বিংশ শতাব্দীতে গোটা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ২২ কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়া, নাৎসি জার্মানি ও চীন শীর্ষে রয়েছে। অকারণ নিষ্ঠুরতা বাড়ছে। এ নিষ্ঠুরতার মধ্যেই মাদার তেরেসার মতো মানবতাবাদীর কথা বড় বেশি করে মনে হয়। সব ছাপিয়ে যাওয়া মানবতা ও করুণার অন্য এক রূপ চোখে পড়ে। কলকাতায় দারিদ্র বেশি। অত্যাচার, অবিচারের মধ্যে গিয়ে ওই প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনযাত্রাকে ছোঁয়ার এটা এর আগে কেউ করেনি। মানুষ তা বুঝেছিল। তাই মাদারকে মানুষ আলাদা ভাবে শ্রদ্ধা, সম্মান জানিয়েছে। কোথাও একটা বোধশক্তি এ ব্যাপারে কাজ করছিল। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব করেননি মাদার। ভাবেননি, তার এই কাজের মাধ্যমে সমাজ কতটা পাল্টাবে। এরও তো একটা আলাদা মূল্য আছে! কমিউনিটি ভেঙে যাচ্ছে। হিংসা বাড়ছে। বাড়ছে নিষ্ঠুরতা। আর এরই মধ্যে মাদার যেন নীরব বিপ্লব করে গিয়েছেন।
তার সম্পূর্ণ অহিংস মানবসেবার কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে মাদার তেরেসা আজীবন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। পৃথিবীর সব মানুষ তার কাছে ছিল সন্তানতুল্য। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের অসহায় আর্ত, দরিদ্র, দুস্থ মানুষের প্রতি সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি ছুটে গেছেন পৃথিবীর এক গোলার্ধ থেকে অপর গোলার্ধে। এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। মানুষের সেবা করে যে আনন্দ পান তাতে তিনি নিজেকে ধন্য পরিতৃপ্ত মনে করেন। বিশ্বমাতা মাদার তেরেসা ছিলেন শিশুদের কাছে অত্যন্ত কাছের মানুষ, আপনজন, মায়ের মতো। মানুষকে ভালোবেসে তিনি পৃথিবীর মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন ভালোবাসার চেয়ে মহৎ কর্ম আর নেই। আজ পৃথিবীব্যাপী হিংসা, উগ্রতাবাদ, অস্থিরতা, যুদ্ধের দামামা গুলি ও বোমার মধ্যে বাস করছে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র। মাদার তেরেসা বলেছিলেন, পৃথিবীবাসীর গুলি আর বোমার দরকার নেই। দরকার ভালোবাসার। ভালোবাসা দিয়ে তিনি মানুষের মন জয় করে গেছেন হৃদয়ে স্থান লাভ করেছেন।
১৯৮৮ সালে প্রবল বন্যায় আমাদের জনজীবন যখন বিপর্যস্ত তখন বন্যাকবলিত দুর্গত মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে তাদের নানাভাবে সেবা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৭২ সালে আমাদের দেশে এসেছিলেন। আর্তমানবতার সেবা শুরু করেছিলেন কলকাতার বস্তিবাসীদের খাবার, আশ্রয়, রোগীর সেবা দিয়ে। বলা যায় মাদার তেরেসার সমগ্র জীবনটাই ছিল আর্তের সেবায়। ১৯৫২ সালে মাদার তেরেসা মুমূর্ষের জন্য প্রথম আশ্রয় ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলেন, দাতব্য চিকিৎসালয় কেন্দ্র। পরবর্তীকালে এ কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে রাখেন নির্মল হৃদয়। ১৯৫৮ সালে টিটাগর রেললাইনের ধারে প্রতিষ্ঠা করেন কুষ্ঠ আশ্রম ‘গান্ধিজি প্রেম নিবাস’।
তিনি যখন স্কুল ছেড়ে আসেন তখন তার হাতে ছিল মাত্র ৫ টাকা। যে টাকা দিয়ে শুরু করেন আর্তমানবতার সেবা। তেরেসার মিশনারিজ ও চ্যারিটি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখন খরচ করছে প্রতিদিন প্রায় ১২ লক্ষ টাকা। তিনি বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানাও গড়ে তুলেছিলেন যেগুলোতে প্রতিদিন আহার করে প্রায় ৬০ হাজার হতদরিদ্র নিরন্ন মানুষ। সারা বিশ্বকে তিনি আগলে রেখেছিলেন মায়ের মমতা, আদর, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে। এমনকি যুদ্ধের মাঝেও ছুটে গেছেন আক্রান্ত দেশে। ১৯৮২ সালে বৈরুত অবরোধের সময়ে হাসপাতালে আটকে পড়া প্রায় ৪০টি শিশুকে উদ্ধার করেন। ফিলিস্তিনি ইসরাইলি গেরিলাদের মধ্যে একসময় যখন যুদ্ধ বিরতি হয় সে সুযোগে তিনি ছুটে গেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে। বিধ্বস্ত হাসপাতাল থেকে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী রোগীদের সরিয়ে আনেন। মাদার তেরেসা ছুটে গেছেন ইথিওপিয়ার ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। সেবা করেছেন আর্তমানবতার। ধর্মীয় কোন বন্ধন তার সেবার পথ থেকে তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মাদার তেরেসা ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মানবতার মূল্য। উপলব্ধির নির্যাস থেকেই করেছেন বিখ্যাত উক্তি- তুমি দৃশ্যমান মানুষকে যদি ভালোবাসতে না পারো তবে অদৃশ্য ঈশ^রকে কী করে ভালোবাসবে! মানুষকে ভালোবেসে হয়ে উঠেছেন বিশ্বমাতা।
বিশ্ব মানবতার সেবায় তিনি আত্মনিয়োগ করার জন্য এ মহীয়সী ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। ১৯৮০ সালে ভারত রত্ন, ১৯৮৫ সালে প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম, ১৯৭৮ সালে বালজান পুরস্কারসহ বিভিন্ন দেশে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার মিশনারিজ অব চ্যারিটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
আজ সারা বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রে যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও উগ্রতাবাদ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে মাদার তেরেসার আদর্শ বড় প্রয়োজন ছিল। নিজের সুখ, শান্তি বিসর্জন দিয়ে আর্তমানবতার সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গকারী ক্ষণজন্মা এই মহীয়সীকে শ্রদ্ধা জানাই।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বুধবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
আলবেনীয় বংশোদ্ভূত মাদার তেরেসার জন্ম ২৬ আগস্ট ১৯১০ মেসিডোনিয়ার স্কোপিতে। পরিবার প্রদত্ত নাম আগ্নেস বোইয়াক্সিউ এবং ডাক নাম গোস্কসা। গোস্কসা মূলত একটি তুর্কি শব্দ, যার অর্থ ‘কুসুমকলি’। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার বাবা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তাদের পরিবারটি ছিল অত্যন্ত সুখী। কিন্তু ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস, মাত্র ৯ বছর বয়সে মাদার তেরেসাকে পিতৃহারা হতে হয়। শুধু বাসস্থানটুকু ছাড়া সর্বস্ব হারিয়ে মহাবিপদের সম্মুখীন হতে হয় পরিবারটিকে। আকস্মিক এই বিপর্যয়ের ফলে তেরেসার মা ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েন। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব এসে পড়ল তেরেসার বড় বোন অ্যাগের ওপর। কাপড় বিক্রি ও এ্যাম্ব্রয়ডারির ব্যবসা দিয়ে তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু হলো। জীবনের এই সংগ্রাম থেকে দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতাকে সাহস ও উদ্দীপনার সঙ্গে গ্রহণ করার তৎপরতা আবিষ্কার করেন মাদার তেরেসা।
তেরেসার লেখালেখির হাত খুব ভালো ছিল। তাই অনেকেই ধারণা করেছিলেন, লেখালেখি করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করবেন। কিন্তু তার আগ্রহ ছিল মানবসেবায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ঠিক করলেন সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করার। তৎকালীন সময়ে ভারতে বাংলায় ধর্মীয় কাজ করতেন যুগোশ্লাভীয় ধর্মযাজকরা। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, লরেটা সিস্টারদের মধ্যে যারা আইরিশ সম্প্রদায়ভুক্ত তারা যাবেন ভারতবর্ষের মতো এলাকায় কাজ করতে। এ্যাগনেস (মাদার তেরেসা) তাই তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করতে চাইলেন। কিন্তু এই কাজ পেতে হলে, তাকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হবে প্যারিসে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বিনয়ী, নম্র এবং পরোপকারে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা, তাকে কি কোন পরীক্ষায় পেছনে ফেলা যায়? আর যায় না বলেই হয়ত প্যারিসের সাক্ষাৎকারে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তেরেসা ও তার সঙ্গীকে পাঠানো হলো আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে তাদের সন্ন্যাস জীবনের প্রশিক্ষণ এবং ইংরেজি শিক্ষার জন্য। সেখানে মিশনারি মেয়েদের দল ‘সিস্টার্স অব লোরেটো’তে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষ করে প্রায় ছয় সপ্তাহ শেষে ১৯২৮ সালের পহেলা ডিসেম্বর দুই সন্ন্যাসিনী সুদূর ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে সমুদ্র পথে পাড়ি দিলেন। ভারতে এসে দার্জিলিংয়ে নবদীক্ষিত হিসেবে কাজ শুরু করেন।
বিংশ শতাব্দীতে গোটা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ২২ কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়া, নাৎসি জার্মানি ও চীন শীর্ষে রয়েছে। অকারণ নিষ্ঠুরতা বাড়ছে। এ নিষ্ঠুরতার মধ্যেই মাদার তেরেসার মতো মানবতাবাদীর কথা বড় বেশি করে মনে হয়। সব ছাপিয়ে যাওয়া মানবতা ও করুণার অন্য এক রূপ চোখে পড়ে। কলকাতায় দারিদ্র বেশি। অত্যাচার, অবিচারের মধ্যে গিয়ে ওই প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনযাত্রাকে ছোঁয়ার এটা এর আগে কেউ করেনি। মানুষ তা বুঝেছিল। তাই মাদারকে মানুষ আলাদা ভাবে শ্রদ্ধা, সম্মান জানিয়েছে। কোথাও একটা বোধশক্তি এ ব্যাপারে কাজ করছিল। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব করেননি মাদার। ভাবেননি, তার এই কাজের মাধ্যমে সমাজ কতটা পাল্টাবে। এরও তো একটা আলাদা মূল্য আছে! কমিউনিটি ভেঙে যাচ্ছে। হিংসা বাড়ছে। বাড়ছে নিষ্ঠুরতা। আর এরই মধ্যে মাদার যেন নীরব বিপ্লব করে গিয়েছেন।
তার সম্পূর্ণ অহিংস মানবসেবার কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে মাদার তেরেসা আজীবন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। পৃথিবীর সব মানুষ তার কাছে ছিল সন্তানতুল্য। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের অসহায় আর্ত, দরিদ্র, দুস্থ মানুষের প্রতি সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি ছুটে গেছেন পৃথিবীর এক গোলার্ধ থেকে অপর গোলার্ধে। এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। মানুষের সেবা করে যে আনন্দ পান তাতে তিনি নিজেকে ধন্য পরিতৃপ্ত মনে করেন। বিশ্বমাতা মাদার তেরেসা ছিলেন শিশুদের কাছে অত্যন্ত কাছের মানুষ, আপনজন, মায়ের মতো। মানুষকে ভালোবেসে তিনি পৃথিবীর মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন ভালোবাসার চেয়ে মহৎ কর্ম আর নেই। আজ পৃথিবীব্যাপী হিংসা, উগ্রতাবাদ, অস্থিরতা, যুদ্ধের দামামা গুলি ও বোমার মধ্যে বাস করছে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র। মাদার তেরেসা বলেছিলেন, পৃথিবীবাসীর গুলি আর বোমার দরকার নেই। দরকার ভালোবাসার। ভালোবাসা দিয়ে তিনি মানুষের মন জয় করে গেছেন হৃদয়ে স্থান লাভ করেছেন।
১৯৮৮ সালে প্রবল বন্যায় আমাদের জনজীবন যখন বিপর্যস্ত তখন বন্যাকবলিত দুর্গত মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে তাদের নানাভাবে সেবা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৭২ সালে আমাদের দেশে এসেছিলেন। আর্তমানবতার সেবা শুরু করেছিলেন কলকাতার বস্তিবাসীদের খাবার, আশ্রয়, রোগীর সেবা দিয়ে। বলা যায় মাদার তেরেসার সমগ্র জীবনটাই ছিল আর্তের সেবায়। ১৯৫২ সালে মাদার তেরেসা মুমূর্ষের জন্য প্রথম আশ্রয় ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলেন, দাতব্য চিকিৎসালয় কেন্দ্র। পরবর্তীকালে এ কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে রাখেন নির্মল হৃদয়। ১৯৫৮ সালে টিটাগর রেললাইনের ধারে প্রতিষ্ঠা করেন কুষ্ঠ আশ্রম ‘গান্ধিজি প্রেম নিবাস’।
তিনি যখন স্কুল ছেড়ে আসেন তখন তার হাতে ছিল মাত্র ৫ টাকা। যে টাকা দিয়ে শুরু করেন আর্তমানবতার সেবা। তেরেসার মিশনারিজ ও চ্যারিটি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখন খরচ করছে প্রতিদিন প্রায় ১২ লক্ষ টাকা। তিনি বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানাও গড়ে তুলেছিলেন যেগুলোতে প্রতিদিন আহার করে প্রায় ৬০ হাজার হতদরিদ্র নিরন্ন মানুষ। সারা বিশ্বকে তিনি আগলে রেখেছিলেন মায়ের মমতা, আদর, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে। এমনকি যুদ্ধের মাঝেও ছুটে গেছেন আক্রান্ত দেশে। ১৯৮২ সালে বৈরুত অবরোধের সময়ে হাসপাতালে আটকে পড়া প্রায় ৪০টি শিশুকে উদ্ধার করেন। ফিলিস্তিনি ইসরাইলি গেরিলাদের মধ্যে একসময় যখন যুদ্ধ বিরতি হয় সে সুযোগে তিনি ছুটে গেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে। বিধ্বস্ত হাসপাতাল থেকে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী রোগীদের সরিয়ে আনেন। মাদার তেরেসা ছুটে গেছেন ইথিওপিয়ার ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। সেবা করেছেন আর্তমানবতার। ধর্মীয় কোন বন্ধন তার সেবার পথ থেকে তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মাদার তেরেসা ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মানবতার মূল্য। উপলব্ধির নির্যাস থেকেই করেছেন বিখ্যাত উক্তি- তুমি দৃশ্যমান মানুষকে যদি ভালোবাসতে না পারো তবে অদৃশ্য ঈশ^রকে কী করে ভালোবাসবে! মানুষকে ভালোবেসে হয়ে উঠেছেন বিশ্বমাতা।
বিশ্ব মানবতার সেবায় তিনি আত্মনিয়োগ করার জন্য এ মহীয়সী ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। ১৯৮০ সালে ভারত রত্ন, ১৯৮৫ সালে প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম, ১৯৭৮ সালে বালজান পুরস্কারসহ বিভিন্ন দেশে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার মিশনারিজ অব চ্যারিটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
আজ সারা বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রে যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও উগ্রতাবাদ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে মাদার তেরেসার আদর্শ বড় প্রয়োজন ছিল। নিজের সুখ, শান্তি বিসর্জন দিয়ে আর্তমানবতার সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গকারী ক্ষণজন্মা এই মহীয়সীকে শ্রদ্ধা জানাই।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]