শিপন রবিদাস প্রাণকৃষ্ণ
যুগ যুগ ধরে মানুষের পায়ের জুতা সৌন্দর্যবর্ধন, মেরামত ও তৈরি করার কাজে নিয়োজিত আছে রবিদাস (চর্মকার/পাদুকাশিল্পী) সম্প্রদায়। বৈশ্বিক মহামারী করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন সারাদেশের নগর-বন্দর-মফস্বলে কর্মরত এই জনগোষ্ঠীর মানুষ, যার রেশ এখনও কাটেনি। সেবামূলক পেশায় নিয়োজিত রবিদাসরা দেশের সব উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে বসবাসরত রয়েছেন। অর্থের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ পর্যায়ের এই জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলো। রবিদাসদের সিংহভাগই রাস্তার পাশে, পাড়া/মহল্লায় বসে অথবা ফেরি (ভাসমান) করে জুতার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। যদিও ইদানীংকালে এই অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার প্রসারের দরুন ভিন্ন ভিন্ন পেশার দিকে ধাবিত হবার নজির লক্ষণীয়।
২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে ঘোর অমানিশা নেমে আসে এই জনগোষ্ঠীর ওপর। এই অতিমারীতে যদিও পুরো বিশ্ববাসীই সীমাহীন ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তবুও রবিদাসদের কষ্ট তুলনামূলক বেশি। রবিদাসদের কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে কাজে বসলেও মিলেনি আশানুরূপ কাস্টমার। অনেককেই মলিন মুখে বসে অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে। কাউকে কাউকে বসে বসে তাদের সেলাইয়ের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র শান দিতে দেখা গেছে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার দরুন তাদের কারো কাছেই মাস্ক ছাড়া করোনাভাইরাসের অন্য কোন সুরক্ষা সরঞ্জাম সচরাচর দেখা যায়নি।
গাজীপুর উপজেলার কালিয়াকৈর বাজার এলাকার শ্রী বাসুদেব জানান, ‘আমার পরিবারে আমার স্ত্রী দুই মেয়ে, দুই ছেলে ও মাসহ মোট ৭ জন সদস্য। ইনকাম না থাকায় পরিবার নিয়ে দু’বেলা খাওয়াটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে কীভাবে এসব সুরক্ষা সরঞ্জাম কিনে ব্যবহার করব। ইনকামের অবস্থা খুবই খারাপ। কাজ একদম কম। লকডাউনের কারণে তো আগের মতো মানুষের চলাফেরা নাই। গতকাল সারাদিনে মাত্র ১২০ টাকার কাজ করছি। আজ সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল মাত্র কয়েক টাকার কাজ হয়েছে। তবে লকডাউনের আগে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত কাজ করতে পারতাম।
সফিপুর এলাকার মৃত সত্যেন্দ্রর ছেলে কানাই জানান, ‘আমি সকাল থেকে মাত্র ১০ টাকার কাম করছি আর গতকাল ৮০ টাকার কাম করছিলাম। বর্তমানে এমন ইনকাম দেইখা আমার ছেলে এই কাম করতে রাজি হয় না। সে নাকি গ্যারেজের কাম করব। কি আর করমু। এহন স্কুল বন্ধ তাই গ্যারেজের কাম শিখাইতাছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাপ-দাদার এই পেশা আমি অনেক কষ্টে ধরে রেখেছি। আমার পরিবারে স্ত্রী ও দুই মেয়ে এক ছেলে। এ কাজ করে সংসার চালাতেই কষ্ট হয়ে যায়। তাই ছেলেমেয়েকে কয়েক ক্লাস পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছি। ইনকামের এই দুরবস্থা দেখে আমার ছেলে সবুজ বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে এখন রিকশা চালায়। আমাদের বর্তমানে খুব করুন অবস্থা।’
চর্মকার ক্ষিতিষ বলেন, ‘করোনা আসার পর থেকে আমাদের কেউ কোন সহযোগিতা করে নাই। আমরা কীভাবে দিনপাত করি এটা দেখার কেউ নাই। আমরা কি এদেশের নাগরিক না? আমরা কি ভোট দেই না? করোনার কারণে আমাদের ইনকাম নাই বললেই চলে এভাবে আমাদের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।’
রাজশাহীর একটি ক্লিনিকের পরিচ্ছন্নকর্মী রিতা রবিদাস। দেশে করোনার প্রকোপ শুরুর পর কর্মী ছাঁটাইয়ের অজুহাতে বেশ কিছুদিন বেকার থাকেন তিনি। পরে আবারও যোগ দিয়েছেন কাজে। তবে বেতন দেয়া হয় আগের অর্ধেক।
তিনি জানান, যতগুলো স্টাফ ছিলাম, সেখান থেকে কম কম করে আমাদের ডাকল। বলল, আমি তো এত বেতন দিতে পারব না, তাই ১০ জনের জায়গায় পাঁচজন নিয়ে কাজ করব।
দেশব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধ। এ বিধিনিষেধ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে রাজবাড়ীর রবিদাস সম্প্রদায়ের জন্য।
‘এখন দিনে ৪০-৬০ টাকা কামাই হয়। এ দিয়ে সংসার চলে না। সংসারে রয়েছে পাঁচ সদস্য। এর মধ্যে কিছুদিন হলো এক ছেলে মারা গেছেন। যার শ্রাদ্ধ করা হবে শুক্রবারে (২ জুলাই, ২০২১)। বিধিনিষেধে লোকজন বের হন না তেমন। এতে কামাইও হয় না। এখন কি করে ছেলের শ্রাদ্ধ করব?- সে চিন্তায় রয়েছি।’
এমন করেই অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন রাজবাড়ীতে তিন যুগের বেশি সময় ধরে জুতা সেলাইয়ের কাজ করা বাহাদুর রবিদাস (৭১)। তিনি রাজবাড়ী শহরের পৌর ইংলিশ সুপার মার্কেটের নিচে জুতা মেরামতের কাজ করেন।
‘সরকার তো ভালোর লিগা লকডাউন দিছে। আমাগো তো খাওন নাই। কাম-কাইজ কম। পোলাপান নিয়া ক্যামনে চলুম। কেউ তো আমাগো একটু সাহাইজ্যও করে না। এক সমায় তো দিনে ৪০০ ট্যাকা কামাইতাম। এহন তো ১০০ ট্যাকার কামও অয় না। পুলিশ আইলে দইরাইয়া পলান লাগে।’
এভাবেই আক্ষেপের স্বরে নিজের অসহায়ত্বের কথাগুলো বলছিলেন বাদল মনি দাস। ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর কায়কোবাদ চত্বরে ৩২ বছর ধরে জুতা সেলাই কাজ করেন তিনি। যন্ত্রাইল ইউনিয়নের হরিষকুল গ্রামের বাসিন্দা বাদল দাস স্কুলে পড়াশোনা করেননি। বাপ-দাদার পেশা বেছে নিয়ে জুতা সেলাই করে জীবনযাপন করেন তিনি। এক সময় কোন রকমে জীবনযাপন করলেও করোনাকালে আর আগের মতো রোজগার নেই। এতে বিপাকে পড়েছেন তিনি। তার মতো অনেকেই এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটান। আয় কমে যাওয়ায় দুর্দিনে থাকলেও নেই তেমন কোন সরকারি-বেসরকারি সহায়তা।
করোনাভাইরাসের কবলে পড়ে কার্যত লকডাউন সারা দেশ। ঘরবন্দি মানুষ। নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ। কবে নাগাদ শেষ হবে করোনা দুর্যোগ তা জানা নেই কারও। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন অনেকেই। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে দিচ্ছেন ত্রাণসামগ্রী। আবার কেউ কেউ করছেন ত্রাণ চুরি। ত্রাণ চুরিতে অনেক জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন। ত্রাণ চুরিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ইতোমধ্যে ৩৫ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। জাতীয় এই দুর্যোগে যখন জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ চুরিতে ব্যস্ত তখন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিরল দৃষ্টান্ত দেখালেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার লতিবপুর ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। তার নাম মিলন রবিদাস (৩৭)। তিনি মূলত একজন চর্মকার। জুতা সেলাই করে সংসার চলে তার।
‘দেশে অনেক সময়, অনেক দুর্যোগ দেখেছি। আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল দুর্যোগে দেশের মানুষের জন্য কিছু করার। করোনার মহামারী আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। জুতা সেলাই করে কিছু টাকা জমিয়েছি। কিন্তু করোনার দুর্যোগে না খেয়ে থাকা মানুষের কষ্ট দেখে ঘর করার ইচ্ছা মরে গেল। দীর্ঘদিনের জমানো ২০ হাজার টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দিয়ে দিলাম আমি। আশা করি, এতে একটু হলেও দরিদ্র মানুষের উপকার হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা দেয়ার পর এমনটাই বললেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার দরিদ্র মিলন রবিদাস।
২৭ এপ্রিল, ২০২০ দুপুর আড়াইটার দিকে মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন ভূঁইয়ার হাতে ২০ হাজার টাকা তুলে দেন মিলন রবিদাস।
মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন ভূঁইয়া বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার কাছে এটা অবাক করার মতো ঘটনা। একজন হরিজন সারাদিন জুতা রং করে, সেলাই করে। সেই ঘাম ঝরানো টাকা করোনার সময় অসহায় মানুষের জন্য সরকারি তহবিলে দেয়াটা নিঃসন্দেহে বিরল ঘটনা।’
সরকারের উচিত হবে সমাজের অত্যন্ত অনগ্রসর এই জনগোষ্ঠীর জন্য প্রণোদনা প্রদানসহ পাদুকা/চামড়াশিল্পে রবিদাসদের সর্বোচ্চ অবদান রাখবার সুযোগ করে দেয়া।
[লেখক : সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশ রবিদাস ফোরাম (বিআরএফ)]
শিপন রবিদাস প্রাণকৃষ্ণ
শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
যুগ যুগ ধরে মানুষের পায়ের জুতা সৌন্দর্যবর্ধন, মেরামত ও তৈরি করার কাজে নিয়োজিত আছে রবিদাস (চর্মকার/পাদুকাশিল্পী) সম্প্রদায়। বৈশ্বিক মহামারী করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন সারাদেশের নগর-বন্দর-মফস্বলে কর্মরত এই জনগোষ্ঠীর মানুষ, যার রেশ এখনও কাটেনি। সেবামূলক পেশায় নিয়োজিত রবিদাসরা দেশের সব উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে বসবাসরত রয়েছেন। অর্থের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ পর্যায়ের এই জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলো। রবিদাসদের সিংহভাগই রাস্তার পাশে, পাড়া/মহল্লায় বসে অথবা ফেরি (ভাসমান) করে জুতার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। যদিও ইদানীংকালে এই অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার প্রসারের দরুন ভিন্ন ভিন্ন পেশার দিকে ধাবিত হবার নজির লক্ষণীয়।
২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে ঘোর অমানিশা নেমে আসে এই জনগোষ্ঠীর ওপর। এই অতিমারীতে যদিও পুরো বিশ্ববাসীই সীমাহীন ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তবুও রবিদাসদের কষ্ট তুলনামূলক বেশি। রবিদাসদের কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে কাজে বসলেও মিলেনি আশানুরূপ কাস্টমার। অনেককেই মলিন মুখে বসে অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে। কাউকে কাউকে বসে বসে তাদের সেলাইয়ের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র শান দিতে দেখা গেছে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার দরুন তাদের কারো কাছেই মাস্ক ছাড়া করোনাভাইরাসের অন্য কোন সুরক্ষা সরঞ্জাম সচরাচর দেখা যায়নি।
গাজীপুর উপজেলার কালিয়াকৈর বাজার এলাকার শ্রী বাসুদেব জানান, ‘আমার পরিবারে আমার স্ত্রী দুই মেয়ে, দুই ছেলে ও মাসহ মোট ৭ জন সদস্য। ইনকাম না থাকায় পরিবার নিয়ে দু’বেলা খাওয়াটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে কীভাবে এসব সুরক্ষা সরঞ্জাম কিনে ব্যবহার করব। ইনকামের অবস্থা খুবই খারাপ। কাজ একদম কম। লকডাউনের কারণে তো আগের মতো মানুষের চলাফেরা নাই। গতকাল সারাদিনে মাত্র ১২০ টাকার কাজ করছি। আজ সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল মাত্র কয়েক টাকার কাজ হয়েছে। তবে লকডাউনের আগে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত কাজ করতে পারতাম।
সফিপুর এলাকার মৃত সত্যেন্দ্রর ছেলে কানাই জানান, ‘আমি সকাল থেকে মাত্র ১০ টাকার কাম করছি আর গতকাল ৮০ টাকার কাম করছিলাম। বর্তমানে এমন ইনকাম দেইখা আমার ছেলে এই কাম করতে রাজি হয় না। সে নাকি গ্যারেজের কাম করব। কি আর করমু। এহন স্কুল বন্ধ তাই গ্যারেজের কাম শিখাইতাছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাপ-দাদার এই পেশা আমি অনেক কষ্টে ধরে রেখেছি। আমার পরিবারে স্ত্রী ও দুই মেয়ে এক ছেলে। এ কাজ করে সংসার চালাতেই কষ্ট হয়ে যায়। তাই ছেলেমেয়েকে কয়েক ক্লাস পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছি। ইনকামের এই দুরবস্থা দেখে আমার ছেলে সবুজ বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে এখন রিকশা চালায়। আমাদের বর্তমানে খুব করুন অবস্থা।’
চর্মকার ক্ষিতিষ বলেন, ‘করোনা আসার পর থেকে আমাদের কেউ কোন সহযোগিতা করে নাই। আমরা কীভাবে দিনপাত করি এটা দেখার কেউ নাই। আমরা কি এদেশের নাগরিক না? আমরা কি ভোট দেই না? করোনার কারণে আমাদের ইনকাম নাই বললেই চলে এভাবে আমাদের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।’
রাজশাহীর একটি ক্লিনিকের পরিচ্ছন্নকর্মী রিতা রবিদাস। দেশে করোনার প্রকোপ শুরুর পর কর্মী ছাঁটাইয়ের অজুহাতে বেশ কিছুদিন বেকার থাকেন তিনি। পরে আবারও যোগ দিয়েছেন কাজে। তবে বেতন দেয়া হয় আগের অর্ধেক।
তিনি জানান, যতগুলো স্টাফ ছিলাম, সেখান থেকে কম কম করে আমাদের ডাকল। বলল, আমি তো এত বেতন দিতে পারব না, তাই ১০ জনের জায়গায় পাঁচজন নিয়ে কাজ করব।
দেশব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধ। এ বিধিনিষেধ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে রাজবাড়ীর রবিদাস সম্প্রদায়ের জন্য।
‘এখন দিনে ৪০-৬০ টাকা কামাই হয়। এ দিয়ে সংসার চলে না। সংসারে রয়েছে পাঁচ সদস্য। এর মধ্যে কিছুদিন হলো এক ছেলে মারা গেছেন। যার শ্রাদ্ধ করা হবে শুক্রবারে (২ জুলাই, ২০২১)। বিধিনিষেধে লোকজন বের হন না তেমন। এতে কামাইও হয় না। এখন কি করে ছেলের শ্রাদ্ধ করব?- সে চিন্তায় রয়েছি।’
এমন করেই অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন রাজবাড়ীতে তিন যুগের বেশি সময় ধরে জুতা সেলাইয়ের কাজ করা বাহাদুর রবিদাস (৭১)। তিনি রাজবাড়ী শহরের পৌর ইংলিশ সুপার মার্কেটের নিচে জুতা মেরামতের কাজ করেন।
‘সরকার তো ভালোর লিগা লকডাউন দিছে। আমাগো তো খাওন নাই। কাম-কাইজ কম। পোলাপান নিয়া ক্যামনে চলুম। কেউ তো আমাগো একটু সাহাইজ্যও করে না। এক সমায় তো দিনে ৪০০ ট্যাকা কামাইতাম। এহন তো ১০০ ট্যাকার কামও অয় না। পুলিশ আইলে দইরাইয়া পলান লাগে।’
এভাবেই আক্ষেপের স্বরে নিজের অসহায়ত্বের কথাগুলো বলছিলেন বাদল মনি দাস। ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর কায়কোবাদ চত্বরে ৩২ বছর ধরে জুতা সেলাই কাজ করেন তিনি। যন্ত্রাইল ইউনিয়নের হরিষকুল গ্রামের বাসিন্দা বাদল দাস স্কুলে পড়াশোনা করেননি। বাপ-দাদার পেশা বেছে নিয়ে জুতা সেলাই করে জীবনযাপন করেন তিনি। এক সময় কোন রকমে জীবনযাপন করলেও করোনাকালে আর আগের মতো রোজগার নেই। এতে বিপাকে পড়েছেন তিনি। তার মতো অনেকেই এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটান। আয় কমে যাওয়ায় দুর্দিনে থাকলেও নেই তেমন কোন সরকারি-বেসরকারি সহায়তা।
করোনাভাইরাসের কবলে পড়ে কার্যত লকডাউন সারা দেশ। ঘরবন্দি মানুষ। নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ। কবে নাগাদ শেষ হবে করোনা দুর্যোগ তা জানা নেই কারও। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন অনেকেই। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে দিচ্ছেন ত্রাণসামগ্রী। আবার কেউ কেউ করছেন ত্রাণ চুরি। ত্রাণ চুরিতে অনেক জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন। ত্রাণ চুরিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ইতোমধ্যে ৩৫ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। জাতীয় এই দুর্যোগে যখন জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ চুরিতে ব্যস্ত তখন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিরল দৃষ্টান্ত দেখালেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার লতিবপুর ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। তার নাম মিলন রবিদাস (৩৭)। তিনি মূলত একজন চর্মকার। জুতা সেলাই করে সংসার চলে তার।
‘দেশে অনেক সময়, অনেক দুর্যোগ দেখেছি। আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল দুর্যোগে দেশের মানুষের জন্য কিছু করার। করোনার মহামারী আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। জুতা সেলাই করে কিছু টাকা জমিয়েছি। কিন্তু করোনার দুর্যোগে না খেয়ে থাকা মানুষের কষ্ট দেখে ঘর করার ইচ্ছা মরে গেল। দীর্ঘদিনের জমানো ২০ হাজার টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দিয়ে দিলাম আমি। আশা করি, এতে একটু হলেও দরিদ্র মানুষের উপকার হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা দেয়ার পর এমনটাই বললেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার দরিদ্র মিলন রবিদাস।
২৭ এপ্রিল, ২০২০ দুপুর আড়াইটার দিকে মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন ভূঁইয়ার হাতে ২০ হাজার টাকা তুলে দেন মিলন রবিদাস।
মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন ভূঁইয়া বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার কাছে এটা অবাক করার মতো ঘটনা। একজন হরিজন সারাদিন জুতা রং করে, সেলাই করে। সেই ঘাম ঝরানো টাকা করোনার সময় অসহায় মানুষের জন্য সরকারি তহবিলে দেয়াটা নিঃসন্দেহে বিরল ঘটনা।’
সরকারের উচিত হবে সমাজের অত্যন্ত অনগ্রসর এই জনগোষ্ঠীর জন্য প্রণোদনা প্রদানসহ পাদুকা/চামড়াশিল্পে রবিদাসদের সর্বোচ্চ অবদান রাখবার সুযোগ করে দেয়া।
[লেখক : সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশ রবিদাস ফোরাম (বিআরএফ)]