alt

উপ-সম্পাদকীয়

এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব

অমিত রায় চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১
image

ছেলেবেলায় আকাশের রঙ বদলালেই মনে হতো পূজা এসে গেছে। প্রকৃতিও হয়ে উঠত অপরূপা। ঠিক মা দুর্গার মতো অদ্ভুত সুন্দর। শরতের নবীন ভোর, স্নিগ্ধ আলো। মনটা কেমন আনমনা হয়ে আসতো। নরম রোদ ঝরে পড়ছে। নিঃসীম আকাশ মিশে গেছে কাশবনে। রোদ বেয়ে পথ চলছে পথ হারানো পথিক। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পরিযায়ী মেঘের ভেলা। নিঃশব্দ জলাভূমির পাশে উচ্ছল কাশফুল। কখনও এক পশলা বৃষ্টি। পাতায় টুপ টুপ জলের শব্দ। আধো রাতে জ্যোৎস্না স্নান। অনুভবের সাগরে ঢেউ। ভেসে ওঠে মন্ডপের চিরকালীন চালচিত্র। হয়তো প্রতিমার অঙ্গে পড়ছে শেষ তুলির টান। গড়ে উঠছে বাঙালি মননে শাশ্বত দুর্গাকল্প। ব্যঞ্জনাটা যত না ধর্মীয় তার চেয়ে ঢের বেশি সামাজিক। প্রকৃতি ও সংস্কৃতির টানে নানা কল্পনায় সেজে উঠত উৎসবের গল্প।

শিউলিতলা ভরে উঠতো ফুলে আর ফুলে। শেষরাতে কান পাতলেই শোনা যেত ফুল ঝরার শব্দ। ভেসে আসতো শিউলি ফুলের মনমাতানো গন্ধ। দারুণ উচ্ছ্বাসে হাজির হতো মহালয়া। শ্রীশ্রী চন্ডিতে উল্লেখ আছে- মহাবিশ্বের অন্তরালে আছেন এক মহাশক্তি, যিনি মহামায়া। এ মহামায়াই জগৎ সৃষ্টি করেন। আবার প্রলয়কালে তিনিই ধারণ করেন রুদ্রমূর্তি। নির্যাতিত দেবতারা অশুভ শক্তির বিনাশে আদ্যাশক্তি মহামায়ার শরণাপন্ন হন। মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে বেতার তরঙ্গে ভেসে ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মোহনীয় কণ্ঠ, সৃষ্টি হয় চন্ডিপাঠের অমর কাব্য; যা বাংলার সব প্রান্তকে একসুরে বেঁধে ফেলতে পেরেছিল। শুধু বাংলা বলি কেন, পৃথিবীর যেখানেই বাংলা ভাষায় কথা হয়, সেখানেই কান পাতলেই শোনা যায় এই জাদুকরি কণ্ঠের আবেশ। ‘প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত/জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা/আশ্বিনের শারদ প্রাতে/বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জুরি’- এখানে যেমন গভীর আনন্দের ছোঁয়া আছে, তেমনি আছে বিষাদের ছায়া। কেমন যেন একটা অজানা মগ্নতা, যা নস্টালজিয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়, নতুন প্রানের ছোঁয়ায় ভরিয়ে দেয় মন। কৃষ্ণপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের সুচনা।

পূজার বিবর্তনের পথ হয়তো অনেক লম্বা। এর শেকড় বিস্তৃত আছে সভ্যতার অনেক গভীরে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন ২৫ হাজার বছর আগেও মাতৃ আরাধনার অস্তিত্ব ছিল। এরপর একে একে বহু সংস্কৃতির সান্নিধ্যে বয়ে এসেছে মাতৃবন্দনার রেওয়াজ। প্রকৃতির মাঝেই শক্তিকে দেখার রীতি শুরু হয়েছিল সভ্যতার প্রায় আদিলগ্নে। নারী ও প্রকৃতির মধ্যে সাযুজ্য দেখার ভঙ্গিটাও তৈরি হয় একই ধাঁচে। মাতৃ উপাসনার নৃতাত্ত্বিক বিস্তৃতিও অনেক গভীর। দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃদেবী আরাধনার প্রচলন ছিল। অনার্য সংস্কৃতিতে এই পূজার প্রচলন হয়েছিল বলে একটা ধারণা চালু আছে। এ কথাও সত্যি- বৈদিক যুগে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে পুরুষ দেবতা। তবে কৃষিজীবী আর্যরা ধরিত্রীকেও মা হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। আর্য-অনার্য ভেদে মাতৃবন্দনার শিকড় সন্ধানে সরল সমীকরণ সম্ভব না। মার্কন্ডেয় পুরাণে আদ্যাশক্তি মহামায়াকে মহাশক্তি হিসেবে বর্ণনা করা আছে, যার সঙ্গে দুর্গা কল্পনার মিল পাওয়া যায়। আবার পুরাণ মতে মহিষাসুরকে বধ করে পৃথিবীকে দুর্গতিমুক্ত করেন বলেই দেবীর নাম দুর্গা। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। মহাভারত অনুসারে কালীশক্তির আর এক রূপ দুর্গা। রামচন্দ্র স্বয়ং অকালে দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। বাঙালি হিন্দুর কাছে দুর্গা অসুরবিনাশী, মমতাময়ী মা।

চিরকালীন বাঙালি চেতনায় যে মননশীলতা জাগ্রত সেখানেও দেবী কল্পনার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে থাকবে। রামপ্রসাদ থেকে রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন হতে নজরুল সর্বত্রই নারীশক্তির মহিমা বর্ণিত হয়েছে। তবে উনিশ শতকেই যে শারদীয় দুর্গোৎসব আড়ম্বরের চেহারা নিয়েছিল তা বেশ অনুমান করা যায়। শাস্ত্র আর সমাজবিদ্যা, পূরাণ আর নৃতত্ত্ব- যে তর্কই চলুক না কেন, দুর্গাই শেষ অবধি বাঙালি অস্মিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই থেকে গেছে। বারোয়ারি মন্ডপে উপচেপড়া ভিড়। ঢাকের বাজনা। ধূপের ধোয়া। চন্দনের সৌরভ। এএক আবহমান, চিরচেনা রূপ। স্বদেশী আন্দোলনেও প্রেরণা জুগিয়েছে দ্রোহের প্রতীক এই দুর্গতিনাশিনী। ব্রিটিশবিরোধী শক্তিকেও ঐক্যবদ্ধ করতে এ উৎসব উদ্দীপনা দিয়েছে।

দুর্গাপুজো ক্রমশই রূপ পাল্টাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্ডপের আদলও বদলে যাচ্ছে। সাবেকি আমলের বনেদি পূজা থেকে হাল-আমলের বারোয়ারি পূজা। চরিত্রগতভাবেই আয়োজনে ভিন্নতা মাথা তুলেছে। রাজদরবার থেকে পূূজার আয়োজন এখন আমজনতার কাতারে। রাজা জমিদারদের বিত্তপ্রদর্শনী এখন নেই। দুর্গাপূজা শুধু বাঙালির ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয়ের বাহন হয়নি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে উৎসবের একটা সর্বজনীন কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। সমাজের এমন কোন অংশ নেই, যারা পূজার সার্বজনীনতার আওতামুক্ত। ভক্তি, আবেগ, উৎসাহ এখানে একাকার। উৎসব মানুষকে মানুষের সঙ্গে মেলায়, দূরত্ব কমায়। মিলন সরণিতেই বাঙালির প্রকৃত অধিবাস। শুধু নগরে নয়, প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ে সমগ্রতার স্পর্শ।

উল্লেখ্য, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এমনকি ধর্মবিশ্বাস নেই এমন জনগোষ্ঠীও উৎসবের এই উত্তাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেনি। প্রবাসী বাঙালির পূজা করার আর্তির মধ্যেই বাঙালি সত্তার মূল অস্তিত্বের খোঁজ মেলে। শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, অনুভূতি নিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে বাঙালিরা পূজার আয়োজনে ডুবে যায় অজানা আকর্ষণে। প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে মেয়েরা জড়ো হয় শাড়ি পরে, ছেলেরা নানা পোশাকে। বাঙালির সাজ-পোশাক, রান্না-বান্নার ঐতিহ্য। সবখানেই নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে নেওয়ার মরিয়া চেষ্টা। ঢাকের আওয়াজ, ধুপের গন্ধ-সব জায়গায় আত্মবিশ্বাসের ঠিকানা খোঁজার অবিরাম চেষ্টা। হয়তো কোথাও শেকড়ের সন্ধানে শারদোৎসবের আশ্রয়ে ব্যাকুল হয়ে পড়ে মন।

গ্রাম-বাংলার শ্যামল প্রান্তরে একচালা সাবেকি পূজামন্ডপ এখন বড় একটা চোখে পড়ে না। সাধারণ মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্গাম-পগুলোর ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে। দলবেঁধে, চাঁদা তুলে, মন্ডপ সাজিয়ে বারোয়ারি পূজার রেওয়াজ এখনো মুছে যায়নি। ঢাকের আওয়াজ, ধুপ-ধুনোর গন্ধ ছেড়ে দূরে সরে যেতে ইচ্ছে করে না। নিজেকে নানা ভঙ্গিতে মেলে ধরে যুবক-যুবতী। শাড়ির রঙ মিলেমিশে যায় রোদের সোনারঙে। পূজাকে কেন্দ্র করে বাঁধ ভাঙে জনস্রোত, ঘটে যায় গণবিস্ফোরণ। পূজা ক্রমশই হয়ে উঠে বৃহৎ এক সামাজিক পর্ব। কখনও তা থিমনির্ভর। কখনও নানারকম কৃৎকৌশল। আয়োজন বিপুল। থিমের সঙ্গে কলার যোগ। ধর্মের সঙ্গে শিল্পের বন্ধন। শারদোৎসব এখন শুধু সামাজিক মিলন নয়, হয়তো বাণিজ্য বিস্তারের বাহনও হয়ে ওঠে। শিল্প মানচিত্রেও আজ অনেকখানি জায়গা দখল করেছে এ উৎসব। এ মেলায় যোগ দেয়ার জন্য মাঠে নামে লাখ লাখ মানুষ।

আর এখানেই যুক্ত হয়েছে নতুন এক শঙ্কা। মহামারীর তৃতীয় তরঙ্গ। স্কুল-কলেজ খুলেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে সংক্রমণের ঝুঁকি। একদিকে মানুষের অসচেতনতা, অন্যদিকে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি। সাধারণভাবে মাস্ক পরা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও মনে হয় শিক্ষক দীর্ঘক্ষণ মাস্ক পরার ঝক্কি সামলাতে কাহিল। এমন বাস্তবতায় সামান্য অসতর্কতা বড় ধরনের বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। এমন একটা এলোমেলো সময়ে এবারে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিপন্ন অর্থনীতি, অনিশ্চয়তায় ঘেরা জীবন। তবুও জীবন থেমে নেই। তাই শঙ্কার মাঝেই আলোর রোশনাই।

উৎসবের সঙ্গে অনেক মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত। উৎসবকে কেন্দ্র করে এখন করপোরেট বাজারও সক্রিয়। অনলাইন শপিং জমে উঠছে বটে। প্রতারক চক্রও সক্রিয়। তবে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করলে মূল্য দিতে হবে। যে কোন মূল্যে আড়ম্বর কমাতে হবে। জনসমাগম এড়াতে হবে। করোনার লেখচিত্র নিম্নমুখী মানেই সংক্রমণ শেষ হয়নি। তাই দরকার সবার দায়িত্বশীলতা। যে কারণেই হোক সামাজিক সম্প্রীতির আবহ আগের মতো নেই। চারপাশকে কেমন যেন অচেনা মনে হয়। কিছুদিন আগেও যে কোন উৎসবকেই সবার বলে মনে হতো। বোধন হতে বিসর্জন-সবখানেই দেখেছি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন অংশীদারত্ব। সমাজবুননের কোথায় যেন বিভেদের অদৃশ্য দেয়াল মাথা তুলতে চাইছে, যা আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়। সমৃদ্ধি, শান্তি ও টেকসই উন্নতির জন্য সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ভীষণ জরুরি। প্রত্যাশা থাকবে- বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে দেশ এগিয়ে যাবে। আর করোনার বাড়বাড়ন্তকেও বিজ্ঞান থামিয়ে দেবে। তবে এ কথাও ঠিক- মিলনেই যেখানে বিধিনিষেধের ছায়া, উৎসবের আবেগ সেখানে প্রায় শূন্য। তাই অন্তরে জেগে থাক পূজার আমেজ। ধরা হোক ব্যাধিমুক্ত। সমাজ হোক ঘৃণামুক্ত। পৃথিবী হোক অগ্নিশুদ্ধ। পূজা হোক ঘরে ঘরে, নিষ্ঠায়-ভক্তিতে। সবমিলে হয়তো এবারই হবে উৎসবের এক নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অধ্যায়।

[লেখক : অধ্যক্ষ, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, ফকিরহাট, বাগেরহাট]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব

অমিত রায় চৌধুরী

image

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১

ছেলেবেলায় আকাশের রঙ বদলালেই মনে হতো পূজা এসে গেছে। প্রকৃতিও হয়ে উঠত অপরূপা। ঠিক মা দুর্গার মতো অদ্ভুত সুন্দর। শরতের নবীন ভোর, স্নিগ্ধ আলো। মনটা কেমন আনমনা হয়ে আসতো। নরম রোদ ঝরে পড়ছে। নিঃসীম আকাশ মিশে গেছে কাশবনে। রোদ বেয়ে পথ চলছে পথ হারানো পথিক। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পরিযায়ী মেঘের ভেলা। নিঃশব্দ জলাভূমির পাশে উচ্ছল কাশফুল। কখনও এক পশলা বৃষ্টি। পাতায় টুপ টুপ জলের শব্দ। আধো রাতে জ্যোৎস্না স্নান। অনুভবের সাগরে ঢেউ। ভেসে ওঠে মন্ডপের চিরকালীন চালচিত্র। হয়তো প্রতিমার অঙ্গে পড়ছে শেষ তুলির টান। গড়ে উঠছে বাঙালি মননে শাশ্বত দুর্গাকল্প। ব্যঞ্জনাটা যত না ধর্মীয় তার চেয়ে ঢের বেশি সামাজিক। প্রকৃতি ও সংস্কৃতির টানে নানা কল্পনায় সেজে উঠত উৎসবের গল্প।

শিউলিতলা ভরে উঠতো ফুলে আর ফুলে। শেষরাতে কান পাতলেই শোনা যেত ফুল ঝরার শব্দ। ভেসে আসতো শিউলি ফুলের মনমাতানো গন্ধ। দারুণ উচ্ছ্বাসে হাজির হতো মহালয়া। শ্রীশ্রী চন্ডিতে উল্লেখ আছে- মহাবিশ্বের অন্তরালে আছেন এক মহাশক্তি, যিনি মহামায়া। এ মহামায়াই জগৎ সৃষ্টি করেন। আবার প্রলয়কালে তিনিই ধারণ করেন রুদ্রমূর্তি। নির্যাতিত দেবতারা অশুভ শক্তির বিনাশে আদ্যাশক্তি মহামায়ার শরণাপন্ন হন। মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে বেতার তরঙ্গে ভেসে ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মোহনীয় কণ্ঠ, সৃষ্টি হয় চন্ডিপাঠের অমর কাব্য; যা বাংলার সব প্রান্তকে একসুরে বেঁধে ফেলতে পেরেছিল। শুধু বাংলা বলি কেন, পৃথিবীর যেখানেই বাংলা ভাষায় কথা হয়, সেখানেই কান পাতলেই শোনা যায় এই জাদুকরি কণ্ঠের আবেশ। ‘প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত/জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা/আশ্বিনের শারদ প্রাতে/বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জুরি’- এখানে যেমন গভীর আনন্দের ছোঁয়া আছে, তেমনি আছে বিষাদের ছায়া। কেমন যেন একটা অজানা মগ্নতা, যা নস্টালজিয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়, নতুন প্রানের ছোঁয়ায় ভরিয়ে দেয় মন। কৃষ্ণপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের সুচনা।

পূজার বিবর্তনের পথ হয়তো অনেক লম্বা। এর শেকড় বিস্তৃত আছে সভ্যতার অনেক গভীরে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন ২৫ হাজার বছর আগেও মাতৃ আরাধনার অস্তিত্ব ছিল। এরপর একে একে বহু সংস্কৃতির সান্নিধ্যে বয়ে এসেছে মাতৃবন্দনার রেওয়াজ। প্রকৃতির মাঝেই শক্তিকে দেখার রীতি শুরু হয়েছিল সভ্যতার প্রায় আদিলগ্নে। নারী ও প্রকৃতির মধ্যে সাযুজ্য দেখার ভঙ্গিটাও তৈরি হয় একই ধাঁচে। মাতৃ উপাসনার নৃতাত্ত্বিক বিস্তৃতিও অনেক গভীর। দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃদেবী আরাধনার প্রচলন ছিল। অনার্য সংস্কৃতিতে এই পূজার প্রচলন হয়েছিল বলে একটা ধারণা চালু আছে। এ কথাও সত্যি- বৈদিক যুগে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে পুরুষ দেবতা। তবে কৃষিজীবী আর্যরা ধরিত্রীকেও মা হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। আর্য-অনার্য ভেদে মাতৃবন্দনার শিকড় সন্ধানে সরল সমীকরণ সম্ভব না। মার্কন্ডেয় পুরাণে আদ্যাশক্তি মহামায়াকে মহাশক্তি হিসেবে বর্ণনা করা আছে, যার সঙ্গে দুর্গা কল্পনার মিল পাওয়া যায়। আবার পুরাণ মতে মহিষাসুরকে বধ করে পৃথিবীকে দুর্গতিমুক্ত করেন বলেই দেবীর নাম দুর্গা। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। মহাভারত অনুসারে কালীশক্তির আর এক রূপ দুর্গা। রামচন্দ্র স্বয়ং অকালে দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। বাঙালি হিন্দুর কাছে দুর্গা অসুরবিনাশী, মমতাময়ী মা।

চিরকালীন বাঙালি চেতনায় যে মননশীলতা জাগ্রত সেখানেও দেবী কল্পনার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে থাকবে। রামপ্রসাদ থেকে রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন হতে নজরুল সর্বত্রই নারীশক্তির মহিমা বর্ণিত হয়েছে। তবে উনিশ শতকেই যে শারদীয় দুর্গোৎসব আড়ম্বরের চেহারা নিয়েছিল তা বেশ অনুমান করা যায়। শাস্ত্র আর সমাজবিদ্যা, পূরাণ আর নৃতত্ত্ব- যে তর্কই চলুক না কেন, দুর্গাই শেষ অবধি বাঙালি অস্মিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই থেকে গেছে। বারোয়ারি মন্ডপে উপচেপড়া ভিড়। ঢাকের বাজনা। ধূপের ধোয়া। চন্দনের সৌরভ। এএক আবহমান, চিরচেনা রূপ। স্বদেশী আন্দোলনেও প্রেরণা জুগিয়েছে দ্রোহের প্রতীক এই দুর্গতিনাশিনী। ব্রিটিশবিরোধী শক্তিকেও ঐক্যবদ্ধ করতে এ উৎসব উদ্দীপনা দিয়েছে।

দুর্গাপুজো ক্রমশই রূপ পাল্টাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্ডপের আদলও বদলে যাচ্ছে। সাবেকি আমলের বনেদি পূজা থেকে হাল-আমলের বারোয়ারি পূজা। চরিত্রগতভাবেই আয়োজনে ভিন্নতা মাথা তুলেছে। রাজদরবার থেকে পূূজার আয়োজন এখন আমজনতার কাতারে। রাজা জমিদারদের বিত্তপ্রদর্শনী এখন নেই। দুর্গাপূজা শুধু বাঙালির ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয়ের বাহন হয়নি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে উৎসবের একটা সর্বজনীন কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। সমাজের এমন কোন অংশ নেই, যারা পূজার সার্বজনীনতার আওতামুক্ত। ভক্তি, আবেগ, উৎসাহ এখানে একাকার। উৎসব মানুষকে মানুষের সঙ্গে মেলায়, দূরত্ব কমায়। মিলন সরণিতেই বাঙালির প্রকৃত অধিবাস। শুধু নগরে নয়, প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ে সমগ্রতার স্পর্শ।

উল্লেখ্য, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এমনকি ধর্মবিশ্বাস নেই এমন জনগোষ্ঠীও উৎসবের এই উত্তাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেনি। প্রবাসী বাঙালির পূজা করার আর্তির মধ্যেই বাঙালি সত্তার মূল অস্তিত্বের খোঁজ মেলে। শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, অনুভূতি নিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে বাঙালিরা পূজার আয়োজনে ডুবে যায় অজানা আকর্ষণে। প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে মেয়েরা জড়ো হয় শাড়ি পরে, ছেলেরা নানা পোশাকে। বাঙালির সাজ-পোশাক, রান্না-বান্নার ঐতিহ্য। সবখানেই নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে নেওয়ার মরিয়া চেষ্টা। ঢাকের আওয়াজ, ধুপের গন্ধ-সব জায়গায় আত্মবিশ্বাসের ঠিকানা খোঁজার অবিরাম চেষ্টা। হয়তো কোথাও শেকড়ের সন্ধানে শারদোৎসবের আশ্রয়ে ব্যাকুল হয়ে পড়ে মন।

গ্রাম-বাংলার শ্যামল প্রান্তরে একচালা সাবেকি পূজামন্ডপ এখন বড় একটা চোখে পড়ে না। সাধারণ মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্গাম-পগুলোর ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে। দলবেঁধে, চাঁদা তুলে, মন্ডপ সাজিয়ে বারোয়ারি পূজার রেওয়াজ এখনো মুছে যায়নি। ঢাকের আওয়াজ, ধুপ-ধুনোর গন্ধ ছেড়ে দূরে সরে যেতে ইচ্ছে করে না। নিজেকে নানা ভঙ্গিতে মেলে ধরে যুবক-যুবতী। শাড়ির রঙ মিলেমিশে যায় রোদের সোনারঙে। পূজাকে কেন্দ্র করে বাঁধ ভাঙে জনস্রোত, ঘটে যায় গণবিস্ফোরণ। পূজা ক্রমশই হয়ে উঠে বৃহৎ এক সামাজিক পর্ব। কখনও তা থিমনির্ভর। কখনও নানারকম কৃৎকৌশল। আয়োজন বিপুল। থিমের সঙ্গে কলার যোগ। ধর্মের সঙ্গে শিল্পের বন্ধন। শারদোৎসব এখন শুধু সামাজিক মিলন নয়, হয়তো বাণিজ্য বিস্তারের বাহনও হয়ে ওঠে। শিল্প মানচিত্রেও আজ অনেকখানি জায়গা দখল করেছে এ উৎসব। এ মেলায় যোগ দেয়ার জন্য মাঠে নামে লাখ লাখ মানুষ।

আর এখানেই যুক্ত হয়েছে নতুন এক শঙ্কা। মহামারীর তৃতীয় তরঙ্গ। স্কুল-কলেজ খুলেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে সংক্রমণের ঝুঁকি। একদিকে মানুষের অসচেতনতা, অন্যদিকে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি। সাধারণভাবে মাস্ক পরা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও মনে হয় শিক্ষক দীর্ঘক্ষণ মাস্ক পরার ঝক্কি সামলাতে কাহিল। এমন বাস্তবতায় সামান্য অসতর্কতা বড় ধরনের বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। এমন একটা এলোমেলো সময়ে এবারে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিপন্ন অর্থনীতি, অনিশ্চয়তায় ঘেরা জীবন। তবুও জীবন থেমে নেই। তাই শঙ্কার মাঝেই আলোর রোশনাই।

উৎসবের সঙ্গে অনেক মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত। উৎসবকে কেন্দ্র করে এখন করপোরেট বাজারও সক্রিয়। অনলাইন শপিং জমে উঠছে বটে। প্রতারক চক্রও সক্রিয়। তবে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করলে মূল্য দিতে হবে। যে কোন মূল্যে আড়ম্বর কমাতে হবে। জনসমাগম এড়াতে হবে। করোনার লেখচিত্র নিম্নমুখী মানেই সংক্রমণ শেষ হয়নি। তাই দরকার সবার দায়িত্বশীলতা। যে কারণেই হোক সামাজিক সম্প্রীতির আবহ আগের মতো নেই। চারপাশকে কেমন যেন অচেনা মনে হয়। কিছুদিন আগেও যে কোন উৎসবকেই সবার বলে মনে হতো। বোধন হতে বিসর্জন-সবখানেই দেখেছি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন অংশীদারত্ব। সমাজবুননের কোথায় যেন বিভেদের অদৃশ্য দেয়াল মাথা তুলতে চাইছে, যা আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়। সমৃদ্ধি, শান্তি ও টেকসই উন্নতির জন্য সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ভীষণ জরুরি। প্রত্যাশা থাকবে- বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে দেশ এগিয়ে যাবে। আর করোনার বাড়বাড়ন্তকেও বিজ্ঞান থামিয়ে দেবে। তবে এ কথাও ঠিক- মিলনেই যেখানে বিধিনিষেধের ছায়া, উৎসবের আবেগ সেখানে প্রায় শূন্য। তাই অন্তরে জেগে থাক পূজার আমেজ। ধরা হোক ব্যাধিমুক্ত। সমাজ হোক ঘৃণামুক্ত। পৃথিবী হোক অগ্নিশুদ্ধ। পূজা হোক ঘরে ঘরে, নিষ্ঠায়-ভক্তিতে। সবমিলে হয়তো এবারই হবে উৎসবের এক নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অধ্যায়।

[লেখক : অধ্যক্ষ, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, ফকিরহাট, বাগেরহাট]

back to top