সানজিদা হক মিশু
সৈয়দ শামসুল হক বাংলা নাট্যসাহিত্যের কিংবদন্তি। তাঁর ৮৫ তম জন্মক্ষণে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি এখানে এখন নাটকটি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিমানসের বোধের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে রচিত নাটকটি। মুক্তির বারতা রয়েছে এ নাটকে। নিরীক্ষাধর্মী এ নাটকে মানুষের ভেতরকার বোধির চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। মানুষের আর্থিক, জৈবিক ও মানসিক টানাপোড়েনের স্থান নির্মিত হয়েছে এ কাব্যনাট্যে। স্বাধীনতা-উত্তর কয়েকজন লোভী ও দুষ্ট মানসিকতার মানুষের চরিত্রের বিশ্লেষণে বিশেষায়িত এ নাটকের প্লাটফর্ম।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় জনগণ যেভাবে দেশ ও জনগণকে ব্যবহার করেছেন তার সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায় এখানে এখন কাব্যনাট্যে। মানসিক চেতনায় জাগ্রত চরিত্রগুলো একটা সময়ে এসে ক্রুশবিদ্ধ হয়, তারা অমানবিক হয়ে ওঠে। সে সময় বাংলাদেশের অনেক চরিত্র-ই পাওয়া না পাওয়ার দাঁড়িপাল্লায় নিজেদের পরিমাণ দেয়। পরিমাণে না পাওয়া ভারি হয়ে যাওয়ায় তারা হয়ে যায় অভিশাপগ্রস্ত মানব সন্তান, অপরকে খুবলে খাওয়া মানব চরিত্র এবং লোভী নষ্ট চরিত্র। নিজের ভেতরকার দ্বন্দ্ব ক্রমশ চরিত্রগুলোকে পাপের পথে পরিচালিত করে।
রফিকুল ইসলাম, নাসিরুদ্দিন, অনামা, শাদা বেশধারী, কালো বেশধারী, মিনতি, সুলতানা এ চরিত্রগুলো নিয়ে নাটকটির আবহ তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যে আলোর অভাব হয়েছিলো তার আভাস রয়েছে এখানে এখন নাটকে। অন্ধকারের বিবমীষায় মানুষ মানুষের মুখ দেখতে পারছে না। অনেক আলো দরকার বাংলাদেশে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অর্থলোভী কিছু মানুষের আধিপত্যে সমস্যাক্রান্ত হয়েছিলো বাংলাদেশ। এখানে এখন কাব্যনাট্যে লেখক এরকম কিছু মানুষের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। রফিকুল ইসলাম, নাসিরুদ্দিন, সুলতানা ও মিনতি এ চরিত্র চারটি এ নাটকের মুখ্য বিষয়কে উপস্থাপন করেছে। রফিক পেশায় ব্যবসায়ী। নাটকের কিছুটা সময় জুড়ে রফিককে সৎ মনে হলেও আদতে সে অসৎ ও অসাধু লোভী ব্যবসায়ী। চরিত্রের স্খলন তাকে বিপথগামী করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এরকম অনেক যুবক অর্থলিপ্সায় বিপথে পরিচালিত হয়েছিলো।
রফিকুল ইসলাম খোলস পড়া এক শঙ্কার নাম। এ নাটকে উল্লিখিত আরেক শঙ্কা নাসিরুদ্দিন। পেশায় ব্যবসায়ী এ মানুষটির মনুষ্যত্বের কোনো বালাই নেই। ধর্মের লেবাসে গড়ে ওঠা এ চরিত্রটির অবক্ষয় আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত। কালোবাজারীর মতো কাজ করতে একটুও দ্বিধান্বিত নয় চরিত্রটি। মুনাফাখোর, মজুতদার, কালোবাজারীর আখড়ায় পরিণত হয়েছিলো স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশ।
মানবিক সম্ভাবনাকে পায়ে ঠেলে অমানবিকতার চরমে পৌঁছানো চরিত্র হলো নাসিরুদ্দিন। অর্থের আগুনে সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত তার মানসিকতা। রফিকের সঙ্গে ব্যবসায়িক ঈর্ষা ও মতানৈক্য তার
মানবিক সম্ভাবনাকে পায়ে ঠেলে অমানবিকতার চরমে পৌঁছানো চরিত্র হলো নাসিরুদ্দিন। অর্থের আগুনে সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত তার মানসিকতা। রফিকের সাথে ব্যবসায়িক ঈর্ষা ও মতানৈক্য তার। মানিকগঞ্জে রেল বসানোর টেন্ডার পাওয়া নিয়ে তাদের লড়াই। ধর্মের লেবাসে নিজেকে আটকিয়ে রেখেছে নাসিরুদ্দিন। খাজা বাবার নাম উচ্চারণ করায় রফিককে সে তিরস্কার করেছে। ধর্মের আভরণে মন্দ কাজ করে বেড়ায় নাসির। মিনতি-মদ নিয়ে আনন্দ করার পূর্ব মুহূর্তে সে কোরানের সোনার লকেট পর্যন্ত খুলে এসেছে। ধর্মের লেবাসে নিজেদের সকল কুৎসিত কাজকর্ম লুকিয়ে রাখার মতো একদল মানুষ স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে আস্তানা গেড়েছিলো। মদ, অর্থ আর নারীলোভী নাসিরুদ্দিন চরত্রটি খাজা বাবার নাম শুনে চিৎকার দিয়ে ওঠে।
আতংকিত এ চরিত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের জন্য হুঙ্কার, ভয় আর অন্ধকার। প্রতারক এ মানুষটি গোল দুটি চোখ খুঁজে বেড়ায় অর্থের বেড়াজাল। দুটি চোখ দেখতে চায় চারিদিকে বন্যা হোক, খরা হোক, দুর্যোগ নামুক, কোটি কোটি লোক কংকাল হোক। এ সুযোগের বিত্তের পাহাড় গড়বে নাসিরুদ্দিন। সকল অপর্কম শেষে স্নান করে নিবে শীতল স্বচ্ছ জলে।
এখানে এখন নাটকের অন্যতম চরিত্র সুলতানা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সখিতা তৈরি হলেও রফিকের সাথে তার বিয়ে হয়নি, বিয়ে করেছিলেন গাফফারকে। গাফফারের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা সুলতানাকে কষ্ট দিতো। সন্তানহীন সুলতানার স্বামী নিজের দায় এড়াতে ধর্মকে পুঁজি করে। স্ত্রীর সান্নিধ্য থেকে বাঁচার অভিপ্রায়ে সে আজমীর শরীফ গিয়ে এবাদত বন্দেগীতে মশগুল হয়। গাফফারের ভাবলেশহীন জীবনের সাথে লেগে থাকা সুলতানার জীবনকে সুলতানা ভুলে যেতে চায়, ঘর বাঁধতে চায় রফিকের সাথে। সুলতানার মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সংকটের কথা শোনা যায়। ১৯৭১ সালে বাঙালি তাঁর সর্বস্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো। পরবর্তীতে বাঙালি তার সত্তার কথা ভুলে গিয়ে স্বাধীনতাকে ধূলিসাৎ করার ব্যাপারে মরিয়া হয়ে ওঠে। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, বাজারের দ্রব্যগুলির চড়া দাম মানুষের জীবনযাত্রাকে বিষিয়ে দিয়েছিলো।
ঘাতক, ডাকাত, চোর সবার জয়গান সে সময়ের বাতাসকে ভারি করে দিয়েছিলো। বিষিয়ে ওঠা জীবনকে এড়িয়ে চলার জন্য গাফফারের মতো অনেকেই আঁকড়ে ধরেছিলো ধর্মকে। মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য শুরু করেছিলো অনেকেই সঞ্চয়। সুলতানা এখানে এখন নাটকে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা খুব ব্যঞ্জনাধর্মী ও রূপকের আড়ালে তুলে এনেছেন। মদমওতা আর যান্ত্রিকতার ভিড়ে মানবিকতা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। মানবিক মূল্যবোধের সঙ্কট তৎসময়কে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলো। আদর্শের প্রতিভূদের নীতিকথা তখন জমাট বেঁধে গিয়েছিলো কারো কানে পৌঁছায়নি। নীতিভ্রষ্ট প্রেত্মাদের স্লোগানে ভারি ছিলো বাংলার আকাশ। সততা তখন হয়ে পড়েছিলো নিবুর্দ্ধিতা। মিথ্যার হুতাশনে চারিদিক ছেঁয়ে গিয়েছিলো।
মিনতি চরিত্রটি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ব্যবহৃত নারী চরিত্র। মিনতি মুক্তি চাইতো কিন্তু সে তা পায়নি। নিম্নবর্গের প্রতিভূ সে। অর্থনীতির মন্দাচক্রে, কালোবাজারি আর মজুতদারদের আধিপত্যে মিনতির মতো নারীদের পেটের জ্বালা মেটাতে দেহের পসার করতে হয়েছিলো। পেটের ক্ষুধা মেটানোর তাগিদে জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলোকে এসিডে ঝলসে দিতে হয়েছিলো মিনতিকে। এ মিনতি যখন রফিকের সান্নিধ্য পায় তখন সুন্দর স্বপ্নের কথা বলে, জীবনবোধের কথা বলে। মিনতিকে ব্যবহার করা রফিকও শুধুমাত্র পতিতা হিসেবে গণ্য করে না মিনতিকে। অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা রফিকের সত্তা মিনতির জন্য সামান্যতম হলেও মানবিক হয়। মিনতির কাছে রফিক তার স্বপ্নের কথা বলে। রফিক অজান্তেই ভরসা চায় মিনতির কাছে। মিনতিও তার স্বপ্নের বয়ান দেয় রফিককে। মিনতি তাকে বলে স্বপ্ন সত্যি নয়। মানুষ জাগ্রত কিংবা নিদ্রা উভয় অবস্থাতেই স্বপ্ন দেখতে পারে। মানুষ যখন সর্বস্ব হারায় কিংবা যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে- তখন স্বপ্ন তাদের শান্তি দেয় ক্ষণিকের জন্য। সুখের স্বপ্নগুলো মানুষকে সুখ দেয়। রফিক আত্মদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। আলো আঁধারের মাঝখানে তার অবস্থান। ভয় আর সাহসে মাঝখানে তার চলাচল। জীবনের বিনাশকে সে ভয় পেতে শুরু করে। বিনষ্ট হতে চায় না সে। জীবনের প্রশ্নে বা বিপক্ষে যেখানেই হোক রফিক শুধু টিকে থাকতে চায়। অস্তিত্বের প্রয়োজনে সে শিকারী হতে চায় শিকার তার লক্ষ্য। মদ আর নারীর যুগল সঙ্গ পেয়ে সে স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি কামনা করে। শুভ কিংবা বিপন্ন বাস্তবতায় রফিক শুধু স্বপ্ন দেখতে চায়। কিছুতেই সে বিনাশ হতে চায় না। অবিরাম, রাত্রিদিন, বর্তমান বিপন্ন বাস্তব থেকে রফিকের যন্ত্রণাবিদ্ধ মন মুক্তি পেতে চায়।
সৈয়দ শামসুল হক এখানে এখন নাটকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটকে স্পষ্ট করেছেন। ১৯৭৫ সালে বাঙালির গণনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। এ হত্যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের যে সঙ্কট লক্ষ্যণীয় ছিলো তার পরিচয় পাওয়া যায় এ নাটকে। শোষক ও শোষিতকে এ নাটকে ব্যবহর্তা ও ব্যবহৃত হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ব্যক্তিক পর্যায়ে ধর্ম হয়ে ওঠে ভৈববের হাতিয়ার, যা একটি স্বাধীনতা লাভের লক্ষ্য ছিলো না।
সুলতানা ও রফিক একে অন্যকে বিয়ে করতে চায়। যন্ত্রণাবিদ্ধ জীবনের পরিত্রাণ চায় সুলতানা আর একাকীত্বকে নির্বাসনে পাঠাতে চায় রফিক। সুলতানাকে বিয়ের আগে আলিঙ্গন করতে চায় রফিক, সুলতানার তাতে ঘোর আপত্তি। ধীরে ধীরে কিছু কার্যকলাপে সুলতানা রফিককে বিয়ে করতে পিছপা হয়। রফিকের বিবেকের পচা রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে সুলতানার নিকট। মিনতিকে যেভাবে ব্যবহার করেছিলো রফিক সেভাবে সুলতানাকে ব্যবহার করতে পারেনি। অমানবিক রফিককে আবারো ঘিরে থাকে বিচ্ছেদ, শূন্যতা, নিরাশা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রেমিক রফিক হারিয়ে যায় অর্থের নিগড়ে। ধর্মের আস্ফালনে বেড়ে ওঠা বন্ধু নাসির তাকে বিপথে নেওয়ার সব যন্ত্র তৈরি করে ফেলেছিলো। আর সে যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে রফিকও হয়ে পড়লো যন্ত্রমানব। মাতাল রফিক জীবনের আরেক অধ্যায় খুঁজে। কিন্তু ততক্ষণে তার সকল অপকর্মের ঝুলি সবার সামনে উন্মোচিত হয়।
জীবনের করুণ অধ্যায়ের সূচনা করার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে কিছু চরিত্রের জন্ম হয়। যারা ঈশ্বর, ভালোবাসা, ডলার কিংবা প্রেম- ভালোবাসাকে একই চোখে দেখে; আর সে চোখ হলো লোভের চোখ। যারা জীবনে এনে দেয় স্তব্ধতা, নিস্তব্ধতা আর অন্ধকার। কারণে-অকারণে মানুষ অন্যকে ব্যবহার করে ও নিজে ব্যবহৃত হয়। সমাজে যাদেরকে আমরা প্রাজ্ঞ মনে করি তারাও অনেক সময় নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের ক্ষতি করে। ঈশ্বর, ডলার কিংবা প্রেম আর ভালোবাসা,/ প্রসঙ্গটা যাই হোক কেন,/ মানুষেরা ব্যবহার করে আর ব্যবহৃত হয়। (সৈয়দ শামসুল হক, ২০১৬ : ১৯১)
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশকে খুবলে খাওয়ায় ব্যস্ত হয়েছিলো কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের রক্তে বাংলার নদীর জল প্লাবিত হয়েছিলো, সবুজ সমতল ধূসর রঙে ছেঁয়ে গিয়েছিলো। সে সময় স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বাংলার মানুষকে প্রস্তুত করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। রক্ত গঙ্গা বহমানের ইতিহাস বাঙালি আজও ভোলে নি। -‘এখন সেখানে কেউ ধূসরতা লেপে দিয়ে গেছে।/ এত মৃত্যু তারপর ভিন্নতর আরো মৃত্যু ঘটিয়েছে’। (সৈয়দ শামসুল হক, ২০১৬ : ২০১)
ঈর্ষা, লোভ আর পাপবোধে পর্যবসিত হলে বাংলার এ মহানায়ককে নির্মমভাবে হত্যা করে দেশীয় কতিপয় সেনাকর্তা। বাংলার মানুষ কি এজন্যই স্বাধীনতা চেয়েছিলো? স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সংকটের অনন্য নির্মাণ সৈয়দ শামসুল হকের এখানে এখন কাব্যনাটকটি। স্বার্থান্বেষী দালালদের ব্যবহর্তার মানসিকতা বাংলাদেশকে আরেকবার অন্ধকার গর্তে নিক্ষেপ করেছিলো। শোষক ও শোষিত, ব্যবহর্তা ও ব্যবহৃত চরিত্রকে দিয়ে নাট্যকার এ নাটকের কাহিনিকে সাজিয়েছেন। তাই এ নাটকটি হয়ে উঠেছে সমকালীন বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র।
তথ্যসূত্র :
সৈয়দ শামসুল হক, কাব্যনাট্য সমগ্র, প্রথম প্রকাশ ২০১৬, চারুলিপি প্রকাশন, ঢাকা।
সানজিদা হক মিশু
বুধবার, ১৬ আগস্ট ২০২৩
সৈয়দ শামসুল হক বাংলা নাট্যসাহিত্যের কিংবদন্তি। তাঁর ৮৫ তম জন্মক্ষণে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি এখানে এখন নাটকটি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিমানসের বোধের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে রচিত নাটকটি। মুক্তির বারতা রয়েছে এ নাটকে। নিরীক্ষাধর্মী এ নাটকে মানুষের ভেতরকার বোধির চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। মানুষের আর্থিক, জৈবিক ও মানসিক টানাপোড়েনের স্থান নির্মিত হয়েছে এ কাব্যনাট্যে। স্বাধীনতা-উত্তর কয়েকজন লোভী ও দুষ্ট মানসিকতার মানুষের চরিত্রের বিশ্লেষণে বিশেষায়িত এ নাটকের প্লাটফর্ম।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় জনগণ যেভাবে দেশ ও জনগণকে ব্যবহার করেছেন তার সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায় এখানে এখন কাব্যনাট্যে। মানসিক চেতনায় জাগ্রত চরিত্রগুলো একটা সময়ে এসে ক্রুশবিদ্ধ হয়, তারা অমানবিক হয়ে ওঠে। সে সময় বাংলাদেশের অনেক চরিত্র-ই পাওয়া না পাওয়ার দাঁড়িপাল্লায় নিজেদের পরিমাণ দেয়। পরিমাণে না পাওয়া ভারি হয়ে যাওয়ায় তারা হয়ে যায় অভিশাপগ্রস্ত মানব সন্তান, অপরকে খুবলে খাওয়া মানব চরিত্র এবং লোভী নষ্ট চরিত্র। নিজের ভেতরকার দ্বন্দ্ব ক্রমশ চরিত্রগুলোকে পাপের পথে পরিচালিত করে।
রফিকুল ইসলাম, নাসিরুদ্দিন, অনামা, শাদা বেশধারী, কালো বেশধারী, মিনতি, সুলতানা এ চরিত্রগুলো নিয়ে নাটকটির আবহ তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যে আলোর অভাব হয়েছিলো তার আভাস রয়েছে এখানে এখন নাটকে। অন্ধকারের বিবমীষায় মানুষ মানুষের মুখ দেখতে পারছে না। অনেক আলো দরকার বাংলাদেশে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অর্থলোভী কিছু মানুষের আধিপত্যে সমস্যাক্রান্ত হয়েছিলো বাংলাদেশ। এখানে এখন কাব্যনাট্যে লেখক এরকম কিছু মানুষের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। রফিকুল ইসলাম, নাসিরুদ্দিন, সুলতানা ও মিনতি এ চরিত্র চারটি এ নাটকের মুখ্য বিষয়কে উপস্থাপন করেছে। রফিক পেশায় ব্যবসায়ী। নাটকের কিছুটা সময় জুড়ে রফিককে সৎ মনে হলেও আদতে সে অসৎ ও অসাধু লোভী ব্যবসায়ী। চরিত্রের স্খলন তাকে বিপথগামী করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এরকম অনেক যুবক অর্থলিপ্সায় বিপথে পরিচালিত হয়েছিলো।
রফিকুল ইসলাম খোলস পড়া এক শঙ্কার নাম। এ নাটকে উল্লিখিত আরেক শঙ্কা নাসিরুদ্দিন। পেশায় ব্যবসায়ী এ মানুষটির মনুষ্যত্বের কোনো বালাই নেই। ধর্মের লেবাসে গড়ে ওঠা এ চরিত্রটির অবক্ষয় আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত। কালোবাজারীর মতো কাজ করতে একটুও দ্বিধান্বিত নয় চরিত্রটি। মুনাফাখোর, মজুতদার, কালোবাজারীর আখড়ায় পরিণত হয়েছিলো স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশ।
মানবিক সম্ভাবনাকে পায়ে ঠেলে অমানবিকতার চরমে পৌঁছানো চরিত্র হলো নাসিরুদ্দিন। অর্থের আগুনে সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত তার মানসিকতা। রফিকের সঙ্গে ব্যবসায়িক ঈর্ষা ও মতানৈক্য তার
মানবিক সম্ভাবনাকে পায়ে ঠেলে অমানবিকতার চরমে পৌঁছানো চরিত্র হলো নাসিরুদ্দিন। অর্থের আগুনে সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত তার মানসিকতা। রফিকের সাথে ব্যবসায়িক ঈর্ষা ও মতানৈক্য তার। মানিকগঞ্জে রেল বসানোর টেন্ডার পাওয়া নিয়ে তাদের লড়াই। ধর্মের লেবাসে নিজেকে আটকিয়ে রেখেছে নাসিরুদ্দিন। খাজা বাবার নাম উচ্চারণ করায় রফিককে সে তিরস্কার করেছে। ধর্মের আভরণে মন্দ কাজ করে বেড়ায় নাসির। মিনতি-মদ নিয়ে আনন্দ করার পূর্ব মুহূর্তে সে কোরানের সোনার লকেট পর্যন্ত খুলে এসেছে। ধর্মের লেবাসে নিজেদের সকল কুৎসিত কাজকর্ম লুকিয়ে রাখার মতো একদল মানুষ স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে আস্তানা গেড়েছিলো। মদ, অর্থ আর নারীলোভী নাসিরুদ্দিন চরত্রটি খাজা বাবার নাম শুনে চিৎকার দিয়ে ওঠে।
আতংকিত এ চরিত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের জন্য হুঙ্কার, ভয় আর অন্ধকার। প্রতারক এ মানুষটি গোল দুটি চোখ খুঁজে বেড়ায় অর্থের বেড়াজাল। দুটি চোখ দেখতে চায় চারিদিকে বন্যা হোক, খরা হোক, দুর্যোগ নামুক, কোটি কোটি লোক কংকাল হোক। এ সুযোগের বিত্তের পাহাড় গড়বে নাসিরুদ্দিন। সকল অপর্কম শেষে স্নান করে নিবে শীতল স্বচ্ছ জলে।
এখানে এখন নাটকের অন্যতম চরিত্র সুলতানা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সখিতা তৈরি হলেও রফিকের সাথে তার বিয়ে হয়নি, বিয়ে করেছিলেন গাফফারকে। গাফফারের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা সুলতানাকে কষ্ট দিতো। সন্তানহীন সুলতানার স্বামী নিজের দায় এড়াতে ধর্মকে পুঁজি করে। স্ত্রীর সান্নিধ্য থেকে বাঁচার অভিপ্রায়ে সে আজমীর শরীফ গিয়ে এবাদত বন্দেগীতে মশগুল হয়। গাফফারের ভাবলেশহীন জীবনের সাথে লেগে থাকা সুলতানার জীবনকে সুলতানা ভুলে যেতে চায়, ঘর বাঁধতে চায় রফিকের সাথে। সুলতানার মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সংকটের কথা শোনা যায়। ১৯৭১ সালে বাঙালি তাঁর সর্বস্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো। পরবর্তীতে বাঙালি তার সত্তার কথা ভুলে গিয়ে স্বাধীনতাকে ধূলিসাৎ করার ব্যাপারে মরিয়া হয়ে ওঠে। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, বাজারের দ্রব্যগুলির চড়া দাম মানুষের জীবনযাত্রাকে বিষিয়ে দিয়েছিলো।
ঘাতক, ডাকাত, চোর সবার জয়গান সে সময়ের বাতাসকে ভারি করে দিয়েছিলো। বিষিয়ে ওঠা জীবনকে এড়িয়ে চলার জন্য গাফফারের মতো অনেকেই আঁকড়ে ধরেছিলো ধর্মকে। মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য শুরু করেছিলো অনেকেই সঞ্চয়। সুলতানা এখানে এখন নাটকে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা খুব ব্যঞ্জনাধর্মী ও রূপকের আড়ালে তুলে এনেছেন। মদমওতা আর যান্ত্রিকতার ভিড়ে মানবিকতা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। মানবিক মূল্যবোধের সঙ্কট তৎসময়কে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলো। আদর্শের প্রতিভূদের নীতিকথা তখন জমাট বেঁধে গিয়েছিলো কারো কানে পৌঁছায়নি। নীতিভ্রষ্ট প্রেত্মাদের স্লোগানে ভারি ছিলো বাংলার আকাশ। সততা তখন হয়ে পড়েছিলো নিবুর্দ্ধিতা। মিথ্যার হুতাশনে চারিদিক ছেঁয়ে গিয়েছিলো।
মিনতি চরিত্রটি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ব্যবহৃত নারী চরিত্র। মিনতি মুক্তি চাইতো কিন্তু সে তা পায়নি। নিম্নবর্গের প্রতিভূ সে। অর্থনীতির মন্দাচক্রে, কালোবাজারি আর মজুতদারদের আধিপত্যে মিনতির মতো নারীদের পেটের জ্বালা মেটাতে দেহের পসার করতে হয়েছিলো। পেটের ক্ষুধা মেটানোর তাগিদে জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলোকে এসিডে ঝলসে দিতে হয়েছিলো মিনতিকে। এ মিনতি যখন রফিকের সান্নিধ্য পায় তখন সুন্দর স্বপ্নের কথা বলে, জীবনবোধের কথা বলে। মিনতিকে ব্যবহার করা রফিকও শুধুমাত্র পতিতা হিসেবে গণ্য করে না মিনতিকে। অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা রফিকের সত্তা মিনতির জন্য সামান্যতম হলেও মানবিক হয়। মিনতির কাছে রফিক তার স্বপ্নের কথা বলে। রফিক অজান্তেই ভরসা চায় মিনতির কাছে। মিনতিও তার স্বপ্নের বয়ান দেয় রফিককে। মিনতি তাকে বলে স্বপ্ন সত্যি নয়। মানুষ জাগ্রত কিংবা নিদ্রা উভয় অবস্থাতেই স্বপ্ন দেখতে পারে। মানুষ যখন সর্বস্ব হারায় কিংবা যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে- তখন স্বপ্ন তাদের শান্তি দেয় ক্ষণিকের জন্য। সুখের স্বপ্নগুলো মানুষকে সুখ দেয়। রফিক আত্মদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। আলো আঁধারের মাঝখানে তার অবস্থান। ভয় আর সাহসে মাঝখানে তার চলাচল। জীবনের বিনাশকে সে ভয় পেতে শুরু করে। বিনষ্ট হতে চায় না সে। জীবনের প্রশ্নে বা বিপক্ষে যেখানেই হোক রফিক শুধু টিকে থাকতে চায়। অস্তিত্বের প্রয়োজনে সে শিকারী হতে চায় শিকার তার লক্ষ্য। মদ আর নারীর যুগল সঙ্গ পেয়ে সে স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি কামনা করে। শুভ কিংবা বিপন্ন বাস্তবতায় রফিক শুধু স্বপ্ন দেখতে চায়। কিছুতেই সে বিনাশ হতে চায় না। অবিরাম, রাত্রিদিন, বর্তমান বিপন্ন বাস্তব থেকে রফিকের যন্ত্রণাবিদ্ধ মন মুক্তি পেতে চায়।
সৈয়দ শামসুল হক এখানে এখন নাটকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটকে স্পষ্ট করেছেন। ১৯৭৫ সালে বাঙালির গণনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। এ হত্যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের যে সঙ্কট লক্ষ্যণীয় ছিলো তার পরিচয় পাওয়া যায় এ নাটকে। শোষক ও শোষিতকে এ নাটকে ব্যবহর্তা ও ব্যবহৃত হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ব্যক্তিক পর্যায়ে ধর্ম হয়ে ওঠে ভৈববের হাতিয়ার, যা একটি স্বাধীনতা লাভের লক্ষ্য ছিলো না।
সুলতানা ও রফিক একে অন্যকে বিয়ে করতে চায়। যন্ত্রণাবিদ্ধ জীবনের পরিত্রাণ চায় সুলতানা আর একাকীত্বকে নির্বাসনে পাঠাতে চায় রফিক। সুলতানাকে বিয়ের আগে আলিঙ্গন করতে চায় রফিক, সুলতানার তাতে ঘোর আপত্তি। ধীরে ধীরে কিছু কার্যকলাপে সুলতানা রফিককে বিয়ে করতে পিছপা হয়। রফিকের বিবেকের পচা রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে সুলতানার নিকট। মিনতিকে যেভাবে ব্যবহার করেছিলো রফিক সেভাবে সুলতানাকে ব্যবহার করতে পারেনি। অমানবিক রফিককে আবারো ঘিরে থাকে বিচ্ছেদ, শূন্যতা, নিরাশা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রেমিক রফিক হারিয়ে যায় অর্থের নিগড়ে। ধর্মের আস্ফালনে বেড়ে ওঠা বন্ধু নাসির তাকে বিপথে নেওয়ার সব যন্ত্র তৈরি করে ফেলেছিলো। আর সে যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে রফিকও হয়ে পড়লো যন্ত্রমানব। মাতাল রফিক জীবনের আরেক অধ্যায় খুঁজে। কিন্তু ততক্ষণে তার সকল অপকর্মের ঝুলি সবার সামনে উন্মোচিত হয়।
জীবনের করুণ অধ্যায়ের সূচনা করার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে কিছু চরিত্রের জন্ম হয়। যারা ঈশ্বর, ভালোবাসা, ডলার কিংবা প্রেম- ভালোবাসাকে একই চোখে দেখে; আর সে চোখ হলো লোভের চোখ। যারা জীবনে এনে দেয় স্তব্ধতা, নিস্তব্ধতা আর অন্ধকার। কারণে-অকারণে মানুষ অন্যকে ব্যবহার করে ও নিজে ব্যবহৃত হয়। সমাজে যাদেরকে আমরা প্রাজ্ঞ মনে করি তারাও অনেক সময় নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের ক্ষতি করে। ঈশ্বর, ডলার কিংবা প্রেম আর ভালোবাসা,/ প্রসঙ্গটা যাই হোক কেন,/ মানুষেরা ব্যবহার করে আর ব্যবহৃত হয়। (সৈয়দ শামসুল হক, ২০১৬ : ১৯১)
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশকে খুবলে খাওয়ায় ব্যস্ত হয়েছিলো কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের রক্তে বাংলার নদীর জল প্লাবিত হয়েছিলো, সবুজ সমতল ধূসর রঙে ছেঁয়ে গিয়েছিলো। সে সময় স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বাংলার মানুষকে প্রস্তুত করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। রক্ত গঙ্গা বহমানের ইতিহাস বাঙালি আজও ভোলে নি। -‘এখন সেখানে কেউ ধূসরতা লেপে দিয়ে গেছে।/ এত মৃত্যু তারপর ভিন্নতর আরো মৃত্যু ঘটিয়েছে’। (সৈয়দ শামসুল হক, ২০১৬ : ২০১)
ঈর্ষা, লোভ আর পাপবোধে পর্যবসিত হলে বাংলার এ মহানায়ককে নির্মমভাবে হত্যা করে দেশীয় কতিপয় সেনাকর্তা। বাংলার মানুষ কি এজন্যই স্বাধীনতা চেয়েছিলো? স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সংকটের অনন্য নির্মাণ সৈয়দ শামসুল হকের এখানে এখন কাব্যনাটকটি। স্বার্থান্বেষী দালালদের ব্যবহর্তার মানসিকতা বাংলাদেশকে আরেকবার অন্ধকার গর্তে নিক্ষেপ করেছিলো। শোষক ও শোষিত, ব্যবহর্তা ও ব্যবহৃত চরিত্রকে দিয়ে নাট্যকার এ নাটকের কাহিনিকে সাজিয়েছেন। তাই এ নাটকটি হয়ে উঠেছে সমকালীন বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র।
তথ্যসূত্র :
সৈয়দ শামসুল হক, কাব্যনাট্য সমগ্র, প্রথম প্রকাশ ২০১৬, চারুলিপি প্রকাশন, ঢাকা।