পিন্টু রহমান
যদিও নিজস্ব আবেগ অনুভুতির বহিঃপ্রকাশ তথা লেখকের মাটিবর্তী হৃদয়ের অন্তঃপুরে লেখার সূচনা তথাপি লেখা প্রকাশের পর তা আর কেবলমাত্র ঐ বিশেষ লেখকের ভালোলাগার সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না; তৈরি হয় লেখক-পাঠকের বহুকৌণিক ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক। সম্পর্কের ধরন কিংবা মাত্রার ক্ষেত্রে পাঠকে-পাঠকে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ম্যাজিক রিয়ালিজমের জনক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড সম্পর্কে নোবেল কমিটি উল্লেখ করেছেন, “মার্কেজের সাহিত্যে স্বপ্ন আর বাস্তবতার অসাধারণ মিশেল রয়েছে- যা জীবনের শুদ্ধতা ও সংঘাতকে তুলে ধরে।”
স্প্যানিশ সাহিত্যের আরেক দিকপাল ও চিলির নোবেলজয়ী লেখক পাবলো নেরুদার মতে সপ্তদশ শতকে মিগুয়েল শারভানতেসের লেখা “ডন কুইক্সোর্ট”-এর পর এই উপন্যাসটিই স্প্যানিশ সাহিত্যে সবচেয়ে মহান সৃষ্টি। বস্তুত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ স্প্যানিশ ভাষার সর্বকালের সেরা লেখকদের একজন। “ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড” বা ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বসাহিত্যে বিশেষ উন্মাদনার সৃষ্টি করেছে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত বইটি সারা বিশ্বে প্রায় ৩ কোটি কপি বিক্রি হয়।
গল্প বা উপন্যাসে সময়কে বয়ে বেড়ানো খুবই কষ্টকর। অথচ সময়ের সাথে মার্কেজ জাদুকরের মতো খেলেছেনে। “নিঃসঙ্গতার একশো বছর” উপন্যাসে মানুষের চিরাচরিত, প্রথাগত সময় ধরে গল্প বলা হয় নি- বরং এতে এক শতাব্দীর প্রতিদিনকার নানা ঘটনা, নানা আখ্যান, একটা আরেকটার পাশাপাশি অবস্থান করেছে। মার্কেজ সম্পর্কে একটি বিশেষ মত প্রচলিত আছে- তিনের যোগফলে মার্কেজ : বোর্হেসের কাছ থেকে কল্পনা, কাফকার কাছ থেকে মেটাফর ও পয়েন্ট অব ভিউ আর উইলিয়াম ফকনারের কাছ থেকে অনেক মানুষ বাস করে এমন এক মনুষ্য অঞ্চলকে চিত্রায়িত করার কৈশল! শুধু তাই নয় জেমস জয়েসের স্বপ্ন বর্ণনা রীতির গদ্যকেও তিনি অসম্ভব সহজবোধ্যতায় নিজের করে নিয়েছেন-
“ডুবে যায় সে, সে এমনকি তার বাবাও হয়ে ওঠে একটা উৎপাত বিশেষ। চারদিকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য মিথ্যে অভিসারের জটিল জাল তৈরি করে সে, তার সাথীদের কাছে সে হয়ে ওঠে ডুমুরের ফুল, যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে মরিসিও ব্যাবিলোনিয়ার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যে গতানুগতিকতার বেড়া ডিঙিয়ে যায়। গোড়ার দিকে তার রুক্ষতায় বিরক্ত হতো মেমো। গ্যারেজের পেছনে পতিত জমিটায় প্রথম যেবার ওরা নির্জনে মিলিত হয় সেবার মরিসিও তাকে টানতে-টানতে এমন একটা জ্যান্তব অবস্থায় নিয়ে আসে যে মেমো বিধ্বস্থ হয়ে যায়।”
কোন-কোন আলোচক মার্কেজকে সাহ্যিতের দৃশ্যশিল্পী হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। আলোচ্য গদ্যে একজন পাঠক হিসেবে ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’-এর নানাবিধ দৃশ্যের সাথে কতিপয় সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করেছি- যে সাদৃশ্যের সাথে একান্তই বাঙালীপনা লেপটে আছে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ রচিত ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ উপন্যাসের মূল সূত্র একটি রহস্যময় পার্চমেন্ট। একশো বছর আগে লিখিত ঐ পার্চমেন্টে বুয়েন্দিয়া পরিবার ও মাকোন্দ শহরের পতনের কারণও বিবরণে উল্লেখ করা ছিল। বুয়েন্দিয়া পরিবারের ষষ্ঠ পুরুষ শিশু অরেলিয়ানো ব্যাবিলোনিয়া শুয়রের লেজ নিয়ে জন্মানোর সাথে-সাথে মেলকিয়াদেসের ভবিষ্যৎবাণী বাস্তবে পরিণত হয়। শিশুটি জন্মের পর অরেলিয়ানো ব্যাবেলোনিয়া রহস্যময় পার্চমেন্টের পাঠোদ্ধারে সক্ষম হয়। শেষ পাতাটি পাঠের মাধ্যমে নিজের মৃত্যুর দিন-তারিখ-ক্ষণ সম্পর্কে অবগত হতে-হতেই সমগ্র মাকোন্দ এক তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। লেজওয়ালা শিশুটি বুয়েন্দিয়া পরিবারের শত বছর যাপিত জীবনের প্রথম ভালবাসাজাত সন্তান। এরূপ সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে পরিবারের প্রথম নারী আমারান্তা উরসুল ইগুয়ারান-এর তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু অরেলিয়ানো ও উরসুলার ভালোবাসার কাছে নিষেধাজ্ঞার সীমারেখা মাড়িয়ে গেছে। শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও তারা দুজন দৈহিক প্রণয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এবং গর্ভধারণ করেছে। যদিও তারা তাদের মধ্যকার প্রকৃত জৈব সম্পর্কের ধরণ কী ছিল তা জানত না। কখনো-কখনো মনে হয়েছে তারা সম্ভবত ভাই-বোন; প্রকৃত পক্ষে তারা ছিল খালা-ভাগ্নে।
‘খালা-ভাগ্নে’ শব্দটির কছে প্রতিবারই পাঠক হিসেবে আমি মনে-মনে হোঁচট খাই; শ্রী কৃষ্ণকীর্তন-এ বর্ণিত রাঁধা ও কৃঞ্চ চরিত্র দুটি চিত্রময় হয়ে ওঠে। বস্তুত জৈবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয় জুটিই একমাত্রিক। চণ্ডীদাসের কৃতির কথা ভেবে ভালো লাগে। মনে মনে পুলকিত হই। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে রচিত গ্রন্থটির চরিত্র দুটি এখনো যেনো পাঠকের মনে জীবন্ত হয়ে আছে। শ্রী-কৃষ্ণ রাখাল। সে বাঁশি বাজায় এবং মাঠে মাঠে গরু চরায়। ঘটনাক্রমে মামী সম্পর্কীয় রমণী রাধা’র প্রতি আসক্ত হয়ে ওঠে। এই আসক্তি যতটা না ভালোবাসার তারচেয়ে বেশি দৈহিক। রাধা রুপবতী; চিরায়ত বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি। তাকে কাছে পেতে কৃষ্ণ নানামুখী ছল-চাতুরির আশ্রয় নেয়। কিন্তু দেহ সম্ভোগের পর রাধা যখন প্রকৃত অর্থেই কৃষ্ণ’র প্রেমে আকুল হয়, ঠিক তখনি কৃষ্ণ তাকে একলা ফেলে বৃন্দাবন চলে যায়।
স্প্যানিশ সাহিত্যের আরেক দিকপাল ও চিলির নোবেলজয়ী লেখক পাবলো নেরুদার মতে সপ্তদশ শতকে মিগুয়েল শারভানতেসের লেখা ‘ডন কুইক্সোর্ট’-এর পর এই উপন্যাসটিই স্প্যানিশ সাহিত্যে সবচেয়ে মহান সৃষ্টি। বস্তুত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ স্প্যানিশ ভাষার সর্বকালের সেরা লেখকদের একজন
আবার কারো-কারো মতে কৃষ্ণ অবতার। ভক্তিভরে অনেকে তাকে পূজা-অর্চনা করে। তাহলে কৃষ্ণকে অবতার মানলে মেলকিয়াদেসকে কোন পাল্লায় ওজন করবো! মেলকিয়াদেস রক্ত-মাংসের কোনো মানুষ নয়। মাকোন্দ শহর পত্তনকারীদের আদিতম পুরুষ হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার একজন জিপসি বন্ধু মূলত মেলকিয়াদেস। বিজ্ঞানের নিত্য-নতুন আবিষ্কার ফেরি করার লক্ষ্যে প্রতিবছর সে মাকোন্দ শহরে আসতো। শহরের আলো-বঞ্চিত অধিবাসীদের বিজ্ঞানের প্রতি প্রলুব্ধ করতো। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পরের বছর জিপসীরা এলেও আসে না শুধু মেলকিয়াদেস। বহু বছর পরে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অনুসন্ধান করে জানতে পারে, জাহাজডুবিতে মেলকিয়াদেস নিহত হয়েছে। অথচ এর কয়েক বছর বাদে দিব্যি জীবিত অবস্থায় মেলকিয়াদেস ফিরে আসে। মাকোন্দোয় ফিরে আসা মেলকিয়াদেস সত্যিকারের জীবিত মানুষ ছিল না- ছিল ছায়ামাত্র। সুতরাং মেলকিয়াদেসের সাথে অবতার কৃষ্ণকে মিলিয়ে দেখলে ক্ষতি কী! না কি খুব বেশি পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে! হলে হোক আমি বরং আরো খানিক এগিয়ে চলি।
কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার অবয়বে প্রতিভাত হয় একজন চাঁদ সওদাগর। মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম প্রধান চরিত্র এই চাঁদ সওদাগর। সওদাগর আভিজাত্য ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। সাপের দেবি মনসা তার কাছে পুজো প্রত্যাশা করে। কিন্তু নীচু গোত্রীয় দেবী হওয়ায় ঐ দাবি বার-বার উপেক্ষিত হয়। এরই ফল¯্রুতিতে সাপের কামড়ে চাঁদ সওদাগরের পর-পর সাত সন্তান নিহত হয়। মার্কেজের কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকেও এমন ভাগ্য-বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়। নিরীক্ষণ করলে দেখা যায় দুটি চরিত্রের মধ্যে আদর্শগত তেমন অমিল নেই।
মাকোন্দোয় তিন হাজার শ্রমিক হত্যা ও তৎপরবর্তী আবহ আমাদের ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে নিয়ে যায়। অনুভূতির দুয়ারে হাহাকার ধ্বনি ভেসে আসে। কারবালার প্রান্তরের শোকগাঁথা নিয়ে মীর মশাররফ হোসেন রচনা করেছেন ‘বষাদসিন্ধু’। এখানে বর্ণিত হয়েছে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দৌহিত্র ঈমাম হাসান ও ঈমাম হোসেন-এর ভাগ্য-বিপর্যয়ের ইতিহাস। প্রতিপক্ষ বাহিনীকে পরাজিত করতে এজিদ বাহিনী ফোরাত নদীর জল অবরোধ করে। ফলে পানি পিপাসায় অসংখ্য সতেজ প্রাণ নেতিয়ে পড়ে।
‘বিসাদসিন্ধু’ বাংলা সাহিত্যের বহুল পঠিত একটি বই। কারবালার শোকগাথা শুধুমাত্র ঐ নিদৃষ্ট ভুখ-ে সীমাবদ্ধ না থেকে বাঙালি সংস্কৃতির অংশীভূত হয়ে গেছে। দুর্ভোগের কারণ ও ধরন ভিন্ন হলেও কারবালা ও মাকোন্দোর মধ্যে আবহগত মিল খোঁজা অযৌক্তিক নয়।
সময় বদলে যাচ্ছে, পরিবেশ বদলে যাচ্ছে, প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে- বদলে যাচ্ছে সাহিত্যের গতি প্রকৃতি। এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করছে নানাবিধ অনুষঙ্গ। এসব অনুষঙ্গের মধ্যে পঠন-পাঠনই গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষত বিদেশি সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এসব পরিবর্তন যেমনি ইতিবাচক তেমনি সময়পোযোগী। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হলে অবশ্যই সাদৃশ্যমূলক সাহিত্যচর্চায় আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে।
পিন্টু রহমান
বুধবার, ১৬ আগস্ট ২০২৩
যদিও নিজস্ব আবেগ অনুভুতির বহিঃপ্রকাশ তথা লেখকের মাটিবর্তী হৃদয়ের অন্তঃপুরে লেখার সূচনা তথাপি লেখা প্রকাশের পর তা আর কেবলমাত্র ঐ বিশেষ লেখকের ভালোলাগার সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না; তৈরি হয় লেখক-পাঠকের বহুকৌণিক ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক। সম্পর্কের ধরন কিংবা মাত্রার ক্ষেত্রে পাঠকে-পাঠকে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ম্যাজিক রিয়ালিজমের জনক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড সম্পর্কে নোবেল কমিটি উল্লেখ করেছেন, “মার্কেজের সাহিত্যে স্বপ্ন আর বাস্তবতার অসাধারণ মিশেল রয়েছে- যা জীবনের শুদ্ধতা ও সংঘাতকে তুলে ধরে।”
স্প্যানিশ সাহিত্যের আরেক দিকপাল ও চিলির নোবেলজয়ী লেখক পাবলো নেরুদার মতে সপ্তদশ শতকে মিগুয়েল শারভানতেসের লেখা “ডন কুইক্সোর্ট”-এর পর এই উপন্যাসটিই স্প্যানিশ সাহিত্যে সবচেয়ে মহান সৃষ্টি। বস্তুত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ স্প্যানিশ ভাষার সর্বকালের সেরা লেখকদের একজন। “ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড” বা ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বসাহিত্যে বিশেষ উন্মাদনার সৃষ্টি করেছে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত বইটি সারা বিশ্বে প্রায় ৩ কোটি কপি বিক্রি হয়।
গল্প বা উপন্যাসে সময়কে বয়ে বেড়ানো খুবই কষ্টকর। অথচ সময়ের সাথে মার্কেজ জাদুকরের মতো খেলেছেনে। “নিঃসঙ্গতার একশো বছর” উপন্যাসে মানুষের চিরাচরিত, প্রথাগত সময় ধরে গল্প বলা হয় নি- বরং এতে এক শতাব্দীর প্রতিদিনকার নানা ঘটনা, নানা আখ্যান, একটা আরেকটার পাশাপাশি অবস্থান করেছে। মার্কেজ সম্পর্কে একটি বিশেষ মত প্রচলিত আছে- তিনের যোগফলে মার্কেজ : বোর্হেসের কাছ থেকে কল্পনা, কাফকার কাছ থেকে মেটাফর ও পয়েন্ট অব ভিউ আর উইলিয়াম ফকনারের কাছ থেকে অনেক মানুষ বাস করে এমন এক মনুষ্য অঞ্চলকে চিত্রায়িত করার কৈশল! শুধু তাই নয় জেমস জয়েসের স্বপ্ন বর্ণনা রীতির গদ্যকেও তিনি অসম্ভব সহজবোধ্যতায় নিজের করে নিয়েছেন-
“ডুবে যায় সে, সে এমনকি তার বাবাও হয়ে ওঠে একটা উৎপাত বিশেষ। চারদিকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য মিথ্যে অভিসারের জটিল জাল তৈরি করে সে, তার সাথীদের কাছে সে হয়ে ওঠে ডুমুরের ফুল, যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে মরিসিও ব্যাবিলোনিয়ার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যে গতানুগতিকতার বেড়া ডিঙিয়ে যায়। গোড়ার দিকে তার রুক্ষতায় বিরক্ত হতো মেমো। গ্যারেজের পেছনে পতিত জমিটায় প্রথম যেবার ওরা নির্জনে মিলিত হয় সেবার মরিসিও তাকে টানতে-টানতে এমন একটা জ্যান্তব অবস্থায় নিয়ে আসে যে মেমো বিধ্বস্থ হয়ে যায়।”
কোন-কোন আলোচক মার্কেজকে সাহ্যিতের দৃশ্যশিল্পী হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। আলোচ্য গদ্যে একজন পাঠক হিসেবে ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’-এর নানাবিধ দৃশ্যের সাথে কতিপয় সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করেছি- যে সাদৃশ্যের সাথে একান্তই বাঙালীপনা লেপটে আছে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ রচিত ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ উপন্যাসের মূল সূত্র একটি রহস্যময় পার্চমেন্ট। একশো বছর আগে লিখিত ঐ পার্চমেন্টে বুয়েন্দিয়া পরিবার ও মাকোন্দ শহরের পতনের কারণও বিবরণে উল্লেখ করা ছিল। বুয়েন্দিয়া পরিবারের ষষ্ঠ পুরুষ শিশু অরেলিয়ানো ব্যাবিলোনিয়া শুয়রের লেজ নিয়ে জন্মানোর সাথে-সাথে মেলকিয়াদেসের ভবিষ্যৎবাণী বাস্তবে পরিণত হয়। শিশুটি জন্মের পর অরেলিয়ানো ব্যাবেলোনিয়া রহস্যময় পার্চমেন্টের পাঠোদ্ধারে সক্ষম হয়। শেষ পাতাটি পাঠের মাধ্যমে নিজের মৃত্যুর দিন-তারিখ-ক্ষণ সম্পর্কে অবগত হতে-হতেই সমগ্র মাকোন্দ এক তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। লেজওয়ালা শিশুটি বুয়েন্দিয়া পরিবারের শত বছর যাপিত জীবনের প্রথম ভালবাসাজাত সন্তান। এরূপ সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে পরিবারের প্রথম নারী আমারান্তা উরসুল ইগুয়ারান-এর তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু অরেলিয়ানো ও উরসুলার ভালোবাসার কাছে নিষেধাজ্ঞার সীমারেখা মাড়িয়ে গেছে। শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও তারা দুজন দৈহিক প্রণয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এবং গর্ভধারণ করেছে। যদিও তারা তাদের মধ্যকার প্রকৃত জৈব সম্পর্কের ধরণ কী ছিল তা জানত না। কখনো-কখনো মনে হয়েছে তারা সম্ভবত ভাই-বোন; প্রকৃত পক্ষে তারা ছিল খালা-ভাগ্নে।
‘খালা-ভাগ্নে’ শব্দটির কছে প্রতিবারই পাঠক হিসেবে আমি মনে-মনে হোঁচট খাই; শ্রী কৃষ্ণকীর্তন-এ বর্ণিত রাঁধা ও কৃঞ্চ চরিত্র দুটি চিত্রময় হয়ে ওঠে। বস্তুত জৈবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয় জুটিই একমাত্রিক। চণ্ডীদাসের কৃতির কথা ভেবে ভালো লাগে। মনে মনে পুলকিত হই। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে রচিত গ্রন্থটির চরিত্র দুটি এখনো যেনো পাঠকের মনে জীবন্ত হয়ে আছে। শ্রী-কৃষ্ণ রাখাল। সে বাঁশি বাজায় এবং মাঠে মাঠে গরু চরায়। ঘটনাক্রমে মামী সম্পর্কীয় রমণী রাধা’র প্রতি আসক্ত হয়ে ওঠে। এই আসক্তি যতটা না ভালোবাসার তারচেয়ে বেশি দৈহিক। রাধা রুপবতী; চিরায়ত বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি। তাকে কাছে পেতে কৃষ্ণ নানামুখী ছল-চাতুরির আশ্রয় নেয়। কিন্তু দেহ সম্ভোগের পর রাধা যখন প্রকৃত অর্থেই কৃষ্ণ’র প্রেমে আকুল হয়, ঠিক তখনি কৃষ্ণ তাকে একলা ফেলে বৃন্দাবন চলে যায়।
স্প্যানিশ সাহিত্যের আরেক দিকপাল ও চিলির নোবেলজয়ী লেখক পাবলো নেরুদার মতে সপ্তদশ শতকে মিগুয়েল শারভানতেসের লেখা ‘ডন কুইক্সোর্ট’-এর পর এই উপন্যাসটিই স্প্যানিশ সাহিত্যে সবচেয়ে মহান সৃষ্টি। বস্তুত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ স্প্যানিশ ভাষার সর্বকালের সেরা লেখকদের একজন
আবার কারো-কারো মতে কৃষ্ণ অবতার। ভক্তিভরে অনেকে তাকে পূজা-অর্চনা করে। তাহলে কৃষ্ণকে অবতার মানলে মেলকিয়াদেসকে কোন পাল্লায় ওজন করবো! মেলকিয়াদেস রক্ত-মাংসের কোনো মানুষ নয়। মাকোন্দ শহর পত্তনকারীদের আদিতম পুরুষ হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার একজন জিপসি বন্ধু মূলত মেলকিয়াদেস। বিজ্ঞানের নিত্য-নতুন আবিষ্কার ফেরি করার লক্ষ্যে প্রতিবছর সে মাকোন্দ শহরে আসতো। শহরের আলো-বঞ্চিত অধিবাসীদের বিজ্ঞানের প্রতি প্রলুব্ধ করতো। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পরের বছর জিপসীরা এলেও আসে না শুধু মেলকিয়াদেস। বহু বছর পরে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অনুসন্ধান করে জানতে পারে, জাহাজডুবিতে মেলকিয়াদেস নিহত হয়েছে। অথচ এর কয়েক বছর বাদে দিব্যি জীবিত অবস্থায় মেলকিয়াদেস ফিরে আসে। মাকোন্দোয় ফিরে আসা মেলকিয়াদেস সত্যিকারের জীবিত মানুষ ছিল না- ছিল ছায়ামাত্র। সুতরাং মেলকিয়াদেসের সাথে অবতার কৃষ্ণকে মিলিয়ে দেখলে ক্ষতি কী! না কি খুব বেশি পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে! হলে হোক আমি বরং আরো খানিক এগিয়ে চলি।
কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার অবয়বে প্রতিভাত হয় একজন চাঁদ সওদাগর। মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম প্রধান চরিত্র এই চাঁদ সওদাগর। সওদাগর আভিজাত্য ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। সাপের দেবি মনসা তার কাছে পুজো প্রত্যাশা করে। কিন্তু নীচু গোত্রীয় দেবী হওয়ায় ঐ দাবি বার-বার উপেক্ষিত হয়। এরই ফল¯্রুতিতে সাপের কামড়ে চাঁদ সওদাগরের পর-পর সাত সন্তান নিহত হয়। মার্কেজের কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকেও এমন ভাগ্য-বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়। নিরীক্ষণ করলে দেখা যায় দুটি চরিত্রের মধ্যে আদর্শগত তেমন অমিল নেই।
মাকোন্দোয় তিন হাজার শ্রমিক হত্যা ও তৎপরবর্তী আবহ আমাদের ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে নিয়ে যায়। অনুভূতির দুয়ারে হাহাকার ধ্বনি ভেসে আসে। কারবালার প্রান্তরের শোকগাঁথা নিয়ে মীর মশাররফ হোসেন রচনা করেছেন ‘বষাদসিন্ধু’। এখানে বর্ণিত হয়েছে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দৌহিত্র ঈমাম হাসান ও ঈমাম হোসেন-এর ভাগ্য-বিপর্যয়ের ইতিহাস। প্রতিপক্ষ বাহিনীকে পরাজিত করতে এজিদ বাহিনী ফোরাত নদীর জল অবরোধ করে। ফলে পানি পিপাসায় অসংখ্য সতেজ প্রাণ নেতিয়ে পড়ে।
‘বিসাদসিন্ধু’ বাংলা সাহিত্যের বহুল পঠিত একটি বই। কারবালার শোকগাথা শুধুমাত্র ঐ নিদৃষ্ট ভুখ-ে সীমাবদ্ধ না থেকে বাঙালি সংস্কৃতির অংশীভূত হয়ে গেছে। দুর্ভোগের কারণ ও ধরন ভিন্ন হলেও কারবালা ও মাকোন্দোর মধ্যে আবহগত মিল খোঁজা অযৌক্তিক নয়।
সময় বদলে যাচ্ছে, পরিবেশ বদলে যাচ্ছে, প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে- বদলে যাচ্ছে সাহিত্যের গতি প্রকৃতি। এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করছে নানাবিধ অনুষঙ্গ। এসব অনুষঙ্গের মধ্যে পঠন-পাঠনই গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষত বিদেশি সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এসব পরিবর্তন যেমনি ইতিবাচক তেমনি সময়পোযোগী। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হলে অবশ্যই সাদৃশ্যমূলক সাহিত্যচর্চায় আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে।