alt

সাময়িকী

বিদ্রোহী : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তি মানববিজয়কেতন

মো. জেহাদ উদ্দিন

: বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩

কাজী নজরুল ইসলামের বিস্ময়কর সৃষ্টি বিদ্রোহী কবিতা। বাংলা সাহিত্যে এ কবিতার মতো আর কোনো কবিতা নেই। বিশ্বসাহিত্যেও তা অতুলনীয়। কবিতাটি প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র চিঁড় ধরেনি, যদিও কেবল জনপ্রিয়তা সাহিত্য বিচারের মানদ- নয়, কেবল একটি অনুষঙ্গ হতে পারে। বিদ্রোহী কবিতা একদিকে যেমন তুমুল জনপ্রিয়, অপরদিকে তা একটি ভাষার খোল-নলচে পাল্টে দিয়েছে, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে দিয়েছে, মূল্যহীন থেকে সে সীমাহীন মূল্য ও শক্তির সন্ধান পেয়েছে, সগৌরবে স্বমহিমায় সে শির উঁচু করে দাঁড়াবার রসদ পেয়েছে, সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সৎসাহস পেয়েছে, মানবজীবনের সত্যিকারের অর্থ খুঁজে পেয়েছে। বিদ্রোহী কবিতা কেবল কবির জীবনে চিরদিনের জন্য বিদ্রোহী মুকুট বয়ে আনেনি, বরং বিশ্বের সকল নির্যাতিত, নিপীড়িত, মুক্তিকামী মানুষের জীবনে বয়ে এনেছে অপরিসীম শক্তি, সাহস, চেতনা, উদ্দীপনা ও নবজীবনের স্বপ্ন।

আর কোনও কবিতা দশকের পর দশক ধরে পরাক্রান্ত ব্রিটিশ শাসকের খাতায় ‘বিপজ্জনক’ মার্কা পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালি আর কোনও কবিকে একটা কবিতার নামে ডাকেনি। নজরুলকে ডাকল

পরাধীন ভারতবর্ষ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামক একটি কোম্পানি ১০০ বছর শাসন করেছে ভারত। ১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলনে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় বাহিনী পরাজিত হলে ভারতকে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়- যা ১৯৪৭ খ্রি. পর্যন্ত বলবৎ থাকে।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে- পলাশী বিপর্যয়ের ১৪২ বছর পর। তিনি যখন কিছুটা বুঝতে শিখছেন তখন স্বাধীনতা হারানোর সার্ধ-শতবর্ষ। পেছনের এই সুদীর্ঘ সময়ে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য বেশ কিছু আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ছিল মূলত মুসলমানদের আন্দোলন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম ছাড়া অন্যদের খুব একটা উচ্চ-বাচ্য ছিল না। এর ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্ আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। একদল প্রতিরোধ নীতিতে ছিলেন আপোসহীন; আরেক দল প্রতিরোধের চাইতে ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতা নীতিকেই শ্রেয় মনে করল।

যেহেতু মুসলমানদের নিকট থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজ্য কেড়ে নিয়েছে, সেহেতু তাদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক ছিল শত্রুতামূলক এবং অবিশ্বাসের। অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুসলমানদের একটি সুবিধাভোগী অংশ ইংরেজ ও তাদের সহযোগীদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। তবে জাতি হিসেবে মুসলমানদের অবস্থান ছিল দখলদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পক্ষে। শুরু থেকেই ভারতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধোরের সংগ্রামে লিপ্ত হয় মুসলিম জাতি। মীর নিসার আলী তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, হাজী শরীয়তুল্লাহ পরিচালিত ফরায়েজি আন্দোলন, ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ, গোটা মুসলিম সম্প্রদায় কর্তৃক ইংরেজি ভাষা এবং লুটেরা ইংরেজদের বর্জন, ১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলন- ইত্যাদি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের একেকটি মাইলফলক।

অব্যাহত ব্রিটিশ-বিরোধিতা, অসহযোগিতা ও আন্দোলন সংগ্রামের অপরিহার্য ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতীয় মুসলমানদের উপর নেমে আসে অত্যাচারের স্টিম রোলার। জেল-জুলুম, নির্বাসন, হত্যাযজ্ঞসহ অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয় স্বাধীনতাকামী মুসলিম সম্প্রদায়। অব্যবহিত পূর্ববর্তী সময়ে গোটা ভারতবর্ষের সিংহাসনে সমাসীন মুসলমানগণ রাতারাতি ছিন্নমূল ও সর্বহারায় পরিণত হয়ে গেল! কেবল স্বাধীনতা আন্দোলন করার কারণে তাঁদের উপর নেমে এল জুলুমের কালরাত। উইলিয়াম হান্টার-এর দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমান গ্রন্থে এ অত্যাচার-নির্যাতন এবং মুসলমানদের প্রতি রাষ্ট্রীয় চরম বৈষম্যমূলক নীতির কিছুটা উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মোৎসর্গকারী বীর মুসলিমদের অপরিসীম আত্মোৎসর্গের অম্লান গাথা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভারতজুড়ে। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক কিংবা দূর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আজও কান পাতলে শোনা যায় সেই সব বীর শহীদদের আত্মবলিদানের কথা। ১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলনের বীর সৈনিক আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর কাফনের কাপড়ে লেখা ‘১৮৫৭ আজাদী আন্দোলন (অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান) কিংবা আল্লামা জাফর থানেশ্বরীর স্মৃতিকথা- বই দুটো নমুনা হিসেবে দেখা যেতে পারে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান, তাঁদের প্রতি ইংরেজ ও তাদের সহযোগীদের জুলুম নির্যাতন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে সেখান থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে (২০১৬) ভারতের লোকসভার সদস্য মিঃ Shashi Tharoor iwPZ An Era of Darkness: The British Empire in India গ্রন্থ থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে ব্রিটিশ শাসন ভারতের উপর কত বড় অভিশাপ ছিল। মুসলিম শাসনামলে ভারতের মোট জিডিপি ছিল পৃথিবীর মোট জিডিপির শতকরা ২৩ ভাগ- যা ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন-শোষণের পরে এসে দাঁড়ায় শতকরা মাত্র ৩ ভাগে। সুতরাং স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলে কেবল সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানগণ অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হননি; বরং রাষ্ট্র হিসেবে ভারতেরও সীমাহীন ক্ষয়-ক্ষতি হয়। আর সেই ক্ষতি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা সবদিকেই। ভারতের সম্পদ লুটপাট করে ব্রিটেনে পাচার করা, ক্ষমতাসীন ইংরেজ এবং তাদের পদলেহীদের মধ্যে সম্পদ ও রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত করা, বিরোধী মতাবলম্বী তথা স্বাধীনতাকামীদের প্রতি অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন চালানো ইত্যাদি তখনকার নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গোটা ভারতবর্ষ শ্মশান বা গোরস্থানে পরিণত হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম জন্মের পর ভারতবর্ষের এ চিত্রটিই দেখলেন। পরাধীনতার অন্ধকার, মানুষে মানুষে বৈষম্য, দুর্বলদের প্রতি অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি তাঁকে ব্যথিত করে তোলে। ছোটবেলা থেকেই নজরুলকে তা বিশেষভাবে ভাবিয়ে তোলে। শিশু নজরুলের কচি মনের হাহাকারের প্রমাণ মেলে তাঁর লেটো জীবনের রচনায়ও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে সেইসব সৃষ্টির মধ্যেও। পরবর্তীতে ভরা যৌবনে রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর আজন্মলালিত চেতনার মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক শেষ রজনীতে কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেন বিদ্রোহী কবিতা। তাঁর ভাবের গতির সাথে ঝর্ণা কলমের গতি তাল মেলাতে পারছিল না বিধায় তিনি পেন্সিলে কবিতাটি লেখা সম্পন্ন করেন এবং প্রত্যুষে তাঁর কক্ষসঙ্গী কমরেড মুজাফফর আহমদকে কবিতাটি পাঠ করে শোনান। কবিতাটি লেখা সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই কবি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, সাহিত্যের ইতিহাসে মহাবিস্ময়কর কাজটি তিনি সম্পন্ন করে ফেলেছেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য একটি নতুন যুগে প্রবেশ করে, বাংলা সাহিত্যকাশের গৌরবময় আসনটি দখল করেন কাজী নজরুল ইসলাম।

বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম প্রকাশের গৌরব অর্জন করে বিজলী পত্রিকা। এখানেও মহাবিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। শুধু একটি কবিতার জন্য পত্রিকার মুদ্রিত সকল কপি শেষ হয়ে যাওয়া এবং পাঠক চাহিদা মেটানোর জন্য পত্রিকা পুনর্মুদ্রণের ঘটনা বিদ্রোহীর কবিতার বেলায় ঘটেছিল। আমাদের জানা মতে পৃথিবীতে এর দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার ২২ শে পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ (৬ জানুয়ারি ১৯২২) সংখ্যায় বিদ্রোহী কবিতাটি মুদ্রিত হওয়ার পর পাঠকদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে যায়। পত্রিকার কপি নিয়ে শুরু হয় কাড়াকাড়ি। যেদিন ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হয়, সেদিন প্রবল বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও কাগজের চাহিদা এতো বেশি হয়েছিলো যে, একই সপ্তাহে দু’বার পত্রিকাটি ছাপতে হয়েছিলো। পরবর্তীতে মোসলেম ভারত ছাড়াও ১৩২৮ মাঘের ‘প্রবাসী’, ১৩২৯ বৈশাখের ‘সাধনা’, দৈনিক বসুমতি, নজরুল-সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু (২২ আগস্ট ১৯২২)সহ আরও অনেক কাগজে বিদ্রোহী পুনর্মুদ্রিত হয়।

বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ উপলক্ষে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি:

‘নলিনীকান্ত সরকার সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বিজলী’র ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি সংখ্যায় সেই দীর্ঘ কবিতা প্রথম বেরোল। বাজারে পড়ামাত্র উড়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি যে ক’দিনের মাথায় ফের ছাপতে হল ‘বিজলী’র ওই সংখ্যা। সব মিলিয়ে ২৭ হাজার কপি। মাস দুয়েকের মধ্যে মোজাম্মেল হক সম্পাদিত ‘মোসলেম ভারত’-এর কার্তিক ১৩২৮ সংখ্যা বেরোল, নির্ধারিত সময়ের চার মাস বাদে। তাতেও রইল সেই কবিতা। তার আগেই ‘প্রবাসী’-র মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায় সেই কবিতার পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। ‘সাধনা’র বৈশাখ ১৩২৯ সংখ্যা, ‘ধূমকেতু’র ২২ অগস্ট ১৯২২ সংখ্যা- কোথায় না ছাপা হলো সেই কবিতা! ওই বছর পুজোর মরসুমে পুরনো কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হলো সেই কবিতা। ক মাস আগেই ‘একজন সৈনিক’ পরিচয়ে যাঁর ‘শাত্?-ইল-আরব’ কাগজে বেরিয়েছে, এই কবিতার বিপুল জনপ্রিয়তা তাঁর নাম পাঠকের মুখে মুখে ছড়িয়ে দিল।

ছাপাখানা আসার পর আর কোনও বাংলা কবিতার বরাতে এমন খাতিরদারি জোটেনি বা অখ্যাতির ভাঁড়ার উপচে পড়েনি। আর কোনও কবিতা দশকের পর দশক ধরে পরাক্রান্ত ব্রিটিশ শাসকের খাতায় ‘বিপজ্জনক’ মার্কা পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালি আর কোনও কবিকে একটা কবিতার নামে ডাকেনি। নজরুলকে ডাকল। রেওয়াজি আবৃত্তিকার কিংবা বাংলা সিনেমার ফুটো মাস্তান প্রমোদ প্রধানের চোখে আজও ওই ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো’-এর প্রথম পরিচয়- ‘বিদ্রোহী কবি’। কবি আর কবিতা একাকার। আজও বাংলা ভাষার চিরকালীন বেস্টসেলার ‘সঞ্চিতা’র পাতা ওল্টালে সবার আগে সেই কবিতাতেই চোখ আটকায়। কোথাও না কোথাও থেকে কানে ভেসে আসে কাজী সব্যসাচীর দরাজ গলায় ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে রেকর্ড করা সেই কবিতার আবৃত্তি- ‘বল বীর-/ বল উন্নত মম শির!’

পৃথিবীতে যেসব কবিতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় সেগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে বিদ্রোহী প্রথম স্থান পাওয়ার দাবিদার। কবিতাটি মুদ্রিত হওয়ার পর কেউ কেউ অবশ্য এর গতি-প্রকৃতি বুঝতে না পেরে, কিংবা নিজেদের সংকীর্ণতা বা পরশ্রীকাতরতার কারণে কিছু নেতিবাচক সমালোচনা করেছিলেন- যেগুলো অবশ্য হালে পানি পায়নি। বিদ্রোহী তার স্বকীয়তা নিয়ে সগৌরবে সাহিত্যাঙ্গনে বিরাজ করছে এবং তা করতেই থাকবে।

ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন:

‘নজরুল তাঁর অগ্নি-বীণায় একদিন দীপক রাগে গেয়ে উঠেছিলেন:

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন!
আমি স্রষ্টা-সৃজন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদচিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!”

সেই থেকে কবির নাম হয়ে গেল বিদ্রোহী। আজ পর্যন্ত গোলমাল-মস্তিষ্ক লোকে কবিকে নাস্তিক ঈশ্বরদ্রোহী বলে নিন্দা করতে কসুর করে না, যদিও কবি আজ নিন্দা প্রশংসার ঊর্ধ্বে। (সংক্ষেপিত)

ছবি

দূরের তারাটিকে

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

ছবি

যেদিন সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন

ছবি

ফিরবে না তা জানি

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

বিদ্রোহী : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তি মানববিজয়কেতন

মো. জেহাদ উদ্দিন

বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩

কাজী নজরুল ইসলামের বিস্ময়কর সৃষ্টি বিদ্রোহী কবিতা। বাংলা সাহিত্যে এ কবিতার মতো আর কোনো কবিতা নেই। বিশ্বসাহিত্যেও তা অতুলনীয়। কবিতাটি প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র চিঁড় ধরেনি, যদিও কেবল জনপ্রিয়তা সাহিত্য বিচারের মানদ- নয়, কেবল একটি অনুষঙ্গ হতে পারে। বিদ্রোহী কবিতা একদিকে যেমন তুমুল জনপ্রিয়, অপরদিকে তা একটি ভাষার খোল-নলচে পাল্টে দিয়েছে, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে দিয়েছে, মূল্যহীন থেকে সে সীমাহীন মূল্য ও শক্তির সন্ধান পেয়েছে, সগৌরবে স্বমহিমায় সে শির উঁচু করে দাঁড়াবার রসদ পেয়েছে, সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সৎসাহস পেয়েছে, মানবজীবনের সত্যিকারের অর্থ খুঁজে পেয়েছে। বিদ্রোহী কবিতা কেবল কবির জীবনে চিরদিনের জন্য বিদ্রোহী মুকুট বয়ে আনেনি, বরং বিশ্বের সকল নির্যাতিত, নিপীড়িত, মুক্তিকামী মানুষের জীবনে বয়ে এনেছে অপরিসীম শক্তি, সাহস, চেতনা, উদ্দীপনা ও নবজীবনের স্বপ্ন।

আর কোনও কবিতা দশকের পর দশক ধরে পরাক্রান্ত ব্রিটিশ শাসকের খাতায় ‘বিপজ্জনক’ মার্কা পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালি আর কোনও কবিকে একটা কবিতার নামে ডাকেনি। নজরুলকে ডাকল

পরাধীন ভারতবর্ষ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামক একটি কোম্পানি ১০০ বছর শাসন করেছে ভারত। ১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলনে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় বাহিনী পরাজিত হলে ভারতকে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়- যা ১৯৪৭ খ্রি. পর্যন্ত বলবৎ থাকে।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে- পলাশী বিপর্যয়ের ১৪২ বছর পর। তিনি যখন কিছুটা বুঝতে শিখছেন তখন স্বাধীনতা হারানোর সার্ধ-শতবর্ষ। পেছনের এই সুদীর্ঘ সময়ে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য বেশ কিছু আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ছিল মূলত মুসলমানদের আন্দোলন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম ছাড়া অন্যদের খুব একটা উচ্চ-বাচ্য ছিল না। এর ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্ আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। একদল প্রতিরোধ নীতিতে ছিলেন আপোসহীন; আরেক দল প্রতিরোধের চাইতে ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতা নীতিকেই শ্রেয় মনে করল।

যেহেতু মুসলমানদের নিকট থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজ্য কেড়ে নিয়েছে, সেহেতু তাদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক ছিল শত্রুতামূলক এবং অবিশ্বাসের। অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুসলমানদের একটি সুবিধাভোগী অংশ ইংরেজ ও তাদের সহযোগীদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। তবে জাতি হিসেবে মুসলমানদের অবস্থান ছিল দখলদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পক্ষে। শুরু থেকেই ভারতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধোরের সংগ্রামে লিপ্ত হয় মুসলিম জাতি। মীর নিসার আলী তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, হাজী শরীয়তুল্লাহ পরিচালিত ফরায়েজি আন্দোলন, ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ, গোটা মুসলিম সম্প্রদায় কর্তৃক ইংরেজি ভাষা এবং লুটেরা ইংরেজদের বর্জন, ১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলন- ইত্যাদি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের একেকটি মাইলফলক।

অব্যাহত ব্রিটিশ-বিরোধিতা, অসহযোগিতা ও আন্দোলন সংগ্রামের অপরিহার্য ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতীয় মুসলমানদের উপর নেমে আসে অত্যাচারের স্টিম রোলার। জেল-জুলুম, নির্বাসন, হত্যাযজ্ঞসহ অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয় স্বাধীনতাকামী মুসলিম সম্প্রদায়। অব্যবহিত পূর্ববর্তী সময়ে গোটা ভারতবর্ষের সিংহাসনে সমাসীন মুসলমানগণ রাতারাতি ছিন্নমূল ও সর্বহারায় পরিণত হয়ে গেল! কেবল স্বাধীনতা আন্দোলন করার কারণে তাঁদের উপর নেমে এল জুলুমের কালরাত। উইলিয়াম হান্টার-এর দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমান গ্রন্থে এ অত্যাচার-নির্যাতন এবং মুসলমানদের প্রতি রাষ্ট্রীয় চরম বৈষম্যমূলক নীতির কিছুটা উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মোৎসর্গকারী বীর মুসলিমদের অপরিসীম আত্মোৎসর্গের অম্লান গাথা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভারতজুড়ে। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক কিংবা দূর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আজও কান পাতলে শোনা যায় সেই সব বীর শহীদদের আত্মবলিদানের কথা। ১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলনের বীর সৈনিক আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর কাফনের কাপড়ে লেখা ‘১৮৫৭ আজাদী আন্দোলন (অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান) কিংবা আল্লামা জাফর থানেশ্বরীর স্মৃতিকথা- বই দুটো নমুনা হিসেবে দেখা যেতে পারে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান, তাঁদের প্রতি ইংরেজ ও তাদের সহযোগীদের জুলুম নির্যাতন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে সেখান থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে (২০১৬) ভারতের লোকসভার সদস্য মিঃ Shashi Tharoor iwPZ An Era of Darkness: The British Empire in India গ্রন্থ থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে ব্রিটিশ শাসন ভারতের উপর কত বড় অভিশাপ ছিল। মুসলিম শাসনামলে ভারতের মোট জিডিপি ছিল পৃথিবীর মোট জিডিপির শতকরা ২৩ ভাগ- যা ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন-শোষণের পরে এসে দাঁড়ায় শতকরা মাত্র ৩ ভাগে। সুতরাং স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলে কেবল সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানগণ অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হননি; বরং রাষ্ট্র হিসেবে ভারতেরও সীমাহীন ক্ষয়-ক্ষতি হয়। আর সেই ক্ষতি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা সবদিকেই। ভারতের সম্পদ লুটপাট করে ব্রিটেনে পাচার করা, ক্ষমতাসীন ইংরেজ এবং তাদের পদলেহীদের মধ্যে সম্পদ ও রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত করা, বিরোধী মতাবলম্বী তথা স্বাধীনতাকামীদের প্রতি অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন চালানো ইত্যাদি তখনকার নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গোটা ভারতবর্ষ শ্মশান বা গোরস্থানে পরিণত হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম জন্মের পর ভারতবর্ষের এ চিত্রটিই দেখলেন। পরাধীনতার অন্ধকার, মানুষে মানুষে বৈষম্য, দুর্বলদের প্রতি অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি তাঁকে ব্যথিত করে তোলে। ছোটবেলা থেকেই নজরুলকে তা বিশেষভাবে ভাবিয়ে তোলে। শিশু নজরুলের কচি মনের হাহাকারের প্রমাণ মেলে তাঁর লেটো জীবনের রচনায়ও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে সেইসব সৃষ্টির মধ্যেও। পরবর্তীতে ভরা যৌবনে রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর আজন্মলালিত চেতনার মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক শেষ রজনীতে কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেন বিদ্রোহী কবিতা। তাঁর ভাবের গতির সাথে ঝর্ণা কলমের গতি তাল মেলাতে পারছিল না বিধায় তিনি পেন্সিলে কবিতাটি লেখা সম্পন্ন করেন এবং প্রত্যুষে তাঁর কক্ষসঙ্গী কমরেড মুজাফফর আহমদকে কবিতাটি পাঠ করে শোনান। কবিতাটি লেখা সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই কবি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, সাহিত্যের ইতিহাসে মহাবিস্ময়কর কাজটি তিনি সম্পন্ন করে ফেলেছেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য একটি নতুন যুগে প্রবেশ করে, বাংলা সাহিত্যকাশের গৌরবময় আসনটি দখল করেন কাজী নজরুল ইসলাম।

বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম প্রকাশের গৌরব অর্জন করে বিজলী পত্রিকা। এখানেও মহাবিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। শুধু একটি কবিতার জন্য পত্রিকার মুদ্রিত সকল কপি শেষ হয়ে যাওয়া এবং পাঠক চাহিদা মেটানোর জন্য পত্রিকা পুনর্মুদ্রণের ঘটনা বিদ্রোহীর কবিতার বেলায় ঘটেছিল। আমাদের জানা মতে পৃথিবীতে এর দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার ২২ শে পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ (৬ জানুয়ারি ১৯২২) সংখ্যায় বিদ্রোহী কবিতাটি মুদ্রিত হওয়ার পর পাঠকদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে যায়। পত্রিকার কপি নিয়ে শুরু হয় কাড়াকাড়ি। যেদিন ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হয়, সেদিন প্রবল বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও কাগজের চাহিদা এতো বেশি হয়েছিলো যে, একই সপ্তাহে দু’বার পত্রিকাটি ছাপতে হয়েছিলো। পরবর্তীতে মোসলেম ভারত ছাড়াও ১৩২৮ মাঘের ‘প্রবাসী’, ১৩২৯ বৈশাখের ‘সাধনা’, দৈনিক বসুমতি, নজরুল-সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু (২২ আগস্ট ১৯২২)সহ আরও অনেক কাগজে বিদ্রোহী পুনর্মুদ্রিত হয়।

বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ উপলক্ষে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি:

‘নলিনীকান্ত সরকার সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বিজলী’র ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি সংখ্যায় সেই দীর্ঘ কবিতা প্রথম বেরোল। বাজারে পড়ামাত্র উড়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি যে ক’দিনের মাথায় ফের ছাপতে হল ‘বিজলী’র ওই সংখ্যা। সব মিলিয়ে ২৭ হাজার কপি। মাস দুয়েকের মধ্যে মোজাম্মেল হক সম্পাদিত ‘মোসলেম ভারত’-এর কার্তিক ১৩২৮ সংখ্যা বেরোল, নির্ধারিত সময়ের চার মাস বাদে। তাতেও রইল সেই কবিতা। তার আগেই ‘প্রবাসী’-র মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায় সেই কবিতার পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। ‘সাধনা’র বৈশাখ ১৩২৯ সংখ্যা, ‘ধূমকেতু’র ২২ অগস্ট ১৯২২ সংখ্যা- কোথায় না ছাপা হলো সেই কবিতা! ওই বছর পুজোর মরসুমে পুরনো কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হলো সেই কবিতা। ক মাস আগেই ‘একজন সৈনিক’ পরিচয়ে যাঁর ‘শাত্?-ইল-আরব’ কাগজে বেরিয়েছে, এই কবিতার বিপুল জনপ্রিয়তা তাঁর নাম পাঠকের মুখে মুখে ছড়িয়ে দিল।

ছাপাখানা আসার পর আর কোনও বাংলা কবিতার বরাতে এমন খাতিরদারি জোটেনি বা অখ্যাতির ভাঁড়ার উপচে পড়েনি। আর কোনও কবিতা দশকের পর দশক ধরে পরাক্রান্ত ব্রিটিশ শাসকের খাতায় ‘বিপজ্জনক’ মার্কা পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালি আর কোনও কবিকে একটা কবিতার নামে ডাকেনি। নজরুলকে ডাকল। রেওয়াজি আবৃত্তিকার কিংবা বাংলা সিনেমার ফুটো মাস্তান প্রমোদ প্রধানের চোখে আজও ওই ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো’-এর প্রথম পরিচয়- ‘বিদ্রোহী কবি’। কবি আর কবিতা একাকার। আজও বাংলা ভাষার চিরকালীন বেস্টসেলার ‘সঞ্চিতা’র পাতা ওল্টালে সবার আগে সেই কবিতাতেই চোখ আটকায়। কোথাও না কোথাও থেকে কানে ভেসে আসে কাজী সব্যসাচীর দরাজ গলায় ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে রেকর্ড করা সেই কবিতার আবৃত্তি- ‘বল বীর-/ বল উন্নত মম শির!’

পৃথিবীতে যেসব কবিতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় সেগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে বিদ্রোহী প্রথম স্থান পাওয়ার দাবিদার। কবিতাটি মুদ্রিত হওয়ার পর কেউ কেউ অবশ্য এর গতি-প্রকৃতি বুঝতে না পেরে, কিংবা নিজেদের সংকীর্ণতা বা পরশ্রীকাতরতার কারণে কিছু নেতিবাচক সমালোচনা করেছিলেন- যেগুলো অবশ্য হালে পানি পায়নি। বিদ্রোহী তার স্বকীয়তা নিয়ে সগৌরবে সাহিত্যাঙ্গনে বিরাজ করছে এবং তা করতেই থাকবে।

ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন:

‘নজরুল তাঁর অগ্নি-বীণায় একদিন দীপক রাগে গেয়ে উঠেছিলেন:

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন!
আমি স্রষ্টা-সৃজন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদচিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!”

সেই থেকে কবির নাম হয়ে গেল বিদ্রোহী। আজ পর্যন্ত গোলমাল-মস্তিষ্ক লোকে কবিকে নাস্তিক ঈশ্বরদ্রোহী বলে নিন্দা করতে কসুর করে না, যদিও কবি আজ নিন্দা প্রশংসার ঊর্ধ্বে। (সংক্ষেপিত)

back to top