alt

সাময়িকী

শালুক-এর ‘ঐতিহ্যের উৎসমুখে অধুনাবাদী যাত্রা ২০২২’

রিসতিয়াক আহমেদ

: বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩

https://sangbad.net.bd/images/2023/August/17Aug23/news/4-1.jpg

গত ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন “শালুক” আয়োজিত ‘ঐতিহ্যের উৎসমুখে অধুনাবাদী যাত্রা ২০২২’। ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে অর্ধ শতাধিক কবি-লেখকের একটি দল সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কৃত প্রত্ন নিদর্শনভূমি উয়ারী-বটেশ^রের উদ্দেশে যাত্রা করে। ওখানে যোগদান করেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত আরো অর্ধশতাধিত কবি-লেখক ও শালুকের শুভাকাক্সক্ষী। দিনব্যাপী প্রত্ন নিদর্শন অবলোকন, আলোচনা, কবিতাপাঠ, মধ্যাহ্নভোজ, চাচক্র ও আড্ডায় আড্ডায় অতিবাহিত হয় দিনটি।

https://sangbad.net.bd/images/2023/August/17Aug23/news/4-2%20%281%29.jpg

উয়ারী-বটেশ্বরে শালুক আয়োজিত ‘ঐতিহ্যের উৎসমুখে অধুনাবাদী যাত্রা ২০২২’-এ উপস্থিত কবি, লেখক ও শুভাকাক্সক্ষীবৃন্দ

কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কবি জাহিদ হায়দার, কবি আশরাফ আহমেদ, কবি আবদুর রাজ্জাক, কথাশিল্পী নাসরীন জাহান তাঁদের বক্তব্যে এই আয়োজনকে সাধুবাদ জানান। এবং এখানকার প্রত্ন নিদর্শন দেখে তাঁদের ইতিবাচক নানা অনুভূতি ব্যক্ত করেন।

শালুক সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ শুরুতেই উপস্থিত কবি-লেখক-শুভাকাক্সক্ষীদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। এই আয়োজন সম্পর্কে বলেন, শালুক কোনো সংগঠন নয়। আমাদের এই যাত্রা কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নয়। শালুক একটি লিটল ম্যাগাজিন। শালুক একটি আন্দোলন। গত ২৩ বছর ধরে শালুক কেন্দ্রিক এই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন চলছে। আজকের ঐতিহ্যের উৎসমূলে আগমন সেই আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতা। আমরা আর একটি চিন্তা কাঠামো নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছি- যার নাম অধুনাবাদী চিন্তার আন্দোলন। যার ইশতেহারের মধ্যে রয়েছে সর্বশেষ সাম্প্রতিকতমকে গ্রহণ করা। সহজাতকে গ্রহণ করা। উৎসে ফিরে যাওয়া। শেকড়ে ফিরে যাওয়া। নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়া। তারই একটি পদক্ষেপ হিসাবে আমাদের এই যাত্রা। যারা এই আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন তারা আমাদের অনুপ্রেরণা, সাহস। সর্বশেষ সাম্প্রতিকতম খননকৃত আড়াই হাজার বছরেরও পুরোনো এই উয়ারী-বটেশ্বরের সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শনগুলির মধ্য দিয়ে আমরা অবলোকন করে যাবো আমাদের ঐতিহ্যকে, আমাদের সংস্কৃতিকে। তিনি আরও বলেন- এই প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি সংগ্রহের যে কাজটি নিঃস্বার্থভাবে যিনি করে গেছেন সেই হানিফ পাঠানকে এত সহজে সম্মানিত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা জানি তাঁর এই কাজের উত্তরসূরি হিসাবে তিনি রেখে গেছেন তাঁর সন্তান হাবিবুল্লাহ পাঠানকে। আমরা তাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে খুবই আপ্লুত। এবং আমরা তার মুখ থেকেই তার বাবার এবং তার এই সংগ্রহের সম্পর্কে জানতে চাই।

শালুকের সহযোগী সম্পাদক কবি মাহফুজ আল-হোসেন উয়ারী-বটেশ্বরের ইতিহাস ব্যক্ত করেন। তুলনামূলক আলোচনা করেন ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর অন্যান্য সকল সভ্যতার সাথে এই উয়ারী-বটেশ্বরের সভ্যতার। বলেন, এখানে গ্রীক সভ্যতার ভূতত্ত্ববিদ টলেমীর বইয়ে যে ‘সৌনাগড়া’ অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায় তা মূলত এই উয়ারী-বটেশ্বরই। বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শনের সাথে এর যোগসূত্র আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, শালুকের অধুনাবাদী আন্দোলনের প্রধান বক্তব্যই হচ্ছে শেকড়ে ফিরে যাওয়া। আজ আমরা শালুকের মতো লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই শেকড়ের অন্বেষণে এসেছি। উয়ারী-বটেশ^র সভ্যতার একটি পাদপীঠ। এখানে একটি প্রত্ন নিদর্শনের নির্মীয়মান জাদুঘর রয়েছে। এবং অসংখ্য প্রাচীন মুদ্রাসহ প্রত্নস্মারক রয়েছে। অধুনাবাদ আমাদেরকে এমনতর শেকড়ের কাছে টেনে আনতে অনুপ্রাণিত করে। শালুকের এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

এ সময় আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রাহক জনাব হাবিবুল্লাহ পাঠান। উপস্থিত শ্রোতারা তাঁকে করতালির মাধ্যমে সম্ভাষণ জানান। হাবিবুল্লাহ পাঠান শালুক আয়োজিত এই ‘ঐতিহ্যের উৎসমুখে অধুনাবাদী যাত্রা ২০২২’কে আন্তরিক অভিবাদন জানান। বলেন ইতিপূর্বে এখানে এতো সুধীজনের আগমন ঘটেনি। তাঁর বাবা ১৯৩৫ সাল থেকে এখানকার বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় জনাব হাবিবুল্লাহ পাঠান এই বিষয়ে আগ্রহী হন। পড়াশোনা করেন। এবং ১৯৫৫ সাল থেকে সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। তিনি জানান এখানে ৩২/২২ বর্গফুট আকারের এবং ১২ ফুট গভীর একটি পুকুরের হদিস পাওয়া যায়। যেখানের কয়লা পরীক্ষা করে বলা হয় এটি প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো একটি প্রতœতত্ত্ব স্থল। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুলতানি আমলের আগে এখানে কোনো ইট বা টেরাকোটার সন্ধান পাওয়া যায় না। এবং বাংলা মূলত পলিতে জমা হওয়া একটি জনগোষ্ঠী মাত্র। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুল। কারণ উয়ারী-বটেশ্বর একটি সম্পূর্ণ সৌন্দর্যম-িত নগর সভ্যতা ছিল। রাস্তা ছিল। তিনি জানান, ত্রিকোণাকৃতির আড়াই কেজি ওজনের প্রায় ১২ হাজার কুড়াল পাওয়া যায়- যা নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তির, কোনো পরিবারের বা কোনো গোষ্ঠীর হতে পারে না। অবশ্যই রাষ্ট্রীয়। অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেই সুগঠিত একটি রাষ্ট্র এখানে উপস্থিত ছিল। তিনি দৈনিক একাধিকবার এই উয়ারী-বটেশ্বরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন। তার পারিবারিক একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রশালা রয়েছে। তার স্বপ্ন ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু তিনি জীবনের এই প্রারম্ভিকে এসে হতাশাগ্রস্ত। যে জমিটি তিনি জাদুঘরের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই জাদুঘরও এখনো অসম্পূর্ণ। সরকারের উচিত ছিল তার এই ব্যক্তিগত সংগ্রশালাকে কাস্টেরিতে রাখা। তিনি বলেন, তার এই ব্যক্তিগত সংগ্রশালা নষ্ট হয়ে গেলে ব্যক্তিগতভাবে তার কোনো ক্ষতিই হবে না। কিন্তু বাঙালি জাতি তার একটি সমৃদ্ধিপূর্ণ ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হবে। যা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, এই যে আমাদের পাগলা কানাই, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন- এঁরা এই সভ্যতারই ফল। আমেরিকার সভ্যতা যেখানে চারশ’ বছরের সেখানে বাঙালির সভ্যতা আড়াই হাজার বছরের চেয়েও পুরোনো।

https://sangbad.net.bd/images/2023/August/17Aug23/news/4-3.jpg

বক্তব্য রাখছেন উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নসংগ্রাহক হাবিবুল্লাহ পাঠান

এ সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শালুক-এর অপর দুই সহযোগী সম্পাদক কবি ভাগ্যধন বড়–য়া ও কবি মনিরুজ্জামান মিন্টু। উপস্থিত ছিলেন লিরিক সম্পাদক এজাজ ইউসুফী, কবি ও চিকিৎসক জিললুর রহমান, মার্কিন প্রবাসী লেখক ও অগ্রবীজ সম্পাদক চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ, প্রাবন্ধিক ও গবেষক সরকার আবদুল মান্নান, কবি শাহেদ কায়েস, মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, হাইকেল হাশমী, চয়ন শায়েরী, জাফর সাদেক, বিপাশা মন্ডল, আহমেদ শিপলু, বীথি রহমান, অরবিন্দু চক্রবর্তী, স্নিগ্ধা বাউল, আদিত্য নজরুল, স্বপন নাথ, দিলীপ কর, মাহবুব আলম, ফরিদা রানু, মনিরুল মোমেন, মামুস রশিদ, অপার অরণ্য, অভি জাহিদ, শারেফ আহমেদ, পারভীন শাহনাজ, ফারহানা রহমান, কুসুম তাহেরা, মালিহা সাদিক, দুর্জয় খান, মহসীন খন্দকার ছাড়াও আরও অনেক বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক। যারা সদা উপস্থিত থেকে শালুকের এই আন্দলোনকে ত্বরান্বিত করেন।

অনুষ্ঠানে একটি আঞ্চলিক ভাষার ছড়া শুনিয়ে আয়োজনকে আরও আনন্দময় করে তোলেন কবি ও ছড়াকার খন্দকার মহসীন। এবং সংগীত পরিবেশন করেন কথাসাহিত্যিক স্বাতী চৌধুরী এবং নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতা থেকে আবৃত্তি করে শোনান সানাউল্লাহ পাঠান ।

শালুকের এই যাত্রা শুরু হয় সকাল সাড়ে আটটায় পুরানা পল্টনের দৈনিক সংবাদ অফিসের সামনে সকলের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। যাত্রাপথেই গাড়িতে ছিল সকলের জন্য সকালের নাস্তার ব্যবস্থা। বিভিন্ন স্থানে বিরতি দিয়ে চলেছে কবি সাহিত্যিকদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন, চা নাস্তা। ঢাকার নাগরিক যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে সবাই যেনো বুক ভরে নির্ভেজাল অক্সিজেন গ্রহণ করেছেন। উয়ারী-বটেশ্বরের প্রবেশই কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে নেমে কবি-সাহিত্যিকগণ নিজেদের ঐতিহ্যকে খুঁজে চলেছেন। দেখেছেন পৃথিবীর বুকে নিজেদের সমৃদ্ধির ইতিহাস। এরপর ভেতরে গিয়ে ছিল আমন্ত্রিতদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা। নাগরিক কনক্রিট থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির কোলে বসে চলছিল খিচুড়ির ভেতর দিয়ে চড়ুইভাতির আমেজ। আর শেষে দই মিষ্টি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজের সমাপ্তি। তারপর চলে আলোচনা। নিজেদের জানা, বোঝা এবং নিজেদের কর্তব্য স্থির করা। এরপর সকলে পাশেই হানিফ পাঠান এবং হাবিবুল্লাহ পাঠানের অক্লান্ত পরিশ্রমের সেই ব্যক্তিগত সংগ্রশালা পরিদর্শনে যাত্রা করেন।

https://sangbad.net.bd/images/2023/August/17Aug23/news/4-4.jpg

হাবিবুল্লাহ পাঠানকে চারটি সংখ্যা ‘শালুক’ উপহার দিচ্ছেন ‘শালুক’-এর সম্পাদক ও সহযোগী সম্পাদক

এই সময় শালুকের সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ এবং সহযোগী সম্পাদক কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক মাহফুজ আল-হোসেন হাবিবুল্লাহ পাঠানের হাতে শালুকের সর্বশেষ চারটি সংখ্যা তুলে দেন। কবি-সাহিত্যিক দেখেন হাবিবুল্লাহ পাঠানের সেই সংগ্রশালায় সংগৃহীত আড়াই হাজার বছরের সেই পুরোনো নিদর্শনগুলি, যা এক সময় জীবন্ত ছিল। ছিল দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ। সব শেষে সবাই উয়ারী-বটেশ্বরের উন্মুক্ত জাদুঘরে প্রবেশ করে। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় ৪১টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ছিল। সবকটি স্থানে পরিদর্শন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সূর্য অস্ত গেছে বহুক্ষণ আগেই। দিনে শেষে নীড়ে ফিরতে হবেই। সারাদিনের উচ্ছ্বাস আর একটা অর্জন শেষে সকলের বাড়ি ফেরা। সেই অর্জন নিজেকে চেনার, নিজেকে জানার। পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি।

গত ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে শালুক আয়োজিত এই সাহিত্যআড্ডা শাহবাগের পাঠকসমাবেশ কেন্দ্রে সাধারণত প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার হয়ে আসছে। মাঝে করোনাকালীন মহামারী সময়ে এটি সাময়িকভাবে বন্ধ থাকলেও ২০২২ থেকে আবার আয়োজনটি শুরু হয়। পাঠকসমাবেশ ছাড়াও ঢাকার কাছাকাছি জিন্দাপার্কের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর স্থানেও শালুকের এই আড্ডা অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, কবিতাপাঠ, চা চক্রের ভেতর দিয়ে চলে শালুকের প্রতিটি আয়োজন।

ছবি

দূরের তারাটিকে

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

ছবি

যেদিন সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন

ছবি

ফিরবে না তা জানি

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

শালুক-এর ‘ঐতিহ্যের উৎসমুখে অধুনাবাদী যাত্রা ২০২২’

রিসতিয়াক আহমেদ

বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩

https://sangbad.net.bd/images/2023/August/17Aug23/news/4-1.jpg

গত ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন “শালুক” আয়োজিত ‘ঐতিহ্যের উৎসমুখে অধুনাবাদী যাত্রা ২০২২’। ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে অর্ধ শতাধিক কবি-লেখকের একটি দল সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কৃত প্রত্ন নিদর্শনভূমি উয়ারী-বটেশ^রের উদ্দেশে যাত্রা করে। ওখানে যোগদান করেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত আরো অর্ধশতাধিত কবি-লেখক ও শালুকের শুভাকাক্সক্ষী। দিনব্যাপী প্রত্ন নিদর্শন অবলোকন, আলোচনা, কবিতাপাঠ, মধ্যাহ্নভোজ, চাচক্র ও আড্ডায় আড্ডায় অতিবাহিত হয় দিনটি।

https://sangbad.net.bd/images/2023/August/17Aug23/news/4-2%20%281%29.jpg

উয়ারী-বটেশ্বরে শালুক আয়োজিত ‘ঐতিহ্যের উৎসমুখে অধুনাবাদী যাত্রা ২০২২’-এ উপস্থিত কবি, লেখক ও শুভাকাক্সক্ষীবৃন্দ

কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কবি জাহিদ হায়দার, কবি আশরাফ আহমেদ, কবি আবদুর রাজ্জাক, কথাশিল্পী নাসরীন জাহান তাঁদের বক্তব্যে এই আয়োজনকে সাধুবাদ জানান। এবং এখানকার প্রত্ন নিদর্শন দেখে তাঁদের ইতিবাচক নানা অনুভূতি ব্যক্ত করেন।

শালুক সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ শুরুতেই উপস্থিত কবি-লেখক-শুভাকাক্সক্ষীদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। এই আয়োজন সম্পর্কে বলেন, শালুক কোনো সংগঠন নয়। আমাদের এই যাত্রা কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নয়। শালুক একটি লিটল ম্যাগাজিন। শালুক একটি আন্দোলন। গত ২৩ বছর ধরে শালুক কেন্দ্রিক এই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন চলছে। আজকের ঐতিহ্যের উৎসমূলে আগমন সেই আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতা। আমরা আর একটি চিন্তা কাঠামো নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছি- যার নাম অধুনাবাদী চিন্তার আন্দোলন। যার ইশতেহারের মধ্যে রয়েছে সর্বশেষ সাম্প্রতিকতমকে গ্রহণ করা। সহজাতকে গ্রহণ করা। উৎসে ফিরে যাওয়া। শেকড়ে ফিরে যাওয়া। নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়া। তারই একটি পদক্ষেপ হিসাবে আমাদের এই যাত্রা। যারা এই আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন তারা আমাদের অনুপ্রেরণা, সাহস। সর্বশেষ সাম্প্রতিকতম খননকৃত আড়াই হাজার বছরেরও পুরোনো এই উয়ারী-বটেশ্বরের সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শনগুলির মধ্য দিয়ে আমরা অবলোকন করে যাবো আমাদের ঐতিহ্যকে, আমাদের সংস্কৃতিকে। তিনি আরও বলেন- এই প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি সংগ্রহের যে কাজটি নিঃস্বার্থভাবে যিনি করে গেছেন সেই হানিফ পাঠানকে এত সহজে সম্মানিত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা জানি তাঁর এই কাজের উত্তরসূরি হিসাবে তিনি রেখে গেছেন তাঁর সন্তান হাবিবুল্লাহ পাঠানকে। আমরা তাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে খুবই আপ্লুত। এবং আমরা তার মুখ থেকেই তার বাবার এবং তার এই সংগ্রহের সম্পর্কে জানতে চাই।

শালুকের সহযোগী সম্পাদক কবি মাহফুজ আল-হোসেন উয়ারী-বটেশ্বরের ইতিহাস ব্যক্ত করেন। তুলনামূলক আলোচনা করেন ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর অন্যান্য সকল সভ্যতার সাথে এই উয়ারী-বটেশ্বরের সভ্যতার। বলেন, এখানে গ্রীক সভ্যতার ভূতত্ত্ববিদ টলেমীর বইয়ে যে ‘সৌনাগড়া’ অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায় তা মূলত এই উয়ারী-বটেশ্বরই। বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শনের সাথে এর যোগসূত্র আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, শালুকের অধুনাবাদী আন্দোলনের প্রধান বক্তব্যই হচ্ছে শেকড়ে ফিরে যাওয়া। আজ আমরা শালুকের মতো লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই শেকড়ের অন্বেষণে এসেছি। উয়ারী-বটেশ^র সভ্যতার একটি পাদপীঠ। এখানে একটি প্রত্ন নিদর্শনের নির্মীয়মান জাদুঘর রয়েছে। এবং অসংখ্য প্রাচীন মুদ্রাসহ প্রত্নস্মারক রয়েছে। অধুনাবাদ আমাদেরকে এমনতর শেকড়ের কাছে টেনে আনতে অনুপ্রাণিত করে। শালুকের এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

এ সময় আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রাহক জনাব হাবিবুল্লাহ পাঠান। উপস্থিত শ্রোতারা তাঁকে করতালির মাধ্যমে সম্ভাষণ জানান। হাবিবুল্লাহ পাঠান শালুক আয়োজিত এই ‘ঐতিহ্যের উৎসমুখে অধুনাবাদী যাত্রা ২০২২’কে আন্তরিক অভিবাদন জানান। বলেন ইতিপূর্বে এখানে এতো সুধীজনের আগমন ঘটেনি। তাঁর বাবা ১৯৩৫ সাল থেকে এখানকার বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় জনাব হাবিবুল্লাহ পাঠান এই বিষয়ে আগ্রহী হন। পড়াশোনা করেন। এবং ১৯৫৫ সাল থেকে সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। তিনি জানান এখানে ৩২/২২ বর্গফুট আকারের এবং ১২ ফুট গভীর একটি পুকুরের হদিস পাওয়া যায়। যেখানের কয়লা পরীক্ষা করে বলা হয় এটি প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো একটি প্রতœতত্ত্ব স্থল। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুলতানি আমলের আগে এখানে কোনো ইট বা টেরাকোটার সন্ধান পাওয়া যায় না। এবং বাংলা মূলত পলিতে জমা হওয়া একটি জনগোষ্ঠী মাত্র। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুল। কারণ উয়ারী-বটেশ্বর একটি সম্পূর্ণ সৌন্দর্যম-িত নগর সভ্যতা ছিল। রাস্তা ছিল। তিনি জানান, ত্রিকোণাকৃতির আড়াই কেজি ওজনের প্রায় ১২ হাজার কুড়াল পাওয়া যায়- যা নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তির, কোনো পরিবারের বা কোনো গোষ্ঠীর হতে পারে না। অবশ্যই রাষ্ট্রীয়। অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেই সুগঠিত একটি রাষ্ট্র এখানে উপস্থিত ছিল। তিনি দৈনিক একাধিকবার এই উয়ারী-বটেশ্বরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন। তার পারিবারিক একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রশালা রয়েছে। তার স্বপ্ন ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু তিনি জীবনের এই প্রারম্ভিকে এসে হতাশাগ্রস্ত। যে জমিটি তিনি জাদুঘরের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই জাদুঘরও এখনো অসম্পূর্ণ। সরকারের উচিত ছিল তার এই ব্যক্তিগত সংগ্রশালাকে কাস্টেরিতে রাখা। তিনি বলেন, তার এই ব্যক্তিগত সংগ্রশালা নষ্ট হয়ে গেলে ব্যক্তিগতভাবে তার কোনো ক্ষতিই হবে না। কিন্তু বাঙালি জাতি তার একটি সমৃদ্ধিপূর্ণ ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হবে। যা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, এই যে আমাদের পাগলা কানাই, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন- এঁরা এই সভ্যতারই ফল। আমেরিকার সভ্যতা যেখানে চারশ’ বছরের সেখানে বাঙালির সভ্যতা আড়াই হাজার বছরের চেয়েও পুরোনো।

https://sangbad.net.bd/images/2023/August/17Aug23/news/4-3.jpg

বক্তব্য রাখছেন উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নসংগ্রাহক হাবিবুল্লাহ পাঠান

এ সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শালুক-এর অপর দুই সহযোগী সম্পাদক কবি ভাগ্যধন বড়–য়া ও কবি মনিরুজ্জামান মিন্টু। উপস্থিত ছিলেন লিরিক সম্পাদক এজাজ ইউসুফী, কবি ও চিকিৎসক জিললুর রহমান, মার্কিন প্রবাসী লেখক ও অগ্রবীজ সম্পাদক চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ, প্রাবন্ধিক ও গবেষক সরকার আবদুল মান্নান, কবি শাহেদ কায়েস, মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, হাইকেল হাশমী, চয়ন শায়েরী, জাফর সাদেক, বিপাশা মন্ডল, আহমেদ শিপলু, বীথি রহমান, অরবিন্দু চক্রবর্তী, স্নিগ্ধা বাউল, আদিত্য নজরুল, স্বপন নাথ, দিলীপ কর, মাহবুব আলম, ফরিদা রানু, মনিরুল মোমেন, মামুস রশিদ, অপার অরণ্য, অভি জাহিদ, শারেফ আহমেদ, পারভীন শাহনাজ, ফারহানা রহমান, কুসুম তাহেরা, মালিহা সাদিক, দুর্জয় খান, মহসীন খন্দকার ছাড়াও আরও অনেক বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক। যারা সদা উপস্থিত থেকে শালুকের এই আন্দলোনকে ত্বরান্বিত করেন।

অনুষ্ঠানে একটি আঞ্চলিক ভাষার ছড়া শুনিয়ে আয়োজনকে আরও আনন্দময় করে তোলেন কবি ও ছড়াকার খন্দকার মহসীন। এবং সংগীত পরিবেশন করেন কথাসাহিত্যিক স্বাতী চৌধুরী এবং নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতা থেকে আবৃত্তি করে শোনান সানাউল্লাহ পাঠান ।

শালুকের এই যাত্রা শুরু হয় সকাল সাড়ে আটটায় পুরানা পল্টনের দৈনিক সংবাদ অফিসের সামনে সকলের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। যাত্রাপথেই গাড়িতে ছিল সকলের জন্য সকালের নাস্তার ব্যবস্থা। বিভিন্ন স্থানে বিরতি দিয়ে চলেছে কবি সাহিত্যিকদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন, চা নাস্তা। ঢাকার নাগরিক যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে সবাই যেনো বুক ভরে নির্ভেজাল অক্সিজেন গ্রহণ করেছেন। উয়ারী-বটেশ্বরের প্রবেশই কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে নেমে কবি-সাহিত্যিকগণ নিজেদের ঐতিহ্যকে খুঁজে চলেছেন। দেখেছেন পৃথিবীর বুকে নিজেদের সমৃদ্ধির ইতিহাস। এরপর ভেতরে গিয়ে ছিল আমন্ত্রিতদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা। নাগরিক কনক্রিট থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির কোলে বসে চলছিল খিচুড়ির ভেতর দিয়ে চড়ুইভাতির আমেজ। আর শেষে দই মিষ্টি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজের সমাপ্তি। তারপর চলে আলোচনা। নিজেদের জানা, বোঝা এবং নিজেদের কর্তব্য স্থির করা। এরপর সকলে পাশেই হানিফ পাঠান এবং হাবিবুল্লাহ পাঠানের অক্লান্ত পরিশ্রমের সেই ব্যক্তিগত সংগ্রশালা পরিদর্শনে যাত্রা করেন।

https://sangbad.net.bd/images/2023/August/17Aug23/news/4-4.jpg

হাবিবুল্লাহ পাঠানকে চারটি সংখ্যা ‘শালুক’ উপহার দিচ্ছেন ‘শালুক’-এর সম্পাদক ও সহযোগী সম্পাদক

এই সময় শালুকের সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ এবং সহযোগী সম্পাদক কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক মাহফুজ আল-হোসেন হাবিবুল্লাহ পাঠানের হাতে শালুকের সর্বশেষ চারটি সংখ্যা তুলে দেন। কবি-সাহিত্যিক দেখেন হাবিবুল্লাহ পাঠানের সেই সংগ্রশালায় সংগৃহীত আড়াই হাজার বছরের সেই পুরোনো নিদর্শনগুলি, যা এক সময় জীবন্ত ছিল। ছিল দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ। সব শেষে সবাই উয়ারী-বটেশ্বরের উন্মুক্ত জাদুঘরে প্রবেশ করে। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় ৪১টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ছিল। সবকটি স্থানে পরিদর্শন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সূর্য অস্ত গেছে বহুক্ষণ আগেই। দিনে শেষে নীড়ে ফিরতে হবেই। সারাদিনের উচ্ছ্বাস আর একটা অর্জন শেষে সকলের বাড়ি ফেরা। সেই অর্জন নিজেকে চেনার, নিজেকে জানার। পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি।

গত ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে শালুক আয়োজিত এই সাহিত্যআড্ডা শাহবাগের পাঠকসমাবেশ কেন্দ্রে সাধারণত প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার হয়ে আসছে। মাঝে করোনাকালীন মহামারী সময়ে এটি সাময়িকভাবে বন্ধ থাকলেও ২০২২ থেকে আবার আয়োজনটি শুরু হয়। পাঠকসমাবেশ ছাড়াও ঢাকার কাছাকাছি জিন্দাপার্কের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর স্থানেও শালুকের এই আড্ডা অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, কবিতাপাঠ, চা চক্রের ভেতর দিয়ে চলে শালুকের প্রতিটি আয়োজন।

back to top